• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯০ | এপ্রিল ২০২৩ | প্রবন্ধ
    Share
  • “সবুজ ধান”—ভিয়েতনামের আধুনিক কবিতা : অংকুর সাহা



    || ১ ||

    ভিয়েতনামের কবি লাম থি মাই জা-র জন্ম ১৯৪৯ সালে। প্রথমে তাঁর নামের পরিচয়টুকু সেরে নিই। “লাম” হল পদবী অথবা বংশনাম; “থি” শব্দটি হল নারীত্বের পরিচায়ক। মা তাঁর নাম রেখেছিলেন “মাই জা”। শব্দবন্ধটির বাংলা করলে দাঁড়াবে “সুন্দর নিশীথিনী”। অর্থাৎ কবি হলেন লাম পরিবারের কন্যা অথবা বধূ, যাঁর নিজের নাম “সুন্দর নিশীথিনী”। ইংরেজি বানানে নামটি লেখা হয় Lam Thi My Da.

    ১৯৪৯ সালে মধ্য-দক্ষিণ ভিয়েতনামের কোয়াং বিন প্রদেশের লা থুই জেলার একটি গ্রামে তাঁর জন্ম। দেশটি তখন ফ্রান্সের অধীন। ১৯৫৪ সালে দিয়েন বিয়েন ফু’র পতনের পর পাততাড়ি গুটালো ফ্রান্স—তার জায়গায় এসে জুটলো আমেরিকা। দেশনেতা হো চি মিন যে-কোন বিদেশি দস্যুর সঙ্গেই যুদ্ধে পেছপা নন। এই যুদ্ধের ফাঁকে ফাঁকেই মাই জা-র বেড়ে ওঠা এবং কবিতা লেখার শুরু—আমেরিকায় যার নাম ভিয়েতনাম যুদ্ধ, ভিয়েতনামে যার নাম মুক্তিযুদ্ধ অথবা স্বাধীনতা সংগ্রাম। কোয়াং বিন প্রদেশে চলেছে দীর্ঘস্থায়ী, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ—যার ফলে ব্যাহত হয়েছে সাধারণ মানুষের জীবন। ১৯৭৫ সালে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটলে কবি শুরু করেন তাঁর শিক্ষাক্রম। ১৯৮৩ সালে ভিয়েতনামী লেখকদের কলেজ থেকে সাহিত্যের ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর সরকারি বৃত্তি নিয়ে যান মস্কোর বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন গোর্বাচভের আমলে রাশিয়াতে উদারপন্থার পত্তন ঘটেছে। ফলে তিনি দেখতে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন বরিস পাস্তেরনাকের দাচা (dacha) অর্থাৎ গ্রাম্য খামারবাড়ি। সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা একটি কবিতা “পাস্তেরনাকের বাগানে পাইন শংকু” এখানে সংকলিত হল।

    ১৯৮৮ সালে তিনি রাশিয়া থেকে সৃজনশীল সাহিত্যের উচ্চতর শিক্ষার ডিগ্রি পেলেন এবং দেশে ফিরে কাজকর্ম শুরু করলেন। প্রথমে সাংবাদিকের এবং পরে পত্রিকা সম্পাদকের। কবিতে লেখা শুরু করেছিলেন যুদ্ধ চলাকালীন, এখন তাঁর সঙ্গে যোগ হল প্রবন্ধ ও শিশুসাহিত্য। বর্তমানে তিনি মধ্য ভিয়েতনামের হুয়ে শহরে বাস করেন; তিনি ভিয়েতনামী লেখক সংস্থার একজিকিউটিভ বোর্ডের সম্মানীয় সদস্য এবং থুয়া থিয়েন হুয়ে-র লেখক সংস্থার সভানেত্রী।

    ভিয়েতনামী ভাষায় শ্রীমতী লামের পাঁচটি কাব্যগ্রন্থের কথা জানতে পারা গেছে—

    “উর্বরা হৃদয়” (“The Fertile Heart”), প্রকাশ ১৯৪৭;
    “যে কবিতায় তারিখ নেই” (“Poem without Date”), প্রকাশ ১৯৮৩;
    “গুছিয়ে রাখি আমার সময় “(“Gathering My Years”), প্রকাশ ১৯৯০;
    “মা ও শিশু” (“Mother and child”), প্রকাশ ১৯৯৪;
    “স্বপ্নের কাছে নিবেদিত” (“Dedicated to a Dream”) প্রকাশ ১৯৯৮।

    এ ছাড়া শিশু সাহিত্যের তিনটি জনপ্রিয় গ্রন্থ—

    “ভূমির অতি পরিচিত গান” (“Well-known songs of the Soil), প্রকাশ ১৯৯৪;
    “হরিণশিশু এবং নদী” (“The Fown and the Stream”), প্রকাশ ১৯৯৭;

    “অনন্ত পুরস্কার” (“The Eternal Reward”), প্রকাশ ১৯৯৭।

    কবি হিসেবে ভিয়েতনামের বেশিরভাগ সেরা পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। ভিয়েতনাম লেখক সংস্থার একাদেমি পুরস্কার দুবার এবং ভিয়েতনামের শিল্প ও সাহিত্যের জাতীয় সংযুক্ত সংস্থার সর্বোচ্চ পুরস্কার একবার। ইংরেজি ও আইরিশ ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর কবিতা; রুশ ও ফরাসি ভাষায় অনুবাদের কাজ চলছে। বিদেশি ভাষায় তাঁর কবিতা অনুবাদের ক্ষেত্রে বাংলা হল পঞ্চম ভাষা।

    || ২ ||

    মার্থা কলিন্‌স (জন্ম ১৯৪০) মার্কিন কবি এবং ওবারলিন কলেজে সাহিত্যের অধ্যাপিকা। তিনি অনেকদিন ধরে ভিয়েতনামী সাহিত্যে আগ্রহী। ১৯৯৪ সালে তিনি হুয়ে শহরে গিয়ে কবির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেই সময় শ্রীমতী লামের মাত্র দু-তিনটি কবিতার ইংরেজি অনুবাদ হয়েছে। মার্থা উৎসাহ প্রকাশ করেন শ্রীমতী লামের কবিতার ইংরেজি অনুবাদে, কিন্তু তাঁদের আলাপ তেমন জমেনি—কারণ একজনের ইংরেজি ভাঙা ভাঙা, অন্যজনের ভিয়েতনামী খুবই দুর্বল এবং কাজও একেবারেই এগোয়নি। ভাগ্যক্রমে তো দিউ লিন নামে যে কবিতাপ্রেমী মহিলা তাঁদের মধ্যে দোভাষীয় ভূমিকায় ছিলেন তিনি কয়েক বছর পরে বস্টনে এলেন স্নাতকোত্তর শিক্ষার জন্যে। শ্রীমতী তো-র সঙ্গে কবির অনেক দিনের পরিচয়, তাঁর কবিতারও তাই; তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হল মার্থা কলিনসের। নব্বই দশকের শেষ ভাগে শ্রীমতী কলিন্‌স আর শ্রীমতী তো মিলে যৌথ উদ্যোগে শুরু করলেন লাম থি মাই জা-র কবিতার সিরিয়াস অনুবাদ কর্ম। প্রথমে একটি কবিতার প্রতিটি লাইনের আক্ষরিক ইংরেজি করতেন তো; তারপর তাকে কবিতায় রূপ দিতেন কলিন্‌স। এর পরে দুজনে পর্যায়ক্রমে ঘষামাজা করতেন তাকে; এবং দুজনের সন্তুষ্টি ঘটলে তখনই সম্পূর্ণ হত অনুবাদকর্ম।

    ২০০০ সালের গ্রীষ্মে শ্রীমতী লাম বস্টনে এলেন দু হপ্তার জন্যে কবিতার একটি কর্মশালায় যোগ দিতে। ওই একই সময়ে অন্য এক কাজে বস্টনে এসেছিলেন ভিয়েতনামী-মার্কিন লেখিকা থুই দিন। তিনিও লামের কবিতার বিশেষ অনুরাগী। দুজনে প্রতিদিন সন্ধে বেলা অধ্যাপক কলিনসের সঙ্গে বসে চালু করলেন কবিতার নির্বাচন, আলোচনা এমনকী কিছু কিছু অনুবাদ। হু-হু করে কেটে গেল দু হপ্তা, ভিয়েতনামে ফিরে গেলেন কবি স্বয়ং। কিন্তু বস্টনে বসে তাঁর কবিতা নিয়মিত অনুবাদ করে গেলেন মার্থা এবং থুই। বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্রপত্রে প্রকাশিত হতে থাকলো ইংরেজি অনুবাদগুলি—মার্কিন পাঠকেরা দেখতে পেলেন আধুনিক ভিয়েতনামী কবিতার একফালি আকাশ। ২০০২ সালে কেভিন বাওয়েল এবং নুয়েন বা চাঙ-এর যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশিত হল “ছ’জন ভিয়েতনামী কবি” (“6 Vietnamese Poets”) নামে একটি সংকলন—প্রকাশক কার্বস্টোন প্রেস। সেখানে ১৯৪১ থেকে ১৯৪৯ সালে জন্ম ছ’জন ভিয়েতনামী কবির ৮১টি কবিতা থাকল। লাম থি মাই জা এই সংকলনের সর্বকনিষ্ঠা কবি—তাঁর ১৭টি কবিতা স্থান পেল। সেখান থেকে শুরু—তারপর ২০১৫ সালে কার্বস্টোন প্রেস প্রকাশ করলেন “সবুজ ধান” (“Green Rice”)—লাম থি মাই জা-র নিজস্ব কাব্যগ্রন্থ; মার্থা কলিন্‌স এবং থুই দিন-এর অনূদিত কবির ৫৬টি নির্বাচিত কবিতা; অর্ধেকের বেশি কবিতা কবির স্বনির্বাচিত—বাকিগুলি দুই অনুবাদক বেছে নিয়েছেন নিজেদের পছন্দমত।

    আমি এই গ্রন্থের থেকে কবির নানান বয়েসে লেখা, বিভিন্ন স্বাদের, বিভিন্ন মেজাজের বারোটি কবিতা বেছে নিয়েছি বাংলা অনুবাদের জন্যে। যদিও অনুবাদ হয়েছে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে, আমি আপিসের ভিয়েতনামী সহকর্মীদের দিয়ে মূল কবিতাগুলি পড়িয়ে নিয়েছি, যাতে কানে শুনে মূল কবিতার ছন্দটি খানিকটা হলেও হৃদয়ঙ্গম করা যায়।

    || ৩ ||

    যুদ্ধের আগুনে পুড়ে মাই জা-র কবিতার জন্ম এবং সেই যুদ্ধের বীভৎসতা ও বিষণ্ণতা দীর্ঘস্থায়ী ছায়া ফেলেছে তাঁর কাব্যকৃতির উপর। এছাড়া রয়েছে ভিয়েতনামের রূপসী কবিতা—মধ্য ভিয়েতনামের থুয়া থিয়েন হুয়ে প্রদেশের রাজধানী হুয়ে শহরে বহুদিনের বসবাস তাঁর; শহরের মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়েছে সং হুয়ং বা অপরূপা সুগন্ধী নদী—তার জলের রং সবুজ, দুধারে ঘন জঙ্গল—গাছের ছায়া পড়ে নদীর জলে; জঙ্গল পেরিয়ে দূরে নু বিন পর্বতমালা। কবির কবিতায় এই পরিবেশটি জীবন্ত। মে মাস থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত প্রতিদিন বৃষ্টি পড়ে; বছরে প্রায় ৭১ ইঞ্চি বৃষ্টি হয়, দিগন্ত অব্দি গাঢ় সবুজ এবং নারী-পুরুষ ছেলে-বুড়ো সকলের মাথায় টোকা। এই পরিবেশের সঙ্গে আন্তরিক সাযুজ্যই মাই জা-র কবিতার মেরুদণ্ড। যুদ্ধ তাকে আঘাত দিয়েছে কিন্তু ভেঙে ফেলতে পারেনি। “ধানের সোনালি রঙ ক্লাস্টার বোমার রঙে মেশে” (রাতের ফসল); বোমার গর্তগুলি হয়ে দাঁড়ায় প্রকৃতির, পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

    প্রকৃতি ও ভিয়েতনাম যুদ্ধ মাইজা-র কাব্যকৃতির দুটি প্রধান স্তম্ভ। যুদ্ধের অপরিসীম ক্ষয়ক্ষতি প্রধানত বইতে হয়েছে ভিয়েতনামের সাধারণ মানুষকে; কেউ কোনদিন সঠিকভাবে গণনা করেনি, কিন্তু এক নিযুতের বেশি ভিয়েতনামী মানুষের মৃত্যু ঘটেছে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে। কেবল ভিয়েতনামের মানুষই নয়, যেসব কমবয়েসি (বেশিরভাগ কালো, বাদামি এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত) মার্কিন সৈন্যকে তাঁদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে পাঠানো হয়েছিল যুদ্ধে, তাঁদের জীবনেও নেমে এসেছিল ট্র্যাজেডি। মাই জা-র কবিতায় নিজের দেশের মানুষ ছাড়াও মার্কিন সৈন্যের দৃষ্টিকোণটিও এসে ওতপ্রোতভাবে মিশেছে। সুজলা সুফলা দেশটির অপূর্ব দৃশ্যাবলী, তার উদ্ভিদ ও প্রাণীকুলকে (flora and fauna) কবি আজীবন নিবিড়ভাবে চেনেন—তার এক অনন্য ছবি কবির রচনায়। সেই সঙ্গে নারীর জীবন, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বে স্বাধীন, শিক্ষিত নারীর প্রেম ও মাতৃত্ব, সন্তান পালন, দৈনন্দিন জীবনের উপকরণ তাঁর সাহিত্যের উপজীব্য। ঠিক পশ্চিমী অর্থে নারীবাদী না হলেও তিনি কবিতায় নারীর সমানাধিকারের কথা তুলেছেন অপ্রত্যক্ষভাবে বার বার—কনফুসিয় সমাজে তা নিষিদ্ধ বিষয় এবং সমাজবাদও তাতে খুব একটা দাঁত বসাতে পারেনি। উদাহরণ, “তুমি নাকি আমার উপযুক্ত?” কবিতাটি।

    ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষপ্রান্তে মরিস ডুর‍্যান্ড এবং অন্যান্য ফরাসি সাহিত্য সমালোচকেরা শুরু করেন ভিয়েতনামী সাহিত্য নিয়ে গবেষণা। বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকে সেই কাজ নতুন করে শুরু হয় আমেরিকায়। ১৯৭৯ সালে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে প্রকাশিত “ভিয়েতনামী কবিতার ঐতিহ্য” (“The Heritage of Vietnamese Poetry”)—মূলত প্রাচীন ও মধ্যযুগের কবিতার প্রথম প্রামাণ্য সংস্করণ। তার পর গবেষণার কাজ এগিয়েছে মূলত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৯৬ সালে ইয়েল থেকে বেরিয়েছে “ভিয়েতনামী কবিতার সংকলন” (“An Anthology of Vietnamese Poems”)—তাতে যে কেবল আধুনিকতম কবিরা রয়েছেন তাই নয়, আছেন ভিয়েতনামের বাইরে বসবাসকারী কবিদের রচনাও।

    ভিয়েতনামের কবিতা এগিয়ে চলেছে পৃথিবীর অন্য দেশগুলির আধুনিক কবিতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে। আশা রাখি সেই কর্মযজ্ঞের এক প্রধান ব্যক্তিত্বের রচনার আংশিক হলেও পরিচয় পাওয়া যাবে এখানে।

    বিশেষ কৃতজ্ঞতা স্বীকার: আধুনিক ভিয়েতনামী কবিতার সবুজ অরণ্যে আমার পা ফেলা শ্রীমতী মার্থা কলিন্স এবং শ্রীমতী থুই দিন-এর সক্রিয় সহায়তায়। অপরিসীম কৃতজ্ঞতা আর আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই তাঁদের।


    সায়গনের বৃষ্টি / লাম থি মাই জা (১৯৪৯—)

    একই সঙ্গে
    আমাকে ভেজায়
    বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি
    সায়গনের বৃষ্টি
    আর আবেগপ্রবণ প্রেমের বাণী
    বন্য উদ্দামতায়
    জলপ্রপাত হয়ে ভাসায়

    মেঘ জমা আকাশ
    পুরুষের বুকের মতন
    ভারী, ঈষৎ বক্র
    তার দরজা ভাঙে আর
    দমকে দমকে বেরোয় প্রেম
    প্রেম প্রেম প্রেম

    বিবাহিতা নারী ভাসাতে পারে না নিজেকে
    দগ্ধে মরি যখন কন্যা ছিলাম
    এমন বৃষ্টির দেখা পাইনি কেন


    তুমি কি আমার উপযুক্ত?

    ধানের দানা যদি পৃথিবীকে শুধোয়
    তুমি কি আমার উপযুক্ত?

    গাছ যদি বাতাসকে শুধোয়
    তুমি কি আমার উপযুক্ত?

    মেঘ যদি আকাশকে শুধোয়
    তুমি কি আমার উপযুক্ত?

    তুমি অনন্ত বিশাল আকাশ
    আমি তাতে মেঘ হয়ে ভাসি
    তুমি প্রবল বেগে বও বাতাস
    আমি বৃক্ষ জড়াতে চাই তোমায়

    আমি গভীর গহন ধরিত্রী
    আমি পাকা ধান প্রণাম করি তোমায়

    কিন্তু প্রশ্নের রেশ থেকেই যায়
    হৃদয়ের আনাচে কানাচে
    তুমি কি আমার উপযুক্ত?

    (Are You Good Enough?)


    স্বপ্নের কাছে নিবেদিত

    পাখি তার ঠোঁটে স্বপ্ন আনে আবার উড়ে যায়
    ছোট ছেলেটি ঘুমোয় তারাভরা আকাশের নীচে
    কোন চিন্তাই নেই তার মনে
    কী স্বপ্ন দেখলি রে কাল সোনা?
    স্বপ্ন দেখি আমি পাখি হয়ে গেছি
    কিন্তু স্বপ্ন-পাখি কথা বলতে শিখল কী করে?
    পাখিটা আসলে মৎস্যকন্যার মতন
    কথা কয় না
    তার প্রতিটি উজ্জ্বল সঙ্গীত
    আজীবন মনে রেখে দেয়
    একজনকে উপহার দেবে বলে

    সহস্র রজনী ধরে উড়ান
    সহস্র তারার পথে উড়ান
    গাছের পাতারা পৌরাণিক রঙে ঝলমলে
    ফুলেরা সাজানো হাতের আঙুলের মতন
    ঘুমোও বাছা ঘুমোও
    ঘুমোও এখন

    ছেলেটি কে?
    ছেলেটি আমি
    পাখিটি কে?
    পাখিটি আমি
    স্বপ্নটি কে?
    স্বপ্নটি আমি

    কাল রাতে
    স্বপ্নে আমি হয়েছি আমি
    স্বপ্নে আমি হয়েছি পাখি
    স্বপ্নে আমি হয়েছি স্বপ্ন

    (Dedicated to Dream)



    জানলায় বেড়াল

    যখন গভীর রাতে জীবন দুঃসহ মনে হয়
    কবিতার কথা ভাবি—হালকা, পালক ভারহীন
    যখন আসে না নিদ্রা, শুয়ে থাকি একাকী নীরবে
    মানুষের কথা ভাবি, ভুলে যাওয়া অতীতের ঋণ

    হঠাৎ বেড়াল এসে দাঁড়িয়েছে জানলার পাশে
    সবুজাভ চোখ মেলে সবুজ নক্ষত্রপানে চায়
    বসে থাকে জানালায় নীরব মূর্তির মত স্থির
    তারা ভরা আকাশের ঝকমকে পটভূমিকায়

    সীমাহীন ভালোবাসা জীবনকে জানাই আবার
    দুঃখ চিন্তা মনে নেই, আজ আমি নির্ভার স্বাধীন
    জানলা দিয়ে চেয়ে থাকি, বেড়াল আকাশপানে চায়
    চেয়ে থাকে, চেয়ে থাকে স্বচ্ছ কবিতার মত প্রায়

    (Cat in the Window)

    উর্বরা হৃদয়

    হৃদয়ে খোপ কেটে রাখা হয় দুঃখ
    সুখ, আকাঙ্ক্ষা ও আরো সব
    প্রেমের খোপ খালি করে এনেছি তোমার জন্যে
    আশার খোপ রেখে দেব আমার সন্তানদের জন্যে

    অপেক্ষার খোপ রয়েছে বেশ কয়েকটা
    আমার মা যখন যুবতী ও সুন্দরী
    সে যুগের পুরুষেরা প্রতারক নয়
    কিন্তু মা দুঃখ ভোগ করল একা

    ঝড়ের বিরুদ্ধে, জলপ্রপাত পেরিয়ে
    গভীর নদীতে নৌকা বাইলে মা
    গোপন করলে দুঃখ, দিন গুনলে
    আমাকে পুষ্টি দিলে নিজের শরীরে

    কত রাতে এমন অশ্রু ভরেছে তাঁর চোখে?
    কার সঙ্গে সে ভাগ করে নিতে পারবে দুঃখ?
    জন্মের পর আমি যখন কেঁদে উঠলাম প্রথম
    মায়ের শুকানো হৃদয় সজীব হল আবার

    জীবন এখন প্রশস্ত পথ, সম্ভাবনায় ভরা
    হৃদয় আবার স্পন্দিত হয় শান্ত রূপে
    মা তাঁর হৃদয় দান করেছেন তোমায়
    প্রেমময় হৃদয়, কোমল অথচ উষ্ণ

    মাঝবয়েসে হৃদয়ে আমাদের পুনর্জন্ম
    আমাদের শিশুরা ঘুমপাড়ানি গান গায়
    হেমন্তের রং গভীর নীল
    সোনালি ধান, মেঘেরা ঘন শাদা

    হৃদয়ের গোলকটি লাল এবং ভরা
    সকাল থেকে সাঁঝ, দিন থেকে রাত
    জীবন যখন ফুরিয়ে ফুরিয়ে সমাপ্ত
    জননীর হৃদয় ভালবাসে আকাশ ও পৃথিবী

    (The Fertile Heart)



    পাস্তেরনাকের বাগানে পাইন শংকু

    দু হাতে ধরেছি ভঙ্গুর পাইন শংকু
    আমার প্রাচীন দুঃখের ওজনে ভারী
    পাইন শংকুগুলি ঘন্টার মতন
    নীল দিগন্ত থেকে নেমে আসে
    ভোরের অনচ্ছ বাগানে তাদের পদধ্বনি

    ঘাসের গহনে
    তোমার হৃদয় ঘন্টা হয়ে ঢং ঢং বাজে
    বাগানে পাইন শংকু ঝরে যায়
    নীরব অশ্রু হয়ে

    (A Pine Cone in Pasternak’s Garden)


    সবুজ ধান
    আমার সুহৃদ টি টি এইচ এং-এর জন্যে

    সবুজ ধানের গরমভাত সবুজ পদ্মপাতায় মোড়া।
    তোমার হৃদয় উদার ও দয়ালু
    অনেক দূরে তুমি, প্রতিটি ভাতের দানায় তুমি
    জীবনে খানিকটা হলেও মিষ্টতা রয়ে যায়

    বয়েস হয়েছে তবু তুমি এখনো শিশুর মতন
    তোমাকে আমি ভাতের দানায় দেখি
    ফিকে সবুজ রঙে চোখ পড়লে কান্না পায়
    অপাপবিদ্ধতা উবে যায় এক মুহূর্তে

    মাঠের গন্ধমাখা ভাতের মিষ্টি স্বাদ
    মনে পড়ে বিন্দু বিন্দু মায়ের স্তনের দুধ
    এক একটি ভাতের দানায় আয়নার মতন
    শৈশবের ছবিগুলি দ্রুত ভেসে যায়

    হাতের নাগাল এড়িয়ে ওড়া গঙ্গাফড়িং
    সবুজ ধান, শিশির গলে তার গায়ে
    আহ্‌ জিভের ওপর ভাত রেখে ভাবতে ইচ্ছে করে
    তুমি আমাকে ফিরিয়ে নেবে শৈশবে

    (Green Rice)

    টীকা—ইংরেজ “rice” শব্দটির বাংলা হতে পারে “ধান”, “চাল” অথবা “ভাত”। তাই অনুবাদের সময়ে আমাকে সাবধান হতে হয়েছে। ধানগাছের সবুজ রঙ হতে পারে কিন্তু চাল বা ভাত সাধারণত সবুজ হয় না। অনুসন্ধান করে জানা গেল যে খাদ্যটির ভিয়েতনামী নাম “কোমে”। ধান পেকে ওঠার আগেই তাকে কেটে ও ঝেড়ে ফেলে, সেই ধান আগুনে সেঁকে খলনুড়িতে গুঁড়ো করে কোমে বানানো হয়। যেকোন পুণ্য কাজ শুরু করার যোগ্য এই শুদ্ধ ও শুচি খাবার—দেবতার কাছে নিবেদনের জন্যেও। সবুজ আভা বেরোয় তার থেকে আর মিষ্টিবাদামের মতন স্বাদ। হেমন্তে ফসল কাটার সঙ্গে যুক্ত নানান পরবে এই খাদ্যটি বহুব্যবহৃত।


    গুছিয়ে রাখি আমার সময়

    আজকে আমার জনম দিন
    ধৌত আকাশ, শুভ্র মেঘ
    আজকে আমার জনম দিন
    সোনা রঙ বালু, সূর্যদেব

    চব্বিশ সাল পহেলে ভাই
    জন্ম দিলেন আমাকে মাতা
    চুলে ঝরে তাঁর বৃষ্টি জল
    বরফে জমেছে জামার হাতা

    মায়ের ছিল না মাথায় ছাদ
    বাপ সে তো দূরে পালিয়ে বাঁচে
    পাথরের গায়ে ফুটবে চারা
    গায়ে তার পাতা ফুলেরা নাচে?

    তোমার জন্ম আমারো আগে
    শৈশব সুখী, শান্তিময়
    সারাদিন খাও, গাও ও নাচো
    উষ্ণ আবাসে পরাণ বয়

    তুমি জানতে না কোথায় কবে
    প্রসূত হয়েছে একটি প্রাণ
    জানতে না তুমি আমার কথা
    দূরের বাতাসে তোমার ঘ্রাণ

    স্নেহ ও সুখের বর্ম ছাড়াই
    আমি কোনমতে বাড়তে থাকি
    মা গাইতেন দুঃখী “কা গাও”
    ঘুম পাড়ানোর জন্যে না কি

    তুমি যদি হতে পাশের গাঁয়ে
    খেলতে আসতে আমার ঘরে
    দোলনায় যবে শায়িত আমি
    ঠেলতে পরম মমতা ভরে

    আমি জানতাম বাতাসে ভাসে
    জননীর ঘুম পাড়ানি গান
    জানতাম আমি হাওয়ায় ডাকে
    ঘাসের গোপন কাতর টান

    চব্বিশ সাল পহেলে ভাই
    সময়ের ছিল বেজায় দাম
    জীবনের এক অচেনা নদী
    সাগরের পানে চলার টান

    আমিও ছিলাম সূর্যের ভাঁজে
    আলোকিত এক উজ্জ্বল সাজে

    বুকের কোটরে গন্ধ নানান
    বাতাস তাহলে কোথায় যায়?
    আমি তার কথা মরমে শুনে
    জন্মদিনের ডালি সাজাই

    যতদিন আছে আমার প্রাণ
    জন্মের দিন সে চলমান
    মৃত্যুর দিন আসার আগে
    অসম্ভবের স্পর্শ লাগে

    ভেবেছি তোমার ধরায় বাঁচি
    অন্য ধরায় সময় কাটে
    পৃথিবীকে ভালো বাসব বলে
    দুদণ্ড থেমে পথের ঘাটে

    জন্মদিনের কুড়ানো ফুলে
    ভরেছে আমার হাতের মুঠো
    জীবন সঁপেছি তোমারে হাতে
    সূর্য ও হাওয়া বন্ধু দুটো

    টীকা—“কা গাও” (“Ca Dao”) হল এক হাজার থেকে দু হাজার বছরের পুরানো ভিয়েতনামের প্রাচীন কবিতাশৈলী। ছন্দের ছোট ছোট সরল কবিতা ফিরত মানুষের মুখে মুখে অথবা গাওয়া হত বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই। ঘুমপাড়ানি গান, বিবাহের গান, শোকসন্তপ্ত পরিবারের বিলাপ, ভিখারির গান, মাঝির গান—সব কিছুই রচিত হয়েছিল এই প্রাচীন শৈলিতে। গত এক দশকে মার্কিন ও ভিয়েতনামী গবেষকরা এই গানগুলিকে যন্ত্রে ধরে রাখতে এবং লিপিবদ্ধ করতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।


    রাতের ফসল

    টোকা পরা মাথাগুলি বৃত্তাকারে বের হয়ে আসে
    আমাদের শৈশবের শব্দহীন আকাশের মত
    বক হয়ে ডানা মেলে নিশীথের উন্মুক্ত প্রান্তরে
    শাদা শাদা বৃত্ত রচে দিগন্তেও শুভ্রতা ছড়ায়

    ধানের সোনালি রঙে ক্লাস্টার বোমার রং মেশে
    বোমার বিলম্বিত ফিউজেও আতংক জাগে না
    অনেক বছর যুদ্ধে আমাদের সংকল্পেরা দৃঢ়
    এসো বোন, সমবেত, ফসল কাটার লগ্ন এলো

    আমাদের অন্তরেও একটি করে ক্ষুদ্র চাঁদ আছে
    সোনালি ধানেতে গড়া কার্পেটে জ্বল জ্বল করে তারা
    গ্রামের চাষীদের মেয়ে আমরা ফসল কাটি সুখে
    এক ডজন শাদা টোকা নিশীথের আঁধার উজ্জ্বল
    আমাদের ভয় নেই বুলেটে ও পড়ন্ত বোমায়
    চুলের লেবুর গন্ধ, শিশির চুম্বন করে তাকে
    (Night Harvest)

    প্রতিধ্বনি

    শব্দ অনেক
    মুক্ত অপার
    নীরবে আলো
    অনুরণন

    নক্ষত্রের প্রতিধ্বনি
    ঝলসে ওঠে চোখের নীড়ে
    বৈকুণ্ঠের অনুরণন
    নীরবে ভাসে মুখের তীরে

    দুলছে ঘাসের প্রতিধ্বনি
    খট খট খট ঘোড়ার খুরে
    ছাদের গোপন শব্দগুলি
    ওই নিহিত কপাটজুড়ে

    চাঁদের আলো
    বেহালা জুড়ে
    নদীতে সময়
    ওঠে ও পড়ে

    তার কৃশ হাত
    পত্র ছুঁয়ে
    জ্বলছে আগুন
    ঠোঁটের ফুঁয়ে

    নোনতা বিষাদ
    চোখের জলে
    অপেক্ষায়
    প্রদীপ জ্বলে
    আকাশ পাথর
    উল্কা পড়ে
    ব্রহ্মাণ্ড
    দুহাত ধরে
    (Echoes)

    কর্পূর গাছের সারি

    অন্তরে যেই বিষাদ জাগে
    তোমার কাছে আসি
    সারি সারি কর্পূর গাছ
    আমার সুখের রাশি

    সবুজ গোল পাতার ফাঁকে
    জেড পাথরের আকাশ
    ফলের মতন বাতাস ঝরে
    ফিসফিসানি দূরের পথে বাঁকা

    গাছের ছায়ায় হাঁটতে গিয়ে
    ভাবি না আমি শিশু
    বৃক্ষ বাড়ে দৈর্ঘ্যে আড়ে
    আমার মতই, কী সুখ

    অনুতাপে লাভ ক্ষতি কার
    পাতায় হবে জরা
    হলুদ পাতা দরজা হয়ে
    আকাশটাকে সরায়

    কর্পূরের গন্ধ আসে
    সত্তায় ও নাকে
    রাতের ঘুমে দিনের জাগায়
    দেখতে পারি তাকে

    সারি সারি কর্পূর গাছ
    হুয়ে শহরে আমায়
    ধরে রাখে বেঁধেও রাখে
    বিষাদটাকে নামায়
    (Row of Camphor Trees)

    বোমা ক্রেটার আকাশ

    লোকে বলে, গ্রামে তুমি ছিলে রাস্তা বানানোর মজুর
    আমাদের দেশ এতটাই ভালোবেসেছিলে
    যে ছুটে বাইরে বেরিয়ে আকাশে আলো দেখালে তুমি
    তারপর মার্কিন বোমা পড়ে তোমার গায়ে, হায়
    এবং সেনাদের যাওয়া আসার পথটি অক্ষত থেকে যায়

    আমাদের ইউনিট যখন সেই ভাঙাচোরা রাস্তায় গেল
    বোমার খোঁদল দেখে তোমার কথা মনে পড়ে
    তোমার সমাধি দ্যুতিময় পাথরে দীপ্যমান
    তোমায় ভালোবেসে রাশি রাশি পাথর, লক্ষ্মী মেয়ে

    তোমার মৃত্যু-বোমার গর্তে তাকিয়ে দেখি
    তাতে জমা বৃষ্টির জলে একফালি নীল আকাশ
    দয়ালু আমাদের মাতৃভূমি
    আকাশের জলধারা মোছে ধরার বেদনা

    মাটির অনেক নীচে শুয়ে আছ তুমি
    আকাশ সাগ্রহে ঝুঁকে রয়েছে তোমার গহ্বরে
    তোমার আত্মা রাতে পথ দেখায়
    জ্বলজ্বলে ধ্রুবতারার মতন
    তোমার নরম ফর্শা ত্বক কি করে
    আকাশের শাদা মেঘ হয়ে যায়?

    সূর্যালোকিত আকাশের নীচে হাঁটি
    তোমার নিজস্ব আকাশ
    আর ওই জ্বলজ্যান্ত চিন্তিত গোলক
    সূর্য, নাকি তোমার হৃদয়
    আমাকে আলো দেখায়
    যখন আমি একা দীর্ঘ পথ হাঁটি?

    পথের নামই আসলে তোমার নাম
    তোমার মৃত্যু এক বালিকার নাম লেখা নীল আকাশ
    তোমার জীবন আলোকিত করে আমার আত্মাকে

    আর আমার বান্ধবীরা যারা তোমায় দেখেনি কখনো
    প্রত্যেকের মনে তোমার মুখের আলাদা আলাদা প্রতিচ্ছবি
    (Bomb Crater Sky)

    টীকা: ভিয়েতনামের এক জনপ্রিয়তম কবিতা। উত্তর ভিয়েতনামের একটি বাচ্চা মেয়ের সাহস ও বীরত্বের কাহিনী। বালিকাটি রাস্তা তৈরির কামিন। রাতে বোমার বিমানের আওয়াজ শুনে লন্ঠন নিয়ে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়েছিল সে। ধানখেতে তার আলো দেখে ভিয়েতকং ভেবে তার গায়ে বোমা ফেলে মার্কিন বিমান। ফলে তাদের নিজের হাতে তৈরি করা রাস্তাটি অক্ষত থেকে যায় ভিয়েতনামী সৈন্য চলাচলের জন্যে। অনেক দিন ধরে তার মৃত্যুস্থানটি দেখতে আসত লোকজন এবং পাঠ করত এই কবিতাটি।
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments