অবিনাশের মনে হল আরেকটা বিরাট দুঃস্বপ্নের মধ্যে ঢুকে পড়েছে সে। আশপাশে যতদূর দেখা যায় সীসে রঙের ঘোলাটে আকাশের নিচে গাঢ় কালির মত উন্মত্ত জলরাশি নেচে নেচে চলেছে। যাবার পথে সেই জলরাশি বাসের জানালা ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে, অনিচ্ছুক খেলুড়েকে দুধভাত বলে হ্যাটা করে যাওয়ার মত।
বাসটা ভাগ্যক্রমে একটা বড়-বড় পাতাওয়ালা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। অবিশ্রাম বৃষ্টির মধ্যেও তাই খানিকটা রক্ষা পাওয়া যাচ্ছিল। সেই দৈব আচ্ছাদনের নিচে আট দশটি মাথা ঘেঁষাঘেষি করে বসে অপেক্ষা করছে অকরুণ বর্ষণের ক্ষান্তির। রাত কত হল বলা মুশকিল। আস্তে আস্তে ব্যাটারির ধক ফুরিয়ে আসা ফোনগুলির নীল-সবুজ আভা নিবে আসছে একে একে।
অবিনাশ আর এই সরকারি বাসের ড্রাইভার বাদে বাকি মাথাগুলি সতেরো আঠেরোর বেশি না। মাটুঙ্গার কোন একটা কলেজের ছাত্র সব। একটার গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। কোনো এক অজ্ঞাত কষ্টে ছেলেটার শরীরটা মুচড়ে মুচড়ে উঠছে। বাসে উঠে বসার সময় ছেলেগুলো হাসি-ঠাট্টা করছিল, মুম্বাইয়ে্র টপোরি ঢংয়ের গালি গলৌচের নুন-চিনি মেশা এক অদ্ভুত খিচুড়ি ভাষায়, খানিক ঝগড়া ও ঝাঁঝ বুঝি ছিল তাতে। অথচ এখন ওর বন্ধুদের পাংশু মুখের দিকে তাকালে বন্ধুতা, ভালবাসার সঙ্গে অসহায়তাও টের পাওয়া যাচ্ছিল। এই বয়সের পারস্পরিক নৈকট্য এরকমই নিঃস্বার্থ, অভিজ্ঞানহীন হয়ে থাকে মনে হয়। ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে তার মনে হল কোথায় যেন এ মুখের ছাঁদ সে আগে দেখে থাকবে। অন্যদিনে এইরকম মুহূর্তে স্বপ্নগুলি সাধারণত ভেঙে যায়। আজ ভাঙছে না কেন!
যাই হোক, এরকম অশৈলী ব্যপারই আজকাল ঘটছে অবিনাশের জীবনে আজকাল। একদিন মৌলালির মোড়ে নীলাকে দেখে ডাক দিতে গিয়ে টের পায় তার কোন কন্ঠস্বর নেই। তার আকুল ডাক শুনতেই পেল না নীলা, একটা থিকথিকে ভিড় এস সিক্সটিনে উঠে পড়ল ঠেলে-ঠুলে। ফুটপাথে কিসে ঠোকর লাগতেই দেখে নমিতা তাকে ঠেলে ঠেলে ডাকছে, ঘুম চোখেই বলছে, তোমাকে বোবায় ধরেছে, মুখে চোখে জল দিয়ে এসো, পাশ ফিরে শোও। ধড়মড় করে উঠে বসে অবিনাশ। নীলা? নীলা কোথায় এখানে...
কোনোদিন রাত্তিরবেলা পেচ্ছাপ করতে উঠে হঠাৎই চোখ পাশের দেওয়ালে গেলে থমকে যায়। মধ্য তিরিশের উস্কোখুস্কো মাথা, লাল লাল চোখ নিয়ে আয়নায় ও কে? গভীর অভিনিবেশে তাকেই মাপছে, বাথরুমের সাদা আলোয়। পেচ্ছাপ থেমে যায় আপনা-আপনি। তার মনে হয়, এটা কি একটা স্বপ্ন? যেই ভেঙে যাবে, মলিন বিছানা থেকে তেলচিটে বালিশের গন্ধ ঝাঁকি মেরে সচেতন করে দেবে? পেট পাকিয়ে বমির বেগ এসে কাঁপিয়ে দিয়ে যাবে আ-মর্ম? অথচ কিছুই ঘটে না, প্রাকৃতিক ক্রিয়া সেরে সে এসে সাজানো ঘরে, সাজানো বিছানায় আবার শরীরটাকে ছেড়ে দেয়।
এই স্বপ্ন আর না-স্বপ্নের মাঝখানে আটকে যাওয়া সময়ে অবিনাশ প্রায় ভোম্বল হয়ে যায়। তার মাথায় বুদ্ধি জোগায় না, এমন সব প্রতিবর্ত ক্রিয়া তাকে চালায় যাদের সে চেনে না।
আজ বিকেলেও আপিসে আহুজা মেমসাহেব যখন ডেকে পাঠিয়ে ধমক দিচ্ছিলেন, তখনও ঠিক এরকমই একটা কেলো ঘটে গেছিল। কোম্পানির রিটার্নে কিছু ট্যাক্স সেট অফ করা নিয়ে অডিটরের সঙ্গে তার আগের দিন ঝগড়া হয়েছিল, কথা-কাটাকাটি না, তর্কাতর্কিই। কিন্তু কুলকার্ণি কাকে যেন বলছিল, ঘোষবাবু আর অডিটর সাব কা তো আজকল ছত্তিশ-আকড়া চল রহা হ্যায়, মেমসাহেবের খাস অর্ডার্লি আবার সে খবরে লঙ্কা-লসুন মাখিয়ে পরিবেশন করে থাকবে, মেমসাহেবের মেজাজের পারা সপ্তমে চড়ে ছিল।
মহিলা হলে কী হয়, আহুজা ম্যাডামের মুখ অসম্ভব খারাপ, কথায় কথায় মা-ব্যহেন করতে পারেন, কাজেই চুপচাপ শুনে সরি বলে বেরিয়ে এলেই হত। কিন্তু অবিনাশের কেন জানি সাহেবী কাপড়চোপড় পরা সভ্যভব্য মেয়েছেলে গালি দিচ্ছে দেখেই মনে হল, এ শালা স্বপ্ন না হয়ে যায় না। এখুনি জেগে উঠলেই দেখবে এ আসলে তাদের পুরনো চওলের পাশের ঘরের বৃহস্পতিয়ার মা, গালি দিয়ে গলির ছেলেদের চোদ্দ পুরুষ উদ্ধার করে দিচ্ছে, তার সদ্য গোলা দেওয়া ডালবড়িতে ক্রিকেট বলের ছাপ বসিয়ে দেওয়ার জন্য।
যেই মনে হওয়া, তার মুখে এক চিলতে ফিচেল হাসি ফুটে উঠে থাকবে। বাস, আগুনে ঘি পড়লে যেমন জ্বলে ওঠে তেমনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন রাণী আহুজা। বিকেলের মধ্যে তাকে কাজে অবহেলার একটা অভিযোগে শো কজ ধরিয়ে, সাসপেন্ড করে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন বড়বাবু। এডমিন চীফ।
চিঠিটা ধরাতে ধরাতে বারবার আক্ষেপ করছিলেন বড়বাবু, যদিও খুবই চাপা গলায়। অমাবস্যা-পূর্ণিমায় পাগলদের পাগলামি একটু বেড়ে গিয়েই থাকে, নিজের যতই ব্যক্তিগত সমস্যা থাকুক, অবিনাশের একটু সমঝে চলা উচিত ছিল, এখন অপিসে একজন কর্মঠ, বুদ্ধিমান স্টাফ এভাবে বসে গেলে, তিনিই বা কীভাবে আপিস চালাবেন?
কীভাবে চালাবেন, তার অবিনাশ কী জানে! সেও তো অপেক্ষা করে থাকে, এখুনি এই দুঃস্বপ্নের শেষ হবে, বৃহস্পতিয়ার মার জরাজীর্ণ, নিদন্ত মুখখানি তাকে দেখে সলজ্জ জিহ্বা-কর্তনপূর্বক ফের অবগুন্ঠিত হবে। গলিত সীসার মত জলরাশির নাচন দেখতে দেখতে এখনো সে আশাই করছিল অবিনাশ।
২
কতদিন? বছর তিনেক হবে। সস্তার ঠেকটার সন্ধান দিয়েছিল আপিসেরই সাহনি। উলহাসনগরের পুরাতন রিফিউজি ক্যাম্পের বাসিন্দা সাহনি নানা ঘাটের জল খেয়ে শেষ পর্যন্ত এই আপিসে এসে ঠেকেছে। একসময় স্বপ্ন দেখতো শের-শায়রী লিখবে, ...তারপর তাদের সিন্ধি পারিবারিক ঐতিহ্য মেনে ঠিক করেছিল বেওসা করবে, এখন বোধহয় কোনোটার জন্যই আর উদ্যম নেই, সে-ই বলেছিল, ক্যায়া করোগে ঘোষ...লাইফহি এয়সা হোতা হ্যায়, নসীব আখির নসীবহি হোতা হ্যায়...আওগে...? ’পর জবরদস্তি নেহি। তখন নমিতার ডাক্তারি পরীক্ষার রিপোর্টগুলি এসেছে সদ্য।
অবিনাশের কি একটু দোনোমোনো ছিল, না কি অনিচ্ছার তেমন জোর ছিল না, বলা মুশকিল। সাহনির মুখে একটা পরাজিত মানুষের মায়ার মত কিছু আছে যার কাছে কবচ-কুণ্ডল খুলে রাখতে সঙ্কোচ হয় নি অবিনাশের। এতদিন হয়ে গেল এই অফিসে... তার মত কম কথা বলা, নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকা মানুষও বুঝি টের পায় অবরে-সবরে কাঁধে রাখার মত একখানি হাত আছে কাছে কোথাও। নমিতার যা অবস্থা, তাতে যে কথা নমিতাকেও বলা যায় না, হয়ত সেরকম কিছু কথা স্রেফ বলে উঠবার মত কাউকে চেয়েছিল, রাজি হয়েছিল সাহনির প্রস্তাবে।
আসলে তখন থেকেই সময়মত বাড়ি ফিরলে অবিনাশের কেমন একটা অস্বস্তি হয়, নমিতা বিকেলেই বেরিয়ে পড়ে, খালি ফ্ল্যাটে অবিনাশের কেমন শীত-শীত করে, নিজের সঙ্গে নিজে একলা থাকা যেন আর পোষাচ্ছিল না।
যখন ঘেঁষাঘেঁষি বাড়িগুলির ফাঁক দিয়ে এক ফালি আকাশে একটি দুটি তারার ফুল ফোটে, প্রায়দিনই সেই সময়ে নমিতার চটি ঘষটানোর আওয়াজ পায় অবিনাশ। ভাবে উঠে গিয়ে ওর হাত থেকে ভারী ব্যাগটা নিয়ে নেবে, দুটো কথা বলবে এলোমেলো। কিন্তু তার মুখচোখ দেখে সেসব কিছু করে উঠতে পারে না। নমিতা দোপাট্টার খুঁটে মুখের ঘাম মুছে ফেলতে ফেলতে একরাশ অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বলে, ওঃ, তুমি এসে গেছ! চা খেয়েছো?
অবিনাশ বিভ্রান্ত বোধ করে... ঠিকঠাক মনে পড়ে না যেন। অথবা মনে পড়লেও উত্তর দেওয়া বাহুল্য বোধ করে। নমিতাও অপেক্ষা করে না, অবিনাশকে পাশ কাটিয়েই ঘরে ঢুকে যায়। চায়ের জল চাপায়।
যেসব দিনে অবিনাশ দেরি করে, ফিরে এসে অভ্যাসবশে তালায় খুটখাট করতে করতেই ভেতর থেকে আলতো আওয়াজে ছিটকিনি খুলে যায়। অন্ধকারের মধ্যেই নমিতার মুখে যেন হারিয়ে যাওয়া কোনো প্রাচীন গুম্ফার বিদেহী এক লামার মুখ কেটে বসানো। কালচক্র ঘুরিয়ে চলেছে। দরজা খুলে দিয়েই কলঘরে গিয়ে মুখ-চোখে জলের ছিটে দেয়, তার ফুলো-ফুলো চোখমুখ দেখে অবিনাশ আর কিছু বলার সাহস পায় না।
ডেস্কের ওপর একটি ক্যালেন্ডারের ছবির শিশু চেয়ে থাকে গেরস্থালীর দিকে। প্রিয় ছবি নমিতার, বছরটা ফুরিয়ে গেলেও ক্যালেন্ডার ফেলতে দেয়নি সে। ঠিক তার নিচে রেকাবে কিছু ফুল, কে জানে কখন নমিতা হাতে করে ঘরে ঢুকেছে। অবিনাশের ভেতরটা পুড়ে গেলেও একটি শব্দ তার মুখ থেকে সরে না। চান-টান হয়ে গেলেই রাতের খাবার খেতে বসে পড়ে। আজকাল আর টেবিলে বসার তাগিদও নেই, হাতে হাতে থালায় রুটি, স্যালাড, থালারই মধ্যে আলাদা বাটিতে ডাল, টিভিতে ঘোষকের কন্ঠস্বর। রাত্রি সাড়ে দশটায় আলো নিবে যায় তাদের সংসারে। নিয়ম মত।
হয়ত তাই সাহনির কথায় ভেবেছিল, যা হয় হোক গে...দেখাই যাক না চাটের ঝালে মাথাটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে কি না। সেসব কিছু হয় নি। বরং এত তাড়াতাড়ি করছিল যে সাহনিও একটু অবাক হয়েছিল... অবিনাশের আচমকা ভাবান্তর লক্ষ্য করে সেও সাবধান হয়ে গেছিলো। বারবার বলছিল, দোস্ত, জরা ধীরে। শেষে অটো দাঁড় করিয়ে তাকে জোর করে আগে তুলে দিয়ে অটোওয়ালার নম্বর চেয়ে নিয়েছিল। তারপরেও সাহনি আর সে বেশ কয়েকবার গিয়েছে সেই পানশালায়। কখনো একাও।
৩
আজ আপিস থেকে এত আগে বেরিয়ে পড়ে ঝিরঝিরে বৃষ্টি আর ব্যাজার আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে, এতটা সময় হাতে নিয়ে কী করবে সে, ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি প্রথমে। লজিকাল মন বলছিল বৃষ্টির গতিক ভাল না, সোজা বাড়ির দিকের প্রথম বাসটায় উঠে পড়া উচিত। অথচ পা-দুটো অনিচ্ছুক, কোনো এক অদৃশ্য শক্তি তাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে ড্রীমল্যান্ডের দিকে। নাই বা সঙ্গে থাকলো সাহনি। বুকপকেটে শো-কজের চিঠিটাকে একবার হাত দিয়ে ছুঁলো সে।
দোকানের দরজাটা ছোট। সামনে ছিটের পর্দা। বহুদিন ধোপাবাড়ির মুখ দেখে নি। কিন্তু এখানে যারা আসে, তাদের ওসব দিকে খুব একটা নজর থাকে না। বিবর্ণ পর্দার আড়ালে সস্তার দারু, আর সামান্য ফরসান (চানাচুর) আর ছোলার চাট নিয়ে বসা মানুষগুলো পর্দা নড়ে উঠলে কখনো সখনো একটু তাকায় মাত্র। কিন্তু আজ দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে একটু ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল অবিনাশ। বন্ধ।
কিন্তু ঠিক তখনি পিঠে কার যেন হাতের ছোঁয়া...আরে দাদা, আপনি এখানে? অবিনাশ চমকে উঠে দেখে পুলক। গাইঘাটার ভেতো বাঙালি পুলক, কথায় এখনো স্পষ্ট এক অন্য রকমের টান। কবছর আগেও বাড়ি বাড়ি ঘুরে শাড়ি বিক্রি করতো। ক্যালকাটা শাড়ি। ধনেখালি, ফুলিয়া টাঙাইল... সস্তার ঢাকাই। তাদের বাসায়ও কয়েকবার গিয়েছে। হলহল করে একগাদা কথা বলা ছেলেটার অভ্যাস। বাড়ি গাইঘাটায়, শ্বশুরবাড়ি গোবরডাঙায়, নিজের ব্যপারে এসব ইনফর্মেশন জানিয়ে দিতে তার বেশি সময় লাগেনি।
নমিতা ভুরু তুলে অবিনাশকে জিজ্ঞেস করেছিল, শুনছো, তোমাদের মেজপিসিমার বাড়ি গোবরডাঙায় ছিল না? কথাটা ঠিকই, এককালে পিসিমারা সেখানে থাকতেন... কিন্তু অবিনাশ ব্যপারটাকে বিশেষ পাত্তা দেয়নি।
--আরে পুলক যে। কেমন আছো? অবিনাশের একবার ভয় হল, পুলক কি তার গভীর অভিনিবেশে পানশালার দিকে তাকানো লক্ষ্য করেছে? পরক্ষণেই ভাবল, মরুক গে, ভারি বয়েই গেল। অন্তত একবার তো তারা দুজনে একসঙ্গে বসে মাল খেয়েছে। পুলকের ভাষায় বিলৈতি। পুলকই খাইয়েছে।
আসলে সে’বার পারেল স্টেশনের সামনে দেখা হয়েছিল। বলেছিল--দাদা একটা ডেরা করেছি কাছেই। আসবেন? চলুন না। খুব ঝুলোঝুলি করেছিল পুলক। ততদিনে নমিতা চক্ষুলজ্জায় পড়ে বার দুই পুলকের থেকে শাড়ি কিনেছে। কিন্তু যে শাড়ি কলকাতায় চারশ টাকায় মেলে সে শাড়ি আটশো-হাজার টাকায় কাঁহাতক কেনা যায়। পুলক কিন্তু অবিনাশের ভদ্র প্রত্যাখ্যানকে আন্তরিকতা দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল। প্রায় টেনে নিয়ে গেছিল নিজের ডেরায়। সে প্রায় বছর পাঁচেক আগের কথা।
বাড়িটার নাম রফিক ম্যানসন। পুরনো জরাজীর্ণ বাড়ি। এককালে এদিকটায় মিলের ওয়ার্কারদের বসবাস ছিল, মিলগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাওয়াতে বাড়িগুলির গায়ে অযত্নের থাবা পড়েছে। তা হলেও ভালই করেছে পুলক। দাদারের মার্কেট থেকে খুব বেশি দূরে নয় ডেরাটা।
আজও পুলক বললো, আমার ডেরায় আজ একটু চা-টা হবে নাকি দাদা? ভাগনেকে একবারটি দেখেও আসবেন... ছুটিতে সে বাড়ি এসেছে। অবিনাশ আড়চোখে তাকে দেখে, মুখে কোন ছায়া নেই, আয়নার মত পরিষ্কার। সজোরে বললো--পাগল! বৃষ্টির রোখ কেমন দেখছো না! আরেকদিন হবে’খন। এখন না বেরলে রাস্তায় আটকে পড়বো।
বলেই কতকটা পুলকের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্যই একটা চলতি বাসে টুক করে উঠে পড়েছিল অবিনাশ। এই বৃষ্টিতে ট্যাক্সি বা অটো জল ঢুকে বন্ধ হয়ে যেতে পারে যখন-তখন। বাসের সেই ভয় কম। অগাস্ট মাস শেষ হতে চলল, কিন্তু এবার বৃষ্টির কোনো থামাথামি নেই। এরই মধ্যে মাটুঙ্গা সার্কেলে হইহই করতে করতে ছেলেগুলো উঠলো। দুটো চৌমাথা সিগনাল গোড়ালি-ডোবা জলের মধ্যেই পেরোল অবিনাশদের বাস। এদিকটায় ব্যাঙে পেচ্ছাপ করলেও বোধহয় জল জমে।
৪
রফিক ম্যানসনে সেদিন পকেট থেকে চাবি বের করে নিজেই ঘর খুলেছিল পুলক। হল হল করে একগাদা কথা বলা পুলকের স্বভাব...তার স্ত্রী যে অন্তঃসত্ত্বা সে কথা অবিনাশের জানা হয়ে গেছে রাস্তাতেই।
এদিকে নমিতা তখন থেকেই ধরা দেয় না, জোর করলে কেমন হিংস্র হয়ে ওঠে, আঁচড়ে-কামড়ে একশা করে দেয়। দুইয়ে মিলিয়ে নিজের অবিমৃশ্যকারিতার জন্য সেদিন বিরক্তই বোধ করেছিল সে, পুলকের স্ত্রী সন্তানসম্ভবা জানলে কিছুতেই তাদের বাড়িতে যেত না। একটা সূক্ষ্ম ঈর্ষার বিদ্যুৎরেখাও কি খেলে গেছিল তার মধ্যে!
কিন্ত আপ্যায়নের জন্য উদগ্রীব পুলক একটা হুইস্কির বোতল বের করে বলেছিল--দাদা, একটু হোক? আজকে প্রথম এলেন। তারপর উঠে ভেতরে গিয়ে বৌকে ডেকে ডেকে বলছিল--আরে এসোই না। জানো তো, দাদার পিসিমার বাড়ি তোমাদের ওখানে। বৌটি কিন্তু এল না কিছুতেই। আতিথেয়তার অবশ্য কোনো ত্রুটি করেনি। পকোড়া ভেজে, চিনেবাদাম দিয়ে কাঠখোলায় ভাজা চিঁড়ে ছোট ছোট প্লেটে পুলকের হাত দিয়ে পাঠিয়েছে। পুলক বার বার অনুরোধ করাতে খুব আস্তে আস্তে দুটো ড্রিঙ্ক নিয়েছিল অবিনাশ, কিন্তু গোলমাল বাঁধালো পুলক নিজে, অভ্যাস নেই, তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে চড়ে গিয়েছিল তার....নানা রকম বিলকি-ছিলকি কথা বলে বলে ক্লান্ত হয়ে শেষে ভুতুমের মত গোঁজ হয়ে বসেছিল। সেই প্রথম ও শেষবার পুলকের বাড়ি যাওয়া।
এখন রাত কত, আকাশের দিকে তাকিয়ে বোঝবার উপায় নেই। বাসটা যত এগোচ্ছিল, জল এসে তাকে বেশি করে ছুঁয়ে যাচ্ছিল, শেষে এই মিঠি নদীর পাশের রাস্তায় এসে একজস্টে জল ঢুকে বাসটাকে পাথর করে দিল। ততক্ষণে অন্ধকার জাঁকিয়ে বসেছে, আমার শহরের আলোগুলি জ্বলে উঠতে পারেনি। আশপাশে বেশ কয়েকটা প্রাইভেট গাড়ির জানালা ছাড়িয়েছে জলস্তর।
ড্রাইভার কোনো ঝুঁকি না নিয়ে তখনই সবাইকে বাসের ছাদে উঠিয়ে দিয়েছিল। ভাগ্যিস ওই ছেলেটাকে তখন তারা কোন রকমে তুলে আনতে পেরেছিল, কারণ বাসের ভিতরে এখন বসা অবস্থায় বুক-জল। ছেলেটিকে সিটে শুইয়ে রাখা যেত না। সেইসব গাড়ির কয়েকটার ছাদও এখন দেখা যাচ্ছে না আর। পৃথিবী কি আজকেই শেষ হয়ে যাবে?
এই রকম বৃষ্টি বোধহয় গত একশো বছরেও দেখে নি এই শহর। এখানে মেঘ ঘনাতে দেখেছে ছোট ছোট টিলার মত পাহাড়ের চূড়োয়....চুড়োটা ঢেকে গিয়ে আধখাওয়া আইসক্রিমের মত দেখতে...
কতদিন বাসে করে হাইওয়েতে যেতে যেতে দেখেছে ডানদিকে গরানের জঙ্গল থেকে বৃষ্টির ছাঁট হাওয়ায় উড়ে রাস্তা পার হচ্ছে সিগনাল ঝাপসা করে দিয়ে...আছড়ে পড়ছে বাঁ-দিকের রুক্ষ লাল পাথুরে জমির বাবলা ঝোপগুলিতে।
কিন্তু আজকের বৃষ্টির রকমসকমই আলাদা। গোঙানির মত হাওয়ার শব্দের সঙ্গে সাদা চাদরের মত বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। একটানা।
ছেলেটার অবস্থা ভাল নয় মোটেই। তার দাঁত খটখট করেছে, চোখদুটো ঘুরছে, ধূসর আকাশের ছায়া বুকে নিয়ে। ঘাড়টা কেমন স্টিফ লাগছে হাতে। গা শিরশির করে ওঠে অবিনাশের... ছেলেটার মৃগী আছে নাকি? মৃগীরোগীর জিভে দাঁত লেগে অনেক কেলেঙ্কারি হওয়ার কথা পড়েছে সে, দাঁতের ফাঁকে কী যেন গুঁজে দিতে হয়? হঠাৎ তার মনে হয়, এটাও একটা স্বপ্ন নয় তো, এক্ষুনি ভেঙে যাবে?... কিন্তু সেই জেগে ওঠা স্বপ্নে নিজের ভূমিকা ঠিক কী হবে সে ভেবে উঠতে পারে না...গলার কাছটা দপদপ করতে থাকে। অথচ বুকপকেটে ভিজে পাঁপড়ের মত সেই চিঠিটা তাকে পুরোপুরি স্বপ্নে ডুবতে দেয় না।
তখনই গাছপালার আড়াল থেকে একটি প্রায়ান্ধকার বারান্দায় লন্ঠনের মত আলো চোখে পড়ে। চতুর্দিকে জলের মধ্যেও প্রায় এক রকম দেখতে তিন-চারতলা বাড়ি দেখে জায়গাটা কতকটা চিনতে পারে। কোনো সরকারি আবাসন। মানুষ আছে, বসতি আছে।
দেখে যেন বল পায় অবিনাশ। চিৎকার করে দৃষ্টি আকর্ষণ করবার চেষ্টা করে। ছেলেগুলোও।
৫
কেউ একজন তাকে ঠেলা দিতে ধড়মড় করে উঠে বসে অবিনাশ। একটা চায়ের গেলাস আর একটি পাও তার দিকে বাড়িয়ে ধরেছেন এক মহিলা, সম্ভবত গৃহকর্ত্রী। অবিনাশ একবার ভাবে সকালে উঠে প্রাকৃতিক চাপ থেকে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত কিছু খাওয়া উচিত হবে না। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে কাল বিকেল পাঁচটায় চায়ের দোকানে একটা কাটিং চা ছাড়া গত কয়েক ঘন্টায় পেটে দানাপানি পড়েনি।
মহিলার চেহারা অতি সাধারণ, একটা মলিন ম্যাক্সি, হাতে সবুজ চুড়ি--এয়োতির চিহ্ন, কিন্তু তাঁর তেঁতুলপাতার মত অপরিসর এই ছাদের নিচে কতজনকে আশ্রয় দিয়েছেন নির্দ্বিধায় সেকথা না দেখলে বোঝা মুশকিল। কৃতজ্ঞতা গোপন করার জন্য তাঁর দিকে তাকায় না অবিনাশ। নাছোড়বান্দা গৃহকর্ত্রী আবারও নরম স্বরে তাকে জিজ্ঞেস করে...বেটে কো দেখেঙ্গে নেহি?
বেটা? তাহলে কালকের সন্ধ্যাটা স্বপ্ন নয়! একটু একটু করে মনে পড়ে সাঁতরাতে সাঁতরাতে কিভাবে কয়েকজন এসে সেই ছেলেটাকে শাড়ির পাকানো দড়ির বেড় দিয়ে নিজেদের সঙ্গে বেঁধে ফেললো। অর্ধচেতন দেহটাকে পিঠে ফেলে সাঁতারে অতিক্রম করলো বাস আর সেই দোতলার বারান্দার মাঝের অংশটুকু। প্রায় একইভাবে তাদের সবাইকে নিয়ে গেল সেই অপরিসর ফ্ল্যাটে...সেখানে আগে থেকেই আরো যে কতজন আশ্রয় নিয়েছিল। তুমুল উত্তেজনায় অবিনাশ বা সেই ছেলেগুলি কেউ যখন গুছিয়ে কথাও বলতে পারছে না, তারই মধ্যে কয়েকজোড়া হাত ছেলেটার দায়িত্ব নিয়ে নিল, কেউ শুকনো কাপড় বাড়িয়ে দিল গা মাথা মোছার জন্য। অবিনাশ বারান্দাতেই বসে পড়েছিল, তারপর তার আর কিছু মনে নেই।
মহিলা চায়ে বোধহয় আদা ছেঁচে দিয়েছেন....সেই গন্ধটা আসছে...নমিতার চায়ের মতই। বাঁ হাতে চায়ের গেলাসটা ধরে সে, ডান হাতে পাও-এর টুকরোটা নিয়ে চায়ে ডোবায়। গেলাসের উষ্ণতা সঞ্জীবিত করছিল তাকে।
মহিলা আবার বললেন, বেটে কো দেখেঙ্গে নহি? অভি সো রহা হ্যায়। ঠিক হো জায়েগা। তখন অবিনাশের মনে পড়লো কাল থেকে নমিতাকে ফোন করা হয়নি, করা যায়নি। সে কি তার সান্ধ্য রুটিন সেরে নিরাপদে ফিরেছে ঘরে? একটা ফোন করা দরকার, এখনই। মহিলাটিকে একটা সচল ফোনের জন্য অনুরোধ করাতে তিনি বললেন, দেখছি, বলেই ভিতরে চলে গেলেন।
ততক্ষণে সে একবার ঘরের মধ্যে উঁকি দিল। এক কোণে ডিভানে একখান ঘুমন্ত তরুণ মুখের দিকে একবার তাকালো সে। শ্যামবর্ণ, বর্তুল নাক, ঈষৎ কোঁকড়ানো চুলে ঘেরা মুখখানি দেখে কালকের চেয়েও বাচ্চা বলে মনে হচ্ছিল ছেলেটাকে। ওর বন্ধুগুলিও আশেপাশে এঁকেবেঁকে শুয়ে, ঘুমোচ্ছে। এখন নমিতার মতই তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা হচ্ছিল তার।
আজকাল রোজ বিকেলে সেজেগুজে বড় রাস্তায় তাদের গলির মুখটায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নমিতা, যতক্ষণ না দিনের শেষ ইস্কুল বাসটা কাঁধে-ব্যাগ খুদের দলকে নামিয়ে চলে যায়, ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে....অবিনাশ কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারেনি কখনো।
যেদিন থেকে ডাক্তার নমিতাকে বলেছে যে সে কোনদিন মা হতে পারবে না, সেদিন থেকে নমিতা যেন পাগল হয়ে উঠেছে। নমিতা দেওয়ালে ক্যালেন্ডার কেটে শিশুর ছবি টাঙায়...অবিনাশ অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে। নমিতা রাস্তায় দাঁড়িয়ে স্কুলবাস দেথে...অবিনাশ আরো দেরি করে বাড়ি ফিরবার চেষ্টা করে। নমিতার খেয়ালে নির্বিচারে সামিল হতে পারে না। রক্তের সম্পর্কহীন একটা জীবন্ত পুতুলের ভাবনা তাকে আকৃষ্ট করে না।
কিন্তু নিজের দিকে তাকিয়ে স্বস্তি না পেলে কী করে মানুষ? গোবরডাঙার নীলা একদিন ভয়ে, লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে যেতে তাকে যে খবরটা দিয়েছিল তাতে পৃথিবীটা যেন এক লহমায় জন্য থেমে গিয়েছিল। বিশ্বাসভঙ্গের বেদনায় নীলা বাজ পড়া গাছের মত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সে তো পালাতে চায়নি, খানিকটা সময় চেয়েছিল শুধু। আরেকটি দুঃস্বপ্নময় বাসযাত্রার প্রস্তুতি, এই তো...
রফিক ম্যানসনে পুলকের স্খলিত-জড়িত কন্ঠস্বর মনে পড়ে...মন পাইলাম না দাদা, মাইয়ামানুষের মনের তল পাইলাম না। আগের পক্ষের ছেলে আছে একটা, মা কালীর কিরা, তারে কাছে রাখতে আমার কোনো আপত্তি নাই...কিন্তু কিসুতে দিব না আনতে। এই যে বাচ্চা হইব, বাচ্চা হইব চলতাসে...তাতেও সুখের আলো দেহি না। আমি কই যাই কয়েন দাদা! পুলকের চোখে জল, পাশের ক্যাবিনেট থেকে টেনে এনেছে একরাশ ব্যক্তিগত ছবির এ্যালবাম।
ঠিক এমনি সময়ে বেরিয়ে এসেছিল পুলকের বৌ। সোজাসুজি তাকিয়েছিল তার দিকে। তাকে দেখে চমকে উঠলেও আচরণে তা টের পেতে দেয়নি অবিনাশ। পুলক ততক্ষণে বসে বসে ঝিমোচ্ছে।
অনেক রাত হল, বৌদি চিন্তা করবেন। আপনি এখন আসুন। বরফের মত ঠান্ডা গলায় বলেছিল নীলা। অবিনাশ নিঃশব্দে উঠে জুতো পায়ে গলাল, ব্যাগটা নিল কাঁধে। সে অবিনাশের সঙ্গে দরজা পর্যন্ত এসে বলেছিল--পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ হবে না! আমার নাম বনলক্ষ্মী। অশোকনগরে বাড়ি। আপনাদের চিনি না। আপনিও চেনেন না আমাকে। আর আসবেন না এখানে।
সম্ভবত সেদিন থেকেই ওই দীন প্রার্থনার শুরু...এটা একটা স্বপ্ন হোক, হে ঈশ্বর, বলো, জেগে উঠি...নাহয় ফের স্বপ্নের মধ্যে মরে যাই। আসলে দুঃস্বপ্নের শুরু বলে আসলে কিছু নেই... একটা দুঃস্বপ্ন থেকে আরেকটা দুঃস্বপ্নে পা রেখেই তো চলেছে এতদিন। পাথরে পা রেখে খরস্রোতা পাহাড়ি নদী পারাপার। সে করেছে ...নমিতা করেছে...নীলা, না না, বনলক্ষ্মী...যে যার নিজের মত করে...।
মহিলা বড্ড দেরি করছেন। টানা আঠেরো ঘন্টা বিদ্যুৎহীন শহরে মোবাইল জীবন্ত থাকার সম্ভাবনা কম। আশার কথা জল নেমে গিয়েছে অনেকটাই। বাস-অটো না চলুক টুকটুক করে হাঁটলেও ঘন্টা তিন-চারের মধ্যে নিজের ঘরে পৌঁছে যেতে পারে অবিনাশ। এই রকম পরিস্থিতিতে আটকে না থেকে পথে নেমে পড়াই সঙ্গত বলে মনে হয়। আরেকবার ঘরের মধ্যে উঁকি দিল, ছেলেটা আশ্চর্য শান্তিতে নিথর হয়ে ঘুমোচ্ছে...আচ্ছা, ও বেঁচে আছে তো? ভাবতে ভাবতেই পাশ ফিরলো, একটা বড় শ্বাস পড়ল ছেলেটার। নাঃ, তাহলে তো সব ঠিকই আছে।
দেওয়ালে বাবাসাহেব আম্বেদকরের ছবি, তার পাশে ধ্যানমগ্ন তথাগতর ছবি--অনেক যুগ আগে যে মানুষটা ঘুমন্ত স্ত্রী-পুত্রকে শেষ দেখা দেখে দুঃখকে জয় করার সংকল্প নিয়ে ঘর ছেড়েছিলেন। তারও কিছুদিন পরে ক্রমাগত আত্মপীড়নে ক্লান্ত সেই মানুষটিই এক গ্রাম-রমণীর হাত থেকে পরমান্ন গ্রহণ করে ধন্য হয়েছিলেন। হয়ত সেই ক্ষণিক স্বস্তিই তাঁর সহায় হয়েছিল, জয়ী করেছিল তাঁকে।
আর কারো অপেক্ষা না করে, কাউকে আর কিছু না বলেই বেরিয়ে পড়লো অবিনাশ।