বব লুকাস (১৯৩৭ – ২০২৩)
বব লুকাসের সঙ্গে দু’টি সাক্ষাৎকার উল্লেখযোগ্য। প্রথমবার ১৯৮২ সালে যখন আমি পিএইচডি সংগ্রাম করছি ক্যালিফোর্নিয়া সান্তা বারবারা বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রতি সপ্তাহে পণ্ডিত লোকেরা সেমিনার দিতে আসতেন সেখানে। ডিপার্টমেন্টে পিএইচডি ছাত্রদের সেটি মস্ত সুযোগ এই ধরণের পণ্ডিত লোকেদের সঙ্গে কথা বলার। আমি তখন সদ্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়তে গেছি ওখানে। মস্তিষ্কের কোষে কোষে তখন সত্তরের দশকের স্ফুলিঙ্গ। এসেছি বুর্জোয়া দেশে বুর্জোয়া অর্থনীতি পড়তে। আমি ববকে আলটপকা জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা প্রফেসর লুকাস, আপনার কিছু মডেলে ধরে নেওয়া হয় দেশে কোন বেকার নেই। এটি তো ঠিক নয়! বব আমার দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বললেন, বৎস, আমি তো মডেলে একটি গল্প বলি আর সেটি আমি খুব ভালোভাবেই বলতে পারি। তুমি কিন্তু ঠিক প্রশ্নটি আমায় করছো না! তখন ভালো বুঝিনি, ভাবলাম বব হয়তো আমার প্রশ্নটি এড়িয়ে গেলেন। এখন বুঝি, কারণ এখন আমি ববের গবেষণার পিছনে অন্তর্নিহিত দর্শনটি ধরতে পেরেছি। বব লুকাস একটি ছোট প্রবন্ধে তাঁর জীবন দর্শনটি বুঝিয়ে গেছেন। প্রবন্ধটির নাম “হোয়াট ইকোনোমিস্টস ডু”? (What economists do?)। সেখানে বব লিখছেন যে অর্থনীতিবিদের কাজ হলো কিছু অনুমানের ভিত্তিতে একটি সুন্দর গোছানো গল্প বলা। এই অনুমানগুলি গল্পটিকে সহজ ভাবে বলার জন্য করা হয়। অনুমানগুলি ছাড়াও গল্পটির মূল বক্তব্যটি অক্ষুন্নই থাকবে। গল্পটি থেকে এমন একটি শিক্ষা পাঠকরা পাবেন যা অনেকটা প্যারাবেলের মত। এক একটি গল্প হলো অর্থনীতির এক একটি মডেল, যার থেকে যে মৌলিক নীতি প্রসূত হবে, সেটি সরকার, সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক ও জনসাধারণকে অনেক চিন্তার খোরাক দেবে।
লুকাস এরকম একটি গল্প এই প্রবন্ধে বলেছেন। তাঁর বাড়ির সামনে একটি বিনোদন পার্কের প্রবেশমূল্য ১০০ ডলার। পার্ক কর্তৃপক্ষ ১০০ ডলারের বিনিময়ে ১০০টি টোকেন দেন। পার্কের মধ্যে টোকেনই হলো টাকা, ডলার ব্যবহার নিষেধ। সব কেনাবেচা শুধু টোকেনেই হয়। এখন যদি এই পার্কের ম্যানেজার ১০০ ডলারে ১০০র জায়গায় ২০০টি টোকেন বিক্রি করেন, এবং সেটি আগে থেকে ক্রেতা বিক্রেতাদের জানিয়ে দেন তাহলে সব বিনোদনের মূল্য দ্বিগুণ হয়ে যাবে। অথবা সকলকে জানিয়ে যদি কর্তৃপক্ষ ১০০ ডলারে ৫০টি টোকেন বেচেন তবে পার্কে সব কিছুর মূল্য অর্ধেক হয়ে যাবে। এর ফলে কারো কোনো লাভ লোকসান হবে না। এখন ধরুন যদি পার্ক কর্তৃপক্ষ কাউকে কিছু না বলে হঠাৎ ১০০ ডলারে ১০০টির জায়গায় ৫০টি টোকেন বেচেন তাহলে কী ঘটবে? বহু লোক যাঁরা এই পার্কে ১০০ ডলারের বিনোদন খরিদ করতে এসেছিলেন, তাঁরা হঠাৎ দেখলেন তাঁদেরকে ১০০টি টোকেন কিনতে ২০০ ডলার খরচ করতে হচ্ছে। কিছু লোক রাগ করে বাড়ি ফিরে গেলেন। আবার কিছু ধনী লোক মেনে নিলেন। কিছু বিক্রেতা তাঁদের সব জিনিস বিক্রি করতে পারলেন না কারণ তাঁদের কিছু খরিদ্দাররা রেগেমেগে বাড়ি ফিরে গেছেন। সব কিছু মিলে লুকাসের এই বিনোদন পার্কে একটি অর্থনৈতিক মন্দা ঘনিয়ে এলো।
এবার এই গল্পটির সঙ্গে ভারতের ২০১৬ সালের আচমকা নোটবন্দির ঘটনাটি মিলিয়ে নিন। সরকার রাতারাতি প্রায় ৮৫% নোট বাতিল ঘোষণা করলেন। এর ফলে ভারতের অর্থনীতিতে ভয়ানক ধ্স নেমেছিল এতো আমাদের সকলের জানা। এই গল্পের থেকে আমরা একটি শিক্ষা পাই যে অপ্রত্যাশিত ভাবে দেশে টাকার সরবরাহ কমালে দেশের মানুষের ক্ষতি হবে। এ সম্বন্ধে পরে আরো আলোচনা করছি।
এই ধরণের গল্প শুধুমাত্র কথায় বললে হবে না। এটির একটি যুক্তিসম্মত ভিত্তি থাকা দরকার। সেই যুক্তিগুলিকে ঠিক ভাবে দাঁড় করাতে গেলে অনেক অঙ্ক কষতে হতে পারে। তাহলেই সেই গল্পটি লোকেরা কিনবে। অর্থাৎ, ভালো অর্থনীতি করতে গেলে সৃষ্টিশীল কল্পনার প্রয়োজন আছে। সেই কল্পনা থেকে একটি ঠাসবুনন গল্প তৈরি হতে পারে যার একটি সমাজকল্যাণমূলক অথচ স্বার্থহীন উদ্দেশ্য থাকবে। এই কাজটি করতে গেলে অনেক কিছু জানতে হবে, যা আমরা আরেক দিকপাল অর্থনীতিবিদের এই কালজয়ী উক্তিটিতে পাই:
The master-economist must possess a rare combination of gifts. He must be mathematician, historian, statesman, philosopher—in some degree. He must understand symbols and speak in words. He must contemplate the particular, in terms of the general, and touch abstract and concrete in the same flight of thought. He must study the present in the light of the past for the purposes of the future. No part of man's nature or his institutions must be entirely outside his regard. He must be purposeful and disinterested in a simultaneous mood, as aloof and incorruptible as an artist, yet sometimes as near to earth as a politician.অর্থাৎ একজন সফল অর্থশাস্ত্রীকে সর্বঘটে কাঁঠালি কলা হতে হবে, তবেই তিনি এ ধরণের টানটান মনোগ্রাহী গল্প লিখতে পারবেন।-John Maynard Keynes
নম্র মার্জিত স্বভাবের মানুষ ছিলেন বব। ২০১১তে মিনিয়াপোলিসে ফেডারাল রিজার্ভে আর একবার দেখা হয়েছিল ববের সঙ্গে। আমেরিকায় প্রতিটি ফেডারাল রিজার্ভ ব্যাঙ্কে একটি অর্থনীতির গবেষণা কেন্দ্র থাকে যেখানে নানারকম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গবেষণা হয়। ফেডারাল রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মিনিয়াপোলিস শাখাটি আমার মতে রীতিমতো তারকাখচিত। নোবেলজয়ী বেশ কিছু অর্থনীতিবিদ সেখানে ঘোরাফেরা করতেন এবং এখনও করেন। সপ্তাহে প্রায় প্রতিদিনই একটি করে সেমিনার হয় যেখানে এই তাবড় তাবড় অর্থনীতিবিদরা বসে থাকেন আর ধারালো সব প্রশ্ন করে বক্তাকে ব্যতিব্যস্ত করেন। বব একদিন আমার অফিসে এসেছিলেন আমি কী নিয়ে কাজ করছি জানতে। শুনতে শুনতে উনি আমায় একটি প্রশ্ন করলেন, কেন আমি আমার মডেলে এই ধরনের অনুমান করছি? আমি সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললাম, বব, এইরকম অনুমান তো অনেকেই করেন। এইটিই তো স্ট্যান্ডার্ড! বব হেসে বললেন, “শোনো, ওই ‘স্ট্যান্ডার্ড’ কথাটি অতি ভয়ানক। মানে তুমি আমাকে বলছো যা সকলে করে আমাকেও তা মেনে নিতে হবে!” সত্যিই তো, এটা তো ভেবে দেখিনি! আজকাল চারপাশে অর্থনীতিবিদদের দেখি পেল্লাই পেল্লাই মডেল তৈরি করছেন উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে বসিয়ে। এ যেন এক ধরনের গড্ডলিকা প্রবাহ! প্রশ্ন করলেই তাঁরা বলেন, এটাই তো স্ট্যান্ডার্ড! এই অভিজ্ঞতার পর থেকে আমি চেষ্টা করি কোন সেমিনার বা বক্তৃতাতে এই 'স্ট্যান্ডার্ড' কথাটি ব্যবহার না করতে। কেউ আমায় কোন মডেলের সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধে কিছু প্রশ্ন করলে আমার দায়িত্ব তাকে বোঝানো কেন এটি আমি করছি? এটিই প্রথা বলে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানো একেবারেই সমীচীন নয়।
বব লুকাসের নোবেল-জয়ী কাজ “ইকোনোমেট্রিক পলিসি ইভ্যালুয়েশন” (Econometric Policy Evaluation)। বব ১৯৭৬এ এই প্রবন্ধটি লিখেছিলেন যার মূল বক্তব্য ছিল, সরকার বা সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক যখন কোন পলিসি বা নীতি পরিবর্তন করে, তখন তাদের ভেবে দেখা উচিত এই পলিসি জনসাধারণের প্রত্যাশা এবং মানসিকতাকে কী ভাবে প্রভাবিত করছে। একটি উদাহরণ দিই। ধরুন সরকার বাহাদুর ১০০ টাকা আয় কর কমালেন এই ভেবে যে জনসাধারণ বেশি খরচ করবেন। খরচ বাড়লে উৎপাদন বাড়বে, দেশের কল্যাণ হবে। কিন্তু জনগণ যদি মনে করেন যে এই আয়কর হ্রাস ক্ষণস্থায়ী, আগামী বছরে আবার আয়কর বেড়ে যাবে, তাঁরা আদৌ বেশি খরচ করবেন না। তাঁরা হয়তো ওই ১০০ টাকার অধিকাংশই সঞ্চয় করবেন, সুতরাং আয়কর কমলেই যে লোকের চাহিদা বাড়বে তার কোন মানে নেই। লোকের প্রত্যাশার ব্যাপারটিকে মাথায় রাখতে হবে। মানুষ এই প্রত্যাশা অতীতে যা ঘটেছে তার ভিত্তিতেই করে। অর্থনীতির ভাষায় এই যুক্তিসঙ্গত প্রত্যাশাকে বলা হয় “র্যাশনাল এক্সপেক্টেশনস” (Rational Expectations) বা যুক্তিগ্রাহ্য প্রত্যাশা। বব লুকাস সামগ্রিক অর্থনীতিতে এই যুক্তিগ্রাহ্য প্রত্যাশাকে মেশালেন। তার ফলে অর্থনীতির চিন্তার জগতে যেন একটি বিপ্লব ঘটে গেল। এই লেখাটি অর্থনীতি মহলে “লুকাস ক্রিটিক” (Lucas Critique) বলে পরিচিত। যে কোন দেশের সরকার এবং সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক এই লুকাস ক্রিটিক মাথায় রেখেই পলিসি পরিবর্তন করেন।
কোন দেশের সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অপ্রত্যাশিত ভাবে টাকার সরবরাহ বাড়ালে বা কমালে, সেই দেশের অর্থনীতিতে কৃত্রিম ভাবে সমৃদ্ধি বা মন্দা সৃষ্টি হতে পারে। এই তত্ত্বটি লুকাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা “এক্সপেক্টেশানস অ্যান্ড দ্য নিউট্রালিটি অফ মানি” (Expectations and the Neutrality of Money)-তে পাই। এই প্রবন্ধটিতে অনেক অঙ্ক কষে বব যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন সেই প্যারাবেলটি আমি আপনাদের আগেই শুনিয়েছি। শিক্ষা হলো যে দেশের সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের পলিসি জনসাধারণকে আগে থেকে না জানিয়ে করলে অর্থনীতিতে অনেক বিশৃঙ্খলা আসতে পারে। এবারের দ্বিতীয় নোটবন্দি মোদী সরকার আগে থেকে জানিয়ে করছেন। নোটবন্দির অনেক সুফল আছে যদি সেটি সঠিকভাবে পরিকল্পিত হয়। এ বিষয়ে আমি এবিপিতে একটি লেখা লিখেছি।
লুকাস ফিনান্স নিয়ে একটি যুগান্তকারী প্রবন্ধ লিখেছেন– "অ্যাসেট প্রাইসেস ইন অ্যান এক্সচেঞ্জ ইকোনমি” (Asset Prices in an Exchange Economy)। এই লেখাটি প্রকাশের আগে ফিন্যান্স আর ইকোনোমিক্স দু'টি আলাদা শাখা ছিল। ফিনান্সের লোকেরা স্টক আর বন্ডের দামের ওঠানামা নিয়ে ভাবতেন। লুকাসের এই লেখাটি আমাদের অবহিত করল যে ফিনান্সের সঙ্গে সামগ্রিক অর্থনীতির একটি ওতপ্রোত যোগাযোগ আছে। দেশের অর্থনীতির যখন উন্নতি হয় স্টকের দাম বাড়ে। এর কারণ বুঝতে গেলে ফিনান্স আর অর্থনীতিকে আলাদা করে ভাবলে চলবে না। একটি নতুন শাখার জন্ম দিলেন লুকাস যার নাম হল ম্যাক্রোফিনান্স। এ নিয়ে এখন রাশি রাশি প্রবন্ধ ছাপা হচ্ছে যার ভিত্তি ১৯৭৮ সালের ববের লেখা এই প্রবন্ধটি।
বব অর্থনীতির দুনিয়ায় আরও একটি শাখার চরিত্র আমূল বদলে দিয়েছেন যাকে আমরা বলি উন্নয়ন অর্থনীতি বা ডেভলপমেন্ট ইকোনমিক্স। ১৯৮৮ সালে বব লিখলেন "অন দ্য মেকানিক্স অফ ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট” (On the mechanics of economic development)। মূল প্রশ্ন হল ধনী আর গরীব দেশের মধ্যে জাতীয় আয়ের ফারাক এত বেশি কেন? ধনী দেশগুলি কী এমন আহামরি কিছু করছে যা গরিব দেশে হয় না? লুকাস এখানে মানবসম্পদ বা হিউম্যান ক্যাপিটাল এবং শিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করলেন। উৎপাদন করতে শুধুমাত্র যন্ত্র আর শ্রম দিলেই হবে না। যন্ত্র, শ্রম ছাড়া উদ্ভাবনী শক্তিরও প্রয়োজন আছে। একটি বৃদ্ধির মডেল তৈরি করে লুকাস দেখালেন যে দু'টি দেশের বৃদ্ধির হার ভিন্ন হবে যদি উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ দেশ দু'টিতে আলাদা হয়। লুকাসের এই লেখাটির ভিত্তিতে ম্যাক্রোকোনমিক্সে আরও একটি নতুন শাখার জন্ম হলো, যার নাম ম্যাক্রো-ডেভেলপমেন্ট। উন্নয়নশীল দেশের বহু ছাত্র-ছাত্রী এই লেখাটির পদাঙ্ক অনুসরণ করে কাজ করে যাচ্ছেন।
চেন স্মোকার ছিলেন বব। ধূমপান কম করলে হয়তো আরও বেশিদিন থাকতেন এই পৃথিবীতে। অর্থনীতি বিষয়টি ওঁর হাত ধরে আরও সমৃদ্ধ হতো।
*********
এডওয়ার্ড প্রেসকট (১৯৪০ - ২০২২)
এবারে এড প্রেসকট সম্বন্ধে কিছু বলি। লুকাস আর এড প্রেসকট একই মৌলিক নীতি নিয়ে তাঁদের চিন্তার ডালপালা বিস্তার করেছিলেন। সেই নীতি হল আবার সেই র্যাশনাল এক্সপেক্টেশন। বেশ কিছু প্রবন্ধ দু’জনে মিলে লিখেছেন। প্রেসকটের দু’টি নোবেল-জয়ী রচনা, “টাইম টু বিল্ড অ্যান্ড এগ্রিগেট ফ্লাকচুয়েশান” (Time to Build and Aggregate Fluctuations” আর “রুলস রাদার দ্যান ডিস্ক্রিশান: দ্য ইনকনসিস্টেন্সি অফ অপটিমাল প্ল্যানস” (Rules Rather than Discretion: The Inconsistency of Optimal Plans), এই দু’টি লেখা ফিন ই. কিডল্যান্ড (Finn E. Kydland)-এর সঙ্গে। দু’জনে নোবেলটি তাই ভাগ করে নিলেন।
প্রথম প্রবন্ধের তত্ত্বটি হলো, অর্থনৈতিক ওঠানামার মূল কারণ উৎপাদনভিত্তিক। এই তত্ত্বটি অর্থনীতিতে “রিয়েল বিজ়নেস সাইকেল থিওরি” (Real Business Cycle Theory) নামে পরিচিত। কোনো কারণে যদি কোনো দেশের উৎপাদন ব্যবস্থায় হঠাৎ একটি আঘাত লাগে, তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে পারে। উৎপাদন কমার জন্য মানুষ বেকার হয়ে গেলে জিনিসপত্রের চাহিদা কমে একটি অর্থনৈতিক মন্দার অবস্থা তৈরি করতে পারে। প্রেসকট আর কিডল্যান্ডের এই তত্ত্বটি সাধারণ বোধ থেকে উদ্ভূত মনে হতে পারে। তবে এই তত্ত্বের সঙ্গে পুরোনো কিন্সিয় (Keynesian) তত্ত্বের একটি মৌলিক দার্শনিক তফাৎ আছে। কিন্স মনে করতেন অর্থনৈতিক ওঠানামা প্রধানত চাহিদা নির্ভর। দেশে জিনিসপত্রের চাহিদার ঘাটতি হলে উৎপাদন কম হবে আর তার থেকে মন্দার কালো মেঘ জমবে। প্রেসকট মনে করেন সমস্ত অর্থনৈতিক সমস্যা উৎপাদনকেন্দ্রিক। এ ব্যাপারে এড ২০০ বছর পূর্বের ফরাসি অর্থশাস্ত্রী জে. বি. সে (J. B. Say) পদাঙ্ক (“Supply creates its own demand”) অনুসরণ করেছেন। ফিন আর এড তাঁদের প্রবন্ধটিতে একটি গাণিতিক অর্থনীতির মডেলের সাহায্যে প্রমাণ করেছেন এই উৎপাদন ভিত্তিক তত্ত্বটি। মডেলটিকে মার্কিন দেশের সামগ্রিক পরিসংখ্যানের সঙ্গেও সফলভাবে মিলিয়েছেন। এই কাজটি অনেক অর্থনীতিবিদদের কাছে পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে। এ সত্ত্বেও অনেক অর্থনীতিবিদ পরে প্রশ্ন করেছেন এই উৎপাদনে আঘাতের উৎস নিয়ে। অর্থনীতির উপর একটি খারাপ ধাক্কা আসতে পারে এমন কিছু থেকে যার উপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। উদাহরণ হিসেবে ধরুন কোভিড। এক্ষেত্রেও করোনাউত্তর যে মন্দা সারা বিশ্বব্যাপী এসেছে, তার গভীরতা সরকারি স্বাস্থ্যনীতির উপর নির্ভর করে। ভারতের ক্ষেত্রে সরকার লক ডাউন, ভ্যাকসিন প্রকল্প, ইত্যাদি সঠিক ভাবে রূপায়ণ করলে হয়তো অতিমারি এতো ভয়াবহ চেহারা নিতো না। অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতিও হয়তো অনেক কম হতো। অনেকেক্ষেত্রে অর্থনীতিতে খারাপ ধাক্কা সম্পূর্ণ ভাবে ভুল সরকারি নীতি থেকে হতে পারে। ভারতের ক্ষেত্রে ২০১৬র আকস্মিক নোটবন্দির কথাতো আগেই উল্লেখ করেছি। প্রেসকট এ বিষয় নিয়ে টিমোথি জে. কিহো (Timothy J. Kehoe)-র সঙ্গে তাঁর লেখা “গ্রেট ডিপ্রেশনস অফ দ্য টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি” প্রবন্ধটিতে লিখেছেন কী ভাবে মার্কিন সরকারের এবং সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের ভুল নীতির জন্য সেই দেশে একাধিক মন্দা হয়েছিল।
উল্টোদিকে কোনো কারণে যদি দেশে উদ্ভাবনশক্তির হঠাৎ বিকাশ হয়, তবে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠতে পারে। বিল গেটসের আই টি বিপ্লবের পর মার্কিন দেশের অর্থনীতিতে জোয়ার এসেছিলো ১৯৯০এর প্রথমে। তবে সব আই টি উদ্ভাবনই যে মানুষের পক্ষে কল্যাণকর তা বলা কঠিন। সাম্প্রতিক কালের কৃত্রিম বুদ্ধিদানব কি ক্রমশ ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানব হয়ে উঠবে? এ বিষয়ে অবশ্য এড কিছু লিখেছেন বলে জানি না। একমাত্র সময়ই আমাদের বলতে পারবে।
দ্বিতীয় লেখা, ১৯৭৭ সালের “রুলস রাদার দ্যান ডিস্ক্রিশান”-এর মূল প্রতিপাদ্য হল সরকারি পলিসি ঘন ঘন পরিবর্তন হলে সমাজের জন্য তা অকল্যাণকর। উদাহরণস্বরূপ ধরুন, সরকার বললেন এখন থেকে ব্যবসায় মুনাফার ওপর কর শূন্য হয়ে যাবে। এই নীতি ঘোষণা হওয়ার পরে, কারখানায় মালিকরা অনেক বিনিয়োগ করলেন, অনেক নতুন মেশিন কিনলেন। যেই মেশিনগুলি কেনা হলো, সরকার নীতি পরিবর্তন করে বাণিজ্য কর বাড়িয়ে দিলেন এই ভেবে যে মালিকরা বিনিয়োগ তো করেই ফেলেছে, মেশিনগুলি তো আর ফেলে রাখবে না! সরকারের এই ধরনের সুবিধাবাদী নীতি (যাকে বলে ডিস্ক্রিশান), মালিকরা কিন্তু আগে থেকেই টের পেয়ে যান। তার ফলে তাঁরা এই শূন্য করের নীতি আদৌ বিশ্বাস করবেন না এবং বিনিয়োগও করবেন না। সরকারি নীতির উপর এই বিশ্বাসভঙ্গের ফলে ভবিষ্যতে পলিসিগুলির প্রভাব ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবে।
প্রেসকট অসংখ্য মনোগ্রাহী প্রবন্ধ লিখেছেন। রাজনিশ মেহরার সঙ্গে লেখা একটি প্রবন্ধ, “দ্য ইকুইটি প্রিমিয়াম: আ পাজ়ল” (The Equity Premium: A Puzzle) শেয়ার বাজারের একটি ধাঁধা নিয়ে। ধাঁধাটি হলো আমেরিকায় একশো বছরে শেয়ারে রিটার্নের হার সরকারি ঋণপত্রের সুদের হারের থেকে এতো বেশি কেন? লেখাটি প্রকাশ হয়েছিল ১৯৮৫ সালে। এই ধাঁধাটি নিয়ে অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা হয়েছে কিন্তু সন্তোষজনক কোন সমাধান এখনও পাওয়া যায়নি। এই ধাঁধা আরো কয়েকটি নতুন মৌলিক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে যা নিয়ে সারা বিশ্বের অর্থনীতিবিদরা এখনও চিন্তা করছেন।
খামখেয়ালি মানুষ ছিলেন প্রেসকট। ১৯৯৬ সালে আমি ফেডারল রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ম্যাক্রোইকোনমিক্স গবেষণা শাখায় এক মাস কাটানোর সুযোগ পেয়েছিলাম। একদিন বিকেলে হঠাৎ এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক আমার কিউবিকলে হাজির। স্বল্পকেশ ব্যক্তিটি আমার দিকে ধারালো চোখে তাকালেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কী নিয়ে কাজ করছ এত? এই ব্যক্তিটি আর কেউ নন, স্বয়ং এডওয়ার্ড প্রেসকট। আমি তখন সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের পলিসি নিয়ে কিছু চিন্তাভাবনা করছিলাম। আমতা আমতা করে দু-একটি কথা বললুম আমার এক পয়সা কাজ সম্বন্ধে। এড প্রেসকট মন দিয়ে শুনলেন, তারপর বললেন, এসব কাজ করে কী হবে? কেউ তোমার এই কাজে উৎসাহী হবে বলে তো আমার মনে হয় না! শুনে আমার ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল। মুখ ঝুলে পড়ল হতাশায়। প্রেসকট তখন আমাকে একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকলেন। আমার চিন্তাগুলিকে যেন ধারালো ছুরি দিয়ে কেউ ফালি ফালি করে কাটছে মনে হচ্ছিল। তারপর সেই কাটা টুকরোগুলিকে আবার জোড়া লাগাতে শুরু করলেন। আধঘন্টা কথা বলে প্রেসকট হনহন করে হেঁটে চলে গেলেন। আমার মাথাটা প্রথমে ধোঁয়াটে হয়ে গেল, তারপর আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম প্রেসকট সাহেব কী বলতে চাইছেন। আমার গবেষণার ধারাটিকে আমূল বদলে একটি নতুন দৃশ্যপট রচনা করে আমাকে নতুনভাবে ভাবতে শেখালেন প্রেসকট।
মিনিয়াপোলিসে প্রতিবছর গ্রীষ্মে একটি ম্যাক্রোইকোনমিক্স সম্মেলন হতো। কোভিদের পরে এখন সেটি আবার শুরু হয়েছে। আমি বেশ কয়েকবার গিয়েছি। নব্বই দশকের শেষে এই সম্মেলনের একটি বৈকালিন পার্টিতে এড একটি পানীয় হাতে নিয়ে ঘন ঘন পায়চারি করছেন আর বিড়বিড় করে বলছেন, কোনো মানে হয় না গ্রেট ডিপ্রেশনের সময়ে সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের এই ধরণের অর্থহীন পলিসি, কোনো মানে হয় না! আরেকজন নামী অর্থনীতিবিদ বয়ান জোভানোভিচ (Boyan Jovanovic), প্রেসকটকে জিজ্ঞেস করলেন, কী মানে হয় না এড? তারপর দু’জনের মধ্যে কী কথা হলো তা আমার মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে গেলো। এই ঘটনার অনতিকাল পরে প্রেসকটের একটি ওজনদার প্রবন্ধ বেরোলো টিম কিহো (Timothy Kehoe)-র সঙ্গে, “গ্রেট ডিপ্রেশনস অফ দ্য টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি” (Great Depressions of Twentieth Century)। মূল বক্তব্য হলো বিভিন্ন দেশের গভীর অর্থনৈতিক মন্দার মূল কারণ সরকারের নানারকম উৎপাদন বিরোধী নীতি। এই একই বিষয় নিয়ে প্রেসকট একটি বই লিখেছেন স্টিফেন প্যারেন্টে (Stephen L. Parente)-র সঙ্গে, “ব্যারিয়ারস টু রিচেস” (Barriers to Riches)। বিভিন্ন ধরণের সরকারি নিয়মের বেড়াজাল একটি দেশের সমৃদ্ধির প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এড প্রেসকট সম্বন্ধে একটি মজার গল্প শুনেছি বন্ধুদের কাছে। যেদিন তিনি নোবেল প্রাইজটি পেলেন সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, হানি, আমি আজ নোবেল পেয়েছি। আজও কি আমাকে গারবেজ ফেলতে হবে? প্রেসকট পত্নী নাকি মিষ্টি হেসে বলেছিলেন, হ্যাঁ সুইটহার্ট! ঘটনাটির সত্যতা জানিনা তবে বিশ্বাস করতে ভালো লাগে যে এই কালজয়ী পণ্ডিত ব্যক্তিরাও রক্ত মাংসেরই মানুষ। সাফল্য এঁদের মাথায় গিয়ে ভর করেনি।
বব লুকাস এবং এড প্রেসকটের অর্থনীতিতে যে এক সমুদ্র অবদান তা এই স্বল্প পরিসরে ধরতে চাওয়া ধৃষ্টতার সামিল। আমি বব লুকাস বা এড প্রেসকটের ছাত্র ছিলাম না। এঁদের বহু দূর থেকে দেখেছি, এঁদের বেশ কিছু লেখা মন দিয়ে পড়েছি। বহু লেখা এখনও পড়া হয়ে ওঠেনি। লুকাস ও প্রেসকট ম্যাক্রোঅর্থনীতির জগতে এক একটি বিশাল মহীরুহ। এঁরা চলে গেলেন কিন্তু এঁদের অভিনব চিন্তা আর পদ্ধতি বহুদিন ম্যাক্রোঅর্থনীতিবিদদের ব্যস্ত রাখবে। যুগান্তকারী কাজ এইরকমই হয়। মানুষগুলি চলে যান কিন্তু তাঁদের কাজ অমর হয়ে থাকে।
************
ঋণ স্বীকার:
লেখাটি যত্ন করে সম্পাদনা করার জন্য কবিবন্ধু অধ্যাপক মহুয়া সেনগুপ্তকে কৃতজ্ঞতা। ত্রুটিবিচ্যুতি অবশ্যই আমার নিজের।