আরও আছে। দূরের মহাশক্তিধর দেশগুলো ভাবে এ দেশটা অন্য কারোর হাতে চলে যাবে না তো? তাদের সামর্থ্য অনেক, অস্ত্রশস্ত্রও অঢেল। তারা সময় সময় তাদের উড়োজাহাজ পাঠিয়ে এখান-সেখানে বোমা ফেলে যায়। উড়োজাহাজ ছাড়া রকেট মানে মিসাইল হামলাও স্বাদ বদলানোর জন্য করে থাকে কখনোসখনো।
এদেশের রাজধানী ইতিহাসের নামকরা এক প্রাচীন নগর। রাজধানীর কাছাকাছি একটা ছোট সুন্দর জনপদ আছে, মানে যুদ্ধের আগে পর্যন্ত ছিল। এখন জায়গাটার অবস্থা বড় করুণ। আস্ত বাড়ি বলতে আর কিছু নেই। বোমার আঘাতে বেশিরভাগ বাড়িই ভেঙেচু্রে ধ্বংসস্তূপ হয়ে রয়েছে। আগে অনেকগুলো ইস্কুল এমনকি দুটো কলেজও ছিল। তারা কোনোরকমে লেখাপড়া চালাবার চেষ্টা করছে, কিন্তু আর পেরে উঠছে না। ছাত্রছাত্রীরা বসবে কোথায়? আর এই ডামাডোলের ভেতরে কারোর পড়াশোনা করার ইচ্ছে নেই।
কয়েক লাখ মানুষ মারা গিয়েছে, বেঘর হয়েছে আরও অনেক। বহু মানুষ দেশ থেকে পালিয়ে আশপাশের দেশে গিয়ে ভিড় করেছে। যদি আশ্রয় পাওয়া যায়। বহু শিশু অনাথ হয়ে গেছে, তাদের দেখার কেউ নেই। যেমন শহরের এই দিকটায় কোনো একটা সংস্থা কী কারণে যেন কটা চালাঘর বানিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। তাতে এখন প্রায় পনেরো-কুড়িটা চার থেকে দশ-এগারো বছরের শিশু থাকে। এদের কেউ নেই, নিজেরাই থাকে। সকালে, দুপুরে আর বিকেলে একটা এন-জি-ও থেকে কিছু খাবার দিয়ে যায়। এদের কেউ কেউ ইস্কুলে ভর্তি হয়েছিল, অক্ষর পরিচয় হয়েছিল কিন্তু এখন বোধহয় সব ভুলে গেছে। সারাদিন এরা খেলে বেড়ায়। এদের দু-একজন লোভে পড়ে চুরি করার চেষ্টা করে। নিজেদের মধ্যে কিংবা অন্য পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মারামারি করে। তবে হ্যাঁ, এরা সেই পুরোনো পাথর যুগের মানুষের মতো ঠেকে শিখেছে যে সবসময় দল বেঁধে থাকাই উচিত।
এমন কিছু মানুষ হয় যাদের ভিতরে একটা পোকা থাকে। সমাজসেবার পোকা। এরা যে কোনো অবস্থাতেই কী করে কিছু লোকের ভালো করা যায় তার চেষ্টা করতে থাকে। এদের নিজেদের দিনকাল কখনোই তেমন ভালো কাটে না, বিশেষ করে এই রকম যুদ্ধকালে, এরকম দেশে। এরা নানা ঝামেলা-টামেলায় প্রায়ই জড়িয়ে পড়ে। তবে যতদূর জানা গেছে এরা এসব করে অদ্ভুত একটা সুখ পায়। এই সুখটুকুই তাদের বাকি অসুবিধে, কষ্ট সব ভুলিয়ে দেয়।
এই যে বছর কুড়ির রোগা ঢ্যাঙ্গা ছেলেটাকে চালাঘরের দিকে আসতে দেখা যাচ্ছে, এর নাম রাসিদ। রাসিদের মাথায় এই রকম সমাজসেবার পোকা আছে। বছর পাঁচেক আগে একটা আত্মঘাতী হামলায় বোমা ফেটে রাসিদের বাড়ির সবাই যমালয়ে চলে গেছে। রাসিদ কী করে যেন বেঁচে যায়। আগে পেছনে কেউ নেই, রোজগার নেই, আশ্রয় নেই – রাসিদের সবই চলে গেছে তবু মাথার পোকাটি যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেছে। অনাথ বাচ্চাদের দিকে রাসিদের একটা ভালোবাসার টান আছে। তার জেরেই রাসিদ কিছুদিন বাচ্চাদের খাবার বিলি করার কাজ করেছিল, তারপর চেষ্টা করেছিল ভাঙা ইস্কুল বাড়িতে কটা ছেলেমেয়েকে একটু লেখাপড়া শেখাতে। কোনোটাই তেমন জমেনি। এখন একটা নতুন ধরনের বুদ্ধি এসেছে তার মাথায়, এই কমাস হলো রাসিদ সেটাই করে দেখছে।
রাসিদ ভেবে দেখেছে এখানকার অনাথ ছেলেমেয়েদের বাড়ি নেই ঘর নেই। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ বলেও কিছু নেই। এরা আজ এখানে বেঁচে আছে, কাল এরা কোথায় থাকবে, বাঁচবে না মরবে তা কেউ জানে না। এদেরকে পড়াশোনা শিখিয়ে কি কিছু হবে? আর বইপত্র পাওয়া যাচ্ছে না – পড়াশোনা করাবেই বা কী করে! যদি কোনোদিন অবস্থা শুধরে যায় তখন দেখা যাবে। রাসিদ কোথা থেকে একটা হুইসিল জোগাড় করেছে, সেটা গলায় ঝুলিয়ে সে একেকদিন একেকটা মহল্লায় যায় যেখানে অনাথ বাচ্চারা থাকে।
সকালবেলা। এন-জি-ও থেকে এই কিছুক্ষণ আগে চালাঘরের বাচ্চাদের পাঁউরুটি দিয়ে গেছে। চালাঘরের সামনে এসে রাসিদ ফুটবল খেলার রেফারির মতো কুই ই ই … করে হুইসিল বাজালো। হুইসিল শুনেই ছোট ছেলেমেয়ের দল ছুটে বেরিয়ে এসে রাসিদকে ঘিরে ফেলল। একটা বছর চারেকের ছেলে, দলের মধ্যে সবথেকে ছোট, সে সবার শেষে পাঁউরুটি খেতে খেতে ছুটে এল। তার খাওয়া তখনও শেষ হয়নি। পাঁউরুটির টুকরোটা মাটিতে পড়ে গিয়েছিল – বছর দশেকের একটা মেয়ে তার কাছে এসে টুকরোটা তুলে ধুলো ঝেড়ে তার হাতে তুলে দিল। তারপর হাত ধরে তাকে রাসিদের সামনে ভাঙা ইটের ওপর বসিয়ে দিল। ঠিক যেন তার দিদি। সকলে একসঙ্গে বলে উঠল “রাসিদভাই, গল্প বলো, গল্প বলো। খুব মজার গল্প বলবে কিন্তু…”
রাসিদ এই কাজটাই শুরু করেছে আজকাল। এদিক সেদিক থেকে ছোটদের গল্প জোগাড় করে। মজার গল্প, হাসির গল্প। কিছু কিছু নিজেও বানিয়ে নেয়। গল্প শুনে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হাসলে তার খুব ভালো লাগে। এদের খাবার বা আশ্রয় বা শিক্ষা দেবার ক্ষমতা রাসিদের নেই। তাতে কী হয়েছে – গল্প বলে সে যদি এদের কিছুক্ষণ হাসাতে পারে!
রাসিদ শুরু করল “তোমরা জানো তো ভালুক সারা শীতকাল ঘুমিয়ে থাকে তারপর গরম পড়লে ঘুম থেকে ওঠে!”
এ কথাটা কেউ জানতো না, তাই প্রথম লাইনেই অবাক করা খবর শুনে এরা গল্পের ভেতর ঢুকে গেল।
“একটা খুব বড় ভালুক ছিল। তার দুটো ছোট ছোট ছেলে। শীত পড়তেই তারা তিনজনে জঙ্গলের ভেতরে পাহাড়ের গুহায় ঘুমিয়ে পড়ল। এক মাস গেল দু মাস গেল তিন মাস গেল … তাদের যেমন স্বভাব তারা ঘুমোচ্ছে তো ঘুমোচ্ছে। তিন মাসের পর শীত কমতে লাগলো আর গরম কাল এসে গেল। এবার তো তাদের উঠে পড়ার কথা। ছোট দুটো ভালুক এক এক করে উঠে পড়ল, কিন্তু উঠে কী করবে – বড় ভালুক তখনও ঘুমোচ্ছে। ছোট ভালুকরা বড় ভালুককে ঠেলেঠুলে ওঠাবার চেষ্টা করতে লাগলো, কিন্তু বড় ভালুকের ঘুম আর ভাঙ্গে না। সে শুধু ঘোঁতঘোঁত করে নিশ্বাস ফেলছে আর পাশ ফিরে আবার ঘুমোচ্ছে।”
রাসিদ একটু থামতেই সকলে বলে উঠল, “তারপর, তারপর কী হলো..”
রাসিদ বুঝল গল্প জমে উঠছে। সে আরও রসিয়ে রসিয়ে শুরু করল “তখন ছোট ভালুকরা গেল বাঁদরভাইয়ের কাছে। বাঁদর শুনে বলল, “ও এই কথা। দাঁড়া, গাছের উঁচুতে মাকড়সা বাসা করেছে, তাদের দুতিনটেকে ধরে আনছি। তোরা মাকড়সাগুলো বড় ভালুকের কানের ওপর ছেড়ে দিস। সুড়সুড়িতে ঘুম ঠিক ভেঙে যাবে।
“বাঁদর তো মাকড়সা নিয়ে এলো। কিন্তু কাজ কিছুই হলো না। বড় ভালুক দু একবার নড়েচড়ে বিরক্ত হয়ে মাথা এপাশ-ওপাশ করল তবে ঘুম তার ভাঙল না।”
বাচ্চাগুলো এই অবধি শুনেই হাসতে লাগলো, “হি হি এত সুড়সুড়িতেও ঘুম ভাঙল না হি হি…”
“তারপর ছোট ভালুকরা গেল হাঁসভাইদের কাছে। হাঁসেরা সারাদিন পুকুরে খেলে বেড়ায়। ছোট ভালুকেরা বলল – হাঁসভাইরা, তোমরা একটু আমাদের বাড়ি গিয়ে প্যাঁকপ্যাঁক করে আসবে, বড় ভালুকের ঘুম ভাঙছে না যে। খুব জোরে জোরে প্যাঁকপ্যাঁক করবে কিন্তু। পাঁচ-পাঁচটা হাঁস লাইন করে এলো, তারপর কত যে প্যাঁকপ্যাঁক করল তার ঠিক নেই। বড় ভালুক ঘড়ঘড় করে আরও নাক ডাকতে লাগলো।”
রাসিদের গল্প বলার ঢং বেশ মজার, ছেলেমেয়েরা সকলে হেসে কুটিপাটি।
“তারপর ছোট ভালুকেরা গেল অজগর সাপের কাছে। কুর্নিশ করে বলল – সাপরাজা আমাদের বলে দাও কী করে বড় ভালুকের ঘুম ভাঙাব। সাপ আড়ামোড়া ভেঙে মাথা তুলে বলল – তোরা দুধ ময়দা আর মধু একটা বাটিতে গরম কর। খাবারের গন্ধ নাকে গেলে বড় ভালুকের ঘুম সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে যাবে, আর কিছু করতে হবে না …”
ছোট ছেলেটা গল্প শুনছিল সবার সঙ্গে কিন্তু এত বোঝার বয়স তার হয়নি। ও শুধু তার পাতানো দিদিকে বলল – আমি মধু খাবো ..। দিদি বলল – আজকাল মধু পাওয়া যায় না, আগে যেত। এখন গল্প শোন।
দুধ, ময়দা আর মধুর গন্ধে কি ঘুম ভাঙবে? ছেলেমেয়েরা হাসিহাসি মুখে আগ্রহ নিয়ে শুনছে এরপরে কী হবে।
এমন সময় চারিদিক থেকে সিই-ই-ই করে সাইরেন বেজে উঠল। মানে বোমারু বিমান আসছে বোমা ফেলতে। রাসিদ তাড়াতাড়ি ছোট ছেলেটাকে কোলে তুলে নিল। বোমা থেকে বাঁচতে হলে এখনই মাটির নিচে কংক্রীটের ‘শেলটার’-এ আশ্রয় নিতে হবে। এখান থেকে দৌড়ে গেলে ‘শেলটার’-এ পৌঁছোতে দু-তিন মিনিট তো লাগবেই। তার মধ্যে উড়োজাহাজের ঝাঁকও এসে পড়বে মাথার ওপর। রাসিদ হুইসিল বাজিয়ে সবাইকে বলল, “আর গল্প নয়, আমাদের এক্ষুনি শেলটারে পৌঁছতে হবে।”
বেশ কদিন উড়োজাহাজের হামলা হয়নি। এই আবার শুরু হলো। বোমা যেখানে পড়ে সেখানে বিকট শব্দে লোকের কানের পর্দা ফেটে যায়, কারোর হার্টফেল হয়ে যায়। বাড়ির কাছাকাছি পড়লে, বাড়ি ভেঙে পড়ে আর চারপাশে দাউদাউ আগুন লেগে যায়। মাঠে পড়লে সেখানে বিরাট বড় গর্ত হয়ে ঘাসপাতা গাছগাছালি সব পুড়ে যায়। এত ধুলো আর ধোঁয়া হয় যে তাতেই দম আটকে অনেকে মারা যায়।
এই শিশুরা মায়ের পেট থেকেই গোলাগুলি বোমা মিসাইলের শব্দে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। চোখ ফোটার মুহূর্ত থেকে যুদ্ধের তাণ্ডবলীলা দেখছে। বোমা পড়লে কী হয়, কী হতে পারে তা এরা জানে।
রাসিদ শেলটারের দিকে সবাইকে নিয়ে দৌড় লাগাতে যাবে এমন সময় সেই বছর দশেকের মেয়েটা রাসিদের ছেঁড়া কোটের আস্তিনটা ধরে বলল “না রাসিদভাই, আমরা আজ কেউ শেলটারে যাব না। আমরা আজ এখানে বসে তোমার গল্প শুনব। কি রে, তোরা গল্প শুনবি না শেলটারে যাবি?”
সকলে রাসিদভাইকে ঘিরে দাঁড়িয়ে বলল “আমরা কোথাও যাব না, তুমি গল্প বল। আজকের গল্পটা খুব মজার, আমাদের খুব মজা লাগছে। উড়োজাহাজ আসছে আসুক, এখানে বোমা ফেলবে তো ফেলুক – তুমি গল্প বলো, আমরা শুধু গল্প শুনবো আর দেখো আজ আমরা সবাই কত হাসছি …”