• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯১ | জুলাই ২০২৩ | গ্রন্থ-সমালোচনা
    Share
  • এক ক্রীতদাসীর কথা : প্রদীপ রায়গুপ্ত

    হাজার টাকার বউ — অদিতি সরকার; অন্তরীপ, কলকাতা; প্রচ্ছদ--তমোজিৎ ভট্টাচার্য; প্রথম প্রকাশ- ডিসেম্বর ২০২১, ISBN: 978-81-955563-0-4

    ক্রাউন সাইজের পাতলা চেহারার হার্ডকভার বই অদিতি সরকারের 'হাজার টাকার বউ'। মূল উপন্যাসের আয়তন ১০৬ পৃষ্ঠা; সামনে ও পিছনে মুখবন্ধ, তথ্যপঞ্জি, শব্দার্থ-তালিকা ও পরিশিষ্ট মিলিয়ে অবয়ব দাঁড়িয়েছে ১২৮ পৃষ্ঠার। এটি একটি বিষয়ভিত্তিক উপন্যাস। বিষয়টি সাধারণ বাঙালিজীবনের অভিজ্ঞতায় সুলভ নয়। শহুরে পরিবেশে প্রেম সংগ্ৰাম স্বপ্নভঙ্গ তথা মানবসম্পর্কের জটিলতায় জারিত যে-সব গল্প-উপন্যাস সচরাচর আমাদের হাতে আসে এ-উপন্যাসের বিষয় তা থেকে একেবারেই আলাদা, এ যেন অন্য এক অচেনা পৃথিবীর গল্প। সেই পৃথিবীর টুকরো খবর মাঝে মাঝে একটু-আধটু হয়তো আমরা পাই, কিন্তু দূরবর্তী বলেই হয়তো তার অভিঘাত খুব তীব্রভাবে আমাদের স্পর্শ করে না। বিষয়টি হল নারী-পাচার ও পাচার-হওয়া সেই হতভাগ্য মেয়েদের ক্রীতদাসত্ব, যার ভেতরে যৌনদাসত্বও আছে। মেয়ের বিয়েতে বিপুল দহেজ বা যৌতুক দিতে হবে বলে হরিয়ানা ও রাজস্থানের সাধারণ জাঠ সম্প্রদায়ের পরিবারগুলিতে কন্যাসন্তান জন্মাতে দেওয়া হয় না। ভ্রূণাবস্থাতেই হত্যা করা হয় তাদের, কিংবা জন্মের পর দুধের গামলায় চুবিয়ে মারা হয়। কিন্তু মেয়ে ছাড়া সংসারযাত্রাও তো চলে না । ঘরগৃহস্থালির কাজ, গোরুবাছুর দেখাশোনার কাজ, এমনকি খেতিজমির কাজ এসব তো মুখ্যত করে মেয়েরাই। এ-ছাড়া আছে পুরুষদের শরীরক্ষুধার নির্বাপণ। তাই চোদ্দো পনেরো ষোলো সতেরো বছরের মেয়েদের দালাল-মারফত কিনে আনে এই জাঠেরা।

    কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে এরকম একটি মেয়ে-চরিত্র নির্মাণ করেছেন অদিতি। তার নাম লীলারানি দাস। লীলার নিষ্করুণ জীবননাট্যের বর্ণনা দিতে দিতে এরকম আরও দু-চারজন মেয়ের ইতিহাসও শুনিয়েছেন তিনি। এই মেয়েরা মূলত পূর্ব-ভারতের বিহার ঝাড়খণ্ড ওড়িশা পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম থেকে পাচার হয়ে আসে হরিয়ানা ও রাজস্থানে। অভাবের সংসারে অনেক ক্ষেত্রে মা-বাবাই কিশোরী মেয়েকে বিক্রি করে দেয়, অনেক ক্ষেত্রে মামা বা কাকা বা গ্ৰামসম্পর্কের দাদাটাদা কেউ ভুলিয়েভালিয়ে কাজের বা বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে মেয়েটাকে তুলে দেয় দালালের হাতে। মেয়েটা জানতেও পারে না সে ভয়ংকর এক প্রতারণার শিকার হচ্ছে। যখন বুঝতে পারে তখন আর কিছু করার থাকে না, ফেরার সব পথ তখন বন্ধ হয়ে গেছে। এসব কথা লেখিকা পাঠকদের জানিয়েছেন উপন্যাস শুরু করার আগে পাঁচ পৃষ্ঠার এক মুখবন্ধ লিখে। জানিয়েছেন যমুনার অপর পার থেকে এসেছে বলে এসব মেয়েদের স্থানীয় ভাষায় 'পারো' বলা হয়, দাম দিয়ে কেনা হয়েছে বলে বলা হয় 'মোলকি', যা 'মোল কী দুলহন'-এর অপভ্রংশ। এদের সঙ্গে কখনও কখনও ক্রেতা পুরুষের নামমাত্র বিবাহ হয়, কখনও সেসব কিছু হয় না। বিবাহ হোক বা না হোক, গৃহশ্রম ও কৃষিশ্রমে ক্লান্ত শরীর নিয়েই তথাকথিত স্বামী বা মালিকের দেহক্ষুধাও মেটাতে হয় এইসব মেয়েকে। পরিবারের অন্য পুরুষদেরও তাকে ভোগ করার সামাজিক সম্মতি থাকে, সেই অন্য পুরুষ সম্পর্কে হতে পারে তার শ্বশুর, দেবর বা সতিনপুত্রও। স্বামী বা মালিকের সম্পত্তিতে পারো মেয়েদের কোনও দাবি থাকে না। মালিক-পুরুষটি মারা গেলে পারো মেয়েকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়, যৌবন থাকলে আবার বিক্রিও করে দেওয়া হতে পারে। আমার মনে হয়েছে এই উপক্রমণিকাটির তেমন প্রয়োজন ছিল না। বইটি পড়ে কেউ যদি সমস্যাটা ধরতে না পারেন তবে তিনি পাঠকই নন। এই উপক্রমণিকাটি বরং পাঠকের মনে ঔৎসুক্যের কোনও জায়গা রাখে না, পাঠক বুঝে যান লেখিকার প্রতিপাদ্য কী, এবং এও বুঝে যান যে সেই প্রতিপাদ্যের দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি এবার একটি মানানসই গল্প শোনাবেন।

    অন্তরীপ পত্রিকার শারদীয় ১৪২৮ সংখ্যায় উপন্যাসটি ছাপা হয়েছিল, দু-মাস বাদে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে অন্তরীপ পাবলিকেশন থেকে বই হয়ে বেরোয়। দেড় বছর হয়ে গেছে, এখন কাহিনি নিয়ে সংক্ষেপে দু-চার কথা বলা যায়। লীলারানি দাস দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার হেঁতালবেড়িয়া গ্ৰামের এক বালিকা। তার জন্মের সাতদিনের মাথায় তার মা মারা যায়, আর তার বাপ গোলোক দাস মেয়েকে অপয়া ঠাউরে বরাবরের মতো শালা নিরঞ্জন মণ্ডলের ঘাড়ে ফেলে উধাও হয়ে যায়। দিদিমা যতদিন ছিল নিঃসন্তান মামা-মামির গঞ্জনা-লাঞ্ছনা থেকে লীলার খানিকটা পরিত্রাণ জুটত। বুড়ি মারা যাবার পর অত্যাচার চরমে ওঠে। গ্ৰামের স্কুল থেকে ছাড়িয়ে এনে মামা-মামি তাকে সংসারের ঘানিতে জুতে দিল। তার সঙ্গে জুটল মামার অতিসামান্য মুদি-দোকান সামলানোর কাজ। তাকে দোকানে রেখে মামা মাল আনতে যায়। সবকিছুতেই মামা-মামির শাপশাপান্ত, অবহেলা। পনেরো বছরের লীলার দেহে যৌবন কুঁড়ি মেলছে, গ্ৰামের ছেলেরা-বুড়োরা বয়স-নির্বিশেষে হাঁ করে তাকিয়ে দেখছে তার দিকে, সেটাও যেন তারই অপরাধ।

    লীলা এই অসহনীয় পরিবেশ থেকে পালাতে চায়, কিন্তু কোথায় যাবে সে! গ্ৰামের বাইরে সে কাউকে চেনে না। এই সময়ে লীলার সানি নামে এক প্রেমিক জোটে। ভালো চেহারা, কথাবার্তাও ভালো। মামার অনুপস্থিতিতে সে দোকানে এসে লীলাকে অনুরাগের কথা বলে, অন্তরঙ্গ হবার চেষ্টা করে। লীলা স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। সংসারের, সন্তানের। কিন্তু প্রেমিকের প্রতারণার জালে ফেঁসে সে পাচার হয়ে যায় সুদূর হরিয়ানার এক গ্ৰামে। জানতে পারে পঁচিশ হাজার টাকায় তার মামা তাকে বেচে দিয়েছে সানির কাছে। হাতবদল করবার আগে সানি ও তার দুজন সঙ্গী মিলে লীলাকে ধর্ষণ করে। কিছুদিন হরিয়ানায় ও কিছুদিন রাজস্থানে দুই প্রৌঢ়ের সংসারে মোষের মতো খেটে ও বারবার ধর্ষিতা হয়ে তৃতীয়বারে সে এসে পড়ে সুখবীরের হাতে।

    উপন্যাসের যবনিকা উঠেছে সুখবীরের বাড়িতেই। সদ্য-বিপত্নীক সুখবীরের বয়স চল্লিশের মতো, সে ধনী ব্যবসাদার বলরাম সিং-এর একখানা ট্রাক চালায়। নিষ্ঠুর, অমানুষ। সুখবীর বিয়ে করেনি লীলাকে। কিন্তু গৃহশ্রম ও কৃষিশ্রমের পর যৌনশ্রমও দিতে হয় লীলাকে, এবং সেটা একা সুখবীরকে নয়, মাঝে মাঝে তার দু-চারজন ইয়ারদোস্তকেও, যাদের সঙ্গে সুখবীর ঘরে মদের আসর বসায়। উপন্যাসের শুরু থেকে একটু উদ্ধৃতি দিই : “আরি-ই ও মরিলিয়া, ও বঙ্গালন। মর গই কে? চিল্লিয়ে-চিল্লিয়ে গলা ফেটে গেল, তবু কথা কানে যায় না হারামজাদি মোলকি?”

    ওড়নির ওপর দিয়ে খোঁপাশুদ্ধু চুল সজোরে মুঠো করে ধরেছে সুখবীর। হ্যাঁচকা টানে ঘাড় বেঁকে যায় লীলার। মাটিতে গড়িয়ে পড়তে-পড়তে গোবর-বিচালিতে মাখামাখি হাত আপনা থেকেই উঠে আসে নিজেকে বাঁচাতে। সত্যিই সে শুনতে পায়নি। ঘুঁটে দিতে-দিতে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। সুখবীর কখন ঘুম থেকে উঠেছে, কখন তাকে ডেকেছে কিছুই সে টের পায়নি। নিজের ঘোরেই মগন ছিল। এত বড়ো অপরাধের শাস্তি তো পেতেই হবে তাকে। কড়কড়ে তিরিশ হাজার টাকা মোল চুকিয়ে কিনেছে তাকে সুখবীর, এমনি-এমনি? সকাল-সকাল তাই পশুর মতো পড়ে-পড়ে মার খায় মোলকি লীলা। বিনা প্রতিবাদে, বিনা প্রতিরোধে। মাঝে-মাঝে শুধু গলা দিয়ে অস্পষ্ট গোঙানি। তাও নেহাত আটকাতে না-পারলে। এতদিনে সে বুঝে গেছে, কেঁদে মুক্তি পাওয়া যায় না। কোনও কিছু থেকেই। মারনেওয়ালা মজা পায় শুধু। জোরে কাঁদলে বরং মার আরও বেশি পড়ে।

    বেশ করে সবক শিখিয়ে লীলাকে ছাড়ে সুখবীর। কোমরে শেষ একটা লাথি মেরে। : “সুরজ ওই খেজড়ি গাছের উপরতক চড়ে এল, অভিতক না চায়ে, না নাশতা। শুয়ে-বসে আরাম করার জন্য এনেছি তোকে, সালি মালজাদি?”

    রাতের ব্যথা তো ছিলই, থাকেই। তার ওপর আবার এই নতুন ব্যথায় সারা শরীর টনটনায় লীলার। কিন্তু উপায় নেই... (পৃ. ১৫-১৬)

    এইভাবেই উপন্যাসে শুরু হয় লীলার কাহিনি। ট্রাক-চালক সুখবীর মাল আনা-নেওয়া করতে দূর-দূর শহরে যায়, ফলে মাঝে মাঝে গৃহে দীর্ঘদিনের জন্য সে অনুপস্থিত থাকে। তাতে একটু স্বস্তি লীলা পায় বটে, কিন্তু সুখবীরের বাপ বৃদ্ধ বুধনরামের খিদমতগারি করতে করতেও সে হাঁফিয়ে ওঠে। বুধনরামের নানা বায়নাক্কা, উঠতে বসতে গালিগালাজ, পুরুষত্বের তেজ এখন না থাকলেও লীলার শরীরের লজ্জাস্থানে আচমকা হাত দিতে তার অনাগ্ৰহ নেই। দু-বেলা দুটো রুটির জন্য সমস্ত কদর্যতা ও গ্লানি লীলা সহ্য করে, কারণ সহ্য না করে উপায় নেই। আশ্চর্যের কথা এই যে দিন ও রাতের অকথ্য লাঞ্ছনার পরেও প্রতিদিন ভোরে ঘুম ভেঙে উঠে লীলা আশা করে দিনটা আগের দিনের থেকে একটু ভালো কাটবে তার। কাটে না। গাঁয়ের পুরুষরা তো বটেই, জাঠ মহিলারাও পারো মেয়েদের ঘৃণা ও অবজ্ঞার চোখে দ্যাখে, গালিগালাজ ছাড়া কথা বলে না।

    এই বীভৎস অত্যাচারের‌ বর্ণনা চলেছে উপন্যাসের তিন-চতুর্থাংশ জুড়ে। এর মধ্যে আমরা দেখা পাই আরও দুই মোলকির। বিহার থেকে আসা কুসুমের ভাগ্য তুলনামূলকভাবে ভালো, তার একটা নাম-কা-ওয়াস্তে বিয়ে হয়েছে সরপঞ্চের ল্যাংড়া ছোটছেলের সঙ্গে, আর কারও সঙ্গে তাকে শুতেও হয়নি, গালিগালাজও কম খায়, তবু দৈহিক শ্রম থেকে তারও রেহাই নেই। সব পারো মেয়েদের মাথার দু-তিনটে ঘড়া পরপর চাপিয়ে তপ্ত বালি পেরিয়ে বহু দূরে যেতে হয় জল আনতে, ওই জল-আনার পথেই লীলা ও কুসুমের যা-কিছু সখীত্ব। অত্যাচারের বিরুদ্ধে কুসুম লীলাকে তাতাবার চেষ্টা করে, লীলা প্রভাবিত হয় না। আরেক মোলকি বাবলি এসেছিল আসামে চা-বাগান থেকে। ট্রাইবাল মেয়ে। বৃদ্ধ গনিরাম চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তার, একটা সতেরো-আঠারো বছরের ছেলেও আছে, তবু গনিরামের মৃত্যুর পর বাবলির জাঠ-সতিনের দুই ছেলে তাকে তাড়াতে চায়। বাবলিও মাথার ওপরে একটু ছাউনি আর দু-বেলা দুটো রুটির জন্য লড়াই করে টিকে থাকে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য যেতেই হয় তাকে, যেতে হয় চিরতরে। জয়রাম ও চরণজিৎ কেরোসিন ঢেলে তাকে বজরার খেতের পাশে পুড়িয়ে দেয়, প্রায় সকলের চোখের সামনেই। কেউ এগিয়ে আসে না, পুলিশে কোনও রিপোর্ট হয় না, জাঠ পুলিশ এ-ধরনের খুনকে অপরাধ বলে মনেও করে না। তারাও তো সমাজ-ব্যবস্থার অংশ। এই পারো-দাহ কাণ্ডটি ঘটে রামলীলা ময়দান থেকে সামান্য দূরে, যেখানে একটু আগেই পারোদের কল্যাণার্থে সভা করেছেন এনজিও-র সদস্যারা এবং তাঁরা তখনও ময়দান থেকে বিদায় নেননি। শুভৈষা সত্ত্বেও এই ধরনের কল্যাণকামী সংস্থার প্রয়াসগুলি যে কত ঠুনকো এবং ফলহীন তা লেখিকা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। জাঠ-সমাজের পুরুষতান্ত্রিক অচলায়তনের একটি ইটও তারা খসাতে পারে না।

    নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতার নিশ্ছিদ্র বিবরণ একনাগাড়ে পড়ে যাওয়া পাঠকের পক্ষে এক দমবন্ধ-করা পাঠ-অভিজ্ঞতা। পাঠকের মন হাঁফিয়ে ওঠে। স্বস্তি চায়। সেটা লেখিকাও জানেন। তাই উপন্যাসের শেষ এক-চতুর্থাংশে আমরা এক আশ্চর্য পালাবদল দেখি। যে-পর্বে বাবলির ভয়াবহ মৃত্যুর কথা বর্ণিত হয়েছে তার পরের পর্বেই আমরা লীলাকে সাতমাসের গর্ভবতী দেখি। ভারী শরীর নিয়ে সে উনোনের চারপাশে গোবর-মাটির প্রলেপ দিচ্ছে। না, সুখবীর বা তার কোনও অতিথির ধর্ষণজাত সন্তানকে পেটে ধরেনি লীলা। তার গর্ভে বড় হচ্ছে তার স্বামী মহিন্দরের সন্তান। স্বামী! লীলার স্বামী! পাঠক নড়ে-চড়ে বসে। অদিতি তখন সাত-আটমাসের পুরোনো ঘটনার বিবরণ দেন। জানা যায় দুর্ঘটনায় দূরে কোথাও মৃত্যু হয়েছিল ট্রাক-ড্রাইভার সুখবীরের। মালিক বলরাম সিং এসেছিল বুধনরামকে কিছু অর্থসাহায্য করতে। মালিক থাকে বিকানের শহরে, সেখান থেকেই ব্যবসা চালায়, তবে রামপুরায় তার খেতিজমি আছে, আছে হাভেলিও, সেখানে কিছু অনুগত কর্মচারী পরিবার নিয়ে থাকে। মালিকের কাছেই বুধনরাম লীলাকে কিনে নেবার প্রার্থনা জানায়। কী ভেবে কিনেও নেয় বলরাম সিং। রামপুরার হাভেলিতে নিয়ে গিয়ে তার বিশ্বস্ত কর্মচারী মহিন্দরের সঙ্গে বিয়ে দেয়।

    প্রথম তিন-চতুর্থাংশ জুড়ে আমরা কেবল মানবেতর চরিত্রের দেখা পাই। নিরঞ্জন মণ্ডল, তার খান্ডার বউ, সানি, সুখবীর, বুধনরাম, চরণজিৎ, জয়রাম। শেষ এক-চতুর্থাংশে যাদের দেখি তারা অমানবিক নয়। সুখবীর-মহিন্দরের মালিক বলরাম সিং-এর কথাই ধরা যাক। বলরাম সিং লোক যেমনই হোক, অন্তত হৃদয়ে কিছু মায়াদয়া তার আছে। তবে জাঠপুরুষদের মতো সেও পারো মেয়েদের অবজ্ঞার চোখেই দ্যাখে। বুধনরামের কাতর আবেদনে সাড়া দিয়ে সে যখন লীলাকে কেনে তখন মোলকি মেয়েটাকে অন্য কারও কাছে বেচে দেবার কথাই ভেবেছিল সে। কিন্তু পথের মধ্যে লীলা তার পায়ে পড়ে। সে আর কারও কাছে বিক্রীত হতে চায় না। মালিক যেন তাকে চরণে স্থান দেয়, দুটো রুটি দেয়, পরিবর্তে সে সব কাজ করে দেবে, এমন-কি ডাকলে বিছানাতেও যাবে। লীলার কথা শোনার পর বলরাম সিংহের প্রতিক্রিয়া কেমন হয় পাঠক দেখুন :

    “ওই লড়কি, ওই। চুপ কর, উঠ, উঠে দাঁড়া। নিজেকে কী ভাবিস তু, হাঁ? আমার দেখাশুনো করবি তুই? দো টকে কি পারো? সুন রে, সবাই জানে আমার বিস্তারা গরম করার জন্য বাহিরি লড়কি লাগে না, ঘরে বিবি আছে আমার খুবসুরত। তার ওপর নিজেরই নৌকরের জুঠা, তোকে তো ছুঁয়েও দেখবে না রে বলরাম সিংহ। খেতি করার ভি লোক আছে আমার, ঘরের কামকাজেরও। বেকার তোকে বসিয়ে খাওয়াব না কি? তিন-তিনটে পারো এমনিতেই পুষি আমি রামপুরাতে, আর দরকার নেই। বিক্রি না-করলে তোকে নিয়ে করব কী?”
    বলরাম সিংহ চৌধুরি একটা ঝটকা মেরে পা সরিয়ে নিতে চেষ্টা করে। (পৃ. ৯৮-৯৯)

    গোড়াতেই লেখিকা আভাস দিয়ে রেখেছিলেন। বলরাম সিং ঝানু ব্যবসায়ী। গরিব জাঠদের সে যেমন কাজে লাগায় তেমনি তাদের শরীরের জ্বালা জুড়োতে পারো মেয়ে জুটিয়ে এনে তাদের বিয়ে দিয়ে ঘরসংসারও বসিয়ে দেয়। নইলে তারা শহরের গণিকালয়ে যাবে, অসুখ-বিসুখ বাধিয়ে এলে বলরামেরই ঝামেলা বাড়বে। এসব সুখবীরের মুখেই শুনেছিল লীলা। বলরাম এই সমাজব্যবস্থার ঊর্ধ্বে নয় মোটেও, কিন্তু সুখবীর বা জয়রামের মতো ইতরও নয় সে। তার কর্মচারীদের মধ্যে মহিন্দরই অবিবাহিত ছিল, এই বিয়ে দিয়ে সে লীলার যেমন একটা হিল্লে করল তেমন তার ত্রিশ বছর বয়সী ম্যানেজার-কাম-কেয়ারটেকারেরও একটা বউ জুটিয়ে দিল, যাতে তার শরীর না অতৃপ্ত থাকে।

    লীলার শাশুড়ি বাসন্তী এবং স্বামী মহিন্দরের অবশ্য ভালো না হবার কারণ নেই। বাসন্তীও কিশোরীবেলায় দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার এক গ্ৰাম থেকে অপহৃতা হয়ে এখানে এসেছিল, তারপর মহিন্দরের বাপের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। সেও বঙ্গালন, মোলকি, লীলার মতো অতটা নির্যাতিত না হলেও পারো মেয়েদের কষ্ট সে বোঝে। ছেলের ঘাড়ে মালিকের জোর করে চাপানো পুত্রবধূ সম্পর্কে বাসন্তীর মনে প্রাথমিক বিরূপতা একটু ছিল, কিন্তু লীলার সেবাযত্নে অচিরেই সে তার প্রতি স্নেহার্দ্র হয়ে ওঠে। তার ছেলে মহিন্দর গোটা উপন্যাসে এক ব্যতিক্রমী চরিত্র। সে জাঠ বাপ ও বঙ্গালন পারো মায়ের সন্তান, পারো মেয়েদের সম্পর্কে তার তেমন ঘৃণা না-থাকবারই কথা। কিন্তু জাঠ পরিবেশে সে মানুষ হয়েছে, মাতাল বাপের প্রহারে মাকে পায়ের হাড় ভেঙে খোঁড়া হয়ে যেতে দেখেছে, শুনেছে চারপাশে অকথ্য গালিগালাজ, তবু লীলাকে কোনও কটুকথা শোনায় না সে, মারধর তো করেই না, এমন-কি হকের পাওনা যৌনসুখও জোর করে আদায় করে না। ভ্রূণের লিঙ্গনির্ণয় করতে গর্ভবতী স্ত্রীর পেটের ছবি করাতে রাজি নয় সে, যা কি না ওই সমাজের দস্তুর। কন্যাসন্তান জন্মালেও সে মেয়েকে সাদরে গ্ৰহণ করবে। 'লড়কা-লড়কি যা হয় উপরওয়ালার দান, বাছাই করার আমরা কে'... এমন দর্শন সে কোথা থেকে অর্জন করল কে জানে! নান্দনিকতার দাবিতেই হয়তো লীলার যন্ত্রণাময় ক্লিন্ন জীবনের কোনও এক পর্বে মহিন্দরের মতো ভালোমানুষই প্রাপণীয় হয়ে ওঠে। পাঠকেরও ইচ্ছাপূরণ ঘটে এভাবেই।

    বাস্তব অথচ বাঙালি সমাজের অজ্ঞাতপ্রায় একটি নিদারুণ সমস্যাকে জনগোচর করতে অদিতি দক্ষ ও সমর্থ হাতে একটি কাল্পনিক কাহিনি বুনেছেন এ-উপন্যাসে। একটি মেয়ের আশা-নিরাশা, অচিন্তনীয় ভাগ্যবিপর্যয়, অকথ্য নির্যাতন সত্ত্বেও শুধু দুটি রুটির জন্য বাঁচতে চাওয়ার দুর্মর আকাঙ্ক্ষাকে তিনি নির্মোহ সংবেদনশীলতায় স্থাপন করেছেন রুক্ষ ও শুষ্ক জাঠ-রাজস্থানের মরুভূমিতে, যেখানে প্রকৃতির মতো মানুষজনও অকরুণ। প্রকৃতির বর্ণনায়, স্থানীয় লোকজনের আচার-আচরণে এবং ভাষাব্যবহারে তিনি বিশ্বাসযোগ্য একটি আবহ তৈরি করতে পেরেছেন। তবে ভাষাব্যবহার নিয়ে আমার দু-এক কথা বলার আছে। অদিতি উপন্যাস লিখেছেন বাঙালি পাঠকদের জন্য। রাজস্থানের জাঠরা বাংলা ভাষায় কথা বলে না ঠিকই, কিন্তু তাদের সংলাপে খাঁটি জাঠ-রাজস্থানি (তার কোনও আলাদা নামও থাকতে পারে যা আমি জানি না) বুলি বসালে তা আবার বাঙালি পাঠকের বোধগম্য হবে না। আবহ-রচনার প্রয়োজনে তাই তাদের মুখে বাংলা ও জাঠ-রাজস্থানি ভাষার মিশ্রণ মেনে নিতে কোনও আপত্তি নেই। সেটা বরং স্বাভাবিক। কিন্তু ঔপন্যাসিক অদিতি যখন কোনও ঘটনার বিবরণ দিচ্ছেন তখন তিনি নিজে এই মিশ্র ভাষা ব্যবহার করবেন কেন? বাঙালি শাশুড়ি বাসন্তী ও বাঙালি পুত্রবধূ লীলাই বা নিজেদের মধ্যে কেন মিশ্র ভাষায় কথা বলবে? লেখিকা অবশ্য দু-জায়গায় কৈফিয়ত দিয়ে রেখেছেন যে দীর্ঘ অনভ্যাসে মাতৃভাষা ভুলে যাবার মতো অবস্থা হয়েছে তাদের, কিন্তু লীলা বাংলা ছেড়েছে দশ বছর আগে আর বাসন্তী ত্রিশ-বত্রিশ বছর আগে। পনেরো-ষোলো বছর বয়স অবধি যে-ভাষায় তারা কথা বলেছে সেটা কি ভুলে যাওয়া সম্ভব! সত্যি বলতে কি, ভোলেওনি। বাসন্তী লীলাকে নিজের জীবনের দীর্ঘ ইতিহাস বলে খাঁটি বাংলায়, তারপরেই আবার শ্রুতিকটুভাবে ফিরে যায় মিশ্র ভাষায়।

    অদিতি সরকারকে আমি এই লেখাটির জন্য অভিনন্দন জানাই। বাজারচলতি সস্তা গল্প না লিখে তিনি অন্ধকার ভারতের এক টুকরো ছবি তুলে ধরলেন তাঁর বলিষ্ঠ লেখনীতে, যদিও সংবাদ-মাধ্যম লোকহিতৈষী সংস্থা ও সরকারের কোনও হেলদোল হবে না এতে। সাহিত্যমূল্যের চেয়েও এ-উপন্যাসের সমাজমূল্য হয়তো বেশি। মোলকি মেয়েরা আত্মহত্যা করে না কেউ, এত যন্ত্রণার পরেও তারা বেঁচে থাকে, বেঁচে থাকতে চায় জীবন কিছু দেবে না জেনেও, কেবল দুটো রুটির জন্যই বেঁচে থাকতে চায়। বাঁচার জন্যই শুধু বাঁচা। মহিন্দরের কাছ থেকে এক উদাসীন নিয়তিনির্ভরতার পাঠ পেয়েছে লীলা। অহেতুক মাথা খারাপ করে লাভ নেই। জীবন যখন যা দেবে তাকে মেনে নিতে হবে, সুখের মুহূর্তে বাঁচতে হবে সুখে। একটা পোয়াতি কুকুরকে রোজ দুটো রুটি দেয় লীলা, তার নাম সে রেখেছে লালি। ভেবে দেখলে লালি নামটা লীলা নামেরই উলটোপিঠ। প্রবল শীতে পুরোনো বস্তা পেতে দিয়েছে লীলা, লালি শুয়ে থাকে তার ওপর। রুটি পেলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। এক মায়াময় জিজীবিষায় শেষ হয় এই উপন্যাস :

    চটপটে হাতে মটর ছাড়ায় লীলা। দেখতে দেখতে বাটি ভরে ওঠে চকচকে নরম সবুজ দানায়। রোদ পড়ে চিকচিক করে, যেন ছোট্ট ছোট্ট গোল সবুজ মুক্তো। মুগ্ধ হয়ে দেখে লীলা। এইটুকুতেও কী সুখ যে।...

    আঙ্গনের মাঝখানে খাটিয়ার ওপর নিমগরম রোদ গায়ে মেখে ঘুমিয়ে পড়েছে বাসন্তী গুটিসুটি হয়ে। অল্প অল্প নাক ডাকছে তার। চটের বস্তার ওপর লালি ঝিমোয়, থাবায় মুখ গুঁজে। কিচকিচ বালির কণা উড়ছে হাওয়ায়। পাশের ঘরের রসুই থেকে ভেসে আসছে গরম তেলে রসুন ফোড়নের ঝাঁজালো গন্ধ। দুর্গা রান্না চাপিয়েছে তার মাতাল মারকুটে ঘরওয়ালার জন্য।

    বসে-বসে সারা শরীর দিয়ে এই সবকিছু শুষতে থাকে লীলা। এই সকাল-সন্ধের ঘরগৃহস্থি, এই রোজকার নিশ্চিন্ত জীবন। স্বপ্ন না সত্যি কে জানে। হয়তো সত্যি, হয়তো নয়। এক লহমার একটা ছোট্ট নিটোল বুদবুদ। হয়তো ফেটেই যাবে একদিন ফট করে। তবু, এই মুহূর্তটুকু নিয়ে, তার মধ্যের সবকিছুকে নিয়ে জড়িয়ে-মড়িয়ে বেঁচে থাকে লীলা।

    বাবলিদিদি বাঁচতে চেয়েছিল। বাঁচেনি। লীলা বেঁচে আছে। লালিও বেঁচে আছে। হয়তো এভাবেই বেঁচে থাকবে ওরা সবাই, ওদের মতো করে, এমনি করেই কুড়িয়ে-বাড়িয়ে। যতদিন, যে ক-টা দিন থাকা যায়। (পৃ.১১৯-২০)

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments