মালিনী আদুরে গলায় বলল, “আমি ডায়ানা পামার সাজব আর তুই বেতাল, ফ্যান্টম… ঠিকাছে? জানিস তো ফ্যান্টম আমার ছোটবেলার ফ্যান্টাসি, ফার্স্ট ক্রাশ। কিলাউইয়ের বেলাভূমি, খুলিগুহা… যদি কোনওদিন যেতে পারতাম!”
আমি মালিনীকে তীক্ষ্ণ চোখে জরিপ করে বললাম, “তোকে মানাবে না।”
মালিনীর বোধহয় অভিমান হল। সে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, “আমাকে কি এতই খারাপ দেখতে?”
আমি তাকে আশ্বস্ত করে বললাম, “না, না, তা নয়। তোকে পুরো রানির মত দেখতে। আমি নামটার কথা বলছি, ডায়ানা, ডায়ানা …”
মালিনী বলল, “কেন? নামটা আবার কী দোষ করল?”
আমি বুঝিয়ে বললাম, “দেখ, আমি চিরকালই বেতালা, আমার জন্য বেতাল নামটা বেশ লাগসই হবে। কিন্তু ডায়ানা শুনলেই আমার কেমন… আচ্ছা, ধর ডায়ানাকে যদি কেউ ভালবেসে ‘ডাইনি’ বলে ডাকে তুই কি রাগ করবি?”
মালিনী আমায় থামিয়ে দিয়ে বলল, “থাক, কাউকে আর অত ডাকাডাকি করতে হবে না।”
ফেলাইন পার্টি থেকে ফেরার পর থেকে মালিনীর সঙ্গে ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। অফিসের বাইরে ক্যাফে-ট্যাফেতে আমাদের মাঝেমধ্যেই দেখা-সাক্ষাৎ হচ্ছিল। আজকে অবশ্য মাছের বাজারে আচমকা দেখা হয়ে গেছে। মাছের বাজার বললে কাদা প্যাচ-প্যাচে হট্টমেলার যে ছবিটা কল্পনায় আসে মলের ‘লাইভ ফিস কর্নার’ তার থেকে অনেক আলাদা। এসি হলে দু’-জন স্মার্ট চেহারার ছেলে একটা ঘুরন্ত কাঁটাওলা মেশিনে আঁশ ছাড়িয়ে, কাটারি দিয়ে কেটেকুটে মাছ বিক্রি করে। মাছ কাটার আগে জিজ্ঞেস করে নেয়, ‘বেঙ্গলি কাট’ হবে কি না। মানে গাদা-পেটি করে কাটবে নাকি গোল-গোল চাকা-চাকা! তাদের সাজপোশাক হাবভাব দেখলে নিজের রবিবারের সকালের পাজামা-পাঞ্জাবি পরা ক্ষীণজীবী চেহারার প্রতি প্রচণ্ড অভক্তি হয়।
মালিনী অবশ্য মেছো ছোকরাদের চালিয়াতির খুব একটা তোয়াক্কা করে বলে মনে হল না। ধমক দিয়ে বলল, “আরে ভাই, তুমলোগ থ্যাঁতলাকে থ্যাঁতলাকে কিঁউ মছলি কাটতা হ্যায়? পিত্তি গলা দেগা কেয়া?”
আমি যেমন দুলাল আর মিহিরের সঙ্গে একটা অ্যাপার্টমেন্ট শেয়ার করি, মালিনীও অফিসের দু’জন মেয়ের সঙ্গে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকে। নতুন চাকরি, মুম্বাইতে একা একা থাকার মত পকেটের জোর এখনও আমরা অর্জন করে উঠতে পারিনি। সে জন্য অবশ্য খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে কোনও আপোষ বরদাস্ত করা হয় না। সকালের খাওয়া অফিস ক্যান্টিনে, রাত্তিরে নিজেরাই চর্ব্য-চোষ্য রেঁধে খাই। আমাদের দুলাল রান্নায় দ্রৌপদী। মিহির বাসন ধোয়, আর আমি বাজার-সরকার। চিকেন-মাটন খেয়ে মুখ পচে গেলে কখনও-সখনও মাছ খাওয়ার ইচ্ছে প্রবল হয়ে ওঠে, যেমন আজকে। সকাল সকাল এসেছিলাম বলে মালিনীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কথায় কথায় সামনের শনিবারের পার্টির প্রসঙ্গ উঠল।
আমাদের মুম্বাই অফিসের বড়কর্তা ছাবারিয়া সাহেব খামখেয়ালি মানুষ। তাঁর ধারনা অফিস পার্টির একটা নির্দিষ্ট থিম থাকা দরকার। আগের বার ফেলাইন পার্টিতে আমরা সবাই বিড়াল সেজে গিয়েছিলাম। এবার তাঁর নির্দেশ, সবাইকে সুপারহিরো, সুপার-হিরোইন সেজে যেতে হবে। দুলাল সাজছে শক্তিমান। মিহির বাহুবলী। আমি ভেবেছিলাম রজনীকান্ত সাজব। ঠোঁটের ওপর একখানা জুতসই গোঁফ লাগালে ল্যাটা চুকে যেত। আমার চেহারার সঙ্গে মানিয়েও যেত। সাজপোষাকের জন্যও বেশি ঝক্কি-ঝামেলা করতে হত না, শুধু প্যান্টের বদলে লুঙি। মালিনী সব প্ল্যান বানচাল করে দিল। এখন পার্টিতে ফুলপ্যান্টের ওপর জাঙিয়া পরে ঘুরতে হবে। ভাগ্যিস মালিনী টারজান সাজতে বলেনি!
আমি বললাম, “তুই না-হয় ডায়ানা সেজে ফ্রক পরে খুকুমণি হয়ে ঘুরবি, আমি ফ্যান্টমের কস্ট্যুম পাব কোথা থেকে? ডোমিনো মাস্ক, গানবেল্ট… ”
“সে আমি কী জানি? দেখ কোত্থেকে জোগাড় করতে পারিস,” মালিনীর মাছ কাটা হয়ে গিয়েছিল। সে প্লাস্টিকের থলি হাতে ঝুলিয়ে হাই তুলে নিরাসক্ত গলায় বলল, “চলি রে, আমায় আবার পার্লারে যেতে হবে চুল সেট করাতে।”
বাড়ি ফিরতে ফিরতে মাথার মধ্যে আইডিয়া চমকাল। তরুণদাকে ফোন করলাম। তরুণদা যাকে বলে স্বনামধন্য নাট্য অভিনেতা ও নির্দেশক। আদ্যন্ত থিয়েটার পাগল এক মানুষ। নতুন মুম্বাইতে যত নাটক মঞ্চস্থ হয় তাদের সঙ্গে তরুণদা কোনও না কোনও ভাবে জড়িয়ে থাকে। ফোন ধরেই তরুণদা এক প্রস্থ গালাগাল করল, সকাল-সকাল ঘুম ভাঙানোর জন্য। আমি দুর্বল গলায় বললাম, “তরুণদা, সাড়ে এগারোটা বাজে…”
তরুণদা ব্যাচেলর মানুষ, ঘড়ি-টড়ির পরোয়া করে না। সাড়ে এগারোটা শুনে অবশ্য একটু থমকাল। সেই ফাঁকে আমি আমার সমস্যাটা পেশ করলাম। তরুণদা বলল, “ওটা কোনও সমস্যাই নয়। গত বছর একটা নাটকে চলমান অশরীরী সেজেছিলাম, বুঝলি? কস্ট্যুমটা বাড়িতেই পড়ে আছে। তুই সন্ধেবেলা এসে নিয়ে যা।”
আমি বিনীত ভাবে জিজ্ঞেস করলাম, “তরুণদা, সেই নাটকে ডায়ানার রোল কে করেছিল?”
তরুণদা উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দিল।
২
“ডায়ানার রোলে অভিনয় করার জন্য কাউকে পাচ্ছি না বলে নাটকটা আর নামাতে পারছি না,” তরুণদা বলল। সন্ধেবেলা তরুণদার বাড়িতে গিয়ে প্রথমেই কস্ট্যুমের প্যাকেটটা বগলদাবা করেছিলাম। তারপর চা আর সামোসা খেতে খেতে খোস গল্প হচ্ছিল। আমি বললাম, “গত বছর কে করেছিল? সে আর করবে না?”
তরুণদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “গতবছর মিতা করেছিল। ওর অসুবিধে আছে।”
“কী অসুবিধে?” আমি অনুসন্ধিৎসু হলাম। তরুণদা হাত ওলটাল, “সে এক কাণ্ড! সরস্বতী পুজোর দিন নাটকটা মঞ্চস্থ হয়েছিল। যা হয় আর কী! শেষ হতে হতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। মিতা কান্ডিভিলিতে থাকে। অ্যাপ ক্যাব ডেকে ফেরত যাওয়ার বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলাম। সঙ্গে একটা ছেলেকেও পাঠিয়েছিলাম... ভোম্বল, তুই চিনবি, শান্তশিষ্ট ভদ্র ছেলে, নাটকে গুরানের রোল করে।”
ভোম্বল নিপাট ভালমানুষ। আমাদের অফিসেই কাজ করে। মাথায় রোজ নারকেল তেল মাখে, সিঁথি করে চুল আঁচড়ায়। আমি শঙ্কিত হয়ে বললাম, “চিনি তো, সে আবার কী করল?”
তরুণদা হাত নেড়ে আমায় থামিয়ে দিয়ে বলল, “ভোম্বল আবার কী করবে? ভোম্বল নয়। মিতার হাজব্যান্ড। রাত একটা দেড়টার সময় মিতা যেই নিজের বাড়ির কলিং বেল-এ আঙুল রেখেছে, দরজা খুলে এক চড়। ভদ্রঘরের মেয়েরা নাকি রাত্তিরে অত দেরি করে ফেরে না।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ভোম্বল কিছু বলল না?”
তরুণদা বলল, “বলতে তো গিয়েছিল। সে শুনলে তো! তাকেও ঠাঁটিয়ে এক…”
আমি তরুণদাকে থামিয়ে দিয়ে আবেগ-বিহ্বল কণ্ঠে বললাম, “সে কী! এ তো শুধু মিতা বা ভোম্বলের গালে নয়, এমনকি বাংলা নাটকের গালেও নয়, বহির্বঙ্গের সমগ্র বাংলা সংস্কৃতি-চর্চার গালে চড়। একজন বাঙালি হয়ে বাংলা সংস্কৃতির এই অপমান সে করে কী করে? এর তীব্র প্রতিবাদ হওয়া উচিত।”
তরুণদা বলল, “অত উত্তেজিত হোস না। মিতার হাজব্যান্ড বাঙালি নয়। আর বাঙালি হলেই বা কী? এই যে মুম্বাই, নতুন মুম্বাইয়ের বাঙালিরা কাব্য-সঙ্গীত-নাট্যচর্চার নাম করে দৈনিক আধিখ্যেতা করে যাচ্ছে তার কে প্রতিবাদ করে?”
কথাটা অন্য দিকে ঘুরে যাচ্ছিল। আমি তরুণদাকে আবার মূল আলোচনায় ফিরিয়ে আনলাম, বললাম, “মেয়েদের থিয়েটার করা নিয়ে এই রকম বাধা-বিপত্তি নটী বিনোদিনীর যুগে ছিল। এই ২০২৩-এও যদি কেউ আপত্তি তোলে…”
তরুণদা অনুনয় করে বলল, “দেখ না ভাই, তোর চেনাজানা কোনও মেয়ে যদি নাটকে ডায়ানা সাজতে রাজি থাকে… আমি শিখিয়ে-পড়িয়ে নেব।”
মনে মনে ভাবলাম, মালিনীকে একবার বললেই প্রস্তাবটা লুফে নেবে। যা বেতাল-পাগল মেয়ে। মুখে বললাম, “দেখি…”
তরুণদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাস-স্ট্যান্ডের দিকে হেঁটে যাওয়ার সময় অন্য একটা দুর্ভাবনা এলো মাথায়। পাইপিঙের সন্তোষ আর সিভিলের সুধীর হাত ধুয়ে মালিনীর পিছনে পড়ে আছে। মালিনী যদি ফস করে ওদের কাউকে ‘হ্যাঁ’ বলে দেয়, বেচারি মেয়েটার জীবনটাই বরবাদ হয়ে যাবে। মালিনী খুব ভাল বন্ধু। কিন্তু আমাদের মধ্যে তার থেকে বেশি অন্তরঙ্গতা হয়নি। আচ্ছা মালিনী তো দেখেশুনে একটা বাঙালি ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক পাতাতে পারে। কে না জানে বাঙালি ছেলেরা বৌয়ের আঁচল ধরা হয়। অবাঙালিদের সেসব বদনাম নেই। মালিনী যদি মিতার মত হাজব্যান্ডের হাতে কিল-চড় খায়, আমার থেকে বেশি দুঃখিত কেউ হবে না।
ভাবছিলাম মালিনীকে সাবধান করে দেওয়া উচিত হবে কি না। তারপর মনে হল - কী দরকার? যদি ভুল বোঝে। যদি ভাবে আমি ওর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পাতাতে চাই বলে সন্তোষ আর সুধীরের নামে নিন্দেমন্দ করছি? বন্ধুত্বটাও যাবে মায়ের ভোগে। তার চেয়ে বরং এই ভাল। মালিনীর যতদিন বিয়ে-থা না হয় মলের কফি শপে কফির পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে আড্ডা দেওয়া যাবে। বেলাপুরের পাহাড় পেরোবার সময় মালিনীর একটা মেসেজ ঢুকল ফোনে, টুং করে। খুলে দেখলাম লিখেছে - কী রে, বেতালের কস্ট্যুম পেলি?
আমি উত্তর দিলাম - হুঁ, তোর চুল সেট করানো হল?
মালিনী লিখল - সে সব নিয়ে তোকে মাথা ঘামাতে হবে না। তুই এবার দেখ তুফান আর বাঘা কোথায় ভাড়া পাওয়া যায়।
সর্বনাশ। এখানে লোকে ঘোড়ির পিঠে চেপে বিয়ে করতে যায় শুনেছি। খুঁজলে ঘোড়ির সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু ঘোড়া? ঘোড়া ভাড়া পাব কোত্থেকে? আমি লিখলাম - ঘোড়ায় চেপে পার্টিতে গেলে ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে না?
মালিনী লিখল - কিন্তু ঘোড়ায় গলদ হলে সমাজ কি তোকে বেতাল বলে মেনে নেবে?
আমি লিখলাম - কোনওদিন ঘোড়ায় চড়িনি। পড়ে-টড়ে গিয়ে শেষে বেঘোড়ে প্রাণ হারাব।
মালিনী লিখল - ওটা বেঘোড়ে নয়, বেঘোরে হবে, গণ্ডমূর্খ।
আমি লিখলাম - যে ঘোরেই হোক। আমি গরিব মানুষ, ঘোড়ারোগ সামলাতে পারব না। তার থেকে বরং তুফান থাক, আমাদের নেড়ি শ্রীমান নাড়ুকেই বাঘার ছদ্মবেশ পরিয়ে সঙ্গে নিয়ে যাব।
মালিনী লিখল - নাড়ুকে নিয়ে তুই একদম পার্টিতে আসবি না বলে দিচ্ছি। যা লোভী, খাবার-দাবারে মুখ দিয়ে বেড়াবে। পার্টি ভেস্তে যাবে।
নাড়ু আমাদের বিল্ডিঙের নিচে থাকে। আমি মাঝেমধ্যে তাকে বিস্কুট খাওয়াই বলে সে আমার খুব ন্যাওটা। নাড়ুকে মালিনী একদম সহ্য করতে পারে না। মালিনীকে দেখলেই নাড়ু হাত চেটে দেয়। লিখলাম - তুই না-হয় নাড়ুকে কোলে করে বসে থাকবি।
মালিনী একটা লাল মুখের ইমোজি দিল। আমি আর বেশি ঘাঁটালাম না।
৩
“সন্তোষকে বৃহন্নলা সাজার বুদ্ধি কে দিল, তুই?”
খেয়েছে, মালিনী খবর পেল কোথা থেকে? মালিনীর চোখ নয় তো এক্স রে স্ক্যানার! মগজ চিরে চিরে দেখছে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে অনবরত মাথার মধ্যে যে সব নিষিদ্ধ চিন্তাভাবনা ঘুরতে থাকে সেগুলোও না জেনে ফেলে! আমি তাড়াহুড়ো করে বললাম, “মানে, সন্তোষ পার্টিতে যাবে বলে একটা এপিক সুপারহিরোর চরিত্র খুঁজছিল, তাই গুগল-টুগল খুঁজে ওকে বললাম, আর কী?”
“বৃহন্নলা এপিক সুপারহিরো? মজা পেয়েছিস?” মালিনী সহজে ছাড়ার পাত্রী নয়।
“সুপারহিরো নয়? অর্জুনকে তুই এই ভাবে হেয় করতে পারিস না।”
“বৃহন্নলা যদি সুপারহিরো হয় তাহলে আমিও অ্যাঞ্জেলিনা জোলি।”
“এই দেখো, এর মধ্যে আবার অ্যাঞ্জেলিনাকে নিয়ে টানাটানি কেন? বাই দ্য ওয়ে, তুই কোত্থেকে জানলি?” আমি সতর্ক হলাম।
“আজ সকালে সন্তোষ এসেছিল মণিকার কাছে, শাড়ি চাইতে,” মালিনী বলল। মণিকা মালিনীর ফ্ল্যাটমেট। সন্তোষ যে মণিকার কাছে এসেছিল, মালিনীর কাছে আসেনি এর থেকে ভাল খবর আর কী হতে পারে? সন্তোষের ফোকাস মণিকার দিকে ঘুরে গেলে মালিনী অন্তত রেহাই পায়। আমি ভাজা-মাছটি-উল্টে-খেতে-জানি-না মুখ করে বললাম, “মণিকার সঙ্গে কি সন্তোষের ভাব-ভালবাসা আছে?”
মালিনী বলল, “ভাব-ভালবাসা মাই ফুট। সন্তোষটা একটা টোটাল লুজ ক্যারাক্টার, যে কোনও মেয়ে দেখলেই লাইন মারার চেষ্টা করে। লাগে তুক না-লাগে তাক।”
যাক বাবা, বাঁচা গেল। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। আমি ভালোমানুষি দেখিয়ে বললাম, “ছিঃ মালিনী, মুখের কী ভাষা হয়েছে! মাইন্ড ইয়োর ল্যাঙ্গুয়েজ।”
মালিনী বলল, “তোকে আর সাধু সাজতে হবে না। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে তুই কী ভাষায় কথা বলিস জানি না ভাবছিস?”
প্রসঙ্গটা স্পর্শকাতর, কথা ঘুরিয়ে দেওয়া দরকার। আমি নিরীহ গলায় বললাম, “তোর কি মনে হয়, বৃহন্নলা সাজলে সন্তোষকে তেমন মানাবে না?”
মালিনী বলল, “দামড়া একটা ছেলে, শাড়ি পরে, ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে, গালে রং মেখে… ম্যাগো!”
পার্কের একটা বেঞ্চের দু’প্রান্তে বসে আমরা কথা বলছিলাম। মাঝখানে অনেকটা খালি জায়গা পড়ে ছিল। কয়েকটা বাচ্চা ছেলেমেয়ে খেলা করছিল আমাদের সামনে, ঘাসের ওপর। পার্কটা আমাদের বাসার কাছে। মালিনী নিচে এসে ফোন করেছিল, “একবার আসতে পারবি, কথা আছে।”
আধঘণ্টা হয়ে গেল পার্কে বসে আছি। আট-ভাট কথা হচ্ছে। মালিনী জেরা করছে, আমি কাঁচুমাচু মুখ করে জবাব দিচ্ছি। কিন্তু মালিনী এখনও বলেনি কী কথা আছে। কেন ডেকেছে। আমি মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলাম, “কী বলবি বলছিলি…”
মালিনী বলল, “বলছি, বলছি, এত ব্যস্ততা কীসের?”
সন্ধে হয়ে আসছে। বাচ্চাগুলো ফিরে গেছে। জগিং ট্র্যাকের ওপর ঝুঁকে পড়া কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোর মাথায় ঝুপসি অন্ধকার নামছে। ব্যস্ততা কীসের আমিই জানি। বেশ কিছুক্ষণ ধরে দেখছি পার্কের গেটের কাছে নাড়ু ঘোরাঘুরি করছে। গন্ধ শুঁকে শুঁকে কাছাকাছি চলে এলে এই সুখের সময়ের ইতি টানতে হবে।
আমি বললাম, “খিদে খিদে পাচ্ছে, বার্গার আর কফি খেতে খেতে কথা বলা যায় না?”
“না, এখানেই,” মালিনী ঘাড় নাড়ল। সোডিয়াম ভেপারের আলোয় ওর মুখ দেখে মনে হল সিরিয়াস কোনও কথা।
আমি আড় চোখে দেখলাম নাড়ু বিপজ্জনক দূরত্বের মধ্যে চলে এসেছে। তবে এখনও বোধহয় আমাদের ঠাহর করতে পারেনি। কথা চালাবার জন্য বললাম, “তরুণদা বলছিল একটা নাটকে ডায়ানা পামারের রোল খালি আছে। তুই ট্রাই করবি নাকি?”
মালিনী যেন শুনতে পেল না। অন্যমনস্ক হয়ে বলল, “যখনই বাইরে বেরোই দুটো ছেলে পিছু নেয়, সন্তোষ আর সুধীর। এমন অস্বস্তি হয়! বিকেলবেলা দু’-একটা কস্মেটিক কিনব বলে বেরিয়েছিলাম, দেখলাম সুধীর, পিছন-পিছন আসছে। তাই তোকে ফোন করে ডাকলাম।”
হায় ঈশ্বর! সুধীরের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য মালিনী আমার শরণাপন্ন হয়েছে? সুধীরের কাশীর গুণ্ডার মত চেহারা। আর আমি ল্যাকপ্যাক সিং। আগে জানলে দুলালকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতাম। মালিনীর সঙ্গে ঘোরাঘুরি করতে হলে জিম জয়েন না করলেই নয়। আমি বললাম, “চিন্তা করিস না। ওদের কিছু করার সাহস হবে না।”
অন্ধকার ঘন হচ্ছিল। পার্কে লোকজনও কমে আসছিল, বললাম, “চল উঠি এবার। তোকে তোর বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।”
কথা বলতে বলতে কখন বেঞ্চে আমাদের দু’জনের মধ্যের খালি জায়গা কমে এসেছিল বুঝিনি। মালিনী আমার হাতের ওপর হাত রাখল, “আর একটু বসি, ভাল লাগছে।”
৪
সেদিন সন্ধেবেলা তারপর যা ঘটেছিল তার জন্য আমরা দু’জনের কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। বস্তুত সেদিনের সেই ঘটনার সঙ্গে এই গল্পের আদৌ কোনও সম্পর্ক আছে কি না সেই নিয়ে আমার এখনও সন্দেহ আছে। তবু ঘটনাটার বিবরণ না দিলে এই গল্পের প্রকৃত সুপারহিরোর প্রতি অন্যায় করা হয়। তাই না লিখলেই নয়।
আগেই বলেছি আমি আর মালিনী যখন হাত ধরাধরি করে ঘন হয়ে বসেছিলাম, তখনই ঠিক সন্ধ্যা নামছিল। আর কে না জানে বাঘের ভয় না থাকলে যেখানে সেখানে সন্ধ্যা নামে না। সন্ধ্যা আসলে মারাত্মক সুযোগসন্ধানী। খেয়াল করিনি কখন, গাছপালার ফাঁক দিয়ে আমাদের গায়ে এসে পড়া সোডিয়াম ভেপারের আলো আড়াল করে একটা ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়িয়েছে। মালিনী হঠাৎ আঁতকে উঠল। আমি ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলাম চিলিবিলি আলো আটকে, আর কেউ নয়, সুধীর এসে দাঁড়িয়েছে। আমি সুধীরের দিকে কঠোর চোখে তাকিয়ে, গলা যত দূর সম্ভব ভারী করে জিজ্ঞেস করলাম, “কেয়া কাম হ্যায়?”
সুধীর আমাকে পাত্তাই দিল না। মালিনীর দিকে তাকিয়ে হিন্দিতে যা জিজ্ঞেস করল সাদা বাংলায় তার মানে দাঁড়ায় - তুমি এই বিটকেল বাঙালি উচ্চিংড়েটার সঙ্গে বসে কী করছ? মস্তি করতে হলে আমার সঙ্গে চলো।
আবার সেই বাঙালি সংস্কৃতির অপমান। আমি উঠে দাঁড়িয়ে সুধীরের দিকে আঙুল তুলে বললাম, “খামোশ! মুহ সাম্ভাল কে বাত করনা।”
সুধীর হাতের একটা ঝটকা দিয়ে আমায় সরিয়ে দিয়ে মালিনীর হাত ধরল। আমি দস্তুর মত সুধীরের চোয়ালে একটা মুষ্ট্যাঘাত করতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই হলুদ বিদ্যুৎ শিখার মত একটা প্রাণী সুধীরের ওপর লাফিয়ে পড়ল। আক্রমণটা যে অন্য দিক থেকে আসবে সুধীর ধারণা করতে পারেনি। সে আত্মরক্ষার জন্য মালিনীর হাত ছেড়ে সরে দাঁড়াল। দেখলাম আমাদের নাড়ু শ্বদন্ত বার করে গজরাচ্ছে। মাটিতে নখ আঁচড়াচ্ছে। তার চোখ জ্বলছে। আরও একবার সুধীরের ঘাড়ে লাফিয়ে পরার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। সুধীর একটা অস্ফুট চিৎকার করে দৌড় লাগাল। মনে হল কাশী পৌঁছনোর আগে সে থামবে না।
মালিনী স্বভাবতই ঘাবড়ে গিয়েছিল। সুধীর পালিয়ে যেতেই সে আমায় জড়িয়ে ধরল। বুঝলাম সে ভিতরে ভিতরে কাঁপছে। আমি তার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বললাম, “ভয় পাস না। বাঘা সুধীরকে তাড়িয়ে দিয়েছে।”
মালিনী আমার দিকে চোখ তুলে তাকাল। দেখলাম তার চোখে জল টলটল করছে। আমি বললাম, “তোর বেতাল প্যাংলা হলে কী হবে, বাঘা রীতিমত পালোয়ান।”
মালিনী ফিক করে হাসল, নাড়ুর দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, “আমার বেতাল না থাকলে বাঘাকে কোথায় পেতাম?”
নাড়ু কী বুঝল কে জানে, কুঁইকুঁই করতে করতে মালিনীর হাত চেটে দিল।