তারপর বড়ো হয়ে এদেশে এলাম। কাজের ভিড়ে কখন যেন তারারা ডুবে গেল। এখন মাথার ওপর শহুরে আকাশে তাকাই কখনোসখনো, দু'একটা তারার দেখা পাই। আঃ! কতদিন আকাশগঙ্গা দেখিনি। ওই ছায়াপথটা কীভাবে, কখন আমাদের জীবন থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল, আমরা টেরই পেলাম না। এভাবে কতো তারা রাতের আকাশ থেকে মিলিয়ে যাচ্ছে, কেউ খোঁজ রাখে না।
এর একটা মুখ্য কারণ--আলোকদূষণ বা light pollution. অন্যান্য নানা দূষণের লিস্টে আরেকটা নাম জোড়া হল। মানুষে-গড়া কৃত্রিম আলোর বিচ্ছুরণে রাতের আকাশ এখন এত উজ্জ্বল যে অনেক তারা নক্ষত্র এখন আর দেখাই যায় না। আমেরিকার ৯৯ শতাংশ জায়গা আলোকদূষণে ভুগছে। ২/৩ ভাগ অঞ্চলে ছায়াপথ একেবারেই অদৃশ্য। এযুগের ছেলেমেয়েরা ধ্রুবতারা চেনে না। (তবে GPS দিয়ে দিকনির্ণয় অবশ্যই করতে পারে।) এরা Milky Way ছায়াপথ কখনো দেখেনি। গত দশকে প্রতি বছর রাতের আকাশ ১০% বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। এভাবে চললে একদিন হয়তো সব তারাই অদৃশ্য হয়ে যাবে।
আজকাল সব দেশে, সব শহরে রাতের বেলায় প্রয়োজনাতিরিক্ত আলো জ্বালিয়ে রাখা হচ্ছে। আমরা যত পারি উজ্জ্বল রংবেরঙের আলো দিয়ে সাজাই বিল্ডিং, ব্রিজ, বিজ্ঞাপন। এই আলোর বিচ্ছুরণ ধুলো ও ধোঁয়ায় মিশে এমন পরিবেশ তৈরি করেছে যে মেঘহীন রাতেও আকাশ মেঘাচ্ছন্ন মনে হয়।
আলোকদূষণ জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাজে গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করেছে। গভীর অন্ধকার আকাশ ক্রমশই বিরল হয়ে যাচ্ছে। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা International Dark Sky Association বা IDS অন্ধকার সংরক্ষণের কাজে যুক্ত। এই সংস্থার এক বিজ্ঞানী John Bortle ২০০১ সালে অন্ধকার মাপার একটি স্কেল চালু করেন--১ থেকে ৯ পর্যন্ত। ৮-৯ Bortle scale হল সবথেকে উজ্জ্বল যে কোন বড়ো শহরের অন্ধকার আকাশ। আমেরিকা, ইয়োরোপ, এমনকি ভারতেরও বেশিরভাগ অঞ্চল ৭ থেকে ৯-এর মধ্যে পড়ে। শুধু গ্রহ ও বড়ো সাইজের কয়েকটি তারা দেখা যায়। ব্যস। শহরতলীতে একটু বেশি ৫-৭ স্কেলের অন্ধকার আর গ্রামে জঙ্গলে আরও গভীর ৩-৪ স্কেল অন্ধকার হয়। তিনের বেশি আলোয় 'মিল্কি ওয়ে' বা আকাশগঙ্গা ছায়াপথ দেখা যায় না। ছায়াপথের উপস্থিতি অন্ধকারের গভীরতার প্রধান চিহ্ন। ১-২ স্কেল-এর ঘন অন্ধকার --যেটা বড়ো বড়ো টেলিস্কোপ ব্যবহারে অপরিহার্য---পাওয়া যাবে ব্রাজিলের আমাজন অঞ্চলে, আফ্রিকার সাভানায়, বা অস্ট্রেলিয়ার মরুভূমিতে। কিন্তু এসব জায়গা দুর্গম, বললেই হুট করে যাওয়া যায় না। অবশ্য ছোট ছোট অন্ধকার জায়গা সব দেশেই আছে। সেগুলি বাঁচিয়ে রাখাটাই IDS-এর প্রধান কাজ।
তবে, মানব সভ্যতায় আলোর অবদান তো স্বীকার করতেই হবে। আলোর উৎসই প্রাণের উৎস। পুরাকালে সব সভ্যতায় সূর্যকে পূজা করা হতো। জ্ঞানী ঋষিরা লিখে গেছেন 'তমসো মা জ্যোতির্গময়'। আলো ছাড়া নিরাপদে বেঁচে থাকা মুশকিল। দরজায়, গেটে, রাস্তায়, ব্রিজ, টাওয়ার, ইত্যাদির ওপর, আলো তো ভীষণ দরকার। কিন্তু অনেক জায়গায় অল্প পাওয়ারের LED আলো, বা কম সংখ্যার আলো, নিরাপদে ব্যবহার করা যায়। এতে আলোকদূষণ কমে আর পয়সারও সাশ্রয় হয়।
এনার্জি, পয়সা বা বৈজ্ঞানিক গবেষণা ছাড়াও অতিরিক্ত আলো পশুপাখি ও মানুষের শরীরে নানারকম দৈহিক ও মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করে।
সূর্যচালিত দিন ও রাত্রি, আলো ও অন্ধকারের বিভাজন, সৃষ্টির প্রথম মুহূর্ত থেকে চলে আসছে। পৃথিবীর প্রতিটি গাছপালা, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ আর মানুষও বিবর্তিত হয়েছে এই আলো-আঁধারের ওপর নির্ভর করেই। আমাদের শরীরের আদিম ছন্দ --circadian rhythm--আমাদের রাত্রে ঘুম পাড়ায় আর সকালে জাগিয়ে দেয়। আলো বা আঁধারের কম বেশি হলে এই সার্কাডিয়ান রিদম বিকল হয় এবং আমাদের নানারকম অসুখবিসুখের উপসর্গ দেখা দেয়। নিদ্রাল্পতা বা নিদ্রাহীনতা আলোকদূষণের একটি বিশেষ সমস্যা। এর থেকে ডিপ্রেশন, হার্টের অসুখ, ওজন বাড়া, বন্ধ্যাত্ব, ডায়াবিটিস ইত্যাদি নানা রোগের উৎপত্তি হতে পারে।
আলোকদূষণে প্রাকৃতিক চাঁদ ও তারার আলো ঢাকা পড়ায় পশুপাখিদের জগতেও ব্যাপক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। সমুদ্রতীরে সদ্য ডিম ফুটে বাচ্চা কচ্ছপেরা কৃত্রিম আলোয় দিশাহারা হয়ে সমুদ্রে পৌঁছতে পারে না, মাঝপথে মানুষ বা অন্য শিকারি পশুদের হাতে মারা যায়। পরিযায়ী পাখিরা রাত্রে চাঁদ আর তারার আলোয় দিকনির্ণয় করে। কৃত্রিম উজ্জ্বল আলোয় তারা অনেক সময় দিক ভুল করে মাঝপথে মারা যায়।
আমাদের কাজকর্ম, পড়াশোনা, খাওয়াদাওয়া, নিরাপত্তা ও মানসিক ভারসাম্যের জন্য আলোর যতটা অবদান, ততটাই অন্ধকারেরও। আলোর মতই অন্ধকার ছাড়া মানবিক সভ্যতার উন্নতি ও অগ্রগতি সম্ভব হতো না। কল্পনা করুন প্রাগৈতিহাসিক যুগে আমাদের পূর্বসূরিরা বাইরে অন্ধকার রাতে তারাদের উদয় ও অস্ত দেখতেন। সেই থেকেই তো জ্যোতির্বিজ্ঞানের শুরু। এই কোটি কোটি নক্ষত্রখচিত আকাশ যুগে যুগে আমাদের প্রেরণা জুগিয়েছে। ভ্যান গগের 'Starry Night’ থেকে রবীন্দ্রনাথের 'আকাশভরা সূর্য তারা, বিশ্বভরা প্রাণ' সবই তো এই অন্ধকার রাতের আশীর্বাদ। জ্যোতির্বিজ্ঞান থেকে দর্শন, ধর্ম, সাহিত্য, চারুকলা, সভ্যতার প্রতিটি পরতে অন্ধকার আকাশ আমাদের নতুন বৈজ্ঞানিক তথ্য বা কল্পনার সন্ধান দিয়েছে। তারাদের সাহায্যে আমরা অকূল সমুদ্রে পাড়ি দিয়েছি নতুন দেশ, মহাদেশের খোঁজে। আবার পৃথিবী ছেড়ে গ্রহ, উপগ্রহদের জগতেও পৌঁছে গেছি। গভীর অন্ধকার আকাশে (Bortle স্কেল ১) দেখেছি ব্রহ্মাণ্ডের সম্প্রসারণ। জেনেছি যে আমরা সবাই তারার মানুষ। তারার কণিকা থেকেই আমাদের জন্ম।
তাহলে আমরা আমজনতা, সাধারণ মানুষ, এত প্রয়োজনীয় অন্ধকার আকাশ টিকিয়ে রাখবার জন্য কী করতে পারি? কতটুকুই বা করতে পারি? আসলে অনেক কিছুই। অদরকারি আলো নিভিয়ে রাখুন, যেখানে সম্ভব অল্প শক্তির LED বাল্ব ব্যবহার করুন, হেমন্তকালে, (সেপ্টেম্বর-অকটোবর ) পাখিদের রাত্রিকালীন মাইগ্রেশন-এর সময় সন্ধ্যের পরে কিছু সময় বাইরের বাতি নিভিয়ে রাখুন--দেখতে না পেলেও জানবেন যে আপনার মাথার ওপর দিয়ে নিঃশব্দে হাজার হাজার পাখি তাদের শীতের বাসায় পৌঁছোবার চেষ্টা করছে। কোনো বিশেষ জায়গায়-- যেমন সমুদ্রতীরে-- কচ্ছপের ডিম ফোটার সময়, আশপাশে সব আলো নিভিয়ে রাখুন। আপনার দেশে, প্রদেশে, ন্যাশনাল বা স্টেট পার্কে অনেক অন্ধকার জায়গা আছে। সেগুলি সংরক্ষণের জন্য স্থানীয় সংস্থাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। আর, ব্যাক্তিগত স্বাস্থ্যের কারণে রাত্রে সুনিদ্রার জন্য টিভি, কম্পিউটার, সেলফোন ইত্যাদি বন্ধ রাখুন। ওইসব যান্ত্রিক আলো আপনার সারকাডিআন রিদম-এর ব্যাঘাত করে।
এসব তো ধান ভানতে শিবের গীত হল। এবার কিছু নিজস্ব অভিজ্ঞতার কথা বলি। IDS সারা পৃথিবীতে প্রায় ২০০টি 'অন্ধকার আকাশ' পার্ক সংরক্ষিত করেছে। এর মধ্যে ১৫টি Bortle স্কেল ১ --যেগুলি জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণায় অপরিহার্য। আমেরিকায় মাত্র তিনটি স্কেল-১ পার্ক--আলাস্কায় ডেনালি পার্ক, টেক্সাসে বিগ বেন্ড পার্ক আর মধ্য আমেরিকায় আমারই প্রদেশ নেব্রাস্কায় মেরিট জলাশয় পার্ক। এটি দেশের অন্যতম অন্ধকার আকাশ অথচ আমার এতদিন জানাই ছিল না!
উত্তর-পশ্চিম নেব্রাস্কায় প্রায় ২০,০০০ বর্গমাইল জুড়ে স্যান্ড-হিল এলাকা। সেখানে বালি মেশানো মাটিতে প্রেরী ঘাস ছাড়া আর কিছুই গজায় না। মাঝেমধ্যে ছড়ানো ছোটো-বড়ো লেক, তারই একটার নাম মেরিট, তার চারপাশে সাতশো একর জমি অন্ধকার পার্কের জন্য বরাদ্দ। অবশ্য শুধু অন্ধকার নয়, পার্কে ক্যাম্পিং, নৌকো চালানো, মাছ ধরা, শিকার, সবকিছুরই বন্দোবস্ত আছে। শুধু রাত্রে কোন আলো না থাকলেই হল। এইখানে প্রতি বছর জুলাই-অগস্ট মাসে আন্তর্জাতিক স্টার পার্টির আয়োজন হয়-- দেশবিদেশ থেকে নক্ষত্রবিজ্ঞানিী ও নক্ষত্রবিলাসীরা এখানে আসেন। আমার তারা, উল্কা, ধূমকেতু ইত্যদি দেখার ও ফোটো তোলার একটু শখ। তাই এদিক-ওদিক অন্ধকার আকাশ খুঁজে বেড়াই। ঘরের কাছেই এমন ঘন গভীর আঁধারের সুযোগ পেয়ে মন আনচান করে উঠল।
কিন্তু যাই বললেই তো আর যাওয়া হয়ে ওঠে না। তারা দেখার দিনক্ষণ ঠিক করা চাই। অমাবস্যার সময় বা কৃষ্ণপক্ষে সবথেকে ঘন অন্ধকার হয়। চাঁদের আলো যতই কাব্যিক হোক না কেন ছায়াপথ, ও তারাদের একেবারে ম্লান করে দেয়। এ ছাড়াও চাই ভালো আবহাওয়া--মেঘ বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকলে তো সব কাজই মাটি। আজকাল আবার উত্তরে ক্যানাডা থেকে দাবানলের ধোঁয়া আকাশ আবছা করে ফেলেছে। আমাদের এখানে অবশ্য সেটা অনেক কম। এইসব দেখেশুনে একদিন দুর্গানাম করে বেরিয়ে পড়লাম।
পার্কটা আমাদের বাড়ি থেকে পাঁচ ঘণ্টার রাস্তা। এদেশে এটাকেই 'কাছে' বলে ধরা হয়। নেব্রাস্কা প্রদেশটা বিরাট। পুব থেকে পশ্চিম প্রান্তে ড্রাইভ করে পৌঁছতে সারা দিন লেগে যায়। পার্ক থেকে ত্রিশ মাইল উত্তরে ছোট্ট শহর--ভ্যালেন্টাইন--একমাত্র আলোর উৎস ও থাকাখাওয়ার জায়গা। গ্রীষ্মের শেষে ক্যাম্পিং-এর ভিড় কম। বিরাট লেক ও পার্কে জনমনিষ্যি নেই। তারা দেখার উৎকৃষ্ট সময়।
নতুন কোন জায়গায় গেলে আমরা সবসময় দিনের বেলায় ঠিক করে দেখে নিই কোথায় পার্ক করার ভালো জায়গা। নইলে ঘুটঘুটে অন্ধকারে খুঁজে পাওয়া ভীষণ মুশকিল। আশপাশে ত্রিশ মাইলের মধ্যে কোনো বাড়িঘর, রাস্তার আলো, উঁচু গাছ, টিলা বা টাওয়ার কিচ্ছু নেই, শুধু দিগন্তজোড়া খোলা আকাশ। এসব জায়গায়, জঙ্গলের মধ্যে না নেমে, একটা পারকিং লট বেছে নেওয়াই ঠিক করলাম। কিন্তু রাত দশটায় যখন ফিরে এলাম, দেখি আমাদের আগেই আরও দুটো গাড়ি এসে গেছে। সবাই আলো নিভিয়ে ছবি তোলায় মগ্ন। আমরাও চটপট গাড়ি অন্ধকার করলাম। ফোটো তোলার সময় বাইরের সব আলো নিভিয়ে রাখা উচিত। নইলে ক্যামেরার ছবি নষ্ট আর দর্শকের চোখও আলোয় ধাঁধিয়ে যায়। অন্ধকারে সইয়ে নিতে আবার পনেরো-কুড়ি মিনিট লাগে। তারপরেই ভালোভাবে তারা দেখা যায়।
অন্ধকারে চোখের সামনে নিজের হাতও দেখা যায় না। ক্যামেরা, ট্রাইপড ইত্যাদি সামলানো বেশ মুশকিল। তাই চাই টর্চ লাইট-- কিন্তু টর্চের মুখে একটা লাল রঙের সেলোফেন কাগজ মুড়ে নেবেন। লাল আলো ক্যামেরার ক্ষতি করে না , চোখও ধাঁধায় না। ক্যামেরা দাঁড় করিয়ে আকাশের দিকে তাকালাম। আমার প্রিয় ছায়াপথ! কত দিন দেখা হয়নি। শেষ দেখেছিলাম এক ঝলক, নেপালের এক গণ্ডগ্রামে, বাতি চলে গিয়েছিল, তাই বেশ অন্ধকার ছিল। দক্ষিণের আকাশে পুব থেকে পশ্চিমে চলে গেছে এক লম্বা নক্ষত্রপুঞ্জ।
আকাশগঙ্গা ছায়াপথ
মাথার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ঝরঝর আকাশগঙ্গা। হঠাৎ দেখলে মেঘ বা কুয়াশা বলে ভুল হতে পারে। কিন্তু উজ্জ্বল জ্যোতির্ময় কুয়াশা। এত লম্বা যে আমার সাধারণ ক্যামেরায় পুরোটা ধরে তোলা মুশকিল। তাও তো পুরো গ্যালাক্সিটার একটা ছোট্ট কোণ মাত্র। আমাদের পৃথিবীটা আকাশগঙ্গায় ছোট্ট একফোঁটা জল! ভাবলে খারাপ লাগে যে এই প্রজন্মের অনেক ছেলেমেয়েরা কখনো ছায়াপথ দেখেইনি। ইস! যদি সবাইকে এখানে নিয়ে আসা যেত!
মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি বা ছায়াপথের আশেপাশে আরও পুরনো বন্ধুদের দেখলাম। ক্যাসিওপিয়া, মঙ্গল আর বৃহস্পতি গ্রহ, নর্থ স্টার (পোলারিস বা ধ্রুবতারা), সপ্তর্ষি মণ্ডল (গ্রেট বেয়ার বা আরসা মেজর), মনে পড়লো ছোটবেলায় মুখস্থ করা ঋষিদের নামগুলো-- ক্রতু, পুলহ, পুলস্ত্য, অত্রি, অঙ্গিরা, বশিষ্ঠ ও মরীচি। বশিষ্ঠর পাশে ক্ষীণ তারা স্ত্রী অরুন্ধতী--তাঁকে খালি চোখে দেখার জন্য চাই কঠোর দৃষ্টিশক্তি।
সপ্তর্ষিমণ্ডল
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে দুএকটা প্লেন ও স্যাটেলাইটও চোখে পড়ে। আমার ক্যামেরায় একটা আবছা উল্কাও উঠে গেছিল। আমার কাছে কোনো টেলিস্কোপ বা অন্যান্য যন্ত্রপাতি নেই। আকাশের শোভা খালি চোখেই ভালো করে উপভোগ করা যায়। এত পরিষ্কার আকাশে সহজেই ছবি তোলা যায় সাধারণ ক্যামেরায়। শুধু ISO-টা বাড়িয়ে ৬৪০০ করে দিন আর ২৫-৩০ সেকেন্ড এক্সপোজার দিন। ব্যাস। তবে স্ট্যান্ড চাই। অতক্ষণ ক্যামেরা হাতে ধরে রাখা অসম্ভব।
গাড়ির পাশে দুটো ক্যাম্প চেয়ার বিছিয়ে বসে পড়লাম, গায়ে পাতলা চাদর, হাতে গরম কফি। একটা স্টার চার্ট পেলে আরও ভালো হতো, অন্য নতুন তারাদের নাম শিখতে পারতাম। (স্টার চার্ট যেকোন বইয়ের দোকানে বা অ্যামাজনে সস্তায় পাওয়া যায়।) আসছে বার মনে করে নিয়ে যেতে হবে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে মাথাটা একেবারে খালি হয়ে যায়। মনে হয় আমরা কত ছোট। এই ছায়াপথের কোটি কোটি তারার মধ্যে একটি নগণ্য তারার গ্রহমাত্র। আকাশগঙ্গার আলোর স্রোতে একবিন্দু জল। ভাবি এই নক্ষত্রশোভা কীভাবে আমাদের পূর্বপুরুষদের যুগে যুগে অনুপ্রাণিত করেছে। কত আলোকবর্ষ দূরের ওই ক্ষীণ তারার আলো লক্ষ হাজার বছর পুরনো! যখন সেটা যখন যাত্রা শুরু করেছিল, পৃথিবীতে তখন হয়তো ডাইনোসরদের রাজত্ব। মানুষের জন্মও হয়নি। এইসব বিরাট কল্পনায় দৈনিক ভাবনাচিন্তাগুলো মুছে যায়। মাথাটা পরিষ্কার হয়ে যায়। অনেকটা যোগব্যায়ামের মতই।
আমার গ্রহ, তারা, উল্কা, ধূমকেতু এসব দেখার খুব শখ। নিজস্ব টেলিস্কোপ নেই কিন্তু সাধারণ ক্যামেরাতেই ছবি তোলার চেষ্টা করি। আমার প্রথম ছবি ১৯৮৬ সালে হ্যালির ধূমকেতু Comet Halley। বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী স্যর এডমন্ড হ্যালির নামে এই ধূমকেতু সবচেয়ে ঐতিহাসিক ও পুনরাবৃত্তিকারী। প্রতি ৭৬ বছর অন্তর পৃথিবীর আকাশে এর আবির্ভাব। এই আবির্ভাবের সঙ্গে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা জড়িত। স্বভাবতই সেযুগে সবাই এটাকে অশুভ লক্ষণ বলে মনে কর। ঐতিহাসিক, চিত্রকর ও গ্রন্থকাররা লিখে গেছেন, এঁকে গেছেন। ১০৬৬ সালে নরমানদের ইংল্যান্ড আক্রমণের সময় এই ধূমকেতু দেখা গেছিল। পরে অটোমান ও মঙ্গোলদের যুদ্ধের সময়েও। এর আগামী আবির্ভাব ২০৬১ সালে। ততদিন তো আর বেঁচে থাকব না।তাই একটা ছবি তুলে রাখা দরকার--মেয়েদের ও নাতিনাতনিদের জন্য।
আমার কপাল খারাপ--সে বছর আমেরিকায় হ্যালি শেষরাত্রে একটুক্ষণের জন্য উদয় হয়েছিল--খুব আবছা আলো। (দক্ষিণ গোলার্ধে অস্ট্রেলিয়ায় বিরাট, উজ্জ্বল দেখা গেছিল।) তার ছবি তুলতে হলে চাই polar alignment tracker -- যার সাহায্যে ক্যামেরাটা আস্তে আস্তে ঘোরাতে হবে, পৃথিবীর axis-এর সঙ্গে সমান্তরাল হয়ে। না হলে তারা, ধূমকেতু সব ক্যামেরার ছবিতে লম্বা লাইন ফেলে দেয়। আজকাল ঐ জিনিশটা অটোম্যাটিক, সহজেই কিনতে পাওয়া যায়, ঐ সময় আমাদের হাতে বানাতে হয়েছিল--আমার এক astronomer বন্ধুর সাহায্যে।
তারপর, মার্চের এক হাড়কাঁপানো শীতের রাত্রে, অন্ধকারের খোঁজে, শহরের বাইরে, কোনো চাষির খামারে, ক্যামেরা তাক করে ছবি তুলছি। এক্সপোজার তিন থেকে পাঁচ মিনিট। অতক্ষণ সময় অন্ধকারে ধীরে ধীরে আন্দাজে ক্যামেরাটা ঘোরাচ্ছি-- খোলা মাঠে হু-হু ঠান্ডা হাওয়ায় আঙুল জমে অসাড়, চোখ দিয়ে জল পড়ছে, তাও কোনরকমে দু-একটা ভদ্রগোছের ছবি উঠে গেল।
ধূমকেতু হ্যালি
ওই ছবি একেবারে ঠিক খালি চোখে ধূমকেতুটা যেমন দেখেছিলাম। তখনকার দিনে কোন ডিজিটাল কারিগরি ছিল না। তবু একেবারে নিকষ অন্ধকারটা পাইনি। দিগন্তে বেশ আলো ছিল। আহা, তখন যদি মেরিট লেক-এর খবরটা জানতাম!
এইরকম আরেকটা ধূমকেতুর ছবি তুলতে পেরেছিলাম ২০২০ সালে। কমেট নিওয়াইজ (Neowise)। সেটা বেশ উজ্জ্বল ছিল। আবহাওয়াও অনুকূল। বাইনকুলার-এর সঙ্গে ক্যামেরা লাগিয়ে হাতে ধরে ছবি তুলতে পেরেছিলাম।
ধূমকেতু নিওয়াইজ
কিন্তু নিওয়াইজ আবার ফিরে আসবে না। হ্যালি-র মতো ঐতিহাসিকও নয়।
চন্দ্রগ্রহণের ছবি অনেক তুলেছি। প্রায় প্রতি বছরেই পূর্ণ বা আংশিক গ্রহণ হয়। চাঁদের আলো এত উজ্জ্বল যে অন্ধকার আকাশের দরকার পড়ে না। হাতে ধরা ক্যামেরায় অনায়াসে ছবি তোলা যায়। এই ছবিটা গতবছর মে মাসের পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ।
চন্দ্রগ্রহণ
সূর্যগ্রহণ অবশ্য আলাদা ব্যাপার-- চোখ বাঁচাবার জন্য ফিলটারের দরকার পড়ে।
সূর্যগ্রহণ
গতবার পূর্ণ সূর্যগ্রহণ হয়েছিল আমাদের এখানেই, ২০১৭ সালে। এত অন্ধকার হয়েছিল যে কয়েকটা তারা পর্যন্ত ফুটে উঠেছিল।
উল্কাপাত (meteor shower) আমার খুব ভালো লাগে। প্রতি বছর গরমের সময় পারসিড উল্কাপাত দেখতে বেশ মজার। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে রাত্তিরে জমিয়ে উল্কা পার্টি করি। কোন কোন বছর বেশ জোরদার। প্রতি পাঁচ মিনিটে দু-তিনটে উল্কা পর্যন্ত দেখেছি। অবশ্য এদের ছবি তোলা মুশকিল। ক্যামেরা খুলে রেখে প্রার্থনা করুন দুএকটা উল্কা যেন ধরা পড়ে যায়।
ঘুটঘুটে অন্ধকারে তারা দেখা বা ছবি তোলা খুব সহজ নয়। ক্যামেরার কারিগরি ছাড়াও কয়েকটি নিরাপত্তার ব্যাপারে সচেতন থাকা উচিত। (১) কোন অচেনা জায়গায় যেতে হলে আগে দিনের বেলায় দেখে নিন কোথায় পার্ক করবেন ইত্যাদি। (২) ভুল করে অন্ধকারে কারুর খেতখামারে ঢুকে পড়বেন না। এদেশের যা দস্তুর, হয়তো জিজ্ঞাসাবাদ না করেই গুলি চালিয়ে দেবে। (৩) সেলফোনে রিসেপশন চেক করে নেবেন। (৪) সঙ্গে সবসময় একজন সঙ্গী নেবেন। (৫) বনেজঙ্গলে যেতে হলে পোকামাকড়, সাপখোপ থেকে সাবধান। (৬) গাড়িতে যথেষ্ট পেট্রল রাখবেন। অন্ধকারে যেন গাড়ি অচল না হয়। (৭) আশপাশে অন্যান্য দর্শকদের ব্যাপারে সতর্ক থাকবেন। কারুর অন্য কুমতলবও থাকতে পারে। (৮) গাড়ি অন্ধকার রাখবেন ও লাল টর্চ-এর ব্যবহার করবেন। (৯) মশা ও পোকার জন্য স্প্রে সঙ্গে রাখবেন। (১০) সবশেষে আরাম করে আকাশ দেখার জন্য সঙ্গে হেলানো চেয়ার, হালকা কম্বল (রাত্তিরে ঠান্ডা পড়ে), স্টার চার্ট, ক্যামেরা, ট্রাইপড, ফ্লাস্কে গরম পানীয়--এসব নাহলে আর মজা কোথায়?
অন্ধকারে সবকিছুই অবশ্য ভয়ের নয়। এক বছর আমরা মাঝরাতে শহরতলির একটা পারকিং লট-এ দাঁড়িয়ে উল্কা গোনার চেষ্টা করছি। হঠাৎ একটা পুলিশের গাড়ি নিঃশব্দে এসে আমাদের পাশে দাঁড়ালো। আমার তো ভয়, এবার কী করলাম আমরা! কিন্তু দেখলাম গাড়ি থেকে নামলেন এক পুলিস অফিসার, হাতে বন্দুকের বদলে দূরবিন! তিনিও আমাদের মতই নক্ষত্রপ্রেমী। মাঝরাত্রে ডিউটি সেরে এসেছেন একটু অন্ধকারের খোঁজে।