কল্পময়ের কিন্তু জায়গাটা বেশ লাগছে। কেমন নির্জন, খোলামেলা সবুজ প্রান্তর, মাঠের পর মাঠ, খেতের পর খেত। চোখ জুড়িয়ে যায়। দুইধারে অজস্র বড়ো-বড়ো বৃক্ষ ছায়া করে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের বাড়িটাও অনেক পুরোনো। একসময় মণিকান্তপুরের রাজবাড়ি ছিল। এখন অবশ্য যেমন রাজত্ব নেই, তেমনই বাড়িটারও ভারি জরাজীর্ণ দশা। শুধু একটা অংশ কোনোমতে আজও দাঁড়িয়ে আছে। সেখানেই বসবাস করেন কল্পময়ের ছোট কাকা আর কাকিমা। বাড়ির পশ্চিম দিকটা একেবারেই ভগ্নপ্রায়। শ্যাওলা আর আগাছায় দেওয়ালগুলিকে একেবারে গ্রাস করে নিয়েছে। সেই সঙ্গে মস্ত-মস্ত স্তম্ভগুলির গায়েও চিড় ধরেছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, যেকোনো দিন হয়তো তাসের মতো সব সুদ্ধ ভেঙে পড়বে।
কল্পময়কে প্রথম দিনই কাকিমা বলে দিয়েছিলেন, ‘ওদিকটায় কক্ষনো যেও না যেন।’
‘কেন কাকিমা? বাড়িটা ভেঙে পড়তে পারে বলে?’
‘তা সে ভেঙে না পড়লেও তোমার বাবা-কাকা মিলে খুব শিগগির ভেঙে ফেলবেন।’ কাকিমার স্বরে কোথাও যেন ক্ষীণ আনন্দের আভাস পেল কল্পময়। তিনি বোঝালেন, ‘অবশ্য আমি সাপ-টাপের জন্য তোমায় যেতে বারণ করছি। ওদিকটা একদম পরিষ্কার করা হয় না যে। আগাছার জঙ্গলে ভরে গেছে।’
তাঁর কথা ঠিক। তবে, শুধু যে ওদিকটাই পরিষ্কার করা হয় না, তা তো নয়, মনে মনে ভাবল কল্পময়। কেন? আসার সময় যে বড়ো ঝিলটা পড়ে তার কথাই ধরা যাক না। যেখানে ছেলেবেলায় বাবা নাকি মাছ ধরতেন, বিছুটি পাতা আর কচুরিপানায় এখন কী চেহারা হয়েছে তার! তারপর, উঠোনটাই বা কী পরিষ্কার? দু-চারবার ঘষলে বোধহয় পুরু ধুলো হাতে উঠে আসবে। কাকিমা একদিন বলছিলেন, ওঁদের মালী এবং ঘর ঝাড়পোঁছ করার লোকটি—হারাধন, আজকাল প্রায়ই কাজ ভুলে যায়। কী একটা কাণ্ড হওয়ার পর থেকে সে খুব অন্যমনস্ক হয়ে গেছে। সে বহুদিনের লোক। আবার তাকে ছাড়া চলবেও না।
আর ওই বাড়ি ভাঙার ব্যাপারটা? আসলে কল্পময়ের বাবা দেখতে গেলে সেই কারণেই এসেছেন। পশ্চিমের বাড়িটা সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলা হবে। একজন প্রমোটারের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে। কাছেই একটি কারখানা তৈরি হচ্ছে। তারাই কিনে নেবে জমিটা। প্রথম দিন ব্যাপারটা জেনে কেন জানি কল্পময়ের দুঃখ হয়েছিল। আহা, এতদিনের পুরোনো বাড়ি! কত স্মৃতি, কত ইতিহাস! সব হারিয়ে যাবে?
এখন দুপুর তিনটে। কল্পময় দুপুরে ঘুমোয় না। এখন সে বাগানে শ্বেত পাথরের শুকনো ঝরনাটার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কতক্ষণ এমন দাঁড়িয়ে আছে তার খেয়াল নেই। হঠাৎ একটা শিস দেওয়ার শব্দে চমকে উঠল সে। কে দিল শিস? কোনো পাখি নয় তো? ওই যে জামরুল গাছের ডালে নীল রঙের কী সুন্দর একটা পাখি বসে আছে। কী নাম যেন? একপা-একপা করে কল্পময় তার দিকে এগোতে চেষ্টা করল। ওই যা--ফুড়ুৎ! পাখিটা সোজা উড়ে গেল পশ্চিমের হানাবাড়ির দিকে। কল্পময় চাইল সেদিকে। হঠাৎ তার মনের গভীরে প্রবল উন্মাদনার একটা স্রোত বয়ে গেল। কীসের এত উন্মাদনা? উত্তরটা সে জানে। পশ্চিমের বাড়িতে কী আছে, তা দেখার অদম্য কৌতূহল কাজ করছে তার মনের ভিতর। এই অদম্য কৌতূহল তাকে বিভোর করে তুলেছে। বাড়ির ধ্বংসাবশেষগুলি তাকে বারে বারে হাতছানি দিয়ে ডাকছে, একবার এসো--একবারটি এসো! কল্পময় ভাবল, সরেজমিনে ওদিকটা দেখে এলে মন্দ হয় না। কাকিমা, হারাধন সকলে এখন ঘুমোচ্ছে। কেউ কিছু জানতে পারবে না। কয়েক মিনিটের তো ব্যাপার।
দুরু-দুরু বুকে নিষিদ্ধ গণ্ডির দিকে পা বাড়াল কল্পময়। সত্যি, বড্ড বেশি কাঁটাঝোপ এদিকটায়। হাঁটতে গেলে পায়ে বিঁধছে। হাত দিয়ে বুনো ঝোপঝাড় সরাতে সরাতে হেঁটে চলল সে।
অবশেষে বাড়ির রোয়াকটা দেখতে পাওয়া গেল। তার উপর প্রবল আনন্দে লাফ দিয়ে উঠে পড়ল কল্পময়। সারা বাড়িটায় সে একবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল। বেশি কিছু দেখার অবশ্য নেই। জানলার গায়ে মর্চে ধরা গরাদগুলি ঘরের ভিতরটা আড়াল করে রেখেছে। কল্পময় ভাবছিল, একবার সামনের জানলাটার পাল্লা দুটো নাড়াচাড়া করে, ভিতরে উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করবে কিনা। তাই সে করত বোধহয়, যদি না এমন অভাবনীয় একটা কাণ্ড ঘটত। কোথা থেকে কে জানে, তারস্বরে কে যেন হঠাৎ কল্পময়ের উদ্দ্যেশ্যে চিৎকার করে উঠল, ‘জানলা খুলো না! খুলো না!’ কল্পময় হুমড়ি খেয়ে আর একটু হলেই পড়ে যাচ্ছিল! পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে, তারই বয়সী একটা লিকলিকে রোগা ছেলে রোয়াকের সামনে দাঁড়িয়ে। ‘দেখো দিকি, পড়ে যাবে যে! খুব চমকে দিলাম নাকি!’
কল্পময়ের রাগই হল। ঝাঁঝাল স্বরে সে বলে ওঠে, ‘হঠাৎ করে অমন চিৎকার করলে কে না ভয় পায়!’
রোগা ছেলেটা কাঁচুমাচু হয়ে বলে, ‘ওই ঘরটার ভিতর যত রাজ্যের চামচিকের বাসা, তাই তোমায় সাবধান করছিলাম। আমি কি আর জানি তুমি এমন ভয় পাবে!’
‘তা, তুমি কে? এখানে কী করছ?’ জানতে চায় কল্পময়।
‘আমিও তো তাই তোমায় জিজ্ঞেস করতে চাই। কে তুমি?’
‘আমি কল্পময়। আমার কাকা-কাকি থাকেন এখানে। মানে, ঠিক এইখানে নয়, ওই বাড়িটায়।’ আঙুল দেখিয়ে বোঝায়।
‘আমি ফটিক। এখানে একটু শান্তিতে বসে পড়ছিলাম। এমন সময় পাতার খসখস আওয়াজ শুনে দেখতে এলাম হঠাৎ কী ব্যাপার। প্রথমে ভেবেছিলাম সাপ-টাপ। বুঝতেই পারছ, সচরাচর কেউ এদিকটায় খুব একটা আসে না। তার উপর আমার আবার খুব সাপের ভয়!’
‘তুমি এখানে বসে পড়ছিলে?’ বিস্ময়ে চোখ কপালে কল্পময়ের।
‘হ্যাঁ, এটাই তো আমার পড়ার জায়গা। ওই যে একদম ছাদের উপর চিলেকোঠার ঘরটা দেখছ? কী নিরিবিলি, বলো? এর চেয়ে শান্তি কোথায় আর পাব?’
‘তোমার ভয় করে না এখানে একা থাকতে?’
‘কীসের ভয়? তা হ্যাঁ, আমার শুধু--ওই যে বললাম, সাপের ভয়। তা, এতদিনে অবশ্য আমার অভ্যেস হয়ে গেছে। সাপ কামড়ালে বড্ড ব্যথা হয়, জানো?’
‘তুমি সন্ধের পরেও এখানে থাকবে?’ কল্পময়ের কৌতূহল বেড়েই চলে।
‘দেখি আজ কী করি…,’ হঠাৎ আনমনা হয়ে পড়ল ফটিক। ‘যদি বাবা খুঁজতে আসে তাহলে তো যেতেই হবে। নইলে…’ থেমে গেল তার কথা।
‘নইলে কী?’ ফটিকের চোখ দুটি হঠাৎ ছলছল করে উঠল। তাই দেখে কল্পময় প্রসঙ্গ বদলাতে চাইল। দুজনেই চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। খানিক পরে, কল্পময় বলল, ‘আচ্ছা, তুমি কী পড়ছিলে এত মন দিয়ে?’
‘অঙ্ক। অঙ্ক করতে খুব ভালো লাগে আমার। কিন্তু দেখো না, অঙ্কখাতাটা কদিন হল শেষ হয়ে গেছে। বাবাকে কতবার বলেছি… কিনেই দেয় না!’
‘আমার অনেক কটা নতুন খাতা আছে। তোমায় পরে এসে দিয়ে দেব একটা।’ আশ্বাস দেয় কল্পময়। তারপর, কী ভেবে বলে, ‘আচ্ছা, তুমি লাভ-লোকসানের অঙ্কগুলো পারো করতে? আমার স্কুলে সবে শিখিয়েছে।’
ফটিকের চোখ দুটি ক্ষণিকের জন্য দপ করে জ্বলে উঠল। ‘লাভ-লোকসানের অঙ্ক শুধু করতে নয়, চোখের সামনে দেখতেও পারি!’ শান্ত কণ্ঠে বলল সে।
‘অঙ্ক দেখতে পারো? সে কী জিনিস!’ ছেলেটা বলে কী! ওর মাথা ঠিক আছে তো? সন্দেহ হয় কল্পময়ের।
‘তুমিও তো দেখছ! চোখের সামনে দেখছ! এই যে এত জায়গা জুড়ে তোমাদের বাড়ির ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে আছে, এগুলো ভেঙে যদি কারখানার কোয়ার্টার বানিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে কত টাকার লাভ হবে, বলতে পারবে?’
কল্পময় সামান্য মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। সে নির্বাক। সত্যি তো, বাড়ি ভাঙার ব্যাপারটা সে ভুলেই গেছিল। খানিকটা সহানুভূতির স্বরেই যেন সে বলে ওঠে, ‘তোমার পড়ার জায়গাটা আর থাকবে না।’
এর কোনো উত্তর দিল না ফটিক নামের ছেলেটা। কল্পময় মাথা তুলতে একেবারে তাজ্জব বনে গেল। ‘কই, কোথায় গেলে?’ কল্পময় চারদিকে চেয়ে দেখে, কেউ কোথাও নেই। আশ্চর্য তো, কোথায় গেল ছেলেটা? বাঁশ ঝাড়ের মধ্যে দিয়ে একটা শোঁ শোঁ বাতাস বইছে। সেই সঙ্গে ধুলো এসে চোখে-মুখে লাগছে। তারই মধ্যে কল্পময় শুনতে পেল যেন, অনেকদূর থেকে ভেসে আসছে কার একটা গলার স্বর, ‘বাড়িটা থাকবে না। কিন্তু আমি তো থাকব! তুমিও পারলে থেকো আমার সঙ্গে… আমার পাশে।’ তারপর খিলখিল করে সে কী হাসি! কল্পময়ের গা ছমছম করে উঠল এবার। আর দেরি না করে সে ছুটে বাইরে বেরিয়ে এল।
এরপর কয়েক সপ্তাহ কেটে গেছে। কল্পময়দের ফিরে যাওয়ার বিকেল উপস্থিত। ওদের সমস্ত জিনিসপত্র সদর ফটকের সামনে এনে রেখেছে হারাধন। বেরোনোর আগে, কল্পময়ের হাতে সে একটি গাছপাকা আম তুলে দিল। বলল, ‘ট্রেনে যেতে-যেতে খেও, ছোটবাবু। আমার নিজে হাতে লাগান গাছের আম… তোমার মতোই তো ছিল গো আমার ছেলেটা… খুব মন দিয়ে লেখাপড়া করো, হ্যাঁ? অনেক বড়ো হতে হবে তোমায়! আমার ছেলেটারও কী শখ ছিল স্কুলে যাওয়ার। আমিই ওকে বলতাম, এবার বাগানের কাজ-টাজ কিছু শেখ! ও অভিমান করে পশ্চিমের কুঠুরিতে গিয়ে লুকিয়ে বসে থাকত… কতবার বারণ করেছিলাম…’ বলতে বলতে হারাধনের মর্চে-ধরা ফ্রেমের চশমার কাচ দুটো ঝাপসা হয়ে এল।
ট্রেন এখন ঝমাঝম শব্দে মণিকান্তপুর স্টেশন পেরিয়ে ছুটে চলেছে। কল্পময়ের কাঁধে হাত রেখে বাবা জানতে চাইলেন, ‘তোর সব জিনিসপত্তর ঠিকঠাক ভরে নিয়েছিস তো? কত যে বইখাতা সঙ্গে করে এনেছিলি!’
কোলের উপর ব্যাগটার ভিতর চোখ বোলাল কল্পময়। সে জানে, একটা খাতা থাকবে না। তবে, মুখে বলল, ‘সব আছে।’ ব্যাগটা নিচে নামিয়ে রাখার সময় তার হাঁটুর কাছটাতে চোখ পড়ল, এখনো কাঁটাঝোপে আঁচড়ের দাগটা বেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। এক-দুফোঁটা রক্তও দেখা যাচ্ছে। ‘কোনও পোকাটোকা কামড়েছে, নাকি?’ বাবা জানতে চাইলেন। কল্পময় কোনো উত্তর দিল না। শুধু জানলার বাইরে তাকিয়ে আপন মনে মৃদু হাসল।
কল্পময় তার কথা রেখেছে।