এর প্রায় সমসময়েই ‘জল মধ্যে মীন’ এই নামে আরেকটি উপন্যাস আমি লিখতে শুরু করি। অনেকটা লেখার পর ওই উপরোক্ত কারণেই সেটাও পরিত্যক্ত হয়। বহুকাল পরে ২০১০ - ১১ সালে ‘জলমধ্যে মীন’ নতুন করে ‘লাশকাটা ঘরের সামনে অপেক্ষা’ নামে বাংলাদেশের 'নান্দনিক' পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এর পরে তৃতীয় উপন্যাস লেখার প্রচেষ্টা ‘বর্গক্ষেত্র’। সম্ভবত ১৯৭৯ কিংবা ১৯৮০ সালের কোনো সময়ে ‘বর্গক্ষেত্র’ লিখি। 'এক্ষণ', ১৯৮৯ বর্ষা সংখ্যায় এই লেখা প্রকাশিত হয়। নকশালপন্থী আবেগ এ লেখাতেও জোরালো ছিল। তবুও অন্য দু-একটি কারণে এ লেখা সমাদৃত হয় সে সময়ে।
এই একই সময়ে ১৯৮০, ৮১ সালে আমি বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গল্প লিখে ফেলেছিলাম। যেমন ‘আইনশৃঙ্খলা’ (১৯৮০), ‘ব্যবচ্ছেদ’ (১৯৮১), ‘কর্কটক্রান্তি’ (১৯৮১) এবং ‘দেবাংশী’ (১৯৮১) ইত্যাদি গল্পগুলি আমি লিখে ফেলেছিলাম এবং সেগুলো কলকাতার বিশিষ্ট পত্রিকা যথাক্রমে 'প্রমা', 'প্রস্তুতিপর্ব' এবং 'বর্তিকা'তে প্রকাশিত হয়েছিল। এই গল্পগুলো এবং ওই সময়ের আরো অনেক কটি লেখা মহাশ্বেতা দেবী ওইসব পত্রিকায় নিজেই উদ্যোগ করে ছাপাতে দিয়েছিলেন। এর হিসাবে একটু পূর্ব কথা বলতেই হয়।
দীপিকার চিঠি পেয়ে আমি বালুরঘাটে গেলাম। দীপিকা সেই সময়ে তার অফিসের একজন বিবাহিত বান্ধবীর বাড়িতে একখানা ঘর ভাড়া নিয়ে একা থাকতে শুরু করেছে।
বালুরঘাট শহর সে সময়ে আত্রেয়ী নদী তীরবর্তী একটা বড় গঞ্জের থেকে খুব বেশি কিছু নয়। কলকাতা থেকে যোগাযোগ রক্ষাকারী একটা মাত্র রোগা মফস্বলী রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে দিনে একটা মাত্র বাস আসে, একটা মাত্র বাস উল্টো পথে যায়। হাজার পঁচিশ লোকের বসবাস সেই শহরে। সেই শহরও বাইশ বছর বয়সি এক মেয়ের পক্ষে নিরাপদ নয়।
চিঠি পাওয়ার পর আমি তিন-চার দিনের মধ্যে গিয়ে হাজির হলাম বালুরঘাটে দীপিকার ঠিকানায়।
আটষট্টি সালের বিশে ডিসেম্বর যে ঘটনাটা আমরা ঘটিয়েছিলাম, তার মূলে দীপিকার কীরকম একটা জেদই ছিল প্রধান। তাছাড়া ওই রকম একটা ঘটনাবহুল সময়ে ওই রকম একটা সিদ্ধান্ত আমার যাবতীয় পরিকল্পনার বাইরেই ছিল। কেন এই সিদ্ধান্ত দীপিকা নিয়েছিল, কেনই বা আমি তা মেনে নিয়েছিলাম, এসব কথা এখানে অবান্তর বলে বাদ দিলাম।
আর সেই ঘটনার প্রায় এক বছর পরে ওরকম একটা জরুরি চিঠি পেয়ে আমি বুঝলাম ব্যাপারটা অবশ্যই জরুরি।
আগের চিঠিতে জেনেছিলাম মাঠের পাশের দরমার বেড়ার ঘর ছেড়ে সে শহরের অপেক্ষাকৃত সুরক্ষিত অংশে তার বান্ধবীর বাসার একখানা ঘর সাবলেট নিয়েছে। কিন্তু তা সত্বেও সেসময় সে ওই শহরে একেবারেই একা। যাদের সঙ্গে সে কলকাতা ত্যাগ করে ওখানে গিয়েছিল, তাঁরা ছিলেন ওর দিদি এবং জামাইবাবু। দীপিকার মা-বাবার মৃত্যু হয়েছিল ওর দশ-এগারো বছর বয়সেই। ভারী জেদী দীপিকা ওই বয়স থেকেই বুঝেছিল ওকে বড় হয়ে একটা চাকরি করতে হবে। দিদি-জামাইবাবুর সঙ্গে যখন সে উত্তর বাংলায় যায় তখন সে সবে স্কুল ফাইনাল পাশ করেছে। কলকাতায় থাকতে কয়েক মাস প্রি-ইউনিভার্সিটিতেও ক্লাস করেছে কলেজে। আমার সঙ্গে তার আলাপ হয়েছিল সেই সময়েই।
আটষট্টি সালের ডিসেম্বর মাসে আমাদের বিয়ে হলেও বিয়ের পরদিনই বালুরঘাটে চলে আসে। ফলে বিয়ের (ধর্মীয় নিয়মকানুন তো নয়ই) সামাজিক বিধিবিধানেও মান্যতা দেওয়ার কোনো চেষ্টাই আমরা করিনি। ফলে একবছর পর্যন্ত দীপিকার ‘কুমারী মেয়ে হয়ে’ থাকতে কোনো অসুবিধা হয়নি। অসুবিধা শুরু হল তার জামাইবাবু বালুরঘাট থেকে বদলি হওয়াতে। একজন একুশ-বাইশ বছরের মেয়ের পক্ষে এভাবে একা থাকা পৃথিবীর সর্বত্রই বোধহয় বিপজ্জনক। ইতিমধ্যে তিন-চার মাস পার হয়ে গেছে।
প্রায় দু’বছর সেই অনির্দিষ্ট বসবাসের জীবন স্থায়ী হয়েছিল আমার। তারপর সত্তর সালের নভেম্বর মাসের তেইশ তারিখে আমি নিরুপায় হয়ে এসপ্ল্যানেড থেকে রাতের বাসে বালুরঘাটের উদ্দেশে যাত্রা করলাম। এই অকস্মাৎ যাত্রার কারণ সত্তরের সেই অনির্দিষ্ট সময়ে কলকাতা বা তার আশপাশে একটি দিনও নিরাপদ রাত্রিবাস করার মতো উপযুক্ত জায়গা আমাদের অনেকেরই ছিল না।
বালুরঘাট শহরে কলকাতা থেকে অনেক দূরে আমার একটা আশ্রয়ের অঙ্গীকার ছিল। তাই আমি ভেবেছিলাম মাস খানেকের মতো সময় ওখানে অপেক্ষাকৃত নিরাপদে থেকে ফের সুযোগ বুঝে নিজের কর্মস্থলে ফিরে যাব।
মাস খানেক নিরাপদে দীপিকার বাসায় কাটিয়ে কলকাতায় ফিরেও এসেছিলাম কিন্তু তখন আমরা ছন্নছাড়া হয়ে গেছি। কারুর সঙ্গে আর তেমনভাবে যোগাযোগ করতে পারলাম না।
অগত্যা বালুরঘাটে দীপিকার আশ্রয়ে ফিরে গেলাম অনির্দিষ্ট ভবিষ্যৎকে মেনে নিয়ে।
ফিরে এসে ভাবতে বসলাম এখানে আমাকে কতদিন কাটাতে হবে? কী করব আমি এখানে বসে? এখানে আমার কোনো বন্ধু ছিল না। ছিল না কোনো পরিচিত সংসর্গও যাদের সঙ্গে বসে সন্ধেবেলা ঘন্টা দুয়েক গল্পসল্প করতে পারি।
মাস তিন-চার এভাবে কাটার পর দীপিকা একদিন জানাল সে অন্তঃসত্বা হয়েছে। আমি তাকে একটু হেসে জিগ্যেস করলাম, ‘ব্যাপারটা একটু তোমার তরফ থেকে বিশ্বাসঘাতকের মতো হয়ে গেল না?’
সে খানিকক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘যা বোঝ না, সে ব্যাপার নিয়ে কথা বোলো না। আমি তোমাকে কায়দা করে বেঁধে ফেলছি না। তোমাকে কোনো দায়িত্ব নিতেও বলছি না।’
আমার মনে পড়ল দু’বছর আগের আরেক ডিসেম্বর মাসে সে আমাকে কী বলেছিল।
কিন্তু সে সময় পর্যন্ত আমার আর নতুন কোনো জায়গার ঠিকানা তৈরি হয়নি। আমি আস্তে আস্তে এই নতুন জায়গার সঙ্গে নিজের অজান্তেই যেন নিজেকে জড়িয়ে ফেলছিলাম। আসলে জীবনের নিয়মই এ রকম।
সেই নিয়মের বলেই আস্তে আস্তে দু-একজন বন্ধু জুটল ওই নামেমাত্র শহরটাতেই। প্রথমে আলাপ হল হরিমাধব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। স্থানীয় কলেজের অধ্যাপক। অবশ্য সে কারণে নয়। তাঁর একটি নাটকের দল ছিল। দীপিকা সেই দলে ইতিমধ্যেই দুটি নাটকে অভিনয় করেছে।
অতি অল্প বয়স থেকে কবিতা ও গল্পের বই পড়া ও লেখার অভ্যাস হয়েছিল। আস্তে আস্তে সে সব আবার ফিরে আসতে লাগল। বেশ কয়েক বছর পরে অনেক দ্বিধা সত্বেও আবার কলম হাতে নিয়ে কাগজের সামনে বসলাম। ততদিনে স্থির করে নিয়েছিলাম যে আমি কথাসাহিত্যেই নিজেকে নিয়োজিত রাখব এবং গুরুত্বের সাথেই এই কাজটি করব সারা জীবন।
সময় চলল খুব শ্লথ গতিতে। এইভাবে প্রায় তিনটি পুরো বছর পার হয়ে গেল। এর মধ্যে পিতৃহীন হলাম এবং প্রায় একই সময়ে নিজে পিতা হলাম। লেখা বিশেষ কিছু হল না কিন্তু প্রচুর অবসর থাকায় পড়া হল বিশ্বসাহিত্যের সেরা উপন্যাসের অনেকগুলো।
এর মধ্যেই একদিন লেখাপড়ার সূত্রে আলাপ হওয়া একজন সরকারি অফিসার খবর দিলেন ‘ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে তিন-চার জন লোক নেওয়া হবে, একটা দরখাস্ত করতে পারেন।’ ব্যাংকটা একটা সমবায় ব্যাংক।
পাড়ার মধ্যেই তরুণ ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটদের একটা মেসবাড়ি ছিল। হরিমাধবের সঙ্গে সকালে একদিন একত্রে বাজারে যাওয়ার সময় সেই বাড়ির বারান্দা থেকে একজন মাধবকে ডাক দিলেন।
‘আরে মাধববাবু, এত সকাল সকাল বাজার বসেনি আসুন এক কাপ চা খেয়ে যান।’
মাধব আমার হাতে টান দিয়ে বলল, ‘এস, আলাপ করিয়ে দিই।’
পরিমল ব্যানার্জী নামের সেই ডেপুটির সঙ্গে সেইদিনই আলাপ হয়েছিল। চা খেতে খেতে প্রথম কথাতেই বললেন, ‘আপনার সব খবরই রাখি। তা হয়ে তো গেল অনেকদিন, এখন ঘর থেকে বের হন। সারাদিন চৌকিতে শুয়ে সিগারেট টেনে আর বই পড়ে আর কত কাল কাটাবেন? এবার বের হন, আমাদের সঙ্গেও মিশুন। সন্ধেবেলায় আমাদের ক্লাবে আসুন--’
মাধব বললেন, ‘না,না ওর নতুন একটা কাজ জুটেছে - মেয়ে রাখা।’
ঠিকই, ততদিনে দীপিকা একটি কন্যাসন্তান জন্ম দিয়েছে।
আমার পরিচিতির বৃত্ত বেশ খানিকটা বাড়ল।
কিছুদিন বাদে সঞ্জীব বসু নামের একজন সমবায়ের অফিসার, তিনি মাঝেমধ্যে একটা ছোটো ম্যাগাজিন বার করতেন, বললেন, ‘এখানকার কো-অপারেটিভ ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে তিন-চার জন লোক নেবে। সাধারণ চাকরি, একটা এপ্লিকেশন করতে পারেন।’
পরিমলও সামনে ছিলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, করবেন না কেন? একটা মেয়ের বাপ হয়েছেন, কতদিন আর বউয়ের রোজগারে খাবেন!’
বালুরঘাটে আসার প্রায় তিন বছর পরে ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে সুপারভাইজারের পদে একটা চাকরি হল। উত্তর বাংলার বিস্তৃত গ্রামাঞ্চল দেখার, বোঝার এবং অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার বিরাট সুযোগ আমার সামনে খুলে গেল।
সমবায় ব্যাংকে কাজ করেছিলাম এক বছর চার মাস। সে সময় জেলার নাম ছিল পশ্চিম দিনাজপুর। বালুরঘাট, রায়গঞ্জ এবং ইসলামপুর এই তিন মহকুমা নিয়ে জেলা পশ্চিম দিনাজপুর গঠিত হয়েছিল। মানচিত্রে ঘাসের টুকরোর মতো দেখতে, দক্ষিণে মালদা এবং উত্তরে দার্জিলিং ছুঁয়ে জেলা পশ্চিম দিনাজপুর। জেলা সদর প্রায় দক্ষিণ প্রান্তে বালুরঘাটে।
সমবায় ব্যাংকের এলাকা পুরো জেলাটাই। শীতের সময়ে ব্যাংকের কাজ খুবই বেড়ে যেত। যেহেতু সেটা ফসল ওঠার সময়, কাজেই সারা জেলা জুড়ে ঋণ গ্রহীতাদের সঙ্গে দেখা করা, তাগাদা দেওয়া এবং ঋণ আদায় করার প্রধান সময় এটা। কখনো কখনো আমরা সুপারভাইজাররা চার-পাঁচজন সশস্ত্র পুলিশ নিয়ে জিপগাড়িতে করে গ্রামে ঢুকতাম। এক-এক বারে এক-একটা থানা ঘুরে চার-পাঁচ দিন পরে বেরিয়ে আসতাম। রাত্রে আগে থাকতে খবর দেওয়া জোতদারদের বাড়িতে থাকতাম। ব্যাংকের বাহিনী জোতদারদের বাড়িতে গেলে কোথাও খাসি কাটা হত, কোথাও রাত দুপুরে জাল ফেলে পুকুর থেকে বড় মাছ মারা হত। নিয়তির পরিহাস বটে আমাকে নিয়ে। আমার ‘পঞ্চাশটি গল্প’ গ্রন্থটির অনেক কটি গল্পে যথা আইনশৃঙ্খলা, দেবাংশী, ফাল্গুনি রাতের পালা, ধানপোকা, বদলি জোয়ানের বিবি, সীমান্ত, মাটির বাড়ি, শিশুপাল, স্ফিংস, জল প্রভৃতি বেশ কয়েকটি গল্পে এই সময়ের অভিজ্ঞতার ছাপ স্পষ্ট রয়ে গেছে। এই সময়ের অভিজ্ঞতায় আমার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ লেখা হয় ১৯৮০-৮১ তে। ’৮০-’৮১ তে লেখা হলেও উপন্যাসটি প্রকাশিত হতে লেগে যায় আরো প্রায় পাঁচ বছর। ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ তে। প্রকাশক সুবর্ণরেখা।
১৯৭৬-এর মার্চ মাসে আমি গৌড় গ্রামীণ ব্যাংকে অফিসার হিসাবে যোগ দিই। এই চাকরি আমার জীবনের তৃতীয় চাকরি। এই চাকরি আমি করেছিলাম ২০০৪ পর্যন্ত। দক্ষিণ দিনাজপুর, উত্তর দিনাজপুর মালদা এবং মুর্শিদাবাদে বিভিন্ন দায়িত্বে আমি কাজ করেছি। ফলে দেখা হয়েছে গৌড়বঙ্গের অনেককিছু, দেখা জানা এবং বোঝা হয়েছে বরিন্দের গ্রামগঞ্জ শহর। উত্তর থেকে মধ্য বাংলার বিস্তৃত ভূখণ্ডের মানুষের সঙ্গে দীর্ঘ চৌত্রিশ বছরের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়েছিল আমার।
১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসনে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হতে নতুন সরকার প্রথম থেকেই বেশ কিছু নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করল।
অপারেশন বর্গা সেইসব কার্যক্রমের মধ্যে একটি বিশিষ্ট কাজ। স্বাধীনতার আগে থেকেই বাংলার চাষি জমিদারি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কখনো বিক্ষিপ্তভাবে কখনো বামপন্থীদের নেতৃত্বে বাংলার বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে জমিদার-জোতদারদের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, আন্দোলন, এমনকি কখনো কোথাও খণ্ড বিদ্রোহ পর্যন্ত করেছে।
এই সব আন্দোলন ও সংগ্রামের নেপথ্যে কম্যুনিস্ট পার্টির উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। কম্যুনিস্টরা আধিয়ার বা বর্গাদারদের সংঘবদ্ধ করে বাংলার বিস্তৃত অঞ্চলে সামন্ততন্ত্রে জোরদার আঘাত করতে পেরেছিল।
তে-ভাগা আন্দোলন দুই বাংলার বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে চল্লিশের দশকে কম্যুনিস্ট আন্দোলনকেও আমাদের দেশে শক্তি জুগিয়েছিল। উত্তরের জলপাইগুড়ি, রঙপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, দক্ষিণ বঙ্গের চব্বিশ পরগণা, খুলনা, যশোর, ঢাকা, মৈমনসিংহ, হুগলি, পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর, বাঁকুড়া প্রভৃতি প্রায় সারা বাংলাদেশ জুড়েই এই আন্দোলন মাথা চাড়া দিয়েছিল।
তেভাগার সংগ্রামে সামনে দাঁড়িয়ে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন দিনাজপুরের হাজি দানেশ, চিয়ার সাঁই, ময়মন সিঙের মনি সিংহ, রাজশাহীর ইলা মিত্র, কাছিম মিঁয়া, যশোরের নুর জালাল প্রভৃতি আরো বহু মানুষ। ১৯৪৬-৪৭ সালে সম্পূর্ণ বাংলাদেশের ১৯টি জেলায় তেভাগা আন্দোলনের আগুন জ্বলে উঠেছিল।
তেভাগা আন্দোলন তথা আধিয়ার বিদ্রোহের উৎস খুঁজতে ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে বাংলার চাষিদের উপরে যে অবিচার নেমে এসেছিল সে সব কথা স্মরণ করতেই হয়। বড়লাট কর্ণওয়ালিসের প্রবর্তিত এই আইনের ফলেই বাংলার চাষিদের হাত থেকে জমির মালিকানা ক্রমশ জমিদার, জোতদারদের হাতে চলে যায়। জমির উপর কর্ত্তৃত্ব হারিয়ে কৃষকেরা পরিণত হয় ভাড়াখাটা মজুরে।
এই সময়ই কৃষক অঞ্চলে জোতদার নামে একটি নতুন শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটে। এরা নতুন মধ্যস্বত্বভোগী, এরাই পরবর্তীতে শক্তিশালী জোতদার শ্রেণী। জোতদাররা জমিদারদের কাছ থেকে জমি ইজারা নিয়ে চাষীদের দিয়ে চাষ করাতো এবং নিজেদের ইচ্ছামতো খাজনা আদায় করত। বহু সময়ই চাষী-কে যে জমি চাষ করতে দেওয়া হত, তার কোনো মাপজোখও হত না।
এর আগেই ১৯৩৬ সালে কৃষকদের নিয়ে কৃষকসভা তৈরি হয়েছিল। তাদের প্রথম থেকেই শ্লোগান নির্ধারিত হয়েছিল ‘লাঙ্গল যার জমি তার’। ১৯৪০ সালে ফজলুল হকের মন্ত্রীসভা প্রস্তাব করে ফ্লাউড কমিশনের। কমিশন কয়েকটি প্রগতিশীল প্রস্তাব দেয় এই সময়। জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ, জমির মালিকানা চাষীদের প্রদান এবং উৎপন্ন ফসলের তিনভাগের দু ভাগ মালিকানা চাষিদের দেওয়ার সুপারিশ করা হয় এই কমিশনে।
এসব ব্যবস্থা কতটা কার্যকরী হয়েছিল, সেসব দু-তিন বছরের মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে গেল। ১৯৪৩ সালে সারা বাংলা জুড়ে যে দুর্ভিক্ষের করাল ছায়া নেমে এসেছিল, তা শুধু কৃষকমজুরদেরই নয়, স্বচ্ছল অবস্থার মানুষকেও গভীর সংকটের মধ্যে ফেলেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রবল অভিঘাত আমাদের মতো দেশেও প্রবলভাবে অনুভূত হয়েছিল। এবং তারপরেই পঞ্চাশের মন্বন্তরের ঘটনা। ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এই দুর্ভিক্ষে এবং প্রায় এক কোটি মানুষ নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল। দুর্ভিক্ষের প্রধান আঘাত নেমে এসেছিল কৃষিমজুর, ছোটো কৃষক, মাঝারি কৃষকের উপরে।
১৯৪৬-এ তেভাগা আন্দোলনের অগ্নিশিখা জ্বলে উঠল খুলনা, চব্বিশ পরগণার কাকদ্বীপে। গোপন এবং প্রকাশ্য সভাসমিতি হতে লাগল এখানে সেখানে। পরে বাংলার প্রায় পুরো কৃষক অঞ্চল জুড়ে। লড়াই হল কাকদ্বীপের চন্দনাপিড়িতে, দিনাজপুরের খাঁপুরে, রঙপুরের নীলফামারি আরো অনেক জায়গায়।
’৪৭-এ দেশ স্বাধীন হল। মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাড়তে লাগল। বাড়তে লাগল হতাশাও। অনেক নতুন নতুন আইনকানুন তৈরি হল। কিছু কিছু আইন কার্যকরী হল। অনেকগুলোই তেমন হল না।
তেভাগা বা আধিয়ার আন্দোলন বামপন্থীদের নেতৃত্বে ব্যাপক প্রচার পেয়েছিল এবং আইনসভায় তার পক্ষে প্রবল সমর্থনও পায়। জোতদার আর বর্গাদারের প্রাপ্তির অংশ আইনে ন্যায্যতা পেলেও বাংলার কোনো জেলায়ই তা তেমনভাবে কার্যত প্রতিষ্ঠা পেল না।
অবশেষে ১৯৭৭ সালে বামপন্থীরা পশ্চিম বাংলায় ক্ষমতায় আসলে প্রথম দিকেই অপারেশন বর্গা নামে একটি বিশেষ কার্যক্রম সরকার গ্রহণ করল।
এই এত কথা লেখার কারণ এতক্ষণে বলার অবকাশ হল আমার। গ্রামীণ ব্যাংকে চাকরি পেয়েছিলাম ১৯৭-এর মার্চ মাসে। আমার প্রথম পোস্টিং হয়েছিল বালুরঘাট থানার পতিরাম শাখায়। পতিরামের প্রায় সংলগ্ন গ্রাম খাঁপুরের তেভাগার লড়াইতে একদিনে চোদ্দ জন শহীদ হয়েছিলেন পুলিশের গুলিতে। আরো আট জন বালুরঘাটের হাসপাতালে মারা গিয়েছিলেন পরবর্তী কয়েক দিনে।
পতিরামের শাখায় কাজ করার সময় খাঁপুরের তেভাগার লড়াইয়ের অনেক কথা আমি শুনেছিলাম। সে সময় পর্যন্ত জীবিত ছিলেন কালী সরকার নামে একজন যিনি খাঁপুরের লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আমার সুযোগ হয়েছিল দুবার তাঁর সঙ্গে বেশ কিছু সময় ধরে কথা বলার। সেই দুবারই বেশ কিছু সময় ধরে তেভাগার লড়াই নিয়ে আমি তাঁর সাথে আলোচনা করেছিলাম।
আমি অবশ্য কলকাতা স্কুলে পড়ার বয়স থেকেই তেভাগার লড়াইয়ের নেতৃত্বস্থানীয় বহু মানুষকে চিনতাম এবং তেভাগার আন্দোলন সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা আমার হয়েছিল।
আমি চিনতাম আবদুল্লা রসুল সাহেবকে, আমি চিনতাম ইলাদিকে। চারু মজুমদারের সঙ্গেও আমার বার তিনেক দেখা হয়েছিল পরবর্তী সময়ে। সেই বালক বয়সেই পড়া ‘ইলা মিত্র’ নামের লেখা কবি গোলাম কুদ্দুসের দীর্ঘ কবিতাটির অনেক অংশই আমার এখনো মুখস্থ আছে। ১৯৮০-৮১ তে সোমনাথ হোড়ের ‘তে-ভাগার ডায়েরি’ পড়া হয়েছিল বোধহয় ১৯৯২-৯৩ তে। সেই সময় থেকেই কিছুদিনের জন্য সোমনাথদার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। এসব কারণে তে-ভাগার লড়াই এবং বিস্তৃত আন্দোলন আমার অন্তরের একটা স্থায়ী জায়গা জুড়ে ছিল। ফলে ব্যাংকের কর্মসূচীতে অপারেশন বর্গা বিশেষ গুরুত্ব নিয়ে যুক্ত হলে আমি আমার নতুন চাকরিতে একটা অতিরিক্ত আকর্ষণ টের পেলাম। জেলাস্তরে ব্যাংক, সমবায় এবং সরকারি বিভিন্ন বিভাগের যুক্ত সভায় ব্যাংক অফিসারদের ডাক পড়ত। জেলা সমাহর্তার আহূত আরো বড় একটি সভায় বক্তা ছিলেন মন্ত্রী বিনয় চৌধুরী। আমরা ব্যাংকের অফিসারেরাও সেখানে উপস্থিত ছিলাম।
১৯৭৭ সালের ১৭ই ডিসেম্বরে আমাদের দ্বিতীয় কন্যা শিঞ্জনার জন্ম হয়। আগের দিন রাতে শোয়ার পর দীপিকা জানাল তার একটু অসুবিধা শুরু হয়েছে।
আমি একটু আতঙ্কগ্রস্থ হলাম। বালুরঘাটে সে বার যেন শীতটা একটু বেশি রকমের পড়েছে। হাসপাতাল শহরের বাইরে, আমাদের বাসা থেকে দুকিলোমিটার মতো দূরত্বে। রিকশা ছাড়া যাতায়াতের অন্য কোনো ব্যবস্থা সাধারণের জন্য নেই। আমাদের বাসার কাছাকাছি কোনো রিকশাআলা ছিল না যে মাঝরাত হলেও ডেকে নিয়ে আসব।
ভয়াবহ শীতের রাত কাটে যেন অসম্ভব দুর্ভাবনায়, প্রায় নির্ঘুমে।
সকাল হতে-না-হতে দীপিকা খাট থেকে নেমে নীচে দাঁড়াতেই প্রথম কথা বলল, রিকশা ডাকো। আমি দরজা খুলে বাইরে এসে বাড়িওলার দরজায় কড়া নাড়লাম।
১৯৭৫ সালের ২রা অক্টোবর গান্ধীজির জন্মদিনে ভারতবর্ষের সব রাজ্যে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই উদ্যোগের পিছনে ছিলেন। প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষক, গ্রামীণ ছোটো কারিগর, গ্রামীণ শিল্পী, সমবায় সমিতি প্রভৃতি মুখ্যত গ্রামীণ উদ্যোগ ও কর্মকাণ্ডে সহায়তা করার লক্ষ্যেই গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠা করা হয়। মহাজন এবং জোতদারদের শোষণ থেকে গ্রামীণ গরিব মানুষকে রেহাই দেওয়ার অভিপ্রায় এই পরিকল্পনায় ছিল। ইন্দিরা গান্ধীর প্রধান মন্ত্রীত্বের সময়ে এই গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠা একটা বড় প্রচেষ্টা ছিল, তাতে সন্দেহ নেই।
প্রথম পর্বে পশ্চিম বাংলায় চার-পাঁচটা গ্রামীণ ব্যাংক হয়েছিল। তার মধ্যে গৌড় গ্রামীণ ব্যাংকে প্রথম অফিসার দলের মধ্যে আমি একজন। মালদা, মুর্শিদাবাদ এবং পশ্চিম দিনাজপুর নিয়ে গঠন করা হয়েছিল গৌড় গ্রামীণ ব্যাংক।
আমি সেই ১৯৭১ সাল থেকেই বালুরঘাটের বাসিন্দা। বালুরঘাট ব্লকের পতিরাম গ্রামের নতুন খোলা ব্যাংকের শাখায় আমার পোস্টিং হল। ইউনাইটেড ব্যাংকের একজন অফিসার এবং স্থানীয় একজন শিক্ষিত যুবককে ক্যাশিয়ার হিসাবে নিয়োগ করে ব্যাংকের শাখা খোলা হয়েছিল ২রা অক্টোবরে গান্ধী জয়ন্তীতে। সারা ভারত জুড়েই এইভাবে সম্ভবত শতখানেক গ্রামীণ ব্যাংকে চার-পাঁচশো শাখা খোলা হয়েছিল।
মালদা শহরে গৌড় গ্রামীণ ব্যাংকের হেড অফিস ছিল। সেখানে দিন পনেরোর নামমাত্র ট্রেনিং-এর পর পতিরাম শাখায় যোগ দিলাম ১লা এপ্রিল, ১৯৭৬।
গ্রামের গরিব মানুষদের ব্যাংক। কোনোরকম ঠাটবাট নেই। একপাশে একটা সাদামাটা খাঁচা - সেটা ক্যাশ কাউন্টার। ভেতরে কেশিয়ার। বাইরে একপাশে আমি। পিছন দিকে ম্যানেজারের টেবিল। তার পিছনে ৪৮ ইঞ্চির একটা ভারি লোহার সিন্দুক। একটা লোহার পাতের আলমারি, একটা কাঠের মাঝারি আকারের কাগজ, ফর্ম, ইত্যাদি রাখার তিন তাকের র্যাক। এসবের আড়ালে খাবার জলের কলসি, চা করার জনতা স্টোভ, গোটা চার-পাঁচ চায়ের কাপ প্রভৃতি।
কলকাতায় ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত ছ-বছর চাকরি করেছিলাম নিউ ইন্ডিয়া অ্যাসুরেন্সের দুটো অফিসে। কোম্পানির মালিক ছিল টাটা-রা। একটি অফিস ছিল পুরোপুরি এয়ার কনডিশনড। ঠিক রাইটার্স বিল্ডিংয়ের পিছনেই তিনতলার পুরোটা নিয়ে সেই বিরাট অফিস ঘর। ঝকঝকে তকতকে সে সময়ের সবথেকে দামী আসবাব এবং সদ্য বাজারে আসা গডরেজ কোম্পানির ধাতব পাতের তৈরি চেয়ার-টেবিল। উপরতলায় অফিসের উপযুক্ত আর্থিক সহায়তা দেওয়া ক্যান্টিন।
আটের দশকের মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে মহাশ্বেতা দেবীর সঙ্গে (তাঁরই কোনো প্রয়োজনে) মন্ত্রী বিনয় চৌধুরী মশাইয়ের রাইটার্সের অফিসে গিয়েছিলাম। বিশাল ঘরখানায় ইংরেজ আমলের মেহগনি অথবা বার্মা সেগুনের বিশাল টেবিলখানা দেখে তাক লেগে গিয়েছিল। চেয়ারগুলোও সেই দামি কাঠের তৈরি। অন্যান্য আসবাবও। কিন্তু শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা ছিল না। পুরানো পর্দায়, গালিচায় ঔপনিবেশিক রক্তাভ রৌদ্রের বিচ্ছুরিত স্বেদ তখনো যেন কিছুটা ছিল। কিন্তু আমার অফিসের ঝলমলে আলোর আভিজাত্য আর শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের অত্যাধুনিক আরাম বিলাসের বন্দোবস্ত সে সময় পর্যন্ত সেখানে ছিল না।
পরবর্তী বছরগুলোতে যেসব গ্রামীণ শাখার উদ্বোধন করেছি অথবা যেসব জায়গায় কাজ করেছি, সে সব জায়গায় গ্রীষ্ম, বর্ষা এবং শীতে যাতায়াতের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা অভ্যাস হওয়াই ছিল ছোটবেলা থেকে। মাটির মেঝেতে ইঁদুর এবং সাপের গর্ত থেকে ইঁদুর অথবা সাপ বেরিয়ে এসে কাঁচা ঘরের শাখা অফিসে সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে। এমন অভিজ্ঞতাও আমাদের কারো কারো হয়েছে।
সেই হিসাবে আমার কপালে জোটা পতিরাম ব্রাঞ্চকে বলতে হবে সোনায় সোহাগা। আমি বালুরঘাট শহর থেকে আধঘন্টার বাসে চেপে ব্রাঞ্চে আসতে পারতাম।
প্রথম দিকে আমার কাজ ছিল সপ্তাহে অন্তত দিন তিনেক গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানো। ঘুরে বেড়িয়ে গ্রামাঞ্চলের সব ধরনের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করা। এ ব্যাপারটা আমার অভ্যাসের মধ্যেই ছিল। বিগত চার-পাঁচ বছর সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে আমি গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়ে গ্রামের মানুষকে নিজে বুঝতে এবং তাদের কিছু বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম।
এবার গ্রামের চাষি এবং ছোটো কারিগর, কামার, কুমার, তাঁতী, ছোটো ব্যবসাদার সবাইকে বলবার এবং বোঝানোর দায়িত্ব হল এই বার্তা পৌঁছে দেওয়া যে চাষের জন্য আর জোতদার মহাজনের কাছে হাত পাততে হবে না। কারিগরকে অর্থাৎ কামার, কুমারকে ছোটো ব্যবসাদারকে আর জোতদার, মালিক, মহাজনের কাছে দেড়া-দুনা ফেরতের শর্তে ভাদ্র-আশ্বিনে আর ঋণ নিতে হবে না। গ্রামে গ্রামীণ ব্যাংকের পত্তন হয়েছে। ঋণ নেওয়ার, সঞ্চয় করার জন্য সবাইকে আহ্বান করতে গ্রামে গ্রামে ঘুরতে লাগলাম আমরা।
চাষে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের উপকারিতা বোঝাতে, চাষের মাঠে অগভীর নলকূপ বসাবার জন্য, ছোটখাটো যন্ত্র, যা দিয়ে দ্রুত অথচ অল্প শ্রমে চাষের নানারকম কাজ করা যায় - এ সব কিনতে ব্যাংকের কাছে আসার জন্য চাষীদের ছোটো ছোটো সভা পর্যন্ত করতাম আমরা।
’৭৬ সালের পুরোটাই ছিলাম পতিরাম শাখায়। ’৭৭ সালের প্রথম দিকের কোনো মাসে বালুরঘাট শহর-সংলগ্ন নদী আত্রাই-এর ওপারে চকভৃগু গ্রামে ব্যাংকের একটি ফিল্ড অফিস খোলা হয়। ফিল্ড অফিসটি পতিরাম ব্রাঞ্চের অধস্তন অফিস হল। প্রথম কিছুদিন সপ্তাহে তিন দিন খোলা হত এই অফিস। অফিসার হিসাবে দায়িত্ব দেওয়া হল আমাকে।
’৭৭ সালে বামপন্থীরা পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসার পর প্রথম থেকেই বর্গাদার বা আধিয়ারদের বর্গা জমির উপর অধিকার বা দখলের স্বত্ব-বিষয়ক আইনকে কার্যকরী করতে তৎপর হল।
১৯৬৯ সালে ইন্দিরা গান্ধী ব্যাংক জাতীয়করণ করেছিলেন। এর ফলে ব্যাংক জেলাস্তরে এবং কিছুকালের মধ্যেই মহকুমা স্তরেও ছড়িয়ে পড়েছিল। গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হলে বড় গ্রাম এবং গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ার ব্যবস্থা হল এবং ব্যাপারটা সম্ভব হতেও লাগল।
চকভৃগুতে আমাদের ব্যাংক পুরোপুরি ব্রাঞ্চ হিসাবে গড়ে ওঠার আগে থেকেই ক্ষুদ্র এবং প্রান্তিক কৃষকদের ঋণ দেওয়া আমরা শুরু করেছিলাম। এতে আমাদের বেশ কিছুটা বেশি পরিশ্রম এবং পতিরাম ব্রাঞ্চ ও চকভৃগুর ফিল্ড অফিসের মধ্যে ছুটাছুটি করতে হচ্ছিল। তবুও শুধু আমার নয়, ব্যাংকের অন্য কয়েকজন কর্মীর মধ্যেও প্রবল উৎসাহ দেখা দিয়েছিল।
চকভৃগুতে ব্যাংক আনার পিছনে আরেকজন মানুষের নেপথ্য অবদানের কথা বলার সুযোগ এতক্ষণে সামনে এল। তাঁর নাম পান্নালাল দাশগুপ্ত। তিনি সেই সময়ের আগে থেকেই ভারত সরকারের প্ল্যানিং কমিশনের একজন সদস্য ছিলেন। সেইসূত্রে পান্নাবাবু (তখন এই নামেই তিনি সর্বত্র পরিচিত হতেন) আমাদের গ্রামীণ ব্যাংকের বোর্ড অব ডিরেক্টরেটে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি ছিলেন। পান্নাবাবু সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গের সবকটি গ্রামীণ ব্যাংকেই কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি সদস্য ছিলেন।
পান্নালাল দাশগুপ্তের পরিচয় আমি কিশোরকাল থেকেই জানতাম। পূর্ব পাকিস্তান থেকে ১৯৫১ সালে এসে আমাদের যৌথ পরিবারের পার্কসার্কাসের ভাড়াকরা বাসায় আমরা উঠেছিলাম। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ওই বাসায় আমরা ছিলাম। আমাদের বাসাটা ছিল ১নং সার্কাস রেঞ্জের তিনতলায়। সার্কাস রেঞ্জ একটা খুব ছোটো রাস্তা। মাত্র গোটা বারো-তেরোটা তিনতলা-চারতলা বাড়ি ছিল সেই রাস্তায়। এই বারো-তেরোটা বাড়ির রাস্তাটা দুই দিকে দুটো নামী রাস্তা দিয়ে সীমাবদ্ধ। একদিকে বেকবাগান রোড, অন্যদিকে তারক দত্ত রোড।
তারক দত্ত রোডের সংযোগে সার্কাস রেঞ্জের শেষ বাড়িটির একেবারে উপর তলার একটি ঘরে পান্নাবাবু আত্মগোপন করেছিলেন তাঁর পার্টির বিপ্লব প্রচেষ্টার বিফলতার পর। আমরা পাকিস্তান থেকে আসার অল্পদিন আগেই তিনি গ্রেপ্তার হয়ে ওই বাড়িটির পাঁচতলার টঙের ঘরটিকে কিংবদন্তি হওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন।
আমরা ওই বয়সেই বড়োদের এসব কথাবার্তায় এই বিষয়ে নিজেদের কাণ্ডজ্ঞান অনুপাতে মোটামুটি একটা আইডিয়া সংগ্রহ করে নিয়েছিলাম। তাছাড়া আমাদের সব থেকে বড়ো দাদা সেই সময় কম্যুনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসায় কিছু কিছু বই এবং কাগজপত্র বাড়িতে আসত।
পান্নাবাবু জেলে থাকাকালীন গান্ধীবাদী রাজনৈতিক আদর্শে আসক্ত হয়ে মার্কসবাদী দর্শন পরিত্যাগ করেন। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি গান্ধীজি প্রদর্শিত পথে গ্রামোন্নয়নের কাজ করতে শুরু করেন।
পান্নাবাবুদের গ্রামোন্নয়ন সংস্থার নাম ছিল টেগোর সোসাইটি ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট। পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি জেলায় টেগোর সোসাইটির সেন্টার ছিল। তার মধ্যে বালুরঘাট মহকুমার তপন থানার বালাপুর গ্রামে একটি।
বালাপুরের রাস্তার দূরত্ব বালুরঘাট শহর থেকে পনেরো কিলোমিটার আর পতিরাম থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার।
পান্নাবাবুদের অনুরোধ মতো পতিরাম থেকে বার দুয়েক আমি অফিসের আর একজনকে সঙ্গে নিয়ে বালাপুরে গিয়ে কয়েকজনকে ঋণ দিয়ে এসেছিলাম। ঋণ গ্রহীতারা সবাই বালাপুরের টেগোর সোসাইটির সভ্য ছিল। অর্থাৎ বালাপুর অঞ্চলের যে কটা গ্রাম টেগোর সোসাইটি উন্নয়ন করার জন্য অধিগ্রহণ করেছিল, ঋণ দেওয়া হয়েছিল সেই ক’টি গ্রামেই।
অনেক দিন আগের কথা সব কথা পরিষ্কার মনে নেই। কিন্তু ব্যাংকের কাগজপত্রের মধ্যে খুঁজলে সব নথি পাওয়া যাবে। মনে নেই কোন তারিখ থেকে আমি চকভৃগু ব্রাঞ্চে পুরোপুরি ম্যানেজার হয়েছিলাম। তবে মনে আছে ’৭৭-’৭৮ সাল থেকেই আমি চকভৃগু থেকেই ঋণ দেওয়া শুরু করেছিলাম। ছোটো চাষিদের ব্যাপকভাবে কৃষিঋণ দিয়েছিলাম একজন ক্যাশিয়ার এবং একজন স্থানীয় যুবককে দৈনিক ২.৫০ (দু টাকা পঞ্চাশ পয়সা) হিসাবে দিয়ে। অর্থাৎ ব্যাংক তাকে ক্যাশ ভাউচারের পিছনে সই করিয়ে মাসিক পঁচাত্তর টাকা দিত। সে একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর সব কাজই করত। টাকার অঙ্কে হাসি পেলেও ’৭০ দশকের প্রথম দিকেও একজন প্রাথমিক শিক্ষকের বেতন ওই সত্তর টাকার মতো ছিল। কয়েক বছর পরে অবশ্য সে এবং তার মতো আরো অনেকজন ব্যাংকের সাবস্টাফ হিসাবে নিয়মিত কর্মচারীর মর্যাদা পায়।
ঠিক কোন বছর থেকে বর্গাদার বা আধিয়ারদের আমরা ঋণ দিতে শুরু করেছিলাম, এখন আর মনে নেই। তবে মনে আছে, দীপিকা খাট থেকে নেমে দাঁড়াতেই বলেছিল, মাসীমাকে ডাক।
মাসীমা আমাদের বাড়িউলি।
আধঘন্টার মধ্যে দ্রুত তৈরি হয়ে একখানা রিকশায় মাসীমার এক কৈশোর উর্ত্তীর্ণা কন্যার পাশে দীপিকাকে বসিয়ে পিছনে পিছনে সাইকেলে আমি চললাম বড়ো হাসপাতালের দিকে। তখন সবে ভোরের সূর্যের আলো পূব আকাশে দেখা যাচ্ছে।
সে দিন রাতের দিকে আমাদের দ্বিতীয় কন্যা শিঞ্জনার জন্ম হল। তারিখটা ছিল ১৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭৭।
দীপিকাকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে বাসায় এসে আমি স্নান-খাওয়া করে চকভৃগু অফিসে চলে গিয়েছিলাম। রাত দশটা নাগাদ নতুন বন্ধু ডেন্টাল সারজন ডাঃ অশোক দত্তের স্কুটারের পেছনে বসে কন্যাদর্শন করে এসেছিলাম রাত এগারোটা নাগাদ। সেটা ছিল ঘোর শীতের রাত। আর সে সময়ে জেলা শহর সেই বালুরঘাটে দুখানা মোটে স্কুটার ছিল। ব্যক্তিগত গাড়ি ছিল একখানা ডাঃ করুণাময় দত্তের। অ্যামবাসেডার খান দুই-তিন ছিল কালেক্টরেটের পুলে। পুলের অন্যগাড়ি বলতে ছিল কয়েকখানা জিপ।
এখন আর আমি ভেবে ঠিক করতে পারছি না যে অপারেশন বর্গার কোন পর্বে এবং ঠিক কোন সময়ে আমরা ব্যাংক থেকে আধিয়ারদের ঋণ দিতে শুরু করেছিলাম। তবে মোটামুটি হিসাব করে বলতে পারি- ১৯৭৮ সালের খরিফ মরসুম থেকেই চকভৃগু শাখা থেকে ব্যাপকভাবে ঋণ দেওয়া শুরু হয়।
গ্রামীণ ব্যাংকের আইনমত আমরা শুধু প্রান্তিক এবং ক্ষুদ্র কৃষক বর্গের অন্তর্ভুক্ত কৃষকদেরই ঋণ দিতে পারতাম। প্রান্তিক কৃষক ছিল সরকারি নিয়মে দু’ একরের নীচে যাদের জমির মালিকানা এবং ক্ষুদ্র কৃষক হল যাদের জমি দু’ একর থেকে পাঁচ একরের মধ্যে। বর্গাদারদের ঋণ দেওয়া শুরু করেছিলাম সম্ভবত ’৭৯-’৮০ সাল থেকে।
রাজনীতিবিদ এবং অর্থনীতিবিদদের মধ্যে অপারেশন বর্গার কারণে পশ্চিমবঙ্গের কৃষিতে কী পরিমাণ উৎপাদন বেড়েছে বা আদৌ বেড়েছে না কমেছে এ বিষয়ে ঘোর বিতর্ক আছে।
তাছাড়া শুধুমাত্র জোতদার-বর্গাদার বিরোধের আইনি নিষ্পত্তিই নয়, জোতদারের লুকোনো জমি পুনরুদ্ধার করে ভূমিহীনদের মধ্যে বন্টন এবং আইনি স্বীকৃতি দিয়ে পাট্টা প্রদান সেই সময় সরকার ব্যাপকভাবেই করেছিল।
আমার অভিজ্ঞতায় অপারেশন বর্গার কারণে পশ্চিমবঙ্গের কৃষিতে উৎপাদনশীলতা যে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
কিন্তু উৎপাদনের বৃদ্ধি ছাড়া আরো দু-একটি ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আমার চোখে ধরা পড়েছে। এই প্রথম এমন ব্যাপকভাবে অত্যাচারী জমিদার-জোতদারদের ছোটো চাষি, মাঝারি চাষি এবং বর্গচাষিরা সমস্ত পশ্চিমবঙ্গেই নিজেদের প্রভূত বলশালী হিসাবে দেখতে পেয়েছিল। এই উপলব্ধি তাদের দলবদ্ধভাবে লড়াই করার সাহস এবং প্রবণতা জীবনের সব ক্ষেত্রেই উদ্যোগী করে তুলেছিল। আমার ধারণা, সম্ভবত এই একটি কারণেই সাড়ে তিন দশক ধরে বামপন্থীরা পশ্চিমবঙ্গে তাঁদের শাসন ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছিলেন।
সেই সময় আমাকে গ্রামেগ্রামে খুবই ঘুরতে হত। উত্তরবঙ্গের ধান উদ্বৃত্ত হয় এমন একটি জেলায় তখন ছিলাম আমি। জোতদারি শোষণ এবং অত্যাচার যে কী ভয়ংকর, সে সবের অভিজ্ঞতা তখন হয়েছিল আমার। ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে কাজ করার সময় একবার সদর থেকে অনেক দূরে এক জায়গায় বন্দুকের লাইসেন্স নবীকরণ করার সময় থানার মধ্যে বসেছিলাম আমি। থানার অফিসার ইনচার্জের সামনে আমার এক জোতদারের রক্তচক্ষু দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। শুধু রক্তচক্ষু না, তিন-চার হাত দূরে দাঁড়িয়ে জোতদার আমাকে শাসাচ্ছিল বন্দুক তাগ করে।
‘গুলি করে মাথার খুলি উড়িয়ে দেব’ - দাঁতে দাঁত চেপে একভাবে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল লোকটি আমার দিকে।
সময়টা ১৯৭৪ সালের জানুয়ারি বা ফেবরুয়ারি মাস। ওই সময়টাতে বন্দুকের লাইসেন্স নবীকরণ হয়। কেননা সরকারি ঋণ, বিশেষ করে সমবায় ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায়ের সময় সেটা। এস ডি ও জেলার থানায় থানায় গিয়ে জোতদারদের বন্দুকের লাইসেন্স রিনিউ করতেন। ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন এস ডি ও। আদেশ ছিল বন্দুক লাইসেন্স নবীকরণের দিন যেন আমরা যে যার দায়িত্বের এলাকার থানায় থাকি। ঋণ বকেয়া থাকলে লাইসেন্স রিনিউ হবে না। ব্যাংকের ঋণ আদায়কারীর কাছ থেকে ঋণ আদায়ের রসিদ নিয়ে এস ডি ও কে দেখালে তবেই লাইসেন্স রিনিউ হবে।
আমি থানার ভিতরে ওসি-র চেয়ার থেকে খানিকটা দূরে একটা চেয়ারে চুপচাপ বসেছিলাম।
জোতদার লোকটির বয়স অনুমান পঞ্চাশের উপর। গত বছর শীতকালেও চক ভগীরথ নামের গ্রামটিতে আমি তার বাড়িতে টাকা আদায় করতে গিয়েছিলাম।
জোতদার বাইরে বেরিয়ে এসে আমাকে বলেছিল, কী চাই?
আমি বলেছিলাম, ব্যাংক থেকে আসছি, ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। আপনার তো লোন -
লোকটি অসম্ভব কর্ত্তৃত্বসূচক ভঙ্গিতে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আমি তো ব্যাংকের চেয়ারম্যান, সেটা জানা আছে?
আমি একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলেছিলাম, না, তা জানি না। কিন্তু –
পরদিন অফিসে গিয়ে জেনেছিলাম যে লোকটি সত্যিই আমাদের ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন বছর তিনেক আগে পর্যন্ত। কিন্তু কী একটা কারণে বছর তিনেক আগে থাকতেই ব্যাংকের পরিচালন সমিতির নির্বাচন হয়নি। ফলে সমবায় দপ্তর থেকে এস ডি ও-কে চেয়ারম্যান করে আপাতত ব্যাংক স্বাধীনভাবেই কাজ চালাচ্ছে।
আমি যখন সমবায় ব্যাংকে চাকরিতে ঢুকেছিলাম, তখন পর্যন্ত সারা রাজ্যে রাজ্যের শাসক দলের লোকেরাই নির্বাচন করে ব্যাংকের কমিটি তৈরি করত এবং সর্বত্রই সমস্ত জেলাগুলোতেই এই জোতদাররাই এই সব কমিটির নেতৃত্বে থাকত।
আমি উত্তর বাংলায় এসে বসবাস এবং কালক্রমে নতুন করে চাকরিতে ঢোকার পর থেকে প্রশাসনের এই সব জটিল বিষয়ে ঢুকতে শুরু করেছিলাম। সত্যি কথা বলতে কি, এর আগে যে তিন-চার বছর সর্বসময়ের রাজনীতিতে ঢুকে ছিলাম, তখন এসবের সঙ্গে কোনো সংস্রবই করিনি।
সেই লোকটিই থানার মধ্যে রক্তচক্ষু নিয়ে বিড়বিড় করতে করতে আমার দিকে বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে আছে!
আমি সন্ত্রস্ত হয়ে উঠে দাঁড়াতেই জোতদার স্পষ্ট উচ্চারণে বলল, ‘গুলি করে মাথার’ -
আমি বিস্মিত হয়ে তাড়াতাড়ি বললাম, ‘কিন্তু কেন –’
চারদিকে অনেকজন লোক। তার মধ্যে পিঠে বন্দুক ঝোলানো আরো জনা তিনেক লোক ছিল। পুলিশের মাস্কেটধারী জনা তিনেক কনস্টেবলও ছিল। তারা সবাই চুপ করেই ছিল।
এস ডি ও-কে যে ঘরে বসানো হয়েছিল, সে ঘর থেকে ও সি কি কাজে বেরিয়ে আসতে জোতদার বিড়বিড় করে সম্ভবত গালাগাল দিতে দিতে বন্দুক নামালো।
ওসি একবার জোতদারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আরে সরকার মশাই, এদিকে আসুন’।
জোতদার ওসির দিকে একবার তাকিয়ে ফের মুখ ঘুরিয়ে আমাকে দেখল। আরেকবার বন্দুকটা তুলে আমাকে বলল, ‘ফের যদি কোনো দিন এই থানায় দেখি –’
চোখেমুখে একটি ভয়ংকর ইঙ্গিত করে ওসির টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল।
সে দিন আমি বাসে করে ফেরার কোনো চেষ্টাই করিনি। এসডিও সাহেবের সঙ্গে আমার আগে দু-একবার সামান্য কথাবার্তা হয়েছিল। সেই সূত্রে বেলা চারটার সময় আমি লাজলজ্জার মাথা খেয়ে তিনি জিপে উঠতেই এগিয়ে গিয়ে বললাম, ‘স্যার, আমি আপনার গাড়িতে উঠতে পারি?’
এসডিও বললেন, ‘আপনিও তো সদরে যাবেন? তা উঠুন, উঠুন।’
আমি সরকারি সহবত অনুযায়ী পিছন দিকে গিয়ে জিপের পিছনের দিকের ঘেরা অংশে উঠে বসলাম। গাড়িটা যদি অ্যামবাসেডার হত, তাহলে আমাকে বসতে হত সামনের দিকে ড্রাইভারের বাঁ দিকে। জিপে ওই জায়গাটা যাঁর গাড়ি (এক্ষেত্রে এসডিও সাহেবের), জিপের সব থেকে সম্মানের জায়গাটিতে বসার অধিকার তাঁর। আটের দশক পর্যন্ত গ্রামাঞ্চলে সরকারি জিপ ছাড়া অন্য কোনো গাড়ির দেখা পাওয়া যেতই না বলা যায়। তাই একটি জিপে ড্রাইভার সহ কখনো কখনো আমরা সাত থেকে ন’জন অক্লেশে অথবা ক্লেশে গ্রামের রাস্তায় যাতায়াত করতাম। পাকা রাস্তার ধারে অবশ্য বাসে করে যাতায়াত করা যেত। কিন্তু সে ছিল ভারী সময় সাপেক্ষ এবং অনিশ্চিত ব্যাপার।
সেই কারণেই সেইদিন আমি এসডিও সাহেবকে ওই অনুরোধ করতে বাধ্য হয়েছিলাম। তার সঙ্গে অবশ্য জোতদারের শাসানির ভয়টাও ছিল। আটের দশক পর্যন্ত বাংলার গ্রামাঞ্চলে জোতদাররা এমনই ভয়ংকর শক্তিশালী গোষ্ঠী ছিল। অল্প কয়েকটি গ্রামাঞ্চলে সাতের দশকের নকশালদের সশস্ত্র প্রচেষ্টায় জোতদারদের দাপট কিছুটা কমলেও, অধিকাংশ গ্রামেই শেষ কথা, তা আইনি বেআইনি যাই হোক না কেন, জোতদারই বলত। বামপন্থীরা ক্ষমতায় আসার পর থেকেই গ্রামাঞ্চলে জোতদারদের দাপট নিশ্চিত ভাবে কমতে শুরু করেছিল।
বাংলার গ্রামাঞ্চলের প্রায় যাবতীয় ব্যাপারের সঙ্গে আমি চাকরিসূত্রে এবং অন্যভাবেও দীর্ঘ সময় জড়িত ছিলাম। চাকরি সূত্রে, রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে এবং সামাজিক কোনো সংগঠনে যুক্ত হয়ে অনেকেই এইভাবে যুক্ত থাকে হয়তো সারা জীবনও।
কিন্তু আমি গল্প লিখতে শুরু করেছিলাম অনেক ছোটো বয়স থেকেই। মানুষকে নিয়ে ভাববার বয়স আমি স্কুল জীবনের বোধের বয়স থেকেই রপ্ত করতে চেষ্টা করেছিলাম। দীর্ঘ এই ভূমিকা লিখতে গিয়ে আমার গ্রাম জীবনের সংস্পর্শের অনেক কথাই মনে পড়েছে। বর্গা নিয়ে গুটি দুয়েক গল্প লিখতেই এবং সেগুলো কলকাতার পত্রিকায় প্রকাশ হতেই সাড়া জেগেছিল।
সব থেকে বেশি উৎসাহিত হয়েছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। চিঠির পর চিঠিতে আমাকে অকৃপন উৎসাহ জুগিয়েছিলেন তিনি। সত্তরের দশকে তাঁর ভারতজোড়া খ্যাতি। একের পর এক অসাধারণ গল্প, উপন্যাস লিখছেন তখন তিনি।
বাংলার তিন বাঁড়ুজ্জে এবং এক ভাদুড়ির সাহিত্যকৃতি এখন পর্যন্ত জাজ্জ্বল্যমান। এই চারজন এখনো বাংলা সাহিত্যের সেরা আসন দখল করে আছেন।
এই সাহিত্যের প্রায় সর্বাংশই বাংলার গ্রামজীবনকে নিয়ে। এই গ্রামজীবনই প্রথম থেকে লক্ষ্য ছিল আমার লেখালেখিতে। এই সংকলনের গল্প এবং নভেলেটগুলিতে একটা সময়ের রাষ্ট্র, রাজনীতি এবং সমাজকে আমি তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি যা ভবিষ্যৎ গবেষকের যেমন দলিল হিসাবে গ্রাহ্য হতে পারে, গ্রামীণ মানুষের সুখদুঃখ-লড়াই-জয়পরাজয়ের কাহিনী হিসাবেও মনে রাখবে সচেতন মানুষ।
এই প্রসঙ্গে আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি মহাশ্বেতা দেবীর সযত্ন প্রয়াসের কথা। আমাকে লেখক হিসাবে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার জন্য তিনি দীর্ঘসময় ধরে আমাকে উৎসাহ এবং উদ্দীপনার রসদ জুগিয়েছেন। আমার লেখা স্বয়ং বিভিন্ন নামী পত্রিকায় প্রকাশের জন্য পাঠিয়ে এবং অনুরূপ আরো নানারকম পরামর্শ দিয়ে আমাকে এই সংকলনের গল্পগুলি লিখিয়ে নিয়েছিলেন। সাত এবং আটের দশকে কলকাতা থেকে প্রায় পাঁচশো কিলোমিটার দূরের একজন উঠতি লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে তাকে লালন করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন মহাশ্বেতা দেবী এবং তাঁর মাধ্যমে আরো দু-একজন বিশিষ্ট সাহিত্য অনুরাগী সম্পাদক ও প্রকাশক। মনে রাখতে হবে তখন এই দূরত্বে যোগাযোগের উপায় শুধু ছিল দীর্ঘ সময়ের বাসযাত্রা, রেলযাত্রা এবং ডাক ব্যবস্থা। সবই আজকের দিনের তুলনায় অতি সময় সাপেক্ষ, দুর্গম এবং কষ্টসাধ্য।
বালুরঘাট থেকে অমল বসু নামে একজন তরুণ তার একক প্রচেষ্টাতেই ‘প্রতিলিপি’ নামে একটি ছোটো পত্রিকা বার করত। ঊনআশি সালের কোনো সময়ে সে একবার কলকাতায় এসে তার ‘প্রতিলিপি’র পুজো সংখ্যা নিয়ে মহাশ্বেতা দেবীর সঙ্গে দেখা করে গিয়েছিল।
মহাশ্বেতা দেবী তাঁর স্বভাব অনুযায়ী পশ্চিম দিনাজপুরের লেখালেখি, পত্রপত্রিকা ইত্যাদি সম্পর্কে নানা কথা জিজ্ঞেস করেন। সেই সূত্রে অমলের কথায় আমার নামও উঠে আসে। অমলের দেওয়া পত্রিকার পুজো সংখ্যায় আমার একটা গল্প ছিল। মহাশ্বেতা দেবী অমলকে ওঠার আগে বলেছিলেন, কলকাতায় এলে অভিজিৎকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বোলো।
সেই বার আমি প্রথম কলকাতা বইমেলায় আসি। তখন পর্যন্ত আমি নিজে থেকে কোনো গল্প কলকাতার পত্রিকায় পাঠাইনি। খুব ছোটো থেকেই আমি প্রত্যাখ্যানের ব্যাপারে খুবই সজাগ। প্রত্যাখ্যাত হলে খুবই ডিপ্রেশনের শিকার হই। মিহির আমার কাছ থেকে দুটি গল্প নিয়ে সেই সময়ের বছর তিন-চার আগে ‘কালি ও কলম’ নামে পত্রিকায় দিয়ে প্রকাশ করেছিল। সে বোধহয় ’৭৪, ’৭৫ সালে। তবুও নিজে কোথাও পাঠাতে পারিনি।
’৭৯ সালের বইমেলা উপলক্ষে কলকাতায় এসে মহাশ্বেতা দেবীর সঙ্গে দেখা করার আমন্ত্রণে তাঁর বালিগঞ্জের বাসায় যাই অনেক দ্বিধা নিয়ে। তাঁর বাড়ির ঘোরানো লোহার সিঁড়ি বেয়ে যখন উপরে উঠছি তখনো ভাবছিলাম যে নেমে যাই, কী না কী ভাববেন! কী ভাবে নেবেন! সিঁড়ির তিন-চার ধাপ নীচে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম।
তিনি তখন ওপর থেকে আমার মাথাটা দেখে ফেলেছেন। ডাক দিয়ে বললেন, ‘কে ওখানে দাঁড়িয়ে? উপরে উঠে আসুন।’
আমি তখনো ভাবছি অমল কি আমায় স্তোক দেওয়ার জন্য ওই কথাটা বলেছিল!
যা থাকে কপালে ভেবে আমি বাকি তিনচারটা সিঁড়ি পার হয়ে সংলগ্ন ঘরে এসে ঢুকলাম।
সেই প্রথম দিনেই প্রায় তিন ঘন্টা কথা বলে চলে এসেছিলাম। তারপরে এসেছিলাম খুব সম্ভবত পরের বছরের বই মেলার সময়। কিন্তু তার মধ্যে চলল অনেক চিঠিপত্র। ততদিনে আমি লিখে ফেলেছি অনেক কটা গল্প, ছোটো উপন্যাস খান দুয়েক - এইসব। ২১/৯/৮০ তারিখের দীর্ঘ চিঠিতে (ফুল স্কেপ কাগজের ঠাসা দু-পৃষ্ঠায়) নিজের এবং আমার লেখা নিয়ে অনেক কথা লিখেছেন।
‘তোমার লেখা ‘আইন ও শৃঙ্খলা’ বর্তিকায়। ‘ব্যবচ্ছেদ’ প্রমায় যাচ্ছে পূজায়। কিন্তু অভিজিৎ, বর্গক্ষেত্রে এ কি করেছ? অসামান্য লেখা হয়েছে। পরশুরাম প্রাকপুরাণিক আয়তন পেয়েছে। তোমার পক্ষে এখন কলম থামানো সম্ভব বা উচিত হবে না। একমাস / পনেরো দিন আগে পেলে কোথাও দিতাম। … বইয়ের জন্য অধীর হোয়ো না - আমার প্রথম উল্লেখ্য গল্পগ্রন্থ স্তনদায়িনী সবে গত বছর বা এবছর বেরোল। অগ্নিগর্ভ বা নৈঋতে মেঘ গল্পগ্রন্থ হিসাবে গণ্য হয় না। এ সব লেখা আমার লেখার ক্ষমতা নেই। আর তোমার লেখায় শিক্ষা, চেতনা, cerebral appeal প্রভূত। …’
আমার ব্যাংকের চাকরি নতুন, ব্যাংকটাই নতুন - ফলে প্রচুর দায়িত্ব এবং পরিশ্রম করতে হচ্ছিল। এই চার-পাঁচ বছর সময়ের মধ্যে আমাকে তিনটি ব্রাঞ্চে বদলি হতে হয়েছে। ফলে অভিজ্ঞতা বাড়ছিল দ্রুত। নতুন নতুন এলাকার মানুষের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগে বাংলাসাহিত্যে প্রায় অপরিচিত এক দিগন্ত আমার লেখনীকে তখন অনেক দিন ধরে ভর করেছিল যেন। মহাশ্বেতা দেবীর উপরোক্ত চিঠির শেষ বাক্য ছিল ‘এখন লেখাই তোমাকে লেখাবে’।
সেই লেখা কটিই আমাকে পরবর্তী চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে লিখিয়েছে। দেবাংশী সংকলনের গল্পগুলি, ক্ষেত্রপাল, ক্রান্তিবলয়, মৌরসীপাট্টা, দীঘি এইসব জমি এবং জমি আশ্রয়ী মানুষের গল্প।
বর্গক্ষেত্র, দেবাংশী, আইনশৃঙ্খলা প্রভৃতি গল্পগুলি লেখার পর কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকার কাছে আমার একটা খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। ব্যাপারটা মোটামুটি আচমকাই হয়েছিল। কেউ কেউ এমনও ভেবেছিলেন যে এই গল্পগুলি আসলে মহাশ্বেতা দেবীই ছদ্মনামে লিখছেন। এমনকি নবারুণ এরকম একটা সন্দেহর কথা খোলাখুলি তাঁর মাকেও বলেছিলেন।
অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে এই গল্পগুলি এবং তিনটি নভেলেট লেখা। এক্ষণ পত্রিকায় ‘বর্গক্ষেত্র’ ছাপা হলে পাঠক মহলে খুবই সাড়া পড়েছিল। কিন্তু আমার কাছ পর্যন্ত সে আলোড়ন পৌঁছানো খুবই কষ্টসাধ্য ছিল। আমি তখন অধীর আগ্রহে দু-তিন জন মানুষের চিঠির জন্য অপেক্ষা করতাম।
মহাশ্বেতা দেবীর ‘বর্গক্ষেত্র’ বিষয়ক চিঠির উদ্ধৃতি একটু আগেই দিয়েছি। ১২/৮/৮১ তারিখে এক্ষণ সম্পাদক নির্মাল্য আচার্যের চিঠিখানা আমার কাছে ওই দূর মফস্বলে অতীব উত্তেজনার কারণ হয়েছিল। এক্ষণ সেই বছর বর্ষার সংখ্যায়ই ছোটো উপন্যাস হিসাবে ‘বর্গক্ষেত্র’ প্রকাশ করেছিল। পত্রিকার ভূমিকায় সম্পাদক লিখেছেন “নতুন প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন লেখকের রচনার জন্য আমরা সাগ্রহে অপেক্ষা করে থাকি অভিজিৎ সেন তেমন একজন তরুণ লেখক। তাঁর ছোট উপন্যাস ‘বর্গক্ষেত্র’ পাঠকদের তৃপ্ত করবে বলে আমাদের ধারণা”।
চিঠিতে নির্মাল্যদা লিখেছেন, “আপনার লেখাটি নিয়ে এখানে বেশ আলোচনা চলছে। দু-চারজন সমালোচনা সূচক মন্তব্য করলেও অধিকাংশ পাঠকের response খুব ভালো। মোট কথা, সবাই পড়ছে। আপনি কি কিছু শুনেছেন?
কারো কারো ধারণা আপনার নামটি ছদ্মনাম। দু-একজন ভাবছেন এ-কাহিনীকে চলচ্চিত্রে রূপ দেবেন! ইত্যাদি” –
২/৯/৮১ তারিখ অর্থাৎ কুড়ি দিন পরের চিঠিতে লিখেছেন, “বর্গক্ষেত্র প্রচুর ব্যক্তি পড়েছেন ও পড়ছেন। চতুর্দিকে বেশ একটা আলোচনাও শোনা যাচ্ছে। অনেকে আমাকে লেখাটি ছাপার জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন। মোট কথা, লেখাটি যে উপেক্ষিত হয়নি, এতে আমি অন্তত খুশি আছি। সরকারি ও বেসরকারি নানা মহলে এ-লেখার কথা উঠেছে। এসব ব্যাপারে মাথা ঘামাবার দরকার নেই। আপনি লিখে যান। বিভিন্ন লোকের মতামত যা আমি মৌখিকভাবে জেনেছি সেসব আপনাকে জানিয়ে লাভ নেই। লিখিত আলোচনা পেলে আপনাকে পাঠাবো। তবে প্রশংসার দিকেই পাল্লা ভারি। বেশ উচ্ছ্বাসপূর্ণ মন্তব্যই শুনছি। চারদিকে লেখালেখির জগতে এমন একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে যে যে-কোনো নতুন সম্ভাবনাপূর্ণ লেখককেই গ্রহণ করতে পাঠক মহল আগ্রহী। সুতরাং এই আপনার সময়!”
নির্মাল্য আচার্যর পরবর্তী চিঠির তারিখ ২৮/৪/৮২। প্রথম বাক্যটি থেকেই কাজের কথা:
“আপনাকে তো চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলাম যে 100 years of solitude আমি ফেরত পেয়ে গেছি! সে চিঠি কি আপনি পাননি?
রহুচন্ডালের হাড় শেষ হলে পড়তে চাই। অপেক্ষায় আছি, আপনি কি May মাসে কলকাতায় আসছেন?....
না, ‘বর্গক্ষেত্র’ নিয়ে শ্যাম বেনেগাল আগ্রহী - এ খবর আমার জানা ছিল না। দেবব্রতবাবুকে পত্রিকা অবশ্য নিজে দিয়েছিলাম। বরং অন্য দু-একজনকে আগ্রহ প্রকাশ করতে শুনেছি।
… ‘দেবাংশী’ ভালো লেগেছে - কিন্তু ওইভাবে ছাপা হলে পড়তে উৎসাহ আমার কমে যায়- ...”
চিঠির প্রত্যেকটি বিষয়ই আমার কাছে প্রবল আনন্দদায়ক এবং উত্তেজক।
(১) One hundred years of solitude নিয়ে আগের সাক্ষাতেই আলোচনা হয়েছিল। গাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেস নোবেল পুরস্কার পাবার আগেই এই বইখানি কলকাতায় সম্ভবত একখানা কপিই এসেছিল। নির্মাল্যদাদের কোনো বন্ধু আমেরিকা থেকে হাতে করে নিয়ে এসেছিলেন। ২২/১১/৮১ তারিখে লেখা দীর্ঘ চিঠিতে লিখেছেন, “(রহুচন্ডালের হাড়কে) তিতাস ও হাঁসুলিবাঁকের সঙ্গে পাল্লা দিতে হবে। কাজটা সোজা নয়। আপনি কি One Hundred Years of Solitude নামে একটি উপন্যাসের খবর রাখেন? লেখক Spanish - বিখ্যাত ব্যক্তি, Gabriel Garcia Marques। বইটি Penguin বার করেছিল ১৯৭২-এ। প্রায় ৪০০ পৃষ্ঠার এই বইটি পড়ে নিতে পারলে মানসিক ব্যাপ্তি অনেখখানি বেড়ে যায়। শুধু জীবন থেকে নয়, সাহিত্য থেকেও লেখককে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়। …”
আমি হয়তো সামান্য কয়েকজন ভারতীয়ের মধ্যে একজন, যে কিনা One Hundred Years - নোবেল পাওয়ার আগেই নির্মাল্যদার আগ্রহে পড়ে ফেলেছিলাম। নির্মাল্য আচার্য আমার বড় লেখক হয়ে ওঠার জন্য এতটাই আগ্রহী ছিলেন।
(২) ‘বর্গক্ষেত্র’ উপন্যাস নিয়ে শ্যাম বেনেগাল আগ্রহী - এমন খবর আমি পেয়েছিলাম রাইটার্স বিল্ডিংয়ের একজন অফিসার পরিমল ব্যানার্জীর কাছ থেকে। পরিমল ব্যানার্জী বালুরঘাট কালেক্টরেটে থাকাকালীন আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়। অপারেশন বর্গা চলাকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার জোতদারি শোষণ নিয়ে একটি উল্লেখযোগ্য ফিল্ম করার ব্যবস্থা করেন। সেই ব্যাপারে রাইটার্সের কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে কেউ কেউ আমার লেখা ‘বর্গক্ষেত্র’র ব্যাপারে উৎসাহী হন। তৎকালীন ভূমি ও ভূমি সংস্কার মন্ত্রী ছিলেন বিনয় চৌধুরী মশাই। তাঁর দপ্তরে সচিব ছিলেন দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। নির্মাল্যদা এই ভদ্রলোকের কাছে ‘বর্গক্ষেত্র’ প্রকাশিত এক্ষণের সংখ্যাটি দিয়েছিলেন। পরে পশ্চিমবঙ্গ সরকার শ্যাম বেনেগালকে দিয়ে একটি বর্গা শোষণের উপর ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি করে। সেই ডকুমেন্টারি আমার বর্গক্ষেত্র নিয়ে নয়।
(৩) ‘দেবাংশী’ গল্প বা নভেলেট নিয়ে আমি প্রভূত আনন্দ পেয়েছিলাম। ‘দেবাংশী’ র মধ্যে আধিয়ার বৃত্তান্ত থাকলেও, সেখানে অন্য একটি বৃত্তান্তই প্রধান। আমার সে সময়ের লেখা মহাশ্বেতাদির নির্দেশমতো আমি তাঁর কাছেই পাঠাতাম। তিনি প্রকাশ্যেই সে সময় বলতেন, “আমি অভিজিতের কলকাতা এজেন্ট!” সেবার পুজোর আগে যে কটি লেখা পাঠিয়েছিলাম সেগুলো কোন পত্রিকায় কী দিয়েছেন, সে কথা চিঠিতেই লিখেছেন। ‘দেবাংশী’ রেখেছিলেন তাঁর নিজের পত্রিকা বর্তিকার জন্য। সে সময় বর্তিকায় সত্তর দশকের প্রায় সব লেখকই গল্প লিখেছেন। স্বাভাবিক কারণেই অত ব্যস্ততার মধ্যে মহাশ্বেতাদির পত্রিকার কাজ দেখা সম্ভব হত না।
ফলে বর্তিকা পুজো সংখ্যাটি হয়েছিল অসংখ্য ভুলে ভরা একটি সংখ্যা। আর নির্মাল্য আচার্যের হাতে তৈরি এক্ষণ পত্রিকার যেকোনো সংখ্যাই ছিল সেসব দিনে একেবারে সব দিক থেকেই আদর্শ।
পরে নির্মাল্যদা আমার কাছে প্রকাশ্যে আফশোষ করেছিলেন। বলেছিলেন, কী গল্পের কী পরিণতি!
নির্মাল্যদা তাঁর কথা রেখেছিলেন। আমার প্রথম বই ‘রহুচন্ডালের হাড়’ তিনি নিজে আগাগোড়া প্রুফ দেখে সুবর্ণরেখা প্রকাশনের দ্বারা প্রকাশ করেছিলেন।
সেই সময়ের আমার লেখালেখির প্রাথমিক উচ্ছ্বাসে যেসব লেখা লিখেছিলাম, এই গল্প এবং উপন্যাসিকা বা নভেলেটগুলি অনেক পাঠককেই মুগ্ধ করেছিল - এতে কোনো সন্দেহ নেই।
অভিজিৎ সেনের আগামী গ্রন্থ ঘাম রক্তের মাটির (পরবাস থেকে প্রকাশিত হবে) ‘কথামুখ’।