কোনো কোনো কথাসাহিত্যিক প্রথম বইতেই পাঠককে রীতিমতো সচকিত করে দেন। মনে হয় এতদিন ইনি কোথায় ছিলেন? সন্মাত্রানন্দের প্রথম উপন্যাস ‘নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা’ পড়ে আমার এমনটাই মনে হয়েছিল। চমকে গিয়েছিলাম প্রস্তাবনা পড়েই, সেখানে লেখক জানিয়েছিল, ‘এ উপন্যাসের বিষয় চিরন্তনী নারীসত্তা, যা আমাদের সমষ্টি অবচেতনের ভিতর সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকে মজ্জিত হয়ে আছে। যে-নারীসত্তা যুগে যুগে মানুষকে জয় করার, অগ্রসর হওয়ার, উৎসর্গ করার, পরিত্যাগ করার প্রেরণা জুগিয়েছে, অথচ যে নারীসত্তা অন্তহীন কাল ব্যেপে প্রেমে, দাম্পত্যে, বাৎসল্যে জীবনকে লালন করেছে, আস্বাদ করেছে; জন্মজন্মান্তর ধরে পৃথিবীর ধুলাপথে ফিরে ফিরে এসেছে — সেই শাশ্বত মানবীসত্তাই ‘নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা’ উপন্যাসের বিষয়বস্তু। এই চিরন্তনী নারীসত্তাকেই উৎসর্গ করা হয়েছে উপন্যাসটি।
‘আবার নতুন করে শুরু করি যদিএই ধরনের গভীর উৎসর্গ প্রথমেই পাঠককে মানবজীবনের দেহগণ্ডি ছাড়িয়ে প্রকৃতিজীবনের বিশাল বিস্তারের ইঙ্গিত দেয়। সময় সম্বন্ধেও আমরা অভিনব কোনো অভিজ্ঞতার সামনে যাবো আন্দাজ পাই কারণ কথনকৌশল কোন পথে চলবে তার আভাস দিতে গিয়ে লেখক জানান, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের ধারাবাহিক ক্রম তিনি স্বীকার করেন না। ‘লেখকের দৃষ্টিতে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ বস্তুত একই সমতলে অঙ্কিত পরস্পরচ্ছেদী তিন বৃত্তের মতন। শুধু তাই-ই নয়, ওই তিনটি বৃত্তের ছেদবিন্দুগুলির মধ্য দিয়ে কোনো কোনো বিশেষ মুহূর্তে এক যুগের চরিত্রগুলির সঙ্গে অন্য যুগের চরিত্রদের দেখা হয়ে যেতে পারে, তাদের বিনিময়ও ঘটতে পারে।’
আমি হব কাশফুল, তুমি — মনুনদী।’
পাঠক বুঝতে পারে লেখক তাকে মৃদুভাষণে প্রস্তুত করে নিচ্ছেন রহস্যময় কোনো জগতে প্রবেশতোরণের সামনে। সেই জগত ‘অতীশ দীপংকরের পৃথিবী’ হয়েও দশম-একাদশ শতক থেকে ঝুঁকে ছায়া প্রসারিত করে দেয় ত্রয়োদশ শতক এবং একবিংশ শতকে। সময় নিয়ে এই ধরণের সুদূরবিসর্পী চেতনা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং জীবনানন্দ দাশের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। অনুভবের গাঢ়তায় এবং কথনের নিপুণ প্রকৌশলে সময়ের বিভিন্ন তলগুলি কোনো অলৌকিক রত্নমঞ্জুষার মতো উন্মোচিত হতে থাকে।
বাংলাদেশের বিক্রমপুরে বজ্রযোগিনী গ্রামে একটি প্রাচীন মাটির ঢিপিকে স্থানীয় মানুষ বলে ‘নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা’। সহস্রাব্দ পার করেও সজীব রয়েছে রাজকুমার চন্দ্রগর্ভ, পরবর্তী জীবনে অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞানের জীবন ঘিরে গড়ে ওঠা কিংবদন্তী। বাস্তবের এই সূত্রটুকু নিয়ে উপন্যাসে শুরু হয় এক মহৎ মানুষের পদচিহ্ন অনুসরণের অন্বীক্ষা। কালের বালুকাতটে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে আসা সেই পদচিহ্নের ওপর ঝাঁপ দিয়ে পড়েছে পরবর্তী কাল — তবু তা মোছেনি, কারণ চৈতন্যের স্বর্ণসূত্র দিয়ে কালকালান্তরকে মুক্তামালার মতো গ্রথিত করেছেন সন্মাত্রানন্দ। বিক্রমপুরের কৃষক অনঙ্গ আর তার মা-মরা মেয়ে জাহ্নবীর আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ জীবন দিয়ে আখ্যান শুরু হয়। অনঙ্গ আর আইনদ্দি মাঠে কাজ করতে গিয়ে পূর্বোক্ত ঢিপির কাছে একটি বহুপ্রাচীন কাঠের বাক্স পেয়েছে। চন্দনকাঠের কারুকাজ করা সেই বাক্সে ছিল এক তাড়া তালপাতার পুঁথি, একটি জপমালা আর অজানা কোনো দেবতার ধাতুমূর্তি। এই তারাদেবীর মূর্তিটিকে ঘিরে উপন্যাসে শুরু হয় কালান্তরের সন্ধান। বৌদ্ধযুগের অবক্ষয়িত পরিসরে অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞানের প্রজ্ঞাময় অসমসাহসী জীবনের যাত্রাপথে দশম একাদশ শতকের ভারত, তিব্বত ও সুবর্ণভূমির দৃশ্যমালা অসাধারণ কল্পনা ও গবেষণার মিলিত শক্তিতে রচে তোলেন লেখক। সময়ের মায়াকুহেলির টানে ত্রয়োদশ শতাব্দীর চাগ্ লোচাবার অভিযাত্রীজীবন আর একবিংশ শতাব্দীর গবেষক অমিতায়ুধ প্রবেশ করে আখ্যানে। রাজকুমার চন্দ্রগর্ভ আর রাজপ্রাসাদের দৌবারিক কন্যা কুন্তলার মাধুর্যময় সখ্যকে নিন্দা ও কটাক্ষে বিদ্ধ করেছিল পরিবার ও সমাজের বিভেদসন্ধানী মন। এই পর্যায়ে বজ্রযানতন্ত্রের ভৈরবভৈরবীচক্রের আশ্চর্য সংযমী বর্ণনা পাচ্ছি। চর্যাপদের যুগের বাংলাকে যেন কুয়াশার ঝাপসা পর্দার আড়ালে দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের অজস্র ভগ্ন চূর্ণিত বৌদ্ধবিহার যেন পূর্ব গরিমায় জেগে ওঠে, প্রাণ পায় বাঙালির বৌদ্ধ অতীত। চন্দ্রগর্ভের দয়িতা হওয়ার সাধ পূর্ণ হয়নি কুন্তলার। শেষ পর্যন্ত সে অতলস্পর্শী খাদে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহনন করে। কিন্তু প্রতিশ্রুতি বাজতে থাকে চরাচরে, ‘অন্যত্র কোথাও আবার দেখা হবে।’
সংস্কৃত ভাষার ওপর গভীর অধিকার রয়েছে সন্মাত্রানন্দের। তাই প্রয়োজনমতো বাংলাভাষায় তিনি সংস্কৃতের মন্দ্রতা ও সান্দ্রতা সঞ্চারিত করতে পারেন। কখনো রচনা করেন সম্পূর্ণ সংস্কৃত শ্লোক। কিন্তু মুগ্ধ করে দেয় ‘বনস্পতিষু যদা বহতি বিপুল প্রবাতঃ’ শ্লোকের অপূর্ব কাব্যানুবাদ, মান্যচলিত এবং বঙ্গালী উপভাষায়, ঔপন্যাসিকের হাতে কবির কলম উঠে এসেছে।
‘যখন বৃক্ষরাজির ভিতর দিয়ে বহে যাবে সমুষ্ণ বাতাসদীপংকরের রচিত বলে কথিত তাঁর জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এই শ্লোক হাজার বছর পার করে তাঁর মাতৃভূমি বজ্রযোগিনীর এক গ্রাম্য তরুণী জাহ্নবীর চুল বাঁধার গানে লোকায়ত আর্তি পেয়েছে।
নদীর উপর ছায়া ফেলবে গোধূলিকালীন মেঘ
পুষ্পরেণু ভেসে আসবে বাতাসে
আর পালতোলা নৌকা ভেসে যাবে বিক্ষিপ্ত স্রোতোধারায়…
সহসা অবলুপ্ত দৃষ্টি ফিরে পেয়ে তুমি দেখবে—
আমার কেশপাশে বিজড়িত রয়েছে অস্থিনির্মিত মালা :
তখন… কেবল তখনই আমি তোমার কাছে আসব…’
‘গাছগাছালির ভিতর দিয়া বইয়া যে যায় বায়।সম্ভবত ত্রিপুরায় প্রধান শিক্ষক রূপে একটি বৃহৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনাসূত্রে লেখক বাঙালি উপভাষা এমন নিখুঁত ভাবে আয়ত্ত করেছেন।
ম্যাঘনা নদীর বুকের উপর অস্তম্যাঘের ছায়।।
ফুলের পরাগ উইরা পরে সাঁঝেরো হাওয়ায়।
ঢেউয়ের তালে মাতাল অইয়া নাপ যে ভেসে যায়।।
আঁধার দিশা অলোক অইলে নয়নতারায়।
দ্যাহ হাড়ের মালা আমি পরছি গো খোঁপায়।।
এমুন যহন অইব তহন শুন হে শ্যামরায়।
ফির্যা পাইব তুমার বুকে তুমারো রাধায়।।
তিনটি টাইমলাইন রয়েছে ‘নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা’তে, মাঝে মাঝেই এই তিনটি কালরেখা একে অন্যকে স্পর্শ করে কুহকবাস্তবের মায়া সৃষ্টি করেছে। কুন্তলা, বজ্রডাকিনী স্বয়ংবিদা এবং জাহ্নবী চিরন্তনী নারীসত্তারই উৎসজাত ত্রিবিধ রূপ। কখনো কন্যা, কখনো মাতা, কখনো জায়া, কখনো প্রণয়িনীরূপে বিচিত্র ভাব অনুভব করার জন্য পৃথিবীতে ফিরে ফিরে আসে জাতিস্মররূপে, জন্মের পর জন্ম চলে পূর্ণতার অভিসার, বিরহবেদনার গাথা। অপার্থিব প্রেম অন্বিষ্ট হলেও এই উপন্যাসে বৌদ্ধদর্শনের গভীর ও ব্যাপ্ত প্রস্থানভূমি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। দার্শনিকপরিভাষাকে এমনভাবে অবলীলায় ব্যবহার করতে বাংলা উপন্যাসে আমরা বেশি দেখিনি। ‘অবিদ্যা, সংস্কার, বিজ্ঞান, নামরূপ, ষড়ায়তন, স্পর্শ, বেদনা, তৃষ্ণা, উপাদান, ভব, জাতি, দুঃখ—এই দ্বাদশ নিদান। একটি থাকলেই আরেকটি থাকবে। একটি চলে গেলেই, অপরটি নির্বাপিত হয়ে যাবে।
কত সরল, অথচ কী অমোঘ শৃঙ্খলা!‘সংস্কার’ উপস্থিত হ’লেই চিত্তের ভিতর অহংরূপ দীপশিখাকে অবলম্বনকরতঃ ‘জানবার সাধ’ হয়। এই-ই ‘বিজ্ঞান’। সেই জানবার সাধ হ’লে বারবার মাতৃগর্ভে ভ্রূণরূপে জাত হ’তে হয়। তাকেই ‘নামরূপ’ বলা হয়।
এই কার্য-কারণ-শৃঙ্খলা না জানার নামই ‘অবিদ্যা’।
অবিদ্যা থেকেই পাপ, পুণ্য, বৈরাগ্যের ‘সংস্কার’।
গর্ভস্থ ভ্রূণ পরিণত হ’লে পঞ্চ ইন্দ্রিয় ও মন — এই ‘ষড়ায়তন’ গঠিত হয়।
তারপর বাহ্যবস্তুর সঙ্গে পঞ্চ ইন্দ্রিয় ও মনের অবধারিতভাবে ‘সংস্পর্শ’ হয়। স্পর্শে স্পর্শে মুখবেদন, শোকবেদন, অনুবেদন। এইভাবে একবার বিষয় আস্বাদ করলেই ‘তৃষ্ণা’ জন্মায়, আবার পেতে ইচ্ছা হয়। কাম্যবস্তু, দৃশ্যবস্তু, কিংবা শীল বা নির্মাণলাভের উদগ্র ইচ্ছা।
আবার আসব, আবার পৃথিবীতে ফিরে আসব — এই ‘ভব’ বোধ তাড়িত করে জীবনকে। অন্তিমে মৃত্যু এসে দেখা দেয় একদিন। অমোঘ অতর্কিত মৃত্যু।
আবার জন্ম বা ‘জাতি’ হয়, আবার জরা-মরণ-শোক-পরিবেদনা, আবার দুঃখ-দৌর্মনস্য হাহুতাস। চক্রাকারে আঘূর্ণিত, চক্রাকারে আবির্ভূত!
কিন্তু এ চক্রনেমির নাভি কোথায়? নাভিকে স্থির ক’রে দিলে অরাসমূহ স্তম্ভিত হয় — এ ভবচক্রের নাভি তৃষ্ণা, সেই তৃষ্ণা নির্বাপিত হলে এ চক্রগতি নিরুদ্ধ হয়। অন্য উপায় নাই। চক্রাকারে নিবর্তিত, চক্রাকারে নির্বাপিত!
আচ্ছা, সব তৃষ্ণা জয় করবার পর নির্বাণের তৃষ্ণাও পরিত্যাগ করতে হবে? হাঁ, নির্বাণের তৃষ্ণাও পরিত্যাগ করা প্রয়োজন। নির্বাণতৃষ্ণা স্থগিত হ’লে তবেই নির্বাণ।’
বাণী বসুর অসামান্য উপন্যাস ‘মৈত্রেয় জাতক’-এর পর আবার আমরা বাংলা উপন্যাসে বৌদ্ধদর্শনের সূক্ষ্ম আলোচনা পেলাম। তন্ত্রের গূঢ়ার্থ প্রকাশ করা ঔপন্যাসিকের পক্ষে হয়তো দুরূহতম ছিল। সহজাত কবিত্বশক্তির সাহায্যে সেই সুকঠিন, রহস্যময়, কখনো নন্দিত, কখনো নিন্দিত কিন্তু সর্বদাই গোপন সাধনার সারাৎসারকে তিনি প্রকাশ করেছেন। সম্পূর্ণ কবিতাটি উদ্ধৃত হল।
‘বালিকার ন্যায় এক ভৈরবীর নাভি হ’তে আদিতম ধ্বনিএই কবিতার বাক্প্রতিমাগুলি দুঃসাহসিক। উপন্যাসে এই অষ্টাদশ পঙ্ক্তিসমন্বিত পদটির রচয়িতা ভিক্ষু মৈত্রী। শুনে মুগ্ধ হলেও দীপংকর অনুভব করেন কবিতাটির বিষয়বস্তু শ্রমণোচিত নয়, এটি সিদ্ধ তান্ত্রিকের অনুভূতিপ্রজ। সুরাপান এবং প্রকৃতিসঙ্গের জন্য ভিক্ষু মৈত্রীকে বিক্রমশীল মহাবিহার থেকে বহিষ্কার করেছিলেন দীপংকর। যদিও অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন তবু তাঁকে কর্তব্যে কঠিন থাকতে হয়েছে। আসলে দীপংকরের জীবনকথার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের এক বিরাট ট্রাজেডির দিকে লেখক আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পান, ভোজন অপরিমিত ইন্দ্রিয়পরিতৃপ্তির আয়োজনে ভৈরব ভৈরবী চক্রের প্রভাবে কীভাবে তথাগত প্রচারিত বিশুদ্ধ সদ্ধর্ম পরিম্লান হয়ে গেল। এই সর্বনাশ ঠেকাবার কাজে দীপংকরকে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে দেখি, শুধু ভারতে নয় তিব্বতেও।
উঠে ঢাকে চরাচর সমাবৃত অমনই তখনই,
নিগূঢ় গগনতল পাংশুমেঘে ধূমল গহন
নামে সান্দ্র অন্ধকারে মন্ত্রবীজ প্রবল বর্ষণ।
প্রলয় ঝড়ের নীচে কাঁপে মাটি পৃথুলা পৃথিবী,
মেখলা উত্তাল হল আলোড়িত নির্মোচিত নীবি।
অম্বর বিদীর্ণ ছিন্ন আদিগন্ত বিদ্যুৎ জিহ্বায়
আচম্বিতে প্রকাশিত নদীতীরে মণিকর্ণিকায়।
অঘোরভৈরব তার ক্রোড়োপরি অথির বিজুরি
আশ্লেষে জাগ্রত করে নিয়ে যাবে নীলোৎপলপুরী।
নিবেশিত বজ্র যেন কমলের নিহিত মৃণালে
আসবে উচ্ছ্রিত হল পানপাত্র করোটি কপালে।
ছন্দিত প্রাণের লীলা ধৃতিশীল প্রতি শ্বাসাঘাতে
স্বণিত প্রমত্ত বীর অকম্পিত ঝটিকার রাতে।
জাগে আয়ু, জাগে বল, সুগম্ভীর সমর্থ প্রণয়
বাসনার রক্তবীজ লেলিহান হুতাশনে জয়।
অন্ধকার ঢেকে দেয় গূঢ়গর্ভে সমাচ্ছন্ন পট
নামে মেঘঘনধারা আর্দ্রজটা অতিবৃদ্ধ বট।’
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ’ উপন্যাসে যে অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞানের চরিত্র নির্মাণ করেছেন তা যতটা না শ্রামণ্যবিভামণ্ডিত তার থেকে বেশি কূটকৌশলী। তিনি ভারতের বিবদমান রাজাদের মধ্যে শান্তিস্থাপনের চেষ্টায় সদাব্যস্ত। ম্লেচ্ছ আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য অগ্নিকন্দুক ব্যবহার শিক্ষার জন্যই তাঁর তিব্বতযাত্রা। সন্মাত্রানন্দ খুব সচেতনভাবে সেই ছাঁচটিকে ভেঙে অন্য দীপংকরকে আমাদের সামনে উপস্থিত করেছেন। ‘রাজভিক্ষু’ বিশেষণে যাঁর আত্মগ্লানি উপস্থিত হয়। রাজনৈতিক কৌশলের আশ্রয়ে বিবদমান শাসকদের আনুকূল্য আদায়কে যিনি মনে মনে ধিক্কার দেন। তাঁর তিব্বত যাবার কারণও বৌদ্ধধর্মকে ভোগসর্বস্ব তন্ত্রাচার থেকে উদ্ধার। ‘নির্বিচারে পশুহত্যা’, নরবলি, নারীসম্ভোগ, সুরাপান, ভ্রূণহত্যা প্রভৃতি পৈশাচিক কর্মে সমগ্র তিব্বত’ পঙ্কিলতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল বলেই রাজা এশেওদ দীপংকরকে সানুনয় আহ্বান করেছিলেন।
তিব্বতীয় সমাজে দীপংকর ক্রমে কর্মফলবাদের আচার্যরূপে পূজিত হয়েছেন। তিব্বতী ভিক্ষু বিনয়ধরকে তিনি বলেছেন, একটা দেশের সমগ্র শক্তি যদি কেবল ভিক্ষু উৎপাদন ও ভিক্ষু সেবায় নিঃশেষিত হয় তবে সে দেশের উৎসন্নে যেতে বিলম্ব হয় না। তিনি সমধিক মূল্য দিয়েছেন গৃহস্থ উপাসকদের, যাঁরা ভবসুখের অত্যধিক প্রত্যাশী নন, যাঁরা পাপাচরণ থেকে বিরত, যাঁরা স্বয়ং দুঃখবরণ করে নিখিল জীবের মুক্তির জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেন। দীপংকর ঘোষণা করেছেন, ‘আমি একাধারে মহাযান মতাবলম্বী, সর্বজীবের আত্যন্তিক দুঃখ নিবারণেই আমার সার্থকতা। … আমি নাস্তিক, আমি মাধ্যমিক শূন্যবাদী, নিন্দা বা স্তুতি সকলই আমার নিকট অর্থহীন।’
বিশাল বিক্রমশীল মহাবিহারে ছয়টি সংঘারামে ছয়টি ভিন্ন বিষয়ের অধ্যয়ন অধ্যাপনা চলত, স্থবিরবাদ, মহাযান, তন্ত্রযান, দর্শন, শিল্প ও বিজ্ঞান। ‘নিজ ভাব অক্ষুণ্ণ রেখে পরস্পরের মতবাদের প্রতি শ্রদ্ধা — বিক্রমশীলের আদর্শ।’ এই সুবিপুল বিদ্যায়তনের শীর্ষে ছিলেন দীপংকর। তাঁকেই আবার আমরা দেখি সুবৃহৎ অন্নপাত্র কাঁধে বহন করে এনে দরিদ্র জনমণ্ডলীর মধ্যে খাদ্য বিতরণ করতে। ক্ষুধার্ত এক ভিক্ষুক বালককে কোলে তুলে জননীর স্নেহে তার মুখে অন্নের গ্রাস তুলে দিতে। সব পাণ্ডিত্য, যশোভার দূরে সরিয়ে এই দীপংকর অনায়াসে বলতে পারেন, ‘আজ দ্বিপ্রহরে এক বালিকাকে দর্শন করে, তার অনাবিল স্নেহের স্পর্শ পেয়ে আমি বুঝেছি, আমি কাষ্ঠ, মৃত্তিকা বা ধাতু নই; আমি মানুষ। আমি শুধু স্নেহবুভুক্ষু অপার এক সত্তা। শুধু সকাতর এক মাতৃহৃদয়। যে-মাতৃহৃদয় যুগে যুগে তার কনিষ্ঠা কন্যা ধরিত্রীর সন্তপ্ত বক্ষের উপর আকাশের বারিবিন্দুর মতন ঝ’রে পড়ে…’
‘চাগ্ লোচাবা দীপংকরের মুখপানে তাকালেন। তিনি দেখলেন —রাজপুত্র চন্দ্রগর্ভ নন, পণ্ডিত শ্রীজ্ঞান নন, অভিযাত্রী অতীশ নন, আচার্য জোবোজেও নন —কক্ষের স্তিমিতালোকের ভিতর মহাকরুণার এক ঘনীভূত মূর্তি বাৎসল্যগলিত চিরকরুণ এক মাতৃহৃদয় তাঁর দিকে অপলক নেত্রে চেয়ে আছে।’
বাংলা কথাসাহিত্যে অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞানের এই অপূর্ব ব্যক্তিত্বছবির জন্য যেন সুদীর্ঘ প্রতীক্ষা ছিল। উনিশ শতক থেকে বুদ্ধদেব এবং বৌদ্ধধর্মদর্শন নিয়ে বাঙালির ধারাবাহিক তাত্ত্বিক চর্চা, সাহিত্যসৃষ্টির বেগবান প্রবাহ ‘নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা’-তে একটি প্রার্থিত সমুন্নতিকে ছুঁয়েছে। আখ্যান এখানে সরলরৈখিক নয়, কালের তিনটি পটকে সমান্তরালে রেখে ঔপন্যাসিক কুহক-বাস্তব শৈলীর আশ্রয় নিয়েছেন। তিনটি কালের ভাষারীতিও আলাদা। দশম-একাদশে যখন আখ্যান সঞ্চরমান তখন কথনরীতিতে রয়েছে ধ্বনিঝংকারময় তৎসম গাম্ভীর্য যা ত্রয়োদশ শতকে এসে অনেকখানি সরল, আর একবিংশ শতকে এসে একেবারে আধুনিক। উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে আরেক উপন্যাস। লেখক শাওনের চরিত্রে যেন ঔপন্যাসিকের আত্মপ্রক্ষেপ লক্ষ করি। অতীশ দীপংকরকে নিয়ে একটি উপন্যাস লেখার চেষ্টায় আছে শাওন। গবেষক অমিতায়ুধ তার পরিচিত কারণ এই চরিত্র তার কল্পনাপ্রসূত। ক্ষয়িষ্ণু সময়ে দাঁড়িয়ে এক ত্যাগদহনদীপ্ত করুণাঘন ব্যক্তিত্বের ছবি বিবর্ণ ইতিহাস থেকে তুলে আনতে চায় শাওন।
‘যে করুণার থেকে সৃষ্টির এই আবির্ভাব, যে-করুণার সূত্রে এই সৃষ্টি বিধৃত, যে করুণায় এই সৃষ্টির বিলয়, তার উৎসমূল খুঁজে পাবার জন্যই পৃথিবী তিব্বতীয় জপযন্ত্রের মতো ঘূর্ণিত হয়, সময় আবর্তিত হয়, মানুষ জন্মজন্মান্তরব্যাপী তারই অন্বেষণ করে ফেরে। ‘অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান’ সেই অন্বেষণেরই অন্য নাম।’
২
তাত্ত্বিক গাম্ভীর্য বা তর্কবিতর্কের পরিসর থাকলে উপন্যাস অনেকসময় গুরুভার হয়ে পড়ে। সন্মাত্রানন্দের লেখা উপন্যাস সমূহ সম্বন্ধে সেই দুষ্পাঠ্যতা, দুর্বোধ্যতা বা ভারাতুরতার অভিযোগ তোলা যাবে না। তিনি গল্প বলতে জানেন। প্রয়োজনমতো ঘটনার চমৎকারিত্বের সৃষ্টি করেন, কালের সরণিতে পর্যটনে সঙ্গী করে নেন পাঠককে। তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘ছায়াচরাচর মধুসূদন সরস্বতীর উপাখ্যান-মঞ্জরী’ পুরোপুরি সাধুভাষায় লেখা। ‘নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা’ যেমন ‘পূর্ব পীঠিকা’, ‘দক্ষিণ পীঠিকা’, ‘পশ্চিম পীঠিকা’য় বিন্যস্ত, ‘ছায়াচরাচর’ তেমনি ‘আলাপ’ ও ‘বিস্তার’ এই দুটি সাংগীতিক ব্যঞ্জনাধর্মী পর্যায়ে সজ্জিত। ইতিহাসের ধূসর জগৎই লেখকের প্রিয়, এখানে কালাঙ্ক মধ্যযুগে পাঠান, মোগল আমলে। গ্রন্থসূচনায় ঔপন্যাসিক নদীতটে পারগামী এক সন্ন্যাসীকে কল্পদৃষ্টিতে দেখেছেন। ‘হয় তিনি নৌকায় করিয়া পরপারে যাইবেন, নয়তো ঘাটেই বসিয়া থাকিবেন — ইহাই আমাদের প্রচলিত সাধারণ ধারণা। কিন্তু একদল উচ্চশ্রেণীর পদার্থবিদ দার্শনিকগণ বলিবেন, যেই না আমি চোখ খুলিব, অমনি ওই দুই প্রকার সম্ভাবনার কোনো একটি আমার নিকট সত্য বলিয়া প্রতিভাত হইবে। অন্য সম্ভাবনাটি আমি দেখিতে পাইব না, যদিও সেই অপর সম্ভাবনা অন্য কোনো সমান্তরাল বিশ্ব বা প্যারালাল ইউনিভার্সে ঘটিয়া চলিতে থাকিবে।’
পাঠক অনুমান করতে থাকে মধুসূদন সরস্বতীকে কেন্দ্রে রেখে লেখক অপর সম্ভাবনাগুলির আভাস দেবেন। ক্রমে আমরা দেখব ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব বৈদান্তিক মধুসূদনের (যাঁর পূর্বনাম কমলনয়ন) বিখ্যাত জীবনের সমান্তরালে লেখক পদ্মাক্ষ, রাজীবলোচন, উৎপলদৃষ্টি তিনটি অন্যতর জীবনসম্ভাবনার ছবি এঁকেছেন। বয়সে, আকৃতিতে এই চারজনের গভীর সাদৃশ্য, কিন্তু অভিজ্ঞতা চলেছে স্বতন্ত্র ধারায় এবং প্রধান আখ্যানের সঙ্গে উপআখ্যানগুলি মিলিয়ে, ষোড়শ শতকের ভারতবর্ষের দ্বন্দ্ববিক্ষুব্ধ এবং ভাবৈশ্বর্যময় কালপটটি বিস্তৃত হয়েছে।
উপন্যাস সূচনায় বালক কমলনয়ন পিতার সঙ্গে নৌকাযোগে চন্দ্রদ্বীপে রাজসন্নিধানে চলেছে। পিতা চলেছেন রাজকরস্বরূপ গাছের ফল নিয়ে, কমল চলেছে রাজাকে কবিতা শোনাবে বলে। কোটালিপাড়ার উনসিয়া গ্রামে বহু প্রজন্ম ধরে শাস্ত্রাধ্যয়ন, যজন যাজনে নিবিষ্ট তাদের পরিবার। চন্দ্রদ্বীপের অতিথিশালায় বনমালী জমাতিয়া নামে এক মধুর স্বভাবের বৈষ্ণবের কাছে কমলনয়ন গৌরাঙ্গসুন্দরের কথা প্রথম শোনে। তখনো গৌরাঙ্গ সন্ন্যাসগ্রহণ করেননি। কিশোর কমলনয়ন বনমালীর কাছে গৌরাঙ্গের আচণ্ডালে প্রেম বিতরণের আশ্চর্য কাহিনি শুনে মোহিত হয়েছিল। পাশাপাশি চন্দ্রদ্বীপের রাজার অহমিকাপূর্ণ ব্যবহার তার সংবেদনশীল মনকে গভীরভাবে আহত করেছে। সংসারে একপ্রকার বিতৃষ্ণা উপস্থিত হয়েছে। সে নবদ্বীপে গৌরাঙ্গের আশ্রয় নেবার জন্য যাত্রা করেছে। কিন্তু ভাগ্যলিপি ছিল অন্যভাবে লেখা। ততদিনে নিমাই সন্ন্যাসাগ্রহণ করে গৃহত্যাগ করেছেন, চলে গেছেন শ্রীক্ষেত্রে। কমলনয়ন গঙ্গার ঘাটে সাক্ষাৎ পেল নব্যন্যায়ের বিদগ্ধপণ্ডিত মথুরানাথ তর্কবাগীশের।
নবদ্বীপ নব্যন্যায়ের প্রসিদ্ধ বিদ্যাপীঠ। কিন্তু এই প্রথম কোনো বাংলা উপন্যাসে যথাসম্ভব পাঠক-বোধগম্য করে এই দুরূহ দর্শনের পরিচয় পাওয়া গেল। দর্শনে নিষ্ণাত ঔপন্যাসিক সে যুগের বিখ্যাত নৈয়ায়িকদের জীবনছবির সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞানচর্চার এই ধারাটির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ ঘটিয়ে দিলেন। ভক্তিরসের বদলে শুষ্ক ন্যায়চর্চার মননসর্বস্ব জগতে প্রবেশ করে কমলনয়ন কালক্রমে হলেন বিখ্যাত মধুসূদন সরস্বতী। গল্পের টানেই উপন্যাসে এসেছেন কাণভট্ট, রঘুনাথ, বাসুদেব সার্বভৌম প্রমুখ পণ্ডিত। মিথিলার খ্যাতি ম্লান করে নবদ্বীপের গৌরববৃদ্ধির কাহিনি।
কমলনয়ন, পদ্মাক্ষ, রাজীবলোচন, উৎপলদৃষ্টি —সব ক’টি নামেরই অর্থ এক। আকৃতি প্রকৃতিতেও সাদৃশ্য কম নয় কিন্তু তাদের জীবনরেখা স্বতন্ত্র। পদ্মাক্ষ রাজার প্রিয় সভাকবি হতে পেরেছিল তারপর পাঠনসৈন্য প্রপীড়িত গ্রামে অসহায় এক বালিকাকে উদ্ধার করে তাকে বিবাহ করে। পদ্মাক্ষ ও হৈমবতীর বিবাহ যতটা সহজে সুসম্পন্ন করিয়েছেন লেখক তাতে পাঠক কিঞ্চিৎ বিভ্রান্ত বোধ করে। সে যুগের রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ এতটা ক্ষমাসুন্দর ছিল কি? অন্তত নারীর সামাজিক পারিবারিক সুখ্যাতি যেখানে প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড়াত। কমঠবৃত্তি অবলম্বনের ফলে ম্লেচ্ছসংসর্গ বা তেমন কিছুর সম্ভাবনাতেও বর্জন ছিল অমোঘ। পরেও সপ্তগ্রামে নৌযাত্রাকালে এই দম্পতি, পর্তুগিজ জলদস্যুদের কবলে পড়ে। সে যুগের জনসাধারণের সার্বিক নিরাপত্তার অভাব, প্রবলের অত্যাচার নানাভাবেই উপন্যাসে এসেছে। ট্রাপিজিয়মের দুটি ভুজের মতো মাঝে মাঝে চারজনের স্বতন্ত্র জীবনরেখা চকিতে ঘনিষ্ঠ হয়েছে।
বিস্তার পর্বে মধুসূদন কাশীতে অদ্বৈতবেদান্তের শিক্ষা গ্রহণের জন্য উপস্থিত হয়েছেন। গুরু মথুরানাথই গূঢ় উদ্দেশ্যে তাঁকে পাঠিয়েছেন।
“কাশী যাও। কাশী আমাদের প্রধান শত্রু অদ্বৈতবাদাবলম্বিদের তীর্থ। তুমি সেস্থলে নিজ নৈয়ায়িক পরিচয় গোপন করিয়া অদ্বৈতবেদান্তের শিক্ষা আত্মসাৎ করিয়া লও। তাহার পর অদ্বৈতবাদের ভ্রান্তিসমূহ আবিষ্কার করিয়া, ওই মত খণ্ডন করিয়া ন্যায়দর্শন ও ভক্তিবাদের পক্ষ পরিপুষ্ট করো।”
কাশীতে পণ্ডিত রামতীর্থের কাছে মধুসূদন যখন অধ্যয়নরত, তখন বিশ্বনাথধামে অশান্তির আগুন জ্বলছে। একদল ইসলাম ধর্মাবলম্বী দস্যুর অত্যাচারে সাধারণ মানুষ প্রচণ্ড উৎপীড়িত হচ্ছে। সন্ন্যাসী ও তীর্থযাত্রীরা এদের আক্রমণের লক্ষ্য। মধুসূদন বিষণ্ণচিত্তে ঘৃণা ও বিতৃষ্ণার এই পরাক্রমের কারণ অনুসন্ধান করেছেন। “হিন্দু পুরোহিতগণ মুসলমানদিগকে ঘৃণা করিতে শিখাইতেছে। আর মুসলমান মৌলানা হিন্দুদিগকে শত্রু ভাবিতে শিখাইতেছে। ‘হয় ধর্মান্তরিতকরণ, নয় মৃত্যু’ — এক হস্তে কোরান ও অন্য হস্তে তরবারি লইয়া ইহারা ভারতভূমে প্রবেশ করিয়াছে। আর হিন্দুরা আচার-আচরণে সর্বথা ভিন্ন মুসলমানদিগকে আপন করিয়া বক্ষে টানিয়া লইতে পারিতেছে না, পরিবর্তে তাহাদের ঘৃণা করিতে শিখিতেছে। অন্তরস্থ সত্যের অনুসন্ধানের অভাবেই ধর্মমতগুলি বাতুলতায় পর্যবসিত হয়।”
উপন্যাসের এই পর্যায়ে বেদান্তদর্শনের তাত্ত্বিক পরিচয় সন্নিবিষ্ট হয়েছে। বিশ্বেশ্বর সরস্বতীর নির্দেশে মধুসূদন রচনা করছেন শ্রীমদ্ভগবতগীতার বিখ্যাত টীকা ‘গূঢ়ার্থদীপিকা’। অন্যদিকে উৎপলদৃষ্টিও কাশীতে উপস্থিত হয়ে বৃদ্ধ বংশীবাদক এনায়েৎ খাঁর কাছে নাড়া বেঁধেছে। তত্ত্ববিশ্বে রচিত হয়েছে সুরের আবেশ। ইসলামে সংগীত কি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ? শিষ্যের এই প্রশ্নের উত্তরে এনায়েৎ জানিয়েছেন, “কে বলে ইসলামে সংগীত হারাম? এসব আনপড় বাত মূলে ছিল না; এসব কাহারা যেন ইদানীং চালাইয়া দিতেছে। মসজিদে যে আজান দেওয়া হয়, তাহা কি বিশুদ্ধ সংগীত নহে? সুরের জান্নাতে হিন্দু, মুসলমান বলিয়া কিছু নাই। উহা এক আনন্দের জগৎ!”
আবার অন্য এক আনন্দের জগতের দ্বার উন্মোচিত হল বৈদান্তিক মধুসূদনের কাছে বৃন্দাবন দর্শন করতে গিয়ে। কৃষ্ণকিশোর তাঁর জ্ঞানদীপ্ত ব্যক্তিত্বের গহনে ভক্তিরসের প্রদীপটি জ্বেলে দিলেন। অদ্বৈতবাদীর অন্তরমন্দিরে দ্বৈতবাদের বিগ্রহটি স্থাপিত হল। আওধি ভাষায় রামায়ণ রচনা করে দেবভাষাপ্রিয় পণ্ডিতদের গাত্রদাহের কারণ ঘটিয়েছেন এক গ্রামীণ কবি — কাশীর ঘাটে সেই তুলসীদাসের ভক্তিরসাশ্রিত রামায়ণগান শুনেছেন মধুসূদন। ‘রামচরিতমানসে’র একটি সংক্ষিপ্ত অথচ ভাবৈশ্বর্যময় পরিচয় দিয়েছেন ঔপন্যাসিক। দেবভাষায় না লিখে লোকচলিত ভাষায় কেন? তুলসীদাসের কী অনবদ্য উত্তর,
“হরি হর যশ সুর নর গিয়া, বরণহি সন্ত সুহান।হরি ও হরের যশোগান সাধুগণ দেবভাষায় কিংবা মানবীয় ভাষায় বর্ণনা করুন না-কেন, সবই সমান। যেমন সোনার তৈরি হাঁড়িতে বা মাটির হাঁড়িতে রাখলেও ব্যঞ্জনের আস্বাদ একই থাকে। তুলসীদাসের রামায়ণ বৈদান্তিক মধুসূদনের হৃদয় জয় করেছে, বোঝা যায় ভক্তিধর্ম তাঁর অন্তরে বিস্তার লাভ করছে। বহু ঐতিহাসিক পুরুষের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়েছে, যশোররাজ প্রতাপাদিত্য, বৈষ্ণব আচার্য জীব গোস্বামী এবং টোডরমল। শেষোক্তজনের সঙ্গে আগ্রা গিয়ে মোগল বাদশাহ্ আকবরের কাছে কাশীতে হিন্দুদের ওপর নিপীড়নের বিবরণ দিতে পেরেছেন তিনি। বাদশাহ এই অত্যাচার রোধে সশস্ত্র হিন্দু সৈন্যদল গঠন করে প্রতিরোধের অনুমতি দিয়েছেন। মধুসূদন সরস্বতী ও বাদশাহ্ আকবরকে ঘিরে গড়ে ওঠা এই কাহিনিটি শুধুমাত্র কিংবদন্তী নয়, ঐতিহাসিক প্রামাণ্যতাও আছে। ইতিহাস বলছে মধুসূদন আগ্রা থেকে ফিরবার পরই কাশীতে নাগা সন্ন্যাসীরা হিন্দুদের ওপর অত্যাচার রোধ করবার জন্য সংগঠিত হয়।
হান্ডী হাটক চারুচীর, রান্ধে স্বাদ সমান।।”
আগ্রায় যে শিশোদিয়া রাজপুতদের গৃহে অতিথি ছিলেন তাদের গৃহদেবতা কৃষ্ণকিশোরকে অদ্ভুতভাবে পেয়ে গেলেন মধুসূদন। ‘কালো কষ্টিপাথরে গড়া বিগ্রহ অপরূপ — বঙ্কিম ঠাটে ত্রিভঙ্গমুরারি বাঁশি বাজাইতেছেন। …. কে এক শ্যামল কিশোর কমলনয়নের গাত্রে তাহার কচি কচি হাত বুলাইয়া চক্ষু ঘুরাইয়া বলিতেছে, “আমাকে লইবে না? আমি যে তোমার সঙ্গে কাশী যাইব। তোমার সঙ্গে থাকিব। আমাকে ফিরাইয়া দিও না।” বিগ্রহটি সঙ্গে নিয়ে এলেন পণ্ডিত — অন্তরে চলে অদ্বৈতপথ ও ভক্তিমার্গের দোলাচলতা। গোপনে পূজা করেন কৃষ্ণমূর্তিটিকে।
পাদ্য, অর্ঘ্য, তুলসী দেন, চৌষট্টিঘাটের এক দোকান থেকে সরভাজা এনে নৈবেদ্য সাজান। ধরাও পড়ে গেলেন অন্য সন্ন্যাসীদের কাছে। যিনি ‘অদ্বৈতসিদ্ধি’ লিখেছেন, বিতর্কসভায় যিনি দ্বৈতবাদীদের যুক্তি খণ্ডবিখণ্ড করে দেন — তিনিই গোপনে বিগ্রহপূজা করেন। স্বীকার করে নিলেন মধুসূদন তাঁর পূজার কথা। কিন্তু কেন ঘটল এমন? মধুসূদন সরস্বতী রচিত দুটি অপূর্ব শ্লোক উদ্ধার করেছেন সন্মাত্রানন্দ, সেখানেই উত্তর আছে।
“অদ্বৈতসাম্রাজ্য পথাধিরূঢ়াস্তৃনীকৃতাখণ্ডল বৈভবাশ্চ।‘অদ্বৈতসাম্রাজ্যের পথ ধরিয়া ইন্দ্রের অতুল ঐশ্বর্যকে তৃণবৎ উপেক্ষা করিয়াই তো চলিতেছিলাম, কিন্তু পথিমধ্য হইতে কে এক শঠ, কে এক গোপবধূলম্পট জোরপূর্বক হরণ করিয়া লইয়া গিয়া তাহার চরণের দাসী করিয়া রাখিল যে!”
শঠেন কেনাপি বয়ং হঠেন দাসীকৃতা গোপবধূবিটেন।।”
“বংশীবিভূষিতকরান্নবনীরদাভাৎ‘যাঁহার দুটি কর বংশীবিভূষিত, নবীন মেঘের ন্যায় যাঁহার গাত্রবর্ণ, পীতাম্বর যাঁহার অঙ্গের বসন, আরক্তিম বিম্বফলের ন্যায় যাঁহার অধরোষ্ঠ, চাঁদের ন্যায় যাঁহার সুন্দর মুখ, পদ্মের ন্যায় যাঁহার দুইটি চক্ষু, সেই কৃষ্ণ ছাড়া আর কোনো তত্ত্ব আমি জানিনা!”
পীতাম্বরাদরুণবিম্বফলাধরোষ্ঠাৎ।
পূর্ণেন্দুসুন্দরমুখাদরবিন্দনেত্রাৎ
কৃষ্ণাৎ পরং কিমপি তত্ত্বমহং ন জানে।।”
এদিকে তাঁরই উদ্যোগে সনাতন ধর্মরক্ষার্থে সংগঠিত হয়েছে নাগা সন্ন্যাসীরা। প্রয়োজনে অস্ত্রধারণে তাদের আপত্তি নেই। বস্তুত ইতিহাস বলে ভারতের অনেক রাজা সৈন্যদলে নাগা সন্ন্যাসীদের রেখেছেন। শাস্ত্রচর্চার সঙ্গে শস্ত্রচর্চাতে তাদের বহুকালের আকর্ষণ। অচিরেই এই প্রতিরোধের ও প্রতিআক্রমণের ফলে বেধে গেল দাঙ্গাহাঙ্গামা। তীর্থযাত্রীদের ওপর মুসলমান দুর্বৃত্তদের আক্রমণ ঠেকাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সশস্ত্র নাগা সন্ন্যাসীরা। নির্বিচারে হত্যা করেছে মুসলমান দেখলেই। উন্মত্ত সন্ন্যাসীদের হাতে নিহত হয়েছেন সুরসাধক এনায়েৎ খাঁ। পড়ে আছে মৃত শিশু ও মৃত জননীর দেহ। আরো অসংখ্য নিরীহ মানুষের শব। আত্মধিক্কারে অনুশোচনায় দগ্ধ হলেন মধুসূদন সরস্বতী আর তাঁর কল্পদৃষ্টির সামনে ঔপন্যাসিক উদ্ঘাটিত করলেন সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে আবিল ভবিষ্যৎ ভারতের ছবি। ষোড়শ শতকের সরণিতে মিশে গেল বর্তমান কাল।
‘হিন্দু সরোষে মুসলমানের মসজিদে সশস্ত্র ঢুকিয়া পড়িতেছে। মুসলমান হিন্দুর মন্দির ভাঙিতেছে। হিন্দু মুসলমানের মসজিদ চূর্ণ বিচূর্ণ করিয়া দিতেছে। মসজিদ ভাঙিয়া মন্দির গড়িবে। হিন্দুর মন্দিরে আট বৎসরের বালিকা — মুসলমান কন্যা দিনের পর দিন গণধর্ষিত হইতেছে। মুসলমানের মসজিদের অন্তরালে হিন্দু কন্যার উপর লোলুপ পুরুষ ঝাঁপাইয়া পড়িতেছে। বৃদ্ধ ইমামের তরুণ পুত্রকে হিন্দু আততায়ীর দল কাটিয়া ফেলিতেছে। … হিন্দু কন্যাকে ভালোবাসিবার অপরাধে মুসলমান যুবকের দেহে আগুন লাগাইয়া দিয়া হিন্দু যুবক পৈশাচিক উল্লাস করিতেছে। হিন্দু জনতায় পরিপূর্ণ শকটে অগ্নিসংযোগ করা হইতেছে। পরিবর্তে অসহায় মুসলমান গ্রামের প্রতিটি প্রাণীকে নির্মমভাবে বধ করা হইতেছে। … অসহায় দেশের সিংহাসনে মূর্খরা বসিয়া রাজত্ব করিতেছে। সাম্প্রদায়িক বিভেদকে কাজে লাগাইয়া উভয় তরফ হইতে রাজনৈতিক সুবিধা লুন্ঠন করা হইতেছে। একদিক হইতে ‘আল্লা হু আকবর’ ধ্বনি উঠিতেছে। অন্যদিক দিয়া ‘জয় শ্রীরাম’ বলিয়া কাহারা আস্ফালন করিতেছে। বাল্মীকির রাম নহে, তুলসীদাসের রামও নহে, ইহা অন্য এক রাম — রক্তপিপাসু, যুদ্ধলোলুপ রাম।’
মধুসূদন সরস্বতী মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন রাজনীতির ক্রূর পথ থেকে। কাশীত্যাগ করে নবদ্বীপ হয়ে এসেছেন উনাসিয়ায়, কৃষ্ণকিশোর তাঁর একমাত্র আশ্রয় এখন। রবীন্দ্রনাথ ভারতবর্ষের ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন মধ্যযুগে ভারতবর্ষে শুধু দিল্লি ও আগ্রা ছিল না, কাশী ও নবদ্বীপও ছিল। এই উপন্যাসে এক মহান জীবনের চিত্র আঁকতে গিয়ে, আরো তিনটি কাল্পনিক চরিত্র যুক্ত করে কাশী; নবদ্বীপ, দিল্লি, আগ্রা সহ সেযুগের ভারতের ধর্ম, সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি — সর্বোপরি জ্ঞানান্বেষণের বিশাল ক্যানভাসটি সৃষ্টি করেছেন লেখক। যা একই সঙ্গে বস্তুবিশ্ব আবার ছায়াচরাচর।
৩
বুদ্ধজীবন সন্মাত্রানন্দের কাছে অনন্ত প্রেরণা। কিন্তু সে জীবনকে একরৈখিকভাবে তিনি দেখেননি, আঁকেননি। ‘তোমাকে আমি ছুঁতে পারিনি’ উপন্যাসটি প্রসঙ্গে গ্রন্থসূচনায় তিনি জানিয়েছেন, সিদ্ধার্থ কীভাবে বুদ্ধ হলেন সেই কাহিনি তিনি নিজের মতো করে পরিবেশন করেছেন কখনো বুদ্ধরিপু মারের দিক থেকে, কখনও নদী, নগরী বা নানা মানুষের দিক থেকে। তবে তাঁর এই দেখা কাজানজাকিস বা সারামাগোর খ্রিস্টজীবনকে দেখার সঙ্গে তুলনা করা যাবে না কারণ সন্মাত্রানন্দ ঐতিহ্যপন্থী। সূচনাতেই তিনি জানিয়েছেন, “আমার কাছে বুদ্ধচরিত্রকে বুঝতে কিছু কিছু অলৌকিক ঘটনা (বা আরও ভালো করে বললে ‘মিথ’) অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। অলৌকিক ঘটনা বা মিথসমূহকে ছেঁটে দিয়ে কৃষ্ণ, বুদ্ধ বা যিশুর অনুধ্যান আমার কাছে সংবাদপত্রের রিপোর্টের মতন নিতান্তই নীরস। তাই আমার বইতে পুনর্জন্মের কথা আছে। যাঁরা হিন্দু পুনর্জন্মবাদ (reincarnation) বা বৌদ্ধ পুনর্ভববাদ (rebirth)-এর মতো তত্ত্বগুলিকে অবৈজ্ঞানিক কুসংস্কার মনে করে সাহিত্যপাঠের সময়েও এদের থেকে দূরে থাকতে চান, এ উপন্যাস তাঁদের জন্য লেখা হয়নি।” উপন্যাসে ‘জাতিস্মর’ প্রসঙ্গ এসেছে। ময়ূখ — উপন্যাসের লেখক পূর্বজন্মে ছিল সৌদাস — সুজাতার স্বামী। কথকরূপে কখনো সিদ্ধার্থে নিজে, কখনো সৌদাস, কখনো সুজাতা, কখনো বর্তমানকালের ময়ূখকে পেয়েছি। বৌদ্ধদর্শনের গভীরতত্ত্বকে সহজ ভাষায় বর্ণনা করেছেন ঔপন্যাসিক। কিন্তু আমার কাছে এই উপন্যাসে সবচেয়ে বড়ো প্রাপ্তি অশ্বঘোষের ‘বুদ্ধচরিতম’ কাব্যের অনেকগুলি শ্লোকের অপূর্ব কাব্যানুবাদ, যার নাম সন্মাত্রানন্দ দিয়েছেন ‘বুদ্ধকৈরবী’।
ভারতবর্ষের দার্শনিক ঐতিহ্যে অসংখ্য আশ্চর্য কাহিনি গ্রথিত আছে, সেই মণিমঞ্জুষার ডালা খুলে তাকে আজকের দৃষ্টিতে দেখে রত্নগুলি চয়ন করতে ভালবাসেন এই লেখক। ‘ভামতী অশ্রুমতী’ তেমনি একটি চয়ন। বাচস্পতি মিশ্র ও ভামতীর কাহিনি ভারতে বহুখ্যাত। বেদান্তের একটি মহামূল্যবান টীকা রচনায় জীবন নিবেদন করে দিয়েছিলেন বাচস্পতি — যথাকালে বিবাহ হলেও, স্ত্রী ভামতী সংসারে এলেও তাঁকে লক্ষ্যও করেননি তিনি। স্বামীসম্ভাষণের সৌভাগ্য ঘটেনি মেয়েটির কপালে। শ্বশুরগৃহে নিরন্তর গৃহকর্ম ও নিপুণ স্বামীসেবাতে অতিবাহিত হয়েছে তাঁর যৌবন। বার্ধক্যে এসে পুঁথি সমাপ্ত করে বাচস্পতি চোখ তুলে তাকিয়েছেন সেবাময়ীর দিকে।
‘কে তুমি, নারী?’
‘নারীমূর্তি ধীর কন্ঠে উত্তর দিল, আমি অভাগিনী ভামতী। প্রথম যৌবনে মনে মনে আমি আপনাকেই পতিরূপে বরণ ক’রে নিয়েছিলাম। কিন্তু বিবাহের রাত্রি থেকেই আপনি পুঁথির পর পুঁথি রচনা করে চলেছেন। কোনোদিন আপনি আমার নাম পর্যন্ত জানতে চাননি, আজই প্রথম আমার পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। আমার মতন হতভাগিনী পৃথিবীতে কেউ আছে কিনা, জানিনা। … আমার কোনো সন্তানাদি নেই, শুনেছি সন্তানহীনার পিণ্ডলোপ হয়, পরলোকে গতি হয় না। আমার ইহলোক নেই, পরলোক নেই। কিন্তু তাতে আমার দুঃখ নেই। আমার আছে শুধু প্রতীক্ষা।’
অনুতপ্ত বাচস্পতি তাঁর সদ্যসমাপ্ত গ্রন্থের নাম রেখেছেন ‘ভামতী টীকা’। নিজের জীবন আহুতি দিয়ে ঐকান্তিক নিষ্ঠায় কর্তব্যের হোমানল জ্বালানোর এই কাহিনি সমুন্নত বেদনাময়। সেইসঙ্গে স্বামীর মননজগতের সঙ্গে স্ত্রীর সুবিপুল দূরত্বের সাক্ষী।
বৌদ্ধ আচার্য অসঙ্গ এবং বসুবন্ধু সহোদর—যদিও তাঁদের পিতারা আলাদা। অংশুমান ও প্রসন্নশীলার পুত্র অসঙ্গ। অংশুমান রণক্ষেত্রে নিহত হবার পর ও অসঙ্গ প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে গৃহত্যাগ করার পর কৌশিকের সঙ্গে দ্বিতীয়বার বিবাহ হয় প্রসন্নশীলার — বসুবন্ধু তাঁদের সন্তান। মাতার দুটি পুত্রই অসামান্য মেধাবী, জ্ঞানতৃষাতুর এবং বৈরাগ্যময়। কীভাবে দুই ভাইয়ের দেখা হল বহুকাল পরে সেই কাহিনির সঙ্গে লেখক এখানে বুনে দিয়েছেন বৈভাষিক ও সৌত্রান্তিক মতাদর্শ ও দুই ভাইয়ের অনুভূতির ঐশ্বর্যে গড়ে ওঠা যোগাচার দর্শনের পরিচয়।
‘কৃষ্ণাদ্বাদশীর মেঘ’ দ্বাদশটি ছোটোগল্পের সংকলন। এখানেও সন্মাত্রানন্দ সন্ধান করে ফিরেছেন ইতিহাসের ধূসর জগতে বিস্মৃতির ধূলায় ঢাকা অপূর্ব রত্নরাজি, তার সঙ্গে মিশেছে খেয়ালি কল্পনা। ‘কাশজ্যোৎস্না’ গল্পে কথক যেন স্বপ্নপ্রয়াণে অষ্টাদশ শতকের এক অখ্যাত কবি দিবাকর চক্রবর্তীর দেখা পেয়েছেন — তাঁর ‘বিজয়ামঙ্গল’ কাব্যের কথা শুনেছেন, যার কথাবস্তুতে মা সারদামণির অষ্টসখীর কাহিনির ছায়া পড়ে গেছে। ‘শিখিবৈবশী ও লাল পাথরের বাটি’ কামরূপ কামাখ্যার জাদুকরী মেয়েদের নিয়ে গড়ে ওঠা ভয়ের ছোঁয়া লাগা রূপান্তরের কাহিনি। অমোঘবজ্রা বা শিখিবৈবশী ডাকিনীতন্ত্রে সিদ্ধা এক নারী। বিক্রমশীল মহাবিহারে তন্ত্রবিদ্যাবিভাগের ভিক্ষুরা অনেকেই সাধনসূত্রে যুক্ত হয়ে পড়েন এই নারীর সঙ্গে। আচার্য দীপংকর প্রকৃতিসঙ্গ অনুমোদন করেন না, ফলে তারা বহিষ্কৃত হন। কোথায় যান তাঁরা? এর রহস্যঘন উত্তর গল্পের মধ্যেই আছে।
‘তর্কালংকারের পাতড়া’ ও ‘কালান্তর’ উনিশ শতকের পটে স্থাপিত। একটি ফলে না ওঠা মহান প্রকল্পের অপমৃত্যুর ছবি রয়েছে দুটিতেই। সে যুগের সারস্বত সাধনার ভারি জীবন্ত বর্ণনা পাঠককে মুগ্ধ করে। ‘পাতড়া’ হল তর্কের সময় বিরুদ্ধবাদীদের যুক্তি কেটে দেবার প্রণালী। এক এক স্থানের পাতড়া এক এক রকম। এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়কে জানতে দিতেন না বিতর্কে জয়ী হবার প্রণালী। এইভাবে গড়ে উঠেছিল অজস্র সংকীর্ণ বিদ্যাসম্প্রদায়। নৈহাটি, ভট্টপল্লী, মুর্শিদাবাদ, নবদ্বীপ এক একটি বিদ্যাসম্প্রদায় এক একটি বদ্ধ কূপে পরিণত হয়েছিল। এই সংকীর্ণতা ঘোচাবার স্বপ্ন দেখতেন শ্রীনাথ ও টোলের সহপাঠী রামমাণিক্য। পরে বিভিন্ন টোলে ছাত্র পাঠিয়ে মূল্যবান পাতড়াগুলি সংগ্রহও করেছিলেন শ্রীনাথ।
‘যে - পাতড়ার সংকলন তিনি প্রস্তুত করেছেন, এ জিনিস বঙ্গদেশের নৈয়ায়িক পণ্ডিতদের বিচারপদ্ধতির প্রায় পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা, বঙ্গমনীষার পূর্ণাঙ্গ ইতিবৃত্ত। এখন শুধু প্রয়োজন, একবার কাশীর পণ্ডিতদের এই নতুন পাতড়াটি দেখিয়ে নেওয়া। তারপর টোলে ফিরে এসে এটি অধ্যাপনা করলে দেশের সর্বসাধারণের জন্য প্রজ্ঞার দ্বারকপাট একেবারে উন্মুক্ত হয়ে যাবে।’
কিন্তু তা হবার আগেই পথে ঠ্যাঙাড়েদের কবলে পড়লেন শ্রীনাথ। তিনি নিহত হলেন। ধ্বংস হয়ে গেল বহুমূল্য পাতড়া। ‘কালান্তর’ গল্পে শ্রীনাথের সহপাঠী বন্ধু রামমাণিক্য সংস্কৃত কলেজে চাকরি নিয়েছেন। টোলের যুগ শেষ হতে চলেছে। ন্যায়, ব্যাকরণ শিখিয়ে অন্নাভাব দূর হয় না আর। সবাই সুনামের সঙ্গে টোল চালাবার মতো মেধাবী হয় না। বেশিরভাগ ছাত্রই শাস্ত্রী উপাধি নিয়ে নিজের গ্রামে গিয়ে পূজারির কাজ করে। কলকাতায় থাকলে সংস্কৃত কলেজ থেকে বেরিয়ে পনেরো-বিশ টাকার মাসমাহিনার চাকরি জোটে। ‘এখন কলিযুগ! অন্নচিন্তা চমৎকারা।’ সংস্কৃত কলেজের সেক্রেটারি রসময় দত্তকে এই গল্পে আমরা পাচ্ছি। রামমাণিক্যকে তিনি বলেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় নামে সদ্ব্রাহ্মণ বংশজ এক তরুণ পণ্ডিতের কথা। সংস্কৃত কলেজেরই ছাত্র — তাঁকে কলেজে চাকরি দেবার ইচ্ছা রসময়ের। তখন অবশ্য রসময় দত্ত জানতেন না পরবর্তীকালে তাঁর সঙ্গে বিরোধ ঘটার পর অনায়াসে চাকরি ছেড়ে দেবেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। দরিদ্র সন্তান ঈশ্বরচন্দ্র — তাই অবজ্ঞাভরে ধনী রসময় বলেছিলেন চাকরি ছেড়ে বিদ্যাসাগর খাবে কী? গভীর আত্মমর্যাদা নিয়ে নতুন যুগের ব্রাহ্মণ সন্তান জানিয়েছিলেন, দরকার হলে আলুপটল বিক্রি করবেন, সম্মান খুইয়ে চাকরি করবেন না। সন্মাত্রানন্দকে অনুরোধ, বিদ্যাসাগরের জীবনের কোনো খণ্ড অংশ নিয়ে যদি গল্প লেখেন তিনি।
গঙ্গারামের ‘মহারাষ্ট্রা পুরাণে’র মতো, বর্ধমানরাজের সভাকবি বানেশ্বর বিদ্যালংকারের ‘চিত্রচম্পূ’ কাব্যও বাংলায় বর্গী হাঙ্গামার ছবি তুলে ধরেছে। বানেশ্বরের দেখাও আমরা পেয়েছি একটি গল্পে, বিদ্যাজীবী, বুদ্ধিজীবীর চিরন্তন সমস্যায় বিব্রত তিনি। ‘বঙ্গাল’ গল্পটি কৌতুকোজ্জ্বল সুরে শাশ্বত সত্য তুলে ধরেছে। পাঠান আমলে স্থাপিত গল্পে বিরোধ বেধেছে সংস্কৃতানুরাগী পিতা বিরূপাক্ষের সঙ্গে ফার্সি অনুরাগী পু্ত্র শ্রীধরের। টোল ছেড়ে শ্রীধর চাকরি নিয়েছে দাউদ খানের দপ্তরে। কোন ভাষাটি টিকবে? সংস্কৃত না ফার্সি? অনায়াস ভবিষ্যৎ দৃষ্টি মেলে বিরূপাক্ষ জননী জনকনন্দিনী বলেছেন, ‘আমার লাতির লাতি, পুঁতির পুঁতি আমার ভাষাতেই কতা কইব। পাঠান রাজত্ব একদিন যাইব গিয়া, ফার্সি বুলি হেইখানেই শ্যাষ!’ তিনি এই সত্যটিও বলতে ছাড়েননি, ‘তর আর তর বাপ-ঠাকুদ্দার অং বং চং সংস্কৃত ভাষাও চলত না।’ আজকের বাংলাদেশকে কি দেখতে পেয়েছিলেন বিরূপাক্ষ-জননী?
চৈতন্যের আমলের নবদ্বীপের পটভূমিতে ‘একনয়ন’ গল্পটি নব্যন্যায়ের ধুরন্ধর পণ্ডিত বাণভট্ট রঘুনাথকে নিয়ে লেখা। মিথিলার পক্ষধর মিশ্রের সঙ্গে তাঁর শ্রদ্ধা ও বিতণ্ডামিশ্রিত সম্পর্ক, নিমাইপণ্ডিতের সংকীর্তনের প্রতি তাঁর সংশয়বিদ্ধ সন্দিগ্ধ মনোভাব — জাগ্রত জ্ঞানতৃষ্ণা ও সন্ধিৎসা মিলিয়ে রঘুনাথ শিরোমণি জাজ্বল্যমান হয়ে উঠেছেন এই গল্পে। আরো পিছিয়ে দ্বাদশ শতাব্দীর বঙ্গদেশের পটে স্থাপিত হয়েছে ‘কৃষ্ণাদ্বাদশীর মেঘ’ গল্পটি। তন্ত্রসাধনার পরিমণ্ডলের রহস্যময়তা এই গল্পে নিবিড় হয়ে আছে। কৌল তান্ত্রিক বিরূপাক্ষ আর কুলবধূ শাম্ভবীর সম্পর্ক কি শুধু সাধক ও সাধকসঙ্গিনীর? পুত্র শ্রুতসেনের অকালমৃত্যু আটকাবার জন্য সরমা জ্যোতিষীর নির্দেশানুসারে পুত্রবধূ শাম্ভবীকে বিরূপাক্ষের সাধনসঙ্গিনী করে দিয়েছিল। বারো বছর ছিল সেই যোগাযোগ। শাম্ভবীর দাম্পত্য সুখের ছিল না। শ্রুতসেন তার যোগ্য নয় কোনোদিকেই, যে স্থূলরুচির পশুস্বভাবী মানুষ। বিরূপাক্ষ শাম্ভবীর সম্পর্ক ধর্মীয় গণ্ডি ছাড়িয়ে প্রেমের পথে যাত্রা করেছিল, কিন্তু সমাজ তাদের মিলনকে স্থায়িত্ব দিল না। বারো বছর শেষ হতেই শ্রুতসেন শাম্ভবীকে নিয়ে গ্রাম ত্যাগ করে গেল। পরে বর্গক্ষত্রিয় ঘরের কন্যা গাঙ্গিনীর মধ্যে শাম্ভবীর আকৃতি-ছায়া দেখে তাকে বিবাহ করবেন মনস্থ করলেন বিরূপাক্ষ। তাঁর ব্যক্তিত্বপ্রভাবে গ্রামের ব্রাহ্মণরা আপত্তি তুলতে পারল না। এখানে পাঠকের একটা খট্কা লাগে এমন অসবর্ণ বিবাহ কি মেনে নিত দ্বাদশ শতকের গ্রামীণ সমাজ? ব্রাহ্মণ ও বর্গক্ষত্রিয়, প্রায় অন্ত্যজ ঘরের কন্যা? কৌল তান্ত্রিকরা অবশ্য সাধনসঙ্গিনী করতেন নিম্নবর্ণ থেকেও। যাই হোক গাঙ্গিনীর অকালমৃত্যুতে বিবাহ সম্পন্ন হল না। উন্মাদদশাগ্রস্ত বিরূপাক্ষের সর্বনাশা ছবিতে গল্পের সমাপ্তি।
নিকট অতীতের পটে স্থাপিত তিনটি গল্পে দেখা দিয়েছেন মির্চা এলিয়াদ, মৈত্রেয়ী এবং সুরেন দাশগুপ্ত, স্বামী বিবেকানন্দ এবং অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা। গল্পে পরিতোষ মহারাজ মির্চাকে ফরাসি সাহেব বললেও বস্তুত মির্চা রুমানিয়ার মানুষ। ‘শসার ফুলের নূর’ গল্পে মুসলমান ফকিরকে বলা স্বামীজীর কথা ক’টি পাঠক ভুলতে পারে না, “ভুখে লোগোঁ কী কোঈ জাতি নহীঁ হোতী, কোঈ ধর্ম নহীঁ হোতা! দো ভাঈ, দে দো! বহ্ খানা মেরে মুঁহ মেঁ খিলা দো! ডরোমৎ!” অগ্নিযুগের দুঃসাহসিক ইতিহাস, সন্মাত্রানন্দকে টানে। পরে তিনি উপন্যাসও লিখেছেন ঐ বিষয়ে। ‘ভাজা মৌরির কৌটো’ গল্পে বিনয়-বাদল-দীনেশ এবং তাঁদের সহযোগীরা অসামান্য বিশ্বাসযোগ্যতায় ধরা দিয়েছেন। সমাধান না হওয়া একটি রহস্যের ব্যাসকূট গল্পটির আকর্ষণ বাড়িয়েছে। ‘নষ্টনাটক’ গল্পে একটি প্রাচীন তমিড় নাটক, কৃষ্ণবেণী আর তার প্রেমিক ষণমুগম,(??) বিশেষ একটি স্থানে অতীত ঘটনা কালস্রোতের বিপরীতে জমাট বেঁধে থাকা এবং পুনর্জন্মের রহস্য নাটকীয় উৎকন্ঠাকে টানটান রেখেছে। আলোচনা থেকে এটুকু হয়তো বোঝাতে পেরেছি বাংলা ছোটোগল্পের প্রসঙ্গ ও প্রকরণে সন্মাত্রানন্দ কোথায় অভিনব মাত্রা সংযোজন করেছেন।
৪
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অবিভক্ত বাংলার স্থান আজ ইতিহাসে প্রায় অনুল্লেখিত। অসম সাহসী যেসব বিপ্লবী সেদিন বিদেশি ঔপনিবেশিক শক্তিকে প্রত্যাঘাত করেছিলেন, তাঁরা বিস্মৃত। এই বিলুপ্তিকরণের কারণ আলোচনা করার স্থান এই প্রবন্ধে নয়। মেদিনীপুর সেদিন ব্রিটিশ শাসকের বুকে চরম আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পেরেছিল। তারপর তিনজন শাসক পেডি, বার্জ, ডগলাস বিপ্লবীদের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। গুপ্তসমিতির রোমাঞ্চকর কার্যকলাপের কাহিনি গবেষণাধর্মী গ্রন্থে বা স্মৃতিকথায় আমরা পেয়েছি। কিন্তু ‘দীনেশ গুপ্তের রিভলবার’ সম্পূর্ণ অন্য ধরণের বই। টাইমট্রাভেল সন্মাত্রানন্দের প্রিয় শৈলী। এই উপন্যাসেও নানা কালরেখার সমাহার ঘটেছে। একটি সময় তীব্রগতিতে পরবর্তী সময়কে স্পর্শ করেছে। উপন্যাসের কেন্দ্রে রয়েছে ট্রেজার হান্ট — কিন্তু নিছক থ্রিলার বলা যাবে না। থ্রিলারের টানটান উৎকন্ঠা আছে, তার সঙ্গে বিপ্লবীদের আত্মদানের গরিমা, সমাজের প্রান্তিক অঞ্চলে, সংসার সীমান্তে বসবাসকারী মেয়েরা কীভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে নিজেদের গচ্ছিত ধনসম্পদ উজাড় করে দিয়েছিল — রয়েছে সেই উপেক্ষিত, চাপা পড়া ইতিহাস। সময়ের যেমন নানা তল রয়েছে, স্থানের ক্ষেত্রেও তেমনটি ঘটেছে। নিবিড় গবেষণা সন্মাত্রানন্দের প্রতিটি লেখার ক্ষেত্রেই আমাদের মুগ্ধ করে। বাস্তব তথ্যের সঙ্গে মায়াকুহেলির রহস্য মিশে গিয়েছে কালের সরণিতে।
‘হাওয়ার মতন, নেশার মতন’ দুঃখী দুই নরনারীর ভালোবাসার গল্প। প্রাত্যহিক জীবনকে এই উপন্যাসে বারে বারে স্পর্শ করে যায় মৃত্যুর কুয়াশা। যারা চলে যায়, মরে যায়, তারা কি নিঃশেষে মুছে যায় এই পৃথিবী থেকে? তাদের সুখ, দুঃখ, প্রেম অপ্রেম, তাদের মনের কথার টুকরো কি কুড়িয়ে পাওয়া যায় না? তাদের গানের সুরগুলি কি নানাভাগে অস্তরাগে রাখা থাকে না? এই উপন্যাস যেন এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে — জীবন আর মৃত্যু আপাতবিচ্ছিন্ন এই দুই লোকের মধ্যে ক্ষণভঙ্গুর অপরূপ এক মায়াসেতু গড়েছে। অরণ্য আর তাপ্তি এই উদাসীন ক্ষয়িষ্ণু বৃহৎ শহরের দুটি মানব মানবী একদা পরস্পরের কাছাকাছি এসেছিল। জীবিকার তাগিদ তাদের দূরেও সরিয়ে দিয়েছে আবার। তবু তারা স্বপ্ন দ্যাখে, চিঠি লেখে। যান্ত্রিক সভ্যতার হুহুংকারেও অস্তিত্বের জাদু হারায় না, ভালোবাসা হারায় না —হাওয়ার মতন, নেশার মতন, ফিরে ফিরে আসে। কেবলই অলৌকিক মুহূর্তের জন্ম হয়।
সন্মাত্রানন্দের মাত্র কয়েকটি গ্রন্থ নিয়ে সামান্য এই আলোচনা নেহাৎই অসমাপ্ত। তাঁর কাছে বাংলা সাহিত্যের পাঠকের প্রত্যাশা অনেক। চিরাচরিত গতানুগতিক স্রোতে তিনি নতুন রঙের সমারোহ এনেছেন, মায়াবী দরজা খুলে কালের যাত্রাপথে পাঠককে আহ্বান করেছেন। আমরা উৎসুক।
গ্রন্থপঞ্জি: সন্মাত্রানন্দ
১) নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা
২) ছায়াচরাচর
৩) কৃষ্ণাদ্বাদশীর মেঘ
৪) ভামতা অশ্রুমতী
৫) দীনেশগুপ্তের রিভলবার
৬) হাওয়ার মতন নেশার মতন
৭) পুনর্যাপী ফিনিকস
৮) তোমাকে আমি ছুঁতে পারিনি