অবোধ শৈশবে তুচ্ছ চুল নিয়ে আমাকে এভাবেই নানা তুতো সম্পর্কের বাক্যস্ফোটের সামনে পড়তে হয়েছিল। আমি চুনোবোড়ে মাত্র, আসল লক্ষ্য অনেকটা বাবা, কিছুটা মা। বামনে ঘরানায় পৈতের আগে ছেলেদের ন্যাড়া হওয়া নিষিদ্ধ। উকুনের পঙ্গপাল উপনিবেশের মৌরসিপাট্টা নিয়ে নিলেও নিয়ম বদলাবে না। উপায় একটাই — চুড়াকরণ। কিন্তু গরীব মধ্যবিত্তের সংসারে পৈতের আগে পৈতের সমতুল্য চুড়াকরণের খরচ সামলানো মহাদায়। অগত্যা পৈতে পর্যন্ত অপেক্ষাই বিধেয়। কিন্তু আমার বাবা সাহিত্যিক রতন ভট্টাচার্য চিরকালই অবিধেয় পথে হাঁটতে অভ্যস্ত। তাই বছর তিনেক বয়সে আমার বালসাফাই হলো কোনো এক হাজামখানায়। অথচ যার উস্কানিতে ঘটনাটা ঘটল তাঁর মাথায় দু-বার বাদে কোনোদিন নাপিত স্পর্শ পড়েনি। ওই দু-বারই-- পিতৃমাতৃদায়।
বাবা আজীবন নিজের চুল নিজেই কেটেছে।
বোধোদয়ের পর প্রথম প্রথম দেখতাম মা হেল্প করতো কিন্তু পরে দেখেছি বাবা একাই নরসুন্দরের দায়িত্বে অবতীর্ণ। সে দৃশ্য বেশ অভিনব। ড্রেসিংটেবিলের বড় আয়নার সামনে একটা ছোটো টুলে বাবা। পেছনে একটা আয়না হাতে দাঁড়িয়ে মা। কেশরাজ্যের সম্মুখ দেশ সামনের আয়নায় দৃশ্যমান। আর পেছনের ছবি মায়ের ছোটো আয়না মারফত বড় আয়নায় দৃশ্যমান। পুরো যেন ভৌত বিজ্ঞানের প্রতিফলন চ্যাপ্টারের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস। পেশাদারী ভঙ্গিতে বাবার হাতের চিরুনি আর কাঁচি চলছে ধীরে সুস্থে। গায়ে জড়ানো একটা ওয়ান পারপাস চাদরে ঝরে পড়ছে কুঁচো চুল। মাও পেন্ডুলামের মত বাবার সোচ্চার নির্দেশ অনুযায়ী ডাঁয়ে-বাঁয়ে, কখনো ঝুঁকে, কখনো সোজা দুলে চলেছে। বাবা চুলে কলপও করতো এইভাবেই। বাবার তিরিশ- পঁয়ত্রিশ বছরের ছবিতে দেখেছি ব্যাকব্রাশ করা চুল। পেছনদিক ফোলা ফোলা। একে বলে বাবরি কাট। আমি কোনোদিনই শৌখিন নয় কোনো কিছুতেই, তাই চুলের কাটফাটের ব্যাপারে কোনো দিনই মাথা ঘামাইনি। অন্য কিছুতে না হলেও চুল নিয়ে বাবার মাথাব্যথা ছিল। বাবাকে কিছুদিন চুলে ব্রিলক্রিম মাখতেও দেখেছি।
রাজেশ খান্না যুগে আমার জন্ম হলেও বোধ তৈরি হতে হতে কাকা যাব যাব করছেন। বাজারে এসে গেছেন বচ্চন সাব। আর কৈশোর পার করে যৌবনে যখন উঁকিঝুঁকি মারছি তখন হইহই আবির্ভাব বাঙালি মিঠুন দাদার। নরসুন্দর সমাজে কানচাপা বচ্চন ও মিঠুন দাদার ডিস্কো চুলের রমরমা। এইসব কাটিং-এ যিনি যত দড় তত তাঁর সেলুনের ক্রেজ। এখন চুলরাজ্যে অভিনেতাদের বোলবোলাও বিগত অতীত। চুলের ইতিহাসে এখন ফুটবল যুগ চলছে। একেকটা ফুটবল বিশ্বকাপ শেষ হয় আর ছেলেপিলেদের মাথার দখল নেয় কোনো না কোনো বিশ্বকাপারের চুলের স্টাইল। বিদঘুটে চুলের ছাঁট, যেন সবসময় দাঁত খিঁচোচ্ছে। কাটা চুলের মাঝেমাঝে ন্যাড়ামুন্ডি, তার গায়ে চিত্রবিচিত্র স্কাল্পট্যাটু। নাপিত বেচারাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। কাটিং-এ আপডুটেট না হলে হাতে কাঁচি, পকেট গড়ের মাঠ।
আমি অবশ্য সাধারণ বাটি বা ক্রু ছাঁটেই স্বচ্ছন্দ। আমার খালি একটাই চাহিদা ছিল, তখন এবং এখনও, সামনের চুল বেশ ছোটো করতে হবে। যাতে উড়ে চশমায় না এসে পড়ে। ছোটোবেলা থেকেই হাই-পাওয়ারের মোটা ফ্রেমের চশমার গয়না পছন্দ আমার চোখের। সেই গয়নার সামনেটা যেন চুলের ব্যারিকেডহীন, অবারিত থাকে, পরিচিত-অপরিচিত নাপিতের কাছে এই ছিল আমার দাবি। অবশ্য অপরিচিত, অপরীক্ষিত নাপিতের দরজায় জগতের কোন মানুষই বা যায়? চেনা ছকে হাঁটাই যে মানুষের স্বাভাবিক চরিত্তির তার এটা একটা পাথুরে প্রমাণ। আমার অবশ্য অচেনা নাপিতের হাতে মাথা সঁপে দেবার অভিজ্ঞতা হয়েছে আসামে মামার বাড়িতে। অনেকেই হয়তো বলতে পারেন, তোমার সঙ্গে পরিচয় না থাকলেও মামাদের তো ছিল বাপু। হক কথা। মামাদের পরিচয় ছিল, মুখ-পরিচয়, হাত পরিচয় অবশ্যই নয়। আর নাপিতের সঙ্গে হাত পরিচয়টাই তো মুখ্য। আসলে আমার মামারা টাক সাম্রাজ্যের প্রজা। তাই 'স্মৃতিটুকু থাক'-এর ভরসায় নাপিতের কাঁচির সংশ্রব থেকে তাঁরা চিরকাল দূরে থাকতেন। তা সেই অপরিচিত হাতে চুল কাটতে মজা তো লেগেই ছিল সঙ্গে বেজায় সুড়সুড়িও।
আমাদের গাঁ-ঘরের সেকালের সেলুন মানে ইট-য়ালিয়েনের দু-মিনিটের বড় যমজ ভাই। চিরুনি, কাঁচি আর ক্ষুর ছাড়া অন্য যন্ত্রের কসরত ছিল না। তাই আসামের গোলাঘাটে ঝাঁ-চকচকে কাঁচের দরজাওলা সেলুনে নরসুন্দরের হাতে ঘাস-ছাঁটা মোয়ার মেশিনের ন্যানো অবতার দেখে প্রায় চমকে চমৎকার, সঙ্গে এক চিলতে ভয়ও, ইঞ্জেকশন নেবার মত। এখন অবশ্য স্যাঁলো থেকে সেলুন এই ট্রিমারের একছত্র শাসন। তা যাইহোক, ঘাড়ে চলতে শুরু করল সেই মেশিন আর আমার ভয়মুক্ত সারা শরীর জুড়ে সুড়সুড়ির আমেজ। বেশ বুঝতে পারছি একথা শুনে একালের ঘোড়ারাও হাসতে শুরু করেছে। ভরসা এই তারা বোধহয় বালসাফ করে না।
একদিন মামাবংশের সূত্রে আমার আর একটা চুলিও অভিজ্ঞতার প্রাপ্তিযোগ ঘটল। একদিন কাটফাটা দুপুরে পাঁচলার ভাড়া বাড়ির দরজায় হঠাৎ ঠকঠক ঠক। দরজা খুলে দেখলাম এক অপরিচিত বেঁটেখাটো চশমা-পরা বয়স্ক স্মিত-মুখ। চিনতে পারলাম না, কিন্তু আমার সমস্ত দৃষ্টি টেনে নিল ভদ্রলোকের একমাথা ঝাঁকড়া কুচকুচে কালো চুল। আমার থতমত খাওয়া মুখ দেখে প্রথম কথাটা উনিই বললেন, 'কি রে মামা, চিনতে পারলি না? '
মুহূর্তের মধ্যে বুঝতে পারলাম বড়মামা। কেননা আমাকে 'মামা' বলে ডাকে শুধু বড়মামাই। কিন্তু মামার টাকে চুল! ততক্ষণে মাও এসে গেছে। ঘরে ঢুকে বড়মামা মাথার চুলের ঢাকনা সরাতে সরাতে বলল, 'ওহ্! এই গরমে এইসব মাথায় পরা যায়।'
সেই আমার প্রথম উইগ দেখা। এখন তো আবার উইগ নয়, গ্র্যাফটিং-এর যুগ। সহকর্মী অনুজ প্রশান্তর মাথায় সেই বাড়বৃদ্ধিহীন চুলের বহর আমার সামনে নিত্য দৃশ্যমান। প্রশান্তর বেশ মজা, ওয়ান টাইম ভারি ইনভেস্টমেন্ট যা হয়েছিল হয়েছিল, এই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বাজারে ওর নাপিত-খরচ লাগে না। বড়মামার উইগ বা অনেক পরে দেখা প্রশান্তর গ্রাফটেড হেয়ারের অন্দরকথা জেনেছিলাম অন্যভাবে, একজন বিখ্যাত মানুষের সঙ্গ উপভোগ করতে করতে একদিন, হঠাৎই।
বাবা বুধ আর শনিবার কলকাতায় যেত কে. সি. দাসে। বিমল কর ও তাঁর লেখক বন্ধুদের বিখ্যাত আড্ডায়। এক বুধবার বাড়ি ফিরে বলল, 'শনিবার বরেন আসবে। রাত্তিরে থাকবে।' বরেন — বরেন গঙ্গোপাধ্যায়। বরেন কাকু তখন কোনো কাগজ, 'আজকাল' বা 'প্রতিদিন'-এ একটা সাপ্তাহিক কলাম লেখেন বাংলার বিভিন্ন প্রান্তিক গ্রামীণ জীবিকা নিয়ে। পাঁচলা জরির কাজের জন্য বিখ্যাত। তাই সরজমিনে তথ্য সংগ্রহের জন্য কাকু শনিবার বাবার সঙ্গে এলেন আমাদের পাঁচলার বাড়িতে। কাকুকে ঘুরিয়ে দেখানোর ভার পড়ল আমার ওপর। কাকুকে নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরছি জরি কারখানাগুলোতে। কাকুর হাতে কোনো নোটবই নেই। শুধু প্রশ্ন করছেন, দেখছেন আর শুনছেন। খালপাড় দিয়ে সেপাই পাড়ায় ঢুকেই আমার মনে পড়ল এখানে তো কয়েক ঘর পরচুলের কারিগর আছেন। বেশি অবশ্য কিছুটা দূরে হাকোলার কুলাইয়ে। আমি কাকুকে তথ্যটা বলতেই কাকু লুফে নিলেন। বললেন, 'জরি তো অনেক দেখলাম, চলো পরচুলের কারবারটা দেখি।' তথ্যটা জানা থাকলেও আমি কোনো দিন এই উইগ তৈরির ব্যাপারে আগ্রহী হইনি। কাকুর সঙ্গে আমারও দেখা হল।
সেই তিরিশ বছর আগে টিভি, মোবাইল বা ইন্টারনেটহীন যুগে চুলের কোটি কোটি টাকার এই বিজনেসের খবর কে রাখত। সেই বয়স্ক পরচুলা কারিগর ও ব্যবসায়ী ধরে ধরে কত গল্পই না করলেন এই কাটা চুলের প্রসঙ্গে। মূল সাপ্লায়ার তিরুপতি মন্দির, শুধু চুল বেচে নাকি শ শ কোটি টাকা আয় করে প্রত্যেক মাসে। উনি আমাদের কাটা চুলকে প্রসেস করে কীভাবে উইগ বানানো হয় দেখালেন। স্পষ্ট করে না বললেও ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিলেন তাঁর আয়ও বেশ বেশ ভালো। বোধহয় দিন পনেরো বাদে বরেন গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই লেখা কাগজে প্রকাশিত হল। লেখায় জরির থেকে চুলের কথাই বেশি। শিরোনাম — "বাল ব্যবসা"।