• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯১ | জুলাই ২০২৩ | গল্প
    Share
  • নীল শাড়ি : ধূপছায়া মজুমদার



    ।।১।।

    এতটা গাঢ় রং বনানী অনেকদিন পরেন না। একসময় ঘন সবুজ, ঘন নীল, গাঢ় বাদামী এমন সব রঙের একরঙা জমির শাড়ির ওপর অসম্ভব টান ছিল তাঁর। আলমারিতে ওরকম শাড়ি যে কত আছে তার ইয়ত্তা নেই। আছেই কেবল, পরা আর হয় কই! রোজকার বাজারহাটে যাওয়ার সময় একটা যাহোক গোছের সিন্থেটিক তুলে নিয়ে গায়ে পেঁচিয়ে বেরিয়ে পড়েন। পরিপাটি করে পরা শাড়ি, ম্যাচিং ব্লাউজ, ম্যাচিং কানের, আর টিপ, মানে যেমনটা বনানী ভালবাসেন বরাবর, তেমনটায় তৈরি হওয়ার উপলক্ষ্য পান কোথায় আজকাল! কালেভদ্রে একেকটা বিয়েবাড়ি বা জন্মদিনের পার্টি, তার সবেতেই আজকাল হাল্কা রংয়ের শাড়ি ছাড়া ভাল দেখায় না। কপালের বলিরেখারা স্পষ্ট, চুলের রুপোলি ছোঁয়া আর ঢেকে রাখা যায় না, ত্বকে শৈথিল্য এসেই পড়েছে না চাইতেও, এমতাবস্থায় বিয়েবাড়িতে ঘন সবুজের আস্তরণে নিজেকে ঢেকে কে আর অন্যের হাসির খোরাক হতে ভালবাসবে! তাই নিজের অত ভাল লাগার গাঢ় একরঙা শাড়িগুলোকেও স্বেচ্ছায় নির্বাসন দিয়েছেন বনানী, বা বলা যায় আলমারিতে অন্তরীণ করে রেখেছেন।

    কিন্তু ওই মালবিকা! সে মেয়ে ঝড়ের মতো আসে, নদীর মতো কলকল করে, আবার ঝড়ের মতো চলে যায়। তবু ওরই মাঝে কী করে টের পেয়ে গেছে বনানীর ভাল লাগার খবর। সে যে বনানীর কাছেই আসে, বা ওঁর সঙ্গে যা তার বেজায় ভাবসাব, তাও নয়। মালবিকা আসলে আসে শান্তনুর কাছে, শান্তনুর ছাত্রী সে, গবেষণা শেষ হয়েছে সদ্য। তার গবেষণার বিষয়েও শাড়ির ছোঁয়া একটুকুও নেই। তবু সে মেয়ে কীভাবে যেন বনানীর জন্মদিনের তারিখটা জানতে পেরে এবছর সেই দিনে একটা গাঢ় নীল রংয়ের শাড়ি উপহার দিয়েছে বনানীকে। বনানীর যে এই গাঢ় রঙের শাড়ি বড় প্রিয়, মালবিকা কীভাবে জেনেছে কে জানে! এই বয়েসে এমন শাড়ি পরলে মানায়! আজকালকার মেয়ে, নিজের পছন্দের দিকটা যত গুরুত্ব দেয়, লোকজন কী ভাববে সে বিষয়ে অতটা গুরুত্ব দেয় না। দেয় না বলেই হয়তো এরা আরেকটু প্রাণ খুলে বাঁচবে। তাঁর তো গোটা একটা জীবন পেরিয়ে গেল বড়রা কে কী বলবে, পাড়া-পড়শি-আত্মীয়কুল কে কী ভাববে সেই ভাবনা বুকে নিয়েই। একটা দীর্ঘশ্বাস লুকোন বনানী। কার কাছে যে লুকোন, নিজেই ভেবে পান না, ঘরে তো কেউই নেই। চোখের কোণটা চিকচিকও করে ওঠে কি? বোঝা যায় না, ঘরে তো কেউ নেই, কে দেখবে! দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে হাতের ওপর রাখা ঘন নীল শাড়িটার গায়ে হাত বোলাতে থাকেন বনানী। আহা! বড় প্রিয় রংখানা। মেয়েটার চিবুক ছুঁয়ে আশিস দিতে বড় সাধ জাগে মনে। উপায় নেই।

    মালবিকাকে তার ঝোড়ো স্বভাবটার জন্য প্রথমদিকে বনানী তেমন পছন্দ করতেন না। মেয়েরা হবে দীঘির মতো, শান্ত, ধীর। বিশেষত যে মেয়ে উচ্চশিক্ষার অঙ্গনে পা রেখেছে, ভবিষ্যতে নাকি শিক্ষকতাও করবে, তার কি এমন ঝোড়ো স্বভাব মানায়! ছাত্রেরা এমন অধ্যাপিকাকে মানবে কেন? বনানী গজগজ করতেন শান্তনুর কাছে,

    “কী যে দেখলে তুমি ঐ ধিঙ্গি মেয়ের মধ্যে কে জানে? ও কি কলেজে পড়াতে পারবে, নাকি থিসিস জমা দিতে পারবে সময়মতো? ঐ তো কাকের বাসা চুল আর ঘাড়ে ট্যাটুম্যাটু করা হাত-পা! ঐ নিয়ে যাবে ছাত্র পড়াতে? তোমার নামটা ডোবাবে দেখো!”

    শান্তনু হাসতেন,

    “আমি কি মালবিকার চেহারা দেখে ওকে দলে নিয়েছি গো বনানী? ওর রেজাল্ট দেখেছ কখনো? তাবড় স্কলারদের পিছনে ফেলে দেবে ও মেয়ে! দেখোই না শেষ পর্যন্ত কী হয়!”

    তা হয়েছে অবশ্য।

    বনানীর চিরকেলে ধারণায় চিড় ধরিয়ে গবেষণার প্রতিটি কাগজপত্র সময়ে জমা করত মালবিকা। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও অচিরেই জনপ্রিয় হয়ে উঠল সে। ঝোড়ো স্বভাবখানা যদিও অমনই রয়ে গেল তার। বনানীর সঙ্গে মৌখিক নৈকট্যও তেমন গড়ে উঠল না। তবে কী করে যেন ও মেয়ে অল্পেই তাঁকে বুঝে ফেলত। আঁচ পেতেন, এতদিনে নিশ্চিত হয়েছেন। তাঁর অতকালের পুরনো ভাল লাগা, গাঢ় রঙের শাড়ির প্রতি টান, মালবিকা কেমন করে বুঝল কে জানে! এত অবাক হয়েছিলেন উপহারটা পেয়ে যে সৌজন্যমূলক ধন্যবাদটুকুও জানাতে ভুলে গিয়েছিলেন। বিস্মিত হাসিই যদি ধন্যবাদ দিয়ে দিয়েছে ওঁর হয়ে, সে আলাদা কথা। তবে তার পরেও যে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে তা নয়। কথা তেমন না বাড়তেই যে মেয়ে তাঁর পছন্দ বুঝে ফেলে, তাকে বনানী একটু সমঝেই চলেন। তাই যাকে হয়তো কাছে ডেকে নেওয়া যেত, তাকে আর ডাকা হয়নি। স্যারের কাছে এলে মাসিমার সঙ্গে দেখা করে যাওয়া, এইটুকুর মধ্যেই সীমিত থেকেছে মালবিকা আর বনানীর সম্পর্ক। শাড়িটা আলমারিতেই তোলা ছিল, আজ বার করেছেন। পুরনোদিনের শাড়িগুলোকেও ছুঁতে বড্ড ইচ্ছে করছে আজ। বার করবেন?

    ।।২।।

    ক্লাসের পর বেরনোর জন্য তৈরি হতে হতে মালবিকা এরপরের কাজগুলো মাথার মধ্যে গুছিয়ে নিচ্ছিল। ওয়েলনেস ক্লিনিকে যেতে হবে একবার, মায়ের টেস্টগুলোর জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে, ফোনে পাচ্ছে না, স্যারের বাড়ির রাস্তাতেই, একবার ঢুঁ মেরে নেবে। আজ করব কাল করব করে বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে, ঠিক নয় এটা। মা যদিও বিন্দাস আছে, মিষ্টিফিষ্টিও খাচ্ছে মনে হচ্ছে আগের চেয়ে বেশি, ওতেই মালবিকার আরও ভয়। রুগি নিজের ভাল নিজে বুঝলে একরকম, নইলে বাড়ির লোকের হ্যাপা বাড়ে। নাহ্, আর দেরি করলে হবে না, কাল টেস্টের জন্যই বলতে হবে। তারপর কয়েকটা জিনিস কেনার আছে, না কিনলেই নয়, নইলে এই প্রায় মাসের শেষে আর বাড়তি খরচাপাতি পোষায় না। সেসব সেরে যাবে স্যারের বাড়ি। এই কদিন রোজই কলেজের পর স্যারের বাড়ি থেকে একবার করে ঘুরে আসবে ভেবেছে মালবিকা। অন্যরাও যাচ্ছে, রোজ না হলেও পালা করে সবাই যাচ্ছে সকালে বা বিকেলে।

    স্যারের সঙ্গে সম্পর্ক আজ বহুদিনের, সেই হায়ার সেকেন্ডারির সময় থেকে। স্কুলের পর বিকেলে প্রথমে স্যারের কাছে ইংলিশ, পরে স্যারএর বন্ধুর কাছে হিস্ট্রি পড়ে বাড়ি ফিরত মালবিকা, আর দু’তিনজন। সেই শুরু। তারপর ইংলিশ অনার্স নিয়ে কলেজ, মাস্টার্স, পি এইচ ডি, সম্পর্কটা রয়েই গেছে। ততদিনে অবশ্য স্যারের বাড়িতে পড়তে আসার ছাড়পত্র মিলেছে, মাসিমার সঙ্গেও আলাপ হয়েছে। মাসিমা যে ওকে খুব একটা পছন্দ করেন না, মালবিকা বুঝতে পারত। অবশ্য ওর ধরনধারণ আর উদ্ভট খেয়ালের জন্য নিজের মায়ের কাছেও তো কম বকুনি খায়নি মালবিকা। মেয়েরা উড়নচণ্ডী হলে কেউই বিশেষ পছন্দ করে না, মালবিকা জানত। কিন্তু মাসিমার ব্যক্তিত্ব ওকে বড্ড ছুঁয়ে যেত। মনে হতো ডালপালা মেলা একখানা গাছ, কাছে গিয়ে বসলেই নরম ছায়ায় আশ্রয় দেবে। কাছে যাওয়া তেমনভাবে হয়নি যদিও কখনও। একটু বড় হওয়ার পর, মানে চাকরিবাকরি পাওয়ার পর আড় একটু ভেঙেছিল, মালবিকাই উদ্যোগ নিয়ে কখনও-সখনও মাসিমাকে ডেকে আনত ওদের মাঝে, চা-টা যোগে আড্ডা বসানোর একটা ক্ষীণ চেষ্টা করত। মাসিমা সেভাবে কোনওদিনই সাড়া দেননি। এসে বসতেন বটে স্বামীর ছাত্রছাত্রীদের আড্ডায়, কেউ তাঁকে কিছু জিজ্ঞাসা করলে উত্তরও দিতেন, কিন্তু মৃদুভাষী ভদ্রমহিলা নিজে থেকে কথাবার্তা শুরু কখনওই করতেন না।

    অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল এসব কথা ভাবতে ভাবতে, ঘড়ির দিকে চোখ পড়তে আর দেরি না করে মালবিকা বেরিয়ে পড়ল কলেজ থেকে।

    ।।৩।।

    রাতের খাওয়া হয়ে গেছে বেশ খানিকক্ষণ, শান্তনু বসে ছিলেন তবুও, এঁটো হাতেই। উঠতে ইচ্ছে করছিল না আসলে, উঠলেই তো সব একা হাতে গুছিয়ে রাখতে হবে। আজ কেউ নেই, কাল অব্দি ছোটবোন আর তার মেয়ে ছিল। আবার কাল আসবে, বাড়িতে কিছু কাজ আছে ওদের। ঠিকই, বাড়িঘর ছেড়ে কদ্দিন আর লোকে তাঁর কাছে এসে থাকবে! আজকের দিনটা কেউ নেই বাড়িতে, কী আর করা যায়! রোজ রোজ তো আর বাড়িভর্তি লোক পাওয়া যাবে না শান্তনুকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য। উঠলেন তিনি, খাবারদাবার ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখলেন হাত মুখ ধুয়ে এসে। এরপর টেবিল মোছা, ডাস্টবিন বাইরে বার করা, কালকের সকালের রান্নার টুকটাক জোগাড় করে রাখা, এসব চলল কিছুক্ষণ। কাজের তো অন্ত থাকে না। এমনিতে বোঝা যায় না, নিজের ঘাড়ে এসে পড়লে তবে বোঝা যায় কত ধানে কত চাল! শান্তনুও তাই, এতকাল ফিরে তাকিয়েও দেখেননি সকাল থেকে রাত অব্দি কেমন করে ঊনকোটি চৌষট্টির জোগাড় চলে, ভাতের থালায় দুটো তরকারি বেড়ে দিতে হলে কতটা খাটতে হয়, জামাকাপড়ের পাঁজা ইস্তিরি করে পাট পাট করে রাখতে কতটা ঘাম ঝরে, ধারণাই ছিল না শান্তনুর। আজ হচ্ছে। এখন থেকে হবে। উপায় নেই।

    খাওয়ার ঘর রান্নাঘরের সব কাজ সেরে বনানীর ঘরে ঢুকলেন শান্তনু। ঘরটা বড় অগোছালো হয়ে আছে। আলনায় শাড়িটাড়ি ঝুলছে, গামছাটাও রয়ে গেছে। যাবেই বা কোথায়, কেউ সরিয়ে না রাখলে! শান্তনু এই ক'দিন কোনওদিকে তাকানোর অবসর পাননি, বা বলা চলে, অবসর পাওয়ার ইচ্ছেটাই হয়নি। বাড়ি ভর্তি লোক ছিল, কেউ না কেউ তাঁর কাছে থেকেছে সবসময়, তাঁকে কথাবার্তায় ভুলিয়ে রাখতে চেয়েছে, ছাত্রছাত্রীরা তাঁকে ঘিরে রেখেছে, আত্মীয়-পড়শিরাও আসছে, কথায় কাজে অবসর মিলছিল না। এখন অখণ্ড অবসর, বনানীর রেখে যাওয়া জিনিসপত্রগুলো নেড়েচেড়ে দেখে গুছিয়ে রাখার সময়। অবশ্য গুছিয়ে রেখে কীই বা হবে! মানুষ ব্যবহার করলে তবেই না গুছিয়ে রাখার অর্থ হয়, যত্নের অর্থ হয়! যা আর কখনও কারও প্রয়োজনে লাগবে না, তা গুছিয়ে রাখা আর হেলাফেলায় ছড়িয়ে রাখার মধ্যে কীই বা ফারাক! তবু, মায়া রয়ে যায়। তাই তেল হলুদের গন্ধমাখা শাড়ি, গন্ধতেলের গন্ধ মাখা গামছা, যেসবে একটু করে বনানী মিশে আছে, নেড়েচেড়ে দেখে আলমারিতে তুলে রাখতে ইচ্ছে করে।

    আলমারিটা খুলে একটু অবাকই হলেন শান্তনু। এত ফাঁকা লাগছে কেন আলমারির তাকগুলো? যতবার দেখেছেন বনানীর শাড়ির তাকের দিকে চোখ পড়েছে, থরে থরে শাড়ি সাজানো থাকে। বেশিরভাগই বনানী পরতেন অন্তত দশবছর আগে, ইদানিং গাঢ় রঙের শাড়ি পরা ছেড়েছিলেন বেশ কিছু বছর। সেসব কোনও শাড়িই চোখে পড়ছে না তো! এদিক-ওদিক তাকালেন শান্তনু, ঘরেরও এদিকে ওদিকে চোখ রাখলেন। হ্যাঁ, ঐ তো! খাটের ওপর মেলে রাখা আছে একটার পর একটা গাঢ় রঙের শাড়ি। কে বার করে রাখল শাড়িগুলো? আজ সারাদিন এঘরে সেভাবে আসা হয়নি, এলেও হয়তো খাটে বসার প্রয়োজন হয়নি, বাড়ি যাওয়ার আগে মুক্তাই কি বার করে রেখে গেছে সবকটা শাড়ি? কিন্তু কেন? জিজ্ঞেস করতে হবে কাল এলে। আপাতত একটা একটা করে শাড়ি পরম মমতায় তুলে আলমারিতে গুছিয়ে রাখেন শান্তনু। যার জিনিস সে অপরিসীম যত্ন করত জিনিসগুলোর। রোদ খাওয়ানো, মাঝে মাঝে এমনিই বার করে ভাঁজ ভেঙে আবার ভাঁজ করে তুলে রাখা, এসব করতে দেখেছেন বনানীকে। তখন তলিয়ে ভাবেননি, এখন মনে হচ্ছে এদের প্রতি সন্তানস্নেহের মতোই কিছু একটা ছিল বোধহয়। নইলে যে শাড়ি দশবছর ধরে একবারও গায়ে তোলেননি তাদের প্রাণে ধরে কাউকে দিতেই বা পারেননি কেন?

    দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুক চিরে, অজান্তেই। চোরা অপরাধবোধও কি ঘিরে ধরে? আনমনে শাড়ি গোছাতে থাকেন শান্তনু। পুরুষমানুষ, শাড়ির ব্যাপারে একেবারেই অনভিজ্ঞ, বনানী এসব ব্যাপারে তাঁকে সেভাবে কখনও শিখিয়েপড়িয়ে নেননি, কয়েকটা শাড়ির ভাঁজ এলোমেলো হয়ে যায় তাই, অপটু হাতে ওভাবেই তুলে রাখেন, মনে মনে ভাবেন মুক্তারা কাল এলে বলতে হবে আলমারিটা ভাল করে গুছিয়ে দেওয়ার জন্য।

    ।।৪।।

    বনানী বড় বিরক্ত হয়ে আছেন। মানুষটা যদি একটা কাজ ঠিকভাবে করতে পারেন! আর বাকিদেরই বা কী আক্কেল কে জানে, একলা ছেড়ে দিয়েছে মানুষটাকে। কোনওদিন কুটো ভেঙে দুটো করেছে নাকি যে আজ সব দায়ভার একলা সামলে নেবে? কেউ ভাবল না সবাই মিলে একসাথে বাড়ি খালি করে চলে গেলে মানুষটার কী দশা হবে!

    মুক্তার মুখেই যত দরদ,

    “বুক দিয়ে আগলাব দেখো বউদি!”

    হুঁঃ, এখন আগলাচ্ছিস কত! সেই তো কাজের ছুতো দেখিয়ে কেটে পড়লি মানুষটার ওপরে সাতকাজের ভার চাপিয়ে। হ্যাঁ, বলে গেছে কাল সকালেই চলে আসবে, একেবারে সব পার করে তারপর যাবে, কিন্তু আজ রাতটা তো মানুষটাকে একলা থাকতে হবে! সারাদিন নাহয় ছাত্রছাত্রীরা পালা করে এসে থেকে গেছে কিছুক্ষণ করে, সন্ধের পরে মালবিকাও এসেছিল, সন্ধের চা-টা সে-ই করে দিয়ে গেছে, রাতের খাবারটাও গুছিয়ে রেখে দিয়ে গেছে টেবিলে। সত্যি এই ক’দিন মালবিকাকে দেখে বনানীর ভুল ভাঙছে। ভুল বুঝেছিলেন মেয়েটাকে। হাতে ঘাড়ে ট্যাটু করলে আর উড়নচণ্ডে জীবন কাটালেই মেয়েদের ধী নষ্ট হয়ে যায় না। তাঁর ধারণা পালটে দিচ্ছে মেয়েটা। আর ক’টাদিন আগে মেয়েটার এই রূপখানি দেখলে মেয়েটাকে একটু কেছে ডেকে নিতে পারতেন। কাছে আসতে চাইত মেয়েটা, দিব্যি বুঝতেন বনানী, ওর ধরনধারণ পছন্দ হতো না বলে তিনিই এড়িয়ে চলতেন। তাও শেষের দিকে সেভাবে আর এড়িয়ে চলতে পারতেন কই! সে মেয়ে এসে নিজেই চা-টা করে আড্ডা বসিয়ে বনানীকে ডেকে নিয়ে যেত সেই আসরে।

    অল্পস্বল্প গল্পের মাঝেই কি বনানী কোনওদিন বলে ফেলেছিলেন গাঢ় একরঙা শাড়ির প্রতি তাঁর তীব্র ভালবাসার কথা? আর ও মেয়ে অমনি সেকথা বুঝে ফেলে তাঁর জন্মদিনে নিয়ে এসেছিল অমন একখানা সুন্দর শাড়ি? এত আপন করে কেউ ভাবতে পারে! বনানী ওঠেন। শাড়িটা এক্ষুনি একবার গায়ে ফেলে দেখতে ইচ্ছে করছে। সত্যিই কি আর একেবারেই মানায় না ওসব রং? কেউ তো তাঁকে বলেনি কখনও,

    “প’রো না এসব রং, আর মানায় না তোমায়।”

    তবে তিনি কেন থামিয়ে দিলেন গাঢ় রঙের শাড়ি পরা? অবশ্য ‘লোকে কী বলবে’র ধমক জীবনভরই তো তাঁকে ভয় দেখিয়েছে, বুড়োবয়সেই বা সে ভয় যায় কীভাবে?

    নাহ্, শাড়িটা দরকার। একটু গায়ে ফেলে আয়নায় দেখবেন। আয়নাটা কোথায় গেল? আলমারির চাবি কোথায় রেখেছেন শান্তনু? রাতে যখন গুছিয়ে রাখছিলেন শাড়িগুলো, তখনই বারণ করলে হতো।

    বললে হতো,

    “তুলে রেখো না ওগুলো, ওভাবেই থাকতে দাও, আমি ওদের দমচাপা অবস্থায় রেখেছিলাম বহু বছর, এবার একটু শ্বাস নিয়ে বাঁচুক। আমিও বেশ ছুঁয়ে থাকতে পারব ওদের অহরহ! আলমারিতে তুলে রেখো না গো আর, ওদের শ্বাস নিতে দাও!”

    বলা হয়নি। বললে রাতদুপুরে নাটকীয়তার একশেষ হত। নিজের মনেই মৃদু হেসে আলমারির দিকে এগোলেন বনানী। নীল শাড়িটাকে অন্তত একবার ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে বড্ড।

    ।।৫।।

    মালবিকাকে আজ সাতসকালেই ডেকে পাঠিয়েছেন শান্তনু। কেন, ভেঙে বলেননি। বলেছেন সামনাসামনি বলবেন, মালবিকা যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে আসে। মায়ের টেস্টগুলো করিয়ে বাড়ি নিয়ে গিয়ে জলখাবার খেয়েই ও বেরিয়ে পড়েছে। মা বলছিল বিকেলে যেতে, শুধু শুধু কলেজ কামাই কেন, মালবিকা খুব বেশি কিছু বলেনি মাকে। বুঝতে পারছে না কী হয়েছে, জেনে এসে তারপরই যা বলার বলবে মাকে।

    স্যারের বোন আর ভাগ্নীর আসার কথা ছিল, স্যারের বাড়ি ঢুকে দেখল তাঁরাও এসেছেন। স্যার সোফায় বসে আছেন হেলান দিয়ে, হাত দিয়ে দু’চোখ ঢাকা।

    “কী হয়েছে স্যার? শরীর খারাপ?”

    “জানি না। বোস।”

    স্যারের বোন ইশারা করলেন মালবিকাকে বসার জন্য।

    “আমি বোধহয় ব্যালান্স হারাচ্ছি জানিস? হ্যালুসিনেট করছি। মেমরি লস হচ্ছে আমার।”

    “এসব কী বলছেন স্যার? কালকেও সন্ধে বেলা আমি এলাম, আমার সঙ্গে কথাবার্তা বললেন, এমন কিচ্ছু মনে হয়নি আমার। আমাদের কারও এমনটা মনে হচ্ছে না। বলুন আণ্টি?” স্যারের বোনও নীরবে সমর্থন করলেন মালবিকাকেই।

    “কী হয়েছে সবটা খুলে বলুন স্যার। নইলে বুঝতে পারছি না কিচ্ছু।”

    “শাড়ি।”

    “শাড়ি? কার শাড়ি? কী হয়েছে শাড়ি নিয়ে?”

    “বলছি। মুক্তা তোরাও এসে বোস। সবার জানা দরকার। যদি সত্যিই আমি ব্যালান্স হারাই, তাহলে ডাক্তারের কাছে যাব। একা লোক, এসব বাড়তে দেওয়ার আগেই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে, অ্যারেস্ট করাতে হবে,”

    “আচ্ছা সে হবে মামা, আগে তো তুমি বলো কী হয়েছে?”

    “কাল রাতে শোবার আগে বনানীর শাড়িগুলো গোছাচ্ছিলাম। যত পুরনো শাড়ি, গাঢ় একরঙা শাড়িগুলো যেগুলো বনানী বহুকাল পরা ছেড়ে দিয়েছিল, সেসব খাটে ছড়িয়ে রাখা ছিল। মুক্তা তুই কি আলমারি গোছাবি বলে বার করেছিলি? তারপর ভুলে গেছিস বাড়ি যাবার আগে?”

    “আমি? কই, মানে, হ্যাঁ হতেও পারে, মনে নেই ঠিক।”

    মালবিকার সঙ্গে চোখাচোখি করে কথাক’টা গিলে নিলেন মুক্তা। তাঁর খুব ভাল করে মনে আছে তিনি বউদির আলমারি খোলেননি কাল। আর খুললেও গত দশবছরে বউদি যেসব শাড়ি পরেননি তাতে হাত দেবেন কেন? এই কি শাড়ি ঘাঁটার সময়? কিন্তু এত কথা দাদাকে বলতে গেলে দাদা আবার হ্যালুসিনেশনের কথা বলতে বসবে।

    “তারপর কী হল দাদা? তুমি তুলে রাখলে শাড়িগুলো?”

    “ইয়ে, হ্যাঁ, তুলে রাখলাম, তারপর শুয়ে পড়লাম। ঘুম আসতে তো চাইছে না এখন, এপাশ ওপাশ করছিলাম। তারপর কখন ঘুম এসেছে জানি না। সকালে উঠেও কিছু খেয়াল করিনি। গাছে জল দিয়ে গামছা নিতে ঘরে ঢুকেছি, দেখি একটা নীল শাড়ি, এই, মালবিকা, মাসিমাকে একটা শাড়ি দিলি না এবারের জন্মদিনে? সেটা। সেটা খাটের ওপরে রাখা।”

    “কাল রাতে তুলতে ভুলে গিয়েছিলেন কি ওই শাড়িটা?”

    “কে জানে! আমার তো মনে হচ্ছে সব শাড়িই তুলে রেখেছিলাম। শোবার সময়ে খাটে কিছু পড়ে থাকলে নজরে আসত তো! আবার মনে হচ্ছে হয়তো ভুলে গেছি, তুলে রাখিনি ওটা। খেয়াল হয়নি।”

    “তাইই হবে মামা। তুমি তুলে রাখলে আবার কীকরে ওটা খাটের ওপর আসবে?”

    “আচ্ছা শোন, আমি শাড়িটা খাটের ওপরেই রেখেছি। তোরা সবাই দ্যাখ, তারপর তোরাই কেউ তুলে রাখ। আমি তুলে রেখে বা না রেখে যদি আবার ভুলে যাই!”

    “আচ্ছা ঠিক আছে। চলুন, ওঘরে যাই। আপনার সামনেই তুলে রাখি, সবাই দেখলে তো সবার মনে থাকবে। আপনিও বুঝবেন আপনি ব্যালান্স হারাননি। চলুন স্যার।”

    ঘরে গিয়ে দেখা গেল খাটের ওপরেই আছে শাড়িটা। দিনের আলোয় সত্যিই সুন্দর লাগছে শাড়িটাকে।

    “তোমার পছন্দ আছে মা! বউদি ঠিক এইরকম শাড়িই সবচেয়ে বেশি ভালবাসত। পরতো না ইদানিং, কী যে বয়স বয়স বাই ঢুকেছিল মাথায়!” মুক্তার কণ্ঠস্বরে খেদ ঝরে পড়ে। মানুষটা বউদিকে বড় ভালবাসতেন।

    আলমারির গায়েই চাবি ঝুলছিল। মুক্তা শাড়িটা তুলে রাখলেন সযত্নে। দাদা কাল সব শাড়ি নামিয়ে আবার তুলে রেখেছে। মনে পড়ছিল বোধহয় খুব। আহা! এই লোকটা বড্ড একা হয়ে গেল। কেন যে এমন হয়! অপটু হাতে গুছিয়েছে তো, কিছু শাড়ির ভাঁজ এলোমেলো হয়ে গেছে।

    “আমি সন্ধে বেলায় আলমারিটা ভাল করে গুছিয়ে দেব দাদা। কাল কয়েকটা শাড়ি রোদেও দেব, ভাল রোদ উঠছে এখন।”

    শান্তনু অন্যমনস্ক হয়ে ছিলেন, হ্যাঁ না কিছুই বললেন না বোনের কথায়। মালবিকার মনে হল মানুষটাকে কাজের মধ্যে ব্যস্ত রাখা খুব দরকার। তখনই মায়ের ফোন এল। মাসতুতো বোন এসেছে মায়ের কাছে, আজ থাকবে। ভালই হল, দ্বন্দ্ব ছিল, ছুটি নিয়েও সারাদিন বাড়িতে থাকবে না, মা একা থাকবে সারাদিন, কুহু থাকছে ভালই হল, মায়ের সময় কাটবে।

    “আমি তাহলে সারাদিন স্যারের কাছেই থাকছি, বিকেলে বাড়ি ঢুকব। এখানে দরকার আছে।”

    মাকে জানিয়ে ফোন রাখল।

    “স্যার, কয়েকটা টপিক একটু ট্রাবল দিচ্ছে, লেসন প্ল্যান করতে পারছি না। আপনার কাছে একটু বুঝে নেব আজ। চলুন স্যার, স্টাডিতে যাই।”

    মুক্তা আর মেয়ে মনামিও গেল রান্নাঘরের দিকে, রান্নার মেয়েকে যা বলার বলতে হবে। শান্তনুকে ব্যস্ত রাখার কাজে ব্যস্ত হল সবাই, অন্যান্য দিনের মতোই।

    ।।৬।।

    সন্ধে হচ্ছে। আশেপাশের বাড়ি থেকে শাঁখের আওয়াজ আসছে। এবাড়িতে অস্বস্তিকর নৈঃশব্দ্য ঘুরে বেড়াচ্ছে চারিদিকে। শান্তনু, মুক্তা, মনামি, মালবিকা, আছে সবাই, কেউ কারও মুখের দিকে তাকাতে পারছে না, কে প্রথম কথা বলবে সেই দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। জড়তা কাটিয়ে মুখ খুলল মালবিকাই,

    “স্যার, আমরা সবাই আজ সারাদিন সবার চোখের সামনেই ছিলাম। আমি আর আপনি স্টাডিতে, আণ্টি আর মনামি হয় আমাদের সঙ্গে, নইলে কিচেনে বা ড্রইংরুমে। আপনাদের ঘরে কেউই যাইনি। খেয়েছি একসঙ্গে, খাবার পরেও ওঘরে যাওয়ার প্রয়োজন কারও হয়নি। আলমারিও আমরা কেউই খুলিনি। তাই তো?”

    বাকি সবাই ঘাড় নেড়ে নীরব সম্মতি জানায়।

    “চা খাওয়ার পর আমি আণ্টি আর মনামি একসাথে ওঘরে ঢুকি, আলমারি গোছাবেন আণ্টি, আমরা হেল্প করব। স্যার তখন গাছে জল দিচ্ছেন, বেডরুমে উনি তখনও ঢোকেননি। আমি এইভাবে সিন বাই সিন বলছি বলে প্লিজ কেউ মাইন্ড করবেন না, আমি জাস্ট আমরা কে কখন ওঘরে ঢুকেছি, তাতে কোনো ফাঁক থাকছে কি না, কেউ মনের ভুলে আগেই আলমারি খুলেছি কি না, সেসব বিষয়ে আরও একবার শিওর হয়ে নিচ্ছি। কেউ আগে ওঘরে গেলে প্লিজ বলবেন মনে করে।

    সবাই দু’দিকে মাথা নাড়ে। কেউ আলাদা করে ওঘরে যায়নি বিকেলের আগে।

    “আমরা গিয়ে দেখি আলমারির গায়ে চাবি লাগানো, আর মাসিমার যত একরঙা শাড়িগুলো আবার খাটে মেলে রাখা আছে, তাদের মধ্যমণি হয়ে রয়েছে আমার দেওয়া নীল শাড়িটা, যেটা মাসিমা একবারও গায়ে তোলেননি। তাই তো?”

    “হ্যাঁ।”

    এবার উত্তর দেন মুক্তা। তাঁর সর্বাঙ্গ শিহরিত হচ্ছে। বাস্তব এবং যৌক্তিক বোধের পরিসরের বাইরে চলে গেছে ঘটনাপ্রবাহ। মুক্তা বুঝতে পারছেন আলমারি তিনি একবার কেন, বারবার গুছিয়ে রাখতেই পারেন, কিন্তু কালকেই আবার শান্তনু দেখবেন, বা তাঁরা সবাই দেখবেন খাট জুড়ে ছড়িয়ে আছে সেইসব গাঢ় একরঙা শাড়ি, যা তাঁর সদ্য পরলোকগতা বউদি গায়ে তোলেননি গত দশবছর।

    ।।৭।।

    আহ্, নীল শাড়িখানা সত্যিই বড় সুন্দর। দিনের আলোয় এর আগে কখনও দেখেননি বনানী শাড়িটাকে। আজ দেখেছেন, মুগ্ধতা আরও বেড়েছে। বনানী আবার বার করেছেন সব প্রিয় শাড়িগুলো, মধ্যমণি করে রেখেছেন মালবিকার দেওয়া শাড়িটাকেই। গায়ে ফেলে দেখলে হতো একবার, প’রে তো দেখা হল না একবারও! আয়নাটা কোথায়, আয়নাটা কোথায়? এখানেই তো ছিল, আয়নাটা কি মানুষটা সরিয়ে ফেলল এর মধ্যে? নইলে তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না কেন?

    শান্তনু-বনানীর শোবার ঘরের এই কোণ থেকে ওই কোণে উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ান বনানী, কিংবা সম্পূর্ণ বনানী নন, কেবলমাত্র কায়াহীন একটা উপস্থিতি।।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments