ও দিকের ঘুমপাড়ানি ছড়ার মধ্যে একটি ছিলো -
আয় ঘুম আয়।
শেয়ালে বেগুন খায়!
তারা তেল কোথা পায়?
তারা ডোবা থেকে
জল তুলে তুলে
তেল বলে বলে খায়!
তারা নুন কোথা পায়?
তারা রাস্তা থেকে
বালি তুলে তুলে
নুন বলে বলে খায়!
সে যুগের সমঝদার শিশুরা এটি শুনে আর জেগে থাকতে পারতো না, তক্ষুণি ঘুমিয়ে পড়তো - অন্ততঃ আমাদের ওদিকে।
হুগলিতে (ব্যান্ডেলে) আমাদের বাড়ির খিড়কীর ঘাটের নীচের ধাপগুলো গঙ্গার জোয়ারে আর ওপরের ধাপগুলো গঙ্গার বানে ডুবে যেতো কিনা, তাই ওই ছড়াটা শুনলেই আমার বাবা চটে উঠে বলতেন - আঃ বলেছি না ওটা ডোবা নয়, নদী হবে।
এ হেন ঘোরতম উচ্চাঙ্গের কাব্যময় কৃষ্টির বৃষ্টির জন্যেই হয়তো ক্ষীণদৃষ্টি সদাশয় রেল কোম্পানি সাহেব বাহাদুর মহাশয় ব্যান্ডেলে জংশন সৃষ্টি করেন।
ওই মহাকাব্যের দ্বিতীয় পংক্তিটির সত্যতা আমি নিজে একবার প্রত্যক্ষ করেছিলাম। সত্যি। দাঁড়ান পাঠিকা, একটু জিরিয়ে নিয়ে বলছি।
প্রথমেই বলে রাখছি যে যে চরিত্রটিকে এই কাহিনীতেও দেখতে পাবেন ভাবছেন সে চরিত্রটি এখানে অনুপস্থিত, যদিও তার পিসির যাকে বলে একটা ক্যামিও রোল এখানে আছে। তাতে যদি আপনার এই লেখা পড়বার ইচ্ছেটা উবে যায় তো দয়া করে এটি নামিয়ে রাখুন, আমার কিছু করার নেই। বিখ্যাত লেখকদের মতো বানিয়ে বানিয়ে ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে কথা বলে সেই চরিত্রটিকে এখানে টেনে আনলে আপনাদের ভারী মজা হতো, তাই না? হুঁঃ! zoৎতো সব!
প্রসঙ্গতঃ মনে পড়ে গেলো - দিদা একবার আপনাদের ওই ফেভারিট চরিত্র সম্বন্ধে বলেছিলেন "কি ঝানু রে বাবা, ওটাকে পুঁতে দিলে গাছ হয়ে গজিয়ে উঠবে!" আমি অন্য কাউকে কারোর সম্বন্ধে কখনো এই কথা বলতে শুনিনি!
যাক গে।
আমাদের দিকে দুরকমের শেয়াল হতো। খ্যাঁকশেয়াল আর শুধু শেয়াল বা পাতিশেয়াল। শেষোক্তদের একজন সদ্য-শেঁকা লিট্টি চুরি করতে এসে আমাদের পাশের বাড়ির আবগারি সেপাইয়ের সুগৃহিণী আমাদের পুষ্পা ভাবীর হাতে চড় খেয়ে দেশ ছেড়ে পালায়, পাড়ার ডিম দেওয়া মুরগী গুলো বেঁচে যায়। ওই শেয়ালরা ছিলো ছোট কুকুরের সাইজের। ধূসর রঙের।
খ্যাঁকশেয়াল সাইজে বেড়ালের চেয়ে একটু ছোট। রঙ লালচে। মুখ ছুঁচলো। ল্যাজের শেষটা ফিকে রঙের, প্রায় সাদাটে।
পরস্পরের শত্রু ওই দুটি শেয়ালের জাত আবার কুকুরদের মহাশত্রু। তাও, প্রচুর বুদ্ধির জোরে কিন্তু সবাই মোটামুটি বেঁচে বর্তে থাকতো।
দিদা কোনদিকে আছেন সেটা আড়চোখে দেখে নিয়ে চট করে পাঁচিলের ওপর দিয়ে রেল লাইনের দিকে প্রত্যেকবার একই জায়গায় একটা আস্ত কুলোয় করে উনুনের ছাই ফেলতো আপনাদের ফেভারিট চরিত্রের পিসি আমাদের কাজের লোক চম্পার মা। দিদা কাছাকাছি থাকলে অবিশ্যি খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে ঘুরে গিয়ে সেই একই জায়গায় ছাইটা ফেলে আসতো সে।
ওই ভাবে আস্তে আস্তে গড়ে উঠেছিলো পাঁচিলটার বাইরে সেই জায়গাটায় একটা ঢালু ডাঁই। ছাইগাদা।
বেনারস এক্সপ্রেসের হাতে একদিন সন্ধ্যে আটটা দশে বিধবা হয়ে গেলো আমাদের পাড়ার অন্তঃসত্বা খ্যাঁকশেয়ালনী। দিন কয়েক আপ বেনারসকে যুদ্ধং দেহি বলে ভয় দেখিয়ে বেচারী হাল ছেড়ে দিলো। তারপর এসে আমাদের পাঁচিলের বাইরে ওই ঢালু ইষদুষ্ণ ছাইগাদায় গর্ত করে থাকা শুরু করলো।
আমাদের উঠোনটা ছিলো মস্ত বড়। পেয়ারা, সিঙ্গল শিবটগর, ডবল বিষ্ণুটগর, কাগজী লেবু, পাতি লেবু এ সব ছিলো। শুঁয়োপোকা ধরে না এমন একটা সজনে গাছ ছিলো। ছিলো দাদুর বেশ কিছু দিশি বিলিতি গোলাপ। আর ছিলো আমার টমেটো বেগুন কাঁচালঙ্কা ফুলকপি। ইত্যাদি। পোস্টকার্ডে লিখে পাঠালে ভিপিপিতে বীজ চলে আসতো পুণার পেস্টনজী পোচা বা রাসেল স্ট্রীটের সাটন বা হগ মার্কেটের সামনে লিন্ডসে স্ট্রীটের গ্লোব নার্সারি থেকে।
সেবার পুজোর আগে গ্লোবের শীতের বেগুন বুনেছিলাম। বড়দিনের আগেই কয়েকটা বেশ তৈরি হয়ে উঠলো।
তা একদিন সকালে উঠে দেখলাম
(ক) আমার ফক্স টেরিয়ার জ্যাকি তার চটের কম্বলের মধ্যে থেকে চোখ বন্ধ করে নাক ডাকিয়ে "পাহারা" দিচ্ছে
(খ) একটা পুরুষ্টু বেগুন নেই; আরে, বললাম তো, নেই মানে নেই
(গ) হিসেবে গোলমাল করে ফেলে পাশে দুটি অতি ক্ষুদ্র সন্তান ও সামনে অর্ধভুক্ত সেই বেগুনটি নিয়ে পাঁচিলের গায়ে একটি ফুটোর তলায় ভয়ে ও শীতে কম্পমতী খ্যাঁকশৃগালিনী - খুব সম্ভব ঘুমন্ত জ্যাকিকে দেখেই অর্ধমৃতা
আমাদের দেখেই সন্তানদের মায়া ত্যাগ করে বেটী সেই পাঁচিলের ফুটো দিয়ে হাওয়া হয়ে গেলো। আর জেগে উঠে যতক্ষণ না আমি বকুনি দিয়ে থামালাম ততক্ষণ জ্যাকি শেয়ালের ছানাদুটোকে ভয় দেখাতে লাগলো - গররর গররর - ফক্স টেরিয়ার কিনা। পাঁচিলের ফুটোটা মাটি থেকে কিছুটা ওপরে ছিলো, তাই ওই নেংটি ইঁদুরের সাইজের ছানা দুটো পালাতে পারছিলো না।
দিদা বললেন - আহা রে
আউটহাউসের ভেতরের দরজা দিয়ে চলে এসে চম্পার মা বললো - জেকিকে বললেই মেরে দেবে। বলি?
দিদা বললেন - আহা রে
ছানাদুটো যে পিতৃহীন তা না জেনে দাদু আমাকে বললেন - ওদের দুজনকে বাইরে রেখে এসো তো বাবু, ওদের বাবা মা এসে ঠিক নিয়ে যাবে
(লক্ষ্য করুন, "ও দুটোকে" নয়, "ওদের দুজনকে"!)
দিদা বললেন - আহা রে
আধখাওয়া বেগুনটা আর নোংরামতো ভূত দুটোকে নিয়ে রেললাইনের ধারের পুটুসঝোপের পাশে রেখে দেবার জন্যে খিড়কী দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি, দেখি মা-টা সেখান থেকেই তাকিয়ে রয়েছে। কাছাকাছি গিয়ে ব্যাটাদের ছেড়ে দিতেই সোজা তিন জনে পুটুসের ভেতর। বেগুনটা ফেলে রেখেই! একেবারে যাকে বলে নিশ্চিন্তি!
পাঁচিলের ফুটোটা ভাবলুম একবার বাইরে থেকে দেখি। ও মা, অত না কি বুদ্ধিমান জন্তু, বোকামি করে ছাইগাদার একদম ওপরে মাথার কাছে সিঁধটা কেটেছে। তাতে ছানা দুটো সহজে ঢুকেছে হয়তো, কিন্তু ভেতর থেকে বেরোবার সময়ে? তখন কি হবে?
বাড়ির জ্যাকি আর বাইরের মটকা আমার ধমকে খ্যাঁকশেয়াল শিকারের চেষ্টা তার পর থেকে থামিয়ে, অন্ততঃ কমিয়ে, দেয়।
"উচ্চশিক্ষা"র জন্য কলকাতা চলে আসি পরে। তখনও শেয়াল তিনটে ফলমূল তরিতরকারী পাখপাখালি মাছ ভাত খেয়ে পাড়াতেই দিব্যি ছিলো।
তেল আর নুন কোথা থেকে জোটাতো কে জানে!