যাই হোক আসল কথাটাতে আসি। অনেক বন্দোবস্ত আর অপেক্ষার পর জেঠু যখন আমাদের বাড়িতে এলেন তখন বিকেল ছটা বাজে। তাঁকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল।
বাবা বেশ ঘাবড়ে গিয়েই জিগ্যেস করলেন, “দাদা তোমাকে ওই রকম দেখাচ্ছে কেন? তোমার শরীর ভালো তো?”
জেঠু শুধু বললেন, “হুঁ! সারাদিন কনফারেন্সে ছিলাম তো তাই মাথাটা একটু ধরেছে। এক কাপ কড়া চা পেলে দারুণ হত।”
মা চা করতে ছুটলেন। পিসি জল নিয়ে এলেন। চা জলখাবার খেয়ে জেঠু বললেন, “ঠিক আছে এবার আমি একটু নিজের ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিতে চাই। খাবারের টেবিলে আবার দেখা হবে।”
আমাদের মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল। জেঠু তো আমাদের সঙ্গে তেমন কথাই বললেন না! কী করব ভাবছি এমন সময় অনন্তদা এসে চুপি চুপি আমাদের বলল, “বড়দা তোমাদের ডাকছেন। শুধু তোমরা তিনজন, আর কেউ নয়! কিছু জরুরি কথা আছে!”
আনন্দে তখন আমাদের বুক ফেটে যাওয়ার জোগাড়! জেঠু আমাদের সঙ্গে দরকারি কথা বলতে চান! আমরা তিনজন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জেঠুর ঘরে গিয়ে হাজির হলাম। দরজায় টোকা দিতে জেঠু বললেন, “কাম ইন!”
আমরা ঘরে ঢুকতে জেঠু বললেন, “দরজাটা বন্ধ করে দাও।” তুলি দরজাটা বন্ধ করে দিল। জেঠু খাটে বসে ছিলেন। নিজের পাশের জায়গাটাতে তুলিকে বসতে বললেন আমি আর ক্যাবলা দুটো চেয়ার নিয়ে বসলাম।
জেঠু বললেন, “তোমরা তো জানো আমি আজ একটা কনফারেন্সে গিয়েছিলাম। ছোট মিটিং। খুব বেশি লোক ছিল না। কিন্তু একটা গন্ডগোল হয়েছে সেই জন্যেই আমাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছিল যখন এলাম তখন।”
ক্যাবলা বলল, “কি হয়েছে?”
জেঠু বললেন, “এক একটা টেবিলে আমরা ছ’জন করে বসেছিলাম। যখন যার টক তখন সে উঠে গিয়ে সামনের পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে টক দিচ্ছিল। আমার টক ছিল শেষে। আমি যখন উঠে টক দিতে যাই তখন আমার ল্যাপটপ আর পেন ড্রাইভটা টেবিলেই রেখে গিয়েছিলাম। দশ মিনিটের টক শেষ করে ফিরে এসি দেখি আমার পেন ড্রাইভটা হাওয়া! প্রথমে ভেবেছিলাম নীচে পড়ে গেছে হয়তো কিন্তু নীচে বা আশপাশে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সেটাকে পেলাম না। আমার মনে হচ্ছে, না মনে হচ্ছে না, আমার স্থির বিশ্বাস যে আমার টেবিলে বসে থাকা কেউ ওটাকে সরিয়েছে। ওটাতে আমার কাজ সংক্রান্ত অনেক তথ্য আছে। আমার কাছে সেই সবের কপি আছে অবশ্যই, কিন্তু অন্য কারো হাতে পড়লে সে ওই কাজ চুরি করে আমার অনেক ক্ষতি করতে পারবে। সে এগিয়ে গিয়ে আমাকে পিছিয়ে দিতে পারবে। সেই জন্যেই ওই পেন ড্রাইভটা আমার চাই। কে চুরি করেছে সেটাও আমার জানা দরকার যাতে সে আমার কাজের অপব্যবহার না করতে পারে। আমার সব থেকে বড়ো প্রতিদ্বন্দ্বী মার্কিন মুলুকের এক বৈজ্ঞানিক কেভিন সিল্ভার। আমাদের কাজ নিয়ে যাকে বলে একেবারে নেক অ্যান্ড নেক ফাইট কিন্তু সে এই ছোট মিটিংয়ে আসেনি।”
আমরা তিনজন কিছু বলছি না দেখে জেঠু বললেন, “তোমাদের কেন ডেকেছি তাই ভাবছ তো? আগামীকাল কনফারেন্সের শেষ দিন। আমি চাই কালকের মধ্যেই চোর ধরা পড়ুক। সেই কাজে তোমরা আমাকে সাহায্য করবে। তোমরা আমার সঙ্গে যাবে আর চোখ কান খোলা রাখবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তোমাদের কেউ সন্দেহ করবে না!”
তুলি গোয়েন্দা গল্পের পোকা, তার চোখ চকচক করে উঠল, “আমরা গোয়েন্দা হব?”
জেঠু বললেন, “হ্যাঁ। আমি তো কালকেও কনফারেন্সের নানান লেকচার শুনতে ব্যস্ত থাকব তাই তোমরা হবে আমার চোখ আর কান, কেমন?”
ভাগ্যিস পরের দিনটা শনিবার আর আমাদের ছুটি তাই জেঠু আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চাইলে কেউ কিছু বলবে না। স্কুল কামাই করে মা মোটেও কোথাও যেতে দেন না। অবশ্য জেঠুর সঙ্গে যাবো বললে হয়তো যেতে দিতেও পারেন।
জেঠু বললেন, “আমার টেবিলে কে কে ছিল আর কী ভাবে বসেছিল আমি বলে দিচ্ছি। কাগজপত্র ছড়ানো ছিটানো ছিল তাই যে কারোর পক্ষে ওটা নেওয়া সম্ভব ছিল। আমার ডান পাশে বসেছিল আমার সহকারী অরিন্দম সান্যাল। অন্য পাশে বসেছিলেন দিল্লির এক সংস্থার বৈজ্ঞানিক অনিল চোপড়া। চোপড়ার পাশে বসেছিলেন চেন্নাই ইউনিভার্সিটির শ্রীনিবাস সত্যানাথন আর তাঁর সহকারী গোপেশ, তাঁর পদবি আমার জানা নেই। সব শেষে ছিলেন ব্রিটিশ বৈজ্ঞানিক বব হ্যারিসন, গ্লাসগো ইউনিভার্সিটি থেকে এসেছেন উনি। অরিন্দমকে ছাড়া যে কজন তাদের গতিবিধির ওপর নজর রাখতে হবে তোমাদের। অরিন্দমকে আমি সন্দেহ করছি না কারণ কাজটা অন্য কেউ চুরি করে নিলে আমার যেমন ক্ষতি হবে ওরও তেমন ক্ষতি হবে। এই কজনের মধ্যেই কেউ কাজটা করেছে। অন্য টেবিল থেকে কারো এসে ওটাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। লোক কম আর জায়গা বড়ো বলে টেবিলগুলো বেশ দূরে দূরে।”
সেদিন রাতে আমাদের চোখের পাতা প্রায় এক হচ্ছিল না। প্রচণ্ড উত্তেজনা। আমরা যদি জেঠুর হারানো পেন ড্রাইভ খুঁজে দিতে পারি তাহলে সেটা তো বিশাল ব্যাপার হবে। তুলি ফিসফিস করে বলল, “ক্যাবলাদা না পেয়ে আমরা চোর ধরতে পেলে আরো জমে যাবে ব্যাপারটা, তাই না?
আমি বললাম, “সে আর বলতে! দেখা যাক কী আছে কপালে!”
(২)
পরদিন সকালে আমরা তিনজন তৈরি হয়ে চললাম জেঠুর সঙ্গে। মা-বাবাকে বলা হয়েছে কনফারেন্স কিছুক্ষণের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে আর তারপর আমরা জেঠুর সঙ্গে কোথাও একটা বেড়াতে যাবো। জেঠুকে আবার বাড়ি ফিরে যাতে আমাদের নিয়ে না যেতে হয় তাই আমরাও সঙ্গে যাচ্ছি। কনফারেন্স সেন্টারটা বাড়ি থেকে কিছুটা দূরেই তাই কেউ আর অন্য কিছু সন্দেহ করল না।
আমরা তিনজন জেঠুর সঙ্গে কনফারেন্স সেন্টারে গিয়ে পৌঁছলাম। বেশ ভালো ব্যবস্থা। হলের এক পাশে চা, কফি জল ইত্যাদির ব্যবস্থা। আরেক দিকে দুটো কম্পিউটার রাখা। কেউ যদি নেটে কিছু দেখতে চায় সেই জন্যে। বেশ আগেই পৌঁছে গিয়েছিলাম আমরা। তখন সংগঠকরা ছাড়া আর কেউ আসেনি। না, আসেনি বললে ভুল হবে অরিন্দমদা এসে গিয়েছিল। জেঠু আমাদের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, “অরিন্দম, আমরা তো একবার কনফারেন্স শুরু হয়ে গেলে আর জায়গা থেকে খুব একটা নড়তে পারব না। এরা তিনজন যা করার করবে। ওই ফ্ল্যাশ ড্রাইভ পেন ড্রাইভ যা বলো সেটাকে খুঁজে পেতেই হবে, সঙ্গে যে নিয়েছে তাকেও যাতে সে আমাদের কাজ চুরি না করতে পারে।”
অরিন্দমদা বলল, “স্যার, আমি কাল ফিরে গিয়ে নেট ঘেঁটে কিছু রিসার্চ করেছি। বেশ কিছু ইন্টারেস্টিং ব্যাপার জানতে পেরেছি।”
“কি রকম?”
“অনিল চোপড়া কয়েক বছর আগে কিছু ভুয়ো মনগড়া তথ্য প্রকাশ করার জন্যে শাস্তি পেয়েছিলেন। বেশ কয়েকটা জার্নাল থেকে আর্টিকেল ফেরত নিতে হয়েছিল তাঁকে। তার মানে বুঝতেই পারছেন…”
“হুঁ, চৌর্যবৃত্তিতে পারদর্শী বলতে চাইছো?”
“ঠিক তাই, স্যার!”
“আমারও মনে পড়ছে, ওয়ার্নিং দেওয়া হয়েছিল মনে হয় তাকে!”
“হ্যাঁ, স্যার।”
“আচ্ছা, বাকিদের সম্পর্কে কিছু?”
“না স্যার। তবে এরা সবাই আমাদের সঙ্গে একই লাইনে কাজ করে। এদের যেকোন কারো কাছেই ওই পেন ড্রাইভটা খুব দামি। কাজ না করেই গবেষণা অনেকটা এগিয়ে যাবে আমাদের ডেটাগুলো পেলে।”
জেঠু তাই শুনে মাথা নেড়ে বললেন, “সে আর বলতে!”
ক্যাবলা বলল, “আচ্ছা মামা, আমাদের কী বলে আলাপ করাবেন ওদের সঙ্গে? ওদের সঙ্গে একটু কথা বললে তো ভালো হয়!”
জেঠু বললেন, “তাই তো…সেটা নিয়ে তো ভাবিনি…”
আমি বললাম, “জেঠু, এটা বললে হয় না যে আমরা আমাদের স্কুলের ম্যাগাজিনের জন্যে কয়েকজন সত্যিকারের বৈজ্ঞানিকদের ইন্টারভিউ নিতে চাই। সেই জন্যে আপনার সঙ্গে এসেছি। আপনার টেবিলে যাঁরা রয়েছেন তাঁদের সঙ্গে কথা বলাটাই তো সুবিধার তাই…”
শুনে জেঠু আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, “আরিব্বাস! দারুণ আইডিয়া তো! এর চেয়ে ভালো কিছু আমিও ভেবে বার করতে পারতাম না।”
একটু পরেই অনিল চোপড়া এসে পড়লেন। জেঠু ওঁকে আমার বলা কথাটা আওড়ে দিলেন। ক্যাবলা প্রশ্ন করতে শুরু করল দুম করে তাই বাধ্য হয়ে আমাকে খাতা পেন্সিল বার করে লেখার ভান করতে হল।
কি নিয়ে কাজ করেন। ল্যাবরেটরি কোথায়, কত জন লোক কাজ করে ইত্যাদি জিগ্যেস করেই ক্যাবলা দুম করে জিগ্যেস করে বসল, “আপনি কয়েক বছর আগে ভুল কিছু তথ্য প্রকাশ করার জন্যে কিছু পেপার ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হন, সেই সম্পর্কে আপনার কিছু বলার আছে?”
আমার ভয়ানক রাগ হচ্ছিল ক্যাবলার ওপর! কোন মানে হয় ওই সব প্রশ্ন করার? লোকটা কি বলবে হ্যাঁ, আমি চুরি করেছি! জেঠু শুনলে যা রেগে যাবেন না!
অনিল চোপড়া অবশ্য মনে হয় ওই রকম প্রশ্নের সম্মুখীন আগেও হয়েছেন। দিব্যি শান্তভাবে বললেন, “হ্যাঁ, আমার ল্যাবের একজন ভুল তথ্য আমাকে জানিয়েছিল। আমার যেটা ভুল হয়েছিল সেটা হল আমি তার কথায় বিশ্বাস করেছিলাম। নিজে বা অন্য কাউকে দিয়ে যাচাই করে দেখিনি। সেই থেকে আমি সাবধান হয়ে গেছি। কোন রকম ভুল পদক্ষেপের থেকে দূরে থাকি, ওই একটা ঘটনার জন্যে আমার চাকরি প্রায় চলে যাচ্ছিল আর আমার মান সম্মান সব কিছু অনেকটাই ধূলিসাৎ হয়েছিল।”
আমি কথা ঘোরাবার জন্যে প্রশ্ন করলাম, “আপনি কি প্রথম এই শহরে এলেন? আমাদের শহরটা কেমন লাগছে আপনার?”
ক্যাবলা আমার দিকে কটমট করে তাকালো বটে কিন্তু কিছু বলল না।
এর পর শ্রীনিবাস সত্যানাথন আর তাঁর সহকারী গোপেশ গাউন্ডার এসে পড়লেন। তাঁদের সঙ্গেও কথা বললাম আমরা। ল্যাবরেটরি কোথায়, কত জন লোক কাজ করে, ফিরে গিয়ে কিছু প্রকাশ করার পরিকল্পনা আছে কিনা। শ্রীনিবাস সত্যানাথন বললেন, না কিছু কাজ মাঝপথে ঝুলে আছে সেগুলো শেষ করে তবেই কিছু প্রকাশ করার কথা ভাববেন, তার আগে নয়। সহকারী ভদ্রলোক খুব কম কথা বললেন অবশ্য। বসের কথায় মাথা নেড়ে চললেন শুধু।
এর পর যেটা হল সেটা একেবারে অপ্রত্যাশিত। কনফারেন্স শুরু হওয়ার সময় এসে গিয়েছিল তাই আমাদের ওই ভুয়ো ইন্টারভিউ শেষ করতে হল। বব হ্যারিসনের সঙ্গে পরিচয় হল আমাদের শুধু ওইটুকুই। উনি বললেন লাঞ্চের সময় নিশ্চয়ই আমাদের সঙ্গে কথা বলবেন।
এর পর সবাই যে যার জায়গায় গিয়ে বসে পড়লেন। আমাদের জন্যেও জেঠু নিজের টেবিলের কাছাকাছি কয়েকটা চেয়ার আনিয়ে নিয়েছিলেন আমরা তাতে গিয়ে বসলাম।
জেঠু হঠাৎ উঠে আমাদের তিনজনের কাছে এসে বললেন, “পেন ড্রাইভটা আমার চেয়ারের ওপর রাখা ছিল। একটু আগেই কেউ রেখেছে মনে হয়!”
ক্যাবলা বলল, “হ্যাঁ, মামা আমি এসেই তোমার চেয়ারটায় একবার বসে নিয়েছিলাম, তখন তো ওখানে কিছু ছিল না!”
জেঠু বললেন, “মনে হয় ভয় পেয়ে ফিরিয়ে দিয়েছে। কী আর করা যাবে। যাক তোরা বোস। কনফারেন্স শেষ হওয়ার আগেই না হয় বেরিয়ে যাবো।”
সেই শুনে আমাদের তিনজনের মনটা খারাপ হয়ে গেল।
ক্যাবলা ফিসফিস করে বলল, “এদের সবার কাছে ল্যাপটপ আছে। সব কিছু পেন ড্রাইভ থেকে ল্যাপটপে কপি করে নিলেই তো হয়ে গেল পেন ড্রাইভটার তো আর দরকার নেই, তাই না?”
আমি আর তুলি মাথা নাড়লাম। ক্যাবলা বলল, “সবার ল্যাপটপ দেখতে হবে!”
আমি বললাম, “ধুস! তাও কি সম্ভব নাকি!”
ক্যাবলা বলল, “দ্যাখ, চোপড়াকে বাদ দেওয়া যেতে পারে। সে ঘরপোড়া গরু, সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পাবে তাই তার অত সাহস হবে না।”
তুলি বলল, “হুঁ, ওর কথা শুনে আমারও তাই মনে হয়েছিল।”
তাহলে অরিন্দমদা আর চোপড়া বাদ। বাকি রইল ডক্টর শ্রীনিবাস সত্যানাথন, গোপেশ আর বব হ্যারিসন।”
তুলি বলল, “গোপেশের কাছে ল্যাপটপ নেই। ফোনেতেই সব করছে!”
“তাহলে তো আরো ভালো, মোটে দুটো! তোরা শ্রীনিবাস সত্যানাথনেরটা সামলা আমি ববেরটা দেখছি। ওরা কেউ বাইরে বেরোলেই তার জায়গায় বসে পড়ে কাজটা করতে হবে। বেশ ঝুঁকির কাজ, কিন্তু উপায় নেই।”
আমি কিছুই করতে পারলাম না কারণ শ্রীনিবাস সত্যানাথন আর গোপেশ কখনই এক সঙ্গে বাইরে যান না। সবারই এটা-সেটা ফোন আসছে। একবার জেঠু ফোন ধরে বাইরে গেলেন, জেঠু ফিরে আসতে অরিন্দমদার ফোনটা বেজে উঠল এবং সেটা ধরেই বাইরে চলে গেল অরিন্দমদা। শ্রীনিবাস সত্যানাথনের ফোন বাজতে তিনি ধরে বাইরে গেলেন কিন্তু গোপেশ তো রইলেন তাই আমি কিছু করতে পারলাম না। বব হ্যারিসনের কোন ফোনটোন আসেনি কিন্তু উনি মনে হয় বাথরুমে যাওয়ার জন্যে বার হলেন, আর ক্যাবলা সেই সু্যোগে ঠিক টুক করে ওঁর চেয়ারে গিয়ে বসে পড়ল। বেশ ভালো অভিনয় করছিল সেটা মানতেই হবে। আড়চোখে ল্যাপটপটাকে দেখছিল। একবার হাতটাকে সরিয়ে নিয়ে এটা-সেটা নাড়তে লাগল। সবাই টক শুনতে ব্যস্ত ওর দিকে কারো নজর নেই আমাদের ছাড়া।
একটু পরেই ফিরে এসে বলল, “কাজ হয়ে গেছে।” বলে জেঠুর কাছে গিয়ে ফিসফিস করে কী সব বলল।
জেঠু এবার সংগঠকদের একজনকে ডেকে কী সব বললেন। তাঁদের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা দিল। ততক্ষণে বব হ্যারিসন ফিরে এসেছেন। যে টকটা চলছিল সেটা শেষ হয়ে যাওয়ার পর সংগঠকদের একজন ঘোষণা করলেন যে অনিবার্য কারণে আধ ঘন্টার বিরতি নেওয়া হচ্ছে। সবাই যেন হল ছেড়ে বেরিয়ে যান ৭ নং টেবিল ছাড়া, মানে জেঠুর টেবিল ছাড়া।
সবাই চলে যেতেই জেঠু বব হ্যারিসনকে বললেন, “তোমার ল্যাপটপটা আমি একবার দেখতে চাই!” সে তো কিছুতেই দেবে না! শেষে সংগঠকদের সাহায্যে সেটা নিয়ে দেখতেই বেরিয়ে পড়ল ফাইলটা। সি এস ডেটা লেখা একটা ফাইল যেটাতে পেন ড্রাইভ থেকে সব কিছু কপি করে ফেলা হয়েছিল।
জেঠু উত্তেজিত হয়ে বললেন, “আপনি এত বড়ো একজন বৈজ্ঞানিক হয়ে এই রকমটা করবেন আমি ভাবতেও পারিনি! আমার ভাগ্নে আপনার ল্যাপটপে সি এস লেখা ফাইলটাকে দেখতে পেয়ে আমাকে জানায়। আমি হয়তো খেয়াল নাও করতে পারতাম যে আমার পেন ড্রাইভটাকে পাওয়া যাচ্ছে না কিন্তু আমি খেয়াল করেছিলাম।”
কেউ কিছু বলছে না। পিন পড়লে শব্দ শোনা যাবে এমন নিঃস্তব্ধতা। এর মধ্যে তুলি হঠাৎ বলে উঠল, “কিন্তু জেঠু, উনি তো বব হ্যারিসন নন!”
এবার জেঠুর চমকে যাওয়ার পালা! বললেন, “অ্যাঁ, কী বলছিস?”
“এই দ্যাখো,” বলে তুলি বাবার ফোনটা এগিয়ে দিল। আমরা সারাদিন এদিক-ওদিক ঘুরবো বলে বাবা নিজের ফোনটা আমাদের দিয়েছিলেন যাতে দরকার হলে ফোন করতে পারি। তুলি সেটাতেই বসে বসে কী সব সার্চ করেছে!
সত্যিই তো মুখের প্রচুর মিল, এক ঝলকে ভুল হলেও হতে পারে, কিন্তু এই লোক বব হ্যারিসন নয় সেটা গ্লাসগো ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে দেওয়া বব হ্যারিসনের ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে।
তুলি বলল, “আরেকটা কথা আছে জেঠু। আমি যখন বাথরুম থেকে ফিরছি তখন অরিন্দমদা কাউকে ফোন করছিল। আমি সেটাকে রেকর্ড করে ফেলেছি। এটা শুনে দেখতে পারেন।”
বলে বাবার ফোনে একটা রেকর্ডিং চালিয়ে দিল তুলি।
আমরা সবাই অবাক হয়ে শুনলাম অরিন্দমদার গলা, “হ্যাঁ কাকু আমি বাবু বলছি। যাক ফোন করে ভালো করেছো। কাল বার বার ফোন করেও তোমাদের পাইনি। কী যে করো! দরকারে কখনো তোমাদের লাইন পাওয়া যায় না। আর নেটের অবস্থা তো আরো খারাপ। আজ আমার হাতে সময় নেই কনফারেন্সে আছি। দরকারি কথাটা বলে নিই। টাকার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। তুমি অপারেশানের জন্যে যা লাগে তা করো। দুয়েকদিনের মধ্যেই টাকা পাঠিয়ে দেবো তোমার অ্যাকাউন্টে। ঠিক আছে। আর কথা বলা যাবে না। এবার যেতে হবে। রাতে আবার চেষ্টা করব।”
জেঠু মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। সংগঠকরা পুলিশ ডাকতে চাইতে বব হ্যারিসন সেজে যে লোকটা এসেছিল সে ভয় পেয়ে গিয়ে বলল, “ও কী বলছে আমি জানি না কিন্তু আমি ওকে কুড়ি হাজার ডলার দিয়েছি ওই ফ্ল্যাশ ড্রাইভটার জন্যে! আমি তো চুরি করিনি! ও আমাকে জিনিসটা বিক্রি করেছে!”
জেঠু বললেন, “কিন্তু কেন?”
লোকটা বলল, “তোমার ওই সহকারীকে জিগ্যেস করো। সে কেভিনকে ফোন করে বলে তার কাছে দারুণ ডেটা আছে কেভিনের কাজে লাগার মত। কুড়ি হাজার ডলার দিলে সেই ডেটা কেভিনের হয়ে যাবে। কুড়ি হাজারটা কেভিনের কাছে কোন অর্থই নয় তাই সে রাজি হয়ে যায়। তার পক্ষে আসা সম্ভব ছিল না তাই আমাকে পাঠায় সে। আমি ইউ এস এ থেকে আসতে তোমার সহকারী বলে আমাকে এই কনফারেন্সে আসতে হবে বব হ্যারিসন সেজে তখন ফ্ল্যাশ ড্রাইভ দেবে। দুদিনের ব্যাপার তাই আমি রাজি হয়ে যাই। ও গতকাল আমাকে ফ্ল্যাশ ড্রাইভটা দিয়েছিল; কথা ছিল আমি ডেটা সব কপি করে ওকে আজকে ফেরত দিয়ে দেব। আজ সকালেই আমি ওকে ফ্ল্যাশ ড্রাইভটা ফিরিয়ে দি। আমার কোন দোষ নেই। আমি তো দাম দিয়ে একটা জিনিস কিনেছিলাম।”
জেঠু অরিন্দমদাকে জিগ্যেস করলেন, “কেন অরিন্দম? তোমার এত কেন অর্থের দরকার হয়ে পড়েছিল? আর হলই যখন তখন আমাকে একবার বলতে তো পারতে!”
“বাবা-মা দুজনেরই শরীর খুব খারাপ। দুজনেরই অপারেশান করাতে হবে। আপনার কাছে কত চাইবো, কত টাকাই বা দেবেন আপনি? যতই দিন সেটা যথেষ্ট হবে না, তাই এই ফন্দি করতে হয়েছিল আমাকে!”
(৩)
পরে জেঠু বলেছিলেন যে কুড়ি হাজার ডলারের সমান অর্থ তিনি অরিন্দমদাকে দিয়েছিলেন কিন্তু চাকরিতে রাখেননি আর। বলেছিলেন বিশ্বাস একবার ভঙ্গ হলে সেটাকে জোড়া লাগানো খুব কঠিন।
তুলির জন্যেই আসল রহস্যভেদটা হল সেটা জেনেই আমার আনন্দ। ক্যাবলা ‘আমি সব করেছি’ বলার সু্যোগটা পুরোপুরি পায়নি সেটা জেনেই আমি খুশি। জেঠু অবশ্য আমাদের তিনজনকেই সমান সমান কৃতিত্ব দিয়েছেন। বলেছেন আমাদের জন্যেই এক জটিল রহস্যের সমাধান হল।