“হ্যাঁ, খুব ভালো, এই দ্যাখো!” কারমেন এক কোয়া কমলালেবু মুখে পুরে চোখ বন্ধ করে, তৃপ্তির সঙ্গে চিবিয়ে গিলে নেয়। বালিকা খর চোখে তাকায় তার দিকে নির্বিকার।
“খেয়ে নাও এবার, সোনা আমার, ফ্রাঁসোয়া।”
দেবতাকে নৈবেদ্য উৎসর্গ করার মত কারমেন কমলালেবুর কোয়া এগিয়ে দেয় ফ্রাঁসোয়ার মুখের কাছে। অহংকারে ঘাড় ঘুরিয়ে নেয় দুর্বিনীত বালিকা। এদিকে সাড়ে সাতটা বেজে গেছে ঘড়িতে। দিনের কাজকর্ম গুছিয়ে নিতে চায় কারমেন, কারণ তারপর তো গৃহকর্ত্রীর মুখোমুখি হতে হবে তাকে…
তার মুখের ভাব কঠোর এবং ঠোঁট থেকে শব্দগুলি বেরিয়ে আসে কাটা কাটা।
“তুমি যদি না খাও, আমি কিন্তু দিদিমণিকে গিয়ে বলব।” বালিকার তাতেও নড়নচড়ন নেই।
গৃহকর্ত্রী আর তাঁর স্বামী বসবার ঘরে ব্রিজ খেলছেন অতিথি বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে। বাড়িতে কোন লোকজন এলে সাংসারিক বিষয় নিয়ে তাঁকে যেন বিরক্ত করা না হয়--মনিবানির কড়া নির্দেশ। কারমেন কি গিয়ে তাঁদের কথাবার্তায় বিঘ্ন ঘটাবে? বকুনি খাওয়াতে তার ভয় নেই। শাদা মানুষেরা চেঁচিয়ে বকুনি গালাগাল দেয় নিজেদের মনের বোঝা লাঘব করতে। আর বাড়ির দারোয়ান ফার্দিনান্দ তাকে আগেই বলেছে--কর্তা মাঝে মাঝেই নিজের হাতে গিন্নীকে ধরে পেটান আর গিন্নী তার প্রতিশোধ নেন চাকরবাকরদের ওপর। এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে আর অভিযোগ করে লাভ কি? গরীব মানুষের কপালে আছে বকুনি খাওয়া। মাথা নীচু করে মেনে নেওয়াই ভালো উদাসীন মনে। তবে উপস্থিত অভ্যাগতদের সামনে তীব্র বকুনি খাওয়ার চাইতে ঘরের নিভৃতে চড়চাপড় সওয়াও ভালো। কারমেন নীরবে অপেক্ষা করে যায়।
আশকারা দিয়ে দিয়ে বাচ্চা মেয়েটাকে মাথায় তুলেছেন দিদিমণি, এমনভাবে তার সঙ্গে কথা বলবেন যেন দুজনে সমবয়েসি।
“ফ্রাঁসোয়া, সোনামণি, মা আমার, কী খেয়েছ তুমি?” ন্যাকামো করে বলবেন দিদিমণি আর উত্তরে খুদে ফ্রাঁসোয়া সব খাবারের ফিরিস্তি দিয়েই মহানন্দে তার সঙ্গে জুড়ে দেবে যে শেষের পাতে তাকে মিষ্টি কোন খাবার বা ফলমূল দেয়া হয়নি তাকে। মানে কারমেন দিয়েছিল কমলালেবু, কিন্তু সেগুলোর সবই পচা। দিদিমণি সেকথা শুনলেই কারমেনকে বকুনি দেবেন, কেন তাঁকে একথা জানানো হয়নি। তিনি বার বার পইপই করে তাকে বুঝিয়েছেন যে ফল না খেলে ছোট বাচ্চাদের পুষ্টির অভাব ঘটবে, কিন্তু বলা সত্ত্বেও তার কানে কিছু ঢোকে না। কারমেন মুখ চুনটি করে সব মন দিয়ে শুনবে চুপচাপ। তার নিজের মাকেলেকেলে গ্রামে বাচ্চারা পেট ভরে খেতে পেলেই মা-বাবার পোয়াবারো—ছেলে-মেয়ে খালি পেটে শুতে না গেলেই হল। তারপর যদি তাদের সুষম খাদ্যের কথা ভাবতে হয়, তাহলে আর জীবনে সমস্যার শেষ থাকবে না। আর ভুললে চলবে না, আজ সন্ধেয় বাড়ি যাবার আগে দিদিমণিকে ধরতেই হবে…
একটাই সমাধান চোখের সামনে। কারমেনের মা তাকে যেভাবে জোর করে খাওয়াত, সেও বাধ্য হবে তাই করতে। একহাতে সে সজোরে ফাঁক করল বালিকার ঠোঁটদুটো আর অন্য হাতে তার মুখে ভরল কমলালেবুর কোয়া। আর্তনাদ করে উঠল ফ্রাঁসোয়া; রাগে রক্তবর্ণ তার মুখ, কাঁদতে শুরু করল চেঁচিয়ে--ঠিক যেমন কারমেন আশংকা করেছিল। তারপর হলের টাইলের মেঝেয় হাতুড়ি পড়ার মত দ্রুত পদশব্দ--এক নিঃশ্বাসে দৌড়ে আসছেন মানিবানি। জিতেছে কারমেন।
“কি হল, এত হইচই কিসের?”
“ফ্রাঁসোয়া খেতে চাইছে না, দিদিমণি।”
“আহা রে! জোর জবরদস্তি করিস না দুধের মেয়েটাকে; বেচারা! তোর কি জ্ঞানগম্যি নেই রে? ফ্রিজ থেকে আঙুর বের করে দে ওকে। আঙুর দিলে ও ঠিক খাবে।”
মা এগিয়ে এসে দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন মেয়ের মাথা; চুমু দিলেন ক’বার।
কারমেন নতমুখে আঙুর আনতে চললে। যাবার আগে দিদিমণিকে কি তার নিজের সমস্যার কথাটা বলবে? না আরেকটু পরে, মেয়ের খাওয়াটা মিটুক আগে। এখন সময়টা ঠিক মনে হয় না।
আমোদ করে আঙুর খেয়ে চলল ফ্রাঁসোয়া। নিশ্চয়ই খেতে খুব ভালো, কারণ মেয়েটি খাবার সময় অমন অনবরত বকবক করে যায়, এখন সে চুপচাপ, আপন মনে খেয়ে চলেছে। কারমেন কোনদিন আঙুর খায়নি, একদিন চুপিসারে, লুকিয়ে কয়েকটা মুখে ফেলে দেখবে বড়লোকেরা কেমন খায়।
বালিকা খেয়ে চলে আর কারমেন চোখের জল মোছে। মেয়েটাকে সে নিজের পেটেরটির মতন করে ভালোবাসে আর খুব যত্ন নেয়। দুমাস বয়েস থেকে সে ফ্রাঁসোয়ার আয়া এবং সেই কোলেপিঠে করে তাকে মানুষ করেছে। ফ্রাঁসোয়া যেমন দিদিমণির মেয়ে, ঠিক তেমনি তারও মেয়ে। কোনদিন যদি এই বাড়িতে তার চাকরি খোওয়া যায়, তবু সে ঘন ঘন এখানে আসবে নিজের চোখে মেয়েটির বড় হওয়া দেখতে।
খাওয়া শেষ হলে পর কারমেন বাচ্চাটিকে বাথরুমে নিয়ে গেল, তার রাতের পোষাক পরাল এবং পৌঁছে দিল বিছানায়। তখন রাত আটটা বাজতে চলেছে। পায়ে হেঁটে মাকেলেকেলে যেতে লেগে যাবে কম করেও দুটি ঘন্টা। কিন্তু ফ্রাঁসোয়া তার আয়াকে ছাড়তে চায় না, তার জামা ধরে টানতে থাকে আর বায়না করে চলে, ঘুমপাড়ানি গান শোনাতে হবে।
আয় ঘুম, যায় ঘুম
সোনা ঘুমোয়, মানিক ঘুমোয়…
একটা গান শেষ হলে আরেকটা। অন্যদিন দ্বিতীয় গানের মাঝামাঝিই ঘুমিয়ে পড়ে মেয়ে, কিন্তু সেই রাতে গাইতে হল তিন তিনটে। গান গাইছে কারমেন, কিন্তু তার মন পড়ে আছে অন্য কোনখানে। সে ভাবছে ফ্রাঁসোয়ার কথা, আর সেই সঙ্গে তার নিজের ছেলের কথাও। দুজন সমবয়েসি হলেও বিস্তর ফারাক তাদের। ফ্রাঁসোয়া যেমন সুন্দর স্বাস্থ্যের ছবি, তার সন্তান হেক্টার কিন্তু এই কম বয়েসেই কয়েক বার মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছে। ফ্রাঁসোয়া কোন কিছুতে ভয় পায় না, ঝি-চাকরদের সমানে হুকুম করে এবং পোশাকআশাকের ব্যাপারে ভীষণ খুঁতখুঁতে। তার হেক্টার অন্য লোকের সামনে মুখ খুলতেই ভয় পায়, গুটিয়ে থাকে, নিজের মনের কথা প্রকাশ করে না। তার মনের মধ্যে হতাশা, শরীরে অসুখ আর চোখে ভয়ের চিহ্ন। অথচ দুজন একই প্রজন্মের মানুষ। তারা একই ভাষায় কথা বলে, কিন্তু বুঝতে পারবে না একে অন্যের কথা এতটাই সামাজিক ব্যবধান তাদের। কারমেন তার হিংসা বা ঈর্ষার জন্যে এসব কথা ভাবছে না। সে কেবল চায় হেক্টার ভালোভাবে মানুষ হোক, কিন্তু তা হতে পারে না, যতক্ষণ না সমাজ পালটায় এবং মানুঢের চিন্তাভাবনার পরিবর্তন ঘটে।
আজকে সকালে উঠেই তার মনে হয়েছিল সারাদিন বাড়িতে থেকে যায় কাজ কামাই করে। সারা রাত এক ফোঁটা ঘুমোয়নি ছেলেটা, যন্ত্রণায় ছটফট করছে। পেটের অসম্ভব ব্যথা, অনেকবার পাতলা পায়খানা আর অন্তত তিন বার বমি। তাতে প্রথমে মনে হল যন্ত্রণার কিছুটা উপশম, কিন্তু তৃতীয় বার গলা দিয়ে উঠে এল সবুজ রঙের তরল। চারপর ফেঁপে রইল পেট আর মাংসপেশির অনিয়মিত খিঁচুনি--তার যেন আর শেষ নেই, সঙ্গে কপাল জুড়ে কুলু কুলু ঘাম। ভয়ে কাঁটা হয়ে ছিল কারমেন সারা রাত--তার কোলজোড়া এই একটিই জীবন্ত সন্তান, আগের দুটিকে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছে যমের হাতে। দুর্ভাবনায় আর আতংকে একবার ভেবেছিল একটু দূরে তার মায়ের কুটিরে গিয়ে তাঁকে ডেকে তুলবে--কিন্তু শেষ অব্দি সামলে নিয়েছে নিজেকে। মা খবর পেলেই তাদের সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যেত গ্রামের ওঝার কাছে ঝাড়ফুঁকের জন্যে। আগের দুবার ঠিক তাই ঘটেছে, আর দুটোই প্রাণে বাঁচেনি। আর প্রতিবার ওঝার দক্ষিণা দিতে গিয়ে খরচ হয়েছে তার এক মাসের মাইনে। কিন্তু সন্তানের মৃত্যুতেই তার শোচনীয় দুর্ভাগ্যের সমাপ্তি নয়। ওঝা তাকে তার পরেও জ্বালিয়ে চলেছে--তার বক্তব্য কারমেন মা-বাবার পছন্দ করে দেওয়া পুরুষটিকে বিয়ে করতে অস্বীকার করেছে বলেই স্বর্গের দেবতারা অসন্তুষ্ট হয়েছেন তার ওপর। সেই কারণেই পাঁচ বছর ধরে এই ভোগান্তি। একদিকে সন্তান হারানোর চরম দুঃখ, তার ওপরে বুড়োহাবড়াদের এই নির্যাতন। সবার মুখেই এক কথা--চাপ দিয়ে তাকে রাজি করানো--দেবতাদের তুষ্টি, পূর্বপুরুষদের আত্মার শান্তি, তার মৃত সন্তানদের অনন্ত স্বর্গবাস--সব ঘটে যাবে তার মুখের কথায়। যদি সে কিতঙ্গা ফ্লাভিয়েনকে বিয়ে করে, পৃথিবীতে সব অশান্তির অবসান ঘটবে। আর পাত্র হিসেবেও সে কি মন্দ? এক সরকারি আপিসে ড্রাইভারের চাকরি, মাইনে ভালো; আবার কাজ শেষ হয়ে গেলে সে তার নিজের মনিব, কারুর কথা শুনতে হয় না তাকে। চারটে ভাড়ার ট্যাক্সি, একটা মনোহারি দোকান, শহরে একটা হোটেল-বার। তাকে আর অন্যের বাড়িতে ঝিগিরি করতে হবে না, সারা জীবন খাওয়া-পরার চিন্তা নেই। তবে কিতঙ্গার আরো দুটি বিবি আছে--একজন গ্রামের বাড়িতে থাকে, আর একজন তাকে শহরে হোটেল চালাতে সাহায্য করে।
যখন তার মনে এইরকম সব চিন্তাভাবনার ঢেউ চলেছে, সে শুনতে পেল ছেলের গলা--মায়ের মাদুরে এসে শুতে চায় হেক্টার। একা ভয় লাগছে তার। রাতটা কাটবে তো? সকাল অব্দি বাঁচবি তো বাছা? পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছে যাদের সন্তানের সামান্য হাঁচিকাশি হলেও ফোন তুলে বড় ডাক্তারের নম্বর ডায়াল করে, সোজা চলে যায় তার চেম্বারে, ডাক্তার চিকিৎসা করেন এবং আশ্বস্ত করেন মা বাবাকে--ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু গরীব মানুষের কথা আলাদা। পাড়ার দাতব্য ডিসপেনসারি বন্ধ হয়ে যায় সন্ধের পর। শহরের হাসপাতালে গেলেও দেখা পাওয়া যাবে গোমড়ামুখো নার্সের, অসময়ে ঘুম ভাঙানোয় তিতিবিরক্ত। আর ডাক্তারেরা সব থাকেন বড়লোকের পাড়ায়; গরীব কালো লোকের সেখানে ঢোকাও মুশকিল-- আর গিয়ে পৌঁছালেও তাঁরা দরজা খুলবেন কিনা সন্দেহ। আর এই শেষের পুরো ব্যাপারটাই তার অলীক কল্পনা। প্রাইভেট ডাক্তারের কাছে যেতে প্রথমেই যা ভিজিট লাগে তা তার সামর্থের বাইরে।
শেষ পর্যন্ত ভোরের হাওয়ায় ঘুম এসে গেল হেক্টারের। সকাল হওয়ার আগেই কাজে রওনা দিয়েছে কারমেন--দুঘন্টা হেঁটে মাকেলেকেলে থেকে মিপলা। এবং দিদিমণির কড়া নির্দেশ, সাড়ে সাতটার থেকে এক মিনিটও যেন বিলম্ব না হয়। এবার সহজেই হিসেব করে নাও কখন সে বাড়ি ছেড়ে বেরুবে--
অসম্ভব অবসাদ সত্ত্বেও কাকভোরে ঘুম থেকে উঠেছিল কারমেন। কিন্তু কাজে যাওয়ার মন ছিল না আজ। বরং হেক্টারকে নিয়ে হাসপাতাল যাওয়া যাক, সেখানকার ডাক্তার যদি বলতে পারেন তার অসুখটা কী। ছেলে অসুস্থ হলেই তাকে একলা ছেড়ে কোথাও যেতে প্রাণটা কাঁদে কারমেনের। সারাদিন বুকটা ধড়ফড় করে তার। একবার হেক্টারকে সঙ্গে নিয়েই কাজে গিয়েছিল, কিন্তু দিদিমণি সাফ সাফ বলে দিয়েছিল সারাদিন তাকে মাইনে দেওয়া হয় ফ্রাঁসোয়ালে দেখভাল করার জন্যে, তার নিজের ছেলেকে নয়। তার মা এবং গ্রামের অন্য গিন্নিবান্নিরা খেয়াল রাখবেন হেক্টারের এবং দরকার হলে নিয়ে যাবেন ডাক্তারের কাছে। গ্রামের যে কোন পরিবারই বিশাল ও বিস্তৃত এবং সেখানে কোন শিশুই একা হয়ে যায় না। কেউ না কেউ দেখবেই তাকে--কিন্তু সে দেখা মায়ের স্নেহময় দেখা নয়। মানুষকে যে পৃথিবীতে আনে, শারীরিক অসুস্থতার সময় তার প্রয়োজন সবচেয়ে অধিক।
কিন্তু সারাদিন বাড়িতে থেকে ছেলের দেখাশোনা সেবাযত্ন করলে আখেরে তার যদি চাকরিটি খোওয়া যায়, তা হ’লে কি হবে। এমাসে দুদিন কাজ কামাই হয়ে গিয়েছে তার। প্রথম দিন নিজের ভীষণ অসুখ, সারাদিন জ্বর গায়ে শুয়েছিল সে। দ্বিতীয় দিন এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান, না গেলেই নয়। কিন্তু দিদিমণি রেগে আগুন।
“কারমেন, আমার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিস কিন্তু। যেদিনই তোকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন এখানে, সেদিন তুই কামাই করবি। মনে হয় তুই ইচ্ছে করেই এরকম করিস। আমার বিশেষ কোন জরুরি কাজ থাকলেই দেখি, তুই কাজে কামাই করবি। এই আমার শেষ কথা বলে দিচ্ছি। এ মাসে যদি আর একদিনও কাজ কামাই হয়, তোকে অন্য কোথাও আয়াগিরি খুঁজতে হবে।”
কি করে সে দিদিমণিকে বোঝাবে? কারমেন আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। কিন্তু শাদা মানুষের মনোভাবটাই এমন যে আমরা একদিন কাজে না এলেই, তাদের বিশ্বাস হবে যে আমরা অলস আর ফাঁকিবাজ।
আজকে হেক্টারের অসুস্থতা সত্ত্বেও সে কাজে এসেছে। দুপুর বেলা তার দিদি লোকের হাতে খবর পাঠিয়েছে, ডাক্তার হেক্টারকে দেখেছেন আর ওষুধের প্রেসক্রিপশান লিখে দিয়েছেন। কিন্তু তার হাতে টাকা কোথায় ওষুধ কেনার। হেক্টারকে যেভাবেই হোক সারিয়ে তুলতেই হবে।
এখানে এদিকে সন্ধে ঘনিয়ে এসেছে; যে বালিকার জীবনে কোন বিলাসিতারই অভাব নেই, তার জন্যে সে ঘুমপাড়ানি গাইছে--পাশের ঘরে তার মা-বাবা মদ্যপান আর তাসখেলায় মগ্ন।
ফ্রাঁসোয়ার ঘুম এসে গেলে কারমেন ফিরে গেল হেঁসেলে, হাতের কাজ সারতে সারতে অপেক্ষা মনিবানির তাস খেলা শেষ হওয়ার জন্যে। আর বুড়ো দারোয়ান ফার্দিনান্দের সঙ্গে সুখদুঃখের কথা, বৃদ্ধের সঙ্গে গল্প করতে ভালো লাগে তার। মনটা হাল্কা হয় নানা সমস্যার মধ্যেও। ফার্দিনান্দ মনিবদের হাঁড়ির খবর জানে আর পুরানো অনেক কেচ্ছা--সে রসিয়ে রসিয়ে আর রং চড়িয়ে বলতেও পারে সব--কারমেন দুঃখের ভেতরেও না হেসে পারে না। আজকে সে অস্বাভাবিক গম্ভীর, সেটা ফার্দিনান্দের নজর এড়ায়নি।
শেষ পর্যন্ত দিদিমণি হেঁসেলে ফিরলেন না।
“কারমেন, এখনো বাড়ি যাসনি কেন তুই?”
সংকটের মুহূর্ত উপস্থিত, আর রক্ষে নেই। “আমি খুব অসুবিধেয় পড়েছি। এখনই কিছু টাকা চাই দিদিমণি।”
“সে কি রে, দিন দশেক আগেই তো মাইনে দিলাম তোকে।”
“আমার ছেলের খুব অসুখ। ওষুধ কিনতেই হবে।”
“শোনো, শোনো কথা শোনো কারমেনের। আমি কি আপামর জনসাধারণের সহায়তাকেন্দ্র? আনন্দ করবে তোমরা, স্বামী ছাড়াও বাচ্চার পর বাচ্চা জন্মাবে, তার পর তাদের দেখাশোনা করতে গিয়ে সমস্যার শেষ নেই!”
“শাদা মানুষদের চোখে তেমনটাই মনে হয়, দিদিমণি…”
“তা বলছ, তোমার ছেলের অসুখ? অসুখ তো করবেই, তুমি কি কথা বললে শোনো? কতবার কান কামড়ে বলেছি বাচ্চাটাকে পুষ্টিকর খাবার খেতে দাও দুই বেলা। তাই কি করেছ?”
“না, দিদিমণি।”
“তা কেন করবে? ওই কচু-ঘেঁচু সেদ্ধ খাইতে তার পেট ভরিয়ে দেওয়া অনেক সোজা। এখন বোঝো ঠ্যালা!”
কারমেন তার কি উত্তর দেবে? দিদিমণির পরামর্শ মতন খোরাকি সংগ্রহ করা তার সাধ্যের বাইরে। দিদিমণি বোঝেন না যে তাঁর নিজের, স্বামীর, কন্যার আর পোষা বেড়ালের জন্যে এক হপ্তার খাবার কিনতে যা খরচ হয়, তা কারমেনের মাস মাইনের তিনগুণ। কিন্তু সে কথা বিনীতভাবে মনে করিয়ে দিলেও মনিবকে অপমানের অজুহাতে তার চাকরটি খোয়াতে হবে।
“সে যাই হোক, এখন এই সন্ধেবেলা বাড়িতে কোন ক্যাশ টাকা নেই। তোরা নেটিভরা কবে এই সহজ কথাটা বুঝবি যে টাকা পয়সা গাছে ফলে না। মাইনের পুরো টাকাটা সঙ্গে সঙ্গে খরচ না করে ফেলে যতটা পারা যায় সঞ্চয় করা উচিত।”
দিদিমণি এসব কথা বলে গেলেন বেশ কিছুক্ষণ। সব কানেও ঢুকল না কারমেনের। শিক্ষিত, ভদ্র লোকেরা যখন দ্রুত গতিতে ফরাসি বলে যান, সব সময় সে মনের মধ্যে তার অনুবাদ কিতুবা ভাষায় করে নিতে পারে না। কথাগুলো তখন তার মাথায় ঢোকে না, সে কেবল বিনীতভাবে ঘাড় নেড়ে যায়। তার একটাই চিন্তা--দিদিমণি কি নরম হয়েছেন কিছুটা? শেষ পর্যন্ত দিদিমণি কারমেনের হাতে কয়েকটা জ্বরের বড়ি দিলেন আর বললেন--কালকে এলে ৫০০ ফ্রাঁ পাবি।
অনেক রাত করে কালো কারমেন রওনা হল তার গ্রামের পথে। অনেকটা পথ হাঁটতে হবে তাকে--মিপলা থেকে মাকেলেকেলে। তার ছোটবেলার ইশকুলটাও ছিল দুঘন্টার হাঁটাপথ। আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে সে আসা যাওয়া করত।
আজ কিন্তু সে পারলে দৌড় মারে, হেক্টার দূর থেকে ডাকছে তাকে। রাতে ভালো ঘুম হয়নি তার, সকালের খাওয়াও তথৈবচ, দুপুরেও পেট ভরেনি খেয়ে--দৌড়বার ক্ষমতা নেই তার। কিন্তু মনে মনে স্পষ্ট বুঝতে পারলে হেক্টার ডাকছে, “মা, মা, মাগো!”
আহা বেচারা! যখন সে ডাগরটি হবে, আমার কথা মনে রাখবে তো? তোর ভালোর জন্যেই আমি তোকে সারাদিন ঘরে একা ফেলে রেখে অন্যের বাড়িতে ঝিগিরি করতে যাই। হয়ত যে অভিমান করেছে আমার ওপর। ওষুধ-পথ্য ছাড়া তাকে একা রেখে যাওয়া উচিত হয়নি। শাদা মানুষ ডাক্তারকে চোখে দেখলেও মনে ভক্তি জাগে; কতভাবে তারা পরীক্ষা করে রুগিকে--হাবভাব দেখলেই মনে হয় ঠিক সারিয়ে তুলবে। কিন্তু মা আজকে তাড়া লাগাতেই--হেক্টারকে নিয়ে চল ওঝার কাছে; কি যে করি।
দিদিমণির কথাগুলোও সে ভাবে। দুজনের ঘনিষ্ঠতা হবে না কখনো, বন্ধুত্বও নয়। কিন্তু দিদিমণির সঙ্গেই সে দিনের বেশিরভাগ সময়টা কাটায়, নিজের ছেলের বা মায়ের সঙ্গে নয়। দিদিমণি তাকে নিজের মেয়ের দেখাশোনার ভার দিয়েছেন; সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেন তাকে। আজকে সে ক্ষুণ্ণ হয়েছে দিদিমণির কড়া ব্যবহারে--একজন মা কেন অন্য একজন মায়ের মনের অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করবেন না। দিদিমণি তাকে ভাবেন ছ্যাবলা, লঘুচিত্র, চপল, দায়িত্বজ্ঞানহীন।
কি করে তার সঞ্চয় হতে পারে? মাস ফুরালে মাইনে পায় ৫০০ ফ্রাঁ। একটা পুরানো ঘড়ি কিনেছে সে দিদিমণির কাছ থেকে--তার জন্যে গত ছ মাস তিনি ৫০০ ফ্রাঁ করে কেটে নিচ্ছেন প্রতি মাসে। আর আগেই সমস্যায় পড়ে সে আগাম নিয়েছিল ৫০০ ফ্রাঁ। তাই এ মাসে মাইনে পেয়েছে ৪০০০ ফ্রাঁ, তার মধ্যে গাঁয়ের মোড়লের দেনা শোধ দিতে হয়েছে ১০০০ ফ্রাঁ, মাকে দিয়েছে ১০০০ ফ্রাঁ, পিসিমার তীর্থ যাবার জন্যে দিতে বাধ্য হয়েছে ১০০০ ফ্রাঁ। ফলে সারা মাসের খরচাপাতি চালানোর জন্যে রয়েছে ১০০০ ফ্রাঁ। কত আর টাকা? দিদিমণির এক হপ্তার বাজার খরচই তার চেয়ে অনেক বেশি।
রাস্তায় আলো খুব কম--কৃষ্ণপক্ষের রাত। উল্টোদিক দিকে ধেয়ে আসা গাড়িগুলোর হেডলাইটের আলোয় চোখ ধাঁধাঁয়। পেছনের গাড়িগুলো দয়া করে তাকে ধাক্কা না মেরে সামনে ছুটে যায়। কেউ থামে না তাকে লিফট দেবার জন্যে। কিন্তু কারমেন জানে অর্ধেকের বেশি গাড়ি মালিকেরা তারই মতন কৃষ্ণকায়। সবাই জানে স্বার্থপর, নিজের আখের গোছাতে বদ্ধপরিকর।
হাঁটতে হাঁটতে সে একসময় চলে এল বিজা স্ট্রিটের কাছাকাছি। অস্পষ্ট নারীকন্ঠের আর্তনাদ ও ক্রন্দন ভেসে আসে রাতের বাতাসে--ধীরে ধীরে কানে ঢোকে কথাগুলো--মানে বোঝা যায়:
কোথায় গেলি, বাছা আমার
হেক্টার রে!
কোথায় গেলি বাছা আমার!
দরকার নেই আগাম মাইনের। প্রয়োজন নেই শাদা চিকিৎসক অথবা কালো ওঝার। গ্রামে ঢোকার পথে এগুলো কারমেন।
ওরে আমার হেক্টর রে!
কোথায় গেলি আমায় ফেলে…
ওরে আমার হেক্টার রে!
হেনরি লোপেস-এর জন্ম ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৩৭, বড়ে কঙ্গোর লিওপোল্ডভিল শহরে। তাঁর শৈশব এবং প্রাথমিক লেখাপড়া ছোট কঙ্গোর ব্রাজাভিলে। বারো বছর বয়েস থেকে ফ্রান্সে--সেখানে উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজের পাঠ। কলেজে পড়ার সময় ফ্রান্সের কৃষ্ণকায় আন্দোলনে এবং কঙ্গোর স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেন। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬৫ তিনি ফ্রান্সে কঙ্গোর ছাত্র সংগ্রাম সমিতির সভাপতি। ১৯৬৫ সালে দেশে ফিরে ব্রাজাভিলে ইতিহাসের অধ্যাপক (১৯৬৫ - ১৯৬৬) এবং তার পরে উচ্চশিক্ষা দপ্তরের আধিকারিক (১৯৬৫ - ১৯৬৮)।
রাষ্ট্রপতি মারিয়েন নাগুয়াবি (১৯৩৮ - ১৯৭৭)-এর জঙ্গী শাসন শুরু হয় ১৯৬৯ সালে। হেনরি প্রথমে তাঁর মন্ত্রিসভার জাতীয় শিক্ষামন্ত্রী (১৯৬৯ -১৯৭১), তার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী (১৯৭১ - ১৯৭৩) এবং প্রধানমন্ত্রী (১৯৭৩ -১৯৭৫)। তাঁর জীবনের স্বপ্ন ছিল মাও সে তুং (১৮৯৩ - ১৯৭৬)-এর সঙ্গে মুখোমুখি আলাপ করার; ১৯৭৫ সালে তিনি রাষ্ট্রীয় সফরে চিন ভ্রমণে গেলেন, কিন্তু মাও তখন অসুস্থ--দেখা সম্ভব হল না। ১৯৭৫-এর শেষ নাগাদ তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
১৯৭৭ সালে নাগুয়াবি খুন হবার পর তিনি নতুন মন্ত্রীসভায় অর্থমন্ত্রীর পদ লাভ করেন (১৯৭৭ - ১৯৮০); পরবর্তী ১৮ বছর তিনি UNESCO-তে উচ্চ পদে (১৯৮০ - ১৯৯৮)। ১৯৯৮ সাল থেকে তিনি প্যারিস বাসী--ফ্রান্স, ব্রিটেন, স্পেন, পর্তুগাল এবং ভ্যাটিকান সিটিতে ছোট কঙ্গোর রাষ্ট্রদূত। ফ্রান্সে তাঁর সাহিত্যচর্চার শুরু ফরাসি ভাষায়। ১৯৭১ সালে প্রথম গল্পগ্রন্থ “ট্রাইবালিক্স--আধুনিক কঙ্গোর ছোট গল্প।” অনূদিত গল্পটি সেই সংকলনের অংশ। ১৯৮৭ সালে গল্পটির ইংরেজি অনুবাদ করেন আন্দ্রিয়া লেসকিস, হ্যইনম্যান প্রকাশিত আফ্রিকার একটি গল্প সংকলনে বাংলা অনুবাদটি সেই ইংরেজি অবলম্বনে।
পরবর্তীকালে প্রকাশিত উপন্যাস “হাস্যময় ক্রন্দন--আফ্রিকার আষাঢ়ে গল্প” (ইংরেজি অনুবাদ--জেরাল্ড মুর), “নদীর ওপার” এবং “লিলি এবং আগুন বৃক্ষ।” ইংরেজি অনুবাদের অভাবে এই শক্তিশালী লেখকের রচনা ফরাসিভাষী জগতের বাইরে প্রায়-অজ্ঞাত।