হৈমবতী সেই কবে থেকে ফুলুরিকে বলে রেখেছে, ‘তুই তো নিত্যদিন মিনিবাসে চেপে মশাট যাস, আমার বাপের বাড়ির খবর আনতে পারিস?’
ফুলুরি বলে, ‘তোমার বাপের ভিটে মশাটে নাকি?’
‘হ্যাঁ-রে, মশাটেই তো! সেই কবে গেছিলুম বাপের বাড়ি—মনেই নেই। আমার ছেলেরাও কাজেকম্মে নানাভাবে ব্যস্ত থাকে; তারাও আর ও-মুখো হয় না। মামাবাড়ি বলে যে একটা বস্তু আছে, তার খবর কেউ রাখে নে। তারা এখন ব্যস্ত শ্বশুরবাড়ি আর শালির বাড়ি নিয়ে। ইদিকে ভাইদের জন্য, বাপের ভিটের জন্য আমার পেরান উচাটন হয়, সে খবর কে রাখে?’
‘তুমি নিজেই যাও না কেন দিদি?’ বলে জড়োসড়ো ভাবটা কাটিয়ে মেঝের মধ্যে একটু ছড়িয়ে বসে ফুলুরি।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হৈমবতী বলে, ‘গায়ের বল নেই, শরীরে তাগদ নেই—যাই কি করে? উঠতে-হাঁটতেই জান কয়লা হয়ে যায়। আর রাস্তা কত—সে কী হেতা? যাব কীসে?’
ফুলুরি ঘাড় নেড়ে বলে, ‘তা বটে! তোর মতন গতর কি আর আমার আছে!’***
‘আমার আবার গতরের কোনখানটা দেখলে গো?’
‘গতর কি কেবল মেদ-মজ্জায় হয়? হয় নে। এই যে খ্যাংরা-কাঠির মতন তোর শরীর, এতে কোনো রোগ সেঁধোয়? সেঁধোলে ঘরের ভেতরে পড়ে থেকেই তোকে কোঁকাতে হত, কোথাও আর যেতে পারতিস নে। রোগা-প্যাংলা এই চেহেরা নিয়ে, একখানা থান কাপড় গায়ে চইড়ে এই যে তুই সুড়ুৎ করে বাসে উঠে বিনা ভাড়ায় মশাট পৌঁছে যাস—এটি আজকের দিকে ক’জন পারে দিকি—বল আমায়।’
ফুলুরি নীরব থাকে। একেবারে নীরব নয় সে। তার যা পরিস্থিতি, সে কোনও কিছুতেই কিছুতেই নীরব থাকতে পারে না। তাতে তার পাওনাগণ্ডা ব্যাহত হয়। তাই সে মুখে কিছু বলে না বটে, তবে ঘাড় নাড়ে। যার মানে দাঁড়ায়, হ্যাঁ।
এবার সে বলে, ‘মশাট হল গে আমার ঘর-দোর দিদি। রোজ যাচ্ছি আর তোমার বাপের ভিটের খবর আনতে পারবুনি? খুব পারব।’
তাকে একবাটি মুড়ি দেয় হৈমবতী। বাটিটা কেবল ফুলুরির জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা থাকে হৈমবতীর চৌকির নীচে। তার চা খাবার কাপও আলাদা। মুড়ি রাখা থাকে একটি টি-টেবলের উপর, ছোটো একটি টিনের কৌটোয়। পাশে প্লাস্টিকে ডিপেতে থাকে চানাচুর, ঝুরিভাজা, বাদাম ও ছোলাভাজা। হৈমবতী সব-সময় ছেলে-বউয়ের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে চায় না। দুপুরের একবাটি ভাত-তরকারি-ডাল তারা ভেতর বাড়ি থেকে হৈমবতীর জন্য দিয়ে যায়। বাকি সময় খিদে পেলে হৈমবতী নিজের খাবার এই টি-টেবল থেকে নিজেই নিয়ে খায়।
‘আমার ভেয়েদের নাম বলে দি তোকে।’
‘দেও।’
বাড়ি থেকে মুঠো ভরে মুড়ি নেয় ফুলুরি। তেল নেই। তেল মাখা মুড়ির স্বোয়াদ আলাদা। কিন্তু বয়স যখন তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, যেখানে কাড়া-আকাড়া ভাববার সময় নেই, সুযোগ নেই, উপায়ও নেই—তখন ওসব নিয়ে না ভাবাই ভালো— জীবনের এই চরম সত্যটা ঠেকে শিখে নিয়েছে ফুলুরি।
‘পাড়ার নাম বলে দি।’
‘দেও।’
নীচু এক চৌকিতে বসে বসে তার সঙ্গে বাপের ভিটের গল্প করে হৈমবতী। ছিল তো মোটে দু’খানা মাটির ঘর। মাথায় চাপানো টালিখোলা। চারিদিকে গাছপালা, পুকুর, জমি। বাড়ি ছেড়ে একটু এগোলেই বাগান। পুজো করে, এটা-ওটা করে তাদের তখনকার সেই সংসার চলত। হৈমবতীর বড় দাদা তখন গোপালপুর পাঠশালার হেড পণ্ডিত। পরে সেই ইস্কুলের নাম হয় ‘আকুনি বিজি বিহারীলাল হাইস্কুল’। কিন্তু ওই করে কত টাকাই বা আয় হয়। সেই দাদা হৈমবতীর চেয়ে কুড়ি বছরের বড়। সেই দাদার উপর পুরো সংসারের ভার। আর সেই ভারের ওজন নেহাত কম নয়। তারা মোট আটজন ভাই-বোন। সঙ্গে মা, বিধবা পিসি, দূর সম্পর্কের একজন বয়স্কা আশ্রিতা। সংসার চালানোই দায়। মাস্টারদের এখন যেমন রমরমা, দেখ-দেখ অবস্থা, বাইক ছাড়া কথা নেই—সেকালে তেমনি ছিল না তখন। তখন মাস্টাররা বিয়ে করার জন্য মেয়ে পেত না। আর আজকাল মেয়ের বাপ মাস্টার ছেলের জন্যে হন্যে হয়ে ঘোরে।
‘বুঝতে পারলি?’
‘হ্যাঁ।’
‘পারবি তো?’
‘লেশ্চয়।’
তাদের মশাট এক অত্যন্ত প্রাচীন জনপদ। এই এলাকার একমাত্র গঞ্জ। জমজমাটির মূল কারণ ছিল মার্টিন রেলকে ঘিরেই। সেই রেল শিয়াখালায় ছেড়ে মশাট-জঙ্গলপাড়া-কালীপুর হয়ে হাওড়া যেত। তখন মশাট স্টেশনকে ঘিরেই হাট বসত। গমগমে অবস্থা। হাট আজও বসে। সপ্তাহে দু’বার। মঙ্গলবার আর শনিবার। সেই দুদিন কত হইহল্লা, কত লোকজন। জিলিপি ভাজা, পাঁপড় ভাজার গন্ধে চারিদিক ম-ম করত। রেলগাড়ি চেপে চারটি স্টেশন গেলেই চণ্ডীতলায় ‘মহালক্ষ্মী’ সিনেমা হল। সেটা একটা ব্যাপার ছিল। সঙ্গে আরও একটা ব্যাপার ছিল। তা হল অভাব।
‘বামুনদিদি, আর একবার বলো।’
‘কি বলব?’
‘পেথম থেকে বলো।’
‘ভেয়েদের নাম?’
‘ধামও বলো।’
‘ঘর-দোরের ঠিকানা?’
‘বলে দেও আর একবার করে বলে দেও।’
‘তুই তাহলে কি শুনলি তখন?’
কার অভাব ছিল না? কোন ঘরে অভাব ছিল না। ঘর ঘর অভাব। মাটির রাস্তা, মাটির বাড়ি, মাটির মানুষ আর অভাবও যেন ছিল মাটির। ফলে কষ্ট হলেও কারো তেমন গায়ে লাগত না। সেই মাটিন রেলের যুগে, মাত্র বারো বছর বয়সে হৈমবতীর বিয়ে হয়ে গেল সাত-আট কিমি দূরের এক গ্রামে তেমনি এক মাটির মানুষের সঙ্গে।
‘তোমার বাবার কথা কি যেন বলছিলে বামুনদিদি...’
‘বাবার কথা? কই!’
‘বলুনি?’
‘কই—না!’
‘কার কথা বললে তবে?’
‘কারও কথা বলিনি তো!’
অনেক পরে তাদের অবস্থা ফিরতে থাকে একটু একটু করে। এক ভাইপো বিডিও হয়। সে বাড়ি করেছে শিলিগুড়িতে। অন্য একজন ভাইপো সরকারি এক ব্যাংকের বড় অফিসার। সে থাকে বিহারে। সেখানেই বাড়ি করে নিয়েছে। একজন করেছে ওড়িষ্যায়। সে সেখানে রেলের চাকুরে। আর একজন ভাইপো রাইটার্সে কাজ করত। ফলে বাপের বাড়ি তখন গমগম করত। বাড়িতে ঘটা করে মা জগদ্ধাত্রীর পূজা হত। বলি হত। তখন একসপ্তা ধরে বাপের বাড়ি গিয়ে পরে থাকত। অন্যান্য বোনেরা চলে আসত। নানা আত্মীয়-স্বজনে ভরে থাকত বাড়ি। সে এক মহা হইহই-রইরই ব্যাপার।
‘তবে এতক্ষণ ধরে যে এত গল্প করে গেলে, বামুনদিদি?’
‘সে তো আমার বাপের ভিটের কথা।’
‘আচ্ছা—তাইলে বেপারটা একই হল।’
‘তার মানে?’
ভাইপোরা আর ফিরবে না, নিজের নিজের বাড়িতে সেটেল্ড। ফলে তার বাপের বাড়ি এখন ফাঁকা। ভেয়েরা মারা যেতে পুজো বন্ধ, বলি হয় না আর। এখন তারাই সেখানে পড়ে আছে যারা সারা জীবনে কিছু করতে পারেনি। তার সেইসব কিছু না-করতে পারা ভাইপোরা কেউ ছাপাখানায় কাজ করে, কেউ কোনও মুদির দোকানে। এই করেই চলছে তাদের দিনগুজরান। কিন্তু তারপর? তারপর কি হল? হৈম জানে না। কে জানে সেই অভাবের দিন তাদের জীবনে ফের ফিরছে কিনা।
দু-গাল মুড়ি চিবিয়ে ফুলুরি বলে, ‘ও নিয়ে তুমি কিছু ভেবেনু বামুনদিদি, ও আমি ঠিক খুঁজে নোবো।’
‘তুই পারবি তো?’
‘মশাট আমার কাছে কী আর এমন ভ্যাপার!’
গালে একমুঠো ভাজা বাদাম ফেলে হৈমবতী বলে, ‘সে আমি জানি, খুব করিতকর্মা মেয়ে তুই।’
প্রশংসায় খুশি হয়ে ফুলুরি দুলে দুলে মুড়ি খায়। একমুঠো বাদাম চেয়ে নেয়। মুড়ির বাটি শেষ হলে সে নিজেই বাইরের কলে গিয়ে বাটিটা মেজে আনে। চৌকির নীচে ঢুকিয়ে রাখে। মেঝেতে বসে পড়ে। সাদা আঁচলে মুখ মুছে নিয়ে বলে, ‘চা হলুনি?’
‘হলুনি তো হলুনি।’
‘ও!’
‘আমার ঘরে ওসব নেই রে।’
ফুলুরি চুপ।
‘মাঝে মাঝে ভাবি জানিস, একটা স্টোভ নেসে ঘরের ভিতরি রেখে দোব। কিন্তু সে আর হয় নে। ঠায়-ঠায় যে চা খাব, হাত পোড়াবে কে? তাছাড়া বারবার চা-ই যদি খাব, পান তবে খাব কখন?’
একাকী এক রেলপথ চোখের সামনে ভেসে ওঠে হৈমর। রেললাইন ধরে সে হেঁটে যেত তখন। মাঝে মাঝে কখনও থাকত ফুলপিসি, রাঙাকাকা, পাড়ার মেয়েরা। সঙ্গে মাঝে মাঝে থাকত বাবা। হৈমর বাবা তখন ঘরেই থাকত। কি একটা রোগ হয়েছিল। বাপের বাইরে বেরোনো বারণ। বেশি কথা বলা বারণ। তাদের সঙ্গে মেশা বারণ। কিন্তু তবু বাবা মাঝে মাঝে বেরোতো। রেললাইন ধরে হেঁটে যেত হৈমর সঙ্গে। কিন্তু একটু হেঁটেই ক্লান্ত হয়ে যেত বাপ। রেললাইনের উপরেই থেবড়ে বসে পড়ত। বাপ তো চলেই গেল তারপর। তাদেরও মানুষ করেছে তাদের চেয়ে কুড়ি বছরের বড় দাদা।
‘চা খাবি যদি ভিতরি গিয়ে বৌমাদের বলে আয় না কেন।’
এবার ফুলুরি হাসে।
‘যাবি না। তবে পান খাবি?’
‘তুমি জানো দিদি, অসব আমি খাই নে।’
‘তা বটে।’
‘আমি তবে যাই।’
‘যাবি?’
ফুলুরি চুপিচুপি উঠে আসে। হৈমবতীর সামনে এগিয়ে আসে পায়ে পায়ে। একটু ঝুঁকে ফিসফিস করে বলে, ‘আমার পঞ্চাশটা টাকা দিতে পারো, দিদি?’
‘পঞ্চাশ টাকা! কোথা পাব?’
ফুলুরি চুপ। কিন্তু সে নড়ে না। তেমনি করেই দাঁড়িয়ে থাকে।
হৈমবতীর বালিশের পাশে একটা জর্দার কৌটো। সেটার ঢাকনা খুলে কুড়ি টাকার একটা লাল নোট ফুলুরির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘আজ এটা রাখ।’
‘আচ্ছা!’
বাপের বাড়ির খবর নিয়ে আয়, একশো টাকার নোট দেব, বলে রাখলুম।’
‘বেশ দিদি। পেন্নাম।’
বলে হৈমবতীর জোড়া পায়ে পেন্নাম ঠুকে ফুলুরি সেদিনের মতন বিদায় নেয়।
কিন্তু সেই যে ফুলুরি গেল, তার আর আসার নাম নেই। তার কোনও খবর কেউ দিতে পারে না। মুদিপাড়ার আর এক বয়স্কা মহিলা চাঁদ মুদির মা মঙ্গলারানীও হৈমবতীর এই একটেরে ঘরে আসে। ফুলুরির মতন সে-ও হৈমবতীর সঙ্গে গল্পগুজব করে। দেশ-কালের খবরাখবর নেয়। হৈমবতীর পানের বাটাও রাখা থাকে চৌকির নীচে। সে ঘরে ঢুকে থেবড়ে বসে মাটিতে। নীচু হয়। তারপর পানের বাটা টেনে নিয়ে পান সাজতে শুরু করে। সে চা খায় না। পান খায়। পানের প্রচণ্ড নেশা। আঁচলে গিঁট বাঁধা থাকে পান।
সে বলে, ‘ফুলুরির হদিস কে রাখে বলো দিকিনি, বামুনদিদি! সে বলে বটে মশাট যায়, কিন্তু বাস থেকেন নেমে সে যে কোথায় না কোথায় গিয়ে ভিক্ষে করে, তার আর ঠিক কি!’
‘সেখেনে যাবার পথটুকুর সবটুকুই তাকে বলে দিয়েছি।’
‘সে কি এক ঠাঁইয়ের মানুষ? দুটি ভাতের লগে সে কোথায় না-কোথায় ঘুরে বেড়ায়। সে আনবে তোমার বাপের ভিটের খপর? দেখো গিয়ে ভুলেই মেরে দিয়েছে সে। টেকা দিলে?’
‘সে—’
‘ওই!’
‘আমার ভেয়েদের নামধাম সব বলে দিলুম, তা-ও ভুলে যাবে?’
‘ফুলুরি অমনিই।’
‘তাকে সব পইপই করে বলে দিয়েছি।’
‘দেখো গিয়ে কার ভিটের মদ্যে থানা গেড়ে বসে আছে, যদি দুটি ভাত মেলে।’
‘আমার বাপের ভিটের অমন উঁচু দোতলা বাড়ি, অতবড় বাগান, তিন চারটে দিশি-বিলিতি পোষা কুকুর আছে, সব সময় তারা ঘেউ ঘেউ করে যাচ্ছে—সব ভুলে যাবে ফুলুরি? কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাবে কুকুরের চিৎকার?’
‘হয় হয়, অমনি হয়। মানুষের জীবনে সব হয়। টেকাটা তোমার বেকার গেল দিদি।’
‘হুম!’ বলে চুপ করে যায় হৈম।
মঙ্গলা বলে, ‘আমি একবার যাব নাকি ফুলুরির বাড়ি?’
‘যাবে?’
‘যাই।’
‘যাও।’
‘ফিরবে কবে?’
‘ওমা! এই তো দুটি পাড়া পরেই ওর বাড়ি—তার আবার এখন-তখন কি, ফেরাফিরিই বা কি? এই যাব আর আসব।’
‘আসো আসো।’
মুখে একটি পান পুরে নিয়ে মঙ্গলা বলে, ‘দুটি পান তবে মুখে পুরে নিলুম দিদি।’ গদগদ হয়ে হৈমবতী বলে, ‘বেশ বেশ!’
‘আর দুটি আঁচলে বেঁধে নিলুম।’
‘আচ্ছা আচ্ছা। ফুলুরির খবর এনো।’
‘হ্যাঁ; নির্ভাবনায় থেকো। কত টেকা দিয়েছিলে যেন ফুলুরিকে?’
আশ্চর্য! সেই যে মঙ্গলারানী গেল তো গেলই—তার আর পাত্তা নেই। ফুলুরি নাহয় মাঝে মাঝে নিখোঁজ হয়; কিন্তু মঙ্গলা? এই তো পাশের পাড়ায় সে থাকে। জোলোদের বাড়ির উঠোন দিয়ে তাদের বাড়িতে পৌঁছে যাওয়া যায়—সর্টকার্ট রাস্তা। হৈম ভেবে কূল পায় না। কী যে হচ্ছে! এদিকে সে অশক্ত। এককালে এপাড়া-ওপাড়া করলেও এখন যে একটু এদিক-ওদিক করবে—শরীর সঙ্গ দেয় না।
একদিন দুয়ারে বসেছিল হৈম, দেখে সামনের রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে কাঁচাপাকা চুলের চাঁদ মুদি যাচ্ছে। গাঁট্টাগোঁট্টা চেহেরার চাঁদ মুদি বাড়িতে বসে বাতাসা বানায়, দোকানে-দোকানে সাপ্লাই দেয়। তার দুই ছেলে। বাঁটলো আর ফক্রে। দুজনেই এখন লায়েক হয়ে উঠেছে। ফক্রে ভগবতীপুর বাজারে একটি কাপড়ের দোকানে কাজ করে, বাঁটলো জন খাটে আর মদ খায়। তার দুই ছেলেই বিয়ে করে আলাদা। চাঁদ তার মায়ের সঙ্গে থাকে। চাঁদের কোনো নেশা নেই। তবে ফি দিন সে উকিলবাড়ির বাইরের রকে বসে খবরের কাগজ পড়ে।
তাকে থামিয়ে হৈম বলে, ‘তোর মায়ের খপর কি রে চাঁদ?’
চাঁদ বলে, ‘মা-র শরীল খারাপ।’
‘কি হল?’
‘বাহ্যে-বমি।’
‘কবে হল?’
‘তিন-চার দিন।’
‘তোর মা ফুলুরির বাড়ি গেছিল?’
চাঁদ মাথা নাড়ে। সাইকেল চালিয়ে চলে যায়।
চাঁদ চলে যায়। বাঘাটি গ্রামের বাগদিদের একটা বউ চুনো মাছ বেচতে আসে। সে রোজই আসে। কোনোদিন আনে কচি মাছের চারা, বা ল্যাটা-শাল-শোল। যেদিন ঘুনিতে মাছ পড়ে না সেদিন সে গেঁড়ি-গুগলি নিয়ে আসে। তাকে থামিয়ে হৈম বলে, ও মেয়ে, ‘তুমি ফুলুরিকে চেনো?’
সে বলে, ‘ফুলুরি? না। সে মাথা নাড়ে। কোনদিকে বাড়ি তার?’
‘মান্নাপাড়ার পেছনে।’
‘ও—ওই মান্নাপাড়া। তা কি করে সে?’
‘ভিক্ষে করে।’
‘তবে আমি চিনি না।’
সে মাছের চুপড়ি কাঁখালে নিয়ে খালধারের দিকে চলে যায়। হৈম চুপ করে বাইরের দুয়ারের ভুঁয়ে বসে থাকে। ছেলেরা বলে, ‘মা, মামাদের সঙ্গে কথা কইবে?’
‘কার সঙ্গে কইব?’
‘সেজো মামার সঙ্গে।’
‘সে কি বেঁচে আছে?’
‘আছে।’
‘তবে সে-ই বা খবর করে না কেন?’
ছেলেরা চুপ।
বড়দাদা কবেই মারা গেছে। তার ছেলেও গেল। ছোটভাই মারা গেল। অন্য বোনেরাও একে একে চলে গেল কবে—সব ভুলেই গেছি। তবে আমি কেন একা একা পড়ে আছি—নিজেই জানি না! আমার দিন কি ঘনিয়ে আসবে না?
‘ফোনে কথা বললে, সেজোমামাকে ধরিয়ে দিচ্ছি।’
‘সে কি ফোন ধরে কথা বলতে পারে?’
ছেলেরা চুপ।
তারপরে একদিন ফুলুরি আসে।
সে-যে কতদিন পরে এল, তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। এসে বললে, ‘দিদি পেলুম। এই যে—’
বলে সে তার সাদা, ময়লা আঁচল খুলে একমুঠো ধুলোমাটি মেঝেতে ঢেলে দেয়। হৈম হাহা করে ওঠে, ‘কী করিস! কী করিস! মেঝেতে ধুলো ঢালিস—কাদা হয়ে যাবে যে!’
‘আনলুম গো দিদি।’
বলে হুস করে শ্বাস ছাড়ে ফুলুরি। বসে পড়ে মেজেতে।
‘এ মাটি কোত্থেকে আনলি? মশাট শ্মশানের মাটি আনলি? আমার ভাইরা যে ওখানেই পুড়েছিল!’
সামনের দিকে পা ছড়িয়ে দিয়ে দেওয়ালে ফুলুরি শরীর ছেড়ে দেয়। যেন এইটুকু মাটির ভার সে সহ্য করতে পারেনি।
‘কি হল তোর?’
‘নিয়ে এলুম।’
‘আমি কিছুই বুঝছি না!’
‘তুমি যে আনতে বলেছিলে?’
‘মাটি আনতে বলেছিলুম?’
‘তাই তো বললে।’
‘কী বললুম?’
‘বললে, ফুলুরি, আমাকে একমুঠো মার্টিন রেলের মাটি এনে দিস।’
‘আঁ! সে কথা কবে বললুম?’
‘মনে করে দেখো।’
বাবার হাতে সময় ছিল না। তাই কচিকচি ভাইবোনদের রেল দেখাতে নিয়ে যেত বড় দাদা। সেই দাদার হাত ধরে তারা চলেছে মার্টিন রেলের লাইনের খোঁজে। আরোও পরিষ্কার করে বললে কর্কটক্রান্তিরেখার খোঁজে। হৈমর দাদা ভূগোল বইতে তেমনি পড়েছিল। বড়দাদার ধারণা, ভূগোল বইতে পড়া সেই রেখা পৃথিবী তোলপাড় করে ছুটে গেছে আমাদের এদিক দিয়েই। মার্টিন রেলের লাইনই হল আসলে সেই রেখা!
চুপ করে বসে থাকে হৈম। নিচু হয়ে মেঝের মাটিতে হাত রাখে।
ফুলুরি এবার হি হি করে হেসে বলে, ‘কী দিদি, মনে পড়ল?’
হৈম চুপ। কত কথা মনে পড়ে, মনে ভেসে ওঠে। কে বলে সেইসব মানুষরা মারা গেছে। কেউ তাদেরকে মার্টিন রেল চাপতে নিয়ে যেত না। তখন বড়দাদা একদিন দুপুরে তাদের সবকটি ভাইবোনকে নিয়ে বেরলো। ছোটভাই বলল, আমরা কেবল লাইনই দেখব দাদা, রেলে চাপব না? দাদা বললে, আগে সেই রেখা খুঁজে বের করতে হবে।
কিন্তু সে রেখা কোথায়? আসলে কোথায় চলেছে তারা? কেবল হেঁটে যাচ্ছে, ঘুরে চলেছে। হৈমরা বুঝতে পারছে, অনুভবে ধরতে পারছে, গন্ধ পাচ্ছে বাতাসে—হ্যাঁ, এই কাছেপিঠেই কোথাও গা ঢাকা দিয়ে আছে সেই কর্কটক্রান্তি রেখা, যা আদতে মার্টিন রেলের শেষ লাইন। আর একটুখানি মাত্র, তাহলেই সেই রেখা তারা ছুঁয়ে ফেলতে পারবে। আর তখনই খুলে যাবে মার্টিন রেলে চাপার সুযোগ।
ফুলুরি বলে, ‘উত্তমকুমারের ধন্যিমেয়ে সিনেমায় সে রেলের একটা সিন আছে, সেটাও তো মার্টিন রেল, না দিদি?’
‘রেল কি চড়িস এখন?’
‘সে চড়েছি অনেক। হাওড়ায় বড়দির বাড়ি ছিল, গেছি কত। তারপর তো রেল বন্ধ হয়ে গেল, বাস চলল। সেই মজা কি আর বাসে চেপে হয় না হাউড়ের মত ছুটে চলা টেরেন-গাড়িতে চেপে হয়। বিনি পয়সার অমন গাড়ি আর পাবে কোথা?’
‘তুই কি কোনোকালেই টিকেট কাটতিস না নাকি?’
সেই প্রথম হৈমর রেল লাইন দেখা। সে দেখেছে, আর ভেবেছে। হ্যাঁ, রেল যদি হতে হয়, তা এইরকমই। কাছ দিয়ে গেলেও তড়াসে প্রাণ কেঁপে ওঠে না। মার্টিন রেলের চাকায় কেউ আত্মহত্যা করতেই পারে না। ও তেমন রেলগাড়িই নয়। কেউ যদি লাইনে মাথা পেতে রাখে তবে গাড়ি কাছে এসে থেমে যাবে, তবু উপর দিয়ে চলে যাবে না।
‘রেল যদি বন্ধ তো লাইন পেলি কোথায়?’
আমরা কজন বুড়ি মাগী ভিক্ষে মাঠের ধারে ডোবার পাশে যেখানে বসি, সেখান দিয়েই তো ছুটে গেছে রেললাইন। রেল নাই চললে বা, রেল লাইনের বেঁচে থাকতে তো কোনো অসুবিধা নেই। এক মাগীই দেখিয়ে দিল। বলল, রেললাইন তখনই দেখবি যখন পাখি ডাকবে আর ভোর হবে।
হৈম অবাক হয়ে বলে, সে ভোর তো কখন হয়ে গেছে। রোদ উঠে গেল।
‘দিদি, ও দিদি, একশো টেকা দেবে বলেছিলে?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ।’
‘দেও!’ বলে সে হাত পাতে। বলে, ‘দেও! ভোর তো হয়ে গেছে।’
সে রেলপথ কি আর একটুখানি? কতদূর বিস্তৃত সে পথ সে আর কে বলতে পারে। কেবলমাত্র হাওড়াতেই তো শেষ নয়। হাওড়া হয়ে সে পথ কোথায় না কোথায় ছুটে গেছে তার ঠিক কি! রেলপথে চলমান অজস্র শস্যকণা, নক্ষত্রের ধুলো। তার উপর দিয়ে ভেসে চলার রেলে চেপেই ত আসল মজা। রেল দৌড়চ্ছে, পাশাপাশি মানুষও দৌড়চ্ছে। এমনি করে দৌড়তে দৌড়তে কত যে মানুষ রেলে চড়ে বসত তার ঠিক কি!
‘তোর তাড়া কেন ফুলুরি?’
‘বা-রে! আজ যাব মাধানির বাড়ি।’
‘কেন?’
‘চারটি বড় বড় লাউ পেইছি, ওরে বেচব।’
‘চারটে লাউ! ও নিয়ে মাধানি কি করবে?’
‘আহা, তুমি ভুলে গেলে দিদি! মাধানি যে বাইরে চালান করে। ওর সব মাল কলকাতার শ্যামবাজারের হাটে বিক্রি হয়—যা তা কথা নয়!’
চাঁদ মুদির মা এল আরো চার দিন পরে।
এসেই ফুলুরির খোঁজ। হৈম বলে, ‘আগে বলো তুমি কেমন আছ? পেট সেরেছে?’ ‘হ্যাঁ হ্যাঁ। আমাদের মতন একঠেঁয়ে মানুষদের আর কদ্দিন ঘরের ভিতরি আটকে রাখবে বলতে পারো?’
‘বেশ বেশ। পান খাবে তো?’
‘লেশ্চয়!’
‘তবে সাজো দিকিনি। আমাকেও একটা দিয়ো।’
পান সেজে মুখে পুরে, আঁচলে বেঁধে নিয়ে গুছিয়ে বসে চাঁদের মা। বলে, ‘ও দিদি, তারপরে? ফুলুরি বাপের বাড়ির ঠিকানা দিল?’
‘ঠিকানা তাকে আমি দিয়েছিলুম।’
‘ও হ্যাঁ হ্যাঁ। বাহ্যে-বমির চক্করে পড়ে মাথা গেছে! তা কত টেকা আবার নে গেল সে?’
‘ফুলুরি এসে একমুঠো মাটি দে গেল আমায়।’
‘মাটি! কোথাকার?’
‘আমার বাপের ভিটের।’
‘দেখো গে, তোমায় ভড়কি দেছে। টেকা দিলে নাকি?’
‘হুম!’
‘ও তোমার বাপের ভিটেতে গেল কবে?’
‘তাই তো বললে।’
‘এখন তো ও আর ভিক্ষে করে না। ভিক্ষে করা ছেড়ে দিয়েছে।’
‘তাইলে?’
‘এখন দেশ-গাঁতেই থাকে। মাধানির হয়ে ঘুরে ঘুরে গেরস্ত বাড়ি থেকে লাউ-কুমড়ো-সিম-শাক-ডিম কেনে। মাধানি ওকে কমিশন দেয়। ও এখন মাধানির আসিসান্ট!’
‘বলো কী!’
‘সেদিন ওর পাড়ায় গিয়ে আমি এইসবই দেখে এলুম।
‘কীরকম?’
‘ঘরে ফুলুরি নেই। দুয়ারে ডাঁই করে রাখা লাউ। ওর পাড়ার লোক বলে, ও এখন লাউয়ের কারবারি। এ একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে জানো দিদি।’
‘ভালো কেন?’
‘আমার ছেলে চাঁদ বলছিল, ফুলুরির জন্যে আমাদের গাঁয়ের নাম খারাপ হয়। ও তো দোকানে দোকানে বাতাসা দিতে যায়, আর ফুলুরি দোকানে-দোকানেই ভিখ মাগে। দোকানিরাই বলে, তোমাদের গাঁয়ে একজন ভিখারি আছে না? সে আসে। কেউ বলে, এই তো খানিক আগে ফুলুরি এসে দু’টাকা আদায় করে নিয়ে গেল। এমনি নচ্ছার, দু মিনিট দাঁড়াবেনে। খদ্দের না ছেড়ে ওকে আগে ছাড়তে হবে—এমনি নানাকথা শোনায় চাঁদকে।’
‘মাটিটা? আমার বাপের ভিটের নয় বলছ?’
দূর দূর! ক’টেকা নিল তোমার থেকে?’
‘হুম!’
‘ওর চক্করে পড়ুনি দিদি, তোমাকে একদম খৈ-খল্লা করে ছেড়ে দেবে, এই কয়ে দি!’
চাঁদের মা মুখে আর দুটি পান পুরে চলে গেল কাঁড়ার পাড়ার দিকে।
নিজের বিছানায় বসে ঝিমুনি এসেছিল হৈমর। মনে হল বড়দাদা যেন কাছটিতে এসে দাঁড়িয়েছে। বলছে, সূর্য যে অক্ষাংশ রেখায় লম্বাভাবে আলোকপাত করে সেই ২৩ ডিগ্রি ২৬ মিনিট ২২ সেকেন্ড অক্ষাংশ রেখাই হল কর্কটক্রান্তি রেখা। তা প্রতি বছর আধ সেকেন্ড করে কমে আসছে। পৃথিবী কক্ষতলের উপর লম্বভাবে থাকার বদলে একটু হেলে থাকে। তাই রেখা সরে যায়।
তবে উপায় কি দাদা?
সেই তো ভাবি রে হৈম! আমাদের সময় বলে কিছুই কি থাকবে না?
পরেরদিন হৈম বৌমাদেরকে ডাকে। রুমালে বাঁধা একমুঠো মাটি তাদের হাতে তুলে দিয়ে বলে, ঠাকুরের সিংহাসনে এটি রেখে দাও বৌমারা।
‘কি আছে মা এতে?’
‘মাটি।’
‘কোথাকার মাটি?’
‘আমার বাপের বাড়ির পাশে যে বড় শিব মন্দিরটি আছে, সেখানের।’