লতিকা চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। ঘরের মধ্যে তখনো ফিসফাস চলছে। একটু পরে ছিটকিনি খোলার আওয়াজ হলো। লতিকা দরজা পেরিয়ে ভিতরে ঢুকলো। ল্যাম্পের অস্পষ্ট আলোয়ে দেয়ালে মেয়েদের ছায়াগুলো সিনেমার পর্দায়ে ক্লোজ-আপের মতো দেখাচ্ছিল।
“ঘরটা এত অন্ধকার কেন?”
“ল্যাম্পে তেল শেষ, ম্যাডাম।”
এটা সুধার ঘর, তাই ওকেই উত্তর দিতে হল। হোস্টেলে সে-ই সবথেকে পপুলার। কারণ, ছুটির দিনে বা রাতের খাওয়ার পর আশপাশের ঘরের সব মেয়েগুলো ওর-ই ঘরে এসে আড্ডা জমায়। অনেক রাত পর্যন্ত গল্পগুজব, হাসিঠাট্টা চলতে থাকে।
“তেলের জন্য করিমুদ্দিনকে বলোনি কেন?”
“কতবার বলেছি ম্যাডাম, কিন্তু ওর মনে থাকলে তো।”
ঘরের কোণে কোণে হাসির ঢেউ খেলে গেল। লতিকা ঘরে ঢোকায় একটু যে ডিসিপ্লিনের ভাবটা এসেছিল তাও হাসির ধাক্কায় মুছে গেল। করিমুদ্দিন হস্টেলের চাকর। ওর আলস্য ও কাজে গাফিলতির কাহিনী মেয়েদের সবার জানা।
ল্যাম্পটা ঘোরালেই দেয়ালের ছায়াগুলোও দৌড়তে থাকে। ঘরের মধ্যে সবাই গোল হয়ে বসে, গা ঘেঁষাঘেঁষি করে। লতিকার হঠাৎ খেয়াল হল, সবারই মুখ চেনা কিন্তু বাতির আবছা হলুদ আলোয় সবাইকে একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে, যেন এই প্রথম দেখছে।
“জুলি, তুমি এখনো পর্যন্ত এই ব্লকে?”
জুলি জানলার ধারে খাটের মাথার দিকে বসেছিল। ও চুপ করে চোখ নামিয়ে নিল। বাতির আলোটা সবাইকে ছেড়ে ওর-ই মুখে পড়ল।
“নাইট রেজিস্টার-এ সাইন করেছ?”
“হ্যাঁ ম্যাডাম।”
“তবে?” লতিকার গলা উঁচু হল। জুলি কাঁচুমাচু মুখে জানলার বাইরে তাকাবার চেষ্টা করছিল।
এই স্কুলে প্রথম থেকেই লতিকা বুঝেছিল যে ভয় দেখিয়ে বা বকুনি দিয়ে হস্টেলের নিয়ম মানানো চলবে না।
“ম্যাডাম, কাল থেকে তো ছুটি শুরু, তাই ভাবলাম আজ রাতে সবাই একসঙ্গে…” সুধা কথাটা শেষ না করেই হেমন্তীর দিকে চেয়ে হেসে ফেললো।
“হেমন্তী গান গাইবে, আপনিও বসুন না একটু।”
লতিকা সামান্য দোটানায় পড়ল। এইসময় এসে পড়ে এদের গালগল্পে বাধা দিয়েছে। এই ছোট্ট হিল-স্টেশনে বছরটা বেশ ভালোই কাটে কিন্তু কখন যে সময়টা গ্রীষ্ম, হেমন্ত পার হয়ে শীতের ছুটির কোলে এসে পড়ে তা ওর মনে থাকে না।
চোরের মতো নিঃশব্দে লতিকা বাইরে পা দিল। মুখের কঠিন ভাবটা একটু হাল্কা হয়েছে, হাসিমুখে জিগ্যেস করল,
“আমার সঙ্গে কেউ স্নো-ফল দেখতে যাবে না?”
“ম্যাডাম, ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছেন না?” সবার চোখ লতিকার উপর।
“এখনো কিছু ঠিক করিনি।–বাট আই লাভ দ্য স্নো-ফল।”
লতিকার মনে হল ও যেন গত বছরেও এই কথাটা বলেছিল, হয়তো বা তার আগের বছরেও। ওর মনে হল মেয়েরা ওর কথাটা বিশ্বাস করেনি, কেমন যেন সন্দেহদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। মাথাটা ভার ভার লাগছে, যেন কোন অজানা কোণ থেকে একদল মেঘ ওকে ঘিরে ফেলছে। ও মাথাটা নেড়ে একটু হাসল।
“জুলি, তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে, যাওয়ার আগে আমার সঙ্গে দেখা করে যেও, কেমন?। আচ্ছা, গুড নাইট।” বলে লতিকা দরজাটা বন্ধ করে দিল।
“গুড নাইট ম্যাডাম, গুড নাইট, গুড নাইট।”
সিঁড়ি দিয়ে না নেমে লতিকা রেলিং ধরে একটু দাঁড়িয়ে ল্যাম্পের শিখাটা কমিয়ে এক কোণে নামিয়ে রাখল। বাইরে আবছা নীল কুয়াশা ঘন হয়ে আসছে। লনের ধারে চীর গাছের পাতাগুলোর সরসর আওয়াজ। হাওয়ায় ঠাণ্ডা আভাস পেয়ে লতিকার মনে পড়ল কাল থেকে শীতের ছুটি শুরু। দুচোখ বন্ধ করে ওর মনে হল পা’দুটো যেন বাঁশের টুকরো—গাঁঠগুলো আস্তে আস্তে খুলছে। মাথাঘোরা ভাবটা তখনো কাটেনি, বাইরের কুয়াশাটা ওর ভিতরেও ছড়িয়ে পড়ছিল।
সিঁড়িতে গলার শব্দ শুনে লতিকা যেন ঘুম থেকে জেগে উঠল। গায়ের শালটা ভালো করে জড়িয়ে বাতিটা তুলে দেখল ডাক্তার মুখার্জি আর মিস্টার হুবার্ট একটা ইংরেজি গান গাইতে গাইতে উপরে উঠছে। সিঁড়িটা অন্ধকার, তাই মিস্টার হুবার্ট বারবার হাতের ছড়ি দিয়ে রাস্তা যাচাই করে নিচ্ছে। লতিকা দু’ধাপ নীচে নেমে আলোটা বাড়িয়ে ধরল।
“গুড ইভনিং ডক্টর, গুড ইভনিং মিস্টার হুবার্ট।”
“থ্যাঙ্ক ইউ মিস লতিকা।” হুবার্ট-এর গলায় কৃতজ্ঞতা। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে তার হাঁফ ধরে গেছিল, দেয়ালে ঠেস দিয়ে একটু বিশ্রাম নিল। বাতির আলোয় তার ফ্যাকাসে রঙে যেন একটু তামাটে ছোপ দেখা যাচ্ছে।
“এখানে, একা-একা?” ডাক্তার ঠোঁটের ফাঁকে একটা শিস দিল।
“চেকিং করে ফিরছি। আর আপনারা এই সময়ে এখানে?”
হুবার্ট হেসে হাতের ছড়িটা ডাক্তারের কাঁধে ছোঁয়ালো,” একে জিগ্যেস করো, এ-ই জোর করে আমায় নিয়ে এসেছে।”
“মিস লতিকা, আমরা আপনাকে নিমন্ত্রণ করতে এসেছি। আজ সারারাত আমাদের ঘরে একটা ছোট্ট কনসার্ট হবে, হুবার্ট শ্যোপ্যাঁ আর চাইকভস্কি বাজাবে তারপর ক্রিম-কফি পান হবে এবং তার পরেও সময় থাকলে আমরা দুজনে মিলে গত বছরের স-ব ভুলচুক কবুল করব।” ডাক্তার মুখার্জির মুখভরা হাসি।
“ডক্টর, আমায় মাফ করবেন। আমার শরীরটা ভালো নেই।”
“তাতে কী? তাহলে তো আপনাকে আমার কাছে আসতেই হত।” বলে ডাক্তার আলগা হাতে লতিকার কাঁধটা ধরে নিজের ঘরের দিকে নিয়ে চলল।
ডাক্তার মুখার্জির ঘরটি ব্লকের উলটো দিকে ছাতের সংলগ্ন। লোকটি আধা-বর্মী, ঈষৎ চাপা নাক ও ছোট ছোট চঞ্চল চোখদুটি তার সাক্ষী। জাপানী আক্রমণের পর দেশ ছেড়ে এই ছোট শহরে বসতি। প্রাইভেট প্র্যাকটিস ছাড়াও এই কনভেন্ট স্কুলে হাইজিন-ফিজিওলজি পড়ায়, তাই হোস্টেলে একটা ঘর পাওয়া গেছে। কেউ কেউ বলে বার্মা থেকে আসার পথে তার স্ত্রীর মৃত্যু হয় কিন্তু এ বিষয়ে কোন নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায় না আর ডাক্তার নিজেও কখনো এ নিয়ে কোনো আলোচনা করে না।
কথায় কথায় ডাক্তার প্রায়ই বলে, “মরার আগে আমি একবার বার্মা যেতে চাই।” সেই সময় এক মুহূর্তের জন্য তার চোখদুটো ঘন হয়ে আসে। তখন লতিকা চেষ্টা করেও আর কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারে না। ওর মনে হয় ডাক্তার এ সম্বন্ধে আর কোন প্রশ্ন বা সহানুভূতি চায় না। পরক্ষণেই ডাক্তার নিজের মুড হাল্কা করতে হেসে ফেলে—তার নিজস্ব সবজান্তা খুশির হাসি। গোপনীয়তাটা এমনই এক অসুখ যার ওষুধ কোনো ডাক্তারের কাছেই নেই।
ছাতের উপর এদিক-ওদিক কয়েকটি টেবিল চেয়ার, ঘরের ভিতরে কফি পারকোলেটর-এ জল ফুটছে।
স্পিরিট-ল্যাম্প জ্বালাতে জ্বালাতে ডাক্তার বলল, “শুনছি আগামী দু’তিন বছরের মধ্যেই ইলেক্ট্রিসিটি এসে যাবে।”
হুবার্ট আরামকেদারায়, একবার বাইরে তাকিয়ে উত্তর দিল, “সে তো গত বছরেও শুনেছি। ঐ যে লম্বা-চওড়া স্কিম বানালো ইংরেজরা, তার কী হল?”
লতিকা ভিতর থেকে দুটো মোমবাতি এনে টেবিলের দুই ধারে লাগিয়ে দিতে ছাতের অন্ধকারটা মোমবাতির আলোয় একটু উজ্জ্বল হল। চীর গাছের পাতার শব্দ হাওয়ায় হাওয়ায় পাহাড়ে ও উপত্যকায় ছড়িয়ে যাচ্ছিল।
“এবার বরফটা শিগগির পড়বে মনে হয়, হাওয়ায় একটা ঠাণ্ডা ভাব আছে।” ডক্টর একটা সিগার ধরাল, অন্ধকারে আগুনের বিন্দুটা জ্বলতে লাগল।
“জানি না স্পেশাল সার্ভিস-এর ঝামেলার উপর মিস উড-এর এত ঝোঁক কেন। মেয়েদের ছুটিতে বাড়ি যাবার আগে ফাদার এলমণ্ডের সারমন শোনাটা কি এতই জরুরি?” হুবার্ট প্রশ্ন করলেন।
“গত পাঁচ বছর ধরে তো শুনে আসছি, ফাদার এলমণ্ডের সারমন-এ কখনো কোনো রদবদল হয় না।”
ফাদার এলমণ্ডকে ডাক্তারও খুব সুনজরে দেখে না।
লতিকা চেয়ারে ঝুঁকে পেয়ালায় কফি ঢালতে শুরু করল। প্রতি বছর স্কুল শেষ হওয়ার দিন দুটো প্রোগ্রাম করা হয়—চ্যাপেল-এ স্পেশাল সার্ভিস ও তারপর সারাদিন পিকনিক। লতিকার মনে পড়ল প্রথম বছর ও ডাক্তারের সঙ্গে পিকনিকের পর ক্লাব-এ গেছিল। ডাক্তার বার-এ বসেছিল, বল-রুমে কুমায়ুন রেজিমেন্টের অফিসারদের ভিড়। কিছুক্ষণ বিলিয়ার্ড খেলা দেখার পর বার-এ আসার সময় ডান দিকে ক্লাব-এর লাইব্রেরিতে তাকে দেখেছিল—ঐ সময় ডাক্তার মুখার্জি ওর পাশে এসে বলেছিল, “মিস লতিকা, উনি মিস্টার গিরিশ নেগি।” বিলিয়ার্ড-রুম থেকে ভেসে আসা হাসিঠাট্টার মধ্যে সে একটু থমকে দাঁড়িয়ে একটা বইয়ে আঙুল রেখে জানলার বাইরে তাকিয়েছিল। পিছন ফিরে বলল, “হ্যালো ডক্টর।” ঠিক তক্ষুনি---
ঠিক তক্ষুনি লতিকার হাতটা কেঁপে গরম কফি ছলকে পড়ল ওর শাড়ির উপর। ভাগ্যিস অন্ধকারে ওর ফ্যাকাসে মুখটা কেউ দেখতে পেল না। হাওয়ার দাপটে মোমবাতির শিখা নিবু-নিবু। ছাতের থেকেও উঁচুতে কাঠগোদামমুখী বড় রাস্তায় ইউ.পি রোডওয়ের শেষ বাসটা ডাক নিয়ে যাচ্ছে। বাসের হেডলাইটে দেয়ালের উপর ঝোপঝাড়ের ছায়াগুলো একে একে মিলিয়ে গেল।
“মিস লতিকা, আপনি এবার ছুটিতে এখানেই থাকছেন?”
ডাক্তারের প্রশ্নটা শূন্যে ঝুলে রইল কিছুক্ষণ। ঠিক সেই সময় হুবার্ট-এর আঙুল থেকে পিয়ানোয় শোপ্যাঁর নকটার্নের সুর ধীরে ধীরে ছাতের অন্ধকারে মিশে যাচ্ছিল—যেমন জলের উপর স্বপ্নিল মৃদু ঢেউগুলি ভ্রমরের ঝিকিমিকি জাল বুনতে বুনতে দূর থেকে দূরান্তরে ছড়িয়ে যায়। লতিকার মনে হল যেন দূর বরফশিখর থেকে একঝাঁক পাখি নীচে কোন অজানা দেশের দিকে উড়ে যাচ্ছে। আজকাল জানলায় বসে সে অনেকবার এই পাখিদের দেখেছে—সুতো ছাড়া ঘুড়ির মতো, আঁকাবাঁকা লাইনে উড়ে যায়, পাহাড়ের নীরবতা থেকে নীচে শহরের জনারণ্যে, যেখানে সে নিজে কোনোদিন যেতে পারবে না।
আরামচেয়ারে লতিকার ঝিম ধরে আসছে। অন্ধকারে ডাক্তার মুখার্জির সিগারটা নিঃশব্দে জ্বলজ্বল করছিল। ডাক্তার আন্দাজ করার চেষ্টা করছে লতিকা কী ভাবছে আর লতিকা ভাবছিল সে কি বুড়ি হয়ে যাচ্ছে? চোখের সামনে স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল মিস উডের মুখটা ভেসে উঠল, পৃথুল চেহারা, চোখের নীচে মাংসের থলি, খিটখিটে মেজাজ, কর্কশ স্বর –সবাই তাঁকে ‘ওল্ড মেইড’ বলে ডাকে। আর কয়েক বছরেই সেও হুবহু ঐ রকম হয়ে যাবে...লতিকার গা শিরশির করে উঠল; যেন অজান্তে সে পচাগলা কিছু ছুঁয়ে ফেলেছে। ওর মনে পড়ল কয়েক মাস আগে আচমকা হুবার্ট-এর লেখা একটা প্রেমপত্র পেয়েছিল। ভালবাসা ও আকাঙ্ক্ষা-ভরা সেই চিঠিতে আরও কতকিছু সে লিখেছিল যা লতিকা বুঝতেও পারেনি। হুবার্টের এই ছেলেমানুষিতে ওর হাসি পেলেও ভিতরে ভিতরে একটু ভালোও লেগেছিল--ওর বয়েসটা তাহলে এখনো পার হয়ে যায়নি। এখনো সে পুরুষকে আকর্ষণ করতে পারে। চিঠি পড়ে রাগের বদলে মমতাই অনুভব করেছিল। চাইলে তো ঐ ভুল ধারণাটা তক্ষুনি দূর করে ফেলতে পারত কিন্তু কিছু একটা ওকে থামিয়ে দিয়েছিল। তার কারণ ওর বিশ্বাস ঐ ছেলেমানুষি চিঠিটার সঙ্গে ওর একটুকরো সুখও জড়িয়ে রয়েছে।
শুধু হুবার্ট কেন, সে যাকে ইচ্ছা চাইতে পারে, এই ভাবনাটা—যা এখন আর নেই—কিন্তু তার ছায়াটা এখনো তাকে অনুসরণ করে, না নিজে মোছে, না তাকে মুক্তি দেয়। ওর মনে হল ঐ মেঘের পুঞ্জ আবার ওর মাথায় ঢুকে পড়ছে, আবার ওর হাতপাগুলো নির্জীব শিথিল হয়ে যাচ্ছে।
ও ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ডক্টর, মাফ করবেন, আমার ভীষণ টায়ার্ড—” কথা শেষ না করেই সে নীচে নেমে গেল।
কিছুক্ষণ ছাতটা নিস্তব্ধ। মোমবাতিগুলো নিভে যাচ্ছে। ডক্টর মুখার্জি সিগারে আরেকটা টান দিয়ে আনমনে বলল, “মেয়েরা সব একরকম, বোকা আর সেন্টিমেন্টাল।”
পিয়ানোর উপর হুবার্টের আঙুলগুলি মন্থর হয়ে আসছে, হাওয়ায় শেষ সুরের গুঞ্জনটা কিছুক্ষণ ধরা রইল।
“ডাক্তার, আপনি কি খেয়াল করেছেন মিস লতিকার ভাবসাব কিছুদিন থেকেই একটু অন্যরকম?”—হুবার্টএর গলায় একটু উদাসীন ভাব। ওর আসল মনোভাবের ইঙ্গিত ডাক্তারকে ও দিতে চায় না। যে কোমল আবেগটা সে এতদিন লুকিয়ে রেখেছে তাকে দরকার পড়লে প্রকাশ্যে এক হাসির দমকে ঠাট্টার মতো উড়িয়ে দিতে পারে।
“তুমি কি নিয়তিতে বিশ্বাস করো হুবার্ট?” ডাক্তার প্রশ্ন করল। হুবার্ট শ্বাসরোধ করে অপেক্ষা করছিল, ও জানে কিছু বলার আগে দার্শনিক প্রশ্ন করাটা ডাক্তারের অভ্যেস। ডাক্তার ছাদের রেলিং ধরে উঠে দাঁড়াল। হাল্কা চাঁদের আলোয় লনের উপর চীরগাছের ছায়া পড়েছে। দু’একটা জোনাকি অন্ধকারে জ্বলে উঠেই আবার হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে।
“আমি কখনো কখনো ভাবি, মানুষ জন্মায় কেন? তার কি আর কোনো কাজ নেই? এই যে আমি দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে পড়ে আছি—এখানে কে আমায় জানে…হয়তো এখানেই মরে যাব। তুমি কী বলো? একজন বিদেশীর জোর করে অন্যের দেশে ঢুকে পড়াটা গর্হিত কাজ নয়?”
হুবার্ট একটু অবাক, ডাক্তার মুখার্জির এইরকম মনোভাবটা সে এই প্রথম দেখছে। সাধারণত ডাক্তার নিজের সম্বন্ধে কখনো মুখ খোলে না।
“আমার পরে আর কেউ নেই, এই কথাটা আমায় একটা অদ্ভুত নিশ্চিন্তি এনে দেয়। কিন্তু অনেকের কাছে মৃত্যুটা শেষ পর্যন্ত একটা রহস্যই থেকে যায়। তারা হয়তো জীবনে অনেক কিছু আশা করে—তাকে অবশ্য ট্র্যাজিক বলতে পারব না কারণ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের মরার কোনো চিন্তাই থাকে না।
“ডাক্তার আপনি কার কথা বলছেন?” হুবার্ট উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করল।
ডাক্তার কিছুক্ষণ চুপচাপ সিগার টানতে লাগল। তারপর মুখ ফিরিয়ে নিভন্ত মোমবাতিগুলোর দিকে তাকাল।
“তুমি তো জানো এক সময় লতিকা একা-একাই ক্লাবে আসাযাওয়া করত। গিরিশ নেগির সঙ্গে ওর পরিচয়ও হয়েছিল। কাশ্মীর যাওয়ার আগের রাত্রে গিরিশ আমাকে সবকিছু বলেছিল। এখনো আমি লতিকাকে ঐ সম্বন্ধে কিছু বলতে পারিনি। কিন্তু সেদিন কে জানত যে সে আর কখনো ফিরবে না? আর এখন...এখন আর কী এসে যায়। লেট দ্য ডেড ডাই।” ডাক্তারের শুকনো হাসিতে অপার শূন্যতা মিশে ছিল।
“কোন গিরিশ নেগি?”
“ঐ যে কুমায়ুন রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন ছিল।”
“ডাক্তার, লতিকা কি—” হুবার্ট আর কিছু বলল না। ওর মনে পড়ল ওর লতিকাকে লেখা চিঠিটা...হঠাৎ মনে হল কী অর্থহীন আর হাস্যকর! চিঠির একেকটা শব্দ এখন ওর বুকে ঘা মারছিল। ও আস্তে করে পিয়ানোর উপর মাথাটা নামাল। লতিকা কেন ওকে আগে কিছু বলেনি? ও কি তারও যোগ্য ছিল না?
“লতিকা...একেবারে ছেলেমানুষ, পাগলি! নইলে মৃতর সঙ্গে সঙ্গে কেউ কি নিজেও মরে যায়?”
আরও একটুক্ষণ চুপ থেকে ডাক্তার পুরনো প্রশ্নটা আবার তুলল।
“কিন্তু হুবার্ট, তুমি কি সত্যিই নিয়তিতে বিশ্বাস করো?”
হাওয়ার ঝাপটায় মোমবাতিটা একবার জ্বলে উঠেই একেবারে নিভে গেল। ছাতে অন্ধকারে হুবার্ট আর ডাক্তার মুখ দেখতে না পেরেও মুখোমুখিই বসেছিল। কনভেন্ট স্কুল থেকে একটু দূরে ময়দানে পাহাড়ি নালার জলের শব্দ। অনেকক্ষণ পর কুমায়ুন রেজিমেন্টের ভোরের বিউগিল শোনা যেতেই হুবার্ট তড়বড় করে উঠে পড়ল।
“আমি যাই ডক্টর, গুড নাইট।”
“গুড নাইট হুবার্ট, মাফ কোরো, আমি সিগারটা শেষ না করে উঠছি না।”
মেঘে ঢাকা সকাল। লতিকা জানলা খুলতেই কুয়াশার বেলুনটা ঘরের ভিতর ঢুকে পড়ল, যেন সারারাত দেয়ালে ঠেস দিয়ে ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে ভিতরে ঢোকার অপেক্ষাতেই ছিল। স্কুল থেকে চ্যাপেল যাওয়ার রাস্তাটা মেঘে ঢাকা, শুধু মাথার উপরে ক্রসটা কুয়াসার মধ্যে পেন্সিল দিয়ে কাটাকুটি রেখার মতো দেখাচ্ছে।
জানলা থেকে চোখ সরিয়ে দেখল করিমুদ্দিন চায়ের ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে। করিমুদ্দিন মিলিটারি আর্দালি, তাই ট্রে-টা টেবিলে রেখে অ্যাটেনশন হয়ে খাড়া রইল।
লতিকা চট করে বিছানায় উঠে বসল। সকাল থেকে আলসেমি করছিল, লজ্জাটা চাপা দিতে বলল, “আজকে কী ঠাণ্ডা! বিছানা থেকে উঠতেই ইচ্ছা করে না।”
“আরে মেমসাহেব, এ আর কী ঠাণ্ডা! বড়দিনের সময় দেখবেন কেমন দাঁত ঠকঠক করবে।” বলে দুই হাত বগলে ঢুকিয়ে এমন কুঁকড়ে গেল যেন ভাবামাত্রই ওর শীত করতে শুরু করেছে। টাক মাথার দুপাশে চুলগুলো কলপ দেওয়ায় লালচে রং হয়েছে। যে কোনো কথাই ও টেনেহিঁচড়ে এমন জায়গায় আনবে যেখানে ও গলা বাড়িয়ে নিজের মতামতটা প্রথম জাহির করতে পারে।
“একবার তো অ্যাত্তো বরফ পড়ল যে ভুওয়ালি থেকে ডাক-বাংলো পর্যন্ত সব রাস্তা একেবারে ‘জাম’! অ্যাতো বরফ মেমসাব, গাছের ডালপালা পর্যন্ত কুঁকড়ে লেপটে গেছিল—ঠিক এইরকম,” করিমুদ্দিন ঝুঁকে পড়ে ‘মুর্গা’ হয়ে দেখাল।
“কতদিন আগের কথা?”
“সেটা তো মেমসাব হিসেব করে বলতে হবে...তবে এইটুকু পষ্টো মনে আছে, অংরেজ বাহাদুর তখন এখানেই থাকতেন। ক্যান্টনমেন্টের চুড়োয় ওঁদের ঝাণ্ডা লাগানো থাকত। ভারি জাঁদরেল ছিলেন সাহেব। দুঘণ্টায় সব রাস্তা সাফ করিয়ে দিলেন। তখনকার দিনে একটা সিটি বাজলেই পঞ্চাশ ঘোড়সওয়ার জমা হয়ে যেত। হ্যাঁ, ওরা কাজ করতে জানত বটে। এখন তো সবই উড়েপুড়ে গেছে।” করিমুদ্দিন উদাস চোখে বাইরে চেয়ে বলল।
লতিকা আগেও করিমুদ্দিনের কাছে এসব গল্প শুনেছে—যখন ‘অংরেজ বাহাদুর’এর নেতৃত্বে এই জায়গাটা স্বর্গের সামিল ছিল।
“আপনি এ বছরও ছুটিতে যাচ্ছেন না মেমসাব?”
“সেইরকমই তো দেখছি করিমুদ্দিন, তোমায় আরও বিরক্ত করব।”
“কী যে বলেন মেমসাব, আপনি থাকলে আমাদেরও দিল খুশ থাকে, নইলে তো ছুটির দিনে এখানে শুধু রাস্তার কুকুরের ঘোরাঘুরি।”
“তুমি মিস্ত্রীকে বলে দিও এই ঘরের ছাতটা যেন একটু সারিয়ে দেয়। গত বছর বরফের সময় ছাত দিয়ে জল পড়ত।” লতিকার মনে পড়ল বরফজল থেকে বাঁচার জন্য ওকে এককোণে গুটিসুটি হয়ে শুতে হত।
করিমুদ্দিন চায়ের ট্রে তুলতে তুলতে বলল, “হুবার্ট সাহেব তো কালই চলে যাচ্ছে। গত রাতে আবার ওর শরীর খারাপ হয়েছিল। মাঝরাতে আমাকে জাগিয়ে বলল যে বুকে ব্যথা। এই ঠাণ্ডা ওর সহ্য হচ্ছে না, বলছিল কালকেই মেয়েদের সঙ্গে বাসে চলে যাবে।”
করিমুদ্দিন দরজা ভেজিয়ে চলে গেল। লতিকার ইচ্ছে হল হুবার্ট-এর ঘরে গিয়ে দেখে আসে ও কেমন আছে। কিন্তু পায়ের চটি পায়েই রইল, লতিকা জানলায় বসে মেঘের খেলায় মজে গেল। আজকাল হুবার্টএর নিরীহ মুখখানা দেখলে ওর নিজেকে ভীষণ দোষী মনে হয়, ওর মনের ভুল ধারণাটা দূরও করতে পারে না, বা নিজের অক্ষমতার জন্য মাফ চাইতেও সাহস হয় না। জাল থেকে বেরুবার জন্য যে সুতোয় টান দেয় সেটাই উলটে আরও জড়িয়ে যায়।
বাইরে হালকা বৃষ্টি শুরু হয়েছে, টিনের ছাতে টুপটাপ শব্দ। লতিকা উঠে পড়ে বিছানাটা ঠিক করল, তারপর পায়ে চটি গলিয়ে বড়ো আয়নাটার সামনে বসে চুলের জট ছাড়াতে ছাড়াতে আবার অন্যমনস্ক হয়ে গেল। হাতের চিরুনিটা ধরাই রইল। করিমুদ্দিনকে বলতে ভুলে গেছে যে এখন থেকে কিছু কিছু জ্বালানি কাঠ জমিয়ে রাখতে হবে। আজকাল শুকনো কাঠের দাম কম। গত বার ভিজে কাঠে এমন ধোঁয়া হত যে ঠকঠকে শীতেও জানলা খুলে শুতে হত।
লতিকা আয়নায় দেখল ওর মুখে হাসি। গত বছর ঠাণ্ডার হাত থেকে বাঁচতে ও কোনো কোনো রাত্রে লুকিয়ে মিস উডের খালি ঘরে চলে যেত। ঐ ঘরটা শীতের সময় বিনা আগুনেও বেশ গরম থাকে। ওর নরম সোফায় শুলেই চোখ জুড়িয়ে ঘুম। ছুটির দিনে ঘরটা খালি পড়ে থাকা সত্ত্বেও মিস উডের মাথায় এতটুকু খেয়াল আসত না যে দু’মাসের জন্য ঘরটা ওর হাতে দিয়ে যায়। প্রতি বছর দরজায় তালা লাগিয়ে যায়। গত বছর বাথরুমের ছিটকিনি দিতে ভুলে গেছিল তাই লতিকা চোরের মতো ঢুকতে পেরেছিল।
প্রথম বছর একলা থাকতে ও খুব ভয় পেয়েছিল। ছুটিতে সারা স্কুল হোস্টেল শুনশান। ভয়ের চোটে ওর ঘুম আসত না, তখন ঐ করিমুদ্দিনকে গল্পগাছায় জাগিয়ে রাখত। গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লে করিমুদ্দিন বাতি নিভিয়ে চলে যেত। কখনো বা অসুখের বায়না করে ডাক্তারকে ডাকিয়ে আনত, আর পরে জেদ করে পাশের ঘরে তার জন্য বিছানা পেতে দিত।
লতিকা চিরুনি থেকে চুল ছাড়িয়ে বাইরে ফেলার জন্য আবার জানলার পাশে দাঁড়াল। বাইরে ঢালু ছাদ থেকে মোটা জলের ধারা পড়ছে লনের ঘাসে। মেঘের আড়ালে পাহাড়ের চূড়োগুলো লুকোচুরি খেলছে, যেমন চলন্ত ট্রেন থেকে দেখলে মনে হয়। জানলা থেকে মুখ বাড়াতেই ঠাণ্ডা হাওয়ার চোটে লতিকার চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে এল। ও যতই কাজের কথা মনে করতে চায় ততই আলস্য ঘনিয়ে আসে। বাসের সিট রিজার্ভ করার জন্য চাপরাশিকে পয়সা দিতে হবে, মেয়েদের ছেড়ে যাওয়া আসবাবপত্র গুদামে তুলে রাখতে হবে। নিচের ক্লাসের মেয়েদের প্যাকিং-এও সাহায্যের দরকার।
এইসব কাজে অবশ্য ওর কোনো আপত্তি নেই। সবকিছুই সময়মতো ঠিকঠাক হয়ে যায়। সব কাজেই ছোটখাটো ভুলভ্রান্তি, একটু-আধটু ঝগড়াঝাঁটি হয় ঠিকই কিন্তু পরে সব মিটে যায়। কিন্তু মেয়েদের শেষ বাসটা চলে যাওয়ার পর মনটা সত্যিই উদাস হয়ে যায়। খালি করিডরে, এঘর-ওঘর করতে থাকে, কোথাও মন লাগে না, সারাদিন কী নিয়ে কাটাবে ভেবে পায় না।
এছাড়াও আছে সবার প্রশ্ন, “মিস লতিকা, ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছেন না?”
এর কী উত্তর দেয় সে?
ডিং-ডং-ডিং… চ্যাপেল-এর স্পেশাল সার্ভিসের ঘণ্টা পড়ল। লতিকা মাথাটা ভিতরে টেনে চটপট শাড়ি ছেড়ে শুধু সায়া পরে কাঁধে তোয়ালে ফেলে বাথরুমে ঢুকে পড়ল।
লেফট-রাইট-লেফট...লেফট...
ক্যান্টনমেন্ট যাওয়ার পাকা রাস্তার উপর চার-চার জনের লাইন করে কুমায়ুন রেজিমেন্টের সেপাইরা মার্চ করছে। ফৌজি বুটের ভারি আওয়াজ চ্যাপেলের দেয়ালে টক্কর খেয়ে প্রেয়ার-হলের ভিতরেও শোনা যাচ্ছে।
“ব্লেসেড আর দ্য মীক”...ফাদার এলমণ্ড খসখসে গলায় প্রতিটি শব্দ চিবিয়ে চিবিয়ে ‘সারমন অফ দ্য মাউন্ট’ পড়ছেন। যিশুখ্রিস্টের মূর্তির নীচে ক্যান্ডেলেব্রা-র দুই দিকের মোমবাতির আলো এসে পড়েছে সামনে বসা মেয়েদের মুখে। পিছনের বেঞ্চে অন্ধকার, সেখানে মেয়েরা ‘ভক্তিভরে’ মাথা ঝুঁকিয়ে নিজেদের মধ্যে গুজগুজ ফুসফুস চালাচ্ছে। মিস উড ছাত্রী ও শিক্ষকদের আরেকটি সার্থক বছর পার হওয়ার জন্য অভিনন্দন দিয়ে বক্তৃতা শেষ করল। এখন ফাদারের পিছনে বসে কিছু বিড়বিড় করছিল, হয়তো বা ফাদারকে প্রম্পট করছিল।
“আমেন!” ফাদার টেবিলে বাইবেলটা রেখে প্রেয়ার-বুকটা তুলে নিলেন। হলের নিস্তব্ধতা একটুক্ষণের জন্য ভেঙে গেল। মেয়েরা উঠে দাঁড়িয়ে ধাক্কাধাক্কি করে পিছনের বেঞ্চে লুকোবার চেষ্টা করতে লাগল। হলের এককোণে হাসির ঢেউ। মিস উড খাড়া হয়ে বসল, কপালে ভ্রূকুটি। ফের সবাই চুপ। হলের আধো-অন্ধকারে ফাদারের তীক্ষ্ণ ফাটা গলা শোনা গেল—“যিশাস সেইড, আই অ্যাম দ্য লাইট অফ দ্য ওয়ার্ল্ড—হি দ্যাট ফলোএথ মি শ্যাল নট ওয়াক ইন ডার্কনেস, বাট শ্যাল হ্যাভ দ্য লাইট অফ দ্য লাইট...।”
ডক্টর মুখার্জি আড়মোড়া ভেঙে বলল, “কখন যে এই ভাঁড়ামো শেষ হবে!” কথাটা একটু জোরেই বলে ফেলেছিল, লতিকা সঙ্কুচিত হয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রইল। ডক্টর মুখার্জির ঠোঁটে বিদ্রূপের হাসি, একহাতে গোঁফে টান দিচ্ছিল। ফাদার এলমণ্ডের জোব্বা দেখে লতিকারও হাসি পাচ্ছিল, ছোটবয়সে ও অবাক হয়ে ভাবত, পাদ্রিরা কি সাদা জোব্বার নীচে আর কিছু পরেন না? যদি হঠাৎ কাপড়টা উঠে যায় তো?
লেফট...লেফট...লেফট...ফৌজি বুটের শব্দ মার্চ করতে করতে দূরে চলে যাচ্ছিল, শুধু হাওয়ায় তার রেশটা রয়ে গেল।
“হিম (hymn) নম্বর ১১৭,” ফাদার প্রার্থনা-বইটা খুলে বললেন। হলে মেয়েরা তাদের সামনে রাখা হিম-বই খুলে ধরল। পাতা উল্টানোর খসখসে আওয়াজ হলের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ল।
হুবার্ট পিয়ানোর সামনে টুলে বসেছিল। সঙ্গীত-শিক্ষক হওয়ার দরুন ওকে ‘কয়ের’-এর সঙ্গে পিয়ানো বাজাতে হয়। পকেট থেকে রুমাল বের করে নাকটা ঝাড়ল, নার্ভাস হলে হুবার্ট-এর এটা অভ্যেস। চোখের কোণে হল-টা দেখে নিল, তারপর কাঁপা হাতে হিম-বইটা খুলল।
লীড কাইন্ডলি লাইট...
আস্তে আস্তে, যেন ইতস্তত ভাবে পিয়ানোর সুরটা গানের সঙ্গে মিশতে লাগল।
হুবার্টএর লম্বা ফর্সা আঙুলগুলো পিয়ানোর উপর খেলে বেড়াচ্ছিল। ‘কয়ের’-এর মেয়েদের সম্মিলিত গলায় কোমল-স্নিগ্ধ সুরটা ছড়িয়ে পড়ছিল।
লতিকার মনে হল ওর খোঁপাটা যেন আলগা হয়ে গেছে। মিস উডের চোখ বাঁচিয়ে ও ক্লিপটা টাইট করে নিল।
“ভীষণ গোঁয়ার ছেলেটা। সকালে ওকে বারণ করলাম না আসতে, তাও চলে এসেছে।” ডাক্তার বলল।
লতিকার মনে পড়ল করিমুদ্দিনও বলেছিল হুবার্টের সারারাত কাশির অসুখ আর ওর চলে যাওয়ার কথাটা।
লতিকা মাথাটা বেঁকিয়ে হুবার্টের মুখটা দেখার বিফল চেষ্টা করল। এত পিছন থেকে কিছু দেখাও অসম্ভব। শুধু পিয়ানোর উপর ঝুঁকে পড়া ওর মাথাটা...
‘লীড কাইন্ডলি লাইট’…গানের সুরটা যেন হাঁফাতে হাঁফাতে একটা উঁচু পাহাড়ের উপর চড়ে আকাশের অগাধ শূন্যতায় ছড়িয়ে নীচে নামছে। বৃষ্টির পর মিঠে রোদে চ্যাপেলের লম্বা, চৌকোনা কাঁচগুলো ঝলমল। সূর্যের একটা রেখা ঠিক যিশুর প্রতিমার উপর তেরছা হয়ে পড়েছে। রোদ পড়ে মোমবাতির ধোঁয়ার নীলচে শিখাগুলো হাওয়ায় তিরতির কাঁপছে। পিয়ানো ক্ষণিক থামতে লতিকা বাইরের গাছের পাতার মর্মর শব্দ শুনতে পেল, যেন অনেক দূর কোনো অজানা দিক থেকে ভেসে আসছে। এক মুহূর্তের জন্য ওর মনে হল চ্যাপেলের আলোআঁধারি ওকে চারকোণ থেকে ঘিরে ফেলছে। যেন কেউ ওর চোখে পট্টি বেঁধে কোথাও নিয়ে এসে চোখটা হঠাৎ খুলে দিল। মোমবাতির ধোঁয়াটে আলোয় সবকিছু অবাস্তব লাগছিল—চ্যাপেলের ছাত, দেওয়াল, ডেস্কের উপর ডাক্তারের বলিষ্ঠ বাহু—আর পিয়ানোর সুর অতীতের শব্দভেদ করতে গিয়ে নিজেই সেই শব্দে মিশে যাচ্ছিল...
একটা পাগল করা স্মৃতি, একরকম উদভ্রান্ত ভাবনা—চ্যাপেলের কাঁচে শুকনো পাহাড়ি হাওয়া, ঝুঁকে পড়া উইপিং উইলোর ডালে কাঁপন, পায়ের তলায় চীর পাতার খসখস...। ঐ যে গিরিশ মিলিটারি টুপি হাতে দাঁড়িয়ে আছে—চওড়া সবল কাঁধ, ওইখানে মাথাটা নামিয়ে নিলে আর সব কিছু ভুলে যাওয়া যায়…চার্লস বোঅর, ঐ নামটা রেখেছিল সে। ঠোঁট চেপে মিটিমিটি হাসত।
“তুমি আর্মিতে ঢুকলে কী করে, মেজর হয়ে গেছ কিন্তু এখনো মেয়েদের সামনে...দুটো কথা বললেই মুখচোখ লাল হয়ে যায়।” অবশ্যই সে এতসব বলেনি, কিন্তু ভাবত—ভাবত কখনো বলব, সেই ‘কখনো’টা আর কখনোই এল না...
“লাল বুরুশ ফুল এনেছ, না ঝুঠ?”
খাকি শার্টের ব্যাজ লাগানো পকেট থেকে মুষড়ে পড়া বুরুশ ফুল বেরিয়ে এল।
“এমা, এ তো একেবারে চিপটে গেছে, এখানে কোথায় ফুটেছে?”
(হাউ ক্লামসি!)
তার চুলে গিরিশের হাত—ফুলটা আটকাচ্ছে না, সে ক্লিপ দিয়ে আটকে দিল, “দেখলে?”
ও মুখ ফিরিয়ে কিছু না বলেই খপ করে মিলিটারি টুপিটা তার মাথায় বসিয়ে দিল। সে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মাথায় গিরিশের টুপি, কপালে ছোট্ট টিপ, টিপের উপর হাওয়ায় দুটো চুল উড়ছে। গিরিশ ঠোঁট দিয়ে ঐ টিপটা ছুঁয়েছে, সে দুই হাতে ওর মাথাটা জড়িয়ে নিয়েছে—
“ম্যান ইটার অফ কুমায়ুন!” (গিরিশ মজা করে ওকে ঐ নামে ডাকত)…ও হেসে পড়ছিল।
“লতিকা...শোনো।” গিরিশের গলাটা কি অন্যরকম শোনাচ্ছিল?
“না...আমি কিচ্ছু শুনছি না।”
“লতিকা...আমি কিন্তু কয়েকমাসের মধ্যেই ফিরে আসব...”
“না...আমি শুনতে পাচ্ছি না...” কিন্তু ও শুনতে পাচ্ছিল—যা গিরিশ বলছিল তা নয়, যা তারা বলতে পারছিল না, যা তারপর আর কোনোদিন বলা হয়নি।
লীড কাইন্ডলি লাইট...
মেয়েদের গলা পিয়ানোর সঙ্গে ওঠানামা করছে। হুবার্ট মাথা ঘুরিয়ে এক পলক লতিকার দিকে তাকাল—ও চোখ বন্ধ করে ধ্যানমগ্ন পাথরের মূর্তির মত স্থির, নিশ্চল। এটা কি তারই জন্য? লতিকা কি শেষ পর্যন্ত ওকে সত্যি সত্যি নিজের সাথী বেছে নিল? হুবার্টএর দীর্ঘশ্বাসে অনেক দিনের ক্লান্তি।
“দেখো, মিস উড বসে বসেই ঘুমোচ্ছে।” ডাক্তার ফিসফিস করে বলল।
এটাও ডাক্তারের পুরনো ঠাট্টা-- মিস উড প্রার্থনার ভণিতায় চোখ বুজে ঘুমোয়।
ফাদার এলমণ্ড চেয়ার থেকে গাউনটা তুলে প্রেয়ার-বুকটা বন্ধ করলেন তারপর মিস উডের কানে কানে কিছু বললেন। হুবার্টের আঙুলে পিয়ানোর সুর ক্রমশ ধীর লয়ে নামছিল। সার্ভিস শেষ হবার আগে মিস উড একটা অর্ডার পড়ে শোনাল। বৃষ্টির আশঙ্কায় আজকের প্রোগ্রামটা বদলাতে হয়েছে। ঝুলা দেবীর মন্দিরে পিকনিকটা বাতিল হল। তাই স্কুল থেকে একটু দূরে ‘মেডোজ’-এ মেয়েরা জলখাবারের পর একত্র হবে। লাঞ্চ পাওয়া যাবে স্কুলের কিচেন থেকেই, শুধু বিকেলের চা-টা মেডোজেই তৈরি হবে।
পাহাড়ি জায়গায় বৃষ্টির কী ভরসা! একটু আগেই আকাশ জুড়ে মেঘগর্জন, সারা শহর ঠাণ্ডায় ভিজে জড়সড়। আর এখন রোদে ভরা নীল আকাশ। লতিকা চ্যাপেল থেকে বেরিয়ে দেখল রোদে উজ্জ্বল উইপিং উইলোর ভিজে ডালপালা থেকে তখনো টুপটাপ জল ঝরছে...
চ্যাপেল থেকে বেরিয়ে মেয়েরা করিডোরে ছোট ছোট দল বানিয়ে জটলা করছে। ব্রেকফাস্ট শুরু হতে এখনো পৌনে এক ঘণ্টা দেরি। মেয়েরা কেউই হোস্টেলে ফিরে যেতে চাইছে না। ছুটি এখনো শুরু হয়নি, তবু, বা হয়তো সেইজন্যই, মেয়েরা যতটুকু ফ্রি সময় পাওয়া যায় লুটেপুটে নিচ্ছিল।
মিস উড মেয়েদের এইসব গালগল্প পছন্দ করে না। কিন্তু ফাদারের সামনে ওদের বকুনি দিতে পারল না। বিরিক্তিটা লুকিয়ে হাসিমুখে বলল, “কালকে সবাই চলে যাওয়ার পর সারা স্কুল খালি হয়ে যাবে।”
ফাদার এলমণ্ডের লম্বাটে মুখটা চ্যাপেলের ভ্যাপসা গরমে লাল। করিডোরের রেলিঙে হাতের ছড়িটা লটকে জিজ্ঞাসা করলেন, “ছুটিতে হোস্টেলে কে থাকবেন?”
“গত দু’তিন বছর ধরে তো মিস লতিকাই থাকছেন।”
“আর ডাক্তার মুখার্জি?” ফাদারের ঠোঁটটা বিদ্রূপে একটু কোঁচকাল।
“ডাক্তার তো শীত-গ্রীষ্ম এখানেই থাকেন।” মিস উড অবাক হয়ে ফাদারের দিকে তাকাল। বুঝতে পারল না ফাদার ডাক্তারকে নিয়ে কেন ঠাট্টা করছেন।
“ডাক্তার মুখার্জি ছুটিতে যান না কোথাও?”
“দু’মাসের ছুটিতে বার্মা যাওয়া বেশ মুশকিল, ফাদার।” মিস উড হাসল।
“মিস উড, জানি না আপনি কি মনে করেন, আমার কিন্তু মিস লতিকার একা-একা হোস্টেলে থাকাটা ভাল লাগছে না।”
“কিন্তু ফাদার, এটা তো কনভেন্ট স্কুলের নিয়ম, টিচাররা ছুটিতে নিজের খরচে হোস্টেলে থাকতে পারেন।”
“আমি স্কুলের নিয়মের কথা বলছি না, বলছি যে মিস লতিকা আর ডাক্তার একা হোস্টেলে থাকছে...সত্যি বলেন তো মিস উড, আমার ডাক্তারের চালচলন ভালো মনে হয় না।”
“কী যে বলেন ফাদার! মিস লতিকা কি বাচ্চামেয়ে নাকি?” মিস উড ভাবেনি যে ফাদার এলমণ্ডও এরকম সেকেলে মনের লোক।
ফাদার এলমণ্ড একটু মিইয়ে গেলেন। প্রসঙ্গ বদলাতে বললেন, ”মিস উড, আমি তা বলছি না। আপনি তো জানেনই মিস লতিকা আর সেই মিলিটারি অফিসারকে নিয়ে কীরকম স্ক্যানডাল ঘটেছিল, স্কুলের বদনাম হতে আর কতক্ষণ?”
“সে বেচারা তো আর বেঁচে নেই। আমি তাকে জানতাম, ফাদার। ঈশ্বর তার আত্মাকে শান্তি দিন।”
মিস উড আস্তে করে দুই হাতে ক্রস করলেন।
মিস উডের আপাত মূর্খতায় ফাদারের এতই রাগ হল যে আর কিছু বলতে পারলেন না। ডাক্তারের সঙ্গে কথায় আঁটতে পারেন না, তাই মিস উডের চোখে তাকে হেয় করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মিস উড লতিকার দুঃখ গাইতে বসল। আর কিছু বলে লাভ নেই। ছড়িটা তুলে উপরে পরিষ্কার আকাশ দেখিয়ে বললেন, “আপনি শুধু শুধু প্রোগ্রামটা বদলালেন মিস উড, কোথায় আর বৃষ্টি!”
চ্যাপেল থেকে বেরোতেই হুবার্টএর চোখ ঝলসে উঠল, যেন কেউ এক মুঠো রোদ ওর চোখে ছুঁড়ে মেরেছে। পিয়ানোর রেশটা তখনো ওর মস্তিষ্কের শিরা-উপশিরায়। খুব ক্লান্ত লাগছিল। পিয়ানো বাজাবার সময় ওর বুকে চাপ পড়ে, ধুকপুকানি বেড়ে যায়, গানের এক সুর থেকে অন্য সুরে ওঠার সময় ওর মনে হয় যেন কোন গভীর পরিখা পার হচ্ছে।
হুবার্ট ভাবতে লাগল, “আজ চ্যাপেলে যেন বিচিত্র রহস্যময় কিছু মনে হল। মনে হল পিয়ানোর একেকটি সুর পুরনো অন্ধকার গুহা থেকে বেরিয়ে বাইরের নীল কুয়াশা ভেদ করে কোনো ভুলে যাওয়া উদ্দেশ্য টেনে বার করছে। নামতে থাকা প্রতিটি বিরতি যেন একেকটা ছোট্ট মৃত্যু। ঘন পাতাভরা গাছের কাঁপা কাঁপা ছায়ায় যেন কেউ পথ হারিয়ে ফেলেছে। ছোট্ট মৃত্যুটি আগামী সুরের মধ্যে নিজের শেষ নিঃশ্বাস সমর্পণ করে যাচ্ছে...
“ডাক্তার, এইভাবেই কি মৃত্যু আসে? ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলে সে হয়তো হেসে পাশ কাটাবে। আমার তো মনে হয় ও গত কয়েকদিন ধরে কিছু একটা লুকোচ্ছে আমার কাছ থেকে—ওর হাসিতে মেশানো সহানুভূতিটা আমার ভালো লাগছে না। আজ আমাকে স্পেশাল সার্ভিসে যেতে মানা করছিল, কারণ জিজ্ঞেস করতে চুপ হয়ে গেল। এ কীরকম কথা যা ও আমাকে বলতে চায় না? কে জানে, হয়তো কিছুই না, আমিই সন্দেহবাতিক হয়ে পড়ছি।”
হুবার্ট দেখতে পেল একদল মেয়ে স্কুল থেকে হোস্টেলে যাওয়ার রাস্তা বেয়ে নামছে। ওদের রংচঙে রিবন, হাল্কা আসমানি ফ্রক আর সাদা বেল্ট সকালের রোদে ঝকমক করছে। সিনিয়র কেম্ব্রিজের কয়েকটি মেয়ে চ্যাপেলের বাগান থেকে গোলাপফুল তুলে নিজেদের মাথায় লাগিয়েছে। ক্যান্টনমেন্টের কয়েকজন সেপাই ওদের দেখে অশ্লীল হাসিঠাট্টা করছিল, কেউ কেউ ঝুঁকে সিটিও দিল।
“হ্যালো, মিস্টার হুবার্ট...” হুবার্ট চমকে পিছন ফিরে দেখল লতিকা একটা মোটা রেজিস্টার হাতে দাঁড়িয়ে।
“আপনি এখনো এখানে?” হুবার্টের চোখ লতিকার উপর নিবদ্ধ। ও একটা ক্রিম রঙের পুরোহাতা কোট পরেছে। কুমায়ুনী মেয়েদের মত সুডৌল গলা, পাকা গমের রং রোদ্দুরের তাপে একটু একটু গোলাপি দেখাচ্ছে, যেমন অনেক ধোয়ার পরেও কাপড়ে গোলাপি ছোপ একটু-আধটু লেগে থাকে।
“ঐ মেয়েদের নাম নোট করার ছিল—যারা কাল চলে যাচ্ছে। তাই দাঁড়াতে হল। আপনিও তো কালকেই যাচ্ছেন, তাই না?”
“এখনো পর্যন্ত তা-ই প্ল্যান। এখানে থেকেই বা কী করব? আপনি স্কুলের দিকে যাচ্ছেন?”
“চলুন।”
পাকা রাস্তায় মেয়েদের ভিড়, তাই ওরা পোলোগ্রাউন্ডের পাশ দিয়ে সরু রাস্তাটা ধরে নামতে লাগল।
জোর হাওয়ায় চীরগাছের পাতাগুলো রাস্তার উপর ডাঁই হচ্ছিল। রাস্তা সাফ করতে হুবার্ট ছড়ি দিয়ে পাতাগুলো দু’ধারে সরিয়ে দিচ্ছিল। লতিকা চলতে চলতে দেখল কেমন আলমোড়ার দিক থেকে হাল্কা মেঘেরা রেশমি রুমালের মত সূর্যের মুখ ঢাকে, কখনো বা হাওয়ায় উড়ে যায়। এই খেলায় রোদ কখনো মেঘে ঢাকা পড়ে, কখনো তার তপ্ত আঁচল সারা শহরে বিছিয়ে দেয়।
লতিকা আগেআগে হাঁটছে। হুবার্টের শ্বাস ধরছিল, সে হাঁপাতে হাঁপাতে পিছু পিছু আসছিল। পোলোগ্রাউণ্ড প্যাভিলিয়ন ছাড়িয়ে মিলিটারির ডান দিকে ঘুরে লতিকা তার অপেক্ষায় দাঁড়াল। ছুটির দিনে ঘরে বসে একঘেয়ে লাগলে ও প্রায়ই হাঁটতে হাঁটতে মিলিটারি পর্যন্ত চলে যায়। কাছের টিলায় চড়ে বরফ ঢাকা দেওদার গাছগুলির শোভা দেখে। কেমন নুয়ে পড়া ডাল থেকে নরম তুলোর বলের মতো বরফ নীচে পড়ে। নীচে বাজারমুখী রাস্তায় বাচ্চারা বরফের উপর স্লেজ চালায়। ও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে সেই বরফঢাকা রাস্তাটা—ফাদার এলমণ্ডের ঘর থেকে ডাকঘর ও মিলিটারি হাসপাতাল হয়ে চ্যাপেলের সিঁড়ির কাছে কেমন মিলিয়ে যায়। একটা ধাঁধার সমাধান পেলে যেমন ভালো লাগে, লতিকারও তেমনি বরফে লুকানো রাস্তাটার খোঁজ পেয়ে আনন্দ হত।
“আপনি ভীষণ জোরে হাঁটেন।” পরিশ্রমে হুবার্টের মুখ শুকিয়ে গেছে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
“কাল রাতে আপনার শরীর খারাপ হয়েছিল শুনলাম।”
“আপনাকে কে বলল? আমায় অসুস্থ দেখাচ্ছে নাকি?” হুবার্টের গলায় একটু বিরক্তির আভাস। ভাবছিল সবাই তার স্বাস্থ্য নিয়েই ব্যস্ত।
“না, না, আমি তো জানতামই না। ঐ করিমুদ্দিন বলল কথায় কথায়।” লতিকা অপ্রতিভভাবে বলল।
“এমন কিছু না, একটা পুরনো ব্যথা চাগিয়ে উঠেছিল। এখন একেবারে ঠিক।” বলে গায়ের জোর দেখাতে বুক চিতিয়ে কয়েক পা এগিয়ে গেল।
“ডাক্তার মুখার্জিকে দেখিয়েছিলেন?”
“সকালে এসেছিল। আমি ওর কথা বুঝি না। সবসময় উলটোপালটা কথা বলে। বলল আমার ছ’সাত মাস ছুটি নিয়ে আরাম করা দরকার। কিন্তু আমি যদি ভালোই আছি তো ওসবের কী দরকার?”
ওর গলায় ক্ষুণ্ণ ভাবটা লতিকার কাছে চাপা রইল না। কথা ঘুরিয়ে বলল, “আপনি হয়তো এমনিই চিন্তা করছেন। আজকাল সিজন চেঞ্জের সময় সুস্থ লোকেরাও অনেক সময় একটু-আধটু অসুস্থ হয়ে পড়ে আর কি।”
হুবার্টের মুখটা একটু উজ্জ্বল হল। ও লতিকার দিকে চেয়ে বুঝতে চাইল সে তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য মিথ্যে বলছে না তো।
“আমিও তো তাই ভাবলাম, মিস লতিকা! ডাক্তারের কথায় আমার ভয় ধরে গেছিল। ছ’মাস ছুটি নিয়ে একলা একলা করবটা কি? স্কুলে বাচ্চাদের সঙ্গে সময়টা কাটে। সত্যি বলতে কি এই দু’মাসও দিল্লীতে কাটানো মুশকিল হবে।”
“কাল আপনি দিল্লী যাচ্ছেন?”
লতিকা চলতে চলতে হঠাৎ থেমে গেল। সামনে পোলো গ্রাউণ্ড, ওপাশের রাস্তায় মিলিটারি ট্রাক যাচ্ছে ক্যান্টনমেন্টের দিকে। হুবার্টের মনে হল লতিকার আধবোজা চোখের পাতায় পুরনো ভুলে যাওয়া স্বপ্নটা ভাসছে।
“মিস্টার হুবার্ট...আপনি দিল্লী যাচ্ছেন!” এবার লতিকার গলায় প্রশ্ন নয়—একটা অসীম দূরের ছোঁয়া ছিল।
“জানেন, অনেক বছর আগে আমি একবার দিল্লী গেছিলাম। খুব ছোট ছিলাম তখন। কে জানে কত বছর আগে। আমার মাসির বিয়ে হয়েছিল সেখানে। অনেক কিছু দেখেছিলাম কিন্তু এখন সবই আবছা মনে পড়ে। এইটুকু মনে আছে, কুতুব মিনারে চড়েছিলাম। সবথেকে উপরতলা থেকে নীচে দেখতে কেমন যেন লাগছিল। নীচের লোকগুলো চলছে যেন দম দেওয়া পুতুল। আমরা উপর থেকে চীনেবাদাম ছুঁড়ছিলাম কিন্তু ওরা কেউ তাকিয়েও দেখল না। মা বকুনি দিয়েছিল আর তারপর আমি নিচে ঝুঁকতে ভয় পাচ্ছিলাম...এখন তো শুনি দিল্লী এত বদলে গেছে যে চেনাই মুশকিল।”
ওরা দুজনে আবার হাঁটতে শুরু করেছে। হাওয়ার বেগ কম। আকাশে উড়ন্ত মেঘগুলি এখন শান্ত। তাদের ছায়া পড়েছে পঞ্চৌলি ও নন্দাদেবী পাহাড়ের উপর। স্কুলের কাছে পৌঁছতে চীরগাছের দল পিছনে পড়ে থাকল। কোথাও কোথাও এপ্রিকট গাছের আশপাশে লাল বুরুশ ফুল রোদ্দুরে ঝকমক করছে।
“মিস লতিকা, আপনি ছুটিতে কোথাও যান না কেন? শীতের সময় এখানে তো সব শুনশান হয়ে যায়।”
“এখন আমার সেটাই ভালো লাগে।” লতিকা বলল, “প্রথম বছর একলা থাকতে একটু কষ্ট হয়েছিল, এখন অভ্যেস হয়ে গেছে। ক্রিসমাসের আগের রাতে ডান্স হয়, লটারি হয়, অনেক রাত পর্যন্ত নাচগান চলে। নতুন বছরের দিন কুমায়ুন রেজিমেন্ট প্যারেড গ্রাউণ্ডে কার্নিভ্যাল করে, বরফের উপর স্কেটিং করে। রঙিন বেলুনের নীচে ফৌজি ব্যান্ড বাজে, ফৌজি অফিসাররা ফ্যান্সি ড্রেস পরে যোগ দেয়। এসব হয় প্রত্যেক বছর, মিস্টার হুবার্ট। কিছুদিন পর উইন্টার স্পোর্টস-এর জন্য অনেক ইংরেজ ট্যুরিস্ট আসে। প্রত্যেক বছর তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। ফিরে যাওয়ার সময় তারা কথা দিয়ে যায় আবার আসবে কিন্তু তারা জানে আসবে না, আমিও জানি তারা আসবে না তবু আমাদের বন্ধুত্বে কোনো ঘাটতি পড়ে না। তারপর…তার কিছুদিন পরেই বরফ গলা শুরু হয়ে যায়। ছুটিও শেষ, আপনারা সবাই যে যার ঘরে ফিরে আসেন। আর মিস্টার হুবার্ট, মনেই থাকে না কখন যে ছুটিটা শুরু হল আর কখনই বা শেষ হয়ে গেল...”
লতিকা দেখল হুবার্ট তার দিকে সন্ত্রস্ত চোখে তাকিয়ে। ও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চুপ করে গেল। ভাবল, হয়তো পাগলের মত বকবক করেছে।
“মাফ করবেন মিস্টার হুবার্ট, আমি কখনো কখনো বাচ্চাদের মত অনর্গল কথা বলে যাই।”
“মিস লতিকা,” হুবার্ট দাঁড়িয়ে পড়ে গভীরস্বরে বলল, লতিকা ওর গলা শুনে একটু থমকে গেল।
“কী হল মিস্টার হুবার্ট?”
“সেই চিঠিটা...আমি খুব লজ্জিত। ওটা আপনি আমায় ফেরত দিন। ভুলে যান যে আমি আপনাকে লিখেছিলাম।”
লতিকা কিছু বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে হুবার্টএর ফ্যাকাশে উদ্বিগ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
হুবার্ট আস্তে করে ওর কাঁধে হাত রাখল।
“কাল ডাক্তার আমায় সবকিছু বলেছে। যদি আগে থেকে জানতাম তো…তো...” হুবার্ট তোতলাচ্ছিল।
“মিস্টার হুবার্ট...” লতিকা আর কিছু বলতে পারল না, ওর মুখও রক্তহীন।
স্কুলগেটের বাইরে ওরা মূক দাঁড়িয়ে রইল।
‘মেডোজ’ পাকদণ্ডী, পাতা ও ছায়ায় ঘেরা ছোট্ট একটি দ্বীপ, দুটি সবুজ উপত্যকার মাঝে। পিকনিকের আগুনে পোড়া কালো পাথর, আধপোড়া ডালপালার টুকরো, বসার জন্য বিছানো পুরনো খবরের কাগজ এখানে সেখানে দেখা যায়। ট্যুরিস্টরাও এখানে আসে পিকনিক করতে। মেডোজের মাঝখান দিয়ে একটা বাঁকাচোরা বর্ষার নালা—দূর থেকে রোদ্দুরে সাদা ফিতের মত ঝিকমিক করে। ঐখানেই একটা কাঠের তক্তা পাতা পুলের উপর মেয়েরা টলোমলো ভাবে হাঁটছিল।
“ডাক্তার মুখার্জি, আপনি তো সারা বনে আগুন লাগিয়ে দেবেন!” মিস উড তার হাইহিল জুতো দিয়ে চীর পাতার উপর ফেলা ডাক্তারের জ্বলন্ত দেশলাইটা নিভিয়ে দিল। সে নালার থেকে একটু তফাতে দুটো চীর গাছের ছায়ায় বসেছিল। তাদের সামনে একটা ছোট্ট রাস্তা নিচে পাহাড়ি গাঁর দিকে চলে গেছে যেখানে পাহাড়ের কোলে একটার নিচে আরেকটা আখের খেত বিছানো। নিস্তব্ধ দুপুরে ভেড়া ছাগলের গলার ঘণ্টির টুংটাং অনেক দূর অবধি শোনা যাচ্ছিল।
ঘাসের উপর শুয়ে সিগার টানতে টানতে ডাক্তার বলল, “জঙ্গলের আগুন কখনো দেখেছ মিস উড? একটা পাগলামি নেশার মতো ধীরে ধীরে ছড়াতে থাকে।”
“আপনি দেখেছেন নাকি? মিস উড জিজ্ঞেস করল, “আমার তো বাবা ভীষণ ভয় করে।”
“অনেক বছর আগে একটা শহর জ্বলতে দেখেছিলাম।” ডাক্তার আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “একেকটা বাড়ি তাসের ঘরের মতো পড়ে যাচ্ছিল। দুর্ভাগ্যবশত এরকম সুযোগ খুব একটা আসে না।”
“আপনি কোথায় দেখলেন?”
“যুদ্ধের সময় আমার শহর রেঙ্গুনকে জ্বলতে দেখেছিলাম।”
মিস উড একটু ধাক্কা খেল কিন্তু কৌতূহলটা তখনো কমেনি। “আর আপনার বাড়িটা—সেটাও কি পুড়ে গেছিল?”
ডাক্তার কিছুক্ষণ চুপ করে শুয়ে রইল।
“আমরা বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিলাম, জানি না পরে কী হয়েছিল।” নিজের ব্যাক্তিগত জীবন সম্বন্ধে ডাক্তার কিছু বলতে চায় না।
“আপনি কখনো বার্মায় ফিরে যাবার কথা ভাবেননি?”
ডাক্তার আড়মোড়া ভেঙে পাশ ফিরে আবার চোখ বুজল। মাথার চুলগুলো মুখে এসে পড়ল।
“ভেবে আর কী হয় মিস উড, যখন বার্মায় ছিলাম তখন কি কখনো ভেবেছিলাম যে এখানে এসে থাকতে হবে?”
“কিন্তু ডাক্তার, যা-ই বলুন, নিজের দেশের মতো সুখ আর কোথাও পাবেন না। এখানে যতদিনই থাকুন না নিজেকে সবসময় বিদেশীই মনে হবে।”
ডাক্তার সিগারের ধোঁয়াটা হাওয়ায় ছেড়ে দিয়ে বলল, “আসলে আমি তো সেখানেও বিদেশী, মিস উড। এত বছর পরে সেখানে কে চিনবে আমাকে? এই বয়সে নতুন করে সম্বন্ধ পাতানো খুব কঠিন, অন্তত আমার দ্বারা সম্ভব নয়।”
“কিন্তু, ডাক্তার, তা বলে কতদিন আপনি এই অজ পাড়াগাঁয়ে পড়ে থাকবেন? এদেশেই থাকবেন তো কোনো বড়ো শহরে প্র্যাকটিস শুরু করুন না।”
“প্র্যাকটিস বাড়াতে গেলে এখানে সেখানে ঘুরে মরতে হয়। তার থেকে এই-ই ভালো। যেখানে আছি সেখানেই রোগী মিলে যায়। এখানে ভালো লাগলো তাই রয়ে গেলাম, যখন আর লাগবে না চলে যাব অন্য কোথাও। আমার কোন শিকড় নেই, তাই পিছটানও নেই। আমার নিজের সম্বন্ধে কোন ভুল ধারণা নেই মিস উড, আমি খুব সুখী।”
মিস উড ডাক্তারের কথাটা গ্রাহ্য করল না। মনে মনে সে ডাক্তারকে উচ্ছৃঙ্খল, উদাসীন ও একটু মাথাখারাপ ভাবে। কিন্তু তার চরিত্রের উপর ওর খুব বিশ্বাস।
মিস উড একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ওর দৃঢ় ধারণা যে ডাক্তার এরকম অলস আর খামখেয়ালি না হলে নিজের যোগ্যতায় খুব নাম করতে পারত। এজন্য ডাক্তারের উপর তার রাগও হয় আর দুঃখও।
মিস উড ব্যাগ থেকে উলকাঁটাটা সরিয়ে রেখে নিচে কাগজে মোড়া কফির ডাব্বাটা বের করল। সেটায় ডিমের স্যান্ডউইচ আর হ্যামবার্গারও রাখা ছিল। থারমস থেকে কাপে কফি ঢেলে ডাকল, “ডাক্তার, কফি জুড়িয়ে যাচ্ছে।”
ডাক্তার শুয়ে শুয়েই কিছু একটা বিড়বিড় করল। মিস উড দেখল সে কনুইয়ে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। তার উপরের ঠোঁটটা একটু খোলা, যেন এখুনি হেসে উঠবে।
জ্বলন্ত সিগারটা তখনো আঙুল থেকে ঝুলছে।
“মেরী, মেরী হোয়াট ডু ইউ ওঅন্ট?” দ্বিতীয় স্ট্যান্ডার্ডএর মেরী তার চপল চোখদুটি উপরে তুলল। তাকে ঘিরে মেয়েদের বলয় কখনো কাছে আসছে, কখনো দূরে সরে যাচ্ছে।
“আই ওআণ্ট, আই ওআণ্ট...ব্লু!” দুই হাত তুলে মেরী চেঁচিয়ে উঠল। সঙ্গেসঙ্গে মেয়েদের বলয়টা ভেঙে ছড়িয়ে পড়ল। সবাই কোনো নীল জিনিশ ছোঁয়ার জন্য এদিক-ওদিক দৌড় লাগাল।
লাঞ্চ শেষ, মেয়েরা ছোট ছোট দলে এখানে-ওখানে ছড়িয়ে। উঁচু ক্লাসের কয়েকজন চা গরম করার জন্য গাছে চড়ে শুকনো ডালপালা ভাঙছে।
দুপুরের ঐ সময়টায় ‘মেডোজ’ আলস্যে নিস্তব্ধ। দমকা হাওয়ায় চীরের পাতাগুলোর মর্মরধ্বনি শোনা যায় কোন পাখি হয়তো আলস্য ভাঙতে ঝোপ থেকে উড়ে নালার ধারে গিয়ে বসল। জলে একটু মাথা ডুবোল, তারপর হাওয়ায় দুটো চক্কর মেরে আবার ঝোপে অদৃশ্য হয়ে গেল।
কিন্তু জঙ্গলের নিস্তব্ধতা কখনো অটুট থাকে না। গভীর ঘুমে ডোবা স্বপ্নের মতো শব্দগুলো নীরবতার হাল্কা উড়নির ভাঁজে ভাঁজে ছড়িয়ে যায়। হাওয়া তিরতির কাঁপে, যেন কেউ পা টিপে টিপে অদৃশ্য সঙ্কেত করছে—দেখো, আমি এখানে।
লতিকা জুলির ববকাট চুলে হাত বুলিয়ে বলল, ”তোমায় কাল রাতে আসতে বলেছিলাম না?“
“ম্যাডাম আমি গেছিলাম, কিন্তু আপনি কামরায় ছিলেন না।” লতিকার মনে পড়ল কাল রাতে ও ডাক্তারের সঙ্গে ছাতে বসেছিল অনেক রাত পর্যন্ত। ঘরের ভিতরে হুবার্ট শোপ্যাঁর নকটার্ন বাজাচ্ছিল।
“জুলি, তোমায় কিছু বলার ছিল।” লতিকা জুলির চোখ থেকে নিজেকে সরাতে চাইছিল।
জুলি মুখ তুলল। ওর বড়ো বড়ো চোখে কৌতূহল।
“জুলি তুমি মেসের অফিসারদের কাউকে জানো?”
মেয়েটা অনিশ্চিত ভাবে মাথা নাড়ল। লতিকা কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে রইল।
“জুলি আমি জানি তুমি মিথ্যা বলবে না।” জুলির চোখের কৌতূহলটা এবার আস্তে আস্তে ভয়ে পরিণত হচ্ছিল।
লতিকা তার কোটপকেট থেকে একটা নীল খাম বের করে জুলির কোলে ফেলে দিল।
“এটা কার চিঠি?”
জুলি খামটা তুলতে হাত বাড়াতে গিয়েও থেমে গেল। খামে ওর নাম আর হোস্টেলের ঠিকানা লেখা।
“থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম, এটা আমার ভাইয়ের চিঠি, ঝাঁসিতে থাকে।” ও তাড়াতাড়ি খামটা স্কার্টের ভাঁজে লুকোবার চেষ্টা করল।
“জুলি, খামটা দেখাও আমায়।” লতিকার স্বর কঠিন।
নাচার জুলি খামটা লতিকাকে ফেরত দিল।
“তোমার ভাই ঝাঁসিতে?”
জুলি এবার নিশ্চুপ। উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে আছে।
“এটা কী?”
জুলির মুখ ফ্যাকাসে, খামের উপর কুমায়ুন রেজিমেন্টাল সেন্টারের মোহরছাপ ওর দিকেই তাকিয়ে আছে!
“এ কে?” লতিকা জিজ্ঞেস করল। সে আগেও হোস্টেলে ভাসা ভাসা গুজব শুনেছিল যে জুলিকে ক্লাবে কোন মিলিটারি অফিসারের সঙ্গে দেখা গেছে। স্কুলে এরকম গুজব প্রায়ই ছড়ায়, তাই সে বিশ্বাস করেনি।
“জুলি, তুমি এখনও অনেক ছোট—” জুলির ঠোঁট কাঁপছে, চোখে নির্দোষীর অনুরোধ।
“আচ্ছা, যাও এখন। ছুটির পর আবার কথা হবে।”
জুলি লোলুপদৃষ্টিতে খামটার দিকে তাকাল। কিছু একটা বলতে গিয়েও না বলে চুপ করে বেরিয়ে গেল।
লতিকা ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল। আমিই কি কোন খিটখিটে বুড়ির থেকে কম? অপরের উপর নিজের অভাবের প্রতিশোধ তুলছি?
কে জানে হয়তো এটা জুলির প্রথম পরিচয়, সব মেয়েই এই অনুভূতিটা বড়ো যত্ন করে নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখে। এই এক অনির্বচণীয় সুখ যা কষ্টও আনে তার সঙ্গে। একটা বাড়তে থাকা জোয়ারের মতো, বেদনা আর আনন্দ দুটোই আলিঙ্গন করে নেশায় ডুবে যায়। এই ব্যথা, আনন্দেই তো তার জন্ম—
এই দেওদারের ছায়ায় তারও এ-ই মনে হয়েছিল। যখন গিরিশ জিজ্ঞেস করেছিল, “চুপ কেন?” ও চোখ বুজে ভাবছিল—না, ভাবছিল কোথায়, বেঁচে নিচ্ছিল, সেই মুহূর্তটা, যখন ভয় আর বিস্ময় দুটোই ওকে পাগল করে ফেলেছে। ও পিছন ফিরলেই গিরীশের ‘নার্ভাস’ হাসিটা দেখতে পাবে আর তখন থেকে আজকের দুপুর পর্যন্ত দুঃস্বপ্নের অতীতটা ভেঙে যাবে। ঐ দেওদার গাছটার ছালে মাথার ক্লিপ দিয়ে ও গিরিশের নাম লেখার চেষ্টা করেছিল। ছালটা শক্ত, ক্লিপটা ভেঙে ভেঙে যাচ্ছিল। তখন গিরিশ নিজের নামের নিচে ওর নামটা লিখে দিল। ও গিরিশের আঁকাবাঁকা অক্ষর দেখে হাসছিল আর গিরিশের কাঁপা হাত আরও কেঁপে যাচ্ছিল।
লতিকা যতই মনে করে ততই ভুলতে চায়। কিন্তু যখন সত্যিই ভুলে যায়, মনে হয় যেন কেউ ওর হাত থেকে কিছু ছিনিয়ে নিচ্ছে। কিছু একটা, যা চিরকালের জন্য হারিয়ে যাবে। ছোটবেলায় যখন কোন খেলনা হারিয়ে যেত, ও গুম হয়ে ভাবত কোথায় সেটা রেখেছিল। যখন অনেক খোঁজাখুঁজির পর পাওয়া যেত, তখন এমন ভান করত যেন এখনো পাওয়া যায়নি। জেনেশুনেও খেলনাটার দিকে না গিয়ে অন্য জায়গায় খোঁজার ছল করত। তবেই ওর মনে থাকত, আর খেলনাটা হারানোর ভয় ছিল না।
আজ সেই ছোটবেলার ভান কেন করতে পারে না? ভান হয়তো করে—তাকে মনে করার ভান, যাকে সে দিন দিন ভুলে যাচ্ছে। মাস কেটে যায় আর তার অজান্তেই গিরিশের মুখটা আবছা হয়ে আসে। মনে তো করে কিন্তু যেন পুরনো ফোটোর ধুলোভরা কাঁচ সাফ করছে। তবে এখন আর ওকে মনে করতে সেরকম কষ্ট হয় না যেমন প্রথম প্রথম হত। সেজন্য মনে অপরাধবোধও হয়। তাই সে পুরনো ঘা-টা আরও খোঁচায়। তা সত্ত্বেও সময়ের নিয়মে ঘা-টা আস্তে আস্তে সারতেই থাকে।
দেওদার গাছের প্রায় মিলিয়ে যাওয়া নামটা ওর দিকে নিরীহভাবে চেয়ে আছে। ‘মেডোজে’ ঘনিয়ে আসা নীরবতায় দূর থেকে মেয়েদের খেলার আওয়াজ আসছিল...
হোয়াট ডু ইউ ওআণ্ট...হোয়াট ডু ইউ ওআণ্ট--?
প্রজাপতি, ঝিঁঝিঁ পোকা, জোনাকি—মেডোজে সন্ধ্যার ছায়ায় বোঝা যায় না কোন ডাকটা কিসের। দুপুরে শব্দগুলো আলাদা আলাদা চেনা যেত, এখন সন্ধ্যেয় সব মিশিয়ে একাকার হয়ে গেছে। ঘাসের উপর কেউ যেন পা মুছছে। ঝোপের মধ্যে ডানার ফড়ফড়ানি, কিন্তু তাকিয়ে দেখো তো কিচ্ছু নেই। মেডোজে ঝর্নার ঘর্ঘর আওয়াজ যেন অন্ধকার সুড়ঙ্গের ভিতরে ট্রেনের শব্দ—অনেক দূর পর্যন্ত তার হুইসিল আর চাকার আওয়াজ শোনা যায়...
পিকনিক আরও কিছুক্ষণ চলত কিন্তু আস্তে আস্তে একের পর এক মেঘের স্তর জমতে শুরু করছিল। সবাই পিকনিকের জিনিসপত্র গুছিয়ে তুলছিল। মেয়েরা মিস উডের পাশে জমা হচ্ছে, হাতে অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিষ। কারুর মাথায় পাখির ভাঙা পালক, কেউ-বা গাছের ডাল ছুলে বেত বানিয়েছে। উঁচু ক্লাসের মেয়েরা রুমালের ভিতর ছোট ছোট মাছ ধরে একে অন্যকে দেখাচ্ছে।
মিস উড একদল মেয়ের সঙ্গে হাঁটা লাগাল। পাকা রাস্তায় তিন-চার ফারলং চড়াই। লতিকা হাঁপাচ্ছে। ডাক্তার মুখার্জি সবার পিছনে। লতিকার কাছে এসে হাঁটু মুড়ে, মাথা নুইয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে ইংরেজিতে বলল, “ম্যাডাম, আপনাকে এত ক্লান্ত লাগছে কেন?”
ওর ঢং দেখে লতিকার হাসি পেয়ে গেল।
“তেষ্টায় গলা কাঠ আর এই চড়াই যে শেষই হয় না।”
ডাক্তার কাঁধে ঝোলানো থারমসটা লতিকার হাতে দিয়ে বলল, “একটু কফি আছে, খেয়ে নিন, আরাম পাবেন।”
“পিকনিকে কোথায় ছিলেন? দেখতে পেলাম না তো।”
“সারা দুপুর ঘুমোচ্ছিলাম, মিস উডের সঙ্গে—মানে মিস উড পাশে বসেছিল আর কী।
“আমার মনে হয় মিস উড আমার প্রেমে পড়েছে।” ঠাট্টা করার সময় ডাক্তার গোঁফের ডগাটা চিবোয়।
“কী বলছিল?” লতিকা থারমসের কফিটা গলায় ঢেলে শুধোল।
“হয়ত কিছু বলেছিল কিন্তু কপালের গেরো, আমি ঠিক সেই সময়ই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমার এই হতচ্ছাড়া ঘুমের জন্য জীবনে বেশ কয়েকটা মিষ্টি প্রেম অসম্পূর্ণ রয়ে গেল।”
এইভাবেই ওদের কথাবার্তার মধ্যে মেডোজ আর মোটর রাস্তার পাশের চীর ও ওকগাছগুলি অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছিল, যেন প্রার্থনার সময় চুপ করে মাথা নুইয়ে ফেলছে। এই গাছের উপরেই মেঘের দল গির্জার ক্রস পর্যন্ত ঢেকে ফেলেছে, নিচে ঢালু পাহাড়ের গায়ে বিছানো খেতগুলো দেখাচ্ছে কাঠবেড়ালির পিঠের মতো।
“ডাক্তার, মিস্টার হুবার্ট পিকনিকে আসেনি?”
ডাক্তার মুখার্জি টর্চ জ্বালিয়ে আগে আগে হাঁটছিল।
“আমি ওকে বারণ করেছিলাম।”
“কেন?”
অন্ধকারে পায়ের তলায় পাতাগুলো একটু বেশিই শব্দ করছিল। ডাক্তার আস্তে কাশল। “কিছুদিন ধরে আমার সন্দেহ হচ্ছিল যে ওর বুকের ব্যথাটা মামুলি নয় বোধহয়।” ডাক্তার একটু হাসল, যেন এত সিরিয়াস হওয়াটা ওকে মানায় না।
ডাক্তার একটু অপেক্ষা করল, যদি লতিকা কিছু বলে। কিন্তু লতিকা চুপ করে ওর পিছন পিছন হাঁটতে থাকল।
“এটা স্রেফ আমার ধারণা, হয়তো একেবারেই ভুল, কিন্তু ওর একটা এক্স-রে করানো দরকার। তাহলেই ঠিক জানা যাবে।”
“আপনি ওকে কিছু বলেছেন এ সম্বন্ধে?”
“এখনো বলিনি। ও অল্পেতেই খুব কাতর হয়ে পড়ে। তাই সাহস করিনি...”
ডাক্তারের মনে হল পিছনে লতিকার পায়ের শব্দ হঠাৎ যেন থেমে গেল। পিছন ফিরে দেখল লতিকা অন্ধকারে রাস্তার মাঝে চুপ করে দাঁড়িয়ে।
“ডাক্তার...” লতিকা দম-বন্ধ গলায় ডাকল।
“কী হল লতিকা? দাঁড়িয়ে গেলে কেন?
“ডাক্তার... মিস্টার হুবার্ট কি...”
ডাক্তার টর্চের আলোয় দেখল লতিকা পাতার মত কাঁপছে, মুখ একেবারে ফ্যাকাসে।
“মিস লতিকা, কী হয়েছে? ভয় পেয়েছ মনে হচ্ছে—”
“কিছু না ডাক্তার...আমার...আমার কিছু মনে পড়ল...”
দুজনে আবার হাঁটতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পরে দুজনেই মুখ তুলে উপরে তাকিয়ে দেখল এক ঝাঁক পাখি ত্রিকোণ লাইন করে পাহাড়ের ওপার থেকে ওদের দিকে উড়ে আসছে। লতিকার মনে পড়ল প্রতি বছর শীতের ছুটির মুখে ও এই পাখিদের ময়দানের দিকে উড়তে দেখে। তারা কিছুদিনের জন্য এই পাহাড়ি স্টেশনে প্রতীক্ষা করে, তারপর বরফ পড়া শুরু হলে নীচে কোন অজানা বিদেশে উড়ে যায়।
আমরাও কি প্রতীক্ষা করছি? সে, ডাক্তার মুখার্জি, মিস্টার হুবার্ট—কিন্তু কিসের অপেক্ষায়, আমরা কোথায় যাব—
কোনো উত্তর পেল না। অন্ধকারে মেডোজের ঝর্নার ভৌতিক শব্দ আর চীরপাতার সরসর ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছিল না।
লতিকা জড়সড় ভাবে হাঁটছে, ডাক্তার লাঠি হাতে আস্তে আস্তে শিস দিল। “মিস লতিকা তাড়াতাড়ি করুন, বৃষ্টি আসছে।”
হোস্টেল পৌছতে পৌঁছতেই বিদ্যুৎ চমকান শুরু হল। কিন্তু সে রাত্রে বৃষ্টিটা আর এল না। হাওয়ায় সব মেঘ উড়িয়ে দিল। পরদিন সকাল সকাল বাস ছাড়বে, তাই রাত্তিরে খাওয়ার পর মেয়েরা নিজের নিজের কামরায় চলে গেল।
লতিকা যখন ঘরে পৌঁছল, কুমায়ুন রেজিমেন্টাল সেন্টার থেকে বিউগিলের শব্দ ভেসে আসছে। ঘরে করিমুদ্দিন একটা পাহাড়ি সুর গুনগুন করতে করতে ল্যাম্পে গ্যাস পাম্প করছিল। লতিকা পোশাক না ছেড়েই বালিশটা ভাঁজ করে শুয়ে পড়ল। করিমুদ্দিন মুখ ফিরিয়ে লতিকাকে এক পলক দেখে নিজের কাজে মন দিল।
“পিকনিক কেমন হল মেমসাব?”
“তুমি এলে না কেন? সবাই জিজ্ঞেস করছিল।” সারাদিনের ক্লান্তি লতিকার হাড়ে মজ্জায়। চোখদুটো আপনাআপনিই বুজে আসছিল।
“আমি গেলে হুবার্ট সাহেবের তদারকিটা কে করত? সারাদিন বিছানায় শুয়ে বসে এখন উনি হঠাৎ গায়েব।” করিমুদ্দিন কাঁধের ময়লা তোয়ালেটা দিয়ে ল্যাম্পের কাঁচগুলো মুছতে শুরু করল।
লতিকার আধবোজা চোখ চট করে খুলে গেল, “ও ঘরে নেই?”
“খুদা জানে। এই অবস্থায় কোথায় ঘুরতে গেল। জল গরম করতে একটু বাইরে গেছিলাম, ফিরে এসে দেখি ঘর খালি।”
করিমুদ্দিন গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেল। লতিকা শুয়েশুয়েই পায়ের চটিটা খাটের নীচে ফেলে দিল।
হুবার্ট এত রাতে গেল কোথায়? কিন্তু লতিকার চোখদুটো আবার জড়িয়ে আসছে। অগাধ ক্লান্তি সব সমস্যা, সব প্রশ্নকে চাপা দিয়ে দিচ্ছে। সারাদিন লুকোচুরি খেলার পর ও এখন নিজের ঘরের দণ্ডি ছুঁয়ে ফেলেছে। এখন সে নিরাপদ। এই চার দেওয়ালের ভিতর কেউ ওকে ধরতে পারবে না। দিনের আলোয় সে ছিল অভিযুক্ত, অপরাধী, সব কিছুতেই তার দোষ ছিল। এখন আর একাকীত্বে কোনো নালিশ নেই। সব টানাটানি শেষ। যা নিজের ছিল তা একেবারেই আপন হয়ে গেছে, এখন আর কোনো দুঃখ নেই, নিজের করে নেওয়ার চেষ্টাও নেই...
লতিকা দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। ল্যাম্পের আলোয় হাওয়ায় কাঁপতে থাকা পর্দার ছায়াটা নড়ছিল। মেঘের ডাকে জানলা দরজা কেঁপে উঠল যেন বাইরে কেউ খটখট করছে। করিডোরে মেয়েদের হাসি, কথার শব্দ—একটু পরে আবার সব চুপচাপ। কিন্তু কাঁচাঘুমে তখনও সে ল্যাম্পের ঢিমে ‘সি-সি’ আওয়াজ শুনতে থাকে। পরে কখন যে সেটা নিঃশব্দে মিলিয়ে যায় তা আর টের পায় না।
একটু পরে লতিকা সিঁড়িতে কারুর পা টিপে টিপে চলার শব্দ শুনতে পেল, মাঝে মাঝে অস্পষ্ট গোঙানির শব্দ, তারপর আবার চুপ।
“মিস লতিকা, আপনার ল্যাম্পটা নিয়ে আসুন তো।” করিডোরের সিঁড়ি থেকে ডাক্তারের গলা শোনা গেল।
করিডোরটা অন্ধকার। লতিকা তিন চার ধাপ নেমে বাতিটা নোয়াল। হুবার্ট সিঁড়ির রেলিং-এ মাথা রেখে দাঁড়িয়ে। একটা হাত রেলিং-এ ঝুলছে, আর অন্য হাতটা ডাক্তারের কাঁধে, ডাক্তার শক্ত করে নিজের হাতে ধরে রেখেছে।
“মিস লতিকা, ল্যাম্পটা আরও নীচে করুন...হুবার্ট…হু...বার্ট...” ডাক্তার ওকে সামলে টেনে ওঠাল। হুবার্ট মুখ তুলতেই হুইস্কির কড়া ঝাঁঝে লতিকার সারা শরীর গুলিয়ে উঠল। হুবার্টের চোখদুটো লাল, শার্টের কলার খোলা, টাই ঢিলে। লতিকা কাঁপা হাতে ল্যাম্পটা নামিয়ে রেখে দেয়াল ধরে নিজেকে সামলাল। ওর নিজেরও মাথা ঘুরছিল।
“ইন এ ব্যাক লেন অফ দ্য সিটি, দেয়ার ইজ এ গার্ল হু লাভস মি...”
হুবার্ট হেঁচকি তুলতে তুলতে গাইছিল।
“হুবার্ট, প্লীজ, প্লীজ…” ডাক্তার ওর লটপটে শরীরটা শক্ত করে ধরল। “মিস লতিকা, আপনি বাতিটা ধরে আগে আগে চলুন।” লতিকা ল্যাম্পটা তুলে নিল। দেয়ালে তিনজনের ছায়াগুলো হোঁচট খাচ্ছিল।
“ইন এ ব্যাক লেন অফ দ্য সিটি, দেয়ার ইজ এ গার্ল হু লাভস মি...”
হুবার্ট ডাক্তারের কাঁধে মাথা রেখে অন্ধকারে নড়বড়ে পায়ে সিঁড়ি চড়ছিল।
“ডাক্তার, আমরা কোথায়?” হুবার্ট হঠাৎ এমন জোরে চেঁচিয়ে উঠল যে ওর আওয়াজটা করিডোরের ছাতে ও দেওয়ালে অনেকক্ষণ ধরে বাজতে থাকল।
“হুবার্ট...” হঠাৎ ডাক্তারের ভীষণ রাগ চড়ে গেল, আর পরক্ষণেই চট করে সামলে নিয়ে ওর পিঠে আস্তে আস্তে চাপড় দিতে লাগল।
“কিছু না হুবার্ট ডিয়ার, তুমি শুধু একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছ।” একটা ভীতু বাচ্চার মত কাতরভাবে হুবার্ট তাকিয়েছিল যেন ডাক্তারের মুখ থেকে ও কোনো প্রশ্নের উত্তর চাইছে।
ঘরে পৌঁছে ডাক্তার ওকে বিছানায় শুইয়ে দিল। হুবার্ট নিজে নিজেই জুতো-মোজা খুলে নিল। ডাক্তার যখন ওর টাইটা খুলছিল ও কনুইয়ে ভর দিয়ে একটু উঠে ডাক্তারের চোখে তাকাল আর ওর হাতটা আঁকড়ে ব্যাকুলভাবে শুধলো, “আমি কি মরে যাচ্ছি?
“কী যা-তা বলছ হুবার্ট!” ডাক্তার হাত ছাড়িয়ে ওর মাথাটা বালিশে শুইয়ে দিল।
“গুড নাইট হুবার্ট¬!”
“গুড নাইট ডক্টর,” হুবার্ট পাশ ফিরতে ফিরতে বলল।
“গুড নাইট মিস্টার হুবার্ট।” লতিকার গলা একটু কেঁপে গেল।
কিন্তু হুবার্ট কোনো উত্তর দিল না। ও পাশ ফিরেই ঘুমিয়ে পড়েছিল।
করিডোরে বেরিয়ে ডাক্তার মুখার্জি রেলিংটা ধরে দাঁড়াল। জোর হাওয়ায় মেঘগুলো সরে যেতেই ধোঁয়াটে চাঁদের আলো আশেপাশের পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়ছে।
“আপনি মিস্টার হুবার্টকে কোথায় পেলেন?” লতিকা উলটো দিকে রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছিল।
“ক্লাবের বারে বসেছিল। আমি না পৌঁছলে কতক্ষণ থাকত কে জানে।” ডাক্তার একটা সিগারেট ধরাল। এখনো দু’একটা রোগীর বাড়ি যাওয়া বাকি। ডাক্তার ইচ্ছে করেই একটু দেরি করছিল।
নীচে নিজের কোয়ার্টারে বসে করিমুদ্দিন মাউথ অরগ্যানে পুরনো ফিল্মি গান বাজাচ্ছে।
“আজ সারা দিন মেঘলা কিন্তু বৃষ্টিটা ভালো করে হলই না।”
“ক্রিসমাস পর্যন্ত এরকমই থাকবে হয়তো।”
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। কনভেন্ট স্কুলের লনে ঝিঁঝিঁপোকার আওয়াজ চারপাশের নিস্তব্ধতা আরও ঘন করে তুলছে। কখনো কখনো উপরে মোটর রাস্তা থেকে একটা কুকুরের কঁকানি শোনা যায়।
“ডাক্তার, কাল রাতে আপনি মিস্টার হুবার্টকে কিছু বলেছিলেন—আমার সম্পর্কে?”
“ঐ, যা সবাই জানে, হুবার্টএরও জানা উচিত ছিল কিন্তু ও জানত না।”
ডাক্তার লতিকার দিকে তাকাল। সে স্থাণুবৎ রেলিংটা ধরে দাঁড়িয়ে।
“আমাদের সবারই নিজের নিজের জেদ আছে। কেউ ছেড়ে দেয়, কেউ জড়িয়ে ধরে রাখে।” ডাক্তার মুখার্জি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে হাসল। হাসির সঙ্গে একটু সূক্ষ্ম বিরক্তিও মিশে ছিল।
“কখনো কখনো আমার মনে হয়, মিস লতিকা, যদি কিছু একটা জানা ভুল হয়, তবে জেনেশুনেও ভুলে না যাওয়াটা, সবসময় জোঁকের মত লেগে থাকাটাও ভুল। বার্মা থেকে আসার সময় আমার স্ত্রীর মৃত্যু হয়। তখন আমার নিজের জীবনটা একেবারেই উদ্দেশ্যহীন মনে হত। এখন এত বছর পরে তুমি তো দেখছ আমি এখনো বেঁচে আছি। আশা করি আরও অনেক বছর বেঁচে থাকব। জীবনটা বেশ ভালোই লাগে। আর যদি বয়েসটা বেশি না হত তো আরেকটা বিয়ে করতেও পিছপা হতাম না। এসব সত্ত্বেও কে বলবে যে আমি আমার স্ত্রীকে ভালবাসি না? এখনও বাসি...“
“কিন্তু ডাক্তার…” লতিকার গলা আটকে আসছিল।
“কী মিস লতিকা…”
“ডাক্তার, এসব ছাড়াও কিছু একটা আছে যা আমাদের চালিয়ে নিয়ে যায়, আমরা থামতে চাইলেও সে আমাদের টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায়।” লতিকার মনে হল সে কথাগুলো ঠিকমতো বলতে পারছে না। মনে হচ্ছিল যেন অন্ধকারে কিছু একটা হারিয়ে গেছে, সে খুঁজে পাচ্ছে না, হয়তো কোনোদিন পাবেও না।
“এর উত্তর তো ফাদার এলমণ্ডই দিতে পারেন।” ডাক্তারের শুকনো হাসিতে পুরনো ঠাট্টাটা ফিরে আসছিল।
“আচ্ছা আমি আসি মিস লতিকা, দেরি হয়ে যাচ্ছে।” ডাক্তার দেশলাই জ্বালিয়ে ঘড়িটা দেখল একবার।
“গুড নাইট মিস লতিকা।”
“গুড নাইট ডক্টর!”
ডাক্তার চলে যাওয়ার পরেও লতিকা অন্ধকারে রেলিং আঁকড়ে দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ। ঠাণ্ডা হাওয়ায় করিডোরে জমা কুয়াশাটা ক্রমশ বাড়তে থাকে। বিকেলে প্যাক করার সময় মেয়েরা নিজেদের কামরার বাইরে পুরনো রদ্দি কাগজ, খাতা ইত্যাদি যা জমা করে রেখেছিল হাওয়ায় সেগুলো এদিকওদিক ছড়িয়ে যায়।
লতিকা ল্যাম্পটা তুলে নিজের কামরার দিকে ফিরল। যাওয়ার সময় দেখল জুলির ভেজানো দরজায় এক টুকরো আলো। লতিকার মনে পড়ল। ও একটুক্ষণ শ্বাস বন্ধ করে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে করে দরজায় নক করল। ভিতরে কোনো সাড়া না পেয়ে সাবধানে দরজাটা খুলে দেখল জুলি বাতিটা নেভাতে ভুলে গেছে। লতিকা পা টিপে টিপে ওর খাটের পাশে এল। জুলির ঘুমন্ত মুখটা ল্যাম্পের মৃদু আলোয় পাংশু দেখাচ্ছে। লতিকা পকেট থেকে সেই নীল খামটা বের করে সাবধানে জুলির বালিশের তলায় রেখে দিল।
বাইরে বৃষ্টি ঝেঁপে এসেছিল। করিমুদ্দিন মাউথ অর্গানে একটা নতুন সুর ধরল।
মূল গল্প 'পরিন্দে' সংগৃহীত হয়েছে: 'হিন্দী কহানী সংগ্রহ’—পৃষ্ঠা ২২৯, লেখক-নির্মল ভার্মা; সম্পাদক-ভীষ্ম সাহানি; প্রকাশনা-সাহিত্য আকাদেমি ১৯৫৯
এই গল্পটির বাংলায় প্রথম অনুবাদের স্বীকৃতির জন্য আমি লেখকের স্ত্রী শ্রীমতী গগন ভার্মার কাছে কৃতজ্ঞ।