• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯১ | জুলাই ২০২৩ | কবিতা
    Share
  • কাকাতুয়ার কাছে : ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত





    ব্রিটিশরা হঠাৎ বে-আক্কেলের মতো ভারত ছেড়ে চলে না গেলে
    আমাদের শহরটাও নাকি এমন চিড়িয়াখানার মতো আবোলতাবোল
    ভূতে বোঝাই হত না।
    আমার বডিবিল্ডার দাদু কথাটা বিশ্বাস করতেন;
    পরে দেশ ও তাসের ইতিহাস বোঝাবার সময় বড়মামা
    আমাকে সেটা জানিয়েছিল স্যাণ্ডব্লাস্টেড ব্রায়ারের পাইপ ঠুকতে ঠুকতে।

    গ্রীষ্মের সেই অবকাশে, দেরাদুনের নীলাভ অপরাহ্নগুলোতে কিচ্ছু করার নেই বলে
    আমরা দুজন নির্ঝঞ্ঝাট মামা ও ভাগ্নে, কাপড়ের হালকা আরামকেদারায় আড়াআড়ি
    বসতাম লনে, আর গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়া কাপভর্তি কফিকে চুমুক
    দিয়ে জাগাতে গিয়ে আমি চমকে উঠে দেখতাম
    প্রতিবিম্বিত তিনটি লম্পট মধ্যবয়স্ক পুরুষের মুখের ছবির মাঝখানে
    আমার আগুনের চেয়ে সুন্দরী
    কিন্তু অসহায় বান্ধবী পম্পা মুখার্জির ক্ষমাহীন চোখ।

    আশির প্রলম্বিত দশক তখন এক্সট্রা টাইমের খেলার মতো ফলাফলহীন।
    সে বছর আমার কলেজ শেষ।
    রেজাল্ট বেরোনোর অপেক্ষা না করে প্রতিবারই
    আমি এর ওর মোটরসাইকেলের পিছনে বসে প্রথমে রুড়কি
    এবং তারপর দেরাদুনে এসে হাজির হতাম।
    রাজপুর রোডের পেট্রলপাম্প থেকে সেবার বড়মামাকে একটা ফোন করতে
    বড়মামা বলেছিল - জয় তোর সঙ্গে একটা শলা করার আছে,
    দেরাদুনে যখন এসেই পড়েছিস পারলে একটু ঘুরে যাবি?

    শলার তো প্রয়োজন আমারই ছিল বেশি। কিন্তু বড়মামার কাছে
    একটার পর একটা অলস দিন ছাগলের মতো চরে যাচ্ছিল গল্প করে
    আর তাস খেলে। দুপুরের খাবারটা গঙ্গোত্রী-জী এসে
    নিজের ইচ্ছে মতো করে দিয়ে যেতেন। হাতে গড়া রুটি, ডাল,
    একটা তরকারি জাতীয় কিছু।
    কোনো কোনোদিন মূলোর পরোটা। তখন বড়মামার পাইপে আগুন থাকত না।
    রাতের ডিনার অভ্যেসবশত আমিই বানাতে লাগলাম।
    কেউ কাউকে মনের কথা বলতে পারছিলাম না। বড়মামা
    ব্রিজের গল্প ছেড়ে ভূতের গল্প ধরল, তারপর দেশের ইতিহাস,
    দেশ ভাঙার ইতিহাস, পারিবারিক ইতিহাস।
    এইভাবে দিন পাঁচেক কেটে যাবার পর আবার ঘুরে ফিরে
    ভূতের গল্পে যখন ঢুকছি তখন এই গড্‌ডলিকাপ্রবাহ
    থামিয়ে দেব বলে আমি আকাশের দিকে মুখ করে শুয়ে
    প্রশ্ন করেছিলাম – আচ্ছা,
    আমার একজন অদ্ভুত টাইপের গার্লফ্রেণ্ড আছে তুমি শুনেছ?

    ***


    রেশমের চামরের চেয়ে লম্বা ও শাদা
    চুলের মধ্যে দিয়ে আঙুল চালিয়ে বড়মামা আমাকে সুদূরের দিকে তাকাতে শিখিয়েছিল।
    নীল মসূরীর পাহাড় থেকে ডিগবাজি খেয়ে নেমে পথ হারিয়ে ফেলা দেবদারুর জঙ্গল
    বাঙালের মতো হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ত পাড়ার হাইকোর্টে।
    ওরই মাঝখানে হাতিরা চুপ করে দাঁড়িয়ে শুনত মানুষের কথোপকথন।
    গাছের ছায়ার দীর্ঘ হাত যখন দীর্ঘতর হয়ে আমাদের ঢেকে দিতে এগিয়ে আসত
    তখন হলুদ-সবুজ সেলোফেনের কাগজে মোড়া উপহারের মতো
    একটা একটা করে বেরোত অশরীরী চিতাবাঘের আত্মজীবনী।
    কফি বানাবার নাম করে আমি জাফরির দরজা ঠেলে ঢুকে পড়তাম ঘরে।

    পরে বাইরে এসে দেখতাম বড়মামা নেই।
    হয়তো উঠে গেছে হাতিবড়কলার মোড় থেকে নিজের জন্য
    দেশলাই আর আমার জন্য মৌরি দেওয়া গরম রাস্ক আনতে।
    ফিরে এসে হয়তো বলত - জয় একটা ভূত দেখলাম রাস্তায় জানিস?
    এগিয়েও এসেছিল কিছু বলবে বলে। আগেকার দিন হলে ঠিক
    অ্যারেস্ট করতাম, কিন্তু এখন আর সাহস হল না,
    তাই না দেখার ভান করে চলে এলাম ঘরে।

    ***


    সেবার আমার প্রশ্ন শুনেও বড়মামা
    না শোনার ভান করে ইজিচেয়ারে শুয়েছিল চুপচাপ। আমি দীর্ঘশ্বাস
    গোপন করে বললাম - মনে হচ্ছে খবর পৌঁছে গেছে এখানেও।

    মিনমিন করে কৈফিয়ৎ এসেছিল - তোর ব্যক্তিগত জীবনের গল্প
    অন্য কারো কাছ থেকে শুনতে চাই না। কিন্তু লোকেরা না বলে কি ছাড়ে?
    শুনেছিলাম এক বয়স্ক মহিলা তোকে রেখেছেন। ধরে নিয়েছিলাম ডাহা মিথ্যে
    কিম্বা ভুল। এখন ভাবছি - সে-ই কি তোর গার্লফ্রেণ্ড?

    এ নির্ঘাৎ টোটোদার কাজ। আমি বললাম - হান্ড্রেড পার্সেন্ট ভুল!
    বয়স্ক মোটেও নয়, আমার চেয়ে কয়েক বছর বড়ো।
    টোটোদার ক্লাসমেট। এক-ই স্কুলে পড়তাম আমরা। বলেনি সে?

    বড়মামা উঠে বসে দেশলাই কাঠি দিয়ে পাইপটা
    খোঁচাতে শুরু করেছিল। আমিও পেরি মেসনের বিবর্ণ বই মুখোশের মতো
    খুলে রেখেছি - যাতে আরেকটু চিন্তা করার অবসর পাওয়া যায়।
    পাইপ খোঁচাতে খোঁচাতে দুঃখের সাথে বড়মামা পরে বলল –
    ছায়ার মতো যে তোর আর আমার মধ্যে এসে বসে আছে,
    তাকে তো আর সরানো যাবে না, জয়।
    আচ্ছা, তার কথাই হোক।

    ***


    সন্ধ্যেবেলাটা আমি আলো না জ্বালিয়ে রান্না করতে ভালোবাসতাম।
    বড়মামাকে পাঠাতাম ঢাবা থেকে চারটে রুমালি রুটি
    কিনে আনতে। তড়কা দেওয়া মুসুরির ডাল করা থাকত দুপুরে।
    সেটা গরম করে উপরে কয়েকটা কাঁচা ধনেপাতা
    ভালো করে ধুয়ে ছড়িয়ে দিতাম। হলদোয়ানির দোহারা গোটা ছয়েক আলু
    আধখানা করে ফেলার পর
    ডেকচিতে অনেকটা ঝাল আলুর দম হয়ে যেত।
    শসা কাটতাম লম্বা লম্বা ফালিতে। পাতিলেবু আর বিটনুন যোগ করলে তোফা ডিনার।
    রান্নাঘরের জানলায় বসে একটা কাঠবেড়ালি
    আমার কার্যকলাপ দেখে মুগ্ধ হয়ে যেত।
    দু-টুকরো শসা তার দিকে ছুঁড়ে দিতাম কিন্তু অন্ধকারে বোঝা যেত না
    কাজটা তার পছন্দ হল কিনা। বাইরে সিমেন্টের চবুতরায় হাওয়ার
    সঙ্গে শুকনো পাতা আর ধুলো গোল করে একপাক দিয়ে চলে যেত।
    পাখিদের আক্রমণাত্মক কিচিরমিচির একটা তুঙ্গে উঠে হঠাৎ
    শেষ হবার সাথে সাথে বড়মামার স্যাণ্ডেলের শব্দ।
    চায়ের জন্য এক কেটলি জল চাপিয়ে ইঁট দিয়ে বাঁধানো খোলা উঠোনে
    ডিনারের জন্য বসব এবার।

    ***


    অন্ধকার আরেকটু নিরেট হবার পর, আলুর দম, রুমালি রুটি আর চা,
    তিনটেই একসঙ্গে স্যাম্পেল করতে করতে বড়মামা আমাকে বুঝিয়েছিল ভূত
    অ্যারেস্ট করা এক সময়ে সহজ ছিল কত।

    এক সময়ে মানে দাদু যখন বেঁচে ও কর্মরত, এবং দেশেও
    ব্রিটিশ শাসন মহানন্দে বহাল।
    ক্রিমিন্যাল ট্রাইব অ্যাক্ট নামক একটি আইনের কল্যাণে গুজ্জর, বঞ্জর, কীচক, ডোম,
    মলহা, বেদে ইত্যাদি গভর্নর জেনারেলের সন্দেহের তালিকাভুক্ত বেশ কয়েকটি জাতির
    দেড়-দু কোটি মানুষ জন্ম থেকে ক্রিমিনাল উপাধি পেয়েছিল।
    শহরের কাছাকাছি এদের ঘোরাফেরা করতে দেখা গেলে
    আইনত ধরা যেত যে অভিপ্রায়টি চুরির, এবং তত্ক্ষণাৎ
    হাতকড়ি পরিয়ে শ্রীঘরে পাঠানোই ছিল দস্তুর।

    বড়মামার কাছ থেকে জানলাম যে একই আইনের অনুল্লিখিত ধারায়
    ভূত, পেত্নি, পিশাচ, পিরেত, জিন, হুরী প্রভৃতি দিশি পারলৌকিক চরিত্রগুলিও
    ধরা পড়ত কারণ এদেরও তো হাব-ভাব দেখে
    মনে হত ক্রিমিনাল ট্রাইবদের কেউ।
    বড়মামার দাবি - এর ফলে নাকি
    ১৮৭১ সাল থেকে শুরু করে স্বাধীনতার বেশ কয়েক বছর পর পর্যন্ত
    বহু উত্থান পতনের মধ্যে দিয়ে এসেও, দিল্লী কিম্বা দেরাদুনে
    ভূতের এমন দৌরাত্ম্য ছিল না।

    বললাম – চমৎকার! কিন্ত ভূত ধরার প্রধান অসুবিধেটা কি যথেষ্ট আইনের অভাব?
    বড়মামার ঈগলপাখির ঠোঁটসুলভ অ্যাকুইলাইন নাকের উপর
    ঘোলাটে চোখদুটো লিচুর মতো গোল হয়ে যাওয়ায়, শাদা ঘোড়ার লেজের তৈরী
    পরচুল পরা একটা রোগা ও অবাস্তব কাকাতুয়ার মতো দেখাচ্ছিল তাকে।
    ঘাড়টাকে হঠাৎ পিছন দিকে টেনে পেন্সিলের মতো তর্জনী
    উত্তোলন করে সেই কাকাতুয়া আমাকে বলেছিল - নট সো ফাস্ট, মাই বয়।
    নট সো ফাস্ট।

    আমার আর কী? স্লো-ই চলুক। বাসনগুলো তুলে কয়েকটা মেজে দিলাম, বাকিগুলো
    গঙ্গোত্রী-জীর জন্য ছেড়ে। ফিরে এসে চায়ের কাপ
    নিয়ে বসেছি। মাতুল পাইপে একচিমটে নতুন ক্যাপ্সটান গোল্ড
    ভরছে। সন্ধ্যাবিলের জল পিছনের জঙ্গল থেকে উঠছে
    এক হাত এক হাত করে আরো পিছনের পাহাড়ে, একাগ্র কাকাতুয়া
    আসন্ন কোনো আগন্তুকের জন্য প্রস্তুত হয়ে বসে দেশলাইয়ের হলুদ
    আলোর দিকে চেয়ে কিছু ভাবছিল।

    ***


    - তোর সমস্যাটা কী?
    অন্ধকার হবার অপেক্ষাতেই ছিল প্রশ্নটা,
    যাতে আমরা কেউ কাউকে দেখতে না পাই। বললাম - সমস্যা...?
    শোঁ করে পাইপে টান পড়ল উপর্যুপর দুটো। - মানে তোকে…
    সেই অগ্রজা সহপাঠিনী কী ছেড়ে দেবে বলেছে?

    বড়মামা যা ভাবছে তা নয়। বললাম - না, ঠিক তা বলেনি। ভয় নেই,
    এখনো কিছুদিন রাখবে বলেই ধরে নাও।
    - কিছুদিন? মানে টেম্পোরারি…? ঘাড় হেঁট করে
    জানাতে বাধ্য হলাম - যতদিন না চাকরি করছি ততদিন।
    চাকরি ধরলে সে আমাকে আর সঙ্গে রাখবে না বলেছে।

    ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বড়মামা গুম মেরে গেল। যত রাজ্যের ভূতেরা চুপ করে শুনছিল আমাদের কথা,
    এবার আমাকে তারা ঝিঁঝিঁদের সঙ্গে ধিক্কার দিতে শুরু করেছে – ছি, ছি, ছি, ছি।
    কাকাতুয়া শাদা ঝুঁটি নাড়িয়ে বলল - লাভলি! হয় চাকরি নয় ছোকরি! আশ্চর্য ব্যাপার,
    এইভাবে চলে কী করে? একসঙ্গে থাকছিসও নাকি আবার?

    সপ্তাহে একদিন মাত্র, যখন কলেজ হয় না আর কি। বাকি ছদিন পম্পা কী করে,
    সেটা জানিয়ে উচাটন বাড়াব কিনা ভাবছি, এমন সময় দরজায় টোকা। সেদিন কাকাতুয়া উঠে
    আলো জ্বেলেছিল ঘরের, এবং আমি
    জোনাকি আর আকাশের তারার মধ্যে মিলিয়ে গিয়েছিলাম যাতে
    মোটর সাইকেলের পিছনে চেপে আমার সেই দিনগুলো যেখানে এসে থেমেছিল
    সেখান থেকে তারা এক পাও আর কোনোদিকে এগোতে না পারে।

    ***

    ফুলস্পীডে চালানো পাখার তলায় একটা পাতলা চাদর গায়ে দিয়ে আমি শুতাম
    রাতগুলোতে। হাতের কাছে খাবার জল রাখা উচিত ঠিক করে সেদিন
    শোবার আগে একটা গ্লাস খুঁজতে ঘর থেকে বেরোই।
    দেখি বসার ঘরের টেবিল ল্যাম্প তখনো জ্বলছে। ডেস্কে বসে হাই পাওয়ারের চশমা
    পরা কাকাতুয়া গভীর মনোযোগ দিয়ে কাগজে কী সব টুকছিল।
    প্রচণ্ড ইচ্ছে হচ্ছিল কাছে গিয়ে মনের আসল কথাটা এবার বলি, যা কাউকে বলতে পারতাম না।
    নইলে এতদিন পরেও

    কীসের জন্য এমন ভূত দেখতে পাওয়া বুড়ো
    কাকাতুয়ার কাছে একটা ছুটির দিনে চলে এসেছি আমি?


    অলংকরণ (Artwork) : পরবাস ডিজিটাল আর্ট
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments