• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯১ | জুলাই ২০২৩ | প্রবন্ধ
    Share
  • বন্যতার বশীকরণ : ফ্রেদেরিক গ্রো
    translated from French to Bengali by শুভময় রায়



    দার্শনিক এমানুয়েল কান্ট নাকি চিন্তার বাধ্যবাধকতাকে এড়াতে নিজের শহরে প্রতিদিন একই সময়ে হাঁটতে বেরোতেন। রুশো আবার চিন্তা করার জন্যই করতেন পদচারণা। ফরাসি কবি জ়েরার দ্য নের্ভাল পায়ে পথ চলতেন বিষণ্ণতা তাড়াতে আর ক্ষিপ্ত আর্তুর র‌্যাঁবো দ্রুত হেঁটে চলতেন। নিট্‌শের পরামর্শ ছিল: মুক্ত বাতাস আর অবারিত গতির মধ্যে জন্ম নেয়নি এমন কোনও ধ্যানধারণাকে কখনই বিশ্বাস করবেন না।

    এসবই পাওয়া গেল ফ্রান্সের বেস্টসেলার বই মিশেল ফুকো বিশারদ ফরাসি দার্শনিক অধ্যাপক ফ্রেদেরিক গ্রো (Frédéric Gros) রচিত মার্শে, উন ফিলোসোফি (A Philosophy of Walking)-তে। দর্শনের সাহায্যে লেখক এ বইতে প্রমাণ করতে সচেষ্ট যে পায়ে হাঁটলে জীবনে শান্তি আসতে পারে। বইয়ের একটি অধ্যায় মার্কিন অতীন্দ্রিয়বাদী পথপ্রদর্শক হেনরি ডেভিড থরো'র (Henry David Thoreau) জন্য নিবেদিত। আধুনিক সভ্যতার যে কোনও মানের নিরিখে তাঁর জীবন বিষণ্ণ, অসফল এক জীবন বলে গণ্য হতে পারে। কিন্তু মানুষ হিসেবে থরো ভিন্নতর কোনও ড্রামবাদকের ছন্দে পা মিলিয়েছিলেন। গ্রো-র বইয়ের ওই অধ্যায়টির ফরাসি থেকে বাংলা অনুবাদ এখানে দেওয়া হল—অনুবাদক

    বস্টনের কাছে কংকর্ড ম্যাসাচুসেটস্‌-এর ছোট্ট শহরে ১৮১৭-র জুলাইয়ে ডেভিড হেনরি থরো’র জন্ম। পেন্সিলের কারখানার মালিকের তৃতীয় সন্তান। হার্ভার্ডে ভালো ফল করে স্নাতক হয়ে হাই স্কুলে পড়ানোর চাকরি নিলেও সেই কাজে লেগে ছিলেন মাত্র দুসপ্তাহ। শিক্ষার্থীদের শারীরিক প্রহারের ব্যাপারে তাঁর আপত্তি ছিল। তা ছাড়া চাইতেন দীর্ঘ হাঁটাচলার মাঝের বিরতিতে ছাত্রছাত্রীদের পড়াতে। অগত্যা পারিবারিক পেন্সিলের কারখানায় ফিরে এলেন। আঠারো শো সাঁইত্রিশে বাবার দেওয়া নাম বদলে হেনরি ডেভিড থরো নামে পরিচিত হন। দিনলিপি লিখতে শুরু করেন। সে অভ্যেস আমৃত্যু বজায় ছিল।

    থরো তাঁর ভাইয়ের সহযোগিতায় ১৮৩৮-এ একটি প্রাইভেট স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেও তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। এরপরে এমারসনের বাড়িতে রাতদিনের লোক (factotum) হিসেবে কাজ করতে করতে দ্য ডায়াল পত্রিকায় কবিতা এবং প্রবন্ধ ছাপান, শহরের অতীন্দ্রিয়বাদীদের (transcendentalist) ক্লাবে ঘন ঘন যাতায়াত শুরু করেন এবং তাদের প্রকাশিত ‘রিভিউ’টির সম্পাদনা করতে থাকেন। বছর খানেক কংকর্ড ছেড়ে নিউ ইয়র্কের স্ট্যাটেন আইল্যান্ডে এমারসনের ভাইপোদের গৃহশিক্ষকতা করেন। মার্চ, ১৮৪৫-এ থরো ওয়াল্ডেন হ্রদের কাছে এমারসনের কেনা জমির ওপর নিজের হাতে কেবিন নির্মাণ শুরু করেন। সেটি হয়ে উঠল তাঁর প্রথম দার্শনিক পদক্ষেপ। সেই হ্রদের ধারে গাছপালায় পরিবৃত হয়ে দুবছরের কিছু বেশি সময় থরো সম্পূর্ণ স্বয়ম্ভর জীবন যাপন করেন। কাজ ছিল জমি চষা, ঘুরে বেড়ানো, লেখাপড়া। আঠারো শো ছেচল্লিশের জুলাইয়ে থরোকে সেই কাঠের কেবিন থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। জেলবন্দি হওয়ার কারণ, তিনি মেক্সিকোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং ক্রীতদাস প্রথা উচ্ছেদে ব্যর্থ হওয়ায় মার্কিন সরকারকে কর দিতে অস্বীকার করেছিলেন। এই অভিজ্ঞতার পরিণামে লেখা হবে আইন অমান্য আন্দোলন সম্পর্কিত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নথি সিভিল ডিসওবিডিয়েন্স। অজানা কোনও হিতকারী জেল থেকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করায় তাঁকে অবশ্য জেলে এক রাতের বেশি কাটাতে হয়নি। জুলাই, ১৮৪৭-এ থরো ওয়াল্ডেন ছেড়ে এক বছরের জন্য এমারসনের গৃহে বাস করেন। এর পরে পারিবারিক বাড়িতে তাঁর প্রত্যাবর্তন ঘটে এবং তিনি জমি জরিপের কাজে নিযুক্ত হন।

    এই সময় থরো কেবেক (Québec), নিউ হ্যাম্পশায়ার আর হোয়াইট মাউণ্টেনস্‌-এ একাধিকবার ভ্রমণ করেন এবং আমেরিকার আদিম ইন্ডিয়ান উপজাতিদের সংস্পর্শে আসেন। দাসপ্রথার বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই জারি ছিল। চুয়াল্লিশ বছর বয়সে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে থরোর মৃত্যু হলেও ইতিমধ্যেই তিনি লিখে ফেলেছেন অরণ্যবাসের অসাধারণ অভিজ্ঞতা সম্বলিত মনোমুগ্ধকর ওয়াল্ডেন সহ অসংখ্য রচনা। হেঁটে বেড়ানোর ওপর প্রথম দার্শনিক নথি ওয়াকিং-এর রচয়িতা তিনিই।

    ঊনবিংশ শতাব্দের প্রথম ভাগে থরোর জীবনকালেই ব্যাপক মাত্রায় পণ্যের যান্ত্রিক উৎপাদন, ধনতান্ত্রিক যুগের আরম্ভ এবং শিল্পক্ষেত্রে শোষণমূলক ব্যবস্থার সূচনা হয়। থরো তাঁর দূরদৃষ্টি দিয়ে বুঝতে ভুল করেননি যে অন্তহীন লাভের জন্য একরোখা কাড়াকাড়ি আর প্রাকৃতিক সম্পদকে সেই লাভের উৎস হিসেবে দেখা এবার শুরু হয়ে গেল। অসীম ধনসম্পত্তির এই তীব্র অভিলাষ, জাগতিক সুখস্বাচ্ছন্দ্যের পণ্যের পেছনে ছোটা অন্ধ ধনতান্ত্রিকতার সম্মুখীন হয়ে থরো প্রস্তাব দিলেন এক নব্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থার (new economics)।

    নীতিটি ছিল সহজ। কোনও কাজ করে কী পাওয়া যাবে তার বদলে ভাবা যাক খাঁটি মানব জীবনের নিরিখে সেই কাজের জন্য কতটা মূল্য দিতে হবে। ‘আমি যাকে আসল জীবন বলি তার কতটা অংশের বিনিময়ে জিনিসটা পাওয়া যাবে তাই হল আমার কাছে কোনও জিনিসের মূল্য।’ লাভ আর উপকারের মধ্যে পার্থক্য করার একটি উপায়ও হল এই। বনের মধ্যে দিয়ে অনেক পথ হেঁটে গেলে আমার কী লাভ হয়? কোনও লাভই হয় না। এমন কিছু তাতে তৈরি হল না যা বিক্রি করা যায়। এমন কোনও সমাজসেবাও হল না যা পুরস্কৃত হতে পারে। সেদিক থেকে দেখলে ওই পদব্রজে ভ্রমণ হল নিষ্ফল, অনুৎপাদক একটি কাজ। চিরাচরিত অর্থনীতির নিরিখে সময়ের অপব্যয় – আমি সময়কে অযথা বয়ে যেতে দিলাম। সময় নষ্ট করলাম। ওই সময়ে আমি কোনও সম্পদ সৃষ্টি করতে পারলাম না। অথচ আমার জন্য, আমার নিজের জীবনের জন্য – আমি এমনকী আমার হৃদয়ের অন্তঃপুরের কথাও তুলছি না – কিন্তু সামগ্রিকভাবে ওই ভ্রমণের হিতকারী প্রভাব তো সীমাহীন। একটা সুদীর্ঘ মুহূর্ত যখন আমি আমার ভেতরের দিকে তাকাতে পারলাম – আমাকে অস্থির, বধির করে দেবে এমন কোনও ঝামেলার সম্মুখীন আমায় হতে হল না। অনর্গল বাজে বকেন এমন কারও অন্তহীন কিচিরমিচির শুনতে হল না। আমি সারা দিন ধরে আমার অভ্যন্তরীণ সম্পদের ভাণ্ডার বাড়িয়ে চলি: একটা দীর্ঘ সময় যখন আমি শুনছি অথবা ভাবছি: যখন প্রকৃতি আমাকে তার সব রঙে রঙিন করে তুলছে – কোনও হিসেব না রেখেই। শুধু আমার জন্যই। হেঁটে বেড়ানোর সময় আমার গ্রহণক্ষমতা বাড়ছে – আমার চারপাশে থাকছে প্রকৃতির খাঁটি উপস্থিতি। স্পষ্টতই এই সব অভিজ্ঞতাকেই ওই লাভের হিসেবের মধ্যে ধরতে হবে। শেষমেশ, যেহেতু আমার সেই ভ্রমণ থেকে কোনওই লাভ হল না, তাই আমি অধিক উপকৃত হলাম: আমি যা পেলাম তা প্রচুর পরিমাণে পেলাম।

    লাভ আর উপকারের মধ্যে তফাতটা হল যেসব কাজ লাভজনক সেটা আমার জায়গায় অন্য যে কেউ করতে পারবে। লাভটা তখন সম্পূর্ণ তারই হবে, যদি না এমন হয় যে আমিই তাকে কাজে লাগিয়েছি। কিন্তু এটা সত্যি যে লাভজনক ক্রিয়াকলাপ অন্য যে কারও দ্বারা সম্পন্ন হতে পারে। এটাই হল প্রতিযোগিতার নীতি। অথচ যেসব কাজকর্ম আমার উপকারে লাগে সেগুলো আর কাউকে দিয়ে করানো সম্ভব নয়। থরো তাঁর চিঠিতে লিখলেন: কোনও কাজ করার ক্ষেত্রে তাই নিজেকে প্রশ্ন করা উচিত, ‘আমার জায়গায় অন্য কেউ কি এই কাজটা সম্পন্ন করতে পারত?’ যদি এই প্রশ্নের উত্তর ‘হ্যাঁ’ হয়, তা হলে কাজটা ছেড়ে দাও, যদি না তা একেবারে অপরিহার্য হয়। অপরিহার্য মনে হলেও সে কাজ কিন্তু তোমার জীবনের জন্য অত্যাবশ্যক নয়। গভীরতম অর্থে বাঁচা হল তাই যা বিকল্প কোনও ব্যক্তি আমাদের হয়ে করে দিতে পারে না। কর্মক্ষেত্রে তোমার বিকল্প তৈরি করে নেওয়া যাবে। হেঁটে বেড়ানোর সময় তা করা যাবে না। এই হল মূল পার্থক্য।

    'যদি আমি না হতাম, তা হলে আমার জায়গায় কে থাকত?'

    আবার আমাদের হিসেবে ফিরে আসা যাক। এখানে চোখে পড়ার মত বিষয় থরোর যুক্তিগুলো নয়। কারণ প্রাচীন মুনিঋষিরা তো জাগতিক সম্পদে তাঁদের অনীহা ব্যক্ত করেই গেছেন। তাঁদের বিচারে আসল সম্পদ হল আত্মিক। অথবা তাঁরা সেই ব্যক্তিকেই সম্পদশালী বলে মনে করেছেন যাঁর কোনও অভাববোধ নেই। আমাদের কাছে যা চিত্তাকর্ষক তা হল উদাহরণ সহযোগে থরোর ব্যাখ্যা। হিসেব মেলানোর জন্য তিনি অনেক দূর পর্যন্ত যেতে রাজি। তিনি বলছেন না যে কোনও কাজের গুণমান যাচাইয়ের জন্য আমাদের অর্থনৈতিক হিসেব নিকেশ বর্জন করতে হবে। তিনি বরং বলছেন: হিসেব রাখো, সব সময় হিসেব কষতে থাকো। আমি আসলে কী পাচ্ছি, কীই বা হারাচ্ছি? আমি যখন আরও অর্থ উপার্জনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছি, তখন আসলে জীবনে কী থেকে বঞ্চিত হচ্ছি? ধনী যখন আরও সম্পদশালী হওয়ার চেষ্টা করে, তখন আসলে তারা কী হারায়? অনবরত কাজ করে যাওয়া, দুশ্চিন্তা করা, নজর রাখা, কখনও তাদের কাজ বা ব্যবসার চিন্তা ছেড়ে থাকতে না পারা।

    মাথার ওপর একটা ছাদের প্রয়োজন, থরো স্বীকার করছেন। চারপাশে দেওয়াল, একটা বিছানা, কয়েকটা চেয়ার। কিন্তু কেমন ছাদ, কোন্‌ ধরনের আসবাবপত্র? যদি বিশাল একটা বাড়ি চান, চকচকে হাতল লাগানো দরজা চান – তা হলে তো আপনাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। দীর্ঘকাল ধরে আবহাওয়াটা কেমন, আকাশের রঙটাই বা কী তা আপনাকে ভুলে থাকতে হবে। অনেক লাভ তখন হবে, কিন্তু তাতে কারও কোনও উপকার হবে না। তাই ছাদটা এমন হবে যা আমাকে ঠান্ডা থেকে বাঁচাবে। তিনটে মাত্র চেয়ার (একটা নিজে বসার জন্য, দ্বিতীয়টি বন্ধুবান্ধবের জন্য, তৃতীয়টি সমাজের জন্য)। শুধুই একটা খাট আর ঘুমোনোর জন্য ভালো একটা কম্বল। এসব জোগাড় করতে অনেক অর্থ ব্যয় হবে না। ন্যূনতম শ্রমেই এসব অর্জন করা যাবে (সামান্য শারীরিক শ্রম, একটু বিন-বরবটির চাষ যা বেচে আপনি চাল কিনতে পারবেন)। এটুকু থাকলেই আপনি বিনিময়ে অনেক কিছু পাবেন। উদ্বৃত্ত সময়ে পায়ে হেঁটে দীর্ঘ ভ্রমণে যেতে পারবেন (দিনে তিন-চার ঘণ্টা) যা আপনার শরীরকে সুস্থ রাখবে। আর বিনাব্যয়ে প্রকৃতির অন্তহীন অপরূপ দৃশ্যাবলী উপভোগ করতে পারবেন। (পশুপাখি, গাছপালার আড়ালে আলোর খেলা, হ্রদের গভীরের নীল আভা।) হিসেব মেলাতে গিয়ে সাপ্তাহিক খাটাখাটনির যে ব্যাখ্যা আছে তা উল্টে গেল। সরল জীবন যাপনের জন্য যেটুকু উপার্জন প্রয়োজন, তার জন্য হপ্তায় এক দিন কাজই যথেষ্ট। বাকি দিনগুলোয় যে কাজ আমরা করি তা নিষ্ফল, নিরর্থক – তা শুধু আরামের জিনিসপত্র কিনতে ব্যয় হয়। আর আসল জীবন থেকে সেই সময়টা মুছে যায়। থরো (নিখুঁত হিসেব কষে) বলেছিলেন যে বাড়িটা তৈরি করতে তাঁর খরচ হয়েছিল আঠাশ ডলারের সামান্য বেশি।

    কাজকর্ম আর পরিশ্রম যেমন ধনসম্পদ সৃষ্টি করে, তেমনই দারিদ্র্যেরও কারণ হয়। কিন্তু তা সেই দারিদ্র্য নয় যার অবস্থান সম্পদের উল্টো মেরুতে। এ অপ্রাচুর্য ধনের পরিপূরক। ধনী, লোভী মানুষ ভোগ করে – তার দৃষ্টি থাকে প্রতিবেশীর থালার ওপর নিবদ্ধ – দেখতে থাকে সেখানে ভাগে বেশি পড়ল কি না। গরীব মানুষ ভোজের থালায় উচ্ছিষ্ট যা পড়ে থাকে তাই গ্রহণ করে। তারাও কিন্তু একই খেলায় নিয়োজিত – তফাতটা হল শুধু বিজয়ী আর বিজিতের। থরো এখানে যে দারিদ্র্যের সুপারিশ করছেন তা চিরাচরিত ধারণায় ধনী আর দরিদ্র এই দুইয়ের থেকেই ভিন্ন। আরও বেশি পাওয়ার লোভে যে ধনী নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে – আর যে দরিদ্র শ্রমের বিনিময়ে প্রায় কিছুই পায় না। থরোর বিদ্রোহ এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। তিনি এই খেলার মধ্যে ঢুকতেই রাজি নন। নিজের মূলধন আগলে থাকা নয়, কৃপণের মত সঞ্চয় করা নয়, ব্যয় করতে ভয় পাওয়াও নয় – তিনি কোনও খেলাই না খেলে বেছে নিয়েছেন সংযমী, স্বয়ম্ভর জীবন।

    এই সংযম ঠিক কৃচ্ছ্রসাধন নয়। আমি যা বলতে চাইছি তা হল কৃচ্ছ্রসাধনের মধ্যে অঢেলের জন্য লোভের বিরোধিতার ব্যাপারটা কাজ করে। অঢেল খাদ্য, অঢেল ধন, অঢেল জিনিসপত্র, আরাম আর ভালো লাগা। থরোর সংযম ওই ভালো লাগা যে ঢাল বেয়ে অঢেলের দিকে নেমে গেছে সেই ঢালটিকে নিখুঁতভাবে চিহ্নিত করেছে। তিনি ‘না’ বলতে, পরিমাণ কমাতে, সংযমী হতে বলছেন। কৃচ্ছ্রসাধনের মধ্যে বেশ একটু কঠোরতা আছে – ভালো লাগা বা তৃপ্তির প্রতি বিতৃষ্ণা বা ভয় আছে। কৃচ্ছ্রসাধন নিজেকে ছেড়ে দেওয়ার বিরোধী – তাতে থাকে অন্যথায় গা ভাসিয়ে দেওয়ার ভয়। থরো যে অল্পে সন্তুষ্ট জীবনের কথা বলছেন তাতে সরল জীবনের সার্থকতার উপলব্ধির পাঠ দেওয়া হচ্ছে – জল, ফল বাতাসের নিশ্বাসের মত অতি সামান্য জিনিস বা কোনও কিছুই না নিয়ে জীবনকে উপভোগ করার পথ দেখানো হচ্ছে। আহ্‌! শুধু নিশ্বাস টেনে যেন নিজেকে পুনর্জীবিত করা, থরো লিখেছেন।

    জিনিসপত্র আর ধনসম্পদ আহরণ করতে হলে মানুষকে যে প্রবল প্রচেষ্টা চালাতে হয়, থরো সেদিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছেন যে এটা কোনও মানুষকে সারাদিন ধরে পরিশ্রম করতে দেখলেও বোঝা যায়। ভেবে দেখুন যে এই পরিশ্রম করে তিনি কী হারাচ্ছেন! এই হিসেব যদি কষতে থাকেন, তা হলে আপনাকে স্বীকার করতেই হবে শুধু পায়ে হেঁটে আমরা হয়ত আরও দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছে যেতাম। তার কারণ গরু বা ঘোড়া আর গাড়ির মালিক হতে আপনাকে অনেক দিন কাজ করতে হবে। গাড়িতে এক দিনে অনেকটা পথ যেতে হলে তার জন্য কয়েক মাস পরিশ্রম করতে হবে – তাই হাঁটুন! আপনি লক্ষ্যে তাড়াতাড়ি পৌঁছোবেন, উপরি পাবেন আকাশের গভীরতা আর গাছপালার রঙের সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ।

    ‘আমি যা দেখি তাকেই নিজের করে নিই,’ থরো লিখেছেন: অর্থাৎ পায়ে হেঁটে চলার সুবিধে হল হাঁটার সময় আমরা বর্ণিল অনুভূতি আর সূর্যের আলো ঝলমল স্মৃতিগুলোকে জমাতে থাকি শীতকালের সন্ধ্যেগুলোর জন্য। আমাদের আসল ধন, আমাদের সত্যিকারের সম্পদ হল সেই কল্পরূপগুলোর সমাহার যা আমরা স্মৃতিতে ধরে রেখেছি।

    আমি সেই সব অন্তর্দৃশ্যের কাছে বারবার ফিরে যাই। সেগুলোই আমার চিরকালীন সম্পদ যা আমাকে বিঘ্নসঙ্কুল জীবন থেকে বাঁচায় – যা আমি দুঃসময়ের জন্য সঞ্চয় করে রাখি।



    কিন্তু ধনসম্পদ আহরণ করাও বোধহয় তাদের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার থেকে সহজ। জাগতিক সুখস্বাচ্ছন্দ্যের জিনিসপত্রের সঙ্গে নিরন্তর ঘষা খেতে খেতে সম্পদের মালিকের হৃদয় জমে যায়, তাতে কড়া পড়ে যায় – শক্ত হয়ে যায়। আর সেই সব জিনিস না মেলায় ঈর্ষায় আর রাগে গরীবের হৃদয় কুঁকড়ে যায়। ধনী স্বাচ্ছন্দ্যের জীবনে খুব তাড়াতাড়ি এমন অভ্যস্ত হয়ে যায় যে তাকে ছেড়ে থাকা তার পক্ষে অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে ওঠে। নরম সোফার বদলে শক্ত কাঠের চেয়ারে বসা অথবা ঠান্ডায় ঘুমোনো অসম্ভব হয়ে পড়ে। পাঁচ শো মিটার হেঁটে যাওয়াও তাদের পক্ষে ক্লান্তিকর হয়। আর গরীবগুর্বোরা সমৃদ্ধি লাভের আশায় বন্দি থাকে – তারা ধনসম্পদ পাবে কীভাবে তাই চিন্তা করে চলে।

    না, বোঝাই যাচ্ছে যে সম্পদ বহু মানুষের অনেক ক্ষতির কারণ হয়। অসামান্য পদব্রজী হলেও – প্রতিদিন তিন থেকে চার ঘণ্টা হেঁটে বেড়ালেও – থরো কিন্তু দারুণ কোনও ভ্রমণকারী ছিলেন না। মেইন (Maine), কেবেক, নিউ হ্যাম্পশায়ারের অরণ্যে তিনি অবশ্যই পায়ে হেঁটে কয়েকবার দীর্ঘ ভ্রমণ করেছিলেন। কিন্তু যে পদসঞ্চারণার অভিজ্ঞতার কথা তিনি বলেছেন আর যা তাঁকে বেঁচে থাকার রসদ জুগিয়েছিল, তার সবই ছিল বাড়ি থেকে বেরিয়ে পকেটে হাতদুটো ঢুকিয়ে কংকর্ডের চারপাশে দৈনিক দীর্ঘ পথ হেঁটে বেড়ানো। গুটি গুটি পায়ে পথ চলা অ্যাডভেঞ্চারার? আসলে তিনি বোধহয় আমাদের বিদেশ থেকে আমদানি করা পর্যটনের বিচিত্র ধারণা সম্পর্কে সাবধান করতে চেয়েছিলেন। আমরা কত মানুষকেই তো দেখি যারা সুদূর ভ্রমণ করে এসে বলেন ‘সেখানে’ তাঁরা কী দেখলেন: সেই স্মৃতিচারণায় থাকে অবিশ্বাস্য, মহাকাব্যিক সব ঘটনা, সব সময়ই মনোমুগ্ধকর সব প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী আর দারুণ সব খাবার-দাবার। বলার ঢঙে, রোমাঞ্চের নিরিখে অথবা চরমতায় এও এক ধরনের পারফরমেন্স। তা সত্ত্বেও থরোর ওয়াল্ডেন অন্যান্য অজস্র ভ্রমণকাহিনীর তুলনায় পাঠকের কাছে চিত্তাকর্ষক। এই রচনায় স্পষ্টতই বৈপ্লবিক কিছু আছে যার পাশে অতিকথন দোষে দুষ্ট রোমাঞ্চকর ভ্রমণকাহিনী নীরস, জোলো মনে হয়। এ কথাটা যতবারই বলা হোক না কেন পুরোনো হবে না যে হেঁটে অনেক দূরে যাওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। হাঁটার লক্ষ্য বিচিত্র অন্য রকমের কিছু খুঁজে পাওয়া নয় – অন্য জগৎ, অন্য মুখ, অন্য সংস্কৃতি, অন্য সভ্যতা। এক্ষেত্রে গন্তব্য হল সভ্য জগতের সীমায় পৌঁছোনো, তা যেখানেই থাকুক না কেন। হাঁটা হল আসলে নিজেকে আলাদা করে নেওয়া। পরিশ্রমী কর্মী, দ্রুত ছুটে চলা সড়ক, লাভ অথবা অনটন-সৃষ্টিকারী, শোষক ও শ্রমিক, আর সেই সব গুরুগম্ভীর মানুষদের থেকে নিজেকে একটু দূরে রাখা যাদের শীতের সূর্যের নরম কোমলতা অথবা বসন্তের টাটকা বাতাসের তুলনায় আরও ভালো কিছু পাওয়ার আছে।

    হেঁটে বেড়ানো তো শুধু সত্যান্বেষণের বিষয় নয়, এটা বাস্তবকে বুঝতেও সাহায্য করে। পদব্রজে যাওয়া হল বাস্তব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা। এই বাস্তব শুধু বাহ্যিক ভৌত বাস্তব নয়, এমন কিছু নয় যা একটা বিষয় হতে পারে। এই বাস্তব হল সারবান: গভীরতা আর প্রতিরোধের নীতি। হাঁটার সময় প্রতিটি পদক্ষেপে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। পায়ের নিচে শক্ত মাটি। প্রত্যেকবার পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীরের সম্পূর্ণ ভার অবলম্বন পাচ্ছে, আবার স্প্রিংয়ের মত ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছে।

    পায়ের তলায় কঠিন ভিত সর্বত্রই আছে।

    খাড়া পথে চলার সময় পা কোথায় রাখছি সর্বদা তার খেয়াল রাখতে হয়: সেই টের পাওয়া যায় না এমন এক মুহূর্তে পা ফেলে আমরা বুঝে নিই যে মাটি আমাদের ভার ধরে রাখতে পারবে কি না। তারপরে, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর আপনি এক পায়ের ওপর শরীরের ভর রাখেন – অন্য যে পা’টি হাওয়ায় সামনের দিকে এগিয়ে গেছে সেটি মাটিতে ফেলার আগে। পথ বরফে ঢাকা হলে পা কাঁপে, ডুবে যাওয়া পায়ের নিচে বরফ টের পাওয়া যায়। অথবা পায়ের তলার মাটি হয়ত অত্যন্ত শুকনো, পাথুরে অথবা বালিতে ভরা। ব্যাপারটা দাঁড়ায় অনবরত শরীরটাকে খাড়া দাঁড় করিয়ে ওজনের ভারসাম্য রাখার মত। অর্থাৎ সে হল পায়ে চলার বদলে নৃত্য করা। মাটি নরম হলে পা দুটো স্নায়ুর চাপে ভোগে – দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। ফুটপাত আবার খুব বেশি রকমের শক্ত। সেখানে চললে মনে হয় যেন ফাঁকা ঢোল বাজছে। পৃথিবী যে ধাক্কা শুষে নিতে পারে সেই ধাক্কা যখন পায়ে এসে লাগে তখন তা সারা শরীরে ছড়িয়ে যায়। পিচ বাঁধানো রাস্তার যে নিখুঁত সমানতা তা পাদুটোকে ক্লান্ত করে তোলে। বাস্তব ঠিক এতটা একঘেয়ে নয়।

    কেউ কেউ লেখায় ঠিক ততটাই সময় দেন যা তাঁরা পড়তে ব্যয় করেন। এমারসন স্মরণ করেছেন যে থরো যতক্ষণ হাঁটতেন তার বেশি সময় লেখার জন্য খরচ করতেন না। সংস্কৃতি আর গ্রন্থাগারের ফাঁদ তিনি এড়িয়ে চলতে চাইতেন। কারণ আমরা যা কিছু লিখি তাই তো অন্য কারও রচনায় ভরা! আর সেই অন্যরা আবার অন্য কোনও লেখকের বইয়ের কথা বলে পাতা ভরিয়েছেন... রচনাকে হতে হবে মৌন অথচ জীবন্ত অভিজ্ঞতার প্রামাণ্য বিবৃতি। অন্য কোনও বই সম্পর্কে মন্তব্য নয় – অন্য রচনার ব্যাখ্যাও নয়। বই হল সাক্ষ্য... কিন্তু আমি ‘সাক্ষ্য’ কথাটা ব্যবহার করছি রিলে রেসের বেটনের কথা মনে করে। আমরা সেই ‘সাক্ষ্য’কে অন্য কারও হাতে সমর্পণ করি – সে আবার দৌড়তে শুরু করে। অভিজ্ঞতা থেকে যে বইয়ের জন্ম তা আমাদের সেই অভিজ্ঞতায় ফিরিয়ে নিয়ে যায়। বই আমাদের বাঁচতে শেখায় না (যদিও যাঁরা পাঠদান করেন তাঁদের বিষণ্ণ কর্মসূচির মধ্যে তাই থাকে), বরং বই আমাদের অন্যভাবে বাঁচার উৎসাহ জোগায়: আমাদের মধ্যে জীবনের সম্ভাবনা, তার নীতিকে আবার খুঁজে পেতে সাহায্য করে। দুটো বই পড়ার (অর্থাৎ দুটি পাঠের মধ্যবর্তী সময়ে প্রয়োজনীয় অথচ একঘেয়ে যে দৈনিক গতিবিধি) মাঝখানের বিশেষত্বহীন, সাধারণ যে জীবন তার তুলনায় অন্য ধরনের অস্তিত্বের আশা বই জাগিয়ে তোলে। বইকে দৈনন্দিন জীবনের ধূসরতাকে এড়িয়ে চলার উপায় করা উচিত নয় (দৈনন্দিন জীবন হল তাই যার পুনরাবৃত্তি হয়, যা অপরিবর্তনীয়)। বরং বই আমাদের এক জীবন থেকে অন্য এক জীবনে যেতে সাহায্য করে।

    আমরা যদি বাঁচার জন্য উঠে না দাঁড়াই, তাহলে লেখার জন্য বসে থাকা নিরর্থক।

    বাস্তবের মধ্যে সেই লেখার উপকরণের অনুসন্ধান করতে হবে। যে পদক্ষেপের গভীর চিহ্ন পড়েছে, পায়ের সঙ্গে পৃথিবীর সেই সংঘাতের পরে লিখতে হবে। কারণ তখন, এমনকী চিন্তাতেও, আমরা শক্তপোক্ত কিছু খুঁজব। আমি আসলে বলতে চাইছি যে যা তীব্রভাবে অনুভূত হয়েছে, শুধু তাই লেখার বিষয় হোক। অভিজ্ঞতা লেখকের শক্তপোক্ত ভিত হয়ে উঠুক।

    ‘মতামত, পূর্বসংস্কার, ঐতিহ্য আর মায়ার যে কর্দমাক্ত পলিমাটিতে পৃথিবী ছেয়ে আছে – প্যারিস থেকে লন্ডন, নিউ ইয়র্ক থেকে বস্টন হয়ে কংকর্ড পর্যন্ত – গির্জা আর রাষ্ট্র, কাব্য, দর্শন আর ধর্মের মধ্যে দিয়ে হেঁটে গিয়ে আমাদের সেই শক্তপোক্ত পাথুরে গভীরতায় পৌঁছোতে হবে যাকে আমরা বাস্তব বলি। আর তখন আমরা বলতে পারব: এটাই সেই – কোনও ভুল হয়নি।

    হেঁটে বেড়ানোর সময় যে বাস্তবের অনুভূতি হয়, তা যে শুধু পায়ের নিচে শক্ত মাটি থেকেই আসে তা নয়। আমরা নিজেরাও কতটা সমর্থ তাও টের পাওয়া যায়। থরো বারবার বলেছেন যে পদচারণার সময় বাস্তব সম্পর্কে তাঁর নিজের ধারণাও বিবেচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। কারণ তখনই মানুষ শুধু প্রকৃতির মধ্যে না থেকে প্রাকৃতিক হয়ে ওঠে। এখানে বিষয়টা প্রকৃতির সঙ্গে ‘ভাবের আদানপ্রদান’ অথবা ‘সমন্বয়ের’ নয়। এই সব পরিভাষা গভীর মিস্টিক অভিজ্ঞতার বর্ণনার ক্ষেত্রে উপযুক্ত -- যেখানে সমগ্রের কল্পনার মধ্যে চিন্তা সম্পূর্ণতা পায়, আবার মুছে যায়। না, হাঁটাচলায় আপনার সক্রিয় অংশগ্রহণের প্রয়োজন হয়: উদ্ভিদ, ধাতু, পশুপাখি এসবই নিজের মধ্যে অনুভূত হয়। যে গাছের পাশ দিয়ে যেতে যেতে তার ছালটা ছুঁয়ে দেখলাম – সে যে কাঠ দিয়ে তৈরি, আমিও যেন তাই দিয়েই তৈরি। যে বড় ঘাসগুলো আমাকে ছুঁয়ে গেল, আমার শরীরটাও যেন তাদের মত একই কোষকলা দিয়ে গঠিত। আর যখন থামি, তখন আমার গভীর শ্বাসপ্রশ্বাস যেন আমাকে দেখে হঠাৎ থমকে গেল যে খরগোশটা – তার দম ফেলার সঙ্গে মিলে যায়।

    সারা দিন ধরে বাস্তবকে এইভাবে পরীক্ষা করে দেখা – মাটির দৃঢ়তার নিরিখে যেমন, তেমনি আমার চারপাশে যে সঘন প্রকৃতি, তার মধ্যে প্রতিধ্বনিত আমার নিজের সত্তার সামঞ্জস্যের নিরিখেও। আর এই পরীক্ষাই আমার আত্মবিশ্বাসকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। ওই যে বলা হয় হাঁটাচলা করলে 'মাথা পরিষ্কার হয়ে যায়'। হাঁটলে আমরা জীবনের একটা অন্য উদ্দেশ্য খুঁজে পাই -- যেটা ধ্যানধারণা, নীতি অথবা মতবাদের সঙ্গে জড়িত নয় -- বাক্য, উদ্ধৃতি, তত্ত্বে টইটম্বুর একটা মাথা নয়। বরং পৃথিবীর উপস্থিতিতে ভরে থাকা একটা মস্তিষ্ক। সারাদিন ধরে ওই পলিমাটির হরেক স্তরের মত কোনও উপস্থিতি আমাদের হৃদয়ে জমতে থাকে। আর যখন সন্ধ্যে নামে, তখন আর বিশেষ চিন্তা করতে হয় না: শুধু চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নিলেই টের পাই যে প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী আমি অবলোকন করেছি, তা আমার শরীরের মধ্যে মিশে যাচ্ছে, আবার নতুন করে তৈরি হচ্ছে: আকাশের রং, পাতার ওপরে আলোর ঠিকরে যাওয়া, পরস্পর মিলেমিশে থাকা টিলাগুলোর অস্পষ্ট নকশা। এতে যে আত্মবিশ্বাস জাগে, তা নিখাদ আশা নয়, বরং নীরব প্রত্যয়। যে মানুষ সারা দিন ধরে পথ চলেন, তিনি সন্ধ্যেয় এই প্রত্যয়ে পৌঁছোন।

    এই আত্মবিশ্বাস আহরিত হয় প্রদোষকালের উদ্যম থেকে। থরো তাঁর সব রচনায় প্রভাতের ওপর বিশ্বাস রাখতে চেয়েছেন। অথবা হয়ত ভোরই তাঁকে বিশ্বাসে ভরিয়ে দিয়েছে। দিনের সূচনার সঙ্গী হতে হলে খুব ভোরে হাঁটতে বেরোতে হবে। সূর্যোদয়ের অব্যবহিত আগে দোলাচলের সেই সময়টাতে বাস্তবের ফিসফিস উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। সকালে হাঁটার অর্থ হল আমাদের ইচ্ছেগুলোর দারিদ্র্যের মুখোমুখি দাঁড়ানো – এই অর্থে ইচ্ছে যেন সঙ্গ দেওয়ার বিপরীত। আমি বলতে চাইছি এক পা এক পা করে ভোর হতে দেখা কোনও কিছু হঠাৎ উপড়ে নেওয়া নয়, কোনও নিষ্ঠুর বিপর্যয়, এমনকী কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়াও নয়। দিনের আভাস আসে ধীরে। এরপরই সূর্য উঠবে, সব কিছু শুরু হবে। স্বেচ্ছাপ্রসূত, গুরুগম্ভীর, বাচালতাপূর্ণ রূপান্তর যা কিছু আছে তার মধ্যে এক ধরনের ভঙ্গুরতা টের পাওয়া যায়। ভোর কারও ইচ্ছেয় শুরু হয় না। সূর্যোদয়ের নিশ্চয়তার মধ্যে কোনও উদ্বেগ নেই। তাই ভোরে পদচারণা হল প্রাকৃতিক প্রারম্ভগুলোর শক্তি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া।

    প্রদোষকালের ভালোবাসাই হল স্বাস্থ্যের পরিমাপ।

    ভোরবেলার প্রতি থরোর যে ভালোবাসা তার প্রতিফলন ঘটে বসন্তের গৌরবগাথার মধ্যে – যখন তিনি বর্ণনা করেন কীভাবে এপ্রিল মাসের নতুন রোদে ওয়াল্ডেন হ্রদের বরফ ভেঙে গলে যায়। নদীতে নতুন পথ তৈরি হয়, রাস্তা আবিষ্কৃত হয়। কিন্তু সবার ওপরে হল কোনও কোনও সকালে এবং সব বসন্তে তিনি যে অনন্তের নব উন্মেষের নীতিটি খুঁজে পান।

    বছর শুরু হয় আশার সেই নব যৌবনে যা আগে কখনও দেখিনি।

    সত্যিকারের আশার এই যে অনন্ত যৌবন তা কোনও শর্তের – কোনও সত্যতা যাচাই, কোনও প্রমাণের – অধীন নয়। তার অধিষ্ঠান হল এই জ্ঞানের মধ্যে যে আশাটা কীসের তার চেয়ে অনেক বেশি প্রাপ্তি হবে আশাটা কেমন তার থেকে। কারণ আশা মূলত বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে, জ্ঞানের ওপর নয়। বিশ্বাস করা, আশা করা, স্বপ্ন দেখা – সব আহরণ, সব শিক্ষা, সব অতীতের সীমার বাইরে যাদের অধিষ্ঠান। প্রকৃতির কোনও ইতিহাস নেই: প্রকৃতির স্মৃতি এক বছরের অধিক অতীতে পৌঁছোয় না। থরো যাকে বসন্তের অভিজ্ঞতা বলেছেন তা হল নিখাদ প্রত্যয়ের প্রবাহে ভেসে যাওয়া – জোরদার ধাক্কা খেয়ে এগিয়ে চলা যাতে বাঁচার ইচ্ছা ছাড়া আর কিছুর গুরুত্ব নেই। আর তিনি বারবার সারল্যকে ফিরিয়ে আনতে বলেছেন: যাতে আবার সব কিছু নতুন করে শুরু হয়। আর রাত শেষ হয়ে দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে অতীত মুছে যায়।

    বসন্তের একটা সকালই সব মানুষের পাপ ক্ষমা করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।

    বসন্তকালে অথবা প্রাতে পদচারণার সময় আমরা অত্যন্ত মনোযোগী থাকি। আমাদের মন সদ্য জেগে ওঠা দিনটার দিকে প্রসারিত হতে থাকে। আর ধীর লয়ে আসা সেই প্রত্যয়টুকু ছাড়া আর কিছুরই গুরুত্ব থাকে না। যিনি পদব্রজে যাত্রা করেন তাঁর কোনও ইতিহাস থাকে না – অতীতের বোঝা ভ্রমণকারীর পক্ষেও বেশ ভারি। সকালে হাঁটার সময় কোনও স্মৃতিও সঙ্গে থাকে না। শুধু থাকে এই নিশ্চিত বিশ্বাসের আনন্দ যে রাতের পাতার মধ্যে থেকে আলো ঠিকরে বেরোবে।

    সূর্যটা তো দিনের বেলার তারা ছাড়া আর কিছুই নয়।

    সকালের উৎপত্তির মধ্যে আমরা পশ্চিমকে – প্রতীচীকে – খুঁজে পাই। থরোর বিশ্বাসে সূর্য সব সময় পশ্চিমে ওঠে। আমাদের স্মৃতি থাকে পূর্বে। প্রাচ্য হল সংস্কৃতি আর পুঁথি, ইতিহাস আর প্রাচীন পরাজয়ের অধিষ্ঠান। অতীত থেকে শেখার কিছু নেই কারণ তা শিখলে পূর্বের ভুলভ্রান্তিরই পুনরাবৃত্তি হবে। এই কারণে বৃদ্ধদের বিশ্বাস করতে নেই – তাঁরা যাকে ‘অভিজ্ঞতা’ বলেন তা আসলে বারবার করা ভুলের ভার। শুধু আত্মপ্রত্যয় আর যৌবনের ওপরই বিশ্বাস রাখা উচিত। ভবিষ্যতের সূত্র পাওয়া যাবে প্রতীচীতে।

    আমরা ইতিহাসকে বুঝতে, শিল্প-সাহিত্য অধ্যয়ন করতে, আমাদের জাতিগত লক্ষণগুলো আবিষ্কার করতে পূর্বের দিকে যাই। আর আমাদের পশ্চিম দিকে ভ্রমণ হল ভবিষ্যতের দিকে যাওয়ার মত। অ্যাডভেঞ্চার আর উদ্যোগের মানসিকতা নিয়ে।

    পশ্চিম হল আকরিকের ভাণ্ডার, ভবিষ্যতের প্রস্তুতি, সত্তার সম্পদ – এমন সম্পদ যা এখনও খোলা হয়নি, যা চিরকালের জন্য নতুন। কিন্তু পশ্চিম বন্যও (the Wild) বটে। প্রকৃতির মধ্যে বন্য হল তাই যা এখনও আহরিত হয়নি, আদিম প্রকৃতি – আদি ও অমানবীয় এক শক্তি (অ্যাকাডেমিক ব্যাখ্যা নয়: থরো বলেছেন অধিকাংশ কবি জানেন না কীভাবে ‘পাহাড়ের পশ্চিম দিকটার’ ছবি আঁকতে হয়।) কিন্তু আবার আমাদের মধ্যে যা কিছু অদম্য আর বৈপ্লবিক, যেখানে আমরা এখনও বাঁচার ব্যাপারে হাল ছেড়ে দিইনি – সেই নিখাদ প্রত্যয়ই হল প্রতীচী। এমারসন যখন থরো সম্পর্কে লেখেন যে তিনি মার্কিনদের থেকেও বেশি মার্কিন, তখন হয়ত তিনি এটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন: আদিম বন্যতার প্রতি তাঁর আকর্ষণ যা ভবিষ্যতের সূত্র হয়ে উঠতে পারে। প্রতীচ্য হল ভবিষ্যৎ, থরো বলেছিলেন: সেই বন্যতায় অবগাহন করে, তার মোকাবিলা করার মাধ্যমেই এগিয়ে যাওয়ার পথ খুলবে – তিনি আবার প্রস্ফুটিত হতে পারবেন। মার্কিন কল্পস্বর্গ (Utopia) আর বন্যতা নিয়ে ইউরোপীয়দের স্বপ্ন দেখার মধ্যে সম্ভবত এটাই পার্থক্য। আমাদের (ইউরোপিয়ানদের) কাছে আদিম জঙ্গল হল উৎপত্তিস্থল: সেই আদি পাপ যার প্রায়শ্চিত্ত এখনও হয়নি – সভ্যতার অস্পষ্ট সূচনা। পিতৃপুরুষের সেই অধিষ্ঠানে আমরা ফিরে যেতে চাইতে পারি, যা কখনওবা আমাদের সামনে ভেসে ওঠে। কিন্তু সেটা আমাদের জ্ঞাত অতীত। মার্কিন থরোর কাছে কিন্তু বন্যতার অবস্থান পশ্চিমে: তাঁর ঠিক সামনে। সেখানে আছে ভবিষ্যতের সম্ভাবনা। বন্যতা আমাদের স্মৃতির বিচারে রাত্রি নয়, বরং পৃথিবী আর মানবিকতার ভোর।

    আমি পশ্চিম বলতে যা বুঝি তার সমার্থক শব্দ ‘বন্য’। বন্য জীবনের মধ্যেই পৃথিবীর সংরক্ষণের উপায় নিহিত আছে।

    এই কারণে পায়ে হেঁটে বেড়ালে আমরা সেই তথ্যে সম্পূর্ণ আগ্রহ হারিয়ে ফেলি যাকে ঠাট্টা করে বলি ‘সংবাদ’ – যার মূল বৈশিষ্ট্য হল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই পুরোনো হয়ে যাওয়া। যতই সেই ছন্দে ঢুকে পড়বেন, থরো বলছেন, ততই আপনি শিকলে বাঁধা পড়ে যাবেন। আপনি তখন খালি জানতে চাইবেন এর পরে কী? আসল চ্যালেঞ্জটা হল কী পরিবর্তন হয়েছে তা জানা নয়, বরং যা চিরনবীন তার কাছাকাছি পৌঁছোনো। তাই সকালের খবরের কাগজটা পড়া ছেড়ে দিয়ে হাঁটাচলা শুরু করুন! সংবাদ একটার জায়গায় আরেকটা এসে বসে, মিলেমিশে যায়, তার পুনরাবৃত্তি হয় আর শেষমেশ বিস্মৃত হয়। সত্যিটা হল আমরা হাঁটতে শুরু করলেই ওই সব আওয়াজ, গুজব – সব কিছুই মুছে যায়। নতুন কী পাই? কিছু না – এক প্রশান্ত অনন্ত যা বারবার পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে।

    থরোর এই যে জীবন যাপন – একদিক থেকে তা ছিল প্রত্যাখ্যানের জীবন (এমারসন স্মরণ করেছেন যে কোনও অনুরোধেই থরোর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল ‘না’ – গ্রহণের তুলনায় তাঁর কাছে অনেক সহজ ছিল প্রত্যাখ্যান)। কিন্তু তাছাড়াও তাঁর জীবনের নির্বাচনগুলো ছিল ভিত-নাড়ানো। শুধু যেটুকু প্রয়োজন তা অর্জন করার জন্যই কাজ করা, সারাদিন ধরে দীর্ঘ সময় পায়ে পথ চলা, সামাজিক খেলায় জড়িয়ে না পড়া। থরোর এই ধরনের জীবনযাপন খুব শীঘ্রই অন্যদের (যারা আপন মহত্ত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত, যারা অত্যন্ত পরিশ্রমী, যারা সম্পদশালী) বিবেচনায় সৃষ্টিছাড়া, উদ্ভট বলে পরিগণিত হতে শুরু করল। থরোর জীবনে এর সঙ্গে ছিল সত্যের অনুসন্ধান আর সত্যতা যাচাইয়ের প্রচেষ্টা। কিন্তু সত্যকে খোঁজার অর্থ হল বাহ্যরূপের অভ্যন্তরে প্রবেশ। অভ্যাস, ঐতিহ্য, সাধারণ প্রাত্যহিকী ছাড়াও অসংখ্য নিয়মনীতি, ভণ্ডামি আর মিথ্যাকে ধিক্কার জানানো।

    ভালোবাসা, অর্থ, খ্যাতির পরিবর্তে আমাকে সত্য দিন।

    সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত যে জীবন তা অন্য এক জীবন – ভিন্ন জীবন। সত্য চিড় ধরায়, মতভেদের কারণ হয়, সে পশ্চিম দিকে হেলে আছে। নিজেকে পুনরাবিষ্কার করতে হলে অনড় মতবাদের বরফের মোড়কের তলায় বন্যতার প্রবাহকে নিজের মধ্যে অনুভব করতে হবে। সেই প্রবাহ যা ফুলেফেঁপে ওঠে, পালিয়ে যায়, উপচে পড়ে। থরো বলছেন, আমরা নিজেদের কারাগারেই বন্দি থাকি। জনমতের স্বৈরাচারের কথা বলি, ব্যক্তির মতামতের তুলনায় যা কিছুই নয়। নিজেদের বিচার-বিবেচনার শিকলেই আমরা বন্দি। থরোর জন্য পায়ে হাঁটা (পশ্চিম দিকে – আর সঠিকভাবে হাঁটতে পারলে আমরা সেই প্রতীচীতে পৌঁছোবই) নিজেকে খুঁজে পাওয়ার জন্য নয় – বরং সব সময় নিজের পুনরুজ্জীবন ঘটাতে তৈরি থাকার জন্য।

    সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত জীবন শুরু করা বড়সড় ভ্রমণে বেরোনোর মত।

    বলা হয় যে জীবন-সায়াহ্নে এক পাদ্রী পরলোক, এ জগতের সীমার ওপারে অন্য জগৎ সম্পর্কে মৃত্যুশয্যায় শায়িত থরোকে স্মরণ করিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য এলে তিনি ম্লান হেসে বলেছিলেন: ‘কেন? কৃপা করুন, একেক বারে একটা করে জগতই থাক না?’

    সূত্র: La conquête du sauvage; Marcher, une philosophie ; Frédéric Gros, Carnets Nord ; 2009

    ১) Walden o Life in the Woods, Henry David Thoreau

    ২) Journal, Henry David Thoreau

    ৩) Walking, Henry David Thoreau

    ৪) Correspondence, Henry David Thoreau



    অলংকরণ (Artwork) : শুভময় রায়
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments