২০২২ র ৩০'এ জুন - আমেরিকার সল্ট লেক সিটি থেকে উড়ে এবার নামছি মন্টানার ছোট্ট শহর বিউটের দিকে। ওপর থেকে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ে ঘেরা শহরটাকে! ওই যে "M" লেখা পাহাড় দেখা যাচ্ছে - ওর কোলেই তো আমাদের বাসস্থান! ওই তো ছোট্ট একটা সাদা বিন্দুর মতো দেখা যাচ্ছে বিউটের আত্মার মূর্তি রূপ "লেডি অফ দা রকিস"! মনে পড়ে যাচ্ছে সেই প্রথম ভ্রমণের কথা ...
২০১৫র জুন মাস, আমার মেয়ে আর আমি চলেছি অ্যামসটারডাম থেকে আমেরিকার সল্ট লেক সিটির পথে; মিশুকে এয়ারহসটেস আমাদের সঙ্গে আলাপ জমাল আর আমাদের শেষ গন্তব্য মন্টানার "বিউট" শহর শুনে ভারী উত্তেজিত ও অবাক! “তোমরা কি ওখানে থাকো?" আমার কন্যা জানিয়ে দিল যে তার বাবা মন্টানা টেক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক; আমরা ইন্ডিয়া থেকে আসছি গরমের ছুটি তাঁর সঙ্গে কাটানোর অভিপ্রায়ে।
এয়ারহসটেস খানিক উদাস হয়ে গিয়ে মৃদু স্বরে বলে উঠলেন, "বিউট, আমার জন্মস্থান! পুরনো দিনে ওই শহরকে কি বলা হত জানো? পৃথিবীর সবচেয়ে সম্পদশালী পাহাড়; খনিজ সম্পদের জন্যে বিখ্যাত ..." ইত্যাদি, ইত্যাদি।
সেই ২০১৫র জুনের গোড়ায়, কলকাতা থেকে শুরু করে প্রায় ছত্রিশ ঘন্টা যাত্রা করে যখন বিউটের "বার্ট মুনি এয়ারপোর্টে" পৌঁছলাম তখন সেখানে প্রায় মাঝ রাত্তির (আমেরিকার মাউন্টেন টাইম অনুযায়ী)। কিন্তু এ কেমন এয়ারপোর্ট? আমেরিকার বুকে এত ছোট, নির্জীব আর নিষ্প্রভ এয়ারপোর্ট হতে পারে এ আমাদের কল্পনার বাইরে! যাই হোক, ছ'মাস অদেখার পরে পরিবারের মিলিত হওয়ার আনন্দে আমরা তখন বিহ্বল - মেয়ে আর তার বাবা তো সেই এয়ারপোর্ট চত্বরেই প্রায় নাচ জুড়ে দেয় আর কি!
সেই গভীর রাত্তিরে, ঘুমন্ত নিঃঝুম পথ দিয়ে, এয়ারপোর্ট থেকে গাড়ি করে "লেক্সিংটনে" আমাদের এপার্টমেন্টে আসার সময়ে মনে হচ্ছিল যেন কোনো এক প্রাচীন ভুতুড়ে শহরে এসে উপস্থিত হয়েছি। আমাদের সদা চঞ্চল কন্যাটিও পুরো রাস্তা কেমন চুপটি করে গুটিসুটি হয়ে চোখ গোল গোল করে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে ছিল। তার বাবা আমাদের ক্রমাগত উৎসাহিত করে গেলেন এই বলে যে আমরা একদম ঠিক সময়ে বিউটে এসেছি, গরমকালে মন্টানার প্রাকৃতিক রূপ অসাধারণ...তারপর গাড়ির মিউজিক সিস্টেমে মৃদু ভলিউমে চালিয়ে দিলেন জন ডেনভারের গাওয়া, এমিলোউ হ্যারিসের লেখা সেই বিখ্যাত গান "ওয়াইল্ড মন্টানা স্কাইস ..."
পরের দিন, মিঃ প্রোফেসর ইউনিভার্সিটিতে চলে যেতেই, মা আর মেয়ে মিলে যুক্তি করলাম যে জেট ল্যাগের তোয়াক্কা না করেই বাসে চেপে ঘুরতে যাব শহরটায় - যতটা সম্ভব। আমরা খোঁজখবর আগে থেকেই খানিকটা জোগাড় করেছিলাম - আমাদের এপার্টমেন্টের কাছেই কোথাও একটা বাস-স্টপ আছে যেখানে "মন্টানা টেক" থেকে "হ্যারিসন এভেন্যু"র "ট্রানসিট সেন্টারে" যাওয়া-আসার বাস নির্ধারিত সময়ের ব্যবধানে পাওয়া যায়। মোবাইলে গুগুল (google) বাবুর ভরসায় আমরা তো বেরিয়ে পড়লাম। ইউনিভার্সিটির এই হাউসিং কমপ্লেক্সটি বিউট শহরের প্রায় শেষ প্রান্তে অবস্থিত। খানিক ভয়-ভয়, আবার বেশ এডভেঞ্চারের উত্তেজনা নিয়ে, অত্যন্ত নিরিবিলি, আঁকাবাঁকা উঁচু-নীচু পাহাড়ি রাস্তা, "লেক্সিংটন", "এমেট", ...ইত্যাদি পেরিয়ে এলাম বড় রাস্তায়, "এক্সেলসিওর"। পরে অবশ্য দেখেছি যে "জি পি এস" বাবাজী আমাদের বৃথাই ঘুরপাক খাইয়েছিল; "লেক্সিংটন" থেকে একদম সোজা রাস্তা গিয়ে উঠেছে এক্সেলসিওরে! কিন্তু বাস স্টপটা কোথায়? কোথাও কোনো কিছু লেখা বা চিহ্ন তো নেই! কি আর করা - ফুটপাথে একটা কোণ দেখে দাঁড়ালাম। চারপাশে কোন কাউকে দেখা যায় না যাকে জিজ্ঞেস করতে পারি - "এ তো আর কলকেতার শহর নয় ..."। মানুষজন না দেখা গেলে কি হবে, তাদের চারপেয়ে পোষ্যরা আমাদের দেখে রীতিমত উত্তেজিত হয়ে ক্রমাগত চেঁচামেচি করে তাদের সন্দেহ ঘোষণা করতে লাগল।
শহরের এই দিকটা পুরোনো আবাসিক অঞ্চল - গায়ে-গায়ে লাগানো বাড়ি, ছোট লন বা ব্যাকইয়ার্ড; বেশ কিছু বাড়িতে মনে হলো কেউ আর বসবাস করে না। পরে বিউটের ইতিহাস জানার পরে বুঝেছি শহরের এই দিকে এককালের ঘন বসতির এবং আজকের দিনে এইরকম ধ্বসে যাওয়া করুণ চেহারার কারণ।
যাইহোক, আমাদের ভাগ্য ভালো, একটু বাদেই দেখি একটা কালো কাঁচওয়ালা কমলা রঙের বাস আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে দরজা খুলে দিল। আমরা ভাড়া দিতে গেলাম কিন্তু আমাদের অবাক করে ড্রাইভার ভদ্রলোকটি জানালেন যে মন্টানা টেকে কর্মরতরা এই বাসে বিনামূল্যে যাতায়াত করতে পারে। আমি আপত্তি জানিয়ে, বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু তাও তিনি ভাড়া নিতে অস্বীকার করলেন।
সেদিন আমরা দু'জনে হেঁটে হেঁটে খানিকটা উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ালাম "হিস্টোরিক আপ টাউন বিউটের" নানা রাস্তায় - কয়েকটা নাম যেমন "গ্রানাইট", "কোয়ার্টজ", "কপার" বুঝিয়ে দেয় এই শহরটার সঙ্গে খনি আর খনিজ সম্পদের কি ওতপ্রোত সম্পর্ক! সুন্দর ঝকঝকে দিন, হাল্কা ঠাণ্ডার আমেজ (কলকাতার ডিসেম্বরে যেমন শীত!), ঝলমলে রোদ্দুরের ওম গায়ে মেখে ঘুরতে বেশ লাগছিল। এই অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে পুরোনো আমলের বড় বড় অনেক ইমারত - বেশ কিছু তখনকার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, পুরোনো আদালত ("ওল্ড কোর্ট হাউস") আর ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্বের অনুকরণে তৈরি বিশাল বিশাল বিলাসবহুল আবাসিক প্রাসাদ। ইন্টারনেট বা অন্তর্জালের তথ্য অনুযায়ী আমেরিকার "জাতীয় ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন জায়গা"র অন্যতমগুলির মধ্যে "বিউট সিলভার বাও কাউন্টি"ও বিবেচিত হয়ে থাকে - প্রায় চার হাজার ঐতিহাসিক ইমারত ছড়িয়ে আছে এই নর্দার্ন রকিস ঘেরা শহরটিতে।
ফিরতি পথে আবার পেলাম সেই আমাদের আসার সময়ের বন্ধুবৎসল বাস চালককে। উনি আমাদের এক্সেলসিওরের বাস স্টপে নামিয়ে হাসিমুখে বিদায় জানিয়ে চলে গেলেন।
সেদিনের সেই খানিকক্ষণের লক্ষ্যহীন ঘোরাফেরা আমাদের বিউটের সমন্ধে আরো কৌতূহলী করে তুলল। আমরা তাই ঠিক করলাম প্রথমে দু'ঘন্টার "বিউট ট্রলি ট্যুর" নিয়ে শহরটার একটা সাধারণ পরিদর্শন করে ঠিক করব কোন কোন বিশেষ দ্রষ্টব্য জায়গাগুলো সময় নিয়ে আলাদা করে ভালো ভাবে দেখব।
এই সফরটি "জর্জ স্ট্রিটে" অবস্থিত "বিউট সিলভার বাও কাউন্টি চেম্বার অফ কমার্স" প্রতি বছর "মেমোরিয়াল ডে" (মে মাসের শেষে ) থেকে "লেবার ডে" (সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে ) শনিবার বাদ দিয়ে সপ্তাহের সবদিনেই চালনা করে। বিউটের পর্যটনকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্যে এই সংগঠনটির প্রচেষ্টা সত্যিই প্রশংসনীয়।
আমরা সকাল-সকাল হাজির হয়ে টিকিট কেটে নিলাম। বড় বড় জানালাওয়ালা উজ্জ্বল লাল-সবুজ রঙের বাসটা দেখেই মন খুশি হয়ে গেল। আরো কয়েকজন পর্যটক জড় হলে, আমাদের ট্যুর-গাইড এবং ড্রাইভার (তাঁর নামটি মনে নেই; ধরে নেওয়া যাক "মাইক") হাসিমুখে আপ্যায়ন করে বাসে তুললেন। শহরের রাস্তা দিয়ে ধীর গতিতে গাড়ি চালাতে চালাতে শুরু করে দিলেন তাঁর ধারাভাষ্য; মন্দ্রমধুর কণ্ঠস্বরে সেই বিবরণী আমাদের পৌঁছে দিচ্ছিল বিউটের সেই হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোতে। মাইক একজন "ভেটারান” এবং এই শহরেই জন্ম ও বড় হওয়া - তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই তথ্যসমৃদ্ধ ধারাবিবরণীর সঙ্গে মিশেছিল এই শহরের প্রতি গভীর অবেকপূর্ণ ভালোবাসার প্রকাশ।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, "মন্টানা রকিসের সিলভার বাও ক্রিক" উপত্যকা বিখ্যাত হয়ে ওঠে তার খনিজ সম্পদের জন্যে। প্রথম দিকে বিশেষ করে সোনা ও রূপোর খোঁজ পাওয়ার কারণে, এই জায়গার খনিজ ব্যবসা সারা পৃথিবী থেকে "প্রস্পেক্টর"দের টেনে নিয়ে এসেছিল এখানে। তারপরেই যখন আমেরিকায় বৈদ্যুতিক আলো ও যন্ত্রের প্রচলন হলো, তখনই ভীষণভাবে তামার প্রয়োজন বেড়ে গেল। এবং এই অঞ্চলের তামার অপর্যাপ্ত সম্ভার, বিউট খনিজ শিল্পকে খুব দ্রুত সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল। এই অর্থনৈতিক উন্নতি, প্রচুর ব্যবসা ও উচ্চ বেতনের কর্মের সুযোগের কারণে সারা পৃথিবীর মানুষ এখানে ভিড় করেছিল - ওয়েলস, আয়ারল্যান্ড, লেবানন, কানাডা, ইটালি, ফিনল্যাণ্ড, চায়না ইত্যাদি জায়গার নানা মানুষের ভীড়ে জমজমাট ছিল এই বিউট নামের ছোট্ট শহরটি।
ভারি মন নিয়ে উঠে পড়লাম বাসে। ধীর গতিতে বাস চলল "হিস্টোরিক আপ টাউন"-এর বিভিন্ন রাস্তা দিয়ে আর তার সঙ্গে মাইকের ধারাভাষ্য। প্রতিটা বিশেষ দ্রষ্টব্য ঐতিহাসিক বাড়ি বা ভবনগুলোর সামনে অল্প সময়ের জন্যে দাঁড়িয়ে মাইক তাদের ইতিহাস ও সংশ্লিষ্ট গল্পকথা ভারি মজাদার করে বলছিলেন। এই সফরে এই জায়গাগুলি শুধু বাইরে থেকেই দেখানো হয় - "কপার কিং ম্যানসন", ডুমা (স) ব্রোথেল", "মাই - ওয়াহ মিউজিয়াম"। শুধু শেষ স্টপ "বার্কলে পিট্” এর ভিতরে ঢুকে বেশ খানিকক্ষণ ঘোরাফেরা করে দেখার সুযোগ পেলাম। যেহেতু পরে আমরা এই সবকটা দ্রষ্টব্যস্থল আলাদা ভাবে ট্যুর নিয়ে দেখেছিলাম, এদের সমন্ধে বিস্তারিত ভাবে পরে বলছি। তাই একেবারে আসছি "বার্কলে পিট্ "এর বর্ণনায়।
"পিটে" ঢোকার পথটা একেবারে খনির খাদের মতোই রাখা আছে আর তারপরে একটা লম্বা (যেন অনন্ত) সুড়ঙ্গ পথ, যেটা গিয়ে উঠেছে "পিট" দেখার "স্ট্যান্ডে"। অদ্ভুত বিচিত্র রঙের জলে ভরা বিশাল গহ্বর দেখে কেমন যেন একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি হল - লোহা মিশ্রিত ফিকে লাল জলের সঙ্গে মিশে আছে "কপার অক্সাইডের" হলদেটে সবুজ রং!
সেই "ট্রলি ট্যুরে” বাইরে থেকে দেখা জায়গাগুলোর কয়েকটা আমরা সেই প্রথমবারের সফরে বিস্তারিতভাবে ঘুরে দেখেছিলাম। এছাড়াও পরবর্তী বহুবারের সফরে আমরা ওই ছোট্ট শহরের নামী-অনামী আরও অনেক আকর্ষণীয় জায়গা ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রাণভরে উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছি। চেষ্টা করছি সেইসব জায়গাগুলোকে স্মৃতি থেকে অন্তত উল্লেখ করতে আর বিশেষ কিছুর খানিকটা বিস্তারিত বিবরণ দিতে।
"আওয়ার লেডি অফ দা রকিস "
যতবার বিউটে এসেছি, ফ্লাইট নামার সময় ওপর থেকে যখনই বিন্দুর মতো দেখা দিয়েছে পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকা এই অভিনব ধবধবে সাদা নারীমূর্তি, মনটা যেন অজান্তেই অদ্ভুত এক ভালো লাগার অনুভূতিতে ভরে উঠেছে - যেন আমাদের জন্যেই অপেক্ষারতা অতি কাছের কোন আত্মীয়া।
"লেডি অফ দা রকিস”-এ যাওয়ার বাস ট্যুর শুরু হলো "বিউট প্লাজা মল” চত্বর থেকে। "রবার্ট" নামে আমাদের "গাইড কাম ড্রাইভার" বেশ বয়স্ক, হাসি-খুশি বাক্যবাগীশ ভদ্রলোক; আমরা ভারতীয় জেনে তিনি ভারি উৎসাহিত হয়ে, আমাদের মেয়েকে তাঁর পাশের সিটে বসালেন। বন্ধুর পাহাড়ি পথ দিয়ে ওপরে যাওয়ার সফরটা শরীরের পক্ষে বিশেষ সুখকর নয় - উঁচু-নীচু ছাড়াও, আঁকাবাঁকা পথে মাথার কাঁটার মত বাঁকগুলো রীতিমতো বিপজ্জনক লাগছিল। কিন্তু এই রাস্তায় অসংখ্য বার টুরিস্ট বাস চালানো, রবার্টের অভিজ্ঞ হাত এবং ক্রমাগত ধারাবিবরণী, কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের নিঃশঙ্ক হতে সাহায্য করল।
বিউটের থেকে ৩৫০০ ফুট ও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮৫৫০ ফুট উপরে "কন্টিনেন্টাল ডিভাইডে” অবস্থিত, আমেরিকার তৃতীয় উচ্চতম মূর্তি "আওয়ার লেডি অফ দা রকিস", "মাদার মেরি"-কে উৎসর্গীকৃত।
উপরে পৌঁছে মূর্তিটির পাদদেশে দাঁড়িয়ে, বিস্মিত হয়ে গেলাম তার বিশালত্ব দেখে। আমার মনে পড়ে গেল কয়েক বছর আগে ব্রাজিলের রিও শহরে দেখা "ক্রাইস্ট দা রিডিমার”-এর মূর্তির কথা।
অনেক নিচে দেখা যায় মন্টানার পর্বতমালার উঁচু শৃঙ্গ ও ঢালু উপত্যকা, তার মাঝে বিউট শহর, বিন্দুর মতো বার্কলে পিট্ - অপূর্ব মনোমুগ্ধকর দৃশ্য।
যদিও মূর্তিটি মাদার মেরিকে উৎসর্গীকৃত, তবু অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য এবং অনুপ্রেরণা পৃথিবীর সব মহিলার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন; বিশেষ করে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব মায়েদের প্রতি। "মেমোরিয়াল ওয়াল"-এ খোদাই করা আছে প্রায় ১৫০০০ বিগতপ্রাণ মহিলাদের নাম।
আমার নিজস্ব ধারণা যে বিউটের অর্থনৈতিক মন্দাবস্থার সময়ে, এখানকার অধিবাসীদের নির্জীব জীবনে এই প্রকল্পটা অনেকটা আনন্দ, উত্তেজনা সঞ্চার করতে সাহায্য করেছিল - তাই, এই প্রকল্পটির সাফল্যের জন্যে তাঁরা অত্যন্ত সাগ্রহে আন্তরিক ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। গভীর শ্রদ্ধায় মাথা নত করলাম তাঁদের এই অদম্য প্রাণশক্তির উদ্দেশ্যে।
"মিনারেল মিউজিয়াম” - আমার প্রথমবারের বিউট সফরেই এই সংগ্রহশালাটি দেখতে গেছিলাম। মিঃ প্রফেসারের সঙ্গেই তাঁর কর্মক্ষেত্র মন্টানা টেক উনিভার্সিটি ঘুরে, ঢুকে পড়লাম ক্যাম্পাসেই অবস্থিত এই মিউজিয়ামটিতে। অবাক হলাম দেখে যে বিনামূল্যে দেখার সুবিধে থাকলেও এখানে দর্শনার্থী প্রায় নেই বললেই হয়। যাইহোক, আমরা নিরিবিলিতে খুব উৎসাহের সঙ্গে ভালো করে ঘুরে দেখলাম।
সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক লাগল একটি কোয়ার্টজ (স্ফটিক), "রিহান্না'স স্টার” নামে খ্যাত, অদ্ভুত সুন্দর প্রায় দু ফুট ব্যাসের ধোঁয়াটে রঙের এই কোয়ার্টজটি জ্যাক জনসন নামে বিউটের এক অধিবাসী দু বছরের পরিশ্রমে খুঁড়ে তুলেছিলেন পূর্ব বিউটের একটি জায়গা থেকে এবং তাঁর মেয়ের নামে নামকরণ করেছিলেন।
এছাড়াও দেখলাম ব্রাজিল, আমেরিকার অন্যান্য জায়গা এবং পৃথিবীর বিভিন্ন খনি থেকে সংগ্রহ করা নানা রকমের খনিজ পদার্থ। বেশ কিছু উল্কাও প্রদর্শিত আছে সংগ্রহশালায়।
এছাড়া যেটা সবচেয়ে ভালো লেগেছে - "হেল রোরিং গাল্চ", ১৮৯০ সময়কার একটা মাইনিং শহরের অবিকল প্রতিরূপ, যেটা ১৯৬৫ থেকে প্রায় ১৯৮০ অবধি লেগেছিল গড়ে তুলতে। বেশ কিছু পুরোনো দিনের গঠন একেবারে অক্ষত রাখা আছে, আর অনেক ঘর-বাড়ি-প্রতিষ্ঠানের প্রতিরূপ বানানো হয়েছে পুরোনো দিনের উপকরণ দিয়ে। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাড়ি, স্কুল, চার্চ, যানবাহন, এবং অজস্র শিল্পকর্মের নিদর্শন দেখতে দেখতে হারিয়ে গেছিলাম যেন সেই পুরোনো দিনে। ওরকম একটা গোটা শহরের প্রতিরূপ বানানো এবং তার রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চয় অত্যন্ত শ্রম ও ব্যয়সাধ্য ব্যাপার। শুনলাম এখানেও আছে বিউটের অনেক অধিবাসীর স্বেচ্ছাশ্রম ও অবদানের কাহিনী।
প্রাসাদের ভিতরে ঘরের ছাদ ও দেয়ালের ফ্রেস্কো, স্টেইনড কাঁচের বিশাল জানলা, অপূর্ব কারুকার্য করা দামি কাঠের আসবাবপত্র, প্রাচীন সব গৃহস্থালীর জিনিস - সুন্দরভাবে সংরক্ষিত করে রাখা আছে। বেশ লাগল ঘুরে দেখতে। পরে শুনেছি বিউটের অন্যান্য পুরোনো জায়গার মতো এই প্রাসাদেও নাকি অতিপ্রাকৃত ঘটনার গুজব শোনা যায়।
"ডুমা(স) ব্রোথেল” - মার্কারি স্ট্রিটে অবস্থিত এই দোতলা লাল রঙের বাড়িটা পুরোনো বিউটের উৎসবমুখর উচ্ছৃঙ্খল দিনের এক নিদর্শন, যখন খনি কর্মীদের হাতে ছিল অঢেল অর্থ আর তার হাত ধরেই এসেছিল নৈশপ্রমোদ, গণিকাবৃত্তি।
"মাই-ওয়াহ মিউজিয়াম" - ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিউটের অর্থনৈতিক উন্নতি ও সচ্ছলতার অংশীদার হওয়ার তাগিদে, পৃথিবীর বহু দেশের মানুষ এখানে জড় হয়েছিল। তার মধ্যে বহুলাংশ ছিল চীন দেশের। সেই সব চাইনিজ অভিবাসীদের জীবনযাত্রা, বিউট এবং তার আর্থসামাজিক জীবনে তাদের অবদানের ইতিহাসের নিদর্শন সংরক্ষিত রাখার উদ্দেশে এই মিউজিয়াম স্থাপিত। পুরোনো দিনের প্রখ্যাত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান "ওয়াহ চং তাই" ও "মাই-ওয়াহ নুডুল পার্লার" মিলেই “ওয়েস্ট মার্কারি স্ট্রিট” এ অবস্থিত আজকের এই মিউজিয়াম। যত্নের সঙ্গে সাজিয়ে রাখা এই ছোট সংগ্রহশালাটি আমি বেশ ভালোই উপভোগ করলাম।
বিউটের পুরোনো জীবন ছেড়ে এবার আসি এখনকার গল্পে।
বিউটের সমৃদ্ধির মধ্যগগনে, যখন একে "পৃথিবীর সবচেয়ে সম্পদশালী পাহাড়" হিসেবে অভিহিত করা হতো, পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষের সমাগমে এই ১8৫০ বর্গ কিঃ (আনুমানিক) শহরে তখন এক লক্ষের বেশি অধিবাসী থাকত। আজকের বিউটে মাত্র ৩৫,০০০-এর মত মানুষ বসবাস করে। খনিজ ব্যবসার আধুনিক যন্ত্রায়নের জন্য অবধারিতভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগের অভাবই বিউটের জনসংখ্যা হ্রাসের প্রধান কারণ। এছাড়া আমার ধারণা, এখানকার সাংঘাতিক ঠান্ডা শীতকাল যা প্রায় ছ'মাস এই শহরকে বরফে ঢেকে রাখে, পরিযায়ী মানুষদের এখানে পাকাপাকি থাকার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করার পক্ষে বেশ যথেষ্ট।
বিউটের জনসংখ্যার ৯৫ শতাংশ হলো শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান এবং এদের বেশিরভাগের পিতৃপুরুষেরা এসেছিলেন আয়ারল্যান্ড থেকে। তবে, এখানে মন্টানা টেক ইউনিভার্সিটি অবস্থিত হওয়ার কারণে, অল্প সংখক হলেও কিছু নানা দেশের ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকার দেখা পাওয়া যায়।
"মন্টানা ফোক ফেস্টিভ্যাল” - প্রতি বছর জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুক্রবার থেকে রবিবার দুপুর থেকে সন্ধ্যে অবধি এই অনুষ্ঠান চলে হিস্টরিক ‘আপ টাউন’ বিউটের বিভিন্ন বিশিষ্ট জায়গায় খোলা আকাশের নিচে তাঁবু খাটিয়ে। আর কেন্দ্রবিন্দু বা প্রধান মঞ্চ তৈরি হয় দিগন্তপ্রসারী পাহাড়ের মাঝে "দা অরিজিনাল মাইন ইয়ার্ড" এর বিউটের প্রতীকী হেডফ্রেমের নিচে। একটু দূরেই দেখা যায় বিউটের ঐতিহাসিক পুরোনো স্থাপত্য। এরকম অপূর্ব প্যানোরামিক দৃশ্যের মাঝে অনুষ্ঠান দেখার জন্যে এই ক'টা দিন বোধহয় সমস্ত বিউটের মানুষ এখানে সারা দিন ধরে ভিড় জমায়। এছাড়াও সারা আমেরিকার বিভিন্ন সংগীতপ্রেমী ও পর্যটনপ্রিয় মানুষকেও এই সময় এখানে দেখা যায়। মেন স্ট্রীট, কপার, গ্র্যানাইট স্ট্রিট ইত্যাদি রাস্তায় প্রায় পাঁচ-ছটা নানা মঞ্চে চলে আমেরিকা ও অন্যান্য দেশের লোকশিল্পীদের নাচ-গানের অনুষ্ঠান। একবারে বিনামূল্যে এইরকম পরিবেশে নানা দেশের প্রথিতযশা শিল্পীদের অনুষ্ঠান দেখার অভিজ্ঞতা আমাদের আর কখনো কোথাও হয়নি।
ছোট বড় নানারকম মানুষ নিজেদের উন্মুক্ত মনের স্ফূর্তিতে অনুষ্ঠান দেখছে, শিল্পীদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান গাইছে বা তাল মিলিয়ে নাচ করছে। অনেকেই দূর থেকে এসেছে নিজেদের বিশাল "রিক্রিয়েশনাল ভেহিকল" নিয়ে - সেখানেই তাদের এই তিন দিনের ঠাঁই, অনেকেই এসেছেন নিজেদের ভাঁজ-করা চেয়ার বা বড় শতরঞ্চি নিয়ে, হুইল চেয়ারে বসে বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, ভিন্নভাবে-সক্ষম মানুষরা - যে যার মতো করে আমোদে কাটায় এই তিন দিন। অনুষ্ঠান মঞ্চের চারপাশের খাবারের স্টল, ইনফরমেশন ডেস্ক, নানারকম হাতের কাজের স্টল - একেবারে জমজমাট ব্যাপার! আমাদেরও এই অনুষ্ঠানের দিনগুলিতে বেশ বাংলার পুজো-পুজো আমেজ আসে।
সবাই অত্যন্ত আনন্দ সহকারে উদারভাবে দান করেন এই অনুষ্ঠান তহবিলে; অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণেও দান সংগ্রহকারীদের প্রায় ডেকে-ডেকে তাঁদের দানের বালতিতে অনুদান দেওয়া দেখে ভারি ভালো লাগে।
এছাড়া আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে তেসরা আর চৌঠা জুলাই পালিত হয় ফ্রিডম ফেস্টিভ্যাল। ওই দুই রাত্তিরে, বিউটের "M" লেখা পাহাড়ের কাছে আতশবাজি আর আলোর রোশনাই একেবারে দেখার মতো। একেবারে আমাদের কালীপুজো বা দীপাবলির দিনের মতো মনে হয়। বিউটের বেশিরভাগ মানুষ সেদিন ভিড় করে এই চত্বরে ও অনেক রাত্তির অবধি সরগরম থাকে এই নির্জন নিরিবিলি জায়গা। আমাদের এপার্টমেন্ট এই পাহাড়ের একেবারে কাছে বলে, আমরা বারান্দায় বসেই দিব্যি উপভোগ করতে পারি এই আলোর রোশনাই।
মে মাসের মাঝামাঝি থেকে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ অবধি প্রতি শনিবার "আপটাউন বিউটের" পার্ক আর মেন্ স্ট্রিটের মাঝে বসে "ফার্মার’স মার্কেট"। এই বাজারে যেতে আমার বেশ ভালোই লাগে কারণ অনেক ধরনের স্থানীয় শাক-সব্জি পাওয়া যায় যা ওয়ালমার্টে সাধারণত পাওয়া যায় না। তবে আমার কেমন মজা লাগে দেখে - মনে হয় যেন খেলনা বাজার। আমাদের কলকাতার পাড়ার স্থানীয় বাজার এবং তার জনসমাগম এখানকার থেকে অন্তত একশো গুন বেশি!
বিউটের রেস্তোরাঁ ও প্রতীকী খাবার:
বেশিরভাগ বাঙালির মতো আমরাও অতি ভোজনরসিক পরিবার। তাই সে ব্যাপারে কিছু কথা বলতেই হয়। এমনিতে আর অন্য আমেরিকান জায়গার মতো ওই ধরাবাঁধা স্যান্ডউইচ আর বার্গারের চল তো আছেই। তবে বিউটের স্বর্ণযুগের সময়ে নানা জায়গার মানুষের সমাগমের ছাপ এখানকার খাওয়াদাওয়াতেও পাওয়া যায়-- চাইনিজ, ইটালিয়ান, মেক্সিকান ও অবশ্যই আইরিশ রেস্তোরাঁ ছড়িয়ে আছে শহরের প্রধান রাস্তার আনাচে-কানাচেতে। এখানকার “পিকিং নুডল পার্লার" আমেরিকার সবচেয়ে পুরোনো চিনে রেস্তোরাগুলোর মধ্যে পড়ে। বিউটের প্রতীকী কিছু বিখ্যাত খাবার হলো আইরিশ/কর্নিশ পাস্টি, হাকলেবেরি জ্যাম, পোভিটিকা (ক্রোশিয়ান ওয়ালনাট ব্রেড)। আমাদের খুব প্রিয় রেস্তোরাঁ কাসাগ্রান্ডা স্টেক হাউস-টিও বেশ অভিনব। এটি ১৯০০ থেকে ১৯৭৫ সাল অবধি একটি গুদাম ঘর হিসেবে চালু ছিল; তারপর বিউটের ব্যবসা বাণিজ্যের অবনতির কারণে এটিও বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এখানেও বিউটের অধিবাসীদের অদম্য মানসিক শক্তি আর উৎসাহের প্রমাণ দেখতে পাওয়া যায় - ১৯৯৩ সালে ওই জায়গায় রেস্তোরাঁ খোলা হয় এবং আজকেও অত্যন্ত সফলভাবে চালু। এর ভিতরের চেহারা সেই পুরোনো গুদামের মতো করেই রাখা আছে - পুরোনো আসবাবপত্র, প্যাকিং বাক্স, ইত্যাদি এদিক ওদিকে ফেলে রাখা আছে, এমনকি পুরোনো নথি, রসিদ দেওয়ালের গায়ে লাগিয়ে রাখা আছে।
সেই ২০১৫ থেকে এই ২০২২ অবধি বেশ কয়েকবার এসেছি এখানে, ঘুরেছি আমেরিকার নানা শহর, এবং নামী-অনামী বহু পর্যটন স্থান। কিন্তু "নর্দান রকিস" ঘেরা মন্টানার এই ছোট্ট শহর তার অপূর্ব নিসর্গ, ইতিহাস, ইতিকথা আর বর্তমান সময়ের জীবনযাত্রার রূপ নিয়ে আমার মনের মণিকোঠায় এক স্থায়ী ভালোবাসার জায়গা করে নিয়েছে।