• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯১ | জুলাই ২০২৩ | প্রবন্ধ
    Share
  • মাতৃ-যত্ন ও এপিজেনেটিক্স : নূপুর রায়চৌধুরি



    ইঁদুর নিয়ে গবেষণা করতে করতে অনেক সময়ই খেয়াল করেছি যে, কিছু মা ইঁদুর তাদের সদ্যজাত ছানাকে ঘন ঘন চেটে চেটে পরিষ্কার করে, বা ছানার লোমগুলো থেকে থেকেই বিন্যস্ত করে দেয়, আবার কিছু মায়েদের ওসবে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই, বাচ্চারা কাছে এলেই তেনারা সোজা মুখ ঘুরিয়ে খাঁচার অন্য প্রান্তে পালাতে ব্যস্ত।

    আপাতদৃষ্টিতে এটা একটা সাধারণ ব্যাপার মনে হলেও জীববিজ্ঞানে এর অন্তর্নিহিত অর্থ কিন্তু খুবই গুরুত্ব বহন করে। গবেষণায় দেখা গেছে, যত্নআত্তি পেয়ে লালিত-পালিত ইঁদুর ছানারা যখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়, তখন তাদের মধ্যে শান্ত হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়; আর ফেলেছড়ে লালন-পালন করা ছানাগুলো অতি অল্পেই উদ্বিগ্ন হয়ে বেড়ে ওঠে। ইঁদুরের এই ব্যবহারগত পার্থক্য কিন্তু জেনেটিক নয়, বরং এপিজেনেটিক। জীবনের প্রথম সপ্তাহে মা ইঁদুরের লালনপালনের ঢংই তার বাচ্চাদের এপিজিনোমের নকশা নির্ধারণ করে এবং ইঁদুর ছানাগুলো প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরেও কিন্তু তা একইরকমভাবে অব্যাহত থাকে। গবেষক ইয়ান উইভার (২০০৪) তাঁর পরীক্ষায় দেখান যে, ইঁদুর মায়েরা যখন তার বাচ্চাদের চাটে বা আদর যত্ন করে, তখন বাচ্চা ইঁদুরদের মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাল গ্লুকোকোর্টিকয়েড রিসেপ্টরের (জিআর) সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, যার ফলে স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা বাচ্চাদের মধ্যে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। চুলচেরা গবেষণায় আরও জানা গেছে যে জন্মের সময়, ইঁদুরের জিআর জিনটি অত্যন্ত ‘মিথাইলেটেড’ এবং- নিষ্ক্রিয় থাকে। যখন একটা মা ইঁদুর তার বাচ্চার প্রতি লালনপালনে মনোযোগী হয়, তখনই বাচ্চা ইঁদুরের জিআর জিনটি ধীরে ধীরে ‘ডিমিথাইলেটেড’ (মিথাইল গ্রূপের অপসারণ) এবং সক্রিয় হয়ে যায়। মা ইঁদুরের এই আচরণের ফলে, জীবনের প্রথম দিকেই বাচ্চা ইঁদুরের জিআর জিনের এই যে এপিজেনেটিক পরিবর্তন (‘ডিমিথাইলেশন’) ঘটল তা কিন্তু পরবর্তীকালেও স্ট্রেস বা প্রতিকূল অবস্থায় বাচ্চাদের ব্যবহারের একটা স্থায়ী পরিবর্তন হিসাবেই বিদ্যমান থাকে।

    এইবেলা স্ট্রেস সার্কিট অক্ষ বা এইচপিএ এক্সিস (HPA-হাইপোথ্যালামিক -পিটুইটারি-অ্যাড্রেনাল এক্সিস)-এর কথাটা একটু ছুঁয়ে যেতে চাই। স্তন্যপায়ী জীবরা কোনোরকম স্ট্রেসের সম্মুখীন হলেই সেই স্ট্রেসের সংকেত তাদের মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস থেকে প্রথমে পিটুইটারি গ্রন্থি এবং তারপর অ্যাড্রিনাল গ্রন্থিতে ভ্রমণ করে। অ্যাড্রিনাল গ্রন্থিগুলো তখন স্ট্রেস-হরমোন কর্টিকোস্টেরন/কর্টিসল নিঃসরণ করে।

    হিপোক্যাম্পাসের কোষগুলি যখন এই কর্টিসল সনাক্ত করে, যা জিআর-এর সঙ্গে আবদ্ধ হয়, তখন তারা হাইপোথ্যালামাসে একটি সংকেত পাঠায় যেটি স্ট্রেস সার্কিট বন্ধ করে দেয়। এখানে আরও লক্ষ করার ব্যাপার এই যে, ইঁদুর (এবং মানুষ) যাদের মধ্যেই বেশি পরিমাণে জিআর রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে কর্টিকোস্টেরন/কর্টিসলের সনাক্তকরণ বেশি ভালো হয় এবং তারা বেশি দ্রুত চাপ থেকে রক্ষাও পায়।

    বিজ্ঞানীরা কিন্তু এখানেই থেমে থাকলেন না, ২০০৬ সালে পরপর বেশ কিছু গবেষণার মাধ্যমে হোফার এবং তার সহকর্মীরা প্রমাণ করলেন যে, বাচ্চা ইঁদুরের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণের উপর ইঁদুর মায়ের যত্নের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। ছোট্টবেলায় মায়ের কাছ থেকে বাচ্চাদের সরিয়ে নেওয়া হলে, মাতৃ যত্নের বেশ কিছু উপাদানের অভাবে তাদের শারীরবৃত্তীয় হোমিওস্ট্যাসিস নষ্ট হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, মায়ের শরীরের উষ্ণতার সান্নিধ্যে না থাকার ফলে বাচ্চাদের মস্তিষ্কের বিকাশে বাধা পড়ে এবং তাদের চলাফেরা শ্লথ হয়ে যায়; মায়ের স্পর্শের উদ্দীপনার অভাবে নতুনত্বের প্রতি বাচ্চাদের ভয়ভীতির মতো আচরণগত প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এই প্রমাণগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় যে, মায়ের প্রাথমিক যত্নের মধ্যেই নিহিত আছে এক "লুকানো নিয়ন্ত্রক", যা বাচ্চাদের জৈব আচরণগত বিকাশে বিশেষ অবদান রাখে।

    ইঁদুরের মডেলের উপর করা এই পরীক্ষাকে মানুষের ক্ষেত্রে নকল করার জন্য গবেষকরা এবার উঠেপড়ে লাগেন। কারণটা সহজেই অনুমেয়–-যদিও ইঁদুরের মস্তিষ্ক মানুষের মস্তিষ্কের তুলনায় ছোট এবং কম জটিল, গবেষণায় দেখা গেছে যে দুটির গঠন এবং কার্যকারিতা উল্লেখযোগ্যভাবে একই রকম। উভয়ই প্রচুর পরিমাণে উচ্চ সংযুক্ত নিউরন নিয়ে গঠিত যা ক্রমাগত একে অপরের সঙ্গে কথা বলে।

    যাই হোক ২০১২ সালেই, মানব মায়ের লালনপালনের গুণমান এবং মানব শিশুর প্রারম্ভিক জৈব আচরণগত বিকাশের মধ্যে একটা গূঢ় সম্পর্ক খুঁজে পেলেন দুই বিজ্ঞানী হেনে এবং ফিলব্রুক। মানসিক চাপের মুখে শিশুর প্রতিক্রিয়াশীলতার উপর শৈশবকালে মায়ের যত্নশীল আচরণের সরাসরি প্রভাবের অকাট্য প্রমাণ উঠে এল তাঁদের গবেষণার ফলাফলে। এরপর, ২০১৮ সালে ব্যারি লেস্টার ৫-মাস বয়সী মানব শিশুদের নিয়ে এক গবেষণা শুরু করেন যেখানে মাতৃ যত্নের প্রতিভূ হিসাবে তিনি স্তন্যপানকে বেছে নেন এবং পরীক্ষার অন্তর্ভুক্ত শিশুদের দুটি ভাগে ভাগ করেন— প্রথম পক্ষে রয়েছে স্তন্যপান করান এমন মায়েদের শিশুরা আর দ্বিতীয়তে রয়েছে স্তন্যপান করাননি এমন মায়েদের শিশুরা। লেস্টার আশ্চর্যভাবে দেখেন যে, প্রথম পক্ষের শিশুদের মধ্যে জিআর জিন-প্রোমোটারের ডিএনএ মিথাইলেশন দ্বিতীয় পক্ষের শিশুদের তুলনায় অনেক হ্রাস পেয়েছে এবং তাদের মধ্যে হাইপোথ্যালামিক স্ট্রেস প্রতিক্রিয়াও দ্বিতীয় পক্ষের শিশুদের তুলনায় অনেক কম। স্তন্যপান করানোর ইতিবাচক প্রভাবগুলি নিঃসন্দেহে শিশুর মানসিক চাপ হ্রাস করেছে এবং তার মনের স্বাস্থ্যের উন্নতি করেছে।

    ব্যস, বিজ্ঞানীদের এবার আর ঠেকায় কে? সোৎসাহে তাঁরা দাবি করলেন যে, ইঁদুর এবং মানুষ–-উভয়ের ক্ষেত্রেই জিআর ওরফে এনআরথ্রিসিওয়ান (NR3C1) জিনের আচরণ এবং এপিজেনেটিক প্রোগ্রামিংয়ের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের পিছনে মাতৃ-যত্নের অনস্বীকার্য ভূমিকা রয়েছে।

    শুধু মাতৃ-যত্ন বলে নয়, একটি শিশু বড়ো হয়ে কী ধরনের মানুষ হয়ে উঠবে তা যথেষ্ট প্রভাবিত করতে পারে অভিভাবকত্বের শৈলি। এই বিশ্বাস জীবনের সব ক্ষেত্রেই ছড়িয়ে পড়ে--সে শারীরিক স্বাস্থ্য বলুন, একাডেমিক পারফরম্যান্স বলুন, অথবা মানসিক সুস্থতার কথা বলুন। এ নিয়ে অনেক বাগবিতণ্ডার অবতারণা হতে পারে, এবং একথাও সত্যি যে, অনেক ক্ষেত্রে ভুলভাবে এবং দুঃখজনকভাবে এই প্রভাবের গুরুত্বকে অতিরঞ্জিত করা হয়েছে যেমন সিজোফ্রেনিয়া বা যৌন অভিমুখিতার বেলায়। ডেভেলপমেন্টাল সাইকোবায়োলোজিতে অভিভাবকত্বের প্রভাব একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এবং এপিজেনেটিক পরিবর্তনের মাধ্যমে এই ধরনের প্রভাব জীবের ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা রয়েছে।

    আমি জানি, যে প্রশ্নটা এই মুহূর্তে আপনাদের মনে ঘুরঘুর করছে, সেটা হলো এপিজেনেটিক্স ব্যাপারটা ঠিক কী, আর এপিজেনেটিক পরিবর্তনগুলোই বা কী ধরনের?

    একটা নির্দিষ্ট জিন কীভাবে এবং কখন চালু বা বন্ধ হবে তা নিয়ন্ত্রণ করে এপিজেনেটিক্স, ১৯৪২ সালে ভ্রূণবিজ্ঞানী কনরাড ওয়াডিংটন প্রথম এই শব্দটির প্রবর্তন করেন।

    এপিজেনেটিক্স সম্বন্ধে কিছু বলতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই কিন্তু জিন ও জেনেটিক্স-এর প্রসঙ্গ এসে যাবে। আমরা সকলেই কমবেশি জানি যে, জীবের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী এককের নাম জিন। প্রতিটা জীবিত কোষে হাজার হাজার জিন রয়েছে আর প্রত্যেকটা জিন ডিএনএ (ডি-অক্সি-রাইবোনিউক্লিয়েক আ্যসিড) দ্বারা গঠিত একটা দীর্ঘ চেইনের অংশ, যাতে এক বা একাধিক প্রোটিন অণু তৈরির নির্দেশনা থাকে, যা শরীরকে নানাবিধ জৈবিক কাজ করতে সাহায্য করে।

    আমাদের জিনগুলি এমন তথ্য বহন করে যা এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে প্রবাহিত হয়। জীবের জিন, জেনেটিক বৈচিত্র এবং বংশগতির অধ্যয়নের নাম জেনেটিক্স। ডিএনএ অনুক্রমের (সিকোয়েন্সের) পরিবর্তনের ফলে পিতামাতার কাছ থেকে কীভাবে নির্দিষ্ট গুণাবলী বা বৈশিষ্ট্যগুলি সন্তানদের মধ্যে স্থানান্তরিত হয়, সেটাই জেনেটিক্স-এর মূল উপজীব্য। এটি জীববিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা কারণ জীবের বিবর্তনের জন্য বংশগতি অপরিহার্য।

    জেনেটিক্স নিয়ে কথা হবে আর মেন্ডেলের নাম আসবে না, তা কী করে হয়? অস্ট্রিয়ান জীববিজ্ঞানী ও ধর্মযাজক গ্রেগর জোহান মেন্ডেলই ১৯ শতকে প্রথম বৈজ্ঞানিকভাবে জেনেটিক্স অধ্যয়ন করেছিলেন এবং আধুনিক জেনেটিক্সের জনক হিসাবে তিনি বিশ্বে পরিচিত। মটর গাছের উপর গবেষণা করে মেন্ডেল উত্তরাধিকারের মৌলিক সূত্রগুলি আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন যে জিন জোড়ায় জোড়ায় থাকে, এবং পিতা ও মাতা দুজনেরই কাছ থেকে একটি করে জিন অপত্যে সংবাহিত হয়।

    এরপর ১৯৫৩ সালে জেমস ওয়াটসন এবং ফ্রান্সিস ক্রিক আবিষ্কার করে ফেললেন ডিএনএ’র ডাবল হেলিক্স স্ট্রাকচার। ব্যস, হইহই পড়ে গেল সারা বিজ্ঞানের ইতিহাসে, জন্ম নিল আধুনিক আণবিক জীববিজ্ঞান। আমরা জানলাম যে, চারটি নিউক্লিওটাইড বেস–অ্যাডেনিন (এ), সাইটোসিন (সি), গুয়ানিন (জি), এবং থাইমিন (টি) নির্দিষ্ট জোড়ে (এ-এর সঙ্গে টি, এবং জি-এর সঙ্গে সি) ডিএনএ'তে অবস্থান করে। প্রতিটি জিনের একটি নির্দিষ্ট ডিএনএ ক্রম রয়েছে যাকে বলা হয় ইউনিভার্সাল জেনেটিক কোড। জিনের এই কোড হল এমন একটা নির্দেশিকা ম্যানুয়াল যা সমস্ত জীবিত কোষ পড়তে এবং তা থেকে একটি সংশ্লিষ্ট প্রোটিন তৈরি করতে ব্যবহার করে। তিনটি করে নিউক্লিওটাইডের ক্রমকে বলে কোডন; যেমন ধরুন এজিটি (AGT)--এই কোডনটি তৈরি হয়েছে এ, জি এবং টি--এই তিনটি নিউক্লিওটাইড দিয়ে। একেকটি ডিএনএ স্ট্রান্ডে পর পর সাজানো রয়েছে এরকম অসংখ্য কোডন। প্রতিটি কোডন একটি নির্দিষ্ট অ্যামিনো অ্যাসিড সূচিত করে, যেমন এজিটি কোডন দ্বারা অ্যামিনো অ্যাসিড সেরিনকে বোঝানো হয়। অ্যামিনো অ্যাসিডগুলো মালার মতো পর পর জুড়ে একটা প্রোটিন তৈরি করে।

    সাধারণভাবে ইউনিভার্সাল জেনেটিক কোডের পরিপ্রেক্ষিতে উত্তরাধিকারের কথা ভাবতেই আমরা অভ্যস্ত যা নির্দেশ করে যে, ডিম্বাণু এবং শুক্রাণুর মাধ্যমে পিতা-মাতার ডিএনএ-স্থিত বৈশিষ্ট্যগুলো বংশধরের কাছে সংবাহিত হয়। কিন্তু ইঁদুর মায়ের বাচ্চা চাটার গল্পটি দেখাল যে, ডিএনএ বাহিত বৈশিষ্ট্য অন্য পথেও বংশধরে আসতে পারে। সন্তান চাটার মাধ্যমে, একটি মা ইঁদুর তার ছানার ডিএনএ’তে সম্পূর্ণরূপে ডিম্বাণু এবং শুক্রাণুর পাশ কাটিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য জোগান দিতে পারে। মায়ের লালন-পালন আচরণ তার ছানাদের ডিএনএ-কে এমনভাবে প্রোগ্রাম করে যা তাদের জীবনযুদ্ধে সফল হওয়ার সম্ভাবনা আরও বেশি করে তোলে। এপিজেনেটিক কোড জিনোমকে নমনীয়তার একটি স্তর দেয় যা অপেক্ষাকৃত স্থির ও সুনির্দিষ্ট ডিএনএ কোডের বাইরে কার্যকর হয়। তর্কের খাতিরে আমরা বলতেই পারি যে, অনির্দিষ্ট (random) মিউটেশন এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমেও জেনেটিক কোডের পরিবর্তন সম্ভব, কিন্তু এই দুটিই বেশ ধীর প্রক্রিয়া। এপিজেনেটিক কোড এসবের মধ্য দিয়ে না গিয়ে কিছু নির্দিষ্ট ধরনের তথ্য সরাসরি সন্তানদের কাছে প্রেরণ করার অনুমতি দেয়। এতদিন অবধি জিনোম সম্পর্কে আমাদের যে ধারণা ছিল, তাকে বদলে দিল এপিজেনেটিক্সের তত্ত্ব।

    এবার দেখি, এপিজেনেটিক পরিবর্তনগুলো কীভাবে সংঘটিত হতে পারে? খুব সহজ করে বলতে গেলে, ডিএনএ’র বেসগুলির রাসায়নিক পরিবর্তন এবং প্যাকেজ করা ডিএনএ’র ক্রোমোসোমাল সুপারস্ট্রাকচারের পরিবর্তনের মাধ্যমে জিনের অভিব্যক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এপিজেনেটিক পরিবর্তন। এপিজেনেটিক পরিবর্তনগুলোকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে: ডিএনএ মেথিলেশন, হিস্টোন প্রোটিনের পরিবর্তন এবং নন-কোডিং আরএনএ-এর মাধ্যমে জিন সাইলেন্সিং। এই পদ্ধতিগুলো নিয়ে বিশদ আলোচনা পরে আরেক সময় করা যেতেই পারে।

    আচ্ছা, আপনি কি এখন এই ভেবে ভয় পাচ্ছেন যে, এপিজেনেটিক পরিবর্তনের কারণে জিন অভিব্যক্তির যে ছাঁচ জীবনের প্রথম দিকে একবার স্থাপিত হয়েছে, তা হয়তো চিরতরের জন্যই স্থায়ী হয়ে যাবে?

    না, সেটা কিন্তু সর্বৈব সত্য নয়। এই যেমন ইঁদুর নিয়ে পরীক্ষার কথাই ধরুন না কেন, গবেষকরা দেখেছেন যে, একটি স্বল্প যত্নে লালিত ইঁদুরের মস্তিষ্কে এমন একটি ওষুধের ইনজেকশন দেওয়া যেতে পারে যা মিথাইল গ্রুপকে ডিএনএ থেকে অপসারণ করে, এবং তার ফলে, জিআর জিনটি আবার চালু হয়, কোষগুলি আরও বেশি জিআর প্রোটিন তৈরি করে এবং সেই ইঁদুর তখন একটা উচ্চ যত্নে পালিত ইঁদুরের মতোই শান্ত, স্বচ্ছন্দ ব্যবহার প্রদর্শন করে। আবার উল্টোটাও হতে পারে: ধরুন আপনি একটা উচ্চ লালিত বেশ শান্ত, আশ্বস্ত আচরণকারী ইঁদুর বেছে নিলেন, তারপর তার মস্তিষ্কে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে মিথাইওনিন (মিথাইলের উত্স) প্রবেশ করালেন। ব্যস, কেল্লা ফতে! এই ইঁদুরটা এবার রীতিমতো উদ্বিগ্ন, অশান্ত হয়ে উঠবে। অনেকটা যেন সেই ডক্টর জেকিল আর মিস্টার হাইডের গল্পের মতো। তবে এখানে একটা ব্যাপার অবশ্যই মনে রাখতে হবে, যে এই রাসায়নিক ওষুধগুলি শুধু জিআর নয়, অনেক জিনকেই একইসঙ্গে, অনির্দিষ্টভাবে প্রভাবিত করতে পারে, সুতরাং, এগুলো কিন্তু মাতৃ যত্নের জন্য সঠিক বিকল্প নয়। তবে হ্যাঁ, এটা বললে ভুল হবে না যে, এপিজেনেটিক ভাগ্য লিপি বদলানো কিন্তু অসম্ভব নয় ।

    তথ্যঋণ:

    1. Epigenetic programming by maternal behavior. Weaver IC, et al. Nat Neurosci. 2004;7(8):847–854.

    2. Psychobiological roots of early attachment. Hofer MA. Current Directions in Psychological Science. 2006; 15:84–88.

    3.Beyond Licking and Grooming: Maternal Regulation of Infant Stress in the Context of Routine Care. Hane AA and Philbrook LE. Parent Sci Pract. 2012; 12(2-3): 144–153.

    4.Epigenetic Programming by Maternal Behavior in the Human Infant. Lester BM, et al. Pediatrics. 2018; 142(4): e20171890.

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments