সন্দীপদার সঙ্গে আমার পরিচয়ের সাল/তারিখ সঠিক মনে নেই। সম্ভবত ১৯৮৪/৮৫ হবে। আমার এক বন্ধু ও পত্রিকা-সম্পাদক কলকাতা নিয়ে একটা কবিতা সংকলনের পরিকল্পনা করে। কবিতা সংগ্রহের দায়িত্ব আসে মূলত আমার ওপর। আমি বুঝতে পারি, এ কাজে সন্দীপদাই একমাত্র ভরসা। আমার মনে পড়ে, কি পরম নিষ্ঠায়, অধ্যবসায়ে, হাসিমুখে একটার পর একটা পত্রিকা র্যাক থেকে নামিয়ে দিয়েছিলেন সন্দীপদা। আমি অক্লেশে কাজ করে গেছি। কাজ ছাড়াও কত গল্প, কত আড্ডা। সন্দীপদাই বলেছিলেন এই লাইব্রেরি গড়ে তোলার আশ্চর্য কাহিনি।
মাত্র একুশ বছর বয়েসে স্কটিশ চার্চ কলেজে বাংলা নিয়ে স্নাতক স্তরে পড়ার সময়ে একদিন আলিপুরের ন্যাশানাল লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখেন মেঝেতে স্তূপ হয়ে ধুলোর মধ্যে অনাদরে পড়ে আছে অজস্র লিটল ম্যাগাজিন। জঞ্জালের মতো এসব পত্রিকা নাকি ফেলে দেওয়া হবে। কলেজপড়ুয়া তরুণ সন্দীপ দত্ত লিটল ম্যাগাজিনের এই অপমান সহ্য করতে পারেননি। নিজেই লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। ১৯৭৮ সালের ২৩ জুন, ১৮ এম টেমার লেনের পৈতৃক বাড়ির এক তলাতেই শুরু হল সেই মহাযাত্রা। লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরির সূচনা। কলেজ স্ট্রিটের পথে ঘুরে ঘুরে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাচীন পত্রিকাগুলিকে নিয়ে আসতেন নিজের বাড়িতে পরম ভালোবাসায়। পরবর্তী সময়ে, রেজিস্ট্রেশন সূত্রে লাইব্রেরির নাম হয় ‘কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র’।
গত ২৬ নভেম্বর, ২০২২ কলকাতার মহাবোধি সোসাইটি হলে ৩৩তম সমাবর্তন উৎসবে সন্দীপদাকে একটু অসুস্থ মনে হয়েছিল। খুব ধীরে ধীরে হাঁটছিলেন, কেউ ধরলে যেন একটু জোর পান। তবুও ডায়াসে উঠে স্বাগত ভাষণ দিয়েছিলেন খুব সংক্ষেপে। ২০২৩-এর কলকাতা বইমেলায় সন্দীপদা অনুপস্থিত। জানতে পারলাম তিনি খুবই অসুস্থ। তারপর যে এত তাড়াতাড়ি এই পৃথিবীর মাটি ছেড়ে সন্দীপদা চলে যাবেন ভাবতে পারিনি। মনে পড়ে যাচ্ছে তারাশঙ্করের সেই বিখ্যাত উক্তি ‘জীবন এত ছোট কেনে...’। মৃত্যু অনিবার্য এই সহজ সত্যটা আমরা জানি। কিন্তু কখনো কখনো এই অনিবার্য সত্যকে মেনে নিতে বড় কষ্ট হয়। যখন সন্দীপদার মতো মানুষ চলে যান, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা একজন সাধক, যার সাধনার কেন্দ্রবিন্দুতে শুধুই লিটল ম্যাগাজিন। সন্দীপদা একক চেষ্টায় যা সংগ্রহ করেছিলেন, তার কোনো তুলনা ছিল না।
একটা সময় নিজের জীবিকার তাড়নায় লাইব্রেরি যাওয়া প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কলকাতা বইমেলায় দেখা হোত নিশ্চিত। বিপুল আন্তরিকতার কোনো খামতি ছিল না। শুধু বলতেন, ‘সময় পেলে মাঝে মধ্যে লাইব্রেরিতে এসো।’ নীরব স্নেহের আলো ছড়ানো এ দৃষ্টির সঙ্গে আর কোনো দিন দেখা হবে না। আমার জন্মদিনে সন্দীপদার কাছ থেকে আসত পোস্টকার্ড বা ইনল্যান্ড লেটার--জন্মদিনের শুভেচ্ছা। মনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ত একরাশ আনন্দ। বেশ কয়েক বছর পর ডাকবাক্সে ধুলো জমতে শুরু করে, আসে না আর জন্মদিনের শুভেচ্ছা। এসবের জন্য আমি তো নিজেই দায়ী। আমি তো খোঁজ নিইনি সন্দীপদা কেমন আছেন! আমি তো বহুদিন লাইব্রেরি যাইনি। এ অনুশোচনার যেন শেষ নেই কোনো। নিজের জীবিকার তাড়না হয়তো এতটাই অসামাজিক।
সন্দীপ দত্ত এখন ‘নেই মানুষ’দের দলে। প্রতি সপ্তাহে মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শনি আর রবিবার নিয়মকরে লাইব্রেরি খুলে বসবেন না সন্দীপদা। আমরা যেন তাঁকে শুধু গ্রন্থাগারিক হিসেবেই মনে না রাখি, তিনি ছিলেন এই সময়ের এক প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব যার প্রমাণ তাঁর ছোট ছোট অকপট লেখা। তাঁর জীবন জুড়ে শুধুই লিটল ম্যাগাজিন। লিটল ম্যাগাজিনের ধুলোয় তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস। লিটল ম্যাগাজিনের কণ্ঠস্বর যেন তাঁরই কণ্ঠস্বর। কজন বলতে পারেন ‘প্রতিটা দিনই হয়ে উঠুক লিটল ম্যাগাজিন দিবস’। শুধু বলা নয়, এই বোধ নিয়েই সন্দীপদার যাপন, এই প্রতিজ্ঞা নিয়েই সন্দীপদার স্বপ্ন ও জাগরণ। যেসব পত্রিকা সম্পাদক লাইব্রেরিকে সৌজন্য সংখ্যা দিতেন না, আমি নিজে দেখেছি ‘পাতিরাম’ থেকে নিজের মাইনের টাকায় মাসের শেষেও সেসব পত্রিকা কিনছেন। সন্দীপদা সিগারেট ছেড়ে দিয়েছিলেন, সেই পয়সায় কিনতেন লিটল ম্যাগাজিন। সন্দীপদার সম্পাদনায় প্রকাশিত হত ‘উজ্জ্বল উদ্ধার’। কত দুষ্প্রাপ্য লেখা যে প্রকাশিত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। সন্দীপদা গড়ে তুলেছিলেন ‘লেখক ব্যাংক’, বলতেন ‘বহিরাগত তো কি, তোমার জেতার জন্য পড়ে আছে গোটা শহর, তোমার কলম কথা বলুক’--এই আত্মবিশ্বাস গ্রাম-মফস্বলের কত অনামি লেখকের মনের ভিতরে পুরে দিতেন সন্দীপদা। ভরসা যোগাতেন। এই শহরে এমন মানুষ আর কতজন আছেন? সন্দীপদার লাইব্রেরিতে সবার গুরুত্ব ছিল সমান। ধোপদুরস্থ সপ্রতিভ তরুণ আবার মলিন মুখ, কলার ফাটা শার্ট পরিহিত যুবক, সন্দীপদার কাছে সবাই আদৃত।
লিটল ম্যাগাজিনের জন্য নিবেদিত প্রাণ এই মানুষটা নিজের স্বার্থ ও স্বাস্থ্যর কথা চিন্তা না করে ছুটে গিয়েছেন বিভিন্ন জেলার ও গ্রামাঞ্চলের নানা লিটল ম্যাগাজিন মেলায়। অনামি কোনো পত্রিকার সম্পাদক লাইব্রেরিতে এসে আঞ্চলিক কোনো লিটল ম্যাগাজিন মেলায় যাবার জন্য আমন্ত্রণ জানালে তিনি ভীষণ খুশি হতেন। নির্দিষ্ট দিনে চলে যেতেন শহর ছাড়িয়ে দূর-দুরান্তে। ভাবেন নি নিজের স্বাচ্ছন্দের কথা। এখন মনে হয় তিনি যদি নিজের শরীরের প্রতি একটু যত্নবান হতেন তাহলে হয়তো ছোট ছোট পত্রিকাগুলো তাদের অভিভাবককে আরো কিছুদিন কাছে পেত। তা তো হল না। তাহলে কি ভাববো লিটল ম্যাগাজিনের জন্যই সন্দীপদাকে চলে যেতে হল? লিটল ম্যাগাজিনের জন্যই সন্দীপ দত্ত অর্জন করলেন শহিদের সম্মান? জানি না, সবকিছু কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
আর একজন সন্দীপ দত্ত কতদিনে আসবেন বা এই স্বার্থপর সময়ে আদৌ আসবেন কিনা জানা নেই, নিজের লেখা না সাজিয়ে কে আর অন্যের মনে প্রদীপ জ্বালাতে অপরের লেখা যত্ন করে তুলে রাখবে! সন্দীপদা ক্ষমতার উল্টোদিকে বসার মানুষ। এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিল তাঁর। তিনি যদি বুঝতে পারতেন যা হচ্ছে তা ঠিক হচ্ছে না, সেখান থেকে নীরবে সরে দাঁড়াতেন। লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্রের অপরিসীম গুরুত্বের কথা আমরা হয়তো মনে রাখব, কিন্তু লাইব্রেরির তাক থেকে খুঁজে খুঁজে নির্দিষ্ট পত্রিকার ভেতর লুকিয়ে থাকা লেখাটির খোঁজ দেবে কে? কিংবা বিকল্প লেখাপত্রর সন্ধান? জানা নেই। এটা তো ঠিক, কোনো বইয়ের খবর, ম্যাগাজিনের রেফারেন্স, কিংবা কোনো জটিল বিষয় গবেষণার জন্য তথ্য সংগ্রহের প্রশ্নে যে ঠিকানা বলা যায়, সেটা হল ‘কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র’। ‘সন্দীপদা না থাকা মানে একটা সময়ের হঠাৎ সামনে থেকে মুছে যাওয়া। একটা লড়াইয়ের মাঝপথে যেন হঠাৎ থমকে যাওয়া’।
ভাস্কর চক্রবর্তীর একটা কবিতার দু’একটা লাইন মনে পড়ল ‘যে আগুনে পুড়বো আমি, সে আগুন,/কিছুটা আলাদা করে বইয়ের পাতার/ মধ্যে সরিয়ে রেখেছি’। সন্দীপদার মৃত্যুর সঙ্গে এই লাইন তিনটির আদৌ কি কোনো সাযুজ্য আছে? হয়তো আছে কিংবা নেই। তবু মনে হয়, নিমতলা মহাশ্মশানের অগ্নিগহ্বরের কিছুটা আগুন তিনি সরিয়ে রেখেছেন হাজার লিটল ম্যাগাজিনের কালো অক্ষরমালার মধ্যে, লিটল ম্যাগাজিনের সেই আগুনের মধ্যেই সন্দীপদা জেগে থাকবেন চিরভাস্বর হয়ে।