এক আলমারি ভর্তি অগোছালো, এলোমেলো করে রাখা ছেঁড়া-ছেঁড়া, টুকরো-টুকরো নানান রঙের স্মৃতি। আলতো করে পাল্লাটা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে ছড়িয়ে, ছিটিয়ে পড়লো ঘরের মেঝেতে। সেগুলোকেই স্বযত্নে কুড়িয়ে সুকৌশলে রিফু করে একটি পূর্ণাঙ্গ বইয়ের আকার দিলেন তাঁরই সুযোগ্য পুত্রবধূ এবং এই বইটির অনুলেখিকা মৌসুমি ভট্টাচার্য।
১৯২৯ থেকে ২০১৮ (বইটির প্রকাশ কাল) এই দীর্ঘ সময়ে গৌরীদেবীর অভিজ্ঞতার ঝুলি পরিপূর্ণ হয়ে কখনো কখনো উপচে পড়েছে। এই সময়কালে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন এমন অনেক কিছু, যা আজ ইতিহাস। দেখেছেন কলকাতার ওপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব। গোটা শহরে তখন আতঙ্কের বাতাবরণ। দেখেছেন তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ এবং ছেচল্লিশের দাঙ্গা। তাঁর শরীরের সমস্ত বলিরেখায় জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস। হয়েছেন অনেক দুর্ঘটনার সাক্ষীও। এতগুলো বছরে সেই স্মৃতিপটে একটুও ধুলো জমেনি। যখন যেরকম ভাবে মনে পড়েছে, উগরে দিয়েছেন কাছের মানুষদের কাছে। তাই বলা যেতেই পারে "যখন যেমন মনে পড়ে" একটি সার্থক শিরোনাম।
স্মৃতিকথাটিকে মোট এগারোটি অধ্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি অধ্যায়ই আলাদা আলাদা ভাবে নামাঙ্কিত। নামগুলি যথাক্রমে 'লাখাই ঢাকাই', 'বেড়ে ওঠার সাত সতেরো', 'মামার বাড়ির ইতিকথা', 'যার সাথে পথচলা', 'ঘরকন্যার দিনলিপি' ইত্যাদি। আছে কিছু বহু পুরোনো পারিবারিক দুর্লভ ছবিও। এখানে কোনো কাল্পনিক চরিত্র নেই। কোনো কষ্টকল্পিত গল্প নেই। আছে জীবনের গায়ে লেগে থাকা বহু ছোটো বড়ো ঘটনার কোলাজ। ঘটনাগুলি পরিবেশনের গুণে পাশে বসে গল্প শোনার অভিজ্ঞতাকেও হার মানিয়েছে। লেখার গুণে ছুঁয়েছে উপন্যাসের কৌলীন্যকে।
জীবনের কোনো সারসংক্ষেপ হয় না। তবুও আলোচনার স্বার্থে তাকে সংক্ষিপ্ত করে নিতে হয়।
গৌরী সেনের জন্ম ১৯২৯ সালে। স্কুলে ভর্তি হওয়া থেকে শুরু করে ১৯৪৬ সালে আই. এ. পাশ এবং ১৯৫০ সালে এম. এ. পাশ, এই পুরো প্রক্রিয়াটাই সম্ভব হয়েছিল মা সুধাময়ী দেবীর সাহচর্যে। সুধাময়ী দেবী একটি মহীয়সী চরিত্র। তিনি নিজেও মেয়ের সঙ্গে একই বছর আই. এ. পাশ করেন এবং সংসারের চাপে পড়াশোনা থেকে বিরতি নেন। দীর্ঘ কুড়ি বছর পর ১৯৬৬তে তেষট্টি বছর বয়সে সুধাময়ী দেবী গ্র্যাজুয়েট হন। দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় ছবি-সহ খবরটা ফলাও করে বেরোয়। সময়টা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। যে সময় অল্প বয়সে বিয়ে হওয়া আর বছর বছর সন্তান বিয়োনোই ছিল মেয়েদের ভবিতব্য, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে সুধাময়ী দেবী তাঁর মেয়েকে পড়িয়েছেন জীবনের অন্য পাঠ। এগিয়ে দিয়েছেন সামনের দিকে। আর সেই সামনের দিকে চলার পথ আরও প্রশস্ত করেছেন বাবা সুরেন্দ্র মোহন দত্ত।
গৌরী দেবীর স্মৃতিচারণার অনেকাংশ জুড়ে রয়েছে তাঁর মামারবাড়ির গল্প। পাঁচ মামার মধ্যে যার কথা না বললেই নয়, তিনি বড় মামা মণীন্দ্র কুমার ঘোষ, ছিলেন মহাত্মা গান্ধীর স্নেহধন্য। স্বাধীন ভারতের প্রথম ডেলিগেট হিসেবে সুইজারল্যান্ড গিয়েছিলেন ইন্টারন্যাশনাল লেবার কনফারেন্সে। তিনিই প্রথম সোলার কুকারের আবিষ্কর্তা। মামার বাড়ি পর্বে আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল ন-মামা সুচিত কুমার ঘোষের সঙ্গে গৌরী দেবীর সম্পর্ক। দুটি মানুষের একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং স্নেহের অভাব ছিল না। কিন্তু কোনো এক রহস্যময় অজ্ঞাত কারণে তাঁদের মধ্যে একটিও শব্দ বিনিময় হয়নি ন-মামার জীবদ্দশায়। এই ঘটনা উপস্থাপন করতে গিয়ে গৌরীদেবী বলছেন, "কেন আমিই বা কথা বলিনি। সব না-বলা কথার পাহাড় ডিঙিয়ে ন-মামা এখন নৈঃশব্দলোকে। আবার যদি তোমার সঙ্গে কখনো দেখা হয়, আমিই আগে কথা বলবো ন-মামা। দেখে নিও।" (পৃ-৬২) স্মৃতিকথার এই অংশটি পড়তে পড়তে চরিত্রকেন্দ্রিক কোনো ছোটোগল্প পাঠের ভালোলাগা মনের মধ্যে চারিয়ে যায়।
গৌরী দেবীর স্মৃতিচারণায় বার বার এসেছে তাঁর মায়ের প্রসঙ্গ। এক্ষেত্রে একটি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সুধাময়ী দেবীর সন্তানসম ছোটো ভাই সুধীর কুমার ঘোষ ছিলেন বিপ্লবী, যুগান্তর দলের সদস্য। গৌরী দেবীর তখন মাত্র কয়েক মাস বয়স। অস্ত্র রাখার অভিযোগে সুধীর গ্রেফতার হন এবং বাড়িতে পুলিসি তল্লাশি শুরু হয়। ভাঙা ছাতার মধ্যে রিভলবার লুকিয়ে সেটা দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখেন সুধাময়ী দেবী। তারপর সেই ছাতার সামনেই নিজের মেয়েকে কাঁদিয়ে গায়ের কাপড় সরিয়ে বুকের দুধ খাওয়ানোর অভিনয় করেন। গৌরী দেবী বলছেন, "যতক্ষণ পুলিশ গোটা বাড়ি সার্চ করেছে মা অবিন্যস্ত অবস্থায় আমাকে দুধ খাইয়েছে, বলা ভালো খাওয়ানোর ভান করেছে। সেবার পুলিশ রেন ওয়াটার পাইপ থেকে শুরু করে সমস্ত গদি তোষক বালিশ ফাটিয়ে সার্চ করেছে, সারা বাড়ি লন্ডভন্ড করেছে। কিন্তু স্তনদানরত মহিলার সামনে গিয়ে ভাঙা ছাতা সার্চ করার কথা ভাবেনি।" (পৃ-৬৩) স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং লেখিকা কমলা দাশগুপ্তের লেখা 'রক্তের অক্ষরে' বইটিতে এ ঘটনার উল্লেখ আছে।
একান্ন সালে ব্যারাকপুর উইমেন্স কলেজে চাকরি পান গৌরী দেবী। কিন্তু বাবার অসুস্থতার কারণে বেশিদিন সে চাকরি তিনি করতে পারেননি। এরপরই স্কটিশচার্চ কলেজের ফিজিক্সের প্রফেসর অনিল সেনের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। শুরু হয় সংসার জীবন। মেনে চলা এবং মানিয়ে চলার মধ্যে দিয়েই অতিবাহিত হতে থাকে জীবন। পাওয়া না পাওয়ার গল্পটাও চলতে থাকে সমান ভাবে। যেমন গৌরী দেবী হারিয়েছেন তাঁর গানকে। তিনি ধ্রুপদী সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন। হিন্দুস্তান রেকর্ডস থেকে একটা রেকর্ডও বেরোয়। সংসারের প্রতি দায়বদ্ধতায় সেই গানকেও তিনি পিছনে ফেলে এসেছেন অনায়াসেই। যেমন অসুস্থ বাবাকে দেখাশোনার জন্য তিনি ছেড়েছিলেন কলেজের চাকরি।
বইয়ের পাতা ওল্টানোর মতোই বদলে যায় জীবনের অধ্যায়গুলো। দুই সন্তান অশোক এবং অরূপের জন্মের সাথে সাথেই গৌরী দেবীর জীবনে শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়। নতুন নতুন নানান মজার ঘটনায় বিকশিত হতে থাকে তার মাতৃত্ব। পুরোনো পরিচয়কে পিছনে ফেলে রেখে জায়গা করে নেয় নতুন পরিচিতি। আজ তিনি রত্নগর্ভা। তিনি পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ "মিলিয়ন ডলার বিজ্ঞানী" অশোক সেনের মা।
গন্তব্য নির্দিষ্ট হলে পিছন ফিরে একবার তাকাতেই হয়। এই বৃদ্ধ বয়সে গৌরী দেবীও তাই ফিরে গেছেন তাঁর পুরোনো আস্তানায়, ছোটবেলার ঠিকানা ৮৭ নম্বর কেশব সেন স্ট্রিট। এখানেই বন্দী আছে তাঁর ছেলেবেলার সতেরো বছরের অতীত। উঠোনে পা রাখতেই চোখের সামনে ছায়াছবির মতো ভেসে উঠলো কত ঘটনা, কত কথা। ভিড় করে এলো কত চেনা মুখের সারি। ছোট্ট গৌরী এক্কাদোক্কা খেলে বেড়াচ্ছে সারা উঠোন জুড়ে। পূর্ণিমা আর বুলি ওরাও তো ঝগড়া করছে। এ যেন টাইম মেশিনে চড়ে ছোটোবেলার দিনগুলোতে ফেরত যাওয়া। সঙ্গী নাতি চিকু। ফিরে পাওয়া শৈশবের হাত ধরে তিনি বললেন, "কথায় বলে বার্ধ্ক্য দ্বিতীয় শৈশব। আমার বার্ধক্য আমাকে প্রথম শৈশবের হাত ধরিয়ে দিল।" (পৃ-১২৮) নাতি এবং পুত্রবধূদের সঙ্গে গৌরী দেবীর সম্পর্কের সাবলীলতা দেখলে বোঝা যায় তাঁর শরীরের বয়স মনকে স্পর্শ করতে পারেনি এখনও। তাই তো তাঁর শিশুকাল আজও ফিরে ফিরে আসে কখনো সুগার ক্যান্ডি হয়ে, কখনো হরিদাসের বুলবুল ভাজা হয়ে আবার কখনো টিনের চৌকো বাক্সে বায়োস্কোপ হয়ে।
একজন নবতিপর বৃদ্ধার অতীত মানেই পুরোনো শ্যাওলা ধরা পাঁচিল অথবা ভাঙা জানলার গরাদে পুঞ্জীভূত হয়ে থাকা স্মৃতি। কিন্তু গৌরী দেবী সে পথের পথিক ছিলেন না। ছিলেন একজন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী চরিত্র। সান্নিধ্য পেয়েছেন বহু জ্ঞানী, গুণী মানুষের। তাই তাঁর অতীতের চাক ভেঙে যে মধু আহরিত হয়েছে তা পাঠকের কাছে অমৃতসমান হবে বলাই বাহুল্য। গৌরী সেনের মায়াময় স্মৃতি রোমন্থন ও মৌসুমী ভট্টাচার্যের অনবদ্য অনুলিখনের মনোমুগ্ধকর কথকথায় 'যখন যেমন মনে পড়ে' বারবার পড়া যায়।