বিন্তির মোবাইলে জিও বা এয়ারটেল কোনও টাওয়ারই ধরছে না। ওয়াইফাই নেই তাই ল্যাপটপও অকেজো। আদ্যিকালের টিভি একটা আছে কিন্তু দু’একটা বাংলা চ্যানেল ছাড়া কিছুই আসে না। সে বিরক্ত হলো। বিল্টুরও বিশেষ সুবিধার লাগছে না জায়গাটা। কিন্তু সে ছটফটে, ডানপিটে ছেলে। ইতিমধ্যেই একটা বেড়ালছানা আবিষ্কার করে দূর থেকে তাকে দেখে সময় কাটাচ্ছে। ভীষণই ক্লান্ত লাগছে বিন্তির। ফ্লাইটে দিল্লি থেকে দুর্গাপুরে, সেখান থেকে এই হরেকৃষ্ণপুর।
বিল্টু এরকম সকাল কক্ষনো দেখেনি। জ্ঞানাবধি ঘুমচোখে স্কুলে যাবার তাড়া খাওয়া তার অভ্যেস। আজ এই অদ্ভুত পাখিডাকা ভোর তাকে মুগ্ধ করে দিল। যে ঘরটায় রাতে শুয়েছিল তার ঠিক পাশেই একটা জামগাছ। তাড়াতাড়ি শুয়েছিল বলে ভোররাতে ঘুম ভেঙ্গে গেছিল। আর ভাঙ্গবে নাই বা কেন? পাখিদের এত ডাকাডাকি সে কোনদিন শোনেনি। তাদের নয়ডার ফ্ল্যাট সাততলায়। চারদিকেই ফ্ল্যাট। আকাশ – পাখি কিছুই তেমনভাবে দেখা যায় না। পাশ ফিরে দেখে ওদিকের খাটে মা আর দিদি ঘুমোচ্ছে। জানলার কাছে গিয়ে বাইরে উঁকি মারল। ওমা কী নরম হাল্কা নীল আলো, আকাশে একটা তারা তখনও জ্বলজ্বল করছে। কালকের মনখারাপটা একটু কমে গেল। নাঃ, খুব একটা খারাপ নয় জায়গাটা।
এ বাড়িতে বাড়ির লোক মাত্র দুটি। কাকাদাদু আর পিসিঠাম্মা। সঙ্গে একগাদা দেখাশোনা করার লোকজন। তারা এ বাড়িতেই থাকে। ফলে বাড়ি সবসময় সরগরম। পিসিঠাম্মা গল্পের ঝুড়ি। কবে বাবাই খেলতে গিয়ে থুতনি ফাটিয়ে ফেলেছিল, কীভাবে একবার পায়ের আঙুল দুখানা করে ফেলেছিল আর বাবাইয়ের ঠাম্মা কেমন কাপড় পুড়িয়ে সেই আঙুল বেঁধে দিয়েছিল, কবে চোর এসে উপরতলায় আটকে পড়েছিল এইসব নানা গল্প। বিল্টু খানিক শোনে, কিন্তু গল্প শুনে আর কতক্ষণ কাটানো যায়। বাড়িটার পেছন দিকে বেশ বড় ফলের বাগান। ছোট একটা ডোবামতন আছে। কিন্তু মায়ের কড়া হুকুম কোনভাবেই বাবাইয়ের সঙ্গে ছাড়া ওখানে যাওয়া যাবে না। সে সেভেন থেকে এইটে উঠেছে, মোটেই ছোট নয়।
ঝুমা আপ্রাণ চেষ্টা করছে সবকিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিতে কিন্তু অনভ্যাসে মাঝে মাঝে অস্বস্তি লাগছে। বাড়িভর্তি এ্যাতো লোক! কেউ রান্না করছে, কেউ ঝাঁট দিচ্ছে, ঘরদোর আসবাবপত্র পরিষ্কারের জন্যও লোক আছে। পিসিমা রান্নার লোকেদের নানারকম নির্দেশ দিচ্ছেন। সুপ্রভাত কী কী ভালোবাসে, কাকামণি কী কী ভালোবাসেন, তাঁর নিজের নাতি-নাতনিদের কী খাওয়াতে ইচ্ছা করে সবই ব্যবস্থা হচ্ছে। ঝুমা মুখ ফুটে বলতে পারছে না এসব আসলে তার ছেলেমেয়েরা খেতে অভ্যস্ত নয়। আর সুপ্রভাতের এই ঘিয়ের লুচি খাওয়া উচিত নয়। তার মাঝে মাঝে দিশেহারা লাগছে। সব থেকে সমস্যা করছে তার মেয়ে বিন্তি, সে গাড়ি থেকে নামা ইস্তক জায়গাটাকে অপছন্দ করে ফেলেছে। মোবাইলের টাওয়ার খুব দুর্বল ফলে অবেলা অবধি ঘুমিয়ে আর ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে সময় কাটাচ্ছে।
সকাল গড়িয়ে দুপুর। আস্তে আস্তে নিঝুম হয় সেই দুপুর। বাড়ি এখন একটু চুপচাপ হয়ে গেছে। মুনিষ-কামিনরা চলে গেছে। রান্নাঘরে শিকল পড়ে গেছে। বাড়ির লোকেরাও গড়িয়ে নিচ্ছে। বিল্টু পড়েছে মুশকিলে। তার ঘুম আসছে না। সে করে কী? গুটি-গুটি পা বাড়ায় বাড়ির উঠোনে। উঠোন বেশ বড়। উঠোনের শেষে দুটি কাঁঠালগাছ গলা জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে। দিনে যেমন ছায়া দেয় রাতে বেশ একট রহস্য তৈরি করে রাখে। গাছদুটি পেরিয়ে একটা সিমেন্ট বাঁধানো চত্বর। সেখানে ধান ঝাড়াইয়ের ব্যবস্থা। তারও পরে একটা সরু লম্বাটে ঘর এবং সেটার মাথায় আরও একটি ঘর। কেমন অদ্ভুত, বেমানান। কিন্তু ঐ বেমানান দোতলাটা তাকে টানতে থাকে।
বিল্টু পায়ে পায়ে দোতলায় ওঠে। দরজায় শিকল, শিকলে মরচে পড়া তালা। বিল্টু তালাটা ধরে টানতেই দেখে তালাটা খুলে চলে এসেছে। চুপিসাড়ে ভিতরে ঢুকে দেখে নানারকম ভাঙ্গা জিনিসে ভর্তি, কিন্তু বেশ গুছিয়ে রাখা। লাল একটা সাইকেল – সিটের কাছটা তুবড়ে গেছে, একটা প্যাডেলও ভাঙ্গা। পাশে রং চটা রকিং চেয়ার। একটা ট্রাঙ্কও রয়েছে একধারে। এসব পেরিয়ে সে জানলাটার কাছে পৌঁছয়। শিকল দিয়ে আটকানো। শিকল খুলে ঠেলতেই ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ করে খুলে গেল সেটা আর ঘরটা আলোয় ভরে গেল। বাইরে তাকিয়ে একটা বড় মাঠ দেখতে পেল বিল্টু। মাঠে একটামাত্র ছেলে একা একা একটা বটগাছে বসে দোল খাচ্ছে, লাফিয়ে মাটিতে নামছে, আবার তরতর করে বটের ঝুরি বেয়ে উঠে দোল খাচ্ছে। বিল্টু ডানপিটে ছেলে, ভাবুক নয় মোটেই। কিন্তু ওই আলো আলো মাঠে ঐ ছেলেটার একা একা গাছে দোল খাওয়ার ছবিটা তাকে মুগ্ধ করে দিল।
ছেলেটা দোল খাওয়া ছেড়ে হঠাৎ ঝুরি বেয়ে উঠে লাফিয়ে মাটিতে নামল, আবার উঠল আবার লাফিয়ে নামল। তারপর কী মনে করে তাদের বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল। সে নিজের মনে হাঁটছে, বিল্টুর দিকে সে একবারও তাকায়নি, কিন্তু বিল্টু একমনে ওকেই দেখছে। ছেলেটা আর একটু কাছে আসতেই বিল্টু “হাই, হ্যালো…ও” বলেই খেয়াল করল সে হরেকৃষ্ণপুরে আছে। তখন জোরে “এই ছেলেটা” বলে চিৎকার করে ডাকল। ছেলেটা চমকে চোখ তুলে তাকাল। চকচকে কালো চাবুকের মত সটান চেহারা, চোখে কৌতূহল।
“কী নাম রে তোর”?
“আমি রূপ।” চেহারার সঙ্গে নামটি যে নেহাতই বেমানান তা রূপ ভালোই জানে। তাই একনিশ্বাসে যোগ করে, “মা দিয়েছে বটে।” বিল্টুর খুব ভালো লেগে যায় ছেলেটাকে।
“দাঁড়া আসছি,” একদৌড়ে নীচে নেমে ওর কাছে পৌঁছয়।
“আমি বিল্টু।” কথা বলতে পেরে বাঁচল। সারাদিন আর কাঁহাতক বড়দের সঙ্গে থাকা যায়।
“তুই কী করে ঐভাবে দোল খাচ্ছিলি রে?”
ফিক করে হেসে ফেলল রূপ, “তা জানি নাইকো। এখানে সব্বাই করে, তুমি লারবে।” বিল্টুর প্রেস্টিজে লাগে। সে স্কুলের ক্রিকেট টিমের রেগুলার প্লেয়ার, ভালো টেবিল টেনিসও খেলে। কিন্তু এটাও সত্যি সে ঐভাবে বটের ঝুরি ধরে দোল খেতে পারবে না।
প্রথম আলাপের জড়তা কাটতে যেটুকু সময় লাগে। নানাকথা হতে থাকে তারপর - যা কিনা শুধু দুজন কিশোরের মধ্যেই হতে পারে। কীভাবে গঙ্গাফড়িং ধরতে হয়, পিঁপড়ের ডিম মাছের ভালো খাবার। মাছ ধরতে গেলে যে টোপ দেয় তাকে বলে ‘চার’। রূপ বঁড়শি দিয়েও চমৎকার মাছ ধরতে পারে। ঘুড়ি ওড়াতে তার সবথেকে ভালো লাগে। নিজের হাতে মাঞ্জা বানায়। সবার ঘুড়ি কেটে ফেলে চটপট।
বিল্টুও গল্পের ঝাঁপি খোলে। স্কুলে তার প্রিয়বন্ধু নীল। সে দাবা খেলায় স্কুল চ্যাম্পিয়ন। নীল খুব ভালো অঙ্ক করে। বিল্টু ভিডিও গেমস খেলায় পটু। তাদের নয়ডার ফ্ল্যাটে বিশাল একটা এ্যাকোয়ারিয়াম আছে। তাতে লাল-নীল-কমলা নানারঙের মাছ আছে। সে সাঁতারও শেখে। গল্প করতে করতে বাড়ির পেছনে চলে এসেছে ওরা। দিনের আলোটূকু মরে আসছে। বিল্টুর মনে পড়ে যায় মা এদিকে আসতে বারণ করেছে, আর সে অনেকক্ষণ বাইরে আছে। মা নিশ্চয়ই খুঁজছে। তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।
রূপের সঙ্গে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে বিল্টুর। শুধু তার একটাই আপত্তি, রূপ কিছুতেই তাকে ‘তুই’ বলে না তুমি করে কথা বলে, যদিও বিল্টু ক্লাস এইট আর রূপ নাইন। বিল্টুর চোখে রূপ প্রায় টারজান বা স্পাইডারম্যানের কাছাকাছি। তড়বড় করে গাছে ওঠে, কোথায় পেয়ারা, কোথায় নারকোল কোথায় কদবেল পেকেছে সব ওর মুখস্থ। সে কোনদিন কয়েৎবেল খায়নি শুনে রূপ তো থ। পরের দিনই দুটো কয়েৎবেল বাড়ির দালানে নামিয়ে দিয়েছিল। পিসিঠাম্মা যখন লেবুপাতা দিয়ে সেই কয়েৎবেল মেখে দিল তখন বিল্টু তো বিল্টু, তার নাক উঁচু দিদি বিন্তিও একেবারে ফ্ল্যাট।
গ্রামে একটাই পুজো। আড়ম্বর কম। একটা মাইক ছাড়া কিছু নেই। মানুষজন সকাল-সন্ধ্যে মণ্ডপে বসে নেই। ঐ পুজোই বিল্টু রূপের সঙ্গে রোজ দেখতে যেত। পিসিঠাম্মার সঙ্গে একদিন অঞ্জলিও দিয়ে এসেছে। সেইসঙ্গে একদিন ওদের বাড়িও ঘুরে এসেছে। আসলে এরকম অবাধ স্বাধীনতা সে কখনও পায়নি।
রূপের দাদা কৃষ্ণ খুব মেধাবী ছাত্র। বছর পাঁচেক আগে ওদের বাবা সাপের কামড়ে মারা গেছে। মা মুড়ি ভেজে, নাড়ু বানিয়ে, আচার করে লোকের বাড়ি বাড়ি দেয়। দুটো ছেলেই কোন-না-কোন কাজ করে। কৃষ্ণ ক্লাস ফাইভ থেকে এইটের ছেলেদের পড়া তৈরি করতে সাহায্য করে। এইভাবে সে কিছু পয়সা পায়। রূপের পড়াশোনা ভালো লাগে না, সে কারোর বাড়ির নারকোল পেড়ে দেয়, কারোর বাগান পরিষ্কার করে দেয়। কিন্তু বিনা পরিশ্রমে কিচ্ছু নেয় না। এক বুড়ি ঠাকমাও থাকে ওদের সঙ্গে। চারজনে জড়িয়ে-মড়িয়ে ভালোবাসায় ভর করে দিন কাটায়।
সাবেকি পালঙ্কের এক কোণে বসে কেমন যেন ঘোর লাগে বিল্টুর। তার বয়সে ছেলেরা যে পয়সার জন্য কাজ করে সেটা তার অজানা নয়। কিন্তু তাদের কাউকে এত কাছ থেকে দেখার সুযোগ তার হয়নি। আর সেই ছেলেটা এক্কেবারে তারই মত। বিরাট কোহলির ফ্যান, রোনাল্ডো না নেইমার না মেসি তাই নিয়ে লড়ে অথচ এখন আর ওর খেলা দেখার সুযোগ হয় না। আগে পরিচিত যেকোন বাড়িতে গিয়ে খেলা দেখত কিন্তু অতিমারির পর থেকে তাও বন্ধ। একটা স্মার্টফোনের অভাবে ওর দাদার পড়াশোনার অসুবিধা হয়, মাঝেমাঝেই আজকাল অনলাইন ক্লাস হয় যে। টেন পর্যন্ত বইখাতা স্কুল থেকে দিত এখন তাও নিজেদের কিনতে হয়।
এভাবে কথাগুলো রূপ বিল্টুকে বলেনি। একটা-আধটা কথার ফাঁকে ফাঁকে একটু একটু করে বেরিয়ে এসেছে। আর বিল্টুও কিছু বড় মানুষ নয়, তবুও কেমন করে যেন এই পার্থক্য তার মনে দাগ কেটেছে। একবার ভাবে বিন্তিকে বলবে এই কথাগুলো, তার ভেতরে একটা মনখারাপ তৈরি হয়েছে যা দিদিকে বললে তার ভালো লাগত কিন্তু দিদি যদি বিল্টুর কথা নিয়ে মজা করে!
ভাবনার সুতো ছেঁড়ে রূপের ডাকে। নীচে থেকে ডাকছে তাকে। কাছে যেতেই হাত ধরে নিয়ে যায় পিছনের বাগানে। পকেট থেকে বার করে তার হাতে একটা রোল করা কাগজ আর একটা মাটির গণেশ দেয়। মুখে কিছু বলে না কিন্তু ওর চোখদুটো খুশিতে চকচকে। উপহারদুটো হাত পেতে নিয়ে মুগ্ধ হয়ে যায় বিল্টু। কৃষ্ণদাদা তার এত সুন্দর ছবি এঁকে দিয়েছে। সে তো মাত্র একটুক্ষণ ছিল ওদের বাড়িতে। রূপ একটা খুব চমৎকার গণেশঠাকুর বানিয়ে দিয়েছে তাকে। মূর্তি সে চমৎকার গড়তে পারে। মাটি দিয়ে নিজের হাতে গত ক’দিন ধরে সে বানিয়েছে বিল্টুর জন্য। কথাটা বলবার সময় তার মুখের লাজুক হাসি বিল্টুকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। সে কী দেবে? আবেগ তার গলার কাছে দলা পাকিয়ে গেছে। পকেট থেকে প্রায় নতুন স্মার্টফোনটা বার করে। সায়েন্স অলিম্পিয়াডে স্কুল টপার হয়েছে বলে মা তাকে দিয়েছে। সে খুব খুশি হয়েছিল গিফটটা পেয়ে। আজ তার কিছু মনে থাকল না। রূপকে কিছু দিতে সে মরিয়া। কাল ভোরেই তাদের যাওয়া। সূর্য ডোবার মুহূর্তে সে রূপের হাতে গুঁজে দেয় ফোনটা। দূরে একটা পাখি ডেকে ওঠে।
ফোনটা হাতে নিয়ে রূপ হতবাক। “ইটা কী করছ? মায়ের দেওয়া উপহার দিতে নাই। জ্যাঠাবাবু বকবেক।”
“তোকে ভাবতে হবে না। আমি বাবাইকে বুঝিয়ে বলব। আমাকে ফোন করবি রোজ।”
“না বিল্টু এত দামি জিনিষ দেখলে লোকে আমাকে চোর ভাববেক।”
“আমার জিনিষ আমি দিচ্ছি, কেউ কিচ্ছু বলবে না। প্লিজ রেখে দে রূপ, এটা দিয়েই তোর সঙ্গে আমার যোগাযোগ থাকবে। মাঝে মাঝে ভিডিও কল করব আমি।” কৈশোরের আবেগ যুক্তি বোঝে না। রূপের বাস্তববুদ্ধি তার নেই। সে রূপকে বাধ্য করে ফোনটা নিতে।
হেমন্তের মায়াবী ভোর। ছুটি শেষ আর ঘরে ফেরার পালা। ভাড়াগাড়ি তাদের নিয়ে কুয়াশার মধ্যেই রওনা দিয়েছে। সুপ্রভাত এবার জোর করেই পুজোর ছুটিটা এখানে কাটাতে এসেছিলেন। তাঁর ছোটবেলাটা, দেশের বাড়ি আর একান্ত আপনজনদের সান্নিধ্য ছেলেমেয়েদের মুঠোভরে দিতে চেয়েছেন। তিনি মনে করেন বেঁচে থাকার জন্য বন্ধন প্রয়োজন – অতীতের সঙ্গে বর্তমানের, মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ জীবনকে উপভোগ করার চাবিকাঠি। তাঁর আবেগপ্রবণ ছেলেটা খুব আনন্দ পেয়েছে। বিন্তির ততটা ভালো লাগেনি। তিনি বুঝেছেন কিন্তু আমল দেননি। গাড়ির দুলুনিতে দুজনেই ঘুমিয়ে পড়েছে। এয়ারপোর্ট পৌঁছতে আর দেরি নেই।
নিজেদের ফ্ল্যাটে ঢুকতেই মনখারাপটা বিল্টুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। গত কদিন এরকম সময়ে পিসিঠাম্মা নানারকম গল্প বলত আর তার সঙ্গে কোনদিন ডালবড়া, কোনদিন মুড়ি-বেগুনি তো কোনদিন মুড়ি-নারকোল খাওয়া হত। রোজই গ্রামের কেউ না কেউ আসত। আজ অষ্টমী তো কাল দশমী। নাহলে লক্ষ্মীপুজো, কিছু না কিছু লেগেই আছে। সারাক্ষণ বাড়িতে লোক গমগম করছে। পড়া নেই, সাঁতার নেই। কম্পিউটার ক্লাস নেই। আর এই ফ্ল্যাটটায় ঢুকলেই নিয়মকানুনগুলো দুটো বড় বড় দাঁত আর এবড়োখেবড়ো শিং বাগিয়ে তেড়ে আসছে। চুপচাপ নিজের ঘরে ঢুকে যায় সে, বুকের মধ্যে একটা আতঙ্কও আছে। সে যে ফোনটা রূপকে দিয়ে এসেছে, বাবাইকে বা মাকে বলা হয়নি এখনও। এখন মনে হচ্ছে মা যদি বকে?
বেশ খানিকক্ষণ সন্ধ্যে হয়েছে। মা খাবার দিয়েছে টেবিলে। পায়ে পায়ে গিয়ে দেখে বাবাই চায়ে চুমুক দিচ্ছে আর দিদি ঘুম ঘুম চোখে নিপুণভাবে ম্যাগি খাচ্ছে। সেও খুব ভালোবাসে ম্যাগি। খাওয়া চলছে, বাবাই হঠাৎ বলল, “বিল্টু, তোমার একটা জিনিষ আমার কাছে আছে।” পকেট থেকে তার ফোনটা টেবিলে রাখল বাবাই। নিমেষে বিল্টু বিবর্ণ। চোখ তুলে কারোর দিকে তাকাতে পারছে না।
মায়ের হাত তার কাঁধে, “ভয় পাচ্ছিস কেন বিল্টু? তুই কিচ্ছু ভুল করিসনি। উপহার দেবার বা পাবার থেকে বড় আনন্দ আর কিছু নেই। তবে আমাদের জানিয়ে দিলে ভালো হত। কিন্তু রূপ খুব বুদ্ধিমান। তোর বাবাইয়ের সঙ্গে দেখা করে ফোনটা দিয়ে গেছে।”
“আর তোর জন্য একটা চিঠি।” বাবাইয়ের বাড়ানো হাত থেকে চিঠিটা নিতে নিতে বুকটা মুচড়ে উঠল। রূপের সঙ্গে যোগাযোগ শেষ।
“তোর মনখারাপের কিছু নেই, আমি কাকাদাদুকে বলে এসেছি আজই ওকে একটা স্মার্টফোন কিনে দেবার জন্য। তোর নম্বরও ওকে দিয়ে দেবে। কিন্তু চিঠিটা ওর মনটাকে চিনিয়ে দিয়েছে।”
একজোড়া বিবশ হাত চিঠিটা খোলে--
“ভাই বিল্টু,বিল্টুর ভীষণ কান্না পাচ্ছে। দুঃখে বা ভয়ে নয়, ভালোবাসায়।
ফোনটা ফেরত দিলাম বলে রাগ কোর না। একে তো এত দামি ফোন, দেখলে সবাই আমায় চোর ভাববে। তার ওপর এটা জ্যেঠিমা তোমায় উপহার দিয়েছেন। তাঁর দেওয়া উপহার তোমার কাছ থেকে নিয়ে নিতে মন চাইল না। দাদাও বলেছে ফোন ছাড়াও ও ভালো রেজাল্ট করবে, অন্তত তোমার জন্যই করবে। তোমার ঠিকানা আমি জ্যাঠাবাবুর কাছ থেকে লিখে নিলাম। চিঠি লিখব, তুমিও উত্তর দিও। তাহলে আর যোগাযোগের অসুবিধা থাকবে না। আর আমি ঠিক জানি তুমি আবার আসবে। আবার ঘুরব, গল্প করব, ঘুড়ি ওড়াব। ভালো থেকো।
রূপ