• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯০ | এপ্রিল ২০২৩ | গল্প
    Share
  • কমবখ্‌ৎপু্রের কাণ্ডজ্ঞানহীন হুরী : ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত



    নিরুলা’জে আইস্‌ক্রীম


    দুপুরের খাওয়ার পর নিজস্ব দিবাস্বপ্ন দেখতে দেখতে আমরা দুজন পম্পার ঘরে গিয়ে ঢুকেছিলাম। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের নতুন বেরোনো রবীন্দ্রনাথের গান বাজছে ক্যাসেটে।

    কে জানিত আসবে তুমি গো, অনাহূতের মতো...


    আমি পম্পাকে বললাম – দেখো, বাঙালিদের মধ্যে কত বড় একজন সুফী এসেছিলেন। কিন্তু মীরের মতো অসংযমী ছিলেন না রবীন্দ্রনাথ। এই একটা ভুলে তাঁর সর্বনাশ হয়ে গেল।

    পম্পা ভুরু কুঁচকে বলল - অসংযমী ছিলেন না বলে সর্বনাশ হয়ে গেল?

    জবাব দিতে যাচ্ছি, হঠাৎ নিচ থেকে কলরব ভেসে এসেছে উপরে। হুড়মুড় করে দুতলায় চলে এল তানিয়া আর সপ্‌না। আগে আমি কে কী পরেছে সেটা দেখেও মনে রাখতে পারতাম না। বিশেষ করে মেয়েদের জামা আমার একদম চোখে পড়ত না। যবে থেকে পম্পার দান করা একটা নীল স্কার্ট আমার সম্পত্তি হয়ে গেছে তবে থেকে মাথায় কিছু ভর করেছে। এখন মেয়েরা কে কী পরে আছে সেটা অনায়াসে লক্ষ্য করি এবং ‘নিজের’ ব্লু স্কার্টের সঙ্গে তুলনা করে ভাবি কারটা ভালো। সুতরাং আমার চোখ এড়াল না যে সপ্‌নার পরনের বিদেশী ব্র্যাণ্ডের জিন্‌স্‌টা বিশুদ্ধ ডেনিম নয়, নাইলন মেশানো। গোলাপী সুতির টপটা নাভির ঠিক এক ইঞ্চি তলায় শেষ হয়েছে। তানিয়ার গায়ে পম্পার মতো স্কার্ট আর ব্লাউজ। তফাৎ রঙে। পম্পারটা সাদা আর সবুজ, তানিয়ার সব কিছুই নীল।

    তানিয়ার অনুরোধে তার ফ্লাস্ক থেকে রোজ খানিকটা করে জল নিয়ে আমি গত এগারোদিন ধরে শিবের মাথায় ঢেলে এসেছি। তানিয়া উপরে এসেই ঘোষণা করল সে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আমাদের আইস্‌ক্রীম খাওয়াতে নিয়ে যাবে।

    আমরা বেরিয়ে আসছিলাম। রবীন্দ্রনাথের গান হচ্ছে শুনে সপ্‌না আর তানিয়া বলল – টাগোর নাকি? শুনি, শুনি।

    পম্পা বলল – এই বজ্জাতটা বলছে টাগোর অসংযমী ছিলেন না বলে তাঁর জীবন নষ্ট হয়ে গেছে।

    তানিয়া আর সপ্‌না এমন মর্মন্তুদ ব্যথায় গুঙিয়ে উঠল যেন তাদের বাপ-ঠাকুর্দার মুখে আমি চপ্পল মেরেছি।

    একটা চিন্তা-উদ্দীপক থিওরি আগেই তৈরী ছিল। সেটা এদের কেমন লাগে জানার জন্য বললাম – কেন বলেছি শোনো। সে জমানার বাঙালীরা আর ইংরেজী জানা অবাঙালীরা গুরুদেব বানিয়ে দিয়ে রবীন্দ্রনাথের মতো একটা পুরোদস্তুর আশিক মানুষের জীবনটা তছনছ করে দিয়েছিল। মীর বা গালিবকে মোঘলরা কেউ কবিগুরু বলে পূজো করেছে শুনেছ? তাঁরা যা ইচ্ছে বলতে বা করতে পারতেন। এদিকে বেচারা রবীন্দ্রনাথকে আজীবন ফার্স্ট বেঞ্চের তটস্থ ফার্স্ট বয়ের মতো কাটাতে হয়। সেই জন্য শান্তিনিকেতনের ক্লাসে ফার্স্ট বেঞ্চ থাকত না।

    তানিয়া পম্পার দিকে চেয়ে বলল – জয় নিজে কোন বেঞ্চে বসে রে?

    - লাস্ট। যেন আমাকে ধুলোর মতো ঝেড়ে ফেলছে এমনভাবে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে খবরটা দিল পম্পা।


    *****


    সপ্‌না তার বাবার স্ট্যান্ডার্ড গাড়ি (পেল্লায় গোঁফওয়ালা বুড়ো ড্রাইভার সমেত) সঙ্গে নিয়ে এসেছিল। পরে সেটাতে করে আমরা কমলানগরের নিরুলা’য় গিয়ে বসি। ড্রাইভারের আইসক্রীমে রুচি নেই বলে সপ্‌না তাকে হাণ্ডিওয়ালার চাট কিনে গাড়িতে দিয়ে এল। বাকিরা সবাই নিল দুটো করে টুটি-ফ্রুটির স্কুপ। তানিয়া ঠিক করেছে আমার হয়ে অর্ডার দেবে। সে জোর খাটিয়ে একটা সুবিশাল ব্যানানা স্প্লিট নিতে বাধ্য করল আমায়।

    গরমের অলস দুপুরগুলোতে চেয়ারে বসে ঝিমোনো উচিত না পা নাচানো, এই বিতর্কটা নাকি কলেজের ছেলেমেয়েদের মধ্যে খুব চলছে আজকাল। তানিয়া-সপ্‌নারা মনের আনন্দে সেটা শুরু করেছিল। পম্পা আর আমিও যোগ দিলাম এবং অচিরেই জমে ওঠে আসর। কখন যে আমাদের মাথার উপর দিয়ে বক্‌ওয়াসের বক উড়তে উড়তে উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরুতে চলে গিয়েছে সেটা বুঝিনি।

    পা নাচানোই সময় কাটানোর শ্রেষ্ঠ উপায় – এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যখন সবাই মিলে একসঙ্গে পা নাচাতে যাব, তখন হংস্‌রাজ কলেজের সামনে অজগরের মতো শুয়ে থাকা ছাত্র মার্গের উপর আকাশে তানিয়া যেন ভূত দেখল। ঠিক আমাদের মতো চেহারার চারটে বেকার মেঘ এলোমেলো হাওয়ায় পরস্পরের থেকে চিরকালের মতো দূরে সরে যাচ্ছিল নাকি। পম্পা কলেজের জন্য চলে যাচ্ছে চণ্ডীগড়। সপ্‌না যাবে বম্বে। ভীষণ ভাবুক হয়ে গিয়ে তানিয়া বলল – আর কবে দেখা হবে জানি না। কে জানে হয়তো মরেই যাব।

    সপ্‌নাকে বেশি ভাবালু হতে দেখিনি। সে হঠাৎ যেন তানিয়ার চেয়েও বিষণ্ণ হয়ে গিয়ে বলল - এই সময়টা আর আসবে না। জয়, যাওয়ার আগে আমাদের সবাইকে নিয়ে ঘন্টেওয়ালার হালুয়ার মতো তাজা আর গরম একটা গল্প বানিয়ে দাও না? তাহলে আরো কিছুক্ষণ বসে থাকা যায়।

    তানিয়ার আনানো ব্যানানা স্প্লিটের একটা বিরাট চাঁই চামচে তুলে আমি বলেছিলাম – টাগোরের গল্প শুনবে? এরকম আঁধি আর জোলো হাওয়ার দিনের জন্য তাঁর একটা দারুণ ভূতের গল্প আছে।

    - না, না। তোমার মতো লাস্ট বেঞ্চার থাকতে টাগোর কেন? গরমের ছুটি শেষ হতে চলল। আমাদের মধ্যে দুজন তো দিল্লীর বাইরে চলে যাবে। তানিয়া পড়ে থাকবে সাউথ দিল্লীর কলেজে। আমার মন বলছে আজকের চারজনের এটাই শেষ একসঙ্গে বসা। এখন যদি পারো তো একটা এমন অসংযমী প্রেমের গল্প বলো যা আগে কেউ শোনেনি, এবং পরেও আমাদের মতো চারজন একসাথে শুনবে না।

    ব্যানানা স্প্লিটের চাঁইটাও এরকম অন্যায়ের প্রতিবাদে চামচ থেকে খসে পড়ে গেল। হিন্দীতে লিখি বলে এদের কাছে শস্তা রোমান্সের হল্‌ওয়াই হয়ে গিয়েছি। অথচ আমার ক্যান্টিনে লাভ্‌-ওয়াভ্‌ যত না আছে তার চেয়ে বেশি আছে আরাবল্লীর লাভা। তাতে যে গল্পের লাড্ডু পাকে, সেগুলো রিজের ধুলো আর যমুনার বালিতে বোঝাই।

    আমাকে চুপ দেখে সপ্‌না বলল – আরে পুত্তর, ভয় কী? তোমার আগের গল্পটা যখন শুনিয়েছিলে তখন প্রায় পা নাচানোর মতো ভালো সময় কেটেছিল। আমার একটা ধাঁসু প্ল্যান আছে। যা পারো শোনাও। গল্পটা চা খেতে খেতে খানিকটা শোনা যাক। চা শেষ হয়ে গেলে তোমাদের একটা দারুণ জায়গায় নিয়ে যাব। আধঘন্টার পথ। বাকিটা গাড়িতেই শুনে নেওয়া যাবে।

    তখন বুঝিনি যে আমাকে গল্পের টাঙায় যুতে দিয়ে সপ্‌না তার নিজের উদ্দেশ্য সাধন করার জন্য গাড়িতে ঢোকাচ্ছে। উলটে তাকে আমি সরলভাবে জিজ্ঞেস করেছিলাম - কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?

    - সেটা সারপ্রাইজ।

    অলেখা গল্প আগে কাউকে শুনিয়ে দিলে পরে লিখতে ভীষণ আলস্য লাগে। ইচ্ছে থাকলে এরা একটা প্রকাশ হওয়া গল্প নিজেরাই পড়ে নিত। আসলে আমার শ্রোতাদের আসল রুচি গল্পের জন্মের সময় প্রসূতিকক্ষে ঢুকে ডাক্তার বা নার্সের ভূমিকা পালন করায়। যাহোক, এটাই সম্ভবত আমাদের শেষ আড্ডা জানার পর সবার একটু মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল এবং তানিয়াকে আমার না বলার ইচ্ছে ছিল না। ভূমিকা হিসেবে বললাম – দেখো, যে গল্পটা স্টক থেকে বের করে আনতে পারি তা কোনো প্রেমের গল্প নয়, উপরন্তু এটার হয়তো কোনো মানেও নেই। কিন্তু তাতে কি খুব একটা অসুবিধে হয়? গল্পের ভিতর সব সময় একটা মানে থাকবেই বলে আমরা ধরে নিই। অনেকটা খাবারে নুন থাকার মতো। আমার তো মনে হয় সেই জন্য নুন একটা বোরিং জিনিস হয়ে গেছে। সেটা না দিলে বরং এখন খাবার বেশি ইন্টারেস্টিং হয়। তোমরা কী বলো?

    তিনটি খাতুন আমার দিকে অপরিসীম করুণার দৃষ্টিতে নিঃশব্দে খানিকক্ষণ চেয়ে রইল। তারপর এক পাক করে চোখ ঘুরিয়ে আর মুণ্ডু নাড়িয়ে বলল – হ্যাঁ, খুবই ইন্টারেস্টিং।


    লজ্জায় মাথা নামালাম। তখন আমাদের চোখের সামনে আস্তে আস্তে শহরটা ধূলো, মেঘ, আঁধি, আর উড়ন্ত কাগজের ঠোঙায় ভরে যাচ্ছিল। যেন দিনের আলো লুকিয়ে পড়তে চাইছে।

    আর অবাক কাণ্ড! নিরুলা’জ থেকে আমরা ছাড়া আর সবাই এক এক করে উঠে চলে যেতে শুরু করেছে। যেন দুনিয়াটা এক্ষুনি তার শাটার নামিয়ে দিয়ে জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে তালা মেরে দিয়ে চলে যেতে চায়। আমার গল্পটার কোনো মানে হয় না বলে ভয়ে আমি আমীর খুসরোর কাছে দোয়া করছিলাম – এই আলোনা গল্পটাকে ডুবতে দিও না। এর ভিতর একটা মানে ভরে দাও যাতে আমার চেয়ে মাত্র দু-বছরের বড়ো এই মেয়েগুলো অবজ্ঞায় আমাকে সারাজীবন ধরে একটা রামছাগল না ভাবে।



    আঁধির মধ্যে দিয়ে খুসরো আমাকে নির্মমভাবে নির্দেশ দিলেন – ডুবলে ডুবুক। এমন একটা গল্প বল খোত্তে যার শেষে গোটা পৃথিবীটা মুসাফিরখানার ঝাঁপ ফেলে দিয়ে বাড়ি চলে যাবে। তারপর দুনিয়ায় আর কোথাও, কোনোদিন, কিচ্ছু ঘটবে না।

    খুসরো যে পাঞ্জাবীতে গালাগাল করতে পারেন তা এর আগে জানা ছিল না। গল্পের কুয়াশায় ঝাঁপ দেওয়ার জন্য এরকম একটা জবরদস্ত্‌ পদাঘাতেরই প্রয়োজন ছিল আমার। তুতলে ওঠার পর সামলে গিয়ে বললাম – তো গল্পটার ন্‌-ন্‌-না-নাম হল ‘কমবখ্‌ৎপু্রের কাণ্ডজ্ঞানহীন হুরী’।


    *****

    কমবখ্‌ৎপু্রের কাণ্ডজ্ঞানহীন হুরী

    জায়গাটার নাম? ধরা যাক কমবখ্‌ৎপুর। এই আমাদের মতোই একটানা আরাবল্লীর পাহাড় ঘেরা শুকনো ধুলোর শহর। গোধূলির আলোয় পান খেতে খেতে তার একমাত্র শীর্ণ নদীর ধারে বসা লোকেরা যখন টিলার দেয়ালের উপর ছায়াজগতের অবাক খেলাগুলো দেখে ঘুমিয়ে পড়ত, তখন তাদের মুখে একটা ব্যথার হাসি ফুটে উঠত, যেন কোনো পুরোনো দুঃখ এইমাত্র জেগে উঠে শহরের গলিতে টহল দিতে বেরিয়েছে। এমন আশ্চর্য শহরের আরো একটা খাসিয়ত, মানে বিশিষ্টতা, ছিল। শহরটাকে চালাত এক দঙ্গল হুরী।

    কমবখ্‌ৎপু্রের চারদিকে পাথরের টিলা আর ইমলি গাছের জঙ্গল। সেই জঙ্গলের মধ্যে একটা টলটলে কালো পুকুর। তার নাম হুরী তলইয়া। কথিত আছে সেই পুকুরের ভিতর থেকে রাত্রিবেলা থালার মতো একটা চাঁদ অল্প বয়সী ছেলে মেয়েদের ডাকত। সেই ডাকে যারা সাড়া দিয়েছে তাদের অনেকে আর ফিরে আসেনি। মেয়েরা সেই পুকুরে ঝাঁপ দিলে হয়ে যেত কমবখ্‌ৎপু্রের হুরী। আর ছেলেগুলো হত আরাবল্লীর হনুমান। পরে হনুমানের সঙ্খ্যা এত বেড়ে যায় যে কেউ আর হুরী তলইয়ার ধারে কাছে যেত না।

    হুরীদের নিয়ে শহরের একটা পুরোনো কিম্বদন্তী ছিল। লোকে বলত ষোলোজন হুরী শহরটাকে চালায়। হুরীদের হাতে কোনো শহর চলে গেলে তার কী ফল হয়? দেখা যায় কোনো বছর ইমলি গাছে ইমলি না ফলে টিকটিকি ফলেছে। বা শহরের প্রধান রাস্তাগুলো যেখানে থাকার কথা সেখানে নেই, তারা নদীর ওপারে পৌঁছে গিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। হুরীরা যে কবে কী গুল খিলাবে তার ঠিক নেই। কখনো এমন আশ্চর্য ভালো কিছু হয় যে দূর দূর থেকে লোক ছুটে আসে দেখতে। কখনো এমন সাঙ্ঘাতিক খারাপ কিছু ঘটে যে কমবখ্‌ৎপু্রের লোকেরা কপাল চাপড়ে মরে। মোট কথা হুরীদের হুজ্জতির জন্য ছোট্ট শহরটার খুব নাম-ডাক ছিল।

    এছাড়া আর কী? জুম্মন বলে একটা তেরো-চৌদ্দ বছরের ছেলে থাকত সেখানে। বাপ-মায়ের এক সন্তান। তার ছিল রুস্তম নামে একটা গাধা। রুস্তমকে ছোটখাটো দেখতে হলে কী হবে, সে প্রচণ্ড ভারি ভারি বস্তা পিঠে নিয়ে গুটগুট করে বহুদূর অবধি যেতে পারত।

    এই হল শহরের পরিচয়। এ পর্যন্ত যেখানে চমৎকার স্বাভাবিক চলছিল সব। তারপর এক রাতে জুম্মনের স্বপ্নের ভিতর হুরী তলইয়ার চাঁদ এসে তাকে ডাকল। ব্যস্‌ সেই থেকে গণ্ডগোলের শুরু।


    চাঁদ এসে জুম্মনকে বলেছিল – আয়, জুম্মন মিঞা কাছে আয়। বুড়ো বাবা-মা পড়ে রইল ঘরে, জুম্মন ঘুমের মধ্যে পটাং করে বিছানা থেকে উঠে হাঁটতে শুরু করে দিয়েছে। যদিও তার দুচোখ খোলা, আসলে জুম্মনের ঘুম ভাঙেনি। সে অন্ধকার গলিগুলো পেরিয়ে চাঁদের আলোয় শহরের বাইরে টিলাগুলোর দিকে রওনা দিয়েছিল।

    এদিকে জুম্মনের গাধা রুস্তম বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমোচ্ছিল। পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় জুম্মনের একটা হাত তার লেজে ঠেকে যায়। রুস্তম ভাবল তাকেও সঙ্গে যেতে বলা হচ্ছে। সুতরাং কান দুটো একবার ঝেড়ে নিয়ে রুস্তম তার তরুণ মালিকের পিছু পিছু চলল।

    যাহোক, জুম্মন তো ঘুমের ঘোরে শহর ছাড়িয়ে টিলা আর ইমলি গাছের জঙ্গলে গিয়ে ঢুকেছে। বসন্তের মরসুম। শোঁ শোঁ করে একটা ঝড় উঠল এই সময়। ইমলির ডালগুলো তুমুলভাবে নড়ছে। সবাই যেন জুম্মনকে বলছে – যেও না, যেও না। ঘরে ফিরে যাও নইলে মৃত্যু অবধারিত। কিন্তু চাঁদ যখন ডাকে তখন কি আর অন্য কারো ডাক কানে ঢোকে? জুম্মন সেই উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ ধরে চলতেই থাকল। তখন সেই বসন্তের ঝড়টা কোত্থেকে হাজার হাজার রঙীন ও বেরঙীন জামা-কাপড়, কামিজ-রজাই, চদ্দর-কম্বল, শাল-দোশালা, ছোটদের মোজা, বড়োদের দস্তানা, মেয়েদের চুন্নি, আর ছেলেদের পাগড়ি উড়িয়ে নিয়ে আসতে লাগল। গাছের উপর দিয়ে হু-হু করে এই সব রেশম-পশম-মখমল-পেশমল-তোষ-শাতোষ-সুতি-বুটা, মানে সব ধরণের সুতোর তৈরি পরিধেয় আর গায়ে মুড়ি দেওয়ার জিনিস একটা আরেকটার ঘাড়ে পড়তে পড়তে ভেসে এসে জুম্মনের গায়ে আছড়ে পড়ছিল, যাতে তার স্বপ্নটা ভাঙে।

    দেখতে দেখতে জুম্মন জঙ্গলের মাঝখানে হুরী তলইয়ার কাছে এসে পড়ল, যার মধ্যে থেকে সেই অভিসন্ধির পিপের মতো দুরাত্মা চন্দ্রমা ভাঙা ডিমের কুসুমের রূপ ধরে উঠে লোলুপ দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে বলছিল - থামিস না, চলতে থাক। জুম্মনকে থামাবার জন্য মরীয়া একটা নীল কাপড়ের টুকরো তখন আকাশ থেকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে তার মুখের উপর। জুম্মনের চোখ দুটো ঢেকে যাওয়ার পর সে কিছু দেখতে পাচ্ছিল না। সঙ্গে সঙ্গে তার স্বপ্ন যায় ভেঙে। জুম্মন মুখ থেকে সেই নীল কাপড়টা খুলে নিয়ে বুঝতে পারল সেটা একটা মেয়েদের ঘাঘরা।

    হঠাৎ একটা ঘাঘরা পেলে কী করা উচিত? খানিকক্ষণ বোকার মতো হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর জুম্মন দু-পা গলিয়ে সেটাকে পরেই ফেলল।


    *****


    পম্পা তার চোখের ইণ্ডিয়া গেট হাট করে খুলে একটা ফ্যাকাশে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে বলল – হোয়া-আ-আ-আ-ট?

    আমি গল্প থামিয়ে তাকে বললাম – কী হয়েছে?

    - জুম্মন ঘাঘরা পরতে যাবে কেন? সে কী পাগল?

    - পরলেই বা কী? মুফতে হাতে এসেছে যখন। তাছাড়া জিনিসটা ভালো। সূক্ষ্ম সুতোর কাজ করা তাতে। হয়তো জুম্মনের লোভ হয়েছিল।

    - দেখতে ভালো হলেই একটা ঘাঘরা পরে ফেলে কোনো ছেলে? এটা কি ইয়ার্কি হচ্ছে?

    তানিয়া বলল – শোনো জয়, এখানে তোমাকে মোটিভটা একটু খোলসা করতে হবে। ছেলেটার ঘুমঘোর কাটেনি। সে ভালো করে না বুঝেই পরে নিয়েছে। ঠিক কি না?

    সপ্‌না বলল – এটাও লিখে দাও যে ঘুমের মধ্যে অনেকের লজ্জাবোধ থাকে না। কেউ কেউ বকরার মতো ডাকে।

    পম্পা আমার দিকে একবার সবার অলক্ষ্যে চোখ পাকিয়ে তাকাবার পর চুপ করে যেতে বাধ্য হল। সে আর আমি দুজনেই জানি এই নীল ঘাঘরা আমার গল্পের ভিতর কোথা থেকে এসে ঢুকে পড়েছে। সপ্‌না আর তানিয়া না থাকলে সে নির্ঘাত আমাকে তুলোধোনা ধুনত। কিন্তু আমিই বা কী করব? যা নিয়ে ভাবছি তার গুণই তো গাইব।


    কাঁধ দুটো একবার ঝাঁকিয়ে আবার গল্পে ফিরে গেলাম।




    *****

    কমবখ্‌ৎপু্রের কাণ্ডজ্ঞানহীন হুরী (আগের পর...)

    জুম্মন মিঞার গোঁফ-দাড়ি গজায়নি। মুখশ্রী সুকুমার। চুলটা বাবরি ধাঁচে কাটা। ফলে ঘাঘরা পরার পর তাকে সুন্দরী না হলেও একটা সুশ্রী মেয়ের মতো যে দেখাচ্ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার ফলে জুম্মন একটু দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। অদূরেই গা ছমছমে হুরী তলইয়া। জুম্মন জানত এখানে এসে অনেকে ফেরে না। তাও একটা কীসের আকর্ষণ তাকে সেদিকে যেতে বলছে। যাব না যাব না করেও জুম্মন যখন এক পা বাড়িয়েছে তখন মাথার উপর থেকে কে যেন বলে উঠল – এই ছুঁড়ি, আমাকে একটু নামতে সাহায্য কর।

    জুম্মন উপর দিকে তাকিয়ে দেখে কাঁটাওয়ালা গাছের ডাল থেকে তারই মতো ঘাঘরা পরা কে যেন একটা ঝুলছে। সমস্ত গাছের ডাল-পালা, শাখা-প্রশাখা থেকে অজস্র শীত আর বসন্তের পোষাক হাওয়ায় ফরফর করে উড়ছিল। সেই সব কাপড় চোপড়ের সঙ্গে একটা জ্যান্ত মেয়েও ভেসে এসেছে কোথাও থেকে। এখন মগডালে আটকে গিয়ে আর নামতে পারছে না।

    গাছগুলোতে চড়া খুব একটা কঠিন কাজ নয়। তারার আলোয় জুম্মন এ ডাল ও ডাল ধরে টঙে পৌঁছে দেখল মেয়েটার ঘাঘরা ফুঁড়ে একটা শাখা বেরিয়ে গেছে। পা উপরে মাথা নিচে করে ভীষণ বেকায়দায় ঝুলে আছে বেচারা। ডাল ভাঙার চেষ্টা করে সফল হল না জুম্মন। মেয়েটাও বারণ করল – আরে ছাগলের বোন, ভেঙে দিলে সোজা নিচে গিয়ে পড়ব তো। একটু আক্কেল দিয়ে কাজ কর। আমাকে টেনে তোল উপরে।

    জুম্মন মেয়েটাকে টেনে ডালের উপর বসাল। বোঝাই যাচ্ছে তার ঘাঘরা আর চলবে না। - যা কোথাও থেকে আরেকটা নিয়ে আয়। বলল মেয়েটা।

    জুম্মন মিঞা খুঁজতে খুঁজতে কোনো কাছাকাছি গাছের ডালে তার পছন্দমতো একটা পুঁতি বসানো সবুজ ঘাঘরা পেয়ে গিয়েছিল। সেটা উদ্ধার করে এনে মেয়েটাকে দিতেই সে টপ করে নিজের ফাঁসা কাপড় ছেড়ে নতুনটাকে পরে ফেলল। তারপর সড় সড় করে ডাল বেয়ে নেমে গিয়ে সে জুম্মনের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিল যেন জুম্মন একা একা গাছ থেকে নামতে পারে না। যা হোক, জুম্মন নিজেই নেমেছিল। তারপর সে অতি চালাক ছুকরিটাকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল – আচ্ছা, তুমিও কি একটা চাঁদের স্বপ্ন দেখেছিলে? কিন্তু সে কিছু বলার আগেই মেয়েটা তার হাত ধরে একটা হ্যাঁচকা টান মেরে বলল – চল, চল। দেরী হয়ে যাবে! দেখছিস না, হাওয়া থেমে গেছে?

    ছুটতে ছুটতে তারা এসে পড়ল কালো টলটলে একটা পুষ্করিনীর ধারে। তার ভিতর থেকে ডিমের কুসুমের মতো খানিকটা মাথা তুলে জেগে আছে চাঁদ। জুম্মনকে আবার এক হ্যাঁচকা টানে নিজের সঙ্গে জুড়ে নিয়ে মেয়েটা অভিজ্ঞ সাঁতারুর মতো ঝাঁপ দিল হুরীর পুকুরে।


    *****


    পুকুরের মাঝখানে বেশ খানিকটা গভীরে চলে যাওয়ার পর জুম্মন দেখল এতক্ষণ যে ঝড়টা অগুনতি কাপড়-চোপড়, পোষাক-আষাক উড়িয়ে টিলার গাছপালার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল, সেটা এবার তালাবের ভিতর ঢুকে গোল হয়ে ঘুরছে। সেখানে ওই লেপ-কম্বল-তোশক-পালক-পর্দা-রুমালের ঘূর্ণির মধ্যে জুম্মনের মতো ঘাঘরা পরা আরো ডজনখানেক মেয়ে তালগোল পাকিয়ে উড়ছিল। তাদের সরু আর টানা চোখের উপর আধ আঙুল লম্বা ভ্রু-পল্লব দেখেই জুম্মন বুঝেছিল সেগুলো হুরী। এদিকে তাকে যে মেয়েটা হাত ধরে নিয়ে এসেছিল দেখতে দেখতে তারও চোখদুটো সরু আর টানা হতে শুরু করেছে। জুম্মন ঝড়ের শোঁ শোঁ শব্দের মধ্যে চিৎকার করে বলল – আমাকে এখানে আনলে কেন? এটা তো হুরীদের তালাব!

    জুম্মনের হাত শক্ত করে ধরে থাকা মেয়েটা খল খল করে হেসে উঠে বলল – তুই তো হুরী হতেই এসেছিলি জঙ্গলে। নইলে স্বপ্নে চাঁদ দেখলি কেন?

    - হু-হু-হু-হু-রী...?

    - তোতলানো ছেড়ে সবাই যা করছে সেটা কর। তালাব নয়, এটা আসলে হুরী বানাবার ঘানি। দেখছিস না হাওয়াটা যত রাজ্যের ময়লা কাপড় উড়িয়ে এনে জড়ো করেছে? বিশ্বের ছাড়া কাপড়-চোপড়ের সঙ্গে এক চাক্কিতে পিষেই তুই ঝাঁ চকচকে একটা হুরী হয়ে যাবি, আর আমাদের দলেও যে একটা শূন্যস্থান হয়েছিল সেটা ভরাট হয়ে যাবে।

    - ছাড়া কাপড় নাকি এগুলো? বিতৃষ্ণায় নিজের ঘাঘরাটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে জুম্মন।

    - নাক সিঁটকোস না বোকা মেয়ে। হুরী হওয়া কি চাট্টিখানি কথা? ভালো হুরী তৈরী করতে গেলে ময়লা দিয়ে পিষতে হয়। সেই জন্য নিয়মিত ঘানিতে নামতে হয় আমাদেরও। ষোলোজনের বেশি দলে রাখি না আমরা। নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দে, আমাদের একজন এই কয়েকদিন হল দল ছেড়ে পালিয়ে গেছে। তাই তুই একটা মওকা পেয়ে গেলি।

    কেন একজন হুরী দল ছেড়ে পালাল সেটা আর জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেল না জুম্মন। হুরী বানাবার চরকিতে হঠাৎ ঝড়ের গতি প্রচণ্ড বেড়ে যাওয়ায় কারো কথা শোনা যাচ্ছিল না।


    হুরীর ঘানি যে কতক্ষণ ঘুরেছিল তার ঠিক নেই। কত যে কাঁচুলি এসে জুম্মনকে থাপ্পড় মেরে গেল, আর কত যে পাজামা তার গলায় গিঁট দিয়ে খুন করতে চেষ্টা করল তার লেখাজোখা নেই। জুম্মন দাঁতে দাঁত চেপে সমস্ত সহ্য করেছিল এর শেষ না দেখে যাবে না বলে। পরে ঝড়ের দাপট যখন কমে আসছিল আর হাওয়ার চরকিটা ছোট হতে হতে ঠিক ষোলোজন হুরীর পক্ষে যথেষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তখন হুরীরা একজন আরেকজনের হাতে ধরে। জুম্মনও দুদিকের দুটো হাতে ধরা পড়ে দেখল সেগুলো বেড়ালের থাবার মতো নরম। তার ছোঁয়া লাগামাত্র ছোট কিন্তু ধারালো নখগুলো টুপ টুপ করে লুকিয়ে পড়ছে। বাতাসের চরকিটা ঘুরতে ঘুরতে তালাবের উপরের দিকে উঠতে শুরু করেছিল যেখানে অতিকায় ডিমের কুসুমের মতো চাঁদ তখনো পালাবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। হুরীরা হেঁইয়ো হেঁইয়ো বলে গায়ের জোরে সেটাকে নামাল জলের নিচে, এবং টানতে টানতে নিয়ে চলল হুরী তলইয়ার একদম গভীরে একটা শ্যাওলার জগতে, যেখানে সঠিক মাপের গোল গর্ত করাই ছিল সেটাকে ভালো করে পুঁতে মাটি চাপা দিয়ে রাখার জন্য।

    এই সব কাজ করতে করতে জুম্মনও ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল। জিরোবার ফুরসৎ কিন্তু পাওয়া গেল না। হাওয়ার ঘূর্ণিটা এতক্ষণ শান্ত হয়ে দাঁড়াবার পর আবার গোঁ গোঁ আওয়াজ করে উপরে উঠতে শুরু করেছে। হুরীরাও অমনি বলল – চল, চল, উপরে চল। একটু বাদে সেই ময়লা কাপড়ের ঝড়টা যখন তাদের তালাব থেকে উড়িয়ে একটা ইমলি গাছের বিভিন্ন ডালে ঝুলিয়ে দিয়ে নিজের পথ ধরেছে, তখন জুম্মনদের কারো গায়ে বা জামায় এক ফোঁটা জল লেগে ছিল না।

    হুরীরা দু-চারবার ডাল ধরে কসরৎ দেখাবার পর পা ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে বসে পড়েছিল। জুম্মন দেখছিল তাদের হাত-পা, মুখ যেন কলাই করা বাসনের মতো চকচক করছে। মাঝে মাঝে কেউ একটুখানি উড়ে এক ডাল থেকে অন্য ডালে যাতায়াত করছিল। জুম্মন এসব কিছুই পারছিল না। কারণ হুরীর ঘানিতে পিষেও সে যা আগে ছিল তা-ই আছে। কোনো পরিবর্তন হয়নি। জুম্মন যে মেয়ে নয় সেটা হুরীরা ধরতে পারছে কিনা বোঝা যাচ্ছিল না।


    *****


    - তোর নাম কী, নতুন মেয়ে?

    - জুম্মন।

    - বাঃ, বাঃ, নামটা তো দারুণ। পনেরোজন হুরী বলে উঠল। - আমাদের নামগুলোও জেনে রাখ তাহলে। এক এক করে নামতা পড়ার মতো আউড়ে দিল তারা – লাঃ, লীঃ, লৈ, লুক, শাঃ, শীঃ, শৈ, শুক, হাঃ, হীঃ, হৈ, হুক, আর থাঃ, থীঃ, থৈ।

    এগুলো কি সত্যি কোনো বড়ো মেয়ের পরিচয় হতে পারে? ভাবছিল জুম্মন। এমন সময় হুরীরা বলল – তোর নতুন নামটা কী হবে বলতো এবার?

    - আমি জানি না।

    - আরে চমরী গাই, তোর আক্কল কী ঘাস চরতে গেছে? লৈ’য়ের পরে লুক, আর শৈ’য়ের পরে শুক হলে থৈয়ের পরে কী হয়?

    - থুক? গোমড়া মুখে বলল জুম্মন।

    - শাবাস!! শাবাস! চারদিক থেকে অভিনন্দনের সঙ্গে ইমলি গাছ জুড়ে গুচ্ছ গুচ্ছ অশৈলী সাদা ফুল ফুটে উঠছিল। হুরীরা বলল – ব্যস্‌ তুই আমাদের একজন হয়ে গেলি। তোর জন্য আমরা কী করতে পারি বল।

    জুম্মন বলল – আমি কেন থুক নাম নিতে যাব? এটা একটা অপমানকর প্রস্তাব। আমার কি আত্মসম্মান নেই?

    আর যাবে কোথায়, পনেরোজন হুরী লাফিয়ে উঠে জুম্মনকে চারদিক থেকে অজগরের মতো বুকের সাথে পেঁচিয়ে ধরে ফোঁসফোঁস করে বলল – কোনো প্রমাণ ছাড়া এত বড়ো একটা অভিযোগ তুই তুলতে পারলি? জানিস থুক যার নাম সে আমাদের দলের সবচেয়ে আদরের সদস্য হয়? অর্থাৎ নামের মতো সুস্বাদু আর মিষ্টি।

    - থুতুর মতো সুস্বাদু? তোমরা সত্যিই ভাবো যে আমি একটা গরু, তাই না?

    - গরু হোক তোর দুশ্‌মন। ভালো না বাসলে তোকে আমাদের তালাবে নামালাম কেন? হুরীর ঘানিতে যে ঝড়টা আসে সেটা যত রাজ্যের ময়লা কাপড় কেন আনে জানিস? তার মধ্যে থাকে বাচ্চাদের থুতু, বুড়োদের চোখের জল, ছুকরিদের খুন, আর বকরিদের পসীনা। আর যত রাজ্যের সমস্ত সুন্দর, বলিষ্ঠ, রুগ্ন, আর বন্ধুহীন পুরুষদের কলিজা থেকে চুঁইয়ে পড়া পরাগের দানার মতো লজ্জাহীন বেশকীমতী হুরী বানাবার মিট্টি।

    - ছেড়ে দাও। আমি বাড়ি যেতে চাই।

    তখন হুরীদের মধ্যে যে সবচেয়ে বড়, আর যার নাম লাঃ, সে বলল – বাড়ি তো আমরা সকলেই যাব, কিন্তু মাসের প্রথম চহারশানবের দিন, মানে বুধবার, আমরা জঙ্গলের ধারে ভাঙা কেল্লার ভিতর জমা হই। থুকজান, মনে রাখিস তোকেও সেখানে আসতে হবে। তোকে ছাড়া আমরা সবাই এক হব কী করে?


    *****


    তানিয়া ডান হাত তুলেছে। এই একটা বদ স্বভাব মেয়েটার। এমন ভাব দেখায় যেন আমি ওদের সংস্কৃতের মাস্টার। জোর করে বসিয়ে বাণভট্টের কাব্য পড়াচ্ছি।

    - তানিয়া প্লীজ যা বলার বলো। আমি তোমাদের মাস্টরজী নই, আর এটা কোনো ইউনিভার্সিটির ক্লাস নয় যে কথা বলতে গেলে অনুমতি নিতে হবে।

    - তোমার আগের একটা গল্পে ছেলেটার নাম ছিল ধুর। এটাতে নাম হয়েছে থুক। এরকম ফুটপাথ-ছাপ নামের প্রেরণা কোত্থেকে পাচ্ছো জয়?

    - তুমি একদম ঠিক ধরেছ। ফুটপাথই এদের প্রেরণা।

    - তার মানেই বা কী? তানিয়া একটু অবাক হয়ে বলল। - এই সব ছেলেগুলো ফুটপাথ-ছাপ? অর্থাৎ আনকালচার্ড? জাহিল?

    - অ্যান্টিহিরো কাকে বলে বোঝো?

    - হিরোও নয়, ভিলেনও নয়? এই পম্পা তুই বুঝিস?

    পম্পা বিরক্ত হয়ে বলল – রাইটারকেই বল না বুঝিয়ে দিতে? আমরা তো শিমলিপুরে থাকি না। এই সব নাম কোনোদিন আমাদের পাড়ায় শুনিনি। তবে ধুর আর থুক দুটো সম্পূর্ণ আলাদা চরিত্র বলে মনে হচ্ছে আমার।

    শ্রোতাদের একজন চুপচাপ শুনে যাচ্ছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে ফেলেছিলাম। সপ্‌নাও অমনি তাল ঠুকে নেমে এল আখাড়ায়। সে বলল – হিরো বলতে বোঝায় এমন একজনকে যে অন্যদের বাঁচাবার জন্য নিজের বলিদান করে। অ্যান্টিহিরো হচ্ছে তার উলটো। অর্থাৎ যে নিজেকে বাঁচাবার জন্য অন্যদের বলিতে চঢ়িয়ে দেয়।

    সপ্‌নার ব্যাখ্যা বেশ মনে ধরার মতো। অন্যদেরও মন্দ লাগেনি। ইউনিভার্সিটির ক্লাসে বোধহয় এটাই পড়ানো হয়। কিন্তু আমি তো নিজে জাহিল। এত ভেবে বলব কী করে?

    সত্যিটাই জানাই। বললাম – দেখো, আমি এতদূর ভাবিনি। মনস্তত্ত্বের দিক দিয়ে আমার কাছে তফাৎ সোজা। হিরো হল সংযম। যেমন টাগোর। আর অ্যান্টিহিরো অসংযম। যেমন মীর আর গালিব। একদল নিজের ইন্দ্রিয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে চায়। অন্যদল সেটা চায় না।

    তানিয়া হঠাৎ একটা ঝটকা দিয়ে সোজা হয়ে বসে বলল – অ্যান্টিহিরো-ফিরো জানি না, কিন্তু ইন্দ্রিয়ের উপর বেশি নিয়ন্ত্রণ থাকা ক্যাথলিক ব্রাদারদের মতো একটা বাড়াবাড়ি জিনিস। সেটা যারা করে তারা নিজেদের সঙ্গে অন্যদের জীবনও বরবাদ করে ছাড়ে।

    সুযোগ বুঝে দুহাতের খোলা চেটো আকাশের দিকে মেলে দেওয়া গেল। যেন তানিয়া সব জলের মতো সোজা করে দিয়েছে। তারপর বললাম – হিরোরা হল ফার্স্ট বেঞ্চের ছেলে। পরের বেঞ্চগুলোতে বসে লালুভুলুরা। অ্যান্টিহিরোদের পেতে চাইলে লাস্ট বেঞ্চ অবধি হাঁটতে হয়। মানো আর না মানো, আমার প্রেরণা আসে এখান থেকে।

    পম্পা বিড়বিড় করে বলল – ধুরস্য ধুর। কিন্তু তানিয়ার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়ে গেছে বলে আমি এগোবার অনুমতি পেয়ে গিয়েছিলাম।




    *****

    কমবখ্‌ৎপু্রের কাণ্ডজ্ঞানহীন হুরী (আগের পর...)

    পরে জুম্মনকে বাড়ির পথে এগিয়ে দিতে আসে সেই হুরীটা যাকে সে গাছ থেকে নামতে সাহায্য করেছিল, এবং যার নাম ছিল শৈ। যেতে যেতে জুম্মন তাকে জিজ্ঞেস করল – আচ্ছা তোমাদের একজন দল ছাড়ল কেন?

    শৈ বলল – আমাদের মধ্যে ছোটরা বড়দের ফরমাইশ খাটে। যেমন আমি লাঃ, লীঃ, লৈ, লুক, এবং শাঃ, আর শীঃ’য়ের হুকুমগুলো মেনে চলি। তোর আগে থুক নামের যে ছিল সে যেহেতু সবার ছোট, তাই দলের বাকি পনেরোজন তাকে দিয়ে মোট বওয়া থেকে শুরু করে উকুন বাছা অবধি সমস্ত কাজ করাত। তো থুক একদিন বলল – দল আরো বাড়াতে হবে, আমার নিচেও গোটা ছয়েক হুরী যোগ করা হোক। চহারশানবের অধিবেশনে তার প্রস্তাবটা খারিজ হয়ে যায়, কারণ ষোলোজনের বেশি হুরী একসঙ্গে তালাবে নামতে পারে না। ব্যস্‌, তার এমন গোঁসা হয়ে গেল যে সে শহর ছেড়ে হাওয়া।

    জঙ্গলের ধারে পুরোনো কেল্লার ভাঙা দেয়ালগুলোর মধ্যে একটা লুকোনো দরজা পেরিয়ে তারা ঢুকেছিল বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখা পাথরের ঘরটায়। শৈ ঘরে ঢুকে একটা তুড়ি মারতেই চলে এল রেশমের গালচে, হাজারটা কাঁচের খণ্ড বসানো ঝাড়লন্ঠন, সেজবাতি, আর রকমারি তাকিয়া দিয়ে সাজানো বসার জন্য আরামকেদারা।

    - বুধবার বাড়ির লোকজন ঘুমিয়ে পড়লেই এখানে চলে আসবি। মজলিস বসবে। শহরটাকে চালানো কি চাট্টিখানি কথা? থুক, মানে জুম্মনকে, বলল শৈ।

    জঙ্গল থেকে বেরিয়ে যখন তাদের দুজনের পথ আলাদা হয়ে যাচ্ছিল তখন জুম্মন শুধোল – আর আমি যদি না আসি?

    নাকটা একটু কুঁচকে শৈ বলল – প্রতিদিন তোর গাধার একটা করে দাঁত পড়ে যেতে পারে। দাঁত যখন একটাও থাকবে না তখন লেজ খসবে। তারপর একটা একটা করে ঠ্যাং।

    - ধুৎ। কখনোই তোমরা এটা করতে পারো না। বেচারা গাধার কী দোষ?

    খলখল করে হাসতে হাসতে শৈ বলল – তোর মনে আছে শহরে একবার পাক্কা একবছর গরু-ছাগলদের বাঁটে এক ফোঁটা দুধ আসেনি, কিন্তু বাড়ির ছয় থেকে বারো বছর বয়স পর্যন্ত বাচ্চাদের নাক দিয়ে নদীর মতো ভালো আর ঘন দুধ বেরোত?

    জুম্মন নিজে সেই বাচ্চাদের একজন। বিভীষিকার মতো সেই বছরটা কি কেউ ভুলতে পারে? নিজেদের নাকের দুধই খেতে হচ্ছিল তাদের। বছরের শেষে যখন সেই ভালো আর ঘন দুধের সরবরাহ হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় তখন শহরের সবাই প্রচণ্ড খচে গিয়ে ছোটদের নাকগুলো মুলে মুলে দেখত কোনোমতে দুধের কলগুলো আবার যদি খোলা যায়।

    দাঁত বার করে শৈ বলল - সেই বাচ্চাগুলোর কী দোষ ছিল? ভালো হুরী হতে গেলে ভেবে কাজ করতে নেই, করে ভাবতে হয়। যা বাড়ি যা আজ। আস্তে আস্তে সব বুঝে যাবি।


    *****


    বুধবার সকালবেলা রুস্তমের দাঁতগুলো পরীক্ষা করতে গিয়ে জুম্মন দেখল একটা নড়তে শুরু করেছে। এবং তার পাশের দুটো ভয়ে কুঁকড়ে আছে, যেন রাতে স্বপ্নে একটা চাঁদ এসে তাদের দিন গুনতে বলে গিয়েছিল।

    ফলে পুরোনো কেল্লার ভিতরে লুকোনো দরজার পিছনের ঘরটায় না গিয়ে উপায় ছিল না। নীল ঘাঘরা পরে জুম্মন যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছোয় তখন বাকিরা আগেই একটা করে ভালো তাকিয়া নিয়ে জাঁকিয়ে বসে ছিল। জুম্মনকে বলা হল সবার জন্য তামাক সেজে আনতে। সেটা করে যখন সে সবচেয়ে ছোট আর নিচু একটা আসন নিয়েছিল তখন লাঃ বলল – আগামী মাসের কার্যসূচি তৈরীর সময় এসেছে। এবার আমরা পাখিদের জন্য উপকারী কিছু করব। কার কী প্রস্তাব আছে রাখো।

    কেউ বলল – আমরা তাদের পেটগুলো কিছুদিনের জন্য বড় করে দিতে পারি, যাতে তারা বেশি করে খেতে পারে।

    দেখা গেল প্রস্তাব সমস্ত হুরীরই পছন্দ হয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে – হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই হোক বলে তা গৃহীত হয়ে গেল। জুম্মন এতক্ষণ কিছু বলার সুযোগ পায়নি। সে একটা হাত তুলে বলল – এটা কী করছ তোমরা? ডানার অনুপাতে পেট বেশি বড় হয়ে গেলে এই পাখিগুলো উড়বে কী করে?

    খুবই বিরক্ত হয়ে হুরীরা তার দিকে চেয়ে বলল – এই থুক, আমাদের খাওয়াদাওয়ার সময় হয়ে যাচ্ছে। যা রান্নাঘরে গিয়ে বাসনগুলো মেজে দে। পাখিরা কী করে উড়বে তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে না, সেটা তারাই ভেবে ঠিক করুক। যে প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়ে গেছে তা আর পালটানো যায় না।

    জুম্মন রেগে গিয়ে বলল – পাখিগুলো উড়তে না পারলে তাদের শেয়াল কুকুরে ছিঁড়বে না? আমি এই মাথামুণ্ডুহীন প্রস্তাব মোটেও অনুমোদন করিনি।

    আর যাবে কোথায়? পনেরোজন হুরী থুককে এক টানে মাটিতে ফেলে তার বুকের উপরে চেপে বসল। কেউ ধরল হাত, কেউ ধরল লাত। লাঃ তার গলায় একটা তীক্ষ্ণ নখ ঠেকিয়ে বলল – ছোট মুখে এত বড় কথা! তিনদিন আগে দলে জায়গা পেয়ে নিজেকে তীস মার খাঁ মনে করছিস? প্রস্তাব তোকে অনুমোদন করতেই হবে।

    জুম্মন হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে বলল – কভী নেহি!

    - আচ্ছা আমরা ডানাগুলোকেও নাহয় বড় করে দেব।

    - তাহলে তো পুরো পাখিটাই বিরাট হয়ে গেল। চিল, শকুন এমনিতেই বড়, তার উপরে আরো বড় হয়ে গেলে একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার হবে। ছাগল, কুকুর, এমনকী মানুষ ধরে ধরে খাবে।

    লীঃ বলল – দিদি, এর বাজে কথা শুনতে গেলে আমরা কিচ্ছু করতে পারব না। সমস্ত হুরীওয়ালী তাকৎ ঘরে বসে বসে নষ্ট হবে। আমরা আগে যা ঠিক করেছিলাম সেটাই হোক। আর এটাকে মট্‌কন্‌-কী-লট্‌কন্‌ দাওয়াই দাও।

    তারপর আর কী? জুম্মন আর তার গাধা রুস্তমের ঠ্যাং বেঁধে পাশাপাশি ছাদ থেকে উলটো করে ঝুলিয়ে দিল হুরীরা। তাদের মাঝখানে ঝোলানো হল একটা ফুটো করা গোলমরীচের থলে। জুম্মন হাঁচতে হাঁচতে থলেটাকে দূরে সরাচ্ছে তো সেটা চলে যাচ্ছে রুস্তমের নাকের ডগায়। তখন বেচারা রুস্তম হাঁচতে হাঁচতে সেটা আবার জুম্মনকে ফেরত দিতে বাধ্য হচ্ছে। এইভাবে তারা দুজন দুজনকে শাস্তি দিয়ে ঘন্টাখানেক কাটাবার পর রুস্তম ঢেঁচু-ঢেঁচু করে কাঁদতে লাগল আর জুম্মন চিঁ চিঁ করে বলল – আমি প্রস্তাব অনুমোদন করছি।

    লীঃ বলল – তাড়ার কী আছে? আরেকটু ভাব না? ততক্ষণে আমাদের খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়ে যাবে। তারপর শুনব তোর কথা।

    কিন্তু শৈ ছুটে এসে জুম্মন আর রুস্তমের বাঁধনগুলো খুলে দিয়ে বলল – উঃ, কী ভালোই না লাগে যখন সবাই মিলেমিশে একটা ভালো কাজ করি। আয় থুক, খেতে আয়।


    সেদিন বাড়ি ফেরার পথে শৈ জুম্মনকে বলল – সারাদিন যখন বাড়িতে থাকি তখন আমাদের এক ফোঁটা ক্ষমতা থাকে না। একটা সাধারণ মেয়ের সাথে কোনো তফাৎ দেখবি না। কেউ গোয়ালনী, কেউ পণ্ডিতাঈন, তো কেউ নবাবের বিটিয়া। আমাদের তাকৎটা আসে রাতে, এবং সেটা তখনই ব্যবহার করা যায় যখন আমরা সবাই এককাট্টা হই। থুক, তোর হুরীওয়ালী সেই তাকৎটা আসেনি, তাই সেটা ব্যবহার করার কীরকম চাড় তা তুই অনুভব করতে পারছিস না। কিন্তু পুরোপুরি হুরী না হতে পারার জন্য তোকে দোষ দেওয়া যায় না। আসলে তুই যে মেয়ে নয়, একটা ঘাঘরা পরা ছেলে।

    থুক বলল - এইরে, সেটা তুমি বুঝে গেছ?

    - হ্যাঁ। কিন্তু দেখতে হবে যাতে অন্যরা না বুঝতে পারে। লাঃ, লীঃ, লৈ, লুকরা যদি জানতে পারে তো এর ফল ভালো হবে না।

    জুম্মন বলল – দেখো, আমি কাউকে ঠকাতে চাইনি। তোমরাই জোর করে যা করার করলে। এখন আমার কী হবে?

    শৈ সান্ত্বনা দিয়ে বলল - এত চিন্তা করিস না। বারবার ঘানিতে নামার পর আস্তে আস্তে একদিন ঠিক আমাদের মতো হুরী হয়ে যাবি। ধৈর্য রাখ একটু।


    *****


    আমরা এখানে একটু বিরতি নিয়েছি। আঁধির জোর কমে এসেছে বলে নিরুলা’জের পাট চুকিয়ে সবাই গাড়িতে উঠেছিলাম। সেখানে জ্যান্ত গল্পের শব ব্যবচ্ছেদ শুরু হয়ে গেল। সপ্‌না বসেছিল ড্রাইভারের পাশে। পিছনের সীটে আমি, পম্পা, আর তানিয়া।

    - এটা একটা ছেলের মেয়ে হতে চাওয়ার গল্প। পিছন ফিরে বাণী দিল সপ্‌না। - এমনিতে আইডিয়া বুরা নহীঁ হ্যায়। সব ছেলেরই মেয়ে হতে চাওয়া উচিত। কেন চায় না সেটা একটা রহস্য।

    তানিয়া বলল – আরে সবাই সিক্রেটলি হতে চায়, লজ্জায় স্বীকার করতে পারে না। এই জয়, তুমি যীশুর শপথ করে বলো তোমার একটা কলেজের মেয়ে হতে ইচ্ছে করে না? তাহলে কত রকম ভালো জামাকাপড় পরে ‘ইঠ্‌লাতে হুয়ে’ মার্কেটে যাবে আর আরো ভালো ভালো জামাকাপড় কিনতে পারবে! তানিয়া ডান হাতটাকে টিনের করাতের মতো দুলিয়ে দেখাল।

    ফিল্মীগানের ইঠ্‌লে ওঠা শব্দজালে আমি পা দিলাম না। - তোমরা যা ভাবছ সেটা সম্পূর্ণ ভুল। তানিয়া আর সপ্‌নার আশায় ঠাণ্ডা জল ঢেলে বললাম। - আমাদের বয়সী বেশির ভাগ ছেলে আরো বেশি ম্যাস্কুলিন আর হি-ম্যান হওয়ার জন্য অখাদ্য-কুখাদ্য খেতে রাজি। ভিটা-এক্স বলে বডি বিল্ডিংয়ের টনিকের নাম শুনেছ? সদর বাজারে ছেলেদের ধরে ধরে এই নর্দমার আলকাতরা বিক্রি করে দোকানদাররা।

    - এতগুলো ছেলে এরকম গাড়ল কী করে হয়? সপ্‌না আশ্চর্য হয়ে বলল।

    তানিয়া আমাকে আশ্বস্ত করে বলল – মাইণ্ড্‌ নহীঁ করনা। সপ্‌না তোমাকে ছোট করার জন্য বলছে না। একটু আধটু গাড়ল হলে তাতে কোনো দোষ নেই। আমরা সকলেই তাই। একটু গাড়ল না হলে সহ্য করা যায় না।

    তানিয়ার বলার ধরণ দেখে বাকি দুজনের দাঁত বেরিয়ে এসেছে। পম্পাও এদের তালে তাল দিচ্ছে বলে আমি বেশ নিরাশ হচ্ছিলাম।

    মুখে একটা বিদ্রুপমার্কা হাসি ফোটাবার চেষ্টা করে বললাম – মেয়েদের পছন্দ করা আর মেয়ে হতে চাওয়া কি এক জিনিস? তুমি যদি ললিপপ খাওয়া পছন্দ করো তার মানে কি তুমি ললিপপ হতে চাও?

    - ও, তার মানে তুমি মেয়েদের ললিপপ হিসেবে দেখো। সপ্‌নার কাছ থেকে চ্যাটাং করে জবাব এসে গেল অমনি। - তোমার ললিপপ যদি নিজেকে অন্যদের দিয়ে চাটায় তো তোমার কেমন লাগবে হি-ম্যান?

    আমাদের বেশির ভাগ কথা ইংরেজিতে হচ্ছিল। সপ্‌নাকে ইংরেজী বলতে দেখে আমরা সবাই বুঝেছিলাম তার গুঁফো তাউজী সব কথা বুঝে ফেললে অসুবিধে আছে। গল্পও তাই কিছুটা হিন্দী, কিছুটা ইংরেজী মিশিয়ে বলছি।

    সপ্‌নাকে বললাম – আমি বোকা হতে পারি, কিন্তু গর্দভ নই।

    আমাকে থামিয়ে দিয়ে সপ্‌না বলল - গর্দভদের ছাড়ো। সত্যি করে নিজের কথা বলো। তুমি কি আমাদের মতো হতে চাও?

    হঠাৎ এমন বিপুলভাবে তোতলাতে শুরু করেছি যে সবার সন্দেহ আরো ঘনিয়ে উঠল। বলছিলাম – নট রিয়্যালি। তোমরা যদি ভেবে থাকো জুম্মনের মতো আমি কোনোদিন স্কার্ট পরেছি তাহলে সে ভুল ধারণা ত্যাগ করো।

    বলতে গিয়ে এত তুতলেছি যে আমার কথা কেউ বিশ্বাস করল না। তানিয়া পম্পাকে প্রায় ডিঙিয়ে এসে বলল – এই জয়, আমার লাইট ব্লু সেমি-ট্রান্সপ্যারেন্ট বটনদার ব্লাউজটা তোমার পরতে ইচ্ছে করে? লজ্জা না করে বলে ফেলো। কাউকে বলব না আমরা।

    সপ্‌না একটা মেশিন গানের বার্স্টের মতো অট্টহাসি হেসে উঠেছে। হিন্দীতে এটাকে বলে ঠহাকা এবং আমার চেনা মেয়েদের মধ্যে এটা একমাত্র পাঞ্জাবিনীরাই ঠিকমতো লাগাতে জানে। রাগটা শাস্ত্রমতো লাগাবার পর সে বলল – জিন্‌সের কাছে কিচ্ছু দাঁড়ায় না পাপ্পে। তুমি একবার আমার সিঙ্গাপুর থেকে আনা হারা-টা পরে দেখো না। পাখির পালকের মতো হালকা আর খরগোশের মতো মোলায়েম, খানিকক্ষণ পর মনে হবে নিজেরই স্কিন। শুধু আরেকটু ইমপ্রুভ্‌ড।

    এতক্ষণে তানিয়ার বোধহয় আমার উপর একটু দয়া হচ্ছিল। সে আমাকে রেহাই দেওয়ার জন্য বলল – আচ্ছা জয়, ঠাট্টা ছেড়ে বলো তোমার মাথায় জুম্মনকে ঘাঘরা পরাবার আইডিয়া এল কোত্থেকে? একটা তো কোনো সোর্স থাকবে তার।

    পম্পা জানে সোর্স কী, তাই সে ঘাপটি মেরে বসে আছে। আমি আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম ওটা আমার ট্রেড সিক্রেট হিসেবে গোপন থাকবে। তানিয়াকে বললাম – মনে করো উৎস হল পঞ্চতন্ত্র বা হিতোপদেশ। যেখান থেকে সাপ-ব্যাং আসে। তোমরা তো জানো আমার গল্পে সাপ-ব্যাং কথা বলে। এটা আর এমন কী উদ্ভট?

    সপ্‌না বলল – তাহলে একটা সত্যিকারের সিরিয়াস প্রশ্ন করব? এই হুরীগুলোকে তুমি এত দায়িত্বজ্ঞানহীন বানালে কেন? সেটা কি তারা মেয়ে বলে? এদের জীবনে কোনো উদ্দেশ্য নেই, স্ট্রাগ্‌ল্‌ও নেই। গুড ফর নাথিং। লুজার!

    আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়ে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কোন দিকে চলেছি? সপ্‌না আমাদের গন্তব্য কী সেটা জানায়নি। গাড়িটা কমলা নগর থেকে বেরিয়ে ইউনিভার্সিটির দিকে চলেছিল। ডানদিকে বর্ষার রিজ, যার টিলা আর জঙ্গল বেমালুম আমার গল্পে ঢুকে এসেছে। গাড়ির ভিতরে চারটে ছেলেমেয়ে, যাদের কারো জীবনে কোনো উদ্দেশ্য আছে বলে মনে হয় না। কে বলবে আমরা সবাই ‘গুড ফর নাথিং’ নই? শিমলিপুরে তো সেটাই স্বাভাবিক। কেউ যেটাকে বিরাট সমস্যা বলে মনে করে না সেটা গল্পে আছে বলে এদের এত দুশ্চিন্তা, এত হীনমন্যতা কেন?

    পম্পা আমাকে একটা ঠেলা মেরে বলল – হুরীগুলো কাদের ক্যারিকেচার জয়? আমাদের?

    *****


    পরে আমি বলেছিলাম – হ্যাঁ হুরীরা তোমাদের ক্যারিকেচার হতে পারে। তবে শুধু তোমাদের নয়। গল্পের সমস্ত চরিত্রের ভিতরে একজন লুকিয়ে থাকে। সে হল গল্পের লেখক। নিজেকে ভেঙে যে ইঁট আর বালি বেরোয় তাই দিয়ে চরিত্রদের মূর্তিগুলো বানাতে হয়। যে লেখক নিজে লুজার নয় তার পক্ষে একটা সঠিক লুজার চরিত্র লেখাও দুষ্কর নিশ্চয়ই।

    সপ্‌না বলল – আমি এই হুরীগুলোর মধ্যে দায়িত্বহীনতার চেয়েও বেশি দেখছি আগাগোড়া মূর্খামি। সিলিনেস।

    তানিয়া বলল – ভুল! মূর্খরা নিজের ক্ষতি করে। এরা অন্যের ক্ষতি করছে শুধু। বিশেষ করে যারা দুর্বল। যেমন বাচ্চারা, গাধারা, বা পশুপাখিরা।

    পম্পা আমাকে বলল – সোজাসুজি বল না জয়? আমরা মূর্খ, না নিষ্ঠুর?

    কী জবাব দেব বুঝতে পারছি না। ভাগ্য ভালো, আমার মাথা খোলার আগে তানিয়ার মুখ খুলল। বোধহয় আমাকে বাঁচাবার জন্য সে সাফ জানিয়ে দেয় – আমি তো দুটোই। এবং তার জন্য কোনো দুঃখ নেই। বরং গর্বই আছে একটু।

    ওরা সবাই হাসতে শুরু করেছিল। আমি তাতে যোগ দিলেও মনে মনে ভাবছি এই হাসিটা কি নকল? পম্পা আমাকে আগেও কয়েকবার বলেছে, তাদের পাড়ার মেয়েরা বোকা নয়, বোকা সেজে যখন ইচ্ছে নকল হাসি হাসে। কীসের তাগিদে এরকম একটা অদ্ভুত বা সমবেদনাহীন কাজ করে কেউ? আমার গল্পের চরিত্রদের চেয়ে এরা কম উদ্ভট? অনেকক্ষণ ধরেই কি এরা আমাকে বোকা বানাচ্ছে?

    গাড়িটা মল রোডের কাছাকাছি এসে পড়েছে। আমার ভিতর থেকে কে যেন বলে দিচ্ছিল এরপর সেটা ডানদিকে বেঁকবে। সেই সঙ্গে আমার বুকে একটা গুড়গুড় করে ভয়ের বাজনা বাজতে শুরু করেছে।

    সপ্‌না আমার শুকিয়ে যাওয়া মুখ দেখে চোখ নাচিয়ে বলল – কী ভাবছ রাইটার? প্রশ্নগুলো শক্ত হয়ে গেছে নাকি?

    আমি প্রসঙ্গে ফিরে এসে বললাম – মেনে নেওয়া যাক যে এরা একটু সিলি, এবং এদের নীতিজ্ঞান তোমাদের মতো উচ্চাঙ্গের নয়। তাই বলে কি এরা মানুষ নয়? হয়তো এরা সেই জমানার লাস্ট বেঞ্চার। দ্যাখো, এই হুরীগুলো দিনের বেলা একদম সাধারণ মেয়ে হয়ে যায়। তখন এদের কোনো ক্ষমতাও থাকে না। পাওয়ারটা বেরিয়ে আসে রাত্রিবেলা, যখন তারা ওই পুরোনো কেল্লার ভিতরে জড়ো হয়, যার পাশে সেই রহস্যের তালাব। তালাবের বুক থেকে একটা চাঁদ ঝড়ের রাতে ছেলেমেয়েদের চুরি করার জন্য ডাকে। এই চাঁদ পৃথিবীর আকাশের চাঁদ নয়। এই বদ গ্রহ ওঠে স্বপ্নের ভিতর। অর্থাৎ হুরীরা একেবারে সাধারণ মেয়ে। স্কুল-কলেজে যায়নি, তাই হয়তো তাদের মূল্যবোধ একটু অন্যরকম। হয়তো সেই জমানা ছিল এখনকার তুলনায় একটু বেশি নিষ্ঠুর। কিন্তু তোমাদের সঙ্গে তাদের আসল তফাৎ হল এই যে তাদের স্বপ্নের জগতে একটা বদ গ্রহ আছে। সেই স্বপ্নের জগতের সঙ্গে তোমাদের স্বপ্নের কোনো মিল আছে কিনা আমি জানি না।

    - আমার জীবনটাই একটা স্বপ্ন রে। একটা দুর্বোধ্য স্বপ্ন। সেইজন্য আমার নাম সপ্‌না। নিজেকে সারাক্ষণ চিমটি কেটে কেটে জাগাবার চেষ্টা করি আমি।

    আবার আবার হাসতে লাগলাম। এই হাসি নকল নয় কারণ একসঙ্গে স্বতস্ফুর্তভাবে এসেছিল সবার কাছে। এমনকি আমাদের গাড়িও হাসতে হাসতে যেদিকে ঘুরবে ভয় করেছিলাম সেদিকে ঘুরল।

    আমাকে গল্পে ফিরে যেতে বলা হয়েছিল। হুরীদের এতটা সমালোচনা হওয়ার পর আমি তাদের কার্যকলাপের আরেকটু বিশদে বর্ণনা দিতে বাধ্য হলাম।




    *****

    কমবখ্‌ৎপু্রের কাণ্ডজ্ঞানহীন হুরী (আগের পর...)

    সেবার পাখিগুলো তাদের বিরাট পেটগুলো ভর্তি করে খেতে গিয়ে প্রথম কয়েকদিন শেয়াল কুকুরের বলি হয়েছিল। যারা বেঁচে যায়, তারা কিন্তু চালাক হয়ে আধপেটা খেতে শেখে। পরে দেখা গেল যে এই সংযমী পাখিরা শিকারীদের পাতা ফাঁদেও পড়ছে না। শৈ জুম্মনকে বলল – দেখলি তো? সব ভালো যার শেষ ভালো।

    পরের মজলিসে প্রস্তাব হল শীতের দিনে কমবখ্‌ৎপুরের হাওয়ায় যে একটা ঘামের বোঁটকা গন্ধ ভাসে সেটা হটাবার জন্য নদী-নালা আর পুকুরগুলোর জল হামামের মতো গরম করে দেওয়া হোক। স্নান এমন আরামদায়ক হলে লোকেরা করবে না কেন? দেখা গেল জুম্মন আবার কাবাবে হাড্ডি। সে গুঁই গুঁই করে বলল – উদ্দেশ্য ভালোই কিন্তু মাছেদের কী হবে? কুমীর যদি গরম সইতে না পেরে ডাঙায় উঠে আসে? পনেরোজন হুরী প্রথমে তার উপর চোটপাট করলেও, কুমীর উঠে আসার সম্ভাবনা সামনে আসার পর দেখা গেল তারা আগের চেয়ে একটু নরম হয়েছে। লীঃ বলল – ঠিক আছে, জল বেশি গরম করতে হবে না। শুধু শীতকালে যেমন কনকনে ঠাণ্ডা হয়ে যায় সেটা বন্ধ করে দেওয়া যাক। এই সমাধানের ফল সত্যিই ভালো হয়েছিল। গোটা শীতে কমবখ্‌ৎপু্রে স্নান করার লোভে দূর দূর থেকে লোকেরা আসতে থাকে, এবং এটা যে হুরীদের কাজ সেটা আন্দাজ করে তাদের নামে ধন্য ধন্য পড়ে যায়।

    শহরে এত ভীড় দেখে কিন্তু হুরীরা প্রচণ্ড বিরক্ত হয়েছিল। শীত কাটতে না কাটতে তারা প্রস্তাব দিল বসন্তের গোড়াতে চেচক, মানে বসন্ত-রোগের বিমারী লাগিয়ে দেওয়া যাক। শুধু ছোট ছেলেমেয়েদের হলেই যথেষ্ট। একটা ভয়ের সঞ্চার ঘটলে ভিনদেশী মানুষগুলো পালাবে।

    - আরে বাবা, বসন্ত তো তোমাদের নিজেদের বাড়িতেও হবে তাহলে! বিস্মিত হয়ে বলল জুম্মন।

    - এতই বোকা যে সেটা ভাবিনি? আমাদের কারো ছোট ছেলেপুলে বা ভাইবোন নেই। বলে হে-হে করে একদম ফুটপাথ-ছাপ জাহিলদের মতো হাসতে লাগল হুরীরা।

    ছোটদের সবার বসন্ত হল। চারদিকে ত্রাহি ত্রাহি রব। কাজটা হুরীদের না কিস্মতের সেটা বুঝতে না পেরে শহরটা বুদ্ধুর মতো চুপ করে গেছে। ভিনদেশীদের সঙ্গে দলে দলে দেশী মানুষও পালাচ্ছে। জুম্মন চেয়েছিল সবচেয়ে প্রথমে অসুখ তার হোক। খুব লজ্জার কথা, হুরীরা কোনো একটা জাদু করে তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। এর ফলে শহরের সবাই জুম্মনদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবছে – এই জুম্মন ছেলেটা কি শয়তানের বংশধর? তার কিছু হয় না কেন? অবশ্য কমবখ্‌ৎপু্রের লোকেরা জানত কিছু বলা শিষ্টাচার নয়। ছেলেটার মাথায় যদি শিংও গজায় আর পা-দুটো খুরের মতো দেখতে হয়ে যায়, তাতেই বা অন্যদের কী?

    হুরীদের উপর আগে জুম্মনের খুব একটা আস্থা ছিল না। এখন তালাবের ঘানিতে নামার ফলে তার নিজের মধ্যেও হুরীওয়ালী তাকৎ অল্প-স্বল্প জন্মাতে শুরু করেছে। তাই সে আর বলবে কী? বছরে একবার হুরীরা অবশ্য একটা দারুণ কাজ করে। বসন্তের কয়েকটা দিনে শহরের সমস্ত গাছে সাদা, হলুদ, লাল, নীল, এবং এমনকী সবুজ ফুল ফোটাত তারা। সেই সব অজানা ফুলের কোনো নাম নেই। এই কয়েকটা দিন কমবখ্‌ৎপু্রের আকাশে রাতের তারাগুলো আতশবাজির মতো আলোর ফুলকি ছড়িয়ে দুম দুম করে ফাটত। সেই অচেনা ফুল আর তারাবাজির জন্য কমবখ্‌ৎপু্রের হুরীদের নাম ছড়িয়ে গিয়েছিল দেশ দেশান্তরে। জুম্মন ভাবত যদি সে লাঃ-এর মতো দলের সবচেয়ে বয়স্ক হুরী হত তাহলে তার দল এই ধরণের দুর্দান্ত কাজ ছাড়া আর কিছুই করত না।


    *****


    তো এইভাবে ভালো মন্দ মিশিয়ে একটা বছর কাটল আর জুম্মনের চৌদ্দ বছরের সালগিরহ, মানে জন্মদিন, পড়ে গেল বসন্তের গোড়ায় একটা বিশেষ তারীখে। শবান মাসের এই রাতের নাম শব-এ-বরাত, যেদিন আকাশ থেকে জোব্বা চোগার তামাম জেব উলটে দিয়ে আসমানের জিন-হুরী-পরীরা মানুষের ভাগ্যের তাসগুলো মাটিতে ঝেড়ে ফেলে দেয়। কে কী পেল জানার অপেক্ষায় শহরের মানুষরা তাদের বাড়ির ছাদে কিম্বা উঠোনে প্রদীপ হাতে দাঁড়িয়ে থাকে। জুম্মনও সেদিন বেরিয়েছিল হুরীদের দলের সঙ্গে টহলে।

    জুম্মনের ওই একটাই ঘাঘরা। তাও সে মুখে মুলতানী মিট্টি মেখে এবং হাতে মেহেন্দীর ছেঁচা পাতা দিয়ে কয়েকটা ফুল আর লতা এঁকে নিজেকে সাজিয়ে নিয়েছে। গভীর রাতে যখন জানালায় দিয়া জ্বালিয়ে শহরের সবাই ঘুমোচ্ছে, তখন পাথুরে গলির দেয়ালের সঙ্গে সেঁটে ষোলোটা হুরী চুপিচুপি হাঁটছিল। কখনো কোনো একলা বাড়ির ধারে দেখা যাচ্ছে একটা সবুজ তাস, যা মানুষের গুনাহ মাফ করে, কিম্বা হয়তো একটা নীল তাস, যা চোখের দৃষ্টি ফিরে পাওয়ায়। হুরীরা সেগুলো কুড়িয়ে নিয়ে জুম্মনের হাতে দিয়ে বলল – যা গিয়ে জানালা দিয়ে ঘরের ভিতরে ছুঁড়ে দিয়ে আয়।

    জুম্মন দেখল জানালাগুলোতে রাখা টিমটিমে লালচে আলোর কম্পমান আভায় চারদিকের পাহাড় আর টিলার গায়ে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে অগুনতি রং-বেরঙের ছায়া। তার মধ্যে স্পষ্ট বোঝা যায় ঘাঘরা পরা টানা চোখের মেয়েদের আকৃতি। এক পাথর থেকে অন্য পাথরে যাওয়ার সময়ে তারা একজন আরেকজনকে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছিল।

    কোত্থেকে এসে শৈ তার কানে কানে বলল - এগুলো কারা জানিস থুক? অনেক দিন আগের গুজরে যাওয়া হুরী, যারা সেই গুজরে যাওয়া শহরের কোনো গুজরে যাওয়া মানুষের মায়া কাটাতে না পেরে পাথরের চাঁই আর দেয়ালের ভিতর জীয়ন্ত ছায়া হয়ে গেছে।

    টিলার মসৃণ দেয়াল থেকে সরে এসে জুম্মন বলল – আচ্ছা আমরা ক্রমশ পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছি কেন?

    - কারণ এবার আমরা নালা পেরিয়ে পুরোনো শহরে প্রবেশ করব। এখানে দল বেঁধে গেলে সিপাহীদের হাতে ধরা পড়ার ভয়। শৈ ঠোঁটে আঙুল দিয়ে জুম্মনকে গলা নিচু করতে শিখিয়ে দিয়ে আবার তার কানে কানে বলল - দেখবি বেশির ভাগ ছায়ার রং আগুনের মতো নীল। শুধু কদাচিৎ দেখতে পাবি এক একজনের রং পোড়া মরীচের মতো লাল, এবং এত আবছা যে প্রায় দেখাই যায় না। সেই ছায়াগুলো নিজেদের জায়গা ছেড়ে বেশিদূর যাবে না। তাদের দেখলে পালাতে হয়। একবার ছুঁয়ে ফেললে বরফের মতো তোর হাত জমে যাবে আর সাতদিন মন ভালো হবে না।

    - কেন? এরা কি হুরী নয়?

    - হুরীরা নিজের ইচ্ছেয় মরে। কিন্তু এরা কোনো গুরুতর অপরাধ করে ধরা পড়ে গিয়েছিল। যার জন্য জ্যান্ত দেয়ালে গেঁথে ফেলা হয়।

    কী সেই অপরাধ? শিউরে উঠে মনে মনে ভাবল জুম্মন।

    দূরের অন্যান্য গলি থেকে মশ্‌মশ্‌ করে সিপাহী আর পাহারাদারদের জুতোর শব্দ। সেগুলোকে এড়িয়ে একজন আরেকজনের সঙ্গে তফাৎ রেখে নিজেদের পথ করে নিচ্ছে হুরীরা। একা হয়ে যাওয়ার পর জুম্মনের মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তার একটা দুটো কচি গোঁফ দেখা দিচ্ছে। হুরীদের অধিবেশনে যাওয়ার আগে ছাঁটতে হয়। সে ভাবছিল এইভাবে কতদিন চালানো যাবে? একদিন সেও লৈ আর শৈয়ের মতো আকাশের তারার নিচে দাঁড়িয়ে নিজের চোখ দুটোকে টেনে লম্বা করে তাকাতে চায়। কিন্তু তার আগেই কি সে দল থেকে বহিষ্কৃত হয়ে যাবে না?

    চলতে চলতে ছোট বাড়িঘরগুলো পেরিয়ে তারা এসে পড়েছিল শহরের ফাটকের ভিতর বানানো বহু পুরোনো কেল্লা, মসজিদ, আর বিরাট বিরাট হামামগুলোর কাছে। রাস্তার একধারে খাম্বার উপর ছোট ছোট প্রদীপ বসানো।

    আমি তো একটা ছেলে! তাহলে কেন মেয়েদের জামা পরে মেয়ে সেজে হাঁটছি? নিজের ভাগ্যের তাসকে জিজ্ঞেস করল জুম্মন। কেন এই নীল ঘাঘরাটা সবাইকে ছেড়ে আমার মুখেই এসে আছড়ে পড়ল? কে পাঠিয়েছিল এটা?

    এই নয় যে সে দিনের বেলা মেয়ে সেজে থাকতে চায়। তখন আর পাঁচজন ছেলের মতোই তারও ইচ্ছে করে চোর বাজারের মোরগের লড়াইয়ে নিজের হাতে তৈরী একটা শানদার মোরগ নামায়। অন্য সব ছেলেদের সঙ্গে পুল মিঠাইয়ের নালার ধারে বসে এজমালি হুক্কা টেনে আসে। বাড়ির ছাদ থেকে ধারালো মাঞ্জা দেওয়া ঘুড়ি ওড়ায়। মোটেও তখন সে মেয়ে হয়ে থাকতে চায় না।

    কিন্তু রাত্রিবেলা যখন সিতারার জরি বসানো পারদর্শী মখমলের পোষাক পরা আসমানের উমরাও জান তরুণ আর তরুণীদের কিস্মতের ছক্কাগুলো গড়িয়ে দিতে আসে তখন জুম্মন নিজেকে হুরী ছাড়া আর কোনো রূপে কল্পনাও করতে পারে না। দিন আর রাতের মধ্যে তার নিজের ইচ্ছে কেন এইভাবে রং পালটাতে থাকে সেই রহস্য জুম্মন এতদিনেও ভেদ করতে পারেনি।

    নিজের দুঃখী বেওকুফ মনকে দুষতে দুষতে জুম্মন বুঝতে পারেনি যে সে হুরীদের দেখানো পথ হারিয়ে ফেলেছে। হঠাৎ তার কানের কাছে ফিসফিস করে কেউ যেন বলল –

    আমি জানি, তুমি আসলে কী!



    *****


    মল রোড থেকে গাড়ি শিমলিপুরের দিকে ঘুরেছে। আশা করি এই প্রকাণ্ড গোঁফওয়ালা ড্রাইভার জানে সে কোথায় চলেছে। আমার মনে কৌতুহলের চেয়ে বেশি পেট্রলের ধোঁয়ার মতো যা ঢুকছিল তা হল একটা আশঙ্কা। মুখ ফুটে সপ্‌নাকে তার বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস হচ্ছিল না। সে যদি বলে – না সেরকম আগে ভাবিনি, কিন্তু কথাটা যখন পেড়ে ফেললি তখন সেখানেই যাওয়া যাক...?

    সপ্‌না আমাকে চুপ দেখে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল – আচ্ছা জয়, রাতের ঘটনাগুলো কি স্বপ্ন, না পনেরোজন হুরী সত্যিকারের মেয়ে?

    স্বপ্ন বলতে আমি অভিলাষা বোঝাচ্ছিলাম। সপ্‌না সেটাকে ঘুমের ভিতর দেখা থিয়েটার ভেবে নিয়েছে বোধহয়।

    সপ্‌নার সন্দেহ নিরসনের জন্য গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে বললাম। - না, না। সবকিছু তোমার আমার মতো রিয়্যাল। ঘটনাগুলো যা-ই হোক, গল্প যেমনই হোক, মানুষগুলো সাচ্চা আর খাঁটি।

    পম্পা আমাকে থামিয়ে বলল – এই তোরা ওর সব কথা বিশ্বাস করিস না। এখন যা বলছে সেটা প্‌য়োর বক্‌ওয়াস। সোজা মানে হল এই যে জুম্মন নামের ছেলেটা নিজের পরিচয় খুঁজছে। জানতে চাইছে দিন আর রাতের মধ্যে কোনটা তার সত্যিকারের রূপ। তারপর পম্পা আমার দিকে তার হরিণ চোখের ঝপকি দিল একটা। মানে – ঠিক বললাম তো?

    গাড়ি শিমলিপুর রোড দিয়ে তার গন্তব্যের দিকে চলেছে। সেটা কি আমাদের বাড়ি? তা হলেই বাঁচি। শিমলিপুরের জঙ্গলে আর যা লুকিয়ে আছে তা এই পার্কটাউনের পার্টির জন্য নয়। পার্কটাউনের পার্কে যখন দিনের আলো, শিমলিপুরে যমুনার ধারের এই জঙ্গলে তখনো রাত শেষ হয়নি। দিন আর রাতের মধ্যে একই সঙ্গে বাস করি আমরা!

    নাঃ এটা বোঝানো যাবে না। অযথা তর্ক না বাড়িয়ে গল্পের গাড়িকে তার সমাপ্তির দিকে নিয়ে চললাম।




    *****

    কমবখ্‌ৎপু্রের কাণ্ডজ্ঞানহীন হুরী (আগের পর...)

    কানের পাশে আওয়াজ শুনে চমকে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল জুম্মন। সামনে, পিছনে, ডাইনে, বাঁয়ে কেউ নেই। বাঁদিকে একটা হামামবাড়ির পাথুরে, মসৃণ দেয়াল। শব্দটা কি সে দিক থেকেই এসেছে?

    ভালো করে দেয়ালটাকে দেখতে গিয়ে জুম্মনের শরীর কাঠের মতো আড়ষ্ট হয়ে যায়। দেয়ালের গায়ে কুয়াশার চেয়ে আবছা, যেন কালো ধোঁয়ার আবরণ ভেদ করে, একটা গাঢ় লাল রঙের ছায়ামূর্তি তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। জুম্মন বিস্মিত হয়ে দেখল সেটা তার মতো একটা ছেলে। বয়সে আরো ছোটই হবে। পরনে কী তা বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু নিশ্চয়ই জুম্মনের মতো পান চিবিয়ে তার রস ঠোঁটে মেখেছিল সে। আর তার দুই বাহু জুড়ে তরুণীদের হার মানানো মেহেন্দীর চিত্রকলা।

    চোখ নাচিয়ে জুম্মনকে ডাকল ছেলেটা। তারপর একটা কচি গলায় বলল –

    তুমি কী সেটা আমি তোমাকে বলে দিতে পারি, যদি কাছে এসে আমার হাতের উপর তোমার হাত রাখো।



    *****


    লাঃ- লীঃ-লৈ-লুক-শাঃ-শীঃ-শৈ-শুক-হাঃ-হীঃ-হৈ-হুক-থাঃ-থীঃ-থৈ কমবখ্‌ৎপু্রের পুরোনো শহরের অলিগলি দিয়ে একে অপরের সঙ্গে দূরত্ব রেখে সন্তর্পনে যাচ্ছিল। হঠাৎ নিস্তব্ধতার পর্দা ছিঁড়ে একটা তীব্র চিৎকার ভেসে এসেছে।

    বাঁ-চা-আ-আ-আ-আ-ও!!!!!



    লাঃ- লীঃ-লৈ-লুক-শাঃ-শীঃ-শৈ-শুক-হাঃ-হীঃ-হৈ-হুক-থাঃ-থীঃ-থৈ -এর বুঝতে একটুও অসুবিধে হল না যে সেটা কার গলা। অমনি তারা সবাই দুহাতে ঘাঘরার ঘের তুলে ধরে সাঁই সাঁই করে ছুটল যেদিক থেকে শব্দটা এসেছিল। দূরের গলিগুলো থেকে সিপাহী আর পাহারাদাররাও শুনেছিল জুম্মনের চিৎকার, এবং তারা লাঠি আর তলোয়ার তুলে দৌড়েছিল একটা দিক আন্দাজ করে। সবচেয়ে প্রথমে জুম্মনকে এসে ধরে থাঃ-থীঃ-থৈ। এসেই তারা একজন জুম্মনকে বাঁদিক, একজন ডানদিক, আর একজন পিছন থেকে ধরে প্রাণপনে টানতে শুরু করেছিল। ততক্ষণে জুম্মনের হাতের দুটো পাঞ্জা সেই হামামের দেয়ালে ঢুকে মোমবাতির শিখার মতো দুলছে। কোনো অদৃশ্য ভুতুড়ে শক্তি জুম্মনকে আস্তে আস্তে দেয়ালের মধ্যে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। দেখতে দেখতে লাঃ-লীঃ-লৈ-লুক-শাঃ-শীঃ-শৈ-শুক-হাঃ-হীঃ-হৈ-হুক-ও এসে পড়ে কেউ হাত, কেউ পা, কেউ ঘাঘরা, কেউ চোলি ধরে জুম্মনকে দেয়াল থেকে বার করার চেষ্টায় লেগে যায়।

    জুম্মনের দু-চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। শরীর বরফের মতো ঠাণ্ডা হলেও সারা গা দিয়ে গড়াচ্ছিল ঘাম। সে অস্ফুটভাবে বলল – আমাকে তোমরা ধরে রাখতে পারছো না। দেখো, আমি আস্তে আস্তে ঢুকে যাচ্ছি। আরো জোরে টানো, আরো জোরে!

    হুরীরা তাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে টেনেও যখন জুম্মনকে আটকাতে পারছিল না তখন পাহারাদার আর সিপাহীরা গলির দুদিক থেকে ছুটে আসে। এই টানা চোখের মহিলারা কে সেটা বুঝতে তাদের একটুও সময় লাগেনি, কিন্তু হেসে আলাপ করার তখন সময় ছিল না। তারা সোজা হুরীদের জাপটে ধরে হ্যাঁচকা টানে সবাইকে দেয়াল থেকে উপড়ে আনার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পনেরোটা হুরী আর আধডজন সিপাহী মিলে হেইশা-হেইশা বলে আপ্রাণ টেনেও কিন্তু জুম্মনকে থামাতে পারছিল না। এক চুল এক চুল করে সে মিলিয়েই যাচ্ছে হামামের দেয়ালে। তখন হুরীদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে সিপাহীরাও ছাড়ল একটা করুণ বাঁচার প্রার্থনা।

    বাঁ-চা-আ-আ-আ-আ-ও!!!!!



    সেই মর্মভেদী ডাক শুনে শহরের সমস্ত ঘুমন্ত নারী আর পুরুষ, ছোট আর বুড়ো, গাধা আর ইঁদুর, মোরগ আর বেড়াল তাদের নরম বিছানা থেকে আঁক্‌ শব্দ করে পড়ে গিয়েছিল মাটিতে।

    তারপর তারা সবাই বোরখা, পাজামা, লুঙ্গী, ঘাঘরা, সামলাতে সামলাতে ছুটল সিপাহীদের সাহায্য করবে বলে।

    গাধারা সিপাহীদের কোমরবন্ধ কামড়ে ধরে ঘেঁহু-ঘেঁহু শব্দে টানতে লাগল।

    মানুষরা ধরল গাধার লেজ।

    ছোটরা বুড়োদের ঠ্যাং, আর মহিলারা পুরুষদের কোমর জড়িয়ে ধরে জোর-লগা-কে-হেইশা বলতে বলতে একজোট হয়ে টানতে লাগল যাতে জুম্মনকে দেয়াল থেকে বের করে আনা যায়।

    ততক্ষণে জুম্মনের দুটো হাত কনুই অবধি ঢুকে গেছে। জুম্মন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে যতটা সম্ভব দেয়াল থেকে দূরে রাখতে চেষ্টা করছিল। শব-এ-বরাতের সেই আশ্চর্য রাতে যখন কমবখ্‌ৎপু্রের প্রতিটি মানুষ আর স্তন্যপায়ী জীব, প্রতিটি পাখি আর উদ্ভিদ, প্রতিটি শরীরী আর ভিখিরি জুম্মনকে বাঁচাবার জন্য তাদের মন-প্রাণ একাগ্র করে পরস্পরকে টানছিল তখন জুম্মন বুঝতে পারল, শুধু এই একটা শহর নয়, আরো দু-চারতে গাঁ আর শহরের মানুষদের জড়ো করলেও তাকে এই দেয়াল থেকে বার করা সম্ভব নয়। তার ভাগ্যের তাস ফেলা হয়ে গেছে।

    জুম্মন বুঝল শহরের তামাম জনতাকে রেহাই দেওয়ার জন্য নিজের ইচ্ছেতেই কমবখ্‌ৎপু্রের দেয়ালে তার মিলিয়ে যাওয়া উচিত। এটা ভেবে যখন সে একটু কাষ্ঠ হাসি হেসে সবাইকে শেষবারের মতো দেখে নিচ্ছে তখন হারুন রশিদ নামের একটা একশো ষাট বছরের বুড়ো সবার থেকে দশ হাত দূরে বাঁশের লাঠি হাতে ‘দাঁড়া আমি বদমাশকে শায়েস্তা করব’ বলতে বলতে আসছিল। অন্ধপ্রায় হারুন রশিদ হনহনিয়ে এসে জুম্মনকে পাশ কাটিয়ে সোজা সেই পাথরের দেয়ালে গিয়ে ধাক্কা খেল। সবাই ভাবছে – এই রে, বুড়ো মরবে এবার। এদিকে হারুন রশিদ হঠাৎ দেয়ালের দিকে আঙুল দেখিয়ে চেঁচিয়ে বলল – আরে এটা আমাদের হুনর না? এই হুনর তুই দেয়ালের ভিতর লাল ছায়া হয়ে নড়ছিস কেন?

    অবাক কাণ্ড! হারুন বুড়োর মুখ থেকে এই কথাটা বেরোনো মাত্র সাঁৎ করে একটা লাল ছায়া দেয়ালে সরে গেল আর জুম্মনের হাত দুটো মুক্ত হয়ে নরম ময়দার লেচির মতো তুলতুলে অবস্থায় বেরিয়ে আসতে শুরু করল। লাঃ-লীঃরা তীব্র একটা চিৎকার করে বলল – সাবধান! কেউ জুম্মনকে এখন ধোরো না! আগে ওর হাতগুলো জমে শক্ত হোক।


    শহরের লোকেরা মেয়েদের মতো সেজে থাকা জুম্মনকে চিনতে পারেনি। তারা ভেবেছিল ষোলোজন হুরীর মধ্যে একজনকে খুনে দেয়ালের হাত থেকে বাঁচিয়েছে তাদের রাগী বুড়ো হারুন রশিদ। তারা হুরীদের ছেড়ে হারুনকে ঘিরে ধরে বলল – হারুন বুড়ো, এই হুনরটা কে? কাকে দেখলে তুমি দেয়ালের ভিতর?

    ধাক্কা খেয়ে হারুনের মাথা গুলিয়ে গিয়েছিল। একটু সামলে ওঠার পর সে বলল – অনেক দিন আগের কথা। তখন আমার বয়স আট কি দশ। হুনর বলে একটা পাক্কা বদমাশ ছেলে আমাদের শহরে থাকত। আমার চেয়ে বড়জোর দু-তিন বছর বড়ো হবে। সেই প্রচণ্ড সেয়ানা ছেলেটা বাজারের মাঝখানে একদিন এক বস্তা রুটির মতো প্রকাণ্ড বাতাসা বিলিয়েছিল। বাতাসা খাওয়ার পর সেই রাত্রে গোটা শহরের লোক শীতের অজগরের মতো গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে পড়ে। সেই মনহূস ঘুম ভেঙেছিল সাত দিন সাত রাত পরে। আর ততদিনে প্রত্যেকের বাড়ি তোলপাড় করে কেউ একটা দামী জিনিস চুরি করে নেয়।

    - দামী জিনিস! লা-হওল-বিলা-কুব্বত! কী জিনিস সেটা?

    - ওই মনহূস ঘুম থেকে ওঠার পর সেটাই কারো মনে পড়েনি। বেওকুফ হুনর নিজেও গোটা দশেক বাতাসা খেয়ে নেয়। তাকে যখন জঙ্গলের মধ্যে হুরীর তালাবের ধারে খুঁজে পাওয়া যায় তখন সেই পাজির পেশাবের শরীর নীল হয়ে মরো মরো অবস্থা। গরম তেল মাখিয়ে ব্যাটাকে চাঙ্গা করা হয়। তারপর সবাই তার হাতে পায়ে ধরে জিজ্ঞেস করে – আরে আমার গাঁদাফুলের গুলদস্তা, হালুয়ার জামবাটি, তোকে আমরা কিচ্ছু বলব না, শুধু আমাদের কী চুরি গেছে সেটা দয়া করে বলে দে। তোর সাঙ্গোপাঙ্গোরাই তো সাফ করেছে আমাদের ঘর। তখন সেই বেশরম ফ্যাচাংয়ের ফালুদা ফুকরে উঠে বলে – আমারই বা কিছু মনে আছে নাকি? সাঙ্গোপাঙ্গো তো ছাড়ো, আমি কে, কী আমার নাম, কিচ্ছু মনে করতে পারছি না। সবাই বলল – আরে তোর নাম হুনর। তুই একটা হাড় বদমাশ ছেলে। কোথায় থাকিস, কোথা থেকে এসেছিস সেটা কেউ জানে না। সাতদিন আগে এক বস্তা হাতির কানের মতো বিরাট বাতাসা নিয়ে এসেছিলি। কে তোকে সেই বাতাসাগুলো দিয়েছিল হারামখোর? তো হুনর চোখ বন্ধ করে খানিকক্ষণ চিন্তা করার পর একটা ভয়ঙ্কর খবর শোনায়। সেটা শোনার পর শহরের সবাই পড়ি কী মরি করে ছুটেছিল তাদের বাড়ির দিকে।

    - কী খবর সেটা হারুন বুড়ো? সবাই হারুনকে ছেঁকে ধরে জিজ্ঞেস করল।

    হারুন ভীড়ের চাপে খাবি খেতে খেতে বলল - হুনরের মনে পড়েছিল যে বাতাসার থলেটা নাকি সে জঙ্গলের কোনো ঝাঁকাবুড়ির কাছে পায়। তার এটাও বিশ্বাস যে আমাদের কারো কোনো জিনিস চুরি যায়নি, চুরি গেছে প্রতিটি বাড়ি থেকে একটা ছোট ছেলে কি মেয়ে। সেই সব হারানো বাচ্চাদের নামও আর মনে পড়বে না কারো। কিন্তু খুঁজলে তাদের ফেলে যাওয়া ছোট ছোট জামাকাপড় এখনো কয়েকটা পাওয়া যেতে পারে। এই খবর শোনার পর সবাই তো আছাড় খেতে খেতে শহরের দিকে দৌড়োয়। বাড়িতে পৌঁছে জামাকাপড়ের পেঁটরাগুলো ঘাঁটতেই কোথাও একটা পুঁচকে ছেলের আচকান, কারো বাড়িতে একটা পাঁচ বছরের মেয়ের চপ্পল, এই সব বেরিয়ে পড়তে থাকে। অথচ সেই সব হারানো শিশুদের নাম, পরিচয়, মুখ, কিচ্ছু মনে পড়ছে না কারো। আমরা তখন বুঝতে পারি যে সবার পরিবার থেকে খুঁজে খুঁজে সবচেয়ে আদরের একটা বাচ্চাকে তুলে নিয়ে গেছে সেই বেরহম জঙ্গলের ঝাঁকাবুড়ি।

    - এ কী ভয়ঙ্কর আর বিদ্‌ঘুটে ব্যাপার হারুন বুড়ো! এই হুনর বলে ছেলেটা আর কিছু বলতে পারল না?

    - আর কী বলবে? সে নিজেই তো কোন রঈস বাড়ির লোপাট করা ছেলে। মা-বাপ আর তাকে নিজের বলে চিনতে পারে না। সেই জন্য আমরা কোনোদিন হুনরকে হাসতে দেখিনি। হুরী তলইয়ার কাছে ফিরে এসে আমরা তাকে দ্বিতীয়বার খুঁজে পেলাম না। টিলা আর জঙ্গল তন্ন তন্ন করে তলাশ করে কোনো বুড়ি-টুড়িকেও পাওয়া যায়নি। সেই থেকে মুখে হাসি নেই এমন কোনো ছেলে বা মেয়েকে কমবখ্‌ৎপু্রে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াতে দেখলে নানারকম লোভ দেখিয়ে শহরে রেখে নেওয়া হয়। কারণ আমাদের নিজেদেরই কারো হারানো ভাই কি বোন হতে পারে সেটা।

    কমবখ্‌ৎপু্রের সবাই যখন মন দিয়ে হারুন বুড়োর গল্প শুনছিল তখন জুম্মনের হাতদুটো আস্তে আস্তে আগের মতো রক্ত মাংসের হয়ে যায়। হুরীরা তাকে ঘাড়ে তুলে নিয়ে প্রথম থেকেই একটু একটু সরতে শুরু করেছিল। তারপর একসময় লা’য়ের নির্দেশ মতো পনেরোটা হুরী চোঁ চাঁ দৌড় লাগিয়েছে। জঙ্গল আর টিলার দিক থেকে একটা দমকা বাতাস এসে তাদের পাগুলো মাটি থেকে খানিকটা তুলে দিয়েছিল, ফলে শহরের কেউ কিছু বোঝার আগেই ষোলোজনের দলটা তাদের চোখের সামনে থেকে হাওয়া।


    *****


    সপ্‌নার বাবার নীল স্ট্যাণ্ডার্ড গাড়ি হু হু করে শিমলিপুরের ফার্স্ট মার্কেট পেরিয়ে ছুটে চলেছিল। এতক্ষণ আশা ছিল হয়তো সেটা আমাদের বাড়ির দিকে যাবে। সেই দুরাশার প্রদীপে পড়ে থাকা শেষ দু-ফোঁটা তেল এবার পুড়েছে। আমার বুক চিরে বেরোল একটা দীর্ঘশ্বাস। সপ্‌না বোধহয় ভাবল আমি হুনরের জন্য কাঁদছি। সে বলল – গল্পটা যা-তা দুঃখের হয়ে যাচ্ছে জয়। তুমি কি জানো আমাদের পাড়ায় সবসময় খোশমেজাজে থাকার একটা পলিসি আছে?

    বলা নেই কওয়া নেই তানিয়ার ছুঁচোলো নখওয়ালা আঙুল পম্পার কোলের উপর দিয়ে এসে আমার পাঁজরের হাড়গুলো হারমোনিয়ামের রীডের মতো বাজাতে লাগল। সাত সুরে ককিয়ে উঠেছি। তানিয়া বলল – লাগছে ওস্তাদজী? আমার বুকেও ব্যথা হয়। এটা একটা জেন্টল্‌ম্যানদের মতো কাজ হল? প্রতিটি বাড়ি থেকে একটা বাচ্চা ছেলে বা মেয়ে গুম করে দিয়েছ আর বাবা মা’রা নাম অবধি তাদের মনে করতে পারছে না? তাহলে সেই বাচ্চাগুলোর কী হবে?

    আমি বললাম – গল্পের মধ্যে শহর আছে। শহরভর্তি মানুষ আছে। তাদের একটা আনন্দ-বিষাদ মেশানো ইতিহাস থাকবে না? কিছু ভুলভ্রান্তি, পাপপুণ্য থাকতে পারে সেখানে। সে সব দিয়েই তো আমরা শহরটাকে চিনব।

    তানিয়া ছটফট করে উঠে বলল – এইরকম হার্টলেস ইতিহাসকে মারো গুলি। লাস্টে একটা মিল-টিল লাগাবে কিছু?

    অবাক হয়ে বললাম – এটা রোমান্সের গল্প নয় তানিয়া। ফিল্মের ম্যাগাজিনে যাচ্ছে না। কার সঙ্গে কার মিল দেব?

    - কেন? হুরীদের সঙ্গে তাদের বয়ফ্রেণ্ডদের।

    - ডোন্ট্‌ বী রিডিকুলাস তানিয়া! হুরীদের সে সব হয় না। তারা কুমারী থাকে।

    - আ-হা-হা-হা! অপূর্ব! নির্লজ্জের মতো সপাটে আমার মন্তব্যকে ভলি করে উড়িয়ে দিয়ে বলল তানিয়া। - ভার্জিন সব? কিঁউ? ভার্জিন কেন থাকতে যাবে তারা? তাদের কি ব্রেন নেই?

    তানিয়ার ছ্যাবলামো হঠাৎ আমার আর সহ্য হল না। গল্পের হুরীদের আমি খুব পছন্দ করি। এদের যদি পছন্দ না হয় তো গল্প শুনিয়ে কাজ কী? ঠাণ্ডা গলায় বললাম – তাদের ব্রেন আছে কি নেই সে সব ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে এই গল্পে একটা লাইনও থাকবে না। এই বলে মুণ্ডুটা জানালার দিকে ঘুরিয়ে দিলাম।

    কথাটা বলে ফেলার পর অবশ্য আপশোষ হতে থাকে। আমি সাধারণত হাসি-খুশী থাকি। তাও আমাকে চটে যেতে পম্পা মাঝে মাঝে দেখেছে। এই দুটো মেয়ে তো কখনো দেখেনি। রাগের মাথায় মুখ ঘুরিয়ে নেওয়ার পর এরা কী ভাবছে?

    তানিয়া আর সপ্‌না দুজনেই হঠাৎ ভীষণ কাঁচুমাচু হয়ে আমাকে সাধাসাধি শুরু করল। তানিয়া বলল – জয়, আমি তোমাকে রাগাতে চাইনি। একটু লেগ-পুল করছিলাম আর কি। প্লীজ তুমি চটে যেও না।

    সপ্‌না বলল – আমরা দুজনেই বেশি বাড়াবাড়ি করেছি। গল্পে একটু আধটু দুঃখ তো থাকতেই পারে। তুমি কাইণ্ডলি কিছু মাইণ্ড কোরো না।

    আমি তো নিজেই ক্ষমা চাইব ভাবছি। তাড়াতাড়ি মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম – আরে মাইণ্ড হী নহীঁ হ্যায় তো কেয়া মাইণ্ড করুঁ?

    সন্ধ্যে হয়নি, কিন্তু গাড়িটা যেখানে বাঘের ভয় সেদিকেই চলেছে। তানিয়ার অনুরোধে আমি আবার আমার ভার্জিন হুরীদের কাহিনীতে ফিরে গিয়েছিলাম, যাদের আমি নিজেই এতটা ভালো করে চিনতাম না যে তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলোতে নাক গলাবার অধিকার জন্মায়।




    *****

    কমবখ্‌ৎপু্রের কাণ্ডজ্ঞানহীন হুরী (আগের পর...)

    হুরীরা জুম্মনকে নিয়ে গিয়েছিল তাদের পুরোনো কেল্লার লুকোনো ঘরে। গুড় মেশানো গরম এক বাটি দুধ পিলিয়ে তার বুকের ধুকপুকানি একটু কমাবার পর হুরীরা বলল – থুক, হমারী জান, তুই একটা ঘি আর শক্করের লাড্ডুর মতো মিষ্টি। কিন্তু তোর খেলা এবার শেষ। এইভাবে হুরী সাজতে থাকলে তোকে আর বাঁচানো যাবে না।

    থুক তোতলাতে তোতলাতে বলল – মা-মা-মা-মা-মানে?

    - সবাই জানি তুই আসলে একটা ছেলে হয়েও ভীষণভাবে হুরী হতে চাস। বিশ্বাস কর তার জন্য আমরা একটুও অখুশী নই। হুরীর ঘানিতে পিষতে পিষতে তুই একদম একটা হুরী হয়ে যাচ্ছিলি। আমরা ভেবেছিলাম একদিন তোর সঙ্গে আমাদের যেটুকু তফাৎ আছে সেটুকুও থাকবে না। কিন্তু কিস্মতে যা নেই তা হওয়ার নয়। আজকে তোর কিছু হলে জানিস কীরকম দুঃখ পেতাম? জেনেশুনে এরকম বিপদের পথে আমরা তোকে কিছুতেই হাঁটতে দেব না।

    থুক মনমরা হয়ে বলল – আজকে যা হল তা আমার ভুলের জন্য। ওই দেয়ালের কাছে না গেলে এটা ঘটত না। তোমরা কেন ধরে নিচ্ছ যে আমি আবার এই একই ভুল করব?

    - কারণ হুনরের ছায়া শুধু ওই দেয়ালে নয়, সব জায়গায় যেতে পারে। এমনকি এই পুরোনো কেল্লার পাথরের পাঁচিলেও তাকে আমরা আগে দেখেছি। তোর উপর তার একটা আলাদা আকর্ষণ আছে। এবার সে তোকে একলা পাওয়ার চেষ্টা করবে। আমরা কেউ যখন কাছাকাছি নেই তখন ডাকবে। তেমন হলে কে তোকে বাঁচাবে বল?

    - আ-আমি তার ডাকে সাড়া দেব না।

    - এরকম ঘাঘরা পরে থাকলে তোর পক্ষে তা সম্ভব হবে না থুক। হয় এটা তোকে ছাড়তে হবে। নয় তোকে হুরীর ঘানিতে নেমে সাতদিন নিজেকে একনাগাড়ে পেষাতে হবে, যাতে তুই পুরোপুরি আমাদের মতো হয়ে যেতে পারিস। তাহলে কিন্তু তোকে আর কেউ ছেলে বলে মানবে না।

    - মানে আমি দিনের বেলাতেও ছেলে হতে পারব না?

    - না। তখন তুই একদম খাঁটি মেয়ে হয়ে যাবি। তোর দাড়ি-গোঁফও আর গজাবে না। সেটাই হতে চাস কিনা ভালো করে ভাব থুক। আসছে বুধবার আবার আমরা এখানে দেখা করব। সে ক’দিন বাড়ি ছেড়ে একা কোথাও যাস না।


    *****


    তার পরের চারটে দিন জুম্মন শহর আর টিলার দেয়ালগুলো ঘেঁষেই কাটাল। সে কী মরতে চাইছিল? হয়তো তাই। বা হয়তো সে দেখতে চাইছিল দিনের আলোয় হুনর নামের সেই ছোট ছেলেটার মুখ দেখা যায় কিনা। জুম্মনের বিশ্বাস ছিল তার মতো হুনরও একদিন দিনে আর রাতে দুটো আলাদা জগতে বাস করত। শেষ পর্যন্ত হুনরকে কে দেয়ালে জ্যান্ত পুঁতে দেয় এই খবরটা না পাওয়া পর্যন্ত জুম্মন এই দেয়ালগুলোর মায়া কাটাতে পারছিল না।

    হুনরকে কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও খুঁজে পায়নি জুম্মন। বুধবার রাতে সে যখন হুরীদের আস্তানায় গিয়ে হাজির হয় তখন নীল ঘাঘরাটা তার পরনে ছিল না। সারাদিন যা পরে থাকে সেই সাদা চুড়িদার পাজামা পরে এসেছিল জুম্মন। হুরীদের লুকোনো ঘরটায় ঢুকে সে দেখে লাঃ থেকে থৈ পর্যন্ত সকলে সেখানে আগেই পৌঁছে গিয়ে তাকিয়ায় আধশোয়া হয়ে রূপোর গড়গড়া থেকে ইত্র মেশানো তাম্বাকু খাচ্ছে।

    জুম্মনকে দেখে সবাই বলল – আয়, থুক, তাম্বাকু খা।

    জুম্মন তাদের পায়ের কাছে ভাঁজ করা নীল ঘাঘরা রেখে বলল – আমার নাম জুম্মন। এখন থেকে পারলে তাই বলেই ডেকো।

    হুরীরা ব্যস্ত হয়ে উঠে বসে বলল – তুই কী ঠিক করলি জুম্মন?

    জুম্মন ঘাড় হেঁট করে জানাল – আমি জুম্মনই থেকে যাব। তাই এই ঘাঘরাটা ফেরত দিয়ে যাচ্ছি। তোমাদের কথা একদম ঠিক, এটা পরলে আমার বিপদ।

    হুরীরা একজন অন্যজনের দিকে বড়ো বড়ো চোখ মেলে তাকিয়ে নিয়ে বলল – সে তো বেশ কথা। খুব ভালো করে ভেবে নিয়েছিস তো? আর আমাদের সঙ্গে দেখা হবে না তাহলে।

    জুম্মন অবাক হয়ে বলল – ও কথা বলছ কেন? আমি এখানে মাঝে মাঝে যদি আসি তোমাদের কোনো অসুবিধে আছে? আমি তো শুধু খেতে আসি না। কাজও করে দিই কত। আমার গাধাটাও তোমাদের জন্য কত খেটেছে।

    হুরীরা আবার একজন অন্যজনের দিকে তাকিয়ে নিয়ে গলা টলা খাঁকরে বলল – আসলে কী জানিস জুম্মন? ঠিক হয়েছে যে আমরা শহর ছেড়ে দেব।

    শুনে জুম্মনের মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল। সে ভাবল তারই কোনো গাফিলতির জন্য হুরীরা দেশান্তর হচ্ছে। হতাশার একটা দীর্ঘশ্বাস সংবরণ করে সে বলল – কেন তোমরা চলে যাচ্ছ? আমি কী কোনো দোষ করেছি? তাছাড়া এই হুরীর তালাব আর ঘানি ছেড়ে তোমরা যাবেই বা কেন? এটা তো তোমাদেরই জায়গা।

    তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে জুম্মনের মাথায় হাত-টাত বুলিয়ে হুরীরা বলল – তালাব থাকবে এখানে। এই ঘরটাও থাকবে তোর জন্য জুম্মন। কিন্তু হুরীর ঘানিটা আমাদের সঙ্গে যাবে। তার জন্য একটা গাড়িও এনেছি আমরা। এখন রুস্তমকে চাই, সে আমাদের গাড়িটা যদি টেনে দেয় তাহলে কাল ভোর ভোরই বেরিয়ে পড়ি।

    জুম্মনের মাথা এবার বন বন করে ঘুরছিল এই খবর শুনে। সে ভেবেছিল যতদিন না তার নেশা কাটছে আর ইয়া ইয়া দাড়ি গোঁফ গজাচ্ছে, মাঝে মাঝে এসে হুরীর ঘানিতে অন্তত নিজেকে একটু পিষে নিতে পারবে। হুরীদের সঙ্গে ঘানিও যদি চলে যায় তাহলে এই উজড়ে যাওয়া নিরানন্দ শহরে সে কী নিয়ে বাঁচবে?

    - কালই চলে যাবে? বিড় বিড় করে শুধোলো সে।

    জুম্মনের প্রশ্ন শুনে হুরীদের সবার চোখ ছল ছল করে উঠেছে। তারা আসলে এই টিলা আর দেয়ালের দেশ ছেড়ে পালাতে চাইছিল, যেখানে অসঙ্খ্য আদ্যিকালের হুরীরা বন্দি হয়ে থাকে। সেই গুজরে যাওয়া হুরীরা না পারে দেয়ালের বাইরে আসতে আর না পারে মরতে। লাঃ-লীঃ-লৈ-লুকরা সেই ভয়ঙ্কর পরিণতি এড়াতে চেয়েছিল। তারা ঠিক করেছিল সাধারণ মেয়েদের মতো বিকেলের আলোয় গড়গড়া টানতে টানতে একদিন তারা মরবে।

    তখন শৈ উঠে এসে জুম্মনের একটা হাত ধরে বলল – থুক্‌কন, তোকে আমি আমার সবচেয়ে ভালো পোষাকটা দিচ্ছি। এটা পরে তুই আজ রাতে যতক্ষণ পারিস হুরীর ঘানিতে নিজেকে পিষে নে। কাল সকালে আর আমাদের দেখতে পাবি না। কিন্তু যাওয়ার আগে আমরা শহরের সবাইকে একটা ভালো কিছু দিয়ে যাব।


    তারপর আর কী? কিছুক্ষণ বাদে জুম্মনকে নিয়ে পনেরোটা দারুণ দারুণ জামা পরা মেয়ে হুরীর তালাবে গিয়ে হাজির হয়।

    জুম্মনের পরনে তখন সোনার সুতো দিয়ে তৈরী শাহজাদীদের মতো ঘাঘরা আর চোলী, নবাবের বিটিয়া বলে যা শৈ’য়ের কাছে ছিল।


    *****


    পম্পার একটা হাত কুটকুট করে আমার প্যান্টের পকেটের কাছে চিমটি কাটছে। টেলিগ্রাফ করে আমাকে কী বলতে চাইছে এই মাসুম মুহ্‌তরমা? সে কী চাইছে জুম্মন হুরীর তালাবে নেমে আগাগোড়া একটা মেয়ে হয়েই বেরোক? না কি উল্টোটা? পম্পার যে নীল স্কার্ট আমার আলমারির তাকে লুকোনো আছে তার উল্লেখ করার সময় সে মাঝে মাঝে বলে ‘আমাদের স্কার্ট’ - যেন আমরা স্কার্ট-ব্লাউজ ভাগাভাগি করে নেওয়া দুই পিঠোপিঠি বোন। জুম্মনের মধ্যে পম্পা আমাকে কল্পনা করছে না তো? সেটা কি আমার পক্ষে ভালো?

    তানিয়া উসখুস করে উঠে বলল – আমি ধরে ফেলেছি এবার কী হবে।

    - কী হবে তানিয়া?

    - তা বলব না। কিন্তু আমি বুঝে গেছি।

    - উফ্‌ তানিয়া, তুমি আবার শুরু করেছ। এই গল্পটাও তোমার স্বপ্নে দেখা নাকি?

    তানিয়া চোখ গোল গোল করে বলল - বিশ্বাস করবে? আমায় তো স্বপ্নে একটা চাঁদ প্রায়ই এসে ডাকে।

    বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তানিয়াকে আশ্বস্ত করে বললাম - কেন ডাকে জানো? রিজের মধ্যে যে খুনী তালাব বলে কালো রঙের ছায়াঘেরা পুকুর আছে তার কাছে যেতে বলে। কোনোদিন রাত্রিবেলা সেখানে গিয়েছ তানিয়া?

    - জয় আমাকে ভয় পাওয়াবার চেষ্টা কোরো না। আমি দুঃস্বপ্ন দেখে দেখে পাগল হয়ে যেতে পারি।

    - ভয় দেখাচ্ছি না। সেই পুকুরটা নিয়ে দিল্লীর পুরোনো লোকদের কাছে এই ধরণের গল্প শোনা যায়। ওটাকে সন্ধ্যেবেলা দেখলে বুঝতে। আমার গল্পে হুরী তলইয়ার ব্যাপারটা আমি সেই খুনী তালাবের কথা ভেবে এনেছিলাম।

    - গল্পের তালাবের মধ্যে তুমি কাউকে খুন করাবে নাকি?

    - নো তানিয়া। আমি তোমাদের গল্পের কুয়াশার মধ্যে দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়ার সময় খুন-খারাবা নয়, একটা অন্য জিনিস খুঁজি। বলতে পারো একটা শব্দ।

    - শব্দ? অ্যাঁ! সেটা আবার কী? সপ্‌না আর তানিয়া প্রায় একসঙ্গে জিজ্ঞেস করল।

    - এই যে আমরা একসঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছি, এক শহরে বেঁচে আছি – আমাদের এই দিনগুলোর কী কোনো মানে আছে? এগুলো তো একদিন নিশ্চয়ই ফুরিয়ে যাবে। তখন কী পড়ে থাকবে আমার কাছে? শুধু একটা ট্রেন চলে যাওয়ার আওয়াজ নয়? যেমন আনন্দ্‌ বক্সী নামের এক সুফীর গানে আছে –


    টেসন সে গাড়ি যব ছুট যাতী হ্যায় তো
    এক দো তিন হো যাতী হ্যায় --


    এরা তিনজনেই কলেজের নামে তিনদিকে ছিটকে যাবে। টেসনে পড়ে থাকবে শিমলিপুর। আর তার ভিতরে আমি।

    সপ্‌না ঠোঁট উলটে একটা ফোঁস আওয়াজ করে বলল – জয়, আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি আমাদের এই দিন কখনো ফুরিয়ে যাবে না। নাও, বাজে কথা ছেড়ে বাকিটা বলো। তারপর কী হল?




    *****

    কমবখ্‌ৎপু্রের কাণ্ডজ্ঞানহীন হুরী (তারপর কী হল...)

    তারপর? তারপর পনেরোজন হুরী জুম্মনকে নিয়ে নেমেছিল তালাবের জলে। নিচের মাটি ভেদ করে উঠে এসেছিল পুকুরের চাঁদ। সেই চাঁদকে দেখে আকাশে উঠেছিল একটা পুরোনো জামা কাপড়ের ঝড়। আর সেই ঝড়ের একটা ঘূর্ণির মতো মুখ পাক দিতে দিতে এসে ঢুকেছিল তালাবের ভিতর।

    পনেরোজন হুরী আর জুম্মন যখন হুরীর ঘানিতে পিষতে শুরু করল তখন তারা কী জাদু করেছিল বোঝেনি জুম্মন, কিন্তু ঘানিটা আগের চেয়ে দ্বিগুণ বা চতুর্গুণ জোরে ঘুরতে শুরু করে। পিষতে পিষতে দম বন্ধ হয়ে আসছিল জুম্মনের। লাঃ-লীঃ-লৈ-লুক, শাঃ-শীঃ-শৈ-শুক, হাঃ-হীঃ-হৈ-হুক, আর থাঃ-থীঃ-থৈ আস্তে আস্তে জুম্মনকে ঠেলে ঘানির একেবারে ভিতর দিকে পাঠিয়েছিল, যেখানে সেই ঘূর্ণির কেন্দ্রে একটা নিথর কালো চোখ তাদের দিকে নিষ্পলকভাবে চেয়ে থাকত। জুম্মন কিছু বোঝার আগেই দুরন্ত হাওয়ার চাপ তাকে সেই কেন্দ্রের ভিতর ঢুকিয়ে দেয়।

    অন্ধকার সেই আবর্তের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর জুম্মন অনুভব করে আর কোনো ময়লা কাপড় তাকে ধোলাই দেওয়ার চেষ্টা করছে না। এবার তার নিজেরই শরীর তাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চাইছিল। সেই অমানুষিক পেষণের মধ্যে শাহজাদীদের জন্য বানানো একটা সোনার সুতো দিয়ে তৈরী ঘাঘরা আর চোলি তার চামড়া ভেদ করে দেহের ভিতর প্রবেশ করতে শুরু করে। জুম্মন ভেবেছিল এবার সমস্ত রক্ত বেরিয়ে গিয়ে সে অক্কা পাবে, এবং একদিক থেকে সেটা ভালোই হবে। কিন্তু ঘানির প্রচণ্ড চাপে তার শরীর থেকে এক বিন্দু জল বা রক্ত বেরোতে পারেনি।

    তারও পর? বহু রাত পর্যন্ত জুম্মনের শরীর নিয়ে খেলা করার পর ঝড়টা আবার উঠে গিয়েছিল আকাশে। হুরীরা চাঁদটাকে মাটির ভিতর গোর না দিয়ে এবার টেনে তোলে ডাঙায়। তারপর সেটাকে শুকনো চাদরে ভালো করে মুড়ে একটা চার চাকার গাড়িতে তোলা হয়। জুম্মনকে হুরীরা অচেতন অবস্থায় তুলে এনে ফেলেছিল পুকুরের ধারে। জুম্মনের গায়ে তখন একটা সুতোও ছিল না। তাকে আবার তার কুর্তা আর চুড়িদার পরিয়ে দেওয়ার পর হুরীরা একটা শিস দিয়ে ডেকে নিয়েছিল গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা রুস্তমকে।

    ভোর রাতে রুস্তম একটা বড়ো সড়ো গাড়ি একাই টানতে টানতে জুম্মনদের বাড়ির পিছনে গিয়ে হাজির। সেখানে পনেরোজোড়া চুড়ি পরা হাত জুম্মনের ঘুমন্ত দেহটাকে উঠোনের জমিতে নামিয়ে দিয়ে আবার সেই গাড়ির ভিতর গায়েব হয়ে যায়। রুস্তমও শেষবার জুম্মনকে দেখে নিয়ে গাড়িটা টানতে শুরু করেছিল শহরের বাইরে যাওয়ার রাস্তায়।


    *****


    ব্যস্‌, আর কিছু নেই। তার পর থেকে গোটা পৃথিবীটা দরজা জানালা বন্ধ করে চুপ।

    আর      কিচ্ছু       কোনোদিন      ঘটেনি      কোথাও।


    *****


    আমীর খুসরোর নির্দেশ হুবহু পালন করে আমি গল্পে ইতি করে দিয়েছি। খুসরোর জাদু কাজ করে না এরকম কোনো প্রাণী দিল্লীতে আজও পা রাখেনি ভাবতাম, কিন্তু হায়! সপ্‌না বাঁই করে ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল - কিচ্ছু ঘটেনি মানে? আর কিছু নেই?

    - ওয়েল, সরি টু ইনফর্ম ইউ, বাট দ্য টেল ইস ওভার। ষোলোজন হুরীর হুকুমৎ খতম, আর দ্য হুরীডম অব কম্বখ্‌ৎপুরের গল্পের দি এণ্ড। পম্পা, সপ্‌না, আর তানিয়াকে জানালাম আমি।

    - আর কিচ্ছু কোনোদিন ঘটেনি কোথাও? এমন হতে পারে নাকি? তাহলে আমরা এলাম কোত্থেকে? রব্বিশ! হৈ হৈ করে উঠে বলল সবাই। - হুরীরা কোথায় গেল? জুম্মনের কী হল? একটা উপসংহার তো থাকবে?

    - হুম্‌ম্‌। উপসংহার ছিল একটা। কিন্তু তার কোনো অর্থ হয় কিনা এ নিয়ে আমার ঘোর সন্দেহ আছে। তোমাদের ভালো লাগত না। তাই আমীর খুস্‌রোর নির্দেশমতো গল্পটা অন্যরকমভাবে শেষ করেছি।

    - আঃ, নখ্‌রা কোরো না জয়। আমাদের কেমন লাগবে তা তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি উপসংহারটা বলো।

    গাড়ি যমুনার দিকে চলেছে হু হু করে। আমার মন বলছিল পুলের ঠিক আগে বালির উপর থামব আমরা। তারপর আমাকে অনুরোধ করা হবে বাজাজের চরের পথ দেখাতে। তার মানে কি এতক্ষণ ধরে সপ্‌না শিমলিপুরের উপদ্রবের মধ্যে নিজের নাক গলাবার ফন্দি আঁটছিল? গল্প শোনার এমন আগ্রহের একটা কারণ তাহলে বেরিয়ে আসে। যাতে আমি গাড়ি থেকে নেমে না যেতে পারি। যে পার্কটাউনের মেয়েদের মধ্যে গিয়ে আমি এক বেলার শান্তি আর নিরাপত্তা চেয়েছিলাম, তারাই আমাকে আবার টেনে এনেছে এই ধুর্‌রা কলোনীর ঝুঁকিসঙ্কুল বালুচরে।

    পম্পার শরীরে আকর্ষণীয় সব কিছুই আছে, শুধু বিপদ-আপদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় হিসেবে ব্যবহার করা যায় এরকম কোনো দেহকোষ নেই। কোথায় যাচ্ছি বুঝতে পেরেছে বলে মনে হল না। আমার দিকে তার হরিণ-অক্ষির ঢেউ খেলানো ঝাঊয়ের পাতা তাক করে সে খোশমেজাজে বলল – কী হল? বল!

    যা ভাগ্যে আছে তা হবেই। মাথাটা ঝাঁকিয়ে নিয়ে বললাম – আচ্ছা, শোনো তাহলে। কিন্তু মানে হয় না বলে পরে দুষো না আমায়।




    *****

    উপসংহার

    হুরীদের আর পাওয়া গেল না সেই শহরে, যেখানে তামাম হালফিলের খবর রাখা বুজুর্গরা হারুন বুড়োর কাছে তাদের শহরের ইতিহাস জানার পর সূর্যাস্তের টিলায় ফুটে ওঠা ছায়ার খেলার মধ্যে নিজের পূর্বপুরুষ আর পূর্বমহিলাদের মুখের আদল সন্ধান করত। এছাড়া সারাদিন ধরে গোপনে তারা পরস্পরের ছেলেমেয়েদের গুনত, পাছে গুনতিতে কেউ কম পড়ে যায়।

    রুস্তমের আর খবর মেলেনি। যদিও জুম্মন তার অপেক্ষায় কোনো কোনো বুধবার জঙ্গলের পুরোনো কেল্লার ভিতর একলা বসে হুক্কা খেত। হুরীরা অবশ্য যা নিয়েছিল তার চেয়ে বেশি দিয়ে যায়। কমবখ্‌ৎপু্রের প্রতিটি বাড়ির উঠোনে একটা করে ঠিক রুস্তমের মতো গাধা এসে পড়েছিল আকাশ থেকে। জুম্মনদের উঠোনেও এসে পড়ে একজন। জুম্মন তার নাম দিয়েছিল ... কী আর দেবে? সে তার নাম দিয়েছিল – মিঞা থুক্‌কন।

    আর জুম্মন নিজে? কী উঠেছিল তার ভাগ্যের তাসে? সে কি তার আগের স্বাভাবিক জীবন ফেরত পেয়েছিল?

    এই প্রশ্নের উত্তর – হ্যাঁ আর না। কারণ হুরীরা তাকে ছেড়ে যাওয়ার পর জুম্মন কোনোদিন ঘাঘরা পরেনি। কিন্তু সন্ধ্যের পরে আকাশে যখন একটা একটা করে তারা ফুটত আর নক্ষত্রের গালিচায় উমরাও জান শুরু করত আকাশগঙ্গার মুজরা, তখন জুম্মনের চামড়ার ভিতর থেকে একটা সোনার মতো আভা ফুটে বেরোতে চাইত।

    জুম্মন সেই নক্ষত্রভরা কালো আকাশের নিচে হাঁটতে হাঁটতে টের পেত যে কারো সোনার সুতোয় বোনা পোষাক তার চামড়া ভেদ করে ফেলার পর আস্তে আস্তে আরো ভিতরে ঢুকছে। জুম্মন বুঝেছিল, হুরীদের রেখে যাওয়া একটা সোনালী ঘাঘরা এইভাবে চিরকাল তার শরীরের গভীরতর কোথাও হারিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজতেই থাকবে।


    *****


    - দি ফাইনাল এণ্ড। দেড়-আনা দন্ত-বিকশিত করে নিবেদন করলাম আমি।

    গল্প সত্যি ফিনিশ করে দিয়েছি বুঝতে পেরে তিনটে মেয়ে আমার ফুটপাথ-ছাপ ক্যাবলা হাসির দিকে অপার বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল। যা ভয় করেছিলাম। গল্প বানাবার সময় আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না তা অন্যরা কীভাবে নেবে। ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে এর হাজারটা মানে থাকলেও আমার শ্রোতাদের কাছে কোনো মানে হয়নি, কারণ পম্পা সকলের হয়ে জিজ্ঞেস করল - ঘাঘরাটা তার শরীরে ঢুকে চলতেই থাকবে? কিন্তু কেন?

    একটু চিন্তা করে বুঝলাম অন্তত এর উত্তর আমার জানা। বললাম - কেননা যতদিন না সেটা জুম্মনের বুকের স্পন্দনের উৎসে পৌঁছে তাকে মুঠোয় ভরে নিয়ে স্তব্ধ করে দিচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত একটা হুরী হতে চাওয়া ছেলের ভিতরে আসলে কী আছে তার খোঁজ শেষ হয় না।


    (শেষ)


    [ অপ্রকাশিত উপন্যাস থেকে গৃহীত গল্প ]


    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments