এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল আমার কলেজ জীবনের এক ঘটনার কথা। পুরুলিয়ার এক গ্রাম্য স্কুল থেকে পাশ করে কলকাতার এক নামী কলেজে ভর্তি হওয়া এক ছাত্রের কথার মধ্যে মাঝে মাঝে, হয়তো বা একটু বেশি পরিমাণেই, জেলাগত বাচনভঙ্গি এসে পড়ত। তাই নিয়ে তার এক সহপাঠী মজা করায় সে ক্রুদ্ধ হয়ে জানায় ‘উটাই ত আসল বাংলা ভাষা বটেক’, আর বেশি বাড়াবাড়ি করলে সে তাকে ‘গাছে টাঙাই দিবে’। তার দাবিও অস্বীকার করা যায় না। ভাষার শিকড় তার মাটিতে। ভাষাতত্ত্ববিদরা বলেন প্রতি পঞ্চাশ মাইলে ভাষার বাচনভঙ্গি বদলে যায়, বদলে যায় শব্দের ব্যবহারও। সুতরাং আঞ্চলিক পরিসরে সেগুলোই আসল ভাষা।
তবু পরিশীলিত ভাষার প্রয়োজন আছে বৃহত্তর পরিসরে তাকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে। আর এই পরিশীলিত ভাষাই ক্রমশ মাধ্যম হয়ে ওঠে মননের প্রকাশের ক্ষেত্রে, সাহিত্য সৃষ্টিতে, একটা গোষ্ঠী বা জাতির সংস্কৃতিগত পরিচয় স্থাপনের ক্ষেত্রে। এরকমই প্রয়োজন পড়েছিল বেদ পরবর্তী সময়ে বৈদিক উপভাষাগুলিকে সুসংবদ্ধ করে সংস্কৃত ভাষা রূপায়ণের। ইংল্যান্ডের মতো ছোটো দেশেও অঞ্চলভেদে বাচনভঙ্গির বিভিন্নতা দেখে বার্নার্ড শ-এর ‘পিগম্যালিঅনের’ প্রফেসর হিগিন্সকে আক্ষেপ করতে হয়েছিল একজন ইংরেজকে কেন ঠিকমতো ইংরেজি বলতে শেখানো হয় না!
ইংরেজি ইংল্যান্ডের সীমানা ছাড়িয়ে এক আন্তর্জাতিক ভাষায় পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন দেশে বা অঞ্চলে স্থানীয় ভাষার বাচনভঙ্গির প্রভাবে ইংরেজির উচ্চারণে ঘটেছে বিরাট পরিমাণে অসমতা। তবু উচ্চারণের মাপকাঠি হিসাবে স্বীকৃত হয়েছে বিবিসি-র ইংরেজি। এমনটাই ঘটেছে বাংলাভাষার ক্ষেত্রে। রাজধানী হওয়ার সুবাদে কলকাতা আর তৎসন্নিহিত অঞ্চলের ভাষাকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে বাংলাভাষার পরিশীলিত রূপ চলিত বাংলাভাষার--লেখা এবং বাচন উভয় ক্ষেত্রেই। পশ্চিমবঙ্গে আর বাংলাদেশে প্রকাশিত উচ্চারণ অভিধানগুলোতে এই নীতিই অনুসৃত হয়েছে। তাই পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের সাহিত্যের ভাষা এক, কলকাতা আর ঢাকা রেডিওর সম্প্রচারের ভাষাও এক। তবে কথিকা বা সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের ব্যক্তিগত অভ্যাস বা অনবধানতার ফলে দুয়েকটা শব্দের উচ্চারণে বিচ্যুতি ঘটতেই পারে, যেমনটা ঘটেছে ‘ক্যাবলের’ বেলায়।
এই ধরনের বিচ্যুতি বৃহত্তর ক্ষেত্রে অনভিপ্রেত, কিন্তু আদ্যক্ষর এ এবং এ-কারান্ত বহু শব্দের উচ্চারণে নিয়তই তা ঘটে চলেছে। ‘এক’ আমরা উচ্চারণ করি অ্যাক, ‘একা’ এবং ‘একেলা’ বা ‘একলা’র বেলায় তাই। ‘এককে’ অ্যা আসে না, কিন্তু ‘একাকী’ বা ‘একান্ত’র উচ্চারণে সমতা পরিলক্ষিত হয় না -- এ কারো উচ্চ্চারণে এ, কারো উচ্চ্চারণে অ্যা। দ্বিতীয়টাই অভিধান সমর্থিত, তবু ‘তোমার চরণপানে নয়ন করি নত/ ভুবন দাঁড়িয়ে আছে একান্ত’ কিংবা ‘জাগিবে একাকী তব করুণ গাইতে শোনা যায়। ‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান, তুমি কি এমনি শক্তিমান’ গাইতে গেলে দুটি এ-র উচ্চারণের ভিন্নতা মনে রাখতেই হবে। একুশ একত্রিশের এ আর একচল্লিশ একান্নর এ সমভাবে উচ্চারিত হয় না বা হওয়া উচিত নয়। ‘খেলা দেখা’ অবশ্যই ‘খ্যালা দ্যাখা’, কিন্তু ‘খেলতে যাওয়া’ ‘খ্যালতে যাওয়া’ নয়। তেমনই ফেলা-ফেলতে, হেলা-হেলতে, মেলা-মেলতে, বেলা-বেলতে। এইসব উচ্চারণে সাধারণত বিভ্রান্তি ঘটে না। ‘বেলা গেল’ কিংবা ‘বেলা দেবী’ ‘বেলফুল’ আমরা যথাযথ উচ্চারণ করি। বিভ্রান্তি ঘটে যখন গাইতে যাই ‘আমার মন চেয়ে রয় মনে মনে / হেরে মাধুরী’। ‘হেরে’ কি ‘হেরিয়া’ অর্থে এ-কারান্ত উচ্চারিত হবে, না ‘দেখতে থাকে’ অর্থে অ্যা-কারান্ত হবে? গীতবিতান দেখলেই সন্দেহের নিরসন হবে -- ওটা অ্যা হবে না-- কেন-না অ্যা উচ্চারণের জন্য গীতবিতানে সামনে মাত্রা-দেওয়া এ-কার নির্দিষ্ট আছে। কিন্তু এই সূক্ষ্ম চিহ্ন অনেকেরই নজর এড়িয়ে যায়, আর অন্যত্র ব্যবহৃত না হওয়ার কারণে এবিষয়ে কারোর ট্রেনিং থাকে না। অথচ বাংলায় আদিতে এ-কারান্ত অ্যা উচ্চারিত শব্দ প্রচুর, তাই এর জন্য বিশেষ চিহ্নের প্রয়োজনের কথা মাঝেমাঝেই আলোচিত হয়েছে। পলাশ বরন পাল প্রস্তাবিত পেট-কাটা এ-কার সমাদর পায় নি । তাই এ-র উচ্চারণে ধন্দ চলতেই থাকবে মনে হয়।
আদ্যক্ষর অ-কারান্ত শব্দের উচ্চারণেও সমস্যা রয়েছে। মন, বন, কল্যাণ, কণিকা, খনিক/ ক্ষণিক, গরু, তরু, মরু, নরুন, শকুন, গতি, পতি, ফণী, স্থলী, পরি, পড়ি, গড়ি, গরীব, সময়, সমীর, প্রবীর, প্রতিমা, যদি, যতি, যতীন্দ্র, রবি, রবীন্দ্র, কলু, সরু, বটু ইত্যাদি অজস্র শব্দের আদ্যবর্ণ ও-কারান্ত রূপে উচ্চারিত হয় । অথচ গত, ফণা, কণা, স্থল, কল, সর, বট শব্দগুলিতে আদ্যবর্ণের উচ্চারণ অ-কারান্ত। এই প্রবণতার কারণ অনুসন্ধান করে রবীন্দ্রনাথ কিছু নিয়ম আবিষ্কার করেছিলেন। সেগুলোর মধ্যে কয়েকটি হলঃ
“দ্ব্যক্ষর-বিশিষ্ট শব্দে দন্ত্য ন অথবা মূর্ধন্য ণ পরে থাকিলে পূর্ববর্তী অ-কার ‘ও’ হইয়া যায়, যথা, বন ধন জন মন মণ পণ ক্ষণ ।
বাংলায় প্রধানত ই এবং উ এই দুই স্বরবর্ণের প্রভাবেই অন্য স্বরবর্ণের উচ্চারণ-বিকার ঘটিয়া থাকে।
গত এবং গতি এই দুই শব্দের উচ্চারণভেদ বিচার করিলে দেখা যাইবে, গত শব্দের গ-এ কোনো পরিবর্তন ঘটে নাই, কিন্তু ই-কার পরে থাকাতে গতি শব্দের গ-এ ও-কার সংযোগ হইয়াছে। কণা এবং কণিকা, ফণা এবং ফণী, স্থল এবং স্থলী তুলনা করিয়া দেখো।
উ-কার পরে থাকিলেও প্রথম অক্ষরবর্তী স্বরবর্ণের এইরূপ বিকার ঘটে। কল এবং কলু, সর এবং সরু, বট এবং বটু তুলনা করিয়া দেখিলেই আমার কথার প্রমাণ হইবে।
নিম্নলিখিত শব্দগুলি নিয়ম মানে না, অর্থাৎ ই উ য-ফলা ঋ-ফলা ইত্যাদি পরে না থাকা সত্ত্বেও ইহাদের আদ্যক্ষরবর্তী অ ‘ও’ হইয়া যায়; মন্দ মন্ত্র মন্ত্রণা নখ মঙ্গল ব্রহ্ম।”
রবীন্দ্রনাথের তালিকা সর্বতোভাবে ত্রুটিমুক্ত নয়। জন ধন পণ ক্ষণ শব্দগুলিতে আদ্যবর্ণ সাধারণত অ-কারান্ত উচ্চারিত হয়ে থাকে, ও-কারান্ত নয়। উদাহরণ হিসাবে আরও যোগ করা যায় গণ ঘন চন্দন ছন্দ ঝনঝন টনক ঢনঢন তন্দ্রা রণ রণন সন সনৎ সন্ত সন্তান। অন্যদিকে আঞ্চলিকতার প্রভাবে কারো কারো উচ্চারণে মন, বন, কল্যাণ, কণিকা মন্দ মন্ত্র ইত্যাদি শব্দগুলিতে আদ্যবর্ণ অকারান্তই থাকে। তবে তা প্রমিত উচ্চারণ হিসাবে মান্যতার দাবি করতে পারে না। উপরের শব্দগুলো থেকে উদ্ভূত মনন, বনানী — এগুলোর বেলায় কিন্তু আদ্যবর্ণ ও-তে রূপান্তরিত হয় না। শব্দের মধ্যবর্ণে অ-এর উচ্চারণ নিয়ে একই সমস্যা— সাধনকে সাধোন, বাঁধনকে বাঁধোন, সমস্যাকে সমোস্যা, আনন্দকে আনোন্দ, মদনকে মদোন উচ্চারণ করেন অনেকে, আবার অনেকে ‘ও’ ছাড়া।। সুতরাং দেখা যাচ্ছে কোন নির্দিষ্ট নিয়মে এই উচ্চারণগুলোকে বাঁধা যাচ্ছে না। ভাষা ব্যাকরণকে অনুসরণ করে না, পরিবর্তনশীল ভাষার সঙ্গে ব্যাকরণের নিয়মকেও বদলে নিতে হয়। তাই অ-এর উচ্চারণের এই ভিন্নতাকে মেনে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। তবে যদি কেউ ‘প্রাণ চায় চক্ষু না চায়’ গাইতে গিয়ে ‘তবে কার লাগি মিথ্যা এ সজ্জা’ আর ‘তব শয্যা যে কন্টকশয্যা’য় সজ্জা আর শয্যার উচ্চারণে পার্থক্য না করে সেটা মেনে নেওয়া যায় না।
বাংলা শব্দে অন্ত্যবর্ণের উচ্চারণ স্বাভাবিকভাবেই হসন্ত। জল, দেব, গীত, বিজন, পারিজাত উচ্চারণে কোন সমস্যা হয় না। সমস্যা হয় সমাসবদ্ধ পদে। জলবায়ু, দেবরাজ, বিজনভূমি, পারিজাতগন্ধ—এদের পূর্বপদে হসন্ত উচ্চারণ ব্যাকরণসম্মত না হলেও প্রায়শই তার ব্যত্যয় ঘটে, এবং সেটাই প্রায় সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার পরিচিত এক শিল্পী রেডিওতে তাঁর নাম ‘দেব্ রাণী’র হসন্তবিহীন ঘোষণায় আপত্তি জানিয়েছিলেন, কেননা পশ্চিমে বড়ো হয়ে ওঠার সুবাদে তাঁর মনে হয়েছিল তাতে তাঁর নামের অর্থ দাঁড়াবে ‘দেবরের স্ত্রী’। গীতগোবিন্দ গীতবিতানের ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যাকরণসম্মত উচ্চারণই প্রচলিত।
বাংলা উচ্চারণে আর এক সমস্যা শব্দের অন্তে ই নিয়ে। কখনই তখনই এখনই মনই – এদের উচ্চারণ কী হবে? ‘এ কথা আমি কখনই বলি নি’-- এ ক্ষেত্রে উচ্চারণ করি ‘নই’, ‘নি’ বলি না, অন্যগুলির ক্ষেত্রে কিন্তু ‘নি’। ‘দিয়ে গেনু বসন্তের এই গানখানি’ এই রবীন্দ্রসঙ্গীতের শেষ লাইনে ‘নব পথিকেরই গানে নূতনের বাণী’তে ‘রই’ উচ্চারণ করি না, বলি ‘রি’। সেটাই বাংলা উচ্চারণের স্বাভাবিক চাল। অথচ বহু বছর আগে রবীন্দ্রস্নেহধন্যা এক নামী শিল্পী ‘কত যে তুমি মনোহর মনই তাহা জানে’ গেয়েছেন ‘মনোই’ উচ্চারণে। তারই (তারোই নয়, তারি) অনুসরণ এখনও প্রায় সকলেই করে চলেছেন। তাই দেখে পরিমল গোস্বামী লিখেছিলেন ‘কেন ওরকম বিকৃত উচ্চারণ করা তা “ভগবানোই” জানেন’। জীবনানন্দের ভাষাতে বলতে হয়ঃ ‘একবার নির্দেশের ভুল হয়ে গেলে/ আবার বিশুদ্ধ হতে কতদিন লাগে!’
আর এক সমস্যা চন্দ্রবিন্দু নিয়ে। ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে’ কারো উচ্চারণে হয়ে দাঁড়ায় ‘চাদের হাসির বাধ ভেঙেছে’ আবার কারো উচ্চারণে ‘চাঁদের হাঁসির বাঁধ ভেঙেছে’। বলা বাহুল্য, আগেরটা পূর্ববঙ্গীয় প্রভাবে, পরেরটা পশ্চিমবঙ্গীয় প্রভাবে। গুঁড়ো ঘাঁটি চাঁদ ছোঁড়া (ঢিল ছোঁড়া) দাঁড়ানো ধোঁকা পাঁচ পঁচিশ পঁচাশি পেঁয়াজ পুঁথি বঁটি বাঁটা বাঁধ বঁড়শি সাঁজা (দই পাতার দম্বল) হাঁড়ি ইত্যাদি শব্দের উচ্চারণে চন্দ্রবিন্দুর লোপ হামেশাই পরিলক্ষিত হয়। আবার অন্যদিকে কাচ হাসপাতাল হাসি অনেকের উচ্চারণে আনুনাসিক হয়ে পড়ে। চন্দ্রবিন্দু নিঃশব্দে ঢুকে পড়েছে কিছু তৎসম শব্দে যুক্তবর্ণের উচ্চারণে। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
বাংলায় তৎসম শব্দের উচ্চারণে বহুক্ষেত্রেই ব্যত্যয় ঘটেছে। ‘কৃষ্ণ’ আমরা উচ্চারণ করি ‘ক্রিষ্ন’, কিন্তু ওড়িয়া বা মারাঠিতে এর উচ্চারণ ‘ক্রুষ্ড়’। ণ-এর উচ্চারণ অনেকটা ‘ড়’-এ চন্দ্রবিন্দুর মতো, এবং সংস্কৃত উচ্চারণের নিরিখে সেটাই ঠিক। তবু আমরা বেঠিক নয়, আমরা এই উচ্চারণের ঐতিহ্যবাহী মাত্র। তেমনই অসঙ্গতি রয়েছে য-ফলা আর ব-ফলা যুক্ত শব্দের উচ্চারণে। ‘উদ্যান’ এবং ‘বিদ্বান’ আমরা একই ভাবে উচ্চারণ করি ‘উদ্দান’ আর ‘বিদ্দান’, সংস্কৃত উচ্চারণ অনুসারে যা হওয়া উচিত ছিল ‘উদিয়ান’ আর ‘বিদ্ওয়ান’। উত্তরভারতীয় দিব্যা নামধারী জনৈকাকে ‘দিব্বা’ বলে ডাকতে সে হেসে বলেছিল সেটা কেমন ‘ডিব্বা ডিব্বা’ শোনাচ্ছে। এটা হবেই, কেননা বাংলায় য-ফলা ’ইয়’ উচ্চারিত হয় না। শব্দের অন্তস্থিত বর্ণে য-ফলা থাকলে সেই বর্ণ দ্বিত্বভাবে উচ্চারিত হয়। আর বাংলায় অন্তঃস্থ্ ব থাকলেও বর্ণপরিচয়ের সময় শিক্ষার্থীরা সেটাকে বর্গীয় ব-এর উচ্চারণেই পড়ে, ‘ওয়’ উচ্চারণে নয়। স্বরাজ স্বরূপ স্বামী স্বাধীন স্বীকার এইসব শব্দে আদ্যবর্ণে যুক্ত ব-ফলা উচ্চারিতই হয় না – উচ্চারিত হয় সরাজ সরূপ (এর নিজস্ব অর্থ রূপবিশিষ্ট) সামি, সাধিন সিকার। মধ্যবর্ণ অথবা অন্তবর্ণের ব-ফলা সেই বর্ণের দ্বিত্ব ঘটায় –যেমন, বিদ্বান বিশ্ব স্বত্ব মহত্ব দ্বিত্ব, যেগুলো আমরা উচ্চারণ করি বিদ্দান বিশ্শ স্বত্ত মহত্ত দিত্ত। আমরা আমাদের মতোই উচ্চারণ করব, কিন্তু বানান যথাযথ লিখতে হবে। অম্বর বিম্ব ডিম্বের ব অন্তঃস্ত নয়, বর্গীয়, তাই এইসব শব্দে ব-এর উচ্চারণ বজায় থাকে। কিন্তু জানা না থাকলে লেখ্য রূপ দেখে কী করে ঠিক করা যাবে কোন্ উচ্চারণ হবে? উদ্বেগ উদ্বেল উদ্বাহু উদ্বাস্তু ইত্যাদি শব্দ উদ্বেগ উদ্বেল উদ্বাহু উদ্বাস্তু বানান লিখলে এই সমস্যা এড়ানো যায়, এবং সাম্প্রতিক লেখায় এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু বিশ্ব অন্বেষণ বিদ্বান এইসব শব্দে অনুরূপ প্রয়াস খাটবে না। নীচের ব-কে একটু পাশে সরিয়ে লেখার প্রস্তাব করেছেন পলাশ বরন পাল। ছাপায় সেটা করা সম্ভব হলেও হাতের লেখায় দুরূহ।
কিছু যুক্তাক্ষর যেমন লেখা হয় তেমন উচ্চারিত হয় না। ব্রহ্মা ব্রাহ্মণের হ+ম হয়ে যায় ম+ভ --ব্রম্ভা ব্রাম্ভণ, বাহ্য সহ্যের হ+ইয় হয়ে যায় ‘জ্ঝো’—বাজ্ঝো সজ্ঝো, জিহ্বা বিহ্বলতার হ+ব হয়ে যায় উ+হ – জিউহা বিউহলতা, আহ্বানের হ+ব হয় ও+হ – আওহান (আওভান ভুল উচ্চারণ)। সব তৎসম শব্দই যে তাদের আদি উচ্চারণ বজায় রাখে নি এগুলো হল তার উজ্জ্বল উদাহরণ। জন্মাবধি শ্রবণ এবং প্রাথমিক শিক্ষার সুবাদে এদের উচ্চারণে আমরা ভুল করি না, কিন্তু অসুবিধা হয় বিদেশী শিক্ষার্থীর। সে অসুবিধা অনুশীলনেই কাটিয়ে উঠতে হবে। সব ভাষাতেই লেখ্য আর উচ্চারিতের মধ্যে এই অসঙ্গতি রয়েছে। ফরাসি Colonel Lieutenant উচ্চারিত হয় কর্নেল লেফটেন্যান্ট এবং অনেক ফরাসি শব্দে বেশ কিছু বর্ণ অনুচ্চারিত থেকে যায়, ইংরেজিতে bring ব্রিং হলেও binge বিন্জ্ psalm সাম, put আর but-য়ের u-এর উচ্চারণ ভিন্ন, স্প্যানিশে San Jose হয়ে যায় সান হোজে, রুশে ego হয়ে যায় ইভো। জার্মানের মতো ফোনেটিক বা উচ্চারণ-অনুসারী ভাষাতেও তার উদাহরণ আছে। তাই বাংলায় পরিশীলিত উচ্চারণ অনুসারে বানান পরিবর্তনের দাবি কোন কোন মহল থেকে উঠলেও তার সারবত্তা এবং গ্রহণ যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নই থেকে যায়। শব্দের যেমন ধ্বনিরূপ আছে তেমনই আছে দৃশ্যরূপ। এই দৃশ্যরূপের সহসা পরিবর্তন জনমনে গৃহীত হয় না। তাই দ্যাখা খ্যালা ব্রম্ভা ব্রাম্ভন সজ্ঝো আওহান লিখলে চোখে বিসদৃশ ঠেকবে আর অবশ্যই ব্যুৎপত্তিগতভাবে সঠিক হবে না। জগন্নাথ চক্রবর্তী দ্যাখা খ্যালা লিখেছেন, কিন্তু সেটা মান্যতা পায় নি।
তৎসম শব্দে যুক্তবর্ণ ত্ম (ত+ম) আর স্ম (স+ম)-এর বাংলা উচ্চারণে কয়েকটি ক্ষেত্রে ম লোপ পেয়ে তার জায়গায় হয় প্রথম বর্ণটির দ্বিত্ব আর শেষে এসে বসে চন্দ্রবিন্দু। তাই আত্মা হয়ে যায় আত্তাঁ, মহাত্মা হয়ে যায় মহাত্তাঁ আবার কয়েকটি ক্ষেত্রে প্রথম বর্ণের এই দ্বিত্ব ঘটে না, যেমন বর্ত্ম উচ্চারিত হয় বর্তঁ। সর্বভারতীয় প্রভাবে আমরা ‘মহাত্মা’ বলি বটে, কিন্তু খাঁচা ছাড়ার উপক্রম হলে ‘আত্তাঁ রাম’ই স্মরণে আসে। স্ম সম্বন্ধে একই কথা। ভস্মের উচ্চারণ করি ভস্সোঁ, ভীষ্মকে ভীস্সঁ, স্মরণকে সঁরণ, বিস্ময়কে বিস্সঁয়, বিস্মিতকে বিস্সিঁত স্মিতহাস্যকে সিঁতহাস্য রশ্মিকে রশ্শিঁ। তবে ব্যতিক্রম আছে-- স্মিতা অস্মিতা শুভস্মিতার ক্ষেত্রে দুটি বর্ণই তাদের উচ্চারণ বজায় রাখে।
ক্ষ – যাকে ‘খিয়’ বলা হয় – সেটা ক আর ষ-এর যুক্তবর্ণ। এর উচ্চারণ হওয়া উচিত ক+ষ। সংস্কৃতে সেটাই হয়, হিন্দিতেও তাই। সেখানে লক্ষের উচ্চারণ লক্ষ্, অপেক্ষার উচ্চারণ অপেক্ষা, বৃক্ষের উচ্চারণ বৃক্ষ্। বাংলায় ক্ষ-এর উচ্চারণ খ-এর দ্বিত্ব খ+খ। ‘লক্ষ লক্ষ যক্ষ রক্ষ অট্ট অট্ট হাসিছে’ আমাদের উচ্চারণে ‘লখ্খ লখ্খ যখ্খ রখ্খ’। কোন অসুবিধা নেই, সেটাই আমাদের ঐতিহ্য। কিন্তু কিছু অসুবিধা ঘটে ক্ষ্ম-এর বেলায়। বর্ণটি ক+ষ+ম। তাই লক্ষ্মীর উচ্চারণ হওয়া উচিত লক্ষ্মী—আমরা বলি লখ্খি। বলায় ভুল নেই, কিন্তু সেই উচ্চারণকে মাথায় রেখে লেখার সময় লক্ষ্মী ‘লক্ষী’ হয়ে যান। লক্ষ্মণ হয়ে যান ‘লক্ষণ’। তেমনই ঘটে ‘আকাঙ্ক্ষা’র বেলায়। যুক্তবর্ণটি ঙ+ক+ষ। তাই শব্দটির উচ্চারণ হওয়া উচিত আকাংক্ষা, কিন্তু আমরা বলি আকাংখা। আর সেই উচ্চারণ অনুসারে লেখার সময় বানানে ভুল হয়ে যায় - ’ঙ্ক্ষা’র বদলে ঙ+ খা। হিন্দি উচ্চারণ ‘লক্স্মী’ ‘লছমন’ ‘আকাংক্ষা’ অনেকটা বানান-অনুসারী। এক্ষেত্রেও আমরা আমাদের মতোই উচ্চারণ করব, কিন্তু লেখার সময় সতর্ক থাকতে হবে।
বাংলাভাষায় তিনটে স --শ ষ স – তাদের উচ্চারণের স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ফেলেছে, প্রায় সর্বত্রই তাদের উচ্চারণ ‘শ’। ‘স্যামবাজারের সসিবাবু’ জাতীয় উচ্চারণ মাঝে মাঝে শোনা গেলেও সেটা আঞ্চলিক অথবা ব্যক্তিগত বিচ্যুতি।
Z-এর যথাযথ উচ্চারণ বাংলায় নেই। তাই পরশুরামকে লিখতে হয়েছিল ‘হয়, zানতি পার না’। জ-এর উচ্চারণে এই আঞ্চলিক বিকৃতির কথা বাদ দিলেও বাংলায় চালু আরবি ফারসি বহু শব্দের z বাংলায় সাদাসাপটা জ দিয়ে উচ্চারিত হয়। যেমন, জনাব জুলফি জুলুম আজান আজিজ(ব্যক্তিনাম) বাজার মাজার নজর নাজির নজরুল নিজাম। অথচ হিন্দিতে উর্দু সান্নিধ্যের কারণে এটা ঘটে না। তেমনই ইংরেজি থেকে আত্তীকৃত zoo ozone size zero zebra zone ইত্যাদি শব্দে z-এর উচ্চারণ জ দিয়েই সম্পন্ন হয়। এতে আপত্তি থাকার কথা নয়। কোন ভাষাতেই বিদেশি শব্দ যথাযথ উচ্চারিত হয় না। সাহেবরা আমাদের বর্ধমানকে Burdwan, তিরুঅনন্তপুরমকে Trivandrum, ঠাকুরকে Tagore বানিয়েছেন। পরশুরামের ‘উলট পুরাণে’ মেমসাহেবের বাচ্চা বাঙালি গভর্নেসের কাছে বাংলা শিখতে গিয়ে এক দুই তিন শাড় বলার পর পাঁচকে পাইচ পাঁইশ শেষমেশ ফ্যাঁচ উচ্চারণ করে রণে ভঙ্গ দিয়েছিল। অতদূরে যাবার দরকার নেই – রবীন্দ্রনাথের যোগিনদার হিন্দি শুনে উত্তর ভারতের কোন এক দেশীয় রাজার মুলুকে কেউ হিন্দি বলে সন্দেহই করে নি। সম্প্রতি আনন্দবাজার জ-এর নিচে ফুটকি দিয়ে z-এর উচ্চারণ বোঝাচ্ছে। উৎসাহের আতিশয্যে অনেক s-বিশিষ্ট ইংরেজি শব্দেও (যেমন, positive plasma) এটা ব্যবহার করছে। আমাদের বক্তব্য, আমরা জু ওজোন সাইজ জিরো জেব্রা জোন পজিটিভ প্লাজমা উচ্চারণ করলে কি আকাশ ভেঙে পড়বে? কিংবা বাংলায় প্রচলিত তাবৎ আরবি আর ফারসি শব্দের উচ্চারণে? সাধারণ মানুষের উচ্চারণে যেটা ব্যাপকভাবে নির্দিষ্ট হয়ে গেছে নিয়মের শাসনে তার পরিবর্তন ঘটানো কি সম্ভব অথবা প্রয়োজনীয়? অন্তঃস্থ্ ব বা যফলার ক্ষেত্রে যা ঘটেছে এক্ষেত্রেও সেটা মেনে নিতে হবে। এবং সেটাই হবে পরিশীলিত বাংলা উচ্চারণ।
তথ্যপঞ্জি:
১) পলাশ বরন পাল --‘বাংলা কথা বনাম বাংলা লেখা’, আ মরি বাংলা ভাষা, অনুষ্টুপ, ২০১১
২) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর --‘বাংলা উচ্চারণ’, রবীন্দ্র রচনাবলী ১০ম খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ১৯৮৯
৩) পরিমল গোস্বামী --‘শব্দের ব্যবহার ও উচ্চারণ’, বেতার জগৎ সেরা প্রবন্ধ সংকলন, মিত্র ও ঘোষ, ২০০০
৪) জগন্নাথ চক্রবর্তী -- জগন্নাথ চক্রবর্তীর শ্রেষ্ঠ কবিতা, বুক সিন্ডিকেট, ১৩৯১
৫) পরশুরাম রচনাবলী –১ম ও ২য় খণ্ড, মিত্র ও ঘোষ, ১৩৮৫