• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯১ | জুলাই ২০২৩ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • অতীতের "সবচেয়ে সম্পদশালী পাহাড় " - মন্টানার বিউট শহরের কাহিনী : স্বস্তিকা চ্যাটার্জ্জী দাস



    ২০২২ র ৩০'এ জুন - আমেরিকার সল্ট লেক সিটি থেকে উড়ে এবার নামছি মন্টানার ছোট্ট শহর বিউটের দিকে। ওপর থেকে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ে ঘেরা শহরটাকে! ওই যে "M" লেখা পাহাড় দেখা যাচ্ছে - ওর কোলেই তো আমাদের বাসস্থান! ওই তো ছোট্ট একটা সাদা বিন্দুর মতো দেখা যাচ্ছে বিউটের আত্মার মূর্তি রূপ "লেডি অফ দা রকিস"! মনে পড়ে যাচ্ছে সেই প্রথম ভ্রমণের কথা ...

    ২০১৫র জুন মাস, আমার মেয়ে আর আমি চলেছি অ্যামসটারডাম থেকে আমেরিকার সল্ট লেক সিটির পথে; মিশুকে এয়ারহসটেস আমাদের সঙ্গে আলাপ জমাল আর আমাদের শেষ গন্তব্য মন্টানার "বিউট" শহর শুনে ভারী উত্তেজিত ও অবাক! “তোমরা কি ওখানে থাকো?" আমার কন্যা জানিয়ে দিল যে তার বাবা মন্টানা টেক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক; আমরা ইন্ডিয়া থেকে আসছি গরমের ছুটি তাঁর সঙ্গে কাটানোর অভিপ্রায়ে।

    এয়ারহসটেস খানিক উদাস হয়ে গিয়ে মৃদু স্বরে বলে উঠলেন, "বিউট, আমার জন্মস্থান! পুরনো দিনে ওই শহরকে কি বলা হত জানো? পৃথিবীর সবচেয়ে সম্পদশালী পাহাড়; খনিজ সম্পদের জন্যে বিখ্যাত ..." ইত্যাদি, ইত্যাদি।

    সেই ২০১৫র জুনের গোড়ায়, কলকাতা থেকে শুরু করে প্রায় ছত্রিশ ঘন্টা যাত্রা করে যখন বিউটের "বার্ট মুনি এয়ারপোর্টে" পৌঁছলাম তখন সেখানে প্রায় মাঝ রাত্তির (আমেরিকার মাউন্টেন টাইম অনুযায়ী)। কিন্তু এ কেমন এয়ারপোর্ট? আমেরিকার বুকে এত ছোট, নির্জীব আর নিষ্প্রভ এয়ারপোর্ট হতে পারে এ আমাদের কল্পনার বাইরে! যাই হোক, ছ'মাস অদেখার পরে পরিবারের মিলিত হওয়ার আনন্দে আমরা তখন বিহ্বল - মেয়ে আর তার বাবা তো সেই এয়ারপোর্ট চত্বরেই প্রায় নাচ জুড়ে দেয় আর কি!

    সেই গভীর রাত্তিরে, ঘুমন্ত নিঃঝুম পথ দিয়ে, এয়ারপোর্ট থেকে গাড়ি করে "লেক্সিংটনে" আমাদের এপার্টমেন্টে আসার সময়ে মনে হচ্ছিল যেন কোনো এক প্রাচীন ভুতুড়ে শহরে এসে উপস্থিত হয়েছি। আমাদের সদা চঞ্চল কন্যাটিও পুরো রাস্তা কেমন চুপটি করে গুটিসুটি হয়ে চোখ গোল গোল করে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে ছিল। তার বাবা আমাদের ক্রমাগত উৎসাহিত করে গেলেন এই বলে যে আমরা একদম ঠিক সময়ে বিউটে এসেছি, গরমকালে মন্টানার প্রাকৃতিক রূপ অসাধারণ...তারপর গাড়ির মিউজিক সিস্টেমে মৃদু ভলিউমে চালিয়ে দিলেন জন ডেনভারের গাওয়া, এমিলোউ হ্যারিসের লেখা সেই বিখ্যাত গান "ওয়াইল্ড মন্টানা স্কাইস ..."



    পরের দিন ঘুম ভাঙতে, এক উজ্জ্বল ঝকঝকে সকাল আমাদের স্বাগতম জানাল। চারপাশে পাহাড় ঘেরা নির্জন জায়গায়টাকে মনে হচ্ছিল যেন ছবির বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা কোনো নিসর্গচিত্র। সেদিনটা আমাদের শুয়ে বসে আর জেট ল্যাগের সঙ্গে যুদ্ধ করেই কেটে গেল।

    পরের দিন, মিঃ প্রোফেসর ইউনিভার্সিটিতে চলে যেতেই, মা আর মেয়ে মিলে যুক্তি করলাম যে জেট ল্যাগের তোয়াক্কা না করেই বাসে চেপে ঘুরতে যাব শহরটায় - যতটা সম্ভব। আমরা খোঁজখবর আগে থেকেই খানিকটা জোগাড় করেছিলাম - আমাদের এপার্টমেন্টের কাছেই কোথাও একটা বাস-স্টপ আছে যেখানে "মন্টানা টেক" থেকে "হ্যারিসন এভেন্যু"র "ট্রানসিট সেন্টারে" যাওয়া-আসার বাস নির্ধারিত সময়ের ব্যবধানে পাওয়া যায়। মোবাইলে গুগুল (google) বাবুর ভরসায় আমরা তো বেরিয়ে পড়লাম। ইউনিভার্সিটির এই হাউসিং কমপ্লেক্সটি বিউট শহরের প্রায় শেষ প্রান্তে অবস্থিত। খানিক ভয়-ভয়, আবার বেশ এডভেঞ্চারের উত্তেজনা নিয়ে, অত্যন্ত নিরিবিলি, আঁকাবাঁকা উঁচু-নীচু পাহাড়ি রাস্তা, "লেক্সিংটন", "এমেট", ...ইত্যাদি পেরিয়ে এলাম বড় রাস্তায়, "এক্সেলসিওর"। পরে অবশ্য দেখেছি যে "জি পি এস" বাবাজী আমাদের বৃথাই ঘুরপাক খাইয়েছিল; "লেক্সিংটন" থেকে একদম সোজা রাস্তা গিয়ে উঠেছে এক্সেলসিওরে! কিন্তু বাস স্টপটা কোথায়? কোথাও কোনো কিছু লেখা বা চিহ্ন তো নেই! কি আর করা - ফুটপাথে একটা কোণ দেখে দাঁড়ালাম। চারপাশে কোন কাউকে দেখা যায় না যাকে জিজ্ঞেস করতে পারি - "এ তো আর কলকেতার শহর নয় ..."। মানুষজন না দেখা গেলে কি হবে, তাদের চারপেয়ে পোষ্যরা আমাদের দেখে রীতিমত উত্তেজিত হয়ে ক্রমাগত চেঁচামেচি করে তাদের সন্দেহ ঘোষণা করতে লাগল।

    শহরের এই দিকটা পুরোনো আবাসিক অঞ্চল - গায়ে-গায়ে লাগানো বাড়ি, ছোট লন বা ব্যাকইয়ার্ড; বেশ কিছু বাড়িতে মনে হলো কেউ আর বসবাস করে না। পরে বিউটের ইতিহাস জানার পরে বুঝেছি শহরের এই দিকে এককালের ঘন বসতির এবং আজকের দিনে এইরকম ধ্বসে যাওয়া করুণ চেহারার কারণ।

    যাইহোক, আমাদের ভাগ্য ভালো, একটু বাদেই দেখি একটা কালো কাঁচওয়ালা কমলা রঙের বাস আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে দরজা খুলে দিল। আমরা ভাড়া দিতে গেলাম কিন্তু আমাদের অবাক করে ড্রাইভার ভদ্রলোকটি জানালেন যে মন্টানা টেকে কর্মরতরা এই বাসে বিনামূল্যে যাতায়াত করতে পারে। আমি আপত্তি জানিয়ে, বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু তাও তিনি ভাড়া নিতে অস্বীকার করলেন।



    বাসে যেতে যেতে রাস্তার ধারে নানা জায়গায় দেখতে পেলাম ছড়ানো-ছেটানো পরিত্যক্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে উঁচু উঁচু লোহার কাঠামো। আশ্চর্য হয়ে দেখছিলাম-এগুলো কি? পরে জেনেছি এগুলোই বিউটের সেই "আইকনিক হেডফ্রেম" - ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের ও বিংশ শতাব্দীর গোড়ার সময়ের সম্পদশালী বিউট-এর ইতিহাসের সাক্ষী। সেই ইতিহাস ও এই সব "হেডফ্রেমের" গল্প বিস্তারিত ভাবে পরে বলছি।

    সেদিন আমরা দু'জনে হেঁটে হেঁটে খানিকটা উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ালাম "হিস্টোরিক আপ টাউন বিউটের" নানা রাস্তায় - কয়েকটা নাম যেমন "গ্রানাইট", "কোয়ার্টজ", "কপার" বুঝিয়ে দেয় এই শহরটার সঙ্গে খনি আর খনিজ সম্পদের কি ওতপ্রোত সম্পর্ক! সুন্দর ঝকঝকে দিন, হাল্কা ঠাণ্ডার আমেজ (কলকাতার ডিসেম্বরে যেমন শীত!), ঝলমলে রোদ্দুরের ওম গায়ে মেখে ঘুরতে বেশ লাগছিল। এই অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে পুরোনো আমলের বড় বড় অনেক ইমারত - বেশ কিছু তখনকার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, পুরোনো আদালত ("ওল্ড কোর্ট হাউস") আর ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্বের অনুকরণে তৈরি বিশাল বিশাল বিলাসবহুল আবাসিক প্রাসাদ। ইন্টারনেট বা অন্তর্জালের তথ্য অনুযায়ী আমেরিকার "জাতীয় ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন জায়গা"র অন্যতমগুলির মধ্যে "বিউট সিলভার বাও কাউন্টি"ও বিবেচিত হয়ে থাকে - প্রায় চার হাজার ঐতিহাসিক ইমারত ছড়িয়ে আছে এই নর্দার্ন রকিস ঘেরা শহরটিতে।

    ফিরতি পথে আবার পেলাম সেই আমাদের আসার সময়ের বন্ধুবৎসল বাস চালককে। উনি আমাদের এক্সেলসিওরের বাস স্টপে নামিয়ে হাসিমুখে বিদায় জানিয়ে চলে গেলেন।

    সেদিনের সেই খানিকক্ষণের লক্ষ্যহীন ঘোরাফেরা আমাদের বিউটের সমন্ধে আরো কৌতূহলী করে তুলল। আমরা তাই ঠিক করলাম প্রথমে দু'ঘন্টার "বিউট ট্রলি ট্যুর" নিয়ে শহরটার একটা সাধারণ পরিদর্শন করে ঠিক করব কোন কোন বিশেষ দ্রষ্টব্য জায়গাগুলো সময় নিয়ে আলাদা করে ভালো ভাবে দেখব।



    "ট্রলি ট্যুর"

    এই সফরটি "জর্জ স্ট্রিটে" অবস্থিত "বিউট সিলভার বাও কাউন্টি চেম্বার অফ কমার্স" প্রতি বছর "মেমোরিয়াল ডে" (মে মাসের শেষে ) থেকে "লেবার ডে" (সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে ) শনিবার বাদ দিয়ে সপ্তাহের সবদিনেই চালনা করে। বিউটের পর্যটনকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্যে এই সংগঠনটির প্রচেষ্টা সত্যিই প্রশংসনীয়।

    আমরা সকাল-সকাল হাজির হয়ে টিকিট কেটে নিলাম। বড় বড় জানালাওয়ালা উজ্জ্বল লাল-সবুজ রঙের বাসটা দেখেই মন খুশি হয়ে গেল। আরো কয়েকজন পর্যটক জড় হলে, আমাদের ট্যুর-গাইড এবং ড্রাইভার (তাঁর নামটি মনে নেই; ধরে নেওয়া যাক "মাইক") হাসিমুখে আপ্যায়ন করে বাসে তুললেন। শহরের রাস্তা দিয়ে ধীর গতিতে গাড়ি চালাতে চালাতে শুরু করে দিলেন তাঁর ধারাভাষ্য; মন্দ্রমধুর কণ্ঠস্বরে সেই বিবরণী আমাদের পৌঁছে দিচ্ছিল বিউটের সেই হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোতে। মাইক একজন "ভেটারান” এবং এই শহরেই জন্ম ও বড় হওয়া - তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই তথ্যসমৃদ্ধ ধারাবিবরণীর সঙ্গে মিশেছিল এই শহরের প্রতি গভীর অবেকপূর্ণ ভালোবাসার প্রকাশ।

    ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, "মন্টানা রকিসের সিলভার বাও ক্রিক" উপত্যকা বিখ্যাত হয়ে ওঠে তার খনিজ সম্পদের জন্যে। প্রথম দিকে বিশেষ করে সোনা ও রূপোর খোঁজ পাওয়ার কারণে, এই জায়গার খনিজ ব্যবসা সারা পৃথিবী থেকে "প্রস্পেক্টর"দের টেনে নিয়ে এসেছিল এখানে। তারপরেই যখন আমেরিকায় বৈদ্যুতিক আলো ও যন্ত্রের প্রচলন হলো, তখনই ভীষণভাবে তামার প্রয়োজন বেড়ে গেল। এবং এই অঞ্চলের তামার অপর্যাপ্ত সম্ভার, বিউট খনিজ শিল্পকে খুব দ্রুত সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল। এই অর্থনৈতিক উন্নতি, প্রচুর ব্যবসা ও উচ্চ বেতনের কর্মের সুযোগের কারণে সারা পৃথিবীর মানুষ এখানে ভিড় করেছিল - ওয়েলস, আয়ারল্যান্ড, লেবানন, কানাডা, ইটালি, ফিনল্যাণ্ড, চায়না ইত্যাদি জায়গার নানা মানুষের ভীড়ে জমজমাট ছিল এই বিউট নামের ছোট্ট শহরটি।



    বাস এসে দাঁড়াল সেই আমাদের আগের দিনের দেখা একটা "হেড ফ্রেমের" কাছে। মাইক বলে চললেন ...বিউটের দিগন্ত জুড়ে এরকম চোদ্দোটা ফ্রেম (১০০ - ২০০ ফুট উঁচু ) পুরোনো খনিজ ব্যবসার ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।আমরা এসে দাঁড়িয়েছি "মেন স্ট্রিটে” "দা অরিজিনাল" এর সামনে - এটা বিউটের প্রথম "কপার মাইন", ১৮৭৮ থেকে ১৯৭৬ অবধি চালু ছিল এই ৩৫৬৯ ফুট গভীর খনিটি এবং ৪৩টি খনি-দুর্ঘটনা জনিত মৃত্যুর সাক্ষী। এই ফ্রেমগুলোকে বলা হতো "গ্যালোস বা গ্যালাস ফ্রেম” যার সঙ্গে কপি কল লাগিয়ে, কর্মীদের খনি-গহ্বরে যাতায়াতের জন্যে ব্যবহার হতো। এছাড়াও মূল্যবান খনিজ ধাতু, যন্ত্রপাতি, জিনিসপত্র, ইত্যাদি ওঠানো-নামানোর কাজে ব্যবহার হতো। "গ্যালোস"-এর আক্ষরিক তর্জমা "ফাঁসিকাঠ" - খনির শ্রমিকদের জীবনের ভয়ানক ঝুঁকির কথা ভাবলে মনে হয় কি সাংঘাতিক অর্থবহ এই নাম! খানিকক্ষণের জন্যে আমার একটা অদ্ভুত অনুভূতি হলো - মনে হলো আমি যেন অনুভব করতে পারছি সেই পুরোনো ব্যস্ততায় সরগরম জীবনযাত্রা। বহুদিন আগে দেখা একটা সিনেমা "হাউ গ্রীন ওয়াস মাই ভ্যালি”র কথা মনে পড়ে গেল। প্রতিদিন সন্ধ্যে পড়তেই, শহরের সব হেডফ্রেমগুলো লাল আলোর মালায় সেজে ওঠে। এই সব জানার পর, রোজ রাত্তিরে যখন আমাদের ঘর থেকে দেখতাম দূরে ওই আলোকোজ্জ্বল হেডফ্রেমগুলো, কেমন একটা বিচিত্র মনখারাপ করা অনুভূতি হতো।

    ভারি মন নিয়ে উঠে পড়লাম বাসে। ধীর গতিতে বাস চলল "হিস্টোরিক আপ টাউন"-এর বিভিন্ন রাস্তা দিয়ে আর তার সঙ্গে মাইকের ধারাভাষ্য। প্রতিটা বিশেষ দ্রষ্টব্য ঐতিহাসিক বাড়ি বা ভবনগুলোর সামনে অল্প সময়ের জন্যে দাঁড়িয়ে মাইক তাদের ইতিহাস ও সংশ্লিষ্ট গল্পকথা ভারি মজাদার করে বলছিলেন। এই সফরে এই জায়গাগুলি শুধু বাইরে থেকেই দেখানো হয় - "কপার কিং ম্যানসন", ডুমা (স) ব্রোথেল", "মাই - ওয়াহ মিউজিয়াম"। শুধু শেষ স্টপ "বার্কলে পিট্” এর ভিতরে ঢুকে বেশ খানিকক্ষণ ঘোরাফেরা করে দেখার সুযোগ পেলাম। যেহেতু পরে আমরা এই সবকটা দ্রষ্টব্যস্থল আলাদা ভাবে ট্যুর নিয়ে দেখেছিলাম, এদের সমন্ধে বিস্তারিত ভাবে পরে বলছি। তাই একেবারে আসছি "বার্কলে পিট্ "এর বর্ণনায়।



    বার্কলে পিট্ - ১৯৫০ এর প্রথম দিক থেকেই বিউটের "আন্ডারগ্রাউন্ড মাইনিং” এর যুগ অবসান হয়ে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ "ওপেন পিট্ মাইনিং" পদ্ধতিতে ভূগর্ভস্থ তামা সংগ্রহ শুরু হয়। পুরোনো পদ্ধতির মাইনিং যদিও অত্যন্ত বিপজ্জনক ছিল, কিন্তু শ্রমশক্তি প্রধান হওয়ার কারণে বহু মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ ছিল এবং সেটা বিউটের সমৃদ্ধির প্রধান হেতু। তাই এই "ওপেন পিট্ মাইনিং" যেমন বিউটের সৌভাগ্যের ইতি ঘটিয়েছিল তেমনই "এনাকোন্ডা কপার কোম্পানির” বার্কলে পিটের সূচনার ইতিহাস গড়েছিল। ১৯৫৫ থেকে ১৯৮২ অবধি এখানে খনন কার্য চলেছে। তারপর তামার মূল্য হ্রাস ও খনি থেকে লভ্যতা কমে যাওয়ার কারণে "এনাকোন্ডা" এইখানে মাইনিং বন্ধ করে দেয়। তখন আশপাশে খনিগুলোরও জলের পাম্প বন্ধ করে দেওয়ার ফলে, এই বিশাল গর্তটির (১.৬ কিঃ লম্বা X ৮০০ মিঃ চওড়া X ৫৫০ মিঃ গভীর) অর্ধেকের উপর ভরে ওঠে অত্যন্ত বিষাক্ত ভারী ধাতু সহ প্রায় ৪০ মিলিয়ন গ্যালন অম্লীয় জলে। তবে আশ্চর্যের কথা এই সাংঘাতিক বিষাক্ত জলে বেঁচে থাকে আণুবীক্ষণিক "প্রটোজোয়া" যারা অদ্ভুতভাবে বিবর্তিত হয়েছে এই রকম পরিবেশে বাঁচার জন্যে।

    "পিটে" ঢোকার পথটা একেবারে খনির খাদের মতোই রাখা আছে আর তারপরে একটা লম্বা (যেন অনন্ত) সুড়ঙ্গ পথ, যেটা গিয়ে উঠেছে "পিট" দেখার "স্ট্যান্ডে"। অদ্ভুত বিচিত্র রঙের জলে ভরা বিশাল গহ্বর দেখে কেমন যেন একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি হল - লোহা মিশ্রিত ফিকে লাল জলের সঙ্গে মিশে আছে "কপার অক্সাইডের" হলদেটে সবুজ রং!

    সেই "ট্রলি ট্যুরে” বাইরে থেকে দেখা জায়গাগুলোর কয়েকটা আমরা সেই প্রথমবারের সফরে বিস্তারিতভাবে ঘুরে দেখেছিলাম। এছাড়াও পরবর্তী বহুবারের সফরে আমরা ওই ছোট্ট শহরের নামী-অনামী আরও অনেক আকর্ষণীয় জায়গা ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রাণভরে উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছি। চেষ্টা করছি সেইসব জায়গাগুলোকে স্মৃতি থেকে অন্তত উল্লেখ করতে আর বিশেষ কিছুর খানিকটা বিস্তারিত বিবরণ দিতে।

    "আওয়ার লেডি অফ দা রকিস "



    সত্যি কথা বলতে, আমার কাছে বিউটের হেডফ্রেমসগুলোর পরে এই ৯০ ফুট উঁচু "লেডি অফ দা রকিস"কেই সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক ও অভিনব মনে হয়েছে।

    যতবার বিউটে এসেছি, ফ্লাইট নামার সময় ওপর থেকে যখনই বিন্দুর মতো দেখা দিয়েছে পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকা এই অভিনব ধবধবে সাদা নারীমূর্তি, মনটা যেন অজান্তেই অদ্ভুত এক ভালো লাগার অনুভূতিতে ভরে উঠেছে - যেন আমাদের জন্যেই অপেক্ষারতা অতি কাছের কোন আত্মীয়া।

    "লেডি অফ দা রকিস”-এ যাওয়ার বাস ট্যুর শুরু হলো "বিউট প্লাজা মল” চত্বর থেকে। "রবার্ট" নামে আমাদের "গাইড কাম ড্রাইভার" বেশ বয়স্ক, হাসি-খুশি বাক্যবাগীশ ভদ্রলোক; আমরা ভারতীয় জেনে তিনি ভারি উৎসাহিত হয়ে, আমাদের মেয়েকে তাঁর পাশের সিটে বসালেন। বন্ধুর পাহাড়ি পথ দিয়ে ওপরে যাওয়ার সফরটা শরীরের পক্ষে বিশেষ সুখকর নয় - উঁচু-নীচু ছাড়াও, আঁকাবাঁকা পথে মাথার কাঁটার মত বাঁকগুলো রীতিমতো বিপজ্জনক লাগছিল। কিন্তু এই রাস্তায় অসংখ্য বার টুরিস্ট বাস চালানো, রবার্টের অভিজ্ঞ হাত এবং ক্রমাগত ধারাবিবরণী, কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের নিঃশঙ্ক হতে সাহায্য করল।

    বিউটের থেকে ৩৫০০ ফুট ও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮৫৫০ ফুট উপরে "কন্টিনেন্টাল ডিভাইডে” অবস্থিত, আমেরিকার তৃতীয় উচ্চতম মূর্তি "আওয়ার লেডি অফ দা রকিস", "মাদার মেরি"-কে উৎসর্গীকৃত।

    উপরে পৌঁছে মূর্তিটির পাদদেশে দাঁড়িয়ে, বিস্মিত হয়ে গেলাম তার বিশালত্ব দেখে। আমার মনে পড়ে গেল কয়েক বছর আগে ব্রাজিলের রিও শহরে দেখা "ক্রাইস্ট দা রিডিমার”-এর মূর্তির কথা।

    অনেক নিচে দেখা যায় মন্টানার পর্বতমালার উঁচু শৃঙ্গ ও ঢালু উপত্যকা, তার মাঝে বিউট শহর, বিন্দুর মতো বার্কলে পিট্ - অপূর্ব মনোমুগ্ধকর দৃশ্য।



    এই মূর্তি স্থাপনের ইতিহাস ছোট্ট করে বলি - ১৯৭৯-এ বিউটের অধিবাসী বব ও'বিল তাঁর ক্যান্সার রোগাক্রান্ত স্ত্রীর সুস্থতা কামনা করে মাদার মেরির কাছে মানত করেছিলেন যে যদি স্ত্রী সুস্থ হয়ে ওঠেন তাহলে নিজের বাগানে ৫ ফিট উঁচু মেরির মূর্তি উনি স্থাপন করবেন। স্ত্রী সুস্থ হয়ে উঠলে, তাঁরা এবং তাঁদের বন্ধুরা মিলে ঠিক করলেন যে পাহাড়ের উপরে একটি ৯০ ফিট মূর্তি বানানো হবে। বিউটের বহু অধিবাসী স্বেচ্ছায় নিজেদের অর্থ, দক্ষতা ও শ্রম দিতে এগিয়ে এলেন। পাহাড়ের উপরের এই জায়গাটা দান করেছিলেন "গাই ওসেলো" নামে এক বিউটের অধিবাসী। প্রধান প্রযুক্তিবিদ ছিলেন "লরিয়েল উইজিন রিহল" নামে "এনাকোন্ডা কপার কোম্পানির" একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রযুক্তিবিদ। ছ'বছরের নিরলস প্রচেষ্টায়, ১৯৮৫ সালে তাঁদের স্বপ্ন সার্থক রূপ পায়; "এয়ার ন্যাশনাল গার্ড"-এর সাহায্যে "স্কাই - ক্রেন হেলিকপ্টার” দিয়ে চার টুকরো আলাদা আলাদা করে পাহাড়ের মাথায় তুলে নিয়ে এসে সম্পূর্ণ মূর্তিটি তৈরি করা হয়।

    যদিও মূর্তিটি মাদার মেরিকে উৎসর্গীকৃত, তবু অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য এবং অনুপ্রেরণা পৃথিবীর সব মহিলার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন; বিশেষ করে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব মায়েদের প্রতি। "মেমোরিয়াল ওয়াল"-এ খোদাই করা আছে প্রায় ১৫০০০ বিগতপ্রাণ মহিলাদের নাম।

    আমার নিজস্ব ধারণা যে বিউটের অর্থনৈতিক মন্দাবস্থার সময়ে, এখানকার অধিবাসীদের নির্জীব জীবনে এই প্রকল্পটা অনেকটা আনন্দ, উত্তেজনা সঞ্চার করতে সাহায্য করেছিল - তাই, এই প্রকল্পটির সাফল্যের জন্যে তাঁরা অত্যন্ত সাগ্রহে আন্তরিক ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। গভীর শ্রদ্ধায় মাথা নত করলাম তাঁদের এই অদম্য প্রাণশক্তির উদ্দেশ্যে।

    "মিনারেল মিউজিয়াম” - আমার প্রথমবারের বিউট সফরেই এই সংগ্রহশালাটি দেখতে গেছিলাম। মিঃ প্রফেসারের সঙ্গেই তাঁর কর্মক্ষেত্র মন্টানা টেক উনিভার্সিটি ঘুরে, ঢুকে পড়লাম ক্যাম্পাসেই অবস্থিত এই মিউজিয়ামটিতে। অবাক হলাম দেখে যে বিনামূল্যে দেখার সুবিধে থাকলেও এখানে দর্শনার্থী প্রায় নেই বললেই হয়। যাইহোক, আমরা নিরিবিলিতে খুব উৎসাহের সঙ্গে ভালো করে ঘুরে দেখলাম।



    প্রদর্শিত আছে "সবচেয়ে সম্পদশালী পাহাড়” আখ্যা পাওয়ার ইতিহাসের নমুনা হিসেবে সোনা, অপূর্ব নীলকান্তমণি, তামা, স্ফটিক, দস্তা ইত্যাদির বিশাল সংগ্রহ। জানলাম ১৯০১ সালে পত্তন হওয়া এই সংগ্রহশালায় প্রায় ১৩০০০ খনিজ পদার্থ ও পাথরের নমুনা প্রদর্শিত করা আছে - সত্যিই চমকপ্রদ সংগ্রহ। এবং সবই এত সুন্দরভাবে লেখা আছে যে বুঝতে কোন অসুবিধে হয় না। মন্টানার ভূতত্ত্ব ও খনি শিল্পের ইতিহাসের উপর প্রদর্শনগুলিও বেশ আকর্ষণীয় লাগল।

    সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক লাগল একটি কোয়ার্টজ (স্ফটিক), "রিহান্না'স স্টার” নামে খ্যাত, অদ্ভুত সুন্দর প্রায় দু ফুট ব্যাসের ধোঁয়াটে রঙের এই কোয়ার্টজটি জ্যাক জনসন নামে বিউটের এক অধিবাসী দু বছরের পরিশ্রমে খুঁড়ে তুলেছিলেন পূর্ব বিউটের একটি জায়গা থেকে এবং তাঁর মেয়ের নামে নামকরণ করেছিলেন।

    এছাড়াও দেখলাম ব্রাজিল, আমেরিকার অন্যান্য জায়গা এবং পৃথিবীর বিভিন্ন খনি থেকে সংগ্রহ করা নানা রকমের খনিজ পদার্থ। বেশ কিছু উল্কাও প্রদর্শিত আছে সংগ্রহশালায়।



    "দা ওয়ার্ল্ড মিউজিয়াম অফ মাইনিং" - আমার মতে বিউটের দর্শনীয় জায়গাগুলোর মধ্যে এটি অবশ্য দ্রষ্টব্য-র তালিকায় পড়ে। মজার ব্যাপার এই মিউজিয়ামটি মন্টানা টেক ক্যাম্পাসের একেবারে সংলগ্ন এবং আমাদের বাসস্থানের খুবই কাছে হওয়া সত্ত্বেও, প্রথমবারের সফরে বাদের তালিকায় ছিল। পরে এই শহরে আমাদের দীর্ঘ মেয়াদী বসবাসের কারণে এই জায়গাটা সময় নিয়ে ভালো করে ঘুরে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। ১৮৭৫ সালে তৈরি "অরফান গার্ল মাইন”কে খুব সুন্দরভাবে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। পুরোনো সব যন্ত্রপাতি, ১০০ ফুট উঁচু হেডফ্রেম ও যে খাঁচা খনির কর্মীদের নিয়ে ৩০০০ ফুট গভীর খনির বুকে যাতায়াত করত - সবই ঠিক পুরোনো দিনের মতোই রাখা আছে। আমরা আবার খনির নিচে (১০০ ফুট অবধি) হেঁটে যাওয়ার একটা দেড় ঘন্টার ট্যুর নিয়েছিলাম - এটি আমাদের কন্যার উৎসাহেই নেওয়া। নির্দেশিকা মেনে পোশাক, জুতো পরেই গিয়েছিলাম। তার ওপর খনি কর্মীদের মত জ্বলজ্বলে নিরাপত্তা জ্যাকেট আর টর্চ লাগানো হেলমেট পরে কন্যাটির কি উত্তেজনা! আমরা, তার বাবা-মা, কার্যসূত্রে বহু প্রজেক্ট সাইট ঘুরতে অভ্যস্ত - তাই আমাদের কাছে এটা তেমন অভিনব নয়, কিন্তু মেয়ের আনন্দ-উদ্দীপনা দেখে আমাদের বেশ মজা লাগল।

    এছাড়া যেটা সবচেয়ে ভালো লেগেছে - "হেল রোরিং গাল্‌চ", ১৮৯০ সময়কার একটা মাইনিং শহরের অবিকল প্রতিরূপ, যেটা ১৯৬৫ থেকে প্রায় ১৯৮০ অবধি লেগেছিল গড়ে তুলতে। বেশ কিছু পুরোনো দিনের গঠন একেবারে অক্ষত রাখা আছে, আর অনেক ঘর-বাড়ি-প্রতিষ্ঠানের প্রতিরূপ বানানো হয়েছে পুরোনো দিনের উপকরণ দিয়ে। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাড়ি, স্কুল, চার্চ, যানবাহন, এবং অজস্র শিল্পকর্মের নিদর্শন দেখতে দেখতে হারিয়ে গেছিলাম যেন সেই পুরোনো দিনে। ওরকম একটা গোটা শহরের প্রতিরূপ বানানো এবং তার রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চয় অত্যন্ত শ্রম ও ব্যয়সাধ্য ব্যাপার। শুনলাম এখানেও আছে বিউটের অনেক অধিবাসীর স্বেচ্ছাশ্রম ও অবদানের কাহিনী।



    "কপার কিং ম্যানসন” - বিউটের একটি অন্যতম রাস্তা ওয়েস্ট গ্রানাইট স্ট্রিটে অবস্থিত, ৩৪টি ঘরের এই প্রাসাদটি, "রোমানেস্ক রিভাইভাল ভিক্টোরিয়ান" স্থাপত্যের একটি নিখুঁত নিদর্শন। মন্টানার সুবিখ্যাত ও অপরিসীম অর্থশালী একজন ব্যবসায়ী "কপার কিং” উইলিয়াম এন্ড্রুস-এর বাসস্থানটি তৈরি হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, যে সময় বিউট সাফল্যে, সম্পদে একেবারে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল ।



    এটি ১৯৫৩ থেকে "কোট” পরিবারের নিজস্ব সম্পত্তি। প্রাসাদের ভিতরে গাইডেড ট্যুর ছাড়াও খানিকটা অংশ হেরিটেজ হোটেল হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয়।

    প্রাসাদের ভিতরে ঘরের ছাদ ও দেয়ালের ফ্রেস্কো, স্টেইনড কাঁচের বিশাল জানলা, অপূর্ব কারুকার্য করা দামি কাঠের আসবাবপত্র, প্রাচীন সব গৃহস্থালীর জিনিস - সুন্দরভাবে সংরক্ষিত করে রাখা আছে। বেশ লাগল ঘুরে দেখতে। পরে শুনেছি বিউটের অন্যান্য পুরোনো জায়গার মতো এই প্রাসাদেও নাকি অতিপ্রাকৃত ঘটনার গুজব শোনা যায়।

    "ডুমা(স) ব্রোথেল” - মার্কারি স্ট্রিটে অবস্থিত এই দোতলা লাল রঙের বাড়িটা পুরোনো বিউটের উৎসবমুখর উচ্ছৃঙ্খল দিনের এক নিদর্শন, যখন খনি কর্মীদের হাতে ছিল অঢেল অর্থ আর তার হাত ধরেই এসেছিল নৈশপ্রমোদ, গণিকাবৃত্তি।



    ১৮৯০ সালে, ফ্রেঞ্চ-ক্যানাডিয়ান দুই ভাই, জোসেফ ও আর্থার নাডিয়াউ, এই গণিকালয়টি স্থাপন করেন এবং জোসেফের স্ত্রীর কুমারী জীবনের ডুমা(স), নামে নামকরণ করা হয়। এটি আমেরিকার সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি চালু "ব্রোথেল" হিসাবে পরিচিত - এবং আমেরিকায় এই বৃত্তি বেআইনি ঘোষণা হওয়ার পরেও অনেক বছর চলেছে; ১৯৮২ সালে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এই বিরানব্বই বছরে মালিকানার হাত বদল হয়েছে বহু বার; শেষ ৩০ বছর মালকিন ছিলেন রোজি গ্যারেট নামে বিউটের এক অধিবাসী। পরবর্তী সময়ে এই বাড়িটিকে মিউজিয়াম হিসেবে সংরক্ষণ করার জন্যে বিভিন্ন মালিকরা সর্বান্তকরণে চেষ্টা চালিয়ে গেছেন ও যাচ্ছেন।



    ২০১৬ সালের সফরে, আমরা এই বাড়িটির ভিতরে ঘুরে দেখার একটি ট্যুর নিয়েছিলাম। সেই সব পুরোনো দিনের নৈশপ্রমোদের সাক্ষী হিসেবে নৈশযাপনের ঘরগুলো এখনো সেইরকমভাবে সাজানো আছে, চড়া রঙের চকচকে বিছানার চাদর, পর্দা, পুরোনো ব্যবহৃত পোশাক ও জিনিসপত্র দিয়ে। এই ট্যুরে, আমরা কোনো গাইড পাইনি - নিজেরাই ঘুরে দেখলাম। বেশ কিছু জায়গার ভগ্নদশা। যে ভদ্রমহিলা রিসেপশন কাউন্টারে বসেছিলেন, তিনিই তৎকালীন মালিক পরিবারের। তাঁর কাছেই শুনলাম এই বাড়িটিও নাকি অভিশপ্ত - এক মহিলার প্রেতাত্মার (যিনি নাকি দোতলার একটি ঘরে আত্মঘাতী হয়েছিলেন) উপস্থিতি ও নানারকম অতিপ্রাকৃত আওয়াজ ইত্যাদির ব্যাপারে জানালেন। আমাদের সেরকম কোনো অভিজ্ঞতা না হলেও (দিনের আলোয় তেনারা কি আর দেখা দেন?), বেসমেন্টে গিয়ে বেশ গা ছমছমে অনুভূতি হয়েছিল। এই গুমোট জায়গা একটা দপদপে বাল্বের আলোয় কেমন যেন ভয়ের শিহরণ অনুভব করলাম। শুনলাম এই বেসমেন্ট থেকে শহরের নানা খনি অঞ্চলে যাতায়াত করার গোপন সুড়ঙ্গ ছিল যাতে খনি শ্রমিকরা বিনা বাধায় চলে আসতে পারত। এই গণিকালয়টির বেসমেন্ট আর দুটো তলার প্রবেশাধিকার, আর্থসামাজিক স্তর অনুযায়ী ভাগ করা ছিল।

    "মাই-ওয়াহ মিউজিয়াম" - ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিউটের অর্থনৈতিক উন্নতি ও সচ্ছলতার অংশীদার হওয়ার তাগিদে, পৃথিবীর বহু দেশের মানুষ এখানে জড় হয়েছিল। তার মধ্যে বহুলাংশ ছিল চীন দেশের। সেই সব চাইনিজ অভিবাসীদের জীবনযাত্রা, বিউট এবং তার আর্থসামাজিক জীবনে তাদের অবদানের ইতিহাসের নিদর্শন সংরক্ষিত রাখার উদ্দেশে এই মিউজিয়াম স্থাপিত। পুরোনো দিনের প্রখ্যাত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান "ওয়াহ চং তাই" ও "মাই-ওয়াহ নুডুল পার্লার" মিলেই “ওয়েস্ট মার্কারি স্ট্রিট” এ অবস্থিত আজকের এই মিউজিয়াম। যত্নের সঙ্গে সাজিয়ে রাখা এই ছোট সংগ্রহশালাটি আমি বেশ ভালোই উপভোগ করলাম।

    বিউটের পুরোনো জীবন ছেড়ে এবার আসি এখনকার গল্পে।

    বিউটের সমৃদ্ধির মধ্যগগনে, যখন একে "পৃথিবীর সবচেয়ে সম্পদশালী পাহাড়" হিসেবে অভিহিত করা হতো, পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষের সমাগমে এই ১8৫০ বর্গ কিঃ (আনুমানিক) শহরে তখন এক লক্ষের বেশি অধিবাসী থাকত। আজকের বিউটে মাত্র ৩৫,০০০-এর মত মানুষ বসবাস করে। খনিজ ব্যবসার আধুনিক যন্ত্রায়নের জন্য অবধারিতভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগের অভাবই বিউটের জনসংখ্যা হ্রাসের প্রধান কারণ। এছাড়া আমার ধারণা, এখানকার সাংঘাতিক ঠান্ডা শীতকাল যা প্রায় ছ'মাস এই শহরকে বরফে ঢেকে রাখে, পরিযায়ী মানুষদের এখানে পাকাপাকি থাকার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করার পক্ষে বেশ যথেষ্ট।

    বিউটের জনসংখ্যার ৯৫ শতাংশ হলো শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান এবং এদের বেশিরভাগের পিতৃপুরুষেরা এসেছিলেন আয়ারল্যান্ড থেকে। তবে, এখানে মন্টানা টেক ইউনিভার্সিটি অবস্থিত হওয়ার কারণে, অল্প সংখক হলেও কিছু নানা দেশের ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকার দেখা পাওয়া যায়।



    বিউটের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে বহু দূর প্রসারিত নানা হাইকিং ট্রেল - কখনো অনেক উঁচু পাহাড়ি পথে, কিছু আবার পুরোনো সংরক্ষিত খনির পাশ দিয়ে, বা মন্টানা টেক ইউনিভার্সিটির গা ঘেঁষে। আমি সবসময়েই গরমকালে বিউটে গেছি - তাই দিগন্তপ্রসারী সবুজ পাহাড়, ঝকঝকে নীল আকাশ, পাহাড়ের বুকে ভোরের বা গোধূলির সোনা ঢালা রূপ এইসব নৈসর্গিক দৃশ্য প্রাণভরে উপভোগ করার সৌভাগ্য হয়েছে। সবচেয়ে মজা লাগত যখন সন্ধ্যে বেলা পাহাড়ের উপর থেকে হরিণের দল নেমে আসত আমাদের এপার্টমেন্টের সামনে লনের সবুজ ঘাসের সদ্ব্যবহার করতে; আমাদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও বিশেষ পাত্তা দিত না; তবে কোনো গাড়ির শব্দ বা রাস্তায় মানুষ দেখলে (সেটা যদিও খুবই বিরল), উৎকর্ণ হয়ে চঞ্চল পায়ে অতি দ্রুত দৌড়ে ঢুকে পড়ত দূরে পাহাড়ের পাদদেশের বড় বড় ঘাসের মধ্যে। মাঝে মাঝে ভোরের দিকে আসত ধূসর আর সাদা লোমের একটা ছোট্ট শেয়াল - কি খেতে আসে কে জানে! শুনেছি মাঝে মাঝে নাকি একটা-দুটো ভাল্লুক (গ্রিজলি বেয়ার) দেখা যায় পাহাড়ি ট্রেলে ও শহরের রাস্তায়। আমাদের সঙ্গে তাদের কখনো মোলাকাত হয়নি; তবে এই বছরে তাদের উপদ্রব বোধহয় একটু বাড়াবাড়ি হয়েছিল, তাই পাহাড়ি ট্রেলগুলোয় সাবধানবাণী লাগিয়েছে দেখলাম - আর তার ফলে আমাদের বাড়ির কাছের নির্জন পাহাড়ের পথে (বিউট লুপ) সান্ধ্য হাইকিং-এ গেলে বেশ একটু ভয়-ভয় করত।



    সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও উৎসব - আপাত নির্জীব এই শহর কিন্তু খুবই আমোদপ্রিয় আর তার প্রকাশ ঘটে বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে। এখানে আমি বিউটের সবচেয়ে বিখ্যাত ও আমাদেরও অতি প্রিয় উৎসবের কথাই একটু বিশেষ করে বলছি।

    "মন্টানা ফোক ফেস্টিভ্যাল” - প্রতি বছর জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুক্রবার থেকে রবিবার দুপুর থেকে সন্ধ্যে অবধি এই অনুষ্ঠান চলে হিস্টরিক ‘আপ টাউন’ বিউটের বিভিন্ন বিশিষ্ট জায়গায় খোলা আকাশের নিচে তাঁবু খাটিয়ে। আর কেন্দ্রবিন্দু বা প্রধান মঞ্চ তৈরি হয় দিগন্তপ্রসারী পাহাড়ের মাঝে "দা অরিজিনাল মাইন ইয়ার্ড" এর বিউটের প্রতীকী হেডফ্রেমের নিচে। একটু দূরেই দেখা যায় বিউটের ঐতিহাসিক পুরোনো স্থাপত্য। এরকম অপূর্ব প্যানোরামিক দৃশ্যের মাঝে অনুষ্ঠান দেখার জন্যে এই ক'টা দিন বোধহয় সমস্ত বিউটের মানুষ এখানে সারা দিন ধরে ভিড় জমায়। এছাড়াও সারা আমেরিকার বিভিন্ন সংগীতপ্রেমী ও পর্যটনপ্রিয় মানুষকেও এই সময় এখানে দেখা যায়। মেন স্ট্রীট, কপার, গ্র্যানাইট স্ট্রিট ইত্যাদি রাস্তায় প্রায় পাঁচ-ছটা নানা মঞ্চে চলে আমেরিকা ও অন্যান্য দেশের লোকশিল্পীদের নাচ-গানের অনুষ্ঠান। একবারে বিনামূল্যে এইরকম পরিবেশে নানা দেশের প্রথিতযশা শিল্পীদের অনুষ্ঠান দেখার অভিজ্ঞতা আমাদের আর কখনো কোথাও হয়নি।



    প্রায় প্রতি বছরেই দেখেছি একটা অন্তত ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত বা নৃত্য পরিবেশনা থাকবেই। তবে এই শিল্পীরা প্রধানত আমেরিকাবাসী ভারতীয়। আমি অবশ্য বুঝিনি আমাদের "শাস্ত্রীয়" কি হিসেবে ওখানে "লোক" হয়ে যায়? এই বছর দেখলাম সানফ্রান্সিসকো নিবাসী বিখ্যাত কত্থক শিল্পী ফারা ইয়াসমীন শেখ-এর অপূর্ব নৃত্য ও তাঁর সহকারী শিল্পীদের--"রাগিন্দার" (বেহালা), "এথেনা নায়ার" (গান) ও "ইউসুফ কেরাই" (তবলা) অসাধারণ কিছু পরিবেশনা। যদিও বেশিরভাগ সময় দেখেছি আমরাই হয়তো একমাত্র ভারতীয় বা এমনকি "নন হোয়াইট", কিন্তু আশ্চর্য হয়েছি দেখে যে কি অপিরিসীম উৎসাহে এই অনুষ্ঠানগুলিও ওখানকার মানুষ ভিড় করে দেখছেন ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রশংসা করছেন।

    ছোট বড় নানারকম মানুষ নিজেদের উন্মুক্ত মনের স্ফূর্তিতে অনুষ্ঠান দেখছে, শিল্পীদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান গাইছে বা তাল মিলিয়ে নাচ করছে। অনেকেই দূর থেকে এসেছে নিজেদের বিশাল "রিক্রিয়েশনাল ভেহিকল" নিয়ে - সেখানেই তাদের এই তিন দিনের ঠাঁই, অনেকেই এসেছেন নিজেদের ভাঁজ-করা চেয়ার বা বড় শতরঞ্চি নিয়ে, হুইল চেয়ারে বসে বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, ভিন্নভাবে-সক্ষম মানুষরা - যে যার মতো করে আমোদে কাটায় এই তিন দিন। অনুষ্ঠান মঞ্চের চারপাশের খাবারের স্টল, ইনফরমেশন ডেস্ক, নানারকম হাতের কাজের স্টল - একেবারে জমজমাট ব্যাপার! আমাদেরও এই অনুষ্ঠানের দিনগুলিতে বেশ বাংলার পুজো-পুজো আমেজ আসে।

    সবাই অত্যন্ত আনন্দ সহকারে উদারভাবে দান করেন এই অনুষ্ঠান তহবিলে; অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণেও দান সংগ্রহকারীদের প্রায় ডেকে-ডেকে তাঁদের দানের বালতিতে অনুদান দেওয়া দেখে ভারি ভালো লাগে।



    এরপরেই অগাস্ট মাসে অনুষ্ঠিত হয় "আন রি রা" মন্টানা "আইরিশ ফেস্টিভ্যাল"। আমার কাছে এই উৎসব মনে হয়েছে ছোট আকারের মন্টানা ফোক ফেস্টিভ্যাল। বিউটের অধিবাসীদের জীবনে আইরিশ ঐতিহ্যের যে প্রগাঢ় যোগাযোগ তারই একটি অন্যতম বহিঃপ্রকাশ এই উৎসব।

    এছাড়া আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে তেসরা আর চৌঠা জুলাই পালিত হয় ফ্রিডম ফেস্টিভ্যাল। ওই দুই রাত্তিরে, বিউটের "M" লেখা পাহাড়ের কাছে আতশবাজি আর আলোর রোশনাই একেবারে দেখার মতো। একেবারে আমাদের কালীপুজো বা দীপাবলির দিনের মতো মনে হয়। বিউটের বেশিরভাগ মানুষ সেদিন ভিড় করে এই চত্বরে ও অনেক রাত্তির অবধি সরগরম থাকে এই নির্জন নিরিবিলি জায়গা। আমাদের এপার্টমেন্ট এই পাহাড়ের একেবারে কাছে বলে, আমরা বারান্দায় বসেই দিব্যি উপভোগ করতে পারি এই আলোর রোশনাই।

    মে মাসের মাঝামাঝি থেকে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ অবধি প্রতি শনিবার "আপটাউন বিউটের" পার্ক আর মেন্ স্ট্রিটের মাঝে বসে "ফার্মার’স মার্কেট"। এই বাজারে যেতে আমার বেশ ভালোই লাগে কারণ অনেক ধরনের স্থানীয় শাক-সব্জি পাওয়া যায় যা ওয়ালমার্টে সাধারণত পাওয়া যায় না। তবে আমার কেমন মজা লাগে দেখে - মনে হয় যেন খেলনা বাজার। আমাদের কলকাতার পাড়ার স্থানীয় বাজার এবং তার জনসমাগম এখানকার থেকে অন্তত একশো গুন বেশি!

    বিউটের রেস্তোরাঁ ও প্রতীকী খাবার:

    বেশিরভাগ বাঙালির মতো আমরাও অতি ভোজনরসিক পরিবার। তাই সে ব্যাপারে কিছু কথা বলতেই হয়। এমনিতে আর অন্য আমেরিকান জায়গার মতো ওই ধরাবাঁধা স্যান্ডউইচ আর বার্গারের চল তো আছেই। তবে বিউটের স্বর্ণযুগের সময়ে নানা জায়গার মানুষের সমাগমের ছাপ এখানকার খাওয়াদাওয়াতেও পাওয়া যায়-- চাইনিজ, ইটালিয়ান, মেক্সিকান ও অবশ্যই আইরিশ রেস্তোরাঁ ছড়িয়ে আছে শহরের প্রধান রাস্তার আনাচে-কানাচেতে। এখানকার “পিকিং নুডল পার্লার" আমেরিকার সবচেয়ে পুরোনো চিনে রেস্তোরাগুলোর মধ্যে পড়ে। বিউটের প্রতীকী কিছু বিখ্যাত খাবার হলো আইরিশ/কর্নিশ পাস্টি, হাকলেবেরি জ্যাম, পোভিটিকা (ক্রোশিয়ান ওয়ালনাট ব্রেড)। আমাদের খুব প্রিয় রেস্তোরাঁ কাসাগ্রান্ডা স্টেক হাউস-টিও বেশ অভিনব। এটি ১৯০০ থেকে ১৯৭৫ সাল অবধি একটি গুদাম ঘর হিসেবে চালু ছিল; তারপর বিউটের ব্যবসা বাণিজ্যের অবনতির কারণে এটিও বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এখানেও বিউটের অধিবাসীদের অদম্য মানসিক শক্তি আর উৎসাহের প্রমাণ দেখতে পাওয়া যায় - ১৯৯৩ সালে ওই জায়গায় রেস্তোরাঁ খোলা হয় এবং আজকেও অত্যন্ত সফলভাবে চালু। এর ভিতরের চেহারা সেই পুরোনো গুদামের মতো করেই রাখা আছে - পুরোনো আসবাবপত্র, প্যাকিং বাক্স, ইত্যাদি এদিক ওদিকে ফেলে রাখা আছে, এমনকি পুরোনো নথি, রসিদ দেওয়ালের গায়ে লাগিয়ে রাখা আছে।

    সেই ২০১৫ থেকে এই ২০২২ অবধি বেশ কয়েকবার এসেছি এখানে, ঘুরেছি আমেরিকার নানা শহর, এবং নামী-অনামী বহু পর্যটন স্থান। কিন্তু "নর্দান রকিস" ঘেরা মন্টানার এই ছোট্ট শহর তার অপূর্ব নিসর্গ, ইতিহাস, ইতিকথা আর বর্তমান সময়ের জীবনযাত্রার রূপ নিয়ে আমার মনের মণিকোঠায় এক স্থায়ী ভালোবাসার জায়গা করে নিয়েছে।





    অলংকরণ (Artwork) : লেখক
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments