• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯১ | জুলাই ২০২৩ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • পম্পেইয়ের শেষ দিন : ছন্দা চট্টোপাধ্যায় বিউট্রা


    ছাই ঢাকা নরদেহঃ ভিসুভিয়াসের বলি
    সমস্ত ইয়োরোপে আমার সবচেয়ে প্রিয় দেশ ইতালি। কী নেই সেদেশে? সারা বছর সুন্দর আবহাওয়া, উত্তরে বরফঢাকা আল্পস থেকে দক্ষিণে উষ্ণ সমুদ্রতট—সারা দেশটা ইতিহাসে ভরা, রোমান সাম্রাজ্য থেকে রেনেসাঁস, আর্ট, স্থাপত্য, ভাস্কর্যশিল্প থেকে গান, খাবার, সাহিত্য, সিনেমা... পশ্চিমী সভ্যতার অনেকটাই ইটালির অবদান। আর আমার ভালো লাগে এদের ধীরেসুস্থে আয়েস করা জীবন, দু’হাত নেড়ে উচ্ছ্বসিত কথা বলা আর অন্যান্য ইয়োরোপীয় দেশের তুলনায় একটু অগোছালো, বিশৃঙ্খল চেহারা—যা আমাকে নিজের দেশের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। আর ঐতিহাসিক রাজধানী রোম ভীষণভাবে দিল্লীকে মনে পড়ায়, সেই পুরনো ইতিহাসের শহর আর আধুনিক নতুন শহর কেমন পরতে পরতে জড়িয়ে আছে।


    দুহাজার বছর পুরোনো ফ্রেসকো- এখনো উজ্জ্বল
    গেছিলাম ফ্লোরেন্সে একটি ডাক্তারি মিটিঙে। রেনেসাঁস ইতিহাসের চূড়ামণি, মাইকেলেঞ্জেলোর শহর, ভাস্কর্য ও স্থাপত্যশিল্পে ভরা। ইতিহাসে কোন ইন্টারেস্ট না থাকলেও ইতিহাস সেখানে নাকে ঢুঁ মারে। সেখান থেকে বাসে পিসা আর সিয়েনা হয়ে রোমে—যেখানে সব রাস্তা এক হয়। না, ফোডোরের বই ছাড়া আর কোনো গাইড ছিল না। তাই হাতের তিন-চার দিন সারা শহরে চক্কর দিলাম, দ্রষ্টব্য জায়গাগুলি দেখলাম, এমনকি মাটির তলায় হাড়গোড় ভর্তি ক্যাটাকোম আর শহরতলীতে (রোমান হলিডে সিনেমাখ্যাত) ‘বোকা দেলা ভেরিতা’র মুখগহ্বর পর্যন্ত। শেষদিন ম্যাপ খুলে দেখি ওমা! পম্পেই যে রোম থেকে খুব কাছেই! এতদূর এসে ওটা না দেখে কী করে ফিরি?

    পম্পেই রোম থেকে বেশি দূর নয়। এক দিনেই ঘুরে আসা যায়। ঘণ্টা দু’তিনেকের রাস্তা। বেশ আরামে ট্যুরবাস চড়ে নেপলস হয়ে সুদৃশ্য আমালফি সমুদ্রতট ধরে যাওয়া যায়। উপরি পাওনা বাসের মিউজিক সিস্টেমে বিখ্যাত ইটালিয়ান অপেরার গান। সকাল বেলায় গিয়ে সন্ধ্যে নাগাদ ফিরে আসা যায়।


    ফোরাম, পম্পেই
    রোমান সাম্রাজ্যেরও অনেক আগে পম্পেই ও পাশের হারকুলেনিয়াম-এ ছোটোখাটো জনবসতি ছিল। রোমানদের অধিকারে ব্যাবসাবাণিজ্য করে এরা বেশ বৈভবশালী হয়ে ওঠে। রোমান সাম্রাজ্যের সূর্য তখন মধ্যগগনে। পাশেই ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি ভিসুভিয়াস। লোকেরা পাহাড়ের গায়ে উর্বর মাটিতে খেতখামারি করতো। আগ্নেয়গিরি নিয়ে কারুর কোনো ভাবনাচিন্তা ছিল না।


    পম্পেইয়ের প্রধান রাস্তা, সুন্দর জ্যামিতিক ছাঁদে
    কিন্তু ২৪শে অগস্ট ৭৯ সালে সব স্বাচ্ছন্দ্য ও আশাভরসায় সত্যি সত্যিই ছাই পড়ল। আগের দিন থেকে থেকেই ভিসুভিয়াসের মাথায় আগুন বেরুচ্ছিল, কিন্তু নগরবাসীরা বিশেষ গা করেনি। পরদিন আকাশ একেবারে অন্ধকার। আগুনগরম ছাই আর গলিত পিউমিস পাথর ১০০ মাইলের ঝোড়ো হাওয়ায় বাড়িঘর রাস্তা গাছপালা সব ঢেকে ফেলছিল। আতঙ্কিত নগরবাসীরা যারা পালাবার জন্য রাস্তায় বেরিয়েছিল তারা সঙ্গেসঙ্গেই জ্বলন্ত ছাইয়ে পুড়ে মরল আর যারা বাড়ির ভেতরে লুকোবার চেষ্টা করছিল তারা ছাই-পাথরের ভারে ধসে পড়া ছাতের নীচে চাপা পড়ে মারা গেল। ধনী বণিক, গৃহস্থ মা, সন্তান, প্রেমিক-প্রেমিকা, ক্রীতদাস, গ্ল্যাডিয়েটর, এমনকি কুকুর বেড়াল, পশুপাখি পর্যন্ত কেউ বাদ গেল না। প্রত্যক্ষদর্শী ঐতিহাসিকদের (যারা হয়তো আগের দিন পালিয়ে বেঁচেছিল) মতে প্রায় ৩০০০ লোক সেইদিন ১৯ ফুট ছাই আর পাথরের নীচে জ্যান্ত কবরস্থ হয়েছিল। মৃত শহরটি পড়ে রইল এই অবস্থায় প্রায় দু’হাজার বছর।


    এখনো উনুনে রান্না চাপানো হাঁড়িতে
    ১৭৪৮ সাল থেকে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা সেই উনিশ ফুট জমাট পাথর কেটে কেটে শহরটা উন্মোচন করছেন। আশ্চর্যের বিষয় যে গরম ছাই আর পাথর বাড়িঘর থেকে মানুষজন পর্যন্ত সবকিছু ঢেকে, মুড়ে নিখুঁত ভাবে এত বছর সংরক্ষণ করে রেখেছে। ছাদগুলি অবশ্য নেই, ছাই আর পাথরের ভারে ধসে পড়েছিল।


    মেঝেতে মোজেইক, ... এখনো টাটকা রঙিন
    কিন্তু দেয়ালে, মেঝেতে মোজেইক, হাতেআঁকা কারুকার্য এখনো টাটকা রঙিন। শহরের মাঝখানে পাথরে বাঁধানো মেন রোড—যেখানে হয়তো শত শত মৃতদেহ পড়েছিল—রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়। একটু এগিয়ে অ্যাপোলোর মন্দির, শুধু কয়েকটা থাম আর অ্যাপোলোর মূর্তিটা রয়ে গেছে।


    "অ্যাপোলোর মন্দির, শুধু কয়েকটা থাম আর অ্যাপোলোর মূর্তিটা রয়ে গেছে"
    রাস্তার দু’পাশে আরও বাড়িঘরের ধ্বংসাবশেষ, এক জায়গায় কোন গৃহস্থের রান্নাঘরের কোণটুকু অবশিষ্ট—হাতে গড়া রুটি আর কিছু ফল পর্যন্ত রয়ে গেছে দু’হাজার বছর পেরিয়ে। ক্যালেডোরিয়াম (গরম জলের ঘর) ঘরের দেয়ালে আর সংলগ্ন বাথটাব-এ উজ্জ্বল ছবি আঁকা—সেখানে ধনী নগরবাসীরা কাজের শেষে বিশ্রাম করতেন। একটু দূরে রোমান আম্ফিথিয়েটারের অংশ দেখা যায়। সেখানেই হয়তো দর্শকদের সামনে গ্লাডিয়েটররা জীবনপণ করে যুদ্ধ করত। আছে ফোরাম-এর থামগুলো, যেখানে সেনেটর ও অন্যান্য নেতারা রাজনীতির বিষয়ে তর্ক করতেন। আবার একটি বেশ্যাগৃহও অবিকৃত রয়ে গেছে, ‘কাসা লুপা গ্রান্দে’, সেখানে দেয়ালে কিছু পর্নো ছবি ও অশ্লীল কথা পর্যন্ত অমলিন।


    "বেশ্যাগৃহ ... অশ্লীল কথা পর্যন্ত অমলিন"
    আর সংরক্ষিত আছে কয়েকটি পাথরে মোড়া মৃতদেহ--কেউ রাস্তায় আছড়ে পড়ে চিৎকার করছে, কেউবা ঘরের মধ্যে ভাঙা খাটের নিচে গুঁড়ি মেরে নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করছে, মা সন্তানকে জড়িয়ে আগলাচ্ছে, প্রত্যেকটির শেষ মুহূর্ত অবিকলভাবে পাথরে জমিয়ে রাখা।


    বাঁচার বৃথা চেষ্টা
    মিশরের পিরামিড থেকে চীনের দেওয়ালের মতো প্রচুর সুপ্রাচীন ভগ্নাবশেষ পৃথিবীর সব দেশে ছড়িয়ে আছে। কিন্তু সে সবই রাজারাজড়াদের প্রাসাদ, দুর্গ, সমাধি বা সৌধ কিংবা দেবদেবীদের মন্দির, চার্চ, মসজিদ বা প্যাগোডা। সাধারণ লোকেরা সেই সময়ে কীভাবে, কেমন থাকত তার কোন চিহ্ন কোথাও পাওয়া যায় না। পম্পেই এর একমাত্র ব্যতিক্রম। দুহাজার বছর আগের সাধারণ লোকেদের স্নানঘর, রান্নাঘর, এমনকি বেশ্যাঘর পর্যন্ত এখানে দেখা যায়। দেখা যায় যে তাদের অভ্যাস আচরণ ছিল ঠিক আমাদের মত। এমনটি পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। সেইজন্যই পম্পেই ঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্ত্ববিদদের কাছে এত মূল্যবান।


    ধনীদের আবাসের অন্দরসজ্জা
    অনেকের মত আমিও ছোটবেলায় পড়েছিলাম বাংলায় অনূদিত এডওয়ার্ড বুলওয়ের-লিটনের বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য লাস্ট ডেজ অফ পম্পেই’ (১৮৩৪)। গ্লাডিএটর আর সেই অন্ধ ফুলওয়ালীর দুর্ভাগ্যের কাহিনী সেই থেকে আমার মনে দাগ কেটেছিল। এবড়োখেবড়ো পাথুরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে তাদের সহজেই কল্পনা করা যায়।


    বাথটাব
    ভিসুভিয়াসের রোষ শুধু পম্পেই নয়, পাশের নগর হারকিউলেনিয়ামকেও ছাই আর পাথরে সমাধিস্থ করেছিল। হারকিউলেনিয়াম অপেক্ষাকৃত সাইজে ছোট, এখনো অনেকটাই খোঁড়া হয়নি। তবে সেখানে ঘরের ছাদগুলি বেঁচে গেছে, বেশি ভারী ছাই আর পাথর পড়েনি। শুধু আগুনে লাভার স্রোত মাটি থেকে ছাদ পর্যন্ত সব ডুবিয়ে দিয়েছিল। গত দুহাজার বছর ধরে লোকেরা তার ওপরেই লাভা আর পাথরের টুকরো দিয়ে বাড়িঘর বানিয়েছে, উর্বর লাভার মাটিতে গাছপালা গজিয়েছে। নীচে রয়ে গেছে অবিকল সংরক্ষিত ইতিহাস।

    পম্পেই-এ ঘুরতে ঘুরতে কেবলই মনে আসছিল ‘শেষের সেদিন ভয়ঙ্কর’। আমাদেরও পম্পেইতেই শেষদিন। ছুটি শেষ, পরদিন বাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়ে বাড়িমুখো। শুধু পম্পেইকে মনে থাকবে চিরদিন।

    সামনে ভিসুভিয়াস এখন শান্ত, ঘুমন্ত। কিন্তু আবার জেগে উঠতে কতক্ষণ?


    ক্যালাডোরিয়াম

    ভ্রমণকাল—১৯৯০



    অলংকরণ (Artwork) : লেখক
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments