তোমরা বলো কী করি?বিংশ শতকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চিত্রশিল্পীদের মধ্যে শিল্পী পল ক্লি অন্যতম (১৮.১২.১৮৭৯&ndash,২৯.৬.১৯৪০)। সুইজারল্যান্ডের সুচেনবুচিসে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পল ক্লি-র বাবা Hans Wilhelm Klee গান, পিয়ানো, অর্গান আর ভায়োলিন নিয়ে চর্চা করতেন আর মা Ida Marie Klee ছিলেন গায়িকা। পল ক্লি সংগীত চর্চায় ডুবে থাকা বাবা-মায়ের সন্তান। পল ক্লি-ও সাত বছর বয়েস থেকেই ভালো ভায়োলিন বাজাতেন। মাত্র এগারো বছর বয়েসেই ভায়োলিন বাজানোয় এমন দক্ষ হয়ে উঠলেন যে, বিশেষ সভ্য হিসেবে বার্ন মিউজিক এ্যাসোসিয়েশন-এ ভায়োলিন বাজানোর আমন্ত্রণ পেলেন। তাঁর বাবা-মা দুজনেই তাঁকে শিল্পচর্চায় আগ্রহী করে তুলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আঠারো-উনিশ বছর বয়েসে পল ক্লি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তিনি ছবি আঁকবেন।
হৃদয় পুড়ে ছারখার,
বার বার চুমু খেতে পারি
এমন কোনো প্রেমিকা নেই।
যদি ছোটো পাখি হতাম,
দূরের গর্জনরত সমুদ্রের কাছে ছুটে যেতাম
এবং ডুব দিয়ে শান্ত হতাম।
একটা ছোটো পাখি জানে
ব্যথা আসলে কী।
১৮৯৮ সালে পল ক্লি মিউনিখের ফাইন আর্টস একাডেমি Knirr–এ শিল্পচর্চা শুরু করেন। ১৯১০ সালে বার্ন-এ তাঁর প্রথম একক এবং পরবর্তী সময়ে তিনটি সুইস শহরেও তাঁর চিত্রপ্রদর্শনী হয়। ক্রমশই পল ক্লি শিল্পরসিক ও শিল্পবোদ্ধাদের আলোচনার বিষয় হয়ে উঠতে থাকেন। তাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি- ‘একটি সরলরেখা কাগজের ওপর হাঁটাহাঁটি করলেই একটি ছবি হয়ে যায়।’
যতদূর জানা যায়, ১৮৯৮ সালে তাঁর উনিশ বছর বয়েস থেকেই পল ক্লি ডায়েরি লেখা শুরু করেন। পল ক্লি-র ডায়েরির চারটি খণ্ড আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান আলোচ্য ডায়েরিটি প্রথম খণ্ড। এই প্রথম বাংলায় তর্জমা। তর্জমা করেছেন শ্রী শুভেন্দু সরকার। শ্রী শুভেন্দু সরকার অঙ্কনের পাঠ নিয়েছেন কলকাতা আর্ট কলেজ থেকে এবং ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রক থেকে ন্যাশনাল স্কলারশিপ প্রাপ্ত। কলকাতা ও দেশের নানা প্রান্তে তাঁর ছবির প্রদর্শনী হয়েছে। ছবি আঁকার পাশাপাশি নিরলসভাবে তিনি অনুবাদেরও কাজ করেন। বর্তমান ‘পল ক্লি-র ডায়েরি’ অনুবাদগ্রন্থটি তাঁর সেই প্রয়াসেরই একটি মাইলফলক।
পল ক্লি-র ডায়েরি ঠিক তাঁর দিনলিপি নয় কারণ ডায়েরিতে কোনো তারিখের উল্লেখ নেই, তিন/চারটি ক্ষেত্র ছাড়া। এ ডায়েরি তাঁর জীবনাচরণের ছবিও নয়। প্রেম-মৃত্যু-যৌনতা সম্পর্কে মৌলিক চিন্তার পাশাপাশি শিল্পীমনের পথে পথে ছড়িয়ে থাকা গভীর-গোপন বোধের অনাবিল উন্মোচন এই ডায়েরি। ছড়িয়ে আছে ছোটোবেলার স্মৃতি— ‘একদিনের ঘটনার কথা মনে পড়ছে। তখন তিন বছর বয়স। মা বাড়ি ফিরে দেখলেন তাঁর প্রিয় টেবিলল্যাম্পটা ভেঙে গেছে। ওইদিন মায়ের সেই বাঁধভাঙা কান্না আমার মধ্যে গভীর রেখাপাত করেছিল। তিন-চার বছর বয়েসে খাতার মধ্যে ভর্তি করে ভূত-প্রেত আঁকতাম এবং হঠাৎ করেই সব জ্যান্ত হয়ে যেত। মায়ের কাছে ছুটে গিয়ে নালিশ করতাম যেন ভূতগুলোকে তিনি জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেন।’ ‘ছোটোবেলা থেকেই ঈশ্বর বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু আমার সমবয়সী অন্যান্য বন্ধুরা কানের কাছে টিয়াপাখির মতো বলে যেত ঈশ্বর সবসময় আমাদের ওপর নজর রাখছেন। এই ধরণের কুসংস্কার মেনে নেওয়ার জন্য আমাকে প্ররোচিত করা হত’, আবার এই পল ক্লি-ই নাস্তিকতার বেড়া ভেঙে আস্তিকতায় নিজেকে আরোপিত করছেন, লিখছেন, ‘অনুভব করি সর্বশক্তিমান ঈশ্বর এখন সঙ্গে। তাঁর সামনে নত হই এবং নিজেকে উৎসর্গ করি। নিজেদের অন্ধকারগুলো আলোকিত করে তোমাকে তোমার মতো করে চাই। ঈশ্বর সহায়। তিনি নির্দিষ্ট পথে নিয়ে চলেছেন। অন্ধকারে তলিয়ে যাবার সময় যে নারী বন্ধুত্বের আলো জ্বেলে এসেছিল তাঁকে যেভাবে ভালোবেসেছি তোমাকেও তেমন ভালোবাসি।’ কিংবা ‘নক্ষত্রের ওপারে গিয়ে আমার ঈশ্বরকে খুঁজবো। এতদিন তাঁকে না চেয়ে অযথাই পার্থিব ভালোবাসার খোঁজে পরিশ্রম করেছি। এখন খুঁজে পেতেই হবে। যিনি কৃপা করেছেন এতদিন তাঁকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম। কী করে চিনতে পারব?’
১৮৯৯ সালে Knirr-এর আর্ট স্কুলে পড়ার সময়েই ক্লি-র আলাপ হয়েছিল লিলি স্টাম্ফ (Lily Stumph)-এর সঙ্গে। ডায়েরিতে লেখা আছে, ‘১৯০১ সালে ৫ই ফেব্রুয়ারী লিলিকে আবার প্রেম নিবেদন করলাম।’ ১৯০৬ সালে দুজনে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। লিলি ক্লি-র চেয়ে তিন বছরের বড় ছিলেন। তাই প্রথম দিকে লিলির একটু সংকোচ ছিল, শেষে ক্লি-র ভালোবাসাকে লিলি অস্বীকার করতে পারেননি। লিলি ছাড়াও ক্লি-র ডায়েরিতে উল্লেখ আছে অনেক নারীর কথা, ভালোবাসার কথা। তিনি লিখছেন, ‘প্রথম যে মেয়েটিকে আমার রক্তমাংসের অনুভূতি জানিয়েছিলাম তাঁর নাম হেলেনা। তখন ওর নয় বছর বয়স। অসম্ভব সুন্দরী। জোর করে চুমু খেয়েছিলাম। বাধা দেয়নি।... জুন মাসে বুবেনবারগের স্টিমারে হেলেনার সঙ্গে দেখা হল। সতেরো বছরের সেই তন্বী সুন্দরী ছিল আমার প্রথম প্রেমিকা।... তখন ও ছিল জংলা নদীর মতো তাজা, স্বচ্ছ।’ আবার ইভলিনের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর লিখছেন, ‘... তুমি ভালোবাসার আগুনে পুড়ে যাওয়ার ভয় দেখাও ইভলিন। ... তুমি ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ’, ‘আমাকে সম্পূর্ণ ভাবে বাঁচাও। তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই ইভলিন।’ এভাবেই নানা নারী প্রসঙ্গ এসেছে ডায়েরিতে। কোথাও তিনি গোপনতার রাস্তায় হাঁটেননি। দ্বিধাহীনভাবে বলতে পেরেছেন, ‘... কিছুতেই সুন্দরী মেয়েদের রূপের মোহ থেকে মুক্ত হতে পারছি না।’
পল ক্লি-র ডায়েরিতে ছড়িয়ে আছে শিল্প-কবিতা নিয়ে অসামান্য সব অনুভূতি—‘কবিতায় দুঃখের একটা গান গাইলাম। যে গান আমার একার, একদম নিজস্ব। আকাঙ্ক্ষার সেই নারী যে ভালোবেসে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চেয়েছিল।’ কোথাও লিখছেন, ‘গ্রামীণ প্রকৃতির বিভিন্ন সৌন্দর্যের সঙ্গে আত্মাকে যদি তুলনা করা হয় তাহলে কতগুলো মোটিফ তৈরি হয়। নিসর্গের ভেতর ছড়িয়ে রয়েছে কবিমনের শেকড়। এখন শরৎকাল। কুয়াশার সঙ্গে খেলা করছে আমার আত্মা।’
শিল্পী পল ক্লি-র চিত্রে ছড়িয়ে আছে ফুল, পাখি, মাছ, গাছ, ও মানুষ। মূর্ত কিংবা বিমূর্ত, দ্বিমাত্রিক তলে নান্দনিক গল্পের চলমান রেখা। শিল্পী পল ক্লি সারাজীবনে ১০,০০০ এরও বেশি পেইন্টিং, ড্রয়িং ও ছাপচিত্রের কাজ করেছেন। মুগ্ধ ছিলেন সেজান ও মাতিসের শিল্পকর্মে। ভ্যান গঘের চিঠি পড়ার পর তিনি জানতে পেরেছিলেন আর একজন শিল্পীর রঙের জন্য অপরিসীম সংগ্রামের কথা। তবুও ক্লি-র মনে হয়েছিল ভ্যান গঘের চেয়ে সেজান আর মাতিস তাঁর জরুরি শিক্ষক।
শেষ জীবনে চরম অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন পল ক্লি। সেসময়ে তাঁর কাছে এসেছিলেন অনেক শিল্পী বন্ধু, এসেছিলেন পিকাসো ও অন্তরঙ্গ বন্ধু কান্দিনসকি। ক্লি-র জীবনের নানা সংকট মুহূর্তে তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন কান্দিনসকি। অসামান্য সুন্দর মনের মানুষ কান্দিনসকি। ক্লি সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, যতো মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছে আমার তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে আমি কিছু না কিছু শিক্ষা নিয়েছি। কিন্তু সবচেয়ে বেশি শিক্ষা নিয়েছি যার কাছ থেকে তাঁর নাম পল ক্লি।
মহান শিল্পী পল ক্লি ২৯ জুন, ১৯৪০ সালে সুইজারল্যান্ডে এই পৃথিবীর মাটি ছেড়ে চলে যান। তাঁর সমাধির ওপর একটা পাথরে লেখা হল তাঁর শেষ কথাটি— ‘I cannot be grasped in the here and now. For many dwelling place is as much among the dead. As the yet unborn, slightly closer to the heart of creation than usual. But still not close enough.’
পল ক্লি চলে গেলেন, নতুন পৃথিবীর নতুন প্রজন্মের জন্যে রেখে গেলেন তাঁর শিল্পকর্ম। এক্সপ্রেশনিজম, কিউবিজম, ফিউচারিজম, সুররিয়ালিজম হয়ে অবশেষে অ্যাবস্ট্রাকশনের সঙ্গে মনের গহন সংযোগ, ছবির দুর্বোধ্যতা, অনুসন্ধিৎসা, নিজের শিল্পপথের টেকনিক ও রীতি—এইসব নিয়ে পল ক্লি-র শিল্পজগৎ পড়ে রইল আগামী প্রজন্মের জন্য।