‘কলোনি’ শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘কলোনিয়া’ (colōnia) থেকে। ‘কলোনিয়া’ শব্দটির অর্থ এরকম – ‘খামার বা ভূমি-সম্পত্তি যা রোমান সাম্রাজ্যের নতুন বিজিত বা অধিকৃত অঞ্চলগুলিতে অবস্থিত ছিল এবং রোমান নাগরিকদের যাদের বেশিরভাগই ছিল অভিজ্ঞ-সৈনিক তাদের মূলত উপহার হিসাবে দেওয়া হয়েছিল। অন্যথায়, প্রতিকূল অঞ্চলে এই ধরনের রোমান উপনিবেশ স্থাপন দখলকৃত জমির উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করে এবং রোমের বিভিন্ন উপনিবেশগুলির মধ্যে লন্ডন ছিল অত্যন্ত বিশিষ্ট।’ বোঝাই যাচ্ছে ‘কলোনিয়া’র অর্থের সঙ্গে রোম-সাম্রাজ্যের ইতিহাস জড়িত। একটা জিনিস আরো স্পষ্ট যে, ঔপনিবেশিকরণ প্রক্রিয়াটি হিংসাত্মক হতে বাধ্য কারণ প্রক্রিয়াটির মধ্যে জোর করে অন্যের জমি দখল করার ও সেই অঞ্চলের সম্পদ ব্যবহার করার একটা ব্যাপার আছে, যে জমি ও সম্পদ অন্য দেশের অন্য অঞ্চলের মানুষের। ‘উপনিবেশ’ বা ‘কলোনি’-গুলি তার মানে হিংস্রতা ও অশান্তির কেন্দ্র ছিল। সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উপনিবেশের প্রভাবের কথা পূর্বে যে উল্লিখিত হয়েছে, একটু ভাবলেই বোঝা যাবে এর মধ্যে বিমূর্তভাবে মিশে আছে ঔপনিবেশিক-হিংস্রতা এবং মূলগত ভাবে শারীরিক নির্যাতনের বাস্তবতা। শারীরিক নির্যাতন তাই উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা ও উপনিবেশ ধরে রাখার প্রাক-শর্ত। ইতিহাসে এর অজস্র উদাহরণ আছে। বিতর্ক থাকলেও প্রথম আধুনিক উপনিবেশ বলা হয় পুয়ের্তো রিকো-কে। ১৪৯৩ সালের নভেম্বর মাসে ক্রিস্টোফার কলম্বাস যখন পুয়ের্তো রিকোতে অবতরণ করেন তখন টাইনো ইন্ডিয়ানরা ঐ দ্বীপের বাসিন্দা। এর পরেই, পুয়ের্তো রিকো একটি স্প্যানিশ উপনিবেশে পরিণত হয় এবং চারশো বছরেরও বেশি সময় ধরে সেখানে স্প্যানিশ শাসন বলবৎ ছিল। পনের ও ষোড়শ শতাব্দীতে স্প্যানিশ ও পর্তুগীজ সাম্রাজ্যের যাদের ‘স্প্যানিশ কনকুইস্টাডোর’ বলা হত তাদের নিধন-যজ্ঞে তৎকালীন আমেরিকা, ওশেনিয়া, আফ্রিকা ও এশিয়া মিলিয়ে তাদের অধিকৃত অঞ্চলে স্থানীয় জনসংখ্যার পরিমাণ পঞ্চাশ লক্ষ থেকে কমে তিন লক্ষে পরিণত হয়। ঔপনিবেশিক বর্বরতার টাইম-লাইন ধরে এগোতে থাকলে ব্রিটিশদের দৌলতে একসময় আমাদের দেশের কথাও এসে পড়বে। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের পৃথিবীর মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখতে পাবো, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে রয়েছে গোটা দক্ষিণ এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, আফ্রিকার বিস্তৃত অঞ্চল এবং কানাডা! এই বিস্তৃত অধিকৃত অঞ্চলের ঔপনিবেশিক মা বা মাদার কান্ট্রি বা মেট্রোপলিস ছিল তুলনায় অতি-ক্ষুদ্র ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ। মজার ব্যাপার হল রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ঔপনিবেশিক মেট্রোপলিস লন্ডন একসময় নিজেই ছিল উপনিবেশ। অর্থাৎ, উপনিবেশ বা সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাস প্রকৃত-প্রস্তাবে মানব-সভ্যতার এক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা ইতিহাসের পাঠক্রম। কিন্তু উত্তরঔপনিবেশিক চর্চার পরিসরে সেই ঔপনিবেশিকতাই বিবেচ্য যা ষোড়শ শতাব্দীতে শিল্প-বিপ্লবের নিগড়ে পল্লবিত হতে শুরু করে। তার মানে যার সঙ্গে পুঁজি ও মুনাফার গভীর সম্পর্ক আছে, কারণ উপনিবেশগুলি উপনিবেশকারীদের কাছে সস্তায় কাঁচা-মালের আড়ত ছাড়া আর কিছুই ছিল না। উপনিবেশগুলি থেকে সস্তায় কাঁচা মাল (এই কাঁচা মালের মধ্যে মানুষও পড়ে) ঔপনিবেশিক ক্ষমতা-কেন্দ্রগুলিতে নিয়ে গিয়ে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে (+উপনিবেশের মানুষ বা সস্তার শ্রম) সেখানে দ্রব্য উৎপাদন করে সেগুলি আবার চড়া দামে উপনিবেশগুলিতেই বিক্রি করা, এই ছিল উপনিবেশ ও পুঁজিবাদের নীরব বোঝাপড়া! ঔপনিবেশিক-উত্তরঔপনিবেশিক, এই নিরবচ্ছিন্ন পর্যায়-পরম্পরায় উপনিবেশের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার প্রাক-শর্ত ছিল অর্থনৈতিক দখলদারি। ঔপনিবেশিকতার এক বিশেষ ধরনের বয়ানের নির্মিতি এবং তার ধারাবাহিকতা হিসেবে একটি কাহিনিচিত্র ও দুটি তথ্যচিত্রে উত্তরঔপনিবেশিক বয়ানের প্রকাশ, এই নিয়ে কিছু আলোচনা হবে আমাদের উদ্দেশ্য।
বয়ান শব্দটির অর্থ হল ‘কোনো বিষয় নিয়ে মৌখিক বা লিখিত অর্থবহ বাক্য’। বলার ও লেখার স্বাধীনতার ভাবনা গণতান্ত্রিক যুগে মানুষের মনে হঠাৎ করে আবির্ভূত হয়েছিল এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। বলার ও লেখার অবাধ স্বাধীনতার ভাবনা বহুদিনের। কিন্তু মুশকিল হল খাতায়-কলমে এই স্বাধীনতা থাকলেও ফরাসী দার্শনিক মিশেল ফুকো (১৯২৬-১৯৮৪) দেখিয়েছেন, গভীরে নিহিত কতকগুলি রেগুলেশান চিরকালই এই বয়ানকে গঠন, নিয়ন্ত্রণ ও প্রচলন করেছে। ফুকো তিনটি রেগুলেশানের কথা বলেছিলেন – ১) ট্যাবু, ২) সুস্থতা ও পাগলামির মধ্যে পার্থক্য এবং ৩) প্রাতিষ্ঠানিক অনুমোদন। প্রথম দুটি নিয়ে আলোচনার সুযোগ এই লেখায় নেই। আমরা কথা বলব তৃতীয়টি নিয়ে। একটু চিন্তা করলেই দেখা যাবে, আমাদের জানার বা জ্ঞান-আহরণের প্রক্রিয়াটি এবং সেই মত অর্থপূর্ণ কোনো কথা বলা বা কোনো কিছু লেখা সবসময় কিছু প্রতিষ্ঠান-কর্তৃক পরিচালিত হয়। এই প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে পড়ে বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, সংবাদ-প্রতিষ্ঠান, সুশীল সমাজ, প্রকাশনা সংস্থা, বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি ইত্যাদি। আজ যদি কেউ মন্তব্য করেন, যেমন সাম্প্রতিক অতীতে কার্তিক চন্দ্র পাল (কে সি পাল) বলেছিলেন, “সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে”, তাহলে একে বয়ান বলা যাবে না। কিন্তু ক্লডিয়াস টলেমিয়াস (খ্রি: ১০০-১৭০) যিনি টলেমি নামে পরিচিত ছিলেন, দ্বিতীয় শতকে এই বয়ানটিই রচনা করেছিলেন। টলেমির জিওসেন্ট্রিক মডেল অনুযায়ী এরপর প্রায় তেরশো বছর পৃথিবীর মানুষের ধারণা ছিল পৃথিবীকে কেন্দ্রে রেখেই গোটা বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড চারপাশে চক্কর খাচ্ছে! বলা বাহুল্য এই ধারণা প্রতিষ্ঠান-সমর্থিত (মূলত চার্চ) ছিল বা অন্যভাবে বললে প্রতিষ্ঠানগুলি মনে করেছিল এই ভাবনা মনোলিথিক খ্রিস্টধর্মের জেনেসিসের অনুপন্থী হওয়ায় বয়ান হিসেবে এর প্রতিষ্ঠা ও প্রচার ন্যায্য। নিকোলাস কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩), টাইকো ব্রাহে (১৫৪৬-১৬০১) এবং জোহান্স কেপলার (১৫৭১-১৬৩০), প্রায় তেরশো বছর বাদে হেলিওসেন্ট্রিক মডেল অর্থাৎ পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহই আসলে সূর্যের চারিদিকে পাক খাচ্ছে এই সত্য প্রতিষ্ঠা করেন। এই নতুন বিশ্ব-ভাবনাকে বয়ান হিসেবে সমর্থন ও প্রচার করতে গিয়ে চার্চ নামক তদানীন্তন নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের হাতে গ্যালিলিও গ্যালিলি (১৫৬৪-১৬৪২) এবং জিওর্দানো ব্রুনো-র (১৫৪৮-১৬০০) কি দশা হয়েছিল তা বহুল প্রসিদ্ধ। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানগুলি কিছু বিবৃতিকে প্রাধান্য দিয়ে বয়ান হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ও প্রচার করে এবং সত্যাসত্যের তোয়াক্কা না করে উল্টো বিবৃতি বা তাদের অপছন্দের বিবৃতির নির্মমভাবে কণ্ঠরোধ করতেও তারা কিছুমাত্র পিছপা হয় না। আর সমাজে যেহেতু ক্ষমতার অসামঞ্জস্য বিদ্যমান তাই অধিক ক্ষমতাধারী প্রতিষ্ঠানের হাতেই থাকে কোনো একটি বিবৃতির বয়ান হিসেবে নির্বাচন, স্বীকৃতি ও প্রচার।
এইজন্য ফুকো বলেছিলেন ক্ষমতা ও জ্ঞান আন্তঃসম্পর্কিত। থমাস ব্যাবিংটন ম্যাকাওলের (১৮০০-১৮৫৯) ২রা ফেব্রুয়ারি, ১৮৩৫ সালে প্রদত্ত ‘মিনিটস আপন ইন্ডিয়ান এডুকেশন’-এর কথা ভাবুন। থমাস ব্যাবিংটন ম্যাকাওলে ছিলেন গভর্নর-জেনারেল’স কাউন্সিলের প্রথম ল মেম্বার, যে কাউন্সিলের কাজ ছিল ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাজকর্ম তদারকি করা। ম্যাকাওলে স্বীকার করেছিলেন যে তিনি এক বর্ণও সংস্কৃত বা আরবি ভাষা জানতেন না। কিন্তু সেসব বিন্দুমাত্র না জেনে মিনিটস-এ তিনি লেখেন,
… a single shelf of a good European library was worth the whole native literature of India and Arabia. Honours might be roughly even in works of the imagination, such as poetry, but when we pass from works of imagination to works in which facts are recorded, and general principles investigated, the superiority of the Europeans becomes absolutely immeasurable.… আজকের দিনে শুনলে মনে হবে পাগলের প্রলাপ। কিন্তু সেই যুগে এই বক্তব্যকে যথেষ্ট গুরুত্ব-সহকারে দেখা হয়েছিল কারণ ম্যাকাওলে আসলে ছিলেন ক্ষমতাশালী উপনিবেশকারীদের মুখ যাদের পিছনে বিপুল আর্থিক ও সামরিক আনুকূল্য ছিল। বুঝতে অসুবিধে হয় না, সে যুগেরই কোনো সংস্কৃত বা আরবি পণ্ডিতকে দিয়ে যদি ব্যাপারটা বিবেচনা করে দেখা হত তাহলে তাদের অভিমত হত যথেষ্ট আলাদা। কিন্তু তা হয় নি যেহেতু উপনিবেশকারীরাই ছিলেন নিরঙ্কুশ ক্ষমতাশালী। মজা হল ক্ষমতা জ্ঞানকে প্রভাবিত করে এটা যেমন সত্যি, এর উল্টোটা অর্থাৎ জ্ঞানও ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে, এটাও একই ভাবে সত্যি। তাই ম্যাকাওলের চরম অবমাননাকর এই বক্তব্যকে খাঁটি সত্য বলে বা বয়ান বলে মেনে নিয়ে একে অ্যাক্টে পরিণত করা হয়। শিক্ষায় আর্থিক অনুদানের সম্পূর্ণটাই ব্যয় করা হয় ইংরেজি শিক্ষার পিছনে এবং সংস্কৃত ও ফার্সি ভাষায় শিক্ষা প্রদানের প্রতিষ্ঠানগুলিকে যাবতীয় আর্থিক সাহায্য থেকে করা হয় বঞ্চিত। চিন্তাশীল মানুষ মাত্রই বুঝবেন, এর ফল হয়েছিল সুদূর-প্রসারী। ঔপনিবেশিক ক্ষমতা যা ষোড়শ শতাব্দীর শিল্প-বিপ্লবের পর থেকে একটু একটু করে বিস্তার লাভ করতে শুরু করে, দেখা যায় এশিয়াতে তা এক বিশেষ ধরনের বয়ানের সঙ্গে নিবিড় ভাবে সম্পৃক্ত। একে এডওয়ার্ড সাঈদ (১৯৩৫-২০০৩) ‘ওরিয়েন্টালিজম’ বা 'প্রাচ্যবাদ' বলেছিলেন। ‘ওরিয়েন্টালিজম’ হল ওরিয়েন্ট বা ইউরোপের পূর্ব-দিকের ভূখণ্ড অর্থাৎ এশিয়া নিয়ে ইউরোপীয়দের এক বিশেষ ধরনের বয়ানের নির্মিতি যার মাধ্যমে ঐ উপনিবেশায়ন-কে ন্যায্যতা প্রদান করা যায়! সাঈদ দেখিয়েছিলেন পঞ্চম শতাব্দীর গ্রিক নাট্যকার এস্কাইলাস থেকে শুরু করে হাল আমলের লর্ড বায়রন, জেরার্ড ডি নার্ভাল, গুস্তাভ ফ্লবেয়ার বা জোসেফ কনরাড প্রত্যেকেই এই বয়ান নির্মাণের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন, যা আসলে প্রাচ্যের উপর পাশ্চাত্যের আধিপত্যকে সঠিক হিসেবে বিবেচনা করে। বলা বাহুল্য পাশ্চাত্যের আর্থিক ও সামরিক আধিপত্যের সঙ্গেও এই বয়ান সংশ্লিষ্ট। মনে রাখতে হবে এই বয়ান নির্মিত ও লালিত হয়েছিল ইউরোপের ঔপনিবেশিক মেট্রোপলিসগুলিতে, উপনিবেশগুলিতে নয়। ‘ওরিয়েন্টালিজম’ হল সাঈদের ভাষায় – “Discourse about the Orient associated with the military and economic domination of the Orient by Europe.” 'ওরিয়েন্টালিজম'-ই ঔপনিবেশিকতার ধারাবাহিকতা হিসেবে উত্তরঔপনিবেশিক ধারণার অন্তঃস্থল।
১৯৪৮-৪৯ সাল নাগাদ ফ্রান্সের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার জাঁ রেনোয়া (১৮৯৪-১৯৭৯) কলকাতায় আসেন রুমের গডেনের আত্মজৈবনিক উপন্যাস থেকে 'দি রিভার' (১৯৫১) ছবির শুটিং করতে। সত্যজিৎ রায় (১৯২১-১৯৯১) রেনোয়ার সঙ্গে প্রায় প্রতিদিন সাক্ষাৎ করতেন এবং রেনোয়া-র প্রতিদিনের কাজ নিয়ে 'সিকোয়েন্স' পত্রিকায় লিখতেন, যা পরে 'কলকাতায় রেনোয়া' নামে প্রসিদ্ধ হয়। মার্টিন স্করসেসি (১৯৪২-) জানিয়েছেন যখন তাঁর ন-বছর বয়স, তাঁর বাবা তাকে ‘দি রিভার’ দেখাতে নিয়ে যান। তিনি আজও মনে করেন রেনোয়ার ‘দি রিভার’ এবং এমেরিক প্রেস বার্গার (১৯০২-১৯৮৮) ও মাইকেল পাওয়েল (১৯০৫-১৯৯০) পরিচালিত ‘দি রেড শুস্’ (১৯৪৮) হল আজ পর্যন্ত নির্মিত সবথেকে সুন্দর দুটি রঙিন চলচ্চিত্র। এসবই ঠিক আছে, কিন্তু মুশকিল হয় আমরা যখন ছবির ভারতীয় চরিত্রগুলির দিকে একটু ভালো করে তাকাই। ‘দি রিভার’ ছবির চিত্রনাট্য শুনে সত্যজিৎ রেনোয়াকে ভারতীয় লিড চরিত্রের অভাবের ব্যাপারে প্রশ্ন করেছিলেন। প্রশ্নটি রেনোয়ার মনে ধরে, তিনি সহ-চিত্রনাট্যকার গডেনের সঙ্গে পরামর্শ করে ছবিতে কিছু ভারতীয় চরিত্র ঢুকিয়েছিলেন। ‘হত-দরিদ্র রোগা আধপেটা খাওয়া অর্ধউলঙ্গ’, এটাকে সাধারণ বৈশিষ্ট্য ধরে নিয়ে ‘দি রিভার’ ছবির ভারতীয় চরিত্রগুলির যদি একটি তালিকা বানাই, তাহলে তাতে থাকবে – ১) গঙ্গাতীরবর্তী মাঝি-মাল্লাদের দল ২) জুট-মিলের কর্মীরা ৩) গঙ্গাতীরবর্তী দোকানদার ৪) সাধারণ নারী-পুরুষ ৫) বাচ্চা ছেলে-মেয়ে ৬) সাধু-সন্ত ৭) সাপুড়ে ৮) দুটি ইংরেজ পরিবারে কর্মরত বেশ কিছু বেয়ারা যাদের মধ্যে অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুও আছে।
এছাড়া আছে একজন ইংরেজি জানা ভারতীয় আয়া, একজন শিখ দারোয়ান, মিঃ জনের মেয়ে মেলিনির প্রেমিক অনিল এবং মিঃ জনের মেয়ে শীর্ণকায় মেলিনি যার মা ছিল ভারতীয়। যাবতীয় বৈশিষ্ট্যের বিচারেই এদের তীক্ষ্ণ বৈপরীত্যে দাঁড়িয়ে আছে প্রাপ্ত থেকে অপ্রাপ্তবয়স্ক সবকটি ইংরেজ নারী-পুরুষ। তাদের মধ্যে আছে জুট মিলের ইন-চার্জ, তার সুন্দরী স্ত্রী, চার মেয়ে (হ্যারিয়েট ও অন্যান্য) ও এক ছেলে (বোগি), জুট মিলের মালিকের মেয়ে ধনী ভ্যালেরি, প্রতিবেশী মিঃ জন এবং মিঃ জনের আত্মীয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এক-পায়ে আঘাত-প্রাপ্ত আমেরিকান ক্যাপ্টেন জন। ভারতীয় এবং ইংরেজ, এরা দুজনে মিলে যেন তৈরি করেছে এক ধরনের ধারণাগত যুগ্ম যা প্রতিপন্ন করে রুডইয়ার্ড কিপলিং (১৮৬৫-১৯৩৬)-এর ভাষায়, “East is east and west is west and never shall the twin meet.” বোঝাই যাচ্ছে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের এই ধরনের ধারণাগত বিপরীত বিভাজন আসলে ভৌগোলিক সীমাকে সূচিত করে না, সূচিত করে সাংস্কৃতিক অভ্যাসকে যার মধ্যে পড়ে খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, শারীরিক-বৈশিষ্ট্য, শরীরী-ভাষা এবং এমনকি নৈতিক আচরণও। এই ধারণাগত যুগ্ম আসলে মিউচুয়ালি এক্সক্লুসিভ, অর্থাৎ পাশ্চাত্য যা কিছু চিত্রিত করে, প্রাচ্য ঠিক তার বিপরীতটা চিত্রিত করে। পাশ্চাত্য যদি ম্যাস্কুলানিটির পক্ষে দাঁড়ায় তাহলে প্রাচ্য বিপরীতে ফেমিনিন সত্তা, পাশ্চাত্য যদি প্রাপ্তবয়স্কতার প্রতিনিধিত্ব করে তাহলে প্রাচ্য বিপরীতে ছেলেমানুষির প্রতিনিধি হয়ে যাবে, পাশ্চাত্য যদি নিজেকে সভ্যতার চূড়া ছুঁয়েছে বলে মনে করে তাহলে প্রাচ্য অবশ্যই সাংস্কৃতিক ও নৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা চরম বর্বর হিসেবে প্রতিভাত হবে! এডওয়ার্ড সাঈদের মতে এই ধরনের চিন্তন-প্রণালীর ভিতর দিয়েই ‘ওরিয়েন্টালিজম’ বা প্রাচ্য সম্বন্ধে বয়ান নির্মিত হয়। পঞ্চম শতাব্দীর গ্রিক ট্র্যাজেডির সময় থেকেই তাঁর মতে পাশ্চাত্যের ধারণায় প্রাচ্য শুধুমাত্র এশিয়া নামক ভূখণ্ড নয়, প্রাচ্য হল পাশ্চাত্য সত্তার ‘অপর’! পাঠক-দর্শক খেয়াল করুন ইন-চার্জ ভদ্রলোক ও মিঃ জনের প্রাসাদোপম বাড়ি দুটি ছবির সুরক্ষিত অন্দর। পাঁচিলের ওপারে বাইরের পরিসর যেখানে মূলত ভারতীয়দের আনাগোনা সেটা যেন সাঈদ বর্ণিত ‘অপর’। ছবির শুরুর দিকে, বাচ্চা ছেলে বোগির ভারতীয় বন্ধু কানুকে যেন তাই পরিচয় করানো হয় – “Bogey’s best friend was Kanu. They had a life separate from ours,” কানু পাঁচিল টপকে বাইরে থেকে অন্দরে প্রবেশ করে।
সুরক্ষিত অন্দরের বাইরে এই ‘অপর’-এর পৃথিবীতে গিয়েই বোগি সাপুড়ের খেলা দেখে এবং কানুর সাহায্যে সেটা নকল করতে গিয়ে সাপের ছোবলে মারা যায়। মার্টিন স্করসেসির মতে কালো কোবরা হল অশুভের প্রতীক এবং তার সামনে সাদা বোগী হল পবিত্রতা বা শুভের প্রতীক। প্রতীক সমীক্ষণকে আরেকটু বিশ্লেষণ করলেই আমরা বুঝতে পারবো কালো কানু কালো কোবরা আসলে মেরুদণ্ডহীন নিকৃষ্ট ভারতীয়দের প্রতীক। মনোভাবটা এরকম যেন এদেশে থেকে গিয়েই যত বিপত্তি ঘটল, পরিবার দুটির উচিত ছিল স্বজাতির প্রায় আর সকলের মত সমস্ত ধনসম্পদ বিলেতে পাচার করে শেষে নিজেদেরও চলে যাওয়া। এই ‘অপর’-এর পৃথিবীতেই গঙ্গায় হ্যারিয়েট আত্মহত্যার চেষ্টা করে। যাবতীয় অমঙ্গল সংঘটিত হয় এই ‘অপর’-এর পৃথিবীতে! ভারতবর্ষ, থুড়ি ভারতীয় সমাজ হল সাপ-হনুমানের খেলা দেখানো, বাজিকরের খেলা দেখানো প্রিমিটিভ সমাজ, যুগান্তব্যাপী এই ঔপনিবেশিক ধারণা থেকে রেনোয়াও মুক্ত নন। মেলিনির ভারতীয় প্রেমিক অনিলকে মাত্র একবার দেখিয়েই পরের বার তাকে নেপথ্যে রেখে কেরিক্যাচার করে বিদায় করে দেওয়া হয়েছে। মেলিনি অর্ধেক ভারতীয় ও অর্ধেক ব্রিটিশ হওয়ায়, ক্যাপ্টেন জনে সম্পূর্ণ নিবেদিত, এও দেখানো যায় নি। ইন্ডোলজি বা ভারতবিদ্যা জাহির করবার হাতছানি রেনোয়াকে চালিত করেছে দ্বিধাগ্রস্ত মেলিনির সত্তাকে ব্যবহার করে রাধাকৃষ্ণ নামক ভারতীয় মিথের হাস্যকর ও চেটাল প্রতিকৃতি নির্মাণে। রাধাকৃষ্ণ, দিওয়ালী-কালীপূজা, জটাধারী বৈরাগ্য ইত্যাদি হল পাশ্চাত্যের চিরকেলে পছন্দের সেই ভারতীয় আধ্যাত্মিকতা, ঔপনিবেশিক সামগ্রীর গোডাউনের আড়াল থেকে যেগুলির দিকে তাকিয়ে মুখ চেপে হাসার মত আনন্দ তারা আর কোনো কিছুতেই পায় নি। এদেশের সংখ্যাগুরু মানুষের অনেক দোষের মধ্যে প্রধানতম একটি তো অবশ্যই প্র্যাগ্ম্যাটিক বুদ্ধির বিপরীতে তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর যূপকাষ্ঠে ভক্তি-ভরে গলা দিয়ে রাখা, যার পূর্ণ সুযোগ ঔপনিবেশিকেরা নিয়েছিল তা অনস্বীকার্য। কিন্তু এ স্বতন্ত্র আলোচনার বিষয়। এখন কেউ যদি ইম্প্রেসনিস্ট পেইন্টার পিয়ের অগস্ত্য রেনোয়া-র (১৮৪১-১৯১৯) ছেলে জাঁ রেনোয়া-র দিকে তাকিয়ে সম্ভ্রমে মনে করেন এই বৈপরীত্য ইচ্ছাকৃতভাবে তিনি তৈরি করেন নি, তাতেও কিন্তু উপস্থাপনাটি মিথ্যে হয়ে যায় না। আসল কথা হল রেনোয়ার কিছু করার ছিল না, এই দৃষ্টিভঙ্গি তিনি পেয়েছিলেন ‘ওরিয়েন্টালিজম’ নামক বয়ানের ততোধিক যুগান্তব্যাপী প্রণালীবদ্ধ প্রক্রিয়াকরণ থেকে। ঔপনিবেশিক ঔদ্ধত্য - পাশ্চাত্য আসলে প্রাচ্যকে এইভাবেই দেখতে চায়।
অন্যভাবে বললে 'ওরিয়েন্টালিজম'-র বয়ান প্রাচ্যকে পরিবেশন করে অন্ধকার ও অসংশোধিত হিসেবে, যারা পাশ্চাত্যের প্রতিপক্ষ এবং একইসঙ্গে অশুভ, ঘৃণ্য এবং কৌতুকপূর্ণভাবে বহিরাগত। এই পরিবেশনা গ্রিক সভ্যতার সময় থেকে শুরু হলেও, অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে ঔপনিবেশিকতার ঊষালগ্নে এই ব্যাপারটা বিশেষ প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে এবং এটা একটা একাডেমিক ডিসিপ্লিনে পরিণত হয়। সাঈদের মতে সপ্তদশ শতক পর্যন্ত ইউরোপ প্রাচ্যকে খুব কাছ থেকে জানার সুযোগ পায় নি। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীতে অর্থনৈতিক ও সামরিক অধিগ্রহণের পর পাশ্চাত্য সুযোগ পেয়ে যায় প্রাচ্যকে ঘনিষ্ঠভাবে জানার বা বলা ভালো অধিকৃত প্রাচ্যকে তারা পরিবর্তিত করে অনুসন্ধানের বস্তুতে এবং পদ্ধতিগত জ্ঞানের একটি ক্ষেত্রতে। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট (১৭৬৯-১৮২১) ও ওয়ারেন হেস্টিংস (১৭৩২-১৮১৮) মোটামুটিভাবে একইসময় একদল সৈন্য-সামন্ত ও একদল স্কলার বা পণ্ডিতকে নিয়ে যথাক্রমে ইজিপ্টে ও ভারতে অনুপ্রবেশ করে। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে এইসব স্কলাররা বিপুল তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন এটা ঠিক, কিন্তু সেই সব তথ্যকে সম্বল করে যারা ভারত-সম্পর্কিত জ্ঞানকে বিভিন্ন বিভাগে ভাগ করে ইন্ডোলজি নামক অধুনা-তত্ত্বের প্রাক-প্রতিমা নির্মাণ করেছিলেন তাদের ছিল একটি পূর্ব-নির্ধারিত এজেন্ডা। উদাহরণ হিসেবে থমাস ব্যাবিংটন ম্যাকওলে যেরকম একজন, তেমনই এদের মধ্যে জেমস মিল-ও (১৭৭৩-১৮৩৬) পড়বেন, আবার কার্ল মার্কস-ও (১৮১৮-১৮৮৩) পড়বেন। শেষোক্ত দুজনই ভারতবর্ষে একবারও না এসে এবং ভারতবর্ষের একটিও ভাষা বিন্দুমাত্র না জেনে শুধুমাত্র ঐসব পরিযায়ী পণ্ডিতদের তথ্যকে মহার্ঘ্য ও যথেষ্ট বিবেচনা করে ভারত সম্পর্কে ও ভারতে ইংরেজ শাসন সম্পর্কে যেসব মতামত দিয়েছিলেন (যেমন ১৮৫৩-য় প্রকাশিত কার্ল মার্ক্সের ‘The Brithish rule in India’) সাঈদের 'ওরিয়েন্টালিজম' নামক বয়ান-নির্মিতির জোরালো প্রমাণ হিসেবে সেগুলিই যথেষ্ট। ঔপনিবেশিক শোষণের যে ব্যাখ্যা এঁরা দিয়েছিলেন তার পিছনেও কাজ করেছে সহস্রাব্দ প্রাচীন সেই সংস্কার যে প্রাচ্য অনগ্রসর ও বর্বর সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে এবং পাশ্চাত্য প্রতিনিধিত্ব করে, এর বিপরীতে, উচ্চ-সভ্যতা। জেমস মিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন প্রশাসক ছিলেন এবং ‘রিকার্ডিয়ান স্কুল অফ ইকনমিক্স’-এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ভারতবর্ষে নির্লজ্জ অর্থনৈতিক শোষণের ঔপনিবেশিক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন! অন্যদিকে কার্ল মার্কস অর্থনৈতিক শোষণের সবচেয়ে প্রধান ক্রিটিক হওয়া সত্ত্বেও মিল-মার্কস উভয়ের চোখেই এই শোষণ মার্জনীয় যেহেতু শোষক পাশ্চাত্য এবং শোষিত প্রাচ্য। ইউরোপের বৌদ্ধিক জগতে এদের প্রভাবের কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। কিন্তু প্রাচ্য সম্পর্কে এধরনের সংস্কার ও মিথ কেন প্রচলিত ছিল এ-কথা ভাবলে আমাদের মনে পড়বে ফুকোর সেই বক্তব্য – যেসব বয়ান ক্ষমতাশালী প্রতিষ্ঠানগুলির দ্বারা উৎপন্ন, প্রচারিত ও অনুমোদিত হয় সেইসব বয়ানই সত্য হিসেবে স্বীকৃত হয়। তাই অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপের প্রাচ্য অধিগ্রহণের পর ‘ওরিয়েন্টালিজম’ হল পাশ্চাত্যের প্রতিষ্ঠানগুলির দ্বারা প্রচারিত সেই বয়ান যা যাবতীয় সংকীর্ণতা ও সীমাবদ্ধতা নিয়েও প্রাচ্য সম্পর্কে বৈধ ও সঠিক সত্য হিসেবে মান্যতা পায়। বলা-বাহুল্য এই লক্ষণ শুধুমাত্র যে একাডেমিক ডিসিপ্লিনে কাজ করেছে তা নয়। সাহিত্য জগতে লর্ড বায়রন থেকে জোসেফ কনরাড হয়ে হাল আমলের ডমিনিক ল্যাপিয়ের, গুন্টার গ্রাস এবং চলচ্চিত্র জগতে রেনোয়া (পূর্বে উল্লেখিত) থেকে লুই মাল (১৯৩২-১৯৯৫) হয়ে হাল আমলের বার্নার্দো বার্তোলুচ্চি, ফ্রান্সিস ফোর্ড কাপোলা পর্যন্ত এর বিস্তৃতি। ফলে ভারত তথা প্রাচ্য সম্বন্ধে ‘ওরিয়েন্টালিজম’র বয়ানই যে সত্য ও সঠিক, এই বোধ ঔপনিবেশিক মেট্রোপলিসগুলির সাধারণ ও অসাধারণ মানুষদের মজ্জাগত হয়ে ওঠে। এই বোধ থেকে জন্ম নেয় আরেক বোধ, অসভ্য আদিম বর্বর 'অপর' এই ভারত তথা প্রাচ্যকে তো এইভাবে রেখে দেওয়া যায় না। পৃথিবীর মঙ্গলের স্বার্থে সভ্য ও উন্নত পাশ্চাত্যের নৈতিক কর্তব্য বা দায়িত্ব এদের অধিগ্রহণ করে সভ্য করা। একেই বলা হয় 'white man's burden.' যা কিনা আসলে ঔপনিবেশিকতার আড়ালে 'civilizing mission'!
রেনোয়ার রিভারের ঠিক পনের বছর বাদে ১৯৬৭-র শেষে আরেক নামকরা ফরাসি চলচ্চিত্রকার লুই মাল ভারতবর্ষে আসেন ‘ফ্রেঞ্চ মিনিস্ট্রি অফ ফরেইন অ্যাফেয়ার্স’-এর উদ্যোগে নতুন ফরাসি সিনেমার খোঁজে। মাল এদেশে দু-মাস ছিলেন। পরে ৫ই জানুয়ারি, ১৯৬৮ থেকে ১লা মে ১৯৬৮, মাল নির্মাণ করেন ভারতবর্ষের উপর তথ্যচিত্র ‘ফ্যান্টম ইন্ডিয়া’।
সাতটি এপিসোডে বিভক্ত টিভি মিনি সিরিজ ‘ফ্যান্টম ইন্ডিয়া’ ১৯৬৯-এ কান চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয় এবং ১৯৭১ সালে বিবিসি এটি সম্প্রচার করে। এপিসোডগুলি ছিল ‘দি ইম্পসিবল ক্যামেরা’, ‘থিংস সিন ইন ম্যাড্রাস’, ‘দি ইন্ডিয়ান্স অ্যান্ড দা স্যাক্রেড’, ‘ড্রিমস অ্যান্ড রিয়েলিটি’, ‘এ লুক অ্যাট দা কাস্টস’, ‘অন দা ফ্রিঞ্জেস অফ ইন্ডিয়ান সোসাইটি’ এবং ‘বম্বেঃ দা ফিউচার ইন্ডিয়া’। তিরিশ ঘন্টার শুটিং মেটিরিয়াল থেকে নির্বাচিত ছ-ঘন্টা আঠেরো মিনিটের ‘ফ্যান্টম ইন্ডিয়া’র সময়ই মাল উপলব্ধি করেন তিন সপ্তাহের কলকাতা বাসের সময়কার শুটিং-রাস থেকে স্বতন্ত্র আরেকটি তথ্যচিত্র নির্মিত হতে পারে। ‘ক্যালকাটা’ সেই তথ্যচিত্রের নাম।
ক্রাইটেরিয়ানের পক্ষ থেকে মাইকেল কোরস্কি ‘ক্যালকাটা’ সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে মালের ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গিকে চিন্তাশীল, অনুসন্ধানমূলক, ক্রিটিক, সত্যানুসন্ধানী ইত্যাদি প্রতিপন্ন করেও যা ঢেকে রাখতে পারেন নি তা একই ভাবে ‘ফ্যান্টম ইন্ডিয়া’র ক্ষেত্রেও সত্য –
The most striking difference…is in the pacing: whereas the former is made up of unhurried, contemplative passages, the latter is a straightforward plunge into a nightmarish world of poverty, sickness, and political turmoil. Calcutta surveys, with ceaseless movement, the myriad desperations of this West Bengali capital city, from its swarming streets and bridges to its shantytowns and filthy back alleys. Like Bombay, the port town of Calcutta was built by the English for colonial needs—and after Great Britain’s departure, widespread violence and famine led to the city’s stagnation. Malle unflinchingly explores the slums, where 40 percent of the population lives, and where animal excrement contaminates the water and piles of uncollected garbage block the streets.
রেনোয়ার মতই, ‘হত-দরিদ্র রোগা আধপেটা খাওয়া অর্ধউলঙ্গ’ ভারতীয়, মালের তথ্য-চিত্রিত ভারতীয়দের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। বামপন্থী মালের যতই সঠিক ক্রিটিক থাক এদেশের কাস্ট সিস্টেম নিয়ে, শ্রেণী-বিভক্ত সমাজের দ্বন্দ্ব নিয়ে, শেষাবধি অনগ্রসর, ভিখিরিতে ভর্তি, চরম দরিদ্র, নিকৃষ্ট ও বস্তি-সদৃশ একটি দেশ হিসেবে ভারতীয়দের কাছেই যদি উপলব্ধ হয় এই দেশ ও কলকাতা, তাহলে ভাবুন পাশ্চাত্যের চোখে ব্যাপারটা কি দাঁড়ায়!
কিন্তু ভারত তো শুধু তা নয়, বহুধা বিস্তৃত, বহু-বৈচিত্র্যে ভরা বহু ভাষাভাষীর এদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক দিকগুলির কিছুই কি এদের চোখে পড়ে না? যে দেশের মানুষ নিয়ে এইসব ছবি তাদের নিজস্ব স্বরের স-ও এর মধ্যে নেই। এ শুধুমাত্র ঔপনিবেশিকদের চোখ দিয়ে দেখা তাদেরই পরিত্যক্ত ভারতবর্ষ নামক গণ-শৌচাগারের ছবি যেখানে মাঝেসাঝে উঁকি মেরে গেছে এরাও নাচতে জানে গাইতে জানে দেখানোর জঘন্য কৌতুক। তথ্যচিত্র দুটির বিবিসি-কর্তৃক সম্প্রচারের পরই ব্রিটেনে বসবাসকারী অনেক ভারতীয়র এবং ভারত সরকারের মনে হয়েছিল মাল ভারতের একটি একতরফা প্রতিকৃতি দেখিয়েছেন, দেশের উন্নয়নশীল অংশগুলির এবং দেশের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের পরিবর্তে দারিদ্র চিত্রণে আগ্রহ দেখিয়েছেন অনেক বেশি। সে সময় ভারত সরকার (ইন্দিরা গান্ধীর সরকার) বিবিসিকে এমনকি অনুষ্ঠান সম্প্রচার বন্ধ করতেও বলে এবং বিবিসি প্রত্যাখ্যান করলে তাদের নয়াদিল্লির দপ্তর ছেড়ে চলে যেতে বলা হয়।
ভারতবর্ষ বললে শুধুমাত্র এই হতশ্রী দিকগুলিই ইউরোপীয়দের চোখে পড়ে কেন? এদের কি তাহলে এদেশের বৈচিত্র, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সত্যিই কোনো ধারণা নেই? রেনোয়া বা মাল যখন কলকাতায় আসেন তখনও নীহাররঞ্জন রায়, কালিকারঞ্জন কানুনগো, রমেশচন্দ্র মজুমদার, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেনরা বেঁচে। ভারতবর্ষ নামক জটিল ভূখণ্ডের বিষয়ে যাঁদের সামগ্রিক জ্ঞান আজও প্রশ্নাতীত। ওয়ার্নার হাইজেনবার্গের মত আদ্যন্ত ফিজিক্সের মানুষ যদি ভারতীয় দর্শনের বিষয়ে একটি বিশেষ কারণে উৎসুক হয়ে কলকাতায় এসে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন, তাহলে রেনোয়া, মাল-ও পারতেন ঐ একই রকম ব্যতিক্রমী পথে হাঁটতে! কিন্তু ঐ ঔপনিবেশিক ঔদ্ধত্বের প্রকোপে তাদের মনে হয়েছে এ-দেশের সবই তো তাদের জানা, তারা চৌকস, ফলে এ-দেশের বিশেষজ্ঞদের শরণাপন্ন হওয়ার ভাবনা তাদের কল্পনাতেও আসে নি। আসলে দীর্ঘকালের ‘ওরিয়েন্টালিজম’-র বয়ানের শিক্ষার মত্ততায় থেকেও স্বাধীনভাবে ভাবার ক্ষমতা খুবই কঠিন ও বিরল ব্যাপার। এ বয়ান পাশ্চাত্য নিজেরাই তৈরি করেছে, এই বয়ানকে অজুহাত হিসেবে খাড়া করে civilizing mission-র নামে সামরিক ও অর্থনৈতিক নিষ্পেষণকে করেছে ন্যায়সঙ্গত এবং ধারাবাহিক ও পৈশাচিক নিষ্পেষণের পরে ফেলে রেখে যাওয়া প্রাচ্য নামক ছিবড়ে থেকে নিজেদের জন্যই তৈরি করেছে স্বমেহনের নতুন সামগ্রী এককথায় যার নাম দেওয়া যায়, ‘পভার্টি পর্নোগ্রাফি’।