• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯২ | অক্টোবর ২০২৩ | গ্রন্থ-সমালোচনা
    Share
  • ছেঁড়া পালে বুক ফুলিয়ে... : মৌসুমী ভট্টাচার্য্য

    সাদা থান থেকে সাদা অ্যাপ্রন— ধ্রুবজ্যোতি দে; সুশান্ত চট্টোপাধ্যায়; কলকাতা; প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০১৯

    "আমার হাত বান্ধিবি, পা বান্ধিবি, মন বান্ধিবি কেমনে..." শাহ্ আবদুল করিম যেন মেয়েদের মনের কথাটি জানতে পেরেছিলেন। টের পেয়েছিলেন শত শিকলে বাঁধা পড়া মেয়েদের ইচ্ছেডানার ঝাপটানি। তবে শেকল ভাঙার জেদ যার মনে, তাকে বেঁধে রাখবে সাধ্যি কার! উনিশ শতকের মেয়েদের পায়ে সমাজ পরিয়েছিল বড় মজবুত বেড়ি। সংস্কারের বাঁধন, সমাজের চোখ রাঙানি আর পুরুষের আধিপত্য তার পথকে দুর্গম করে তুলেছিল। আজ ফিরে তাকালে মনে হয় কী কঠিনই না ছিল সেদিন মেয়েদের পথচলা। স্বপ্ন দেখার বিলাসিতা তার জন্যে নয়। জানলার গরাদে চোখ রেখে এক চিলতে আকাশের খোঁজে হারিয়ে যেত সে মেয়ে। নীরবে, অনাদরে। এ পৃথিবীতে এসে যেন অপরাধ করে ফেলেছে সে। বড় ফেলনা তার অস্তিত্ব। অকারণ তার দিন যাপন। তারই মধ্যে যে দু-চার জন মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার পথ খুঁজতে চেয়েছিল, চার দেয়ালের বাইরে প্রতিষ্ঠা করেছিল আত্মপরিচয়, তাদেরই একজন হৈমবতী সেন।

    শৈশবের খেলনা বাটি নামিয়ে রেখেই আচমকা বিয়ে, আর বছর না ঘুরতেই শুরু বৈধব্যের আচার বিচার। দীর্ঘ চড়াই উৎরাই পেরিয়ে বাল্য বিধবা হৈমবতী হয়ে ওঠেন ডাক্তার হৈমবতী সেন। কাদম্বিনী গাঙ্গুলী কিংবা আনন্দীবাঈ জোশীর মতো মসৃণ ছিল না সে পথ। জীবনের প্রান্তে এসে একখানা লাইন টানা খাতায় লিখতে বসেন নিজের জীবনযুদ্ধের কাহিনী। লিঙ্গবৈষম্য, জাতিবৈষম্য এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সঙ্গে অসম লড়াইয়ের ইতিকথা উজাড় করে লিখে গেছেন তাঁর সেই খাতায়। এ যেন তাঁর সামাজিক দায়বদ্ধতা। আড়ালেই ছিল, হয়তো চিরকাল চাপাই পড়ে থাকত সেই খাতা কেজো অকেজো কাগজের নীচে। সৌভাগ্য আমাদের, তাঁর নাতনি নমিতা দে এই পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করে তুলে দিয়েছিলেন ইতিহাসবিদ জেরাল্ডিন ফোর্বস-এর হাতে। সেটিকে ইংরেজি তর্জমা করে, বলা ভাল, সাহিত্যানুবাদ করে এবং প্রাসঙ্গিক ভূমিকা ও তথ্যসহযোগে ২০০০ সালে 'দি মেমোয়ার্স অফ ড: হৈমবতী সেন: ফ্রম চাইল্ড উইডো টু লেডি ডক্টর' নামে প্রকাশ করেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক তপন রায়চৌধুরী। হৈমবতীর মূল বাংলা লেখাটি দুষ্প্রাপ্য। অধ্যাপক রায়চৌধুরীর ইংরেজি বইটিও সজজলভ্য নয়। তবু এই ইংরেজি বইটির অনুসরণে হৈমবতী সেন-এর জীবনের কথিকা লিখেছেন ধ্রুবজ্যোতি দে। বইয়ের ভূমিকায় ধ্রুবজ্যোতি লিখছেন, "আমি নিজে অবশ্য সম্পূর্ণ ইংরাজী বইটিকে পুনরায় বাংলায় অনুবাদের কথা ভাবিনি। কারণ, প্রথমত, এমন ফিরতি অনুবাদে হৈমবতীর আঞ্চলিক ভাষায় লেখা মাটির গন্ধমাখা ঘর গেরস্থালীর বাংলাকে অনুধাবন করা যাবে না। দ্বিতীয়ত, হৈমবতীর আত্মকাহিনীর মধ্যে কতিপয় ঘটনার এমন আনুপূর্বিক রোমাঞ্চকর বর্ণনা রয়েছে যার অনাবশ্যক সন্নিবেশ আমাদের দৃষ্টিবিক্ষেপ ঘটিয়ে দিতে পারে। সেইসব বর্ণনা হয়তো রচনাটিকে শিথিল করে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে তাঁর জীবন দর্শন উপলব্ধিকেও।" লেখক রোমাঞ্চকর বর্ণনার প্রলোভন এড়িয়ে আঁটোসাটো একখানি জীবনকাহিনী উপহার দিয়েছেন আমাদের। চমৎকার তার শিরোনাম; সাদা থান থেকে সাদা এপ্রন। হৈমবতীর জীবনের প্রত্যেক পর্বকে সময়ের বন্ধনীতে এবং পৃথক শিরোনামে চিহ্নিত করে লেখক এক মূল্যবান দলিল রচনা করেছেন। অচেনাকে চেনার এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হবেন পাঠক, তাতে বিন্দুমাত্র সংশয় নেই।

    ১৮৬৬ সাল। অবিভক্ত বাংলার খুলনা জেলায় জমিদার প্রসন্ন কুমার ঘোষের প্রথম সন্তান জন্মাল। কন্যা সন্তানের জন্মে বাড়ির বাকিরা অখুশি হলেও প্রসন্ন কুমারের আনন্দের সীমা নেই। খুশিতে একমাস ধরে গানের আসর চলল। আর সেই সঙ্গে তিনি ঘোষণা করে দিলেন মেয়ে বলে তার সন্তানকে কেউ অবহেলা করলে সে জমিদারির সাহায্য থেকে বঞ্চিত হবে। মেয়ের নাম রাখলেন চুনীবাবু। ভাল নাম হৈমবতী। পুত্রসন্তান লাভের সুপ্ত বাসনা, নাকি কন্যাকে পুত্রসম বড় করার ইচ্ছে, কীসের জন্যে মেয়ের নামে এমন পুরুষত্ব আরোপ! জানা নেই। বাবার আস্কারায় চুনীবাবু বাড়ির ভিতরে বাইরে বাধাহীন ঘুরে বেড়ায়। ছেলেদের পোশাক পরানো হয় তাকে। বাড়ির ছেলেরা স্কুলঘরে যা পড়াশোনা শেখে, চুনীবাবু তা শুনে শুনেই শিখে ফেলে। ছেলেরা যে পড়া বলতে পারে না, হেম তা বলে দেয়। তার এই মেধা ও স্মরণশক্তি দেখে, একবার ইন্সপেক্টর সারদাবাবু প্রসন্ন কুমারকে অনুরোধ করেন হেমকে লেখাপড়া শেখাতে। সানন্দে রাজি হন প্রসন্ন কুমার। বাড়ির সবার অজান্তে গুরুমশাইয়ের কাছে হেম-এর লেখাপড়ার শুরু। তখন সমাজে স্থির বিশ্বাস ছিল, লেখাপড়া শিখলে মেয়েরা বিধবা হয়। প্রসন্ন কুমার সে কথা বিশ্বাস না করলেও বাড়ির মেয়েরা সে বিশ্বাসে অনড়।

    এদিকে লেখাপড়া শিখতে পেয়ে হেম-এর খুশির অন্ত নেই। সে শুভঙ্করী গণিত অবধি শিখে ফেলেছে কদিনেই। রামায়ণ, মহাভারত পড়ে সে গুরুমশাইয়ের প্রশংসা পায়। ঠাকুমাকে একদিন তা পড়ে শোনাতে গেলে জানাজানি হয়ে যায়। মেয়েমানুষ লেখাপড়া শিখেছে! এ মেয়ে বিধবা হবে, জাত যাবে ওর জন্যে। হেম এগিয়ে চলে, ডুবে থাকে পড়াশোনায়। ইন্সপেক্টর তার পরীক্ষা নেন। পরীক্ষায় তার ফলাফল দেখে ইন্সপেক্টর তাকে দুটো বই, মাথায় দেওয়ার রূপোর ফুল, আয়না আর চিরুনী পুরস্কার দেন। সেই সঙ্গে বলেন "লেখাপড়া শিখলে এ মেয়ে মহীয়সী হবে। কিন্তু ওকে সে সুযোগ কেউ দেবে না"। বড় তাড়াতাড়ি ফলে গেল ভবিষ্যৎবাণী। ইন্সপেক্টরের কাছ থেকে পাওয়া পুরস্কারই তার কাল হল। বাইরের লোকের কাছ থেকে উপহার এনেছে এ মেয়ে! কী ভীষণ লজ্জার কথা! লোকে জানলে এ মেয়ের বিয়ে হবে! অতএব তড়িঘড়ি তার জন্য পাত্র খোঁজা শুরু হল। হেম মজে আছে গুরুগিরিতে। উনুনের ভুষোকালি গুলে সরকাঠি দিয়ে কলাপাতার ওপর তার খুড়িকে লেখা শেখাতে ব্যস্ত সে। জানাজানি হতে খুড়ির কপালে জুটল গঞ্জনা। আর সেই সঙ্গে শুরু হল হেম-এর মাথা থেকে লেখাপড়ার ভূত তাড়ানোর প্রবল তোড়জোড়। দশ বছরের হেম-এর জন্য বছর পঁয়তাল্লিশের এক পাত্র স্থির হল। যশোরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, আগে দুই স্ত্রী প্রয়াত, দুই কন্যার পিতা। কন্যারা হেমের প্রায় সমবয়সী। আদরিণী চুনীবাবু এমন পাত্রের তৃতীয় পক্ষ হবে ভেবেই মুষড়ে পড়লেন প্রসন্ন কুমার। কিন্তু পরিবারের চাপের কাছে হার মানতে হল তাঁকে। অথচ ১৮৬১ সালের পেনাল কোড অনুযায়ী ১০ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে নিষিদ্ধ ছিল এবং ব্রাহ্মদের ক্ষেত্রে বিয়ের ন্যূনতম বয়স ছিল ১৪ বছর। তাই প্রসন্ন কুমারের কাছ থেকে এই অবিবেচকের কাজটি প্রত্যাশিত ছিল না।

    শুরু হল হৈমবতীর দুঃসহ বৈবাহিক জীবন। বিকৃতকাম স্বামী ডুবে থাকেন নারী ও সুরায়। বারবণিতার অবাধ যাতায়াত অন্দরমহলেও। আতঙ্কে মাঝে মাঝেই মূর্চ্ছা যায় হেম। বছর না ঘুরতেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন হেম-এর স্বামী। ১১ বছর বয়সে বিধবা হয়ে হেম বাপের বাড়ি ফিরে আসে। শুরু হয় কঠিন পথ চলা। বাপের বাড়িতে আবার পড়াশোনা শুরু করল সে। তার পড়াশোনা বন্ধ করতে আবার তাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিল তার ঠাকুমা। শ্বশুরবাড়ি, বাপের বাড়ি, কোথাওই যেন আর ঠাঁই নেই তার। নেই কোন কদর। ইতিমধ্যে মারা গেছেন প্রসন্ন কুমার। মেয়ের জন্যে বরাদ্দ করে গেছেন মাসোহারা এবং জমিজমা। কিন্তু সে না পেল শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি, না বাপের বাড়ির। শ্বশুরবাড়ির তরফের মাত্র দশ টাকা মাসোহারা সম্বল করে হেম চলল বৈধব্যের বারানসীতে। কাশীবাসী হল হেম। বিধবাদের কাশীবাসী করার পিছনে সমাজতাত্ত্বিকরা যে অভিসন্ধিগুলি লক্ষ্য করেন তার মধ্যে প্রধান হল শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি থেকে বিধবাদের বঞ্চিত করা। হেম-এর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না।

    দূর সম্পর্কের এক দিদির ঠিকানা হাতে নিয়ে কাশী পাড়ি দিলেও তার ঠাঁই হল না সেখানে। অগত্যা ঘর ভাড়া নিয়ে কোনমতে মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করা। আসবাব বলতে পায়া ভাঙা এক খাটিয়া। লেখক বলছেন "কাশীতে পুজো বা ব্রতর পর মেয়েরা মাটির তৈরী শিবলিঙ্গগুলি পথের ধারে ফেলে যেতেন। হৈমবতী তার কয়েকটি তুলে এনে খাটিয়ার পায়া করলেন।" হেম তার আত্মকথায় মজা করে লিখেছেন "সকলে শিবলোকে যাবার জন্য শিবপুজো করেন আর শিবঠাকুর নিজে মাথায় করে আমাকে শিবলোকে নিয়ে যাবেন।" এ তো কেবল মস্করা নয়। আভাস পাই, সংস্কারহীন একটা মন তৈরী হচ্ছে কিশোরী হৈমবতীর। ইতিমধ্যে মাসোহারা বন্ধ হয়ে গেল তার। চরম দারিদ্র্যে অনাহারে দিন কাটে, তা-ও কারো কাছে হাত পাতা তার স্বভাবে নেই। তার দুরবস্থা দেখে প্রতিবেশী ভূবনমোহিনী দেবী তাঁর শ্বশুর মশাইয়ের প্রতিষ্ঠিত স্কুলে শিক্ষিকার কাজ নিতে অনুরোধ করেন। রাজি হলেন হেম। মাসিক দশ টাকা বেতন। কিছু প্রবীণ শিক্ষকের বিরূপ মন্তব্য সহ্য করতে হলেও, বাকি শিক্ষক এবং অভিভাবকরা তাঁকে সাদরে গ্রহণ করেন। একসময় তাঁর মনে হয় আরো পড়াশোনা করে পরীক্ষায় পাশ করলে আরো ভালভাবে পড়াতে পারবেন। স্কুলের পরিচালন সমিতিকে এই ইচ্ছের কথা জানালে, সমিতির এক সদস্য কলকাতার ব্রাহ্ম নেতা শিবনাথ শাস্ত্রী এবং দূর্গামোহন দাস-এর উদ্দেশে দুটি চিঠি লিখে দেন। সেই চিঠি দুটি আর নিজেকে সম্মানজনকভাবে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন নিয়ে অনিশ্চিতের পথে পাড়ি দিলেন হৈমবতী।

    ১৮৮৮ সাল। এসে উঠলেন কলকাতার ব্রাহ্ম বিধবা নিবাসে। দেখা হল না দুজনের কারোর সঙ্গেই। তাঁরা তখন ইংল্যান্ডে। হাল ভাঙা নৌকোর মতো ভেসে বেড়ান তিনি, কলকাতা থেকে নারায়ণগঞ্জ, সেখান থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে ফের কলকাতা। হিন্দু থেকে ব্রাহ্ম, এক পরিবার থেকে আরেক পরিবারের আশ্রিতা হয়ে। কোথাও একটু স্নেহ, কোথাও নিগ্রহ, কোথাও অশালীন প্রস্তাব। পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলেন হেম। দিন যাপনের গ্লানি তাঁকে আরো জেদি করে তোলে।

    একসময় ঢাকার ব্রাহ্ম নেতা নবকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন হৈমবতী। মিলেও যায় আশ্রয়। অত্যন্ত মানবিক ও স্নেহশীল নবকান্তবাবু কন্যাসম আগলে রাখেন হেমকে। তাঁর সান্নিধ্যে থাকাকালীনই তিনি ব্রাহ্ম আচার্য নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, সীতানাথ তর্কভূষণ, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ও সুন্দরী মোহন দাসের মতো সম্মানীয় মানুষদের সংস্পর্শে আসেন। ফলতঃ হৈমবতীর চিন্তাভাবনা ও জীবন দর্শনে স্বচ্ছতা আসতে থাকে। লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে। এই জেদ নিয়ে এবার ঢাকা থেকে কলকাতায় এসে ব্রাহ্ম নিবাসে উঠলেন। কিন্তু তেমন কোন সুযোগ না পেয়ে কিছুটা হতাশ হয়েই ব্রাহ্ম ধর্ম প্রচারক কুঞ্জবিহারী সেনকে বিয়ে করেন। তাবড় ব্রাহ্মনেতাদের উপস্থিতিতে সে বিয়ে সম্পন্ন হল। কিন্তু বাউণ্ডুলে কুঞ্জবিহারী কেবলই বেরিয়ে পড়েন পথের টানে। সংসারের দায়দায়িত্বে তার মন নেই। নেই কোন রোজগারও। কুঞ্জবিহারী পূর্ণসময়ের ধর্মপ্রচারক। আর ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন হেম-এর। ক্যাম্পবেল মেডিকেল স্কুলে ভর্তির প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন হৈমবতী। প্রথম বাংলা মেডিকেল জার্নাল 'ভিষক দর্পণ'-এর সম্পাদক ডা: দেবেন্দ্রনাথ রায় তাঁকে যারপরনাই সাহায্য করেন। ২৫ বছর বয়সী হৈমবতী ক্যাম্পবেল প্রবেশিকা পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করলেন।প্রথম হলেন স্বর্ণলতা মিত্র, তৃতীয় ইদেন্নিসা বিবি। ১৮৯১ সাল। শুরু হল হৈমবতীর ডাক্তারী পড়া। মাসিক সাত টাকা বৃত্তি, সঙ্গে ডাফরিন ফান্ডের বৃত্তি। কী গভীর নিষ্ঠায় শত বাধা অতিক্রম করে হেম ডাক্তারি বিদ্যা আয়ত্ব করেছেন, তা গল্পের মতো শোনায়। হেম শ্রুতিধর। অন্য দুই বান্ধবী ক্লাসে পড়া মুখস্থ করে, বেঞ্চে মাথা রেখে শোনে হেম। তৈরি হয়ে যায় তার পড়া। ক্লাসের পড়া বুঝতে না পারলে, প্রধান মেট্রন মিসেস রোবস্-কে অনুরোধ করতেন আগে হাসপাতালে আসার জন্যে। তিন বন্ধু পালা করে মিসেস রোবস্-এর প্রাতরাশ বানিয়ে আনতেন। মেডিকেল ডিস্পেন্সিং থেকে ধাত্রীবিদ্যা, শব ব্যবচ্ছেদ থেকে সার্জারি, সবেতেই দক্ষ হয়ে ওঠেন হেম।

    এবার এল পরীক্ষার সময়। আট মাসের গর্ভবতী হেম। পরীক্ষক ডা: ব্যাঙ্কট কোন মেয়ের পরীক্ষা নিতে নারাজ। হেম বৃত্তিপ্রাপক, ভাল ছাত্রী, তা শোনার পরেও না। শেষে রাজি হলেন বটে, তবে অত্যন্ত কঠিন যাচাই পর্ব ও প্রশ্নবাণের বৈতরণী পার হতে হল হেমকে। শুধু মেয়ে বলেই এই বৈষম্য। পরীক্ষার শেষে যদিও পরীক্ষক খুশি হয়ে হেম-এর পিঠ চাপড়ে দেন। ফল প্রকাশের পর দেখা গেল পরীক্ষায় প্রথম হয়েছেন হৈমবতী সেন। কিন্তু বৈষম্য তো পিছু ছাড়ে না। কোনো মেয়ে স্বর্ণপদক পাবে, সহপাঠি ছেলেদের পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন বৈকি! হৈমবতীর কথায় "তাঁরা ধর্মঘট করলেন, কলেজ অবরোধ করলেন, যে সব মেয়েরা কলেজে আসছিলেন, তাদের গাড়িতে ঢিল পাটকেল ছুঁড়তে শুরু করলেন ... খবরের কাগজে কেউ কেউ চিঠি লিখলেন মেয়েদের এভাবে মাথায় তোলা ঠিক হয়নি।" বিষয়টি লেফটেন্যান্ট গভর্নর পর্যন্ত গড়িয়ে গেল। তিনি ডেকে পাঠলেন হৈমবতীকে। কয়েকদিন বয়সের পুত্রসন্তানকে কোলে নিয়ে হেম দেখা করলেন গভর্নরের সঙ্গে। গভর্নর জানতে চাইলেন হেম স্বর্ণপদকের পরিবর্তে কী আশা করেন। অভাবের সংসারে স্বর্ণপদক নিয়ে কী বা হবে! পরিবর্তে তাই হেম চাইলেন বিনা খরচে মেডিকেল কলেজে পড়ার সুযোগ। সানন্দে তা মঞ্জুর হল। মাসিক ত্রিশ টাকা বৃত্তি, রৌপ্য পদক এবং যাতায়াতের ব্যবস্থা-সহ কলকাতা মেডিকেল কলেজে পড়ার অনুমতি দেওয়া হল তাঁকে। অনেক বৈষম্যের সাক্ষী উনিশ শতক। তবে মেয়ে বলে তার পদক ছিনিয়ে নেওয়া হল, এমন কথা হৈমবতী কলম না ধরলে আমাদের অজানাই থেকে যেত বোধ হয়।

    এদিকে চাকরি না করে স্ত্রী আবার পড়াশোনা করবেন শুনে ক্ষিপ্ত হলেন কুঞ্জবিহারী। তবে মাসিক বৃত্তির টাকার অঙ্কটা শুনে তিনি খুশি হলেন। বৃত্তির সব টাকা উপার্জনহীন স্বামীর হাতে তুলে দিয়ে হেম বাস্তবিকই পরনির্ভরশীল হয়ে জীবন কাটান। এমনকি সামান্য একটা শাড়ি কেনার জন্যেও তাঁকে স্বামীর কাছে হাত পাততে হয়। অবিবেচক ও আত্মকেন্দ্রিক কুঞ্জবিহারী বারে বারেই সংসার ছেড়ে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। একা হাতে সংসার ও সন্তানদের সামলে ১৮৯৪ সালে, হৈমবতী সাফল্যের সঙ্গে এল এম এস (লাইসেন্সিয়েট ইন মেডিসিন এন্ড সার্জারি) পাশ করলেন। তবে ম্যাট্রিক না হওয়ায় তাঁকে হসপিটাল এসিস্ট্যান্ট হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হল। তাঁর এই সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে লর্ড ডাফরিন রৌপ্য পদক, লর্ড এলগিন রৌপ্য পদক এবং অন্য এক বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত করা হল।

    জীবনভর কেবল বৈষম্যের পাহাড় ডিঙিয়ে চলেছেন হেম। ডাক্তারী পাশ তো করলেন। কিন্তু তাঁকে কাজ কে দেবে! সরকারি হাসপাতালগুলোয় শুধু পুরুষ ডাক্তাররাই চিকিৎসা করেন। কেবলমাত্র ডাফরিন মহিলা হাসপাতালে ইউরোপীয় মহিলা ডাক্তাররা চাকরি পেতেন। হৈমবতীর মতো ডিপ্লোমাধারী ডাক্তারদের নির্ভর করতে হতো পসারওয়ালা পুরুষ ডাক্তারদের ওপর। কাজ পেতে গেলে তাদের কাছে তদ্বির করতে হত। হেম সে পথে হাঁটার পাত্রী নন। ইতিমধ্যে কুঞ্জবিহারী এলেন চুঁচুড়ায় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাগানবাড়িতে। আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভের আশায়। হেমও সঙ্গে এলেন। তবে গন্তব্য এক হলেও উদ্দেশ্য আলাদা। তিনি এলেন অসুস্থ সন্তানের হাওয়া বদলের এবং আরোগ্যের আশায়। চুঁচুড়ার লোকজন ক্যাম্পবেল ডাক্তার হৈমবতীকে ওখানেই প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে অনুরোধ করেন। কিন্তু বাধ সাধলেন কুঞ্জবিহারী। সরকারি হাসপাতাল ছাড়া স্বামী অনুমতি দেবেন না। মেনে নেন হেম। অবশেষে জেলার সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের উদ্যোগে তহবিল গড়ে, কিছুটা সরকারি সাহায্যে এবং কিছুটা মহসিন তহবিলের অনুদানে ১৮৯৪ সালে গড়ে উঠল হুগলী ডাফরিন উইমেন্স হাসপাতাল। হাসপাতালের দায়িত্ব নিয়ে হৈমবতী সপরিবারে কোয়ার্টারে এসে উঠলেন। কলকাতার ডাফরিন হাসপাতালের লেডি ডাক্তাররা যেখানে চার-পাঁচশ টাকা বেতন পেতেন, হৈমবতী পেলেন চল্লিশ টাকা। দুবছর পর তা বেড়ে হল পঞ্চাশ টাকা। পরবর্তী ষোল বছর এই একই বেতনে হেম কাজ করেছেন। এমন আর্থিক বৈষম্যের উদাহরণ হেম-এর কর্মজীবনে ভূরি ভূরি। সংসার চালাতে প্রাইভেট প্র্যাকটিসও করতে হয় তাঁকে। 'স্বনির্ভর ব্রাহ্ম মহিলা' হতে চেয়েও উপার্জনের সব টাকা স্বামীর হাতে তুলে দিয়ে হেম 'স্বামী-নির্ভর হিন্দু নারী' হয়ে রইলেন। চার পুত্র ও এক কন্যা ছাড়াও হেম-এর পোষ্যের অভাব নেই। হাসপাতালে কোন দুস্থ রোগিনী মারা গেলে কম করে দু-তিনটি শিশু অনাথ হয়। তারা আশ্রয় পায় হেম-এর ঘরে। একদিন আশ্রিতার জীবন কাটিয়েছেন বলেই হয়ত আশ্রয় দিতে তার কোন কার্পণ্য নেই। এ যেন সমাজকে তার প্রতিদান। স্বামীকে লুকিয়ে বাড়তি কাজ করে টাকা রোজগার করতেন দুঃস্থদের পাশে দাঁড়াবেন বলেই। দিন দিন স্বামীর দুর্ব্যবহার ও ঔদ্ধত্যে ঘরে বাইরে হেনস্তা হতে হয়েছে তাঁকে। মুখ বুজে তা সহ্য করেছেন হেম। ১৯০২ সালে মারা গেলেন কুঞ্জবাবু। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে আর একবার বিধবা হলেন হৈমবতী। ছেলেমেয়েদের বড় করা, সমাজসেবা আর ডাক্তারি, এই তখন তাঁর জীবনের ধ্যানজ্ঞান।

    তবে হৈমবতী তাঁর কর্মজীবনের শেষটুকু আমাদের জানিয়ে যাননি। হয়ত বা বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে ক্লান্ত হেম কলম বন্ধ করেছেন, অভিমানে, বিতৃষ্ণায়। তাঁর বংশধররা জানিয়েছেন ১৯১০ সালে ইউরোপীয় এক পুরুষ সিভিল সার্জেন হাসপাতাল পরিদর্শনের নাম করে রোগিনী দেখার ঘরে ঢুকে পড়তেন। প্রতিবাদ করেন হেম। স্বভাবতই বিরোধ বাধে তাঁর সঙ্গে। যে হেম এতদিন স্বাধীনভাবে হাসপাতাল চালিয়েছেন, এখন প্রশ্ন ওঠে তারই কর্তৃত্বের প্রকৃত অধিকার নিয়ে। এর ফলস্বরূপ, হাসপাতালটি ডাফরিন তকমা হারায়। কর্মচ্যুতি ঘটে হূগলীর প্রথম মহিলা ডাক্তার হৈমবতী সেন-এর। হাসপাতালের কোয়ার্টার ছেড়ে তিনি বাসাবাড়িতে ওঠেন। অল্পস্বল্প প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে সংসার খরচ চালান। দিন যায়। ছেলেরা যে যার মতো প্রতিষ্ঠিত হয়ে চলে যায়। পড়ে থাকেন হৈমবতী। একাকীত্বকে সঙ্গী করে। মেজো ছেলে আত্মজ্যোতি ডাক্তার হন। তিনি শেষ বয়সে মার দেখাশোনা করেন। ১৯৩৩-এ ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে চলে গেলেন হৈমবতী। রেখে গেলেন এক সাধারণ মেয়ের অসাধারণ হয়ে ওঠার আখ্যান।

    ১৯২০ সালে হঠাৎই নিজেকে ফিরে দেখার শুরু। আত্মকথন তো নয়, যেন এক উপন্যাস। সজীব স্মৃতির খেয়া বেয়ে নোঙর করেছেন ফেলে আসা জীবনের এক একটি ঘাটে। লড়াই তাঁর ভবিতব্য। ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ববাদ, বর্ণবৈষম্য এবং প্রাতিষ্ঠানিক পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে ক্রমাগত তিনি লড়ে গেছেন। তাঁর অনুপুঙখ আত্মকথন এবং নিখুঁত সাল তারিখের উল্লেখ আমাদের অবাক করে। অত্যন্ত বলিষ্ঠ, রাখঢাকহীন এবং নির্মোহ তাঁর লেখনী। উনিশ শতকের শেষে কিংবা বিশ শতকের গোড়ায় লেখা মহিলাদের আত্মজীবনীর ধারার সঙ্গে এর মিল খুঁজে পাওয়া ভার। লেখক ধ্রুবজ্যোতিও মুল বই-এর ধাঁচেই এই জীবন কাহিনী রচনা করেছেন। এই বইতে বাড়তি পাওনা হল হৈমবতীর জীবন প্রবাহের সঙ্গে সম্পৃক্ত সমসাময়িক ঘটনাবলীর সমান্তরাল উল্লেখ। 'সময়ের কথা' শিরোনামে টীকা সংযোজন করে বইটির ঐতিহাসিক মুল্য অনেক বাড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। পরিশিষ্টে দিয়েছেন ব্রাহ্ম আচার সংক্রান্ত নানান তথ্য। যদিও এই সংযোজন হৈমবতীকে জানার ক্ষেত্রে বিশেষ প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয় না। লেখককে ধন্যবাদ এমন এক ব্যতিক্রমী নারীর সঙ্গে পাঠকের পরিচয়ের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। পাঠকের মনে এই পরিচয়ের রেশ থেকে যাবে পাকাপাকি ভাবে, হলফ করে বলতে পারি সে কথা।

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments