খেতে খেতে দরজায় ঠক ঠক শব্দ হ'ল। সিধু গলা তুলে বলল, "কে?"
উত্তর নেই। একটু পরে আবার ঠক ঠক। সিধু বিরক্ত হয়ে গজগজ করতে করতে এঁটো হাতেই উঠে গিয়ে দরজা খুলল।
কেউ নেই। আজ জ্যোৎস্নার রাত, অনেক দূর অবধি দুদিকে দেখা যাচ্ছে। ত্রিসীমানায় কেউ নেই।
সিধু বিস্মিত হয়ে একবার বাড়ির চারিদিকে ঘুরে এল। কাউকে দেখা গেল না৷ নিশ্চয়ই গাঁয়ের কোন ছেলে বদমায়েসি করে দৌড়ে পালিয়েছে। সিধু দরজা দিয়ে আবার খেতে বসল। আর বসতে না বসতেই আবার ঠক ঠক। এবার আরও জোরে। সিধু মাথা ঠান্ডা রেখে উঠে আগে হাত ধুয়ে নিল। বাড়ির পিছনে একটা খিড়কি দরজা আছে। সিধু সন্তর্পণে সেটা খুলে বেরল। হাতে একটা ছোট বাঁশ।
বাড়ি ঘুরে সে সামনের দিকে গেল। দরজায় কেউ নেই। সে কী করবে ভাবছে ঠিক তখনই তাকে স্তম্ভিত করে দিয়ে দরজায় আবার শব্দ হল... ঠক ঠক।
দরজায় কেউ আছে, কিন্তু তাকে দেখা যাচ্ছে না। সিধুর বুক কেঁপে উঠল। কিন্তু সে রাতবিরেতে ঘুরে বেড়ায়, এত সহজে ভয় পেলে তার চলে না। সে একটু এগিয়ে গিয়ে গলায় জোর এনে বলল, "কে ওখানে?"
তার মনে হল কেউ যেন দরজা ছেড়ে ঘুরে দাঁড়াল। তার পর সে শুনল কেউ নরম গলায় বলছে, আমি নিধিরাম গো, জমিদারবাড়িতে থাকি।
জমিদারবাড়ি পোড়োবাড়ি, সেখানে কারও থাকার কথা নয় । কিন্তু সিধুর এখন মাথা কাজ করছে না। সে কাঁপা গলায় বলল, তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?
এবারে একটা হাসির শব্দ এল। তারপর লোকটা বলল, আমাকে দেখলে তুমি ভয় পাবে গো সিধুভাই।
কথাটার একটাই মানে হয়। সিধুর গলা শুকিয়ে এসেছে, বুকের মধ্যে ধকধক শব্দ হচ্ছে, তবু সে সাহসে ভর করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, না দেখলে কথা বলি কী করে?
এবার মনে হল কেউ এগিয়ে আসছে। তারপর তার থেকে দুহাত দূরে একটি শরীর ধীরে ধীরে ভেসে উঠল। সিধু নিজের অজান্তেই দু পা পিছিয়ে এল।
চেহারাটি গাঁ-গঞ্জের সাধারণ মানুষের মতনই। ময়লা রঙ, ছোটখাট চেহারা। একটা ময়লা ধুতি হাঁটুর উপর তোলা। ভয় পাওয়ার মত কিছু নয়। তবে চোখদুটি একটু গোল ও বড়, যেন কোটর থেকে ঠেলে বেরতে চাইছে।
এই তাহলে ভূত। সিধু রাতবিরেতে ঘোরার সময় অদ্ভূতুড়ে কাণ্ড কিছু কিছু দেখে থাকলেও মুখোমুখি কোন ভূতের সঙ্গে দেখা তার এই প্রথম। ভয়ের মধ্যেও কী ভেবে তার হঠাৎ হাসি পেয়ে গেল, সে ফিক করে হেসে দিল। তাকে হাসতে দেখে ভূতটি থুড়ি নিধিরামও যেন আশ্বস্ত হল। বলল, "তোমার সঙ্গে কথা ছিল গো, সিধুভাই।“
সিধু কিছুটা সামলে নিয়েছে। গম্ভীর গলায় বলল, “কী কথা?”
নিধিরাম বলল, “বিষ্টুবাবুর বাড়িতে যাচ্ছিলে তো? কিন্তু ওখানে পরেশ দারোগা আজ পাহারা রেখেছে। গেলে ধরা পড়ে যাবে।”
সিধু চুপ করে শুনছিল। নিধিরাম আবার বলল, “তাই এলাম। তুমি আমার সঙ্গে চলো। পুলিশটাকে আমি সরিয়ে দেব। তারপর তুমি তোমার কাজ করে নিও।”
সিধু সন্দেহের সুরে বলল, “তুমি আমাকে সাহায্য করবে কেন? কী মতলব?”
নিধিরাম হেসে বলল, “তা মতলব কিছু তো আছেই। তবে তেমন কিছু নয়। ধীরে সুস্থে শুনো। এখন চলো আমার সঙ্গে।”
সিধু একটুক্ষণ ভেবে নিল। তার লোকসান কিছু নেই। তেমন হলে বিষ্টুবাবুর বাড়ি দূর থেকে দেখে চলে আসবে।
সে ঘরে ঢুকে সিঁদকাটি আর ঝোলা হাতে নিয়ে দরজা বন্ধ করল। নিধিরাম ‘এসো’ বলে হাওয়া হয়ে গেল। সিধু ‘দুর্গা দুর্গা’ বলে হাঁটা লাগাল। বিষ্টুবাবুর বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে দূর থেকে সন্তর্পণে দেখল থানার কনস্টেবল মানিক হাজরা লাঠি হাতে পায়চারি করছে। নিধিরামের খবর তা হলে ভুল নয়। সে পিছিয়ে এল। তখনই তার কানের কাছে ফিসফিস করে নিধিরাম বল'ল, “তৈরি থাকো, মানিক সরে গেলেই ঢুকবে।”
একটু পরে মানিকের গলায় আর্তনাদ শোনা গেল। সিধু উঁকি মেরে দেখল, মানিক লাঠি ফেলে চিৎকার করতে করতে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাচ্ছে। একটু পরে নিধিরাম এসে বলল, “বিষ্টুবাবুর ঘরেও নিদালি মন্ত্র পড়ে দিয়ে এসেছি, এখন মড়ার মত ঘুমোবে। তুমি চটপট কাজ শুরু করো।”
সিঁদ কেটে ঘরে ঢুকে সিন্দুক খুলে কাজ সারতে সিধুর ঘন্টাখানেক লাগল। গয়নাগাঁটি সবই গরিব মানুষদের বন্ধকী জিনিষ, চড়া সুদে ধার নিয়ে পরে আর শোধ করতে পারেনি।
এবার চোরাই মাল গাঁ থেকে প্রায় দুই ক্রোশ দূরে বৈকুন্ঠপুরে তার সাঙ্গাৎ মোহন স্যাকরার বাড়িতে দিয়ে আসতে হবে। নিজের বাড়িতে রাখলে কাল সকালেই পরেশ দারোগা এসে টেনে বার করবে।
নিধিরাম বাইরেই ছিল। সব শুনে বলল, “তুমি বাড়ি গিয়ে ঘুমোও, মাল আমি পৌঁছে দিচ্ছি।”
সিধুর হাত থেকে থলেটা নিয়ে নিধিরাম উধাও হয়ে গেল।
পরের দিন সকালে দরজায় প্রবল ধাক্কা ও সেই সঙ্গে পরেশ দারোগার তর্জন-গর্জনে তার ঘুম ভাঙল। সে দরজা খুলতেই পরেশ দারোগা তার গলায় লাঠির ডগা ঠেকিয়ে বললেন, “হারামজাদা, বিষ্টুবাবুর মাল কোথায় রেখেছিস বার কর।”
সে খুবই অবাক হবার ভান করে বলল, “আপনি কোন মালের কথা কন? আমি তো কাল সারারাত বাড়িতেই ছিলাম।”
পরেশ দারোগা লাঠি দিয়ে তার পাঁজরে এক ঘা দিলেন। সে ককিয়ে উঠল। মানিক সঙ্গেই ছিল, পরেশ দারোগা তাকে বললেন, “এটাকে গাড়িতে তোল। থানায় নিয়ে গিয়ে কচুয়া ধোলাই দিতে হবে।”
থানায় নিয়ে মানিক তাকে লকআপে ঢোকাল। একটু পরে পরেশ দারোগা লাঠি হাতে এসে বললেন, “শোন সিধু, এ অনেক টাকার মামলা। উপর অবধি যাবে। তাই বলছি ভালয় ভালয় বলে দে, তোর মেয়াদ কম করে দেব।”
সিধু দুই হাত জড়ো করে, কাতর কন্ঠে বলল, “আমি কিছু জানি না কর্তা।”
পরেশ দারোগা লাঠি তুললেন। কিন্তু সিধুর পিঠ অবধি পৌঁছানর আগে লাঠিটা মাঝপথে যেন আটকে গেল। পরেশের মনে হল লাঠিটা কেউ চেপে ধরেছে। তিনি প্রাণপণে টানাটানি করেও লাঠিটা ছাড়াতে পারলেন না। তারপর কে যেন এক ঝটকায় লাঠিটা তার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে লকআপের খোলা দরজা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলল।
পরেশ দারোগা স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। মানিক অত বোঝেনি, হাত থেকে ছিটকে পড়েছে ভেবে লাঠিটা কুড়িয়ে এনে আবার তাঁর হাতেই দিল। তিনি অনেকক্ষণ লাঠিটার দিকেই তাকিয়ে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে কম্পিত হাতে আবার লাঠি উপরে তুললেন। কিন্তু ফল সেই একই। আবার কে যেন লাঠি চেপে ধরে বাইরে ফেলে দিল। পরেশ দারোগার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল, তিনি লক আপের মেঝেতেই বসে পড়লেন। মানিক অবাক হয়ে আবার লাঠিটা কুড়িয়ে আনল, এনে এবারে নিজেই চালাল কিন্তু লাঠি আবার বাইরে ছিটকে পড়ল। সিধুর গায়ে আজ যেন কোন মারই পড়বে না। মানিকের মুখও দেখতে দেখতে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
পরেশ দারোগা এবার মেঝে থেকে উঠে লকআপ থেকে বেরিয়ে নিজের চেয়ারে এসে বসলেন। ভয়ে ও বিস্ময়ে তাঁর মাথা কাজ করছিল না। মানিক ভীত মুখে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে। তার মনে পড়ছিল কাল রাতে মহাজনের বাড়ির সামনে দেখা মড়ার খুলির নৃত্য। সে গলা নামিয়ে বলল, “ভূতুড়ে কাণ্ড। ওকে ছেড়ে দিন স্যার।”
পরেশ কিছুই বললেন না। সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে মানিক লকআপের দরজা খুলে বেশ খাতির করে সিধুকে বার করে আনল। এমনকি তাকে বাড়িতে ছেড়ে দেবে বলে জিপেও তুলে নিল। পরেশ দারোগা মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলেন।
এই ঘটনার পরে দু দিন কেটে গেছে। সিধু বাড়িতেই খেয়ে বসে দিন কাটাচ্ছে৷ পুলিশ নজর রাখতে পারে বলে সে বৈকুন্ঠপুরেও যায়নি। অবশ্য ও নিয়ে তার চিন্তা নেই। মোহন স্যাকরা তাকে ঠকাবে না। দরকার পড়লে নিজেই তার বাড়িতে টাকা দিয়ে যাবে।
তিন দিনের মাথায় নিধিরাম এল। আবার রাতের বেলা দরজায় ঠক ঠক। আজ আর হাওয়া নয়, মনুষ্যরূপ ধারণ করেই এসেছে। সিধু দরজা খুলে তাকে ভিতরে নিয়ে এল।
নিধিরাম আমতা আমতা করে বলল, এবার তোমাকে বলি আমাদের দরকারের কথাটা।
সিধু হেসে বলল, "শোনবার জন্যই ত বসে আছি।”
নিধিরাম যা বলল তার সারমর্ম হল এই। অনেক বছর আগে এ গাঁয়ের জমিদার ছিলেন অঘোরনাথ চৌধুরী। তিনি মারা যাবার পর চৌধুরীরা এক এক করে কলকাতায় চলে যায়। বিশাল জমিদারবাড়ি পড়ে থাকতে থাকতে ধীরে ধীরে ভূতেদের দখলে চলে যায়। তা ভূতেরা তিনপুরুষ ধরে নিশ্চিন্তেই ছিল কিন্তু এখন বিপদ আসছে। তারা খবর পেয়েছে জমিদারবাবুর নাতির ছেলে সৌমেন্দ্রবাবু, যিনি কিনা বিষয়সম্পত্তির একমাত্র ওয়ারিশ বাড়িটা বিক্রী করে দিতে চলেছেন। যে কিনবে সে বাড়িটা ভেঙ্গে বিশাল কোল্ড স্টোরেজ বানাবে। তবে এখনও নাকি পাকা কথা কিছু হয়নি।
সিধু বলল, “তো আমাকে কী করতে হবে?”
নিধিরাম কাঁদো-কাঁদো মুখে বলল, “তুমিই বাঁচাতে পারো। তবে কিনা, সৌমেন্দ্রবাবু কলকাতায় ভাল চাকরি করেন, টাকার লোভ নেই। তুমি গিয়ে দেখা করে বলো, তুমি কিনে এখানে গাঁয়ের ছেলেমেয়েদের জন্য জমিদারবাবুর নামে স্কুল বানাবে। উনি রাজি হয়ে যাবেন। দুখানা ঘর আমরাও ছেড়ে দেব।”
নিধিরামের কথা অনুযায়ীই কাজ হল। সিধুর আর কয়েক দিন লাগল মোহন স্যাকরার সঙ্গে হিসাব-নিকাশ মেটাতে। তারপরই সে কলকাতায় দৌড়ল। দাদুর বাবার নামে স্কুল হবে শুনে সৌমেন্দ্রবাবু রাজিও হয়ে গেলেন। কয়েকদিন পরে জেলা সদরে সিধুর নামে দলিল রেজিস্ট্রিও হয়ে গেল।
কিছুদিন পরের কথা। স্কুলবাড়ির কাজ শুরু হয়ে গেছে। নিধিরামরা দুটো বড় ঘর ছেড়ে দিয়েছে। সামনে বোর্ড লাগান হয়েছে--অঘোরনাথ স্মৃতি প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র-- গ্রামের লোক এসে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। সিধু এখন গ্রামের একজন গণ্যমান্য লোক। স্কুল ছাড়াও সে নিজের মায়ের নামে গ্রামে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় খুলে দিয়েছে; সেখানে সপ্তাহে দুদিন করে শহর থেকে ডাক্তারবাবু আসেন। সে সবাইকে বলেছে তার এক দূরসম্পর্কের কাকা তাকে বিষয়সম্পত্তি দিয়ে গেছেন। পরেশ দারোগা দুয়ে আর দুয়ে চার করতে পারলেও ভয়ে চুপ করে আছেন।
দরজায় ঠক ঠক। সিধু উঠে দরজা খুলে নিধিরামকে ভিতরে নিয়ে এল। নিধি এখন তার বন্ধুর মত হয়ে গেছে প্রায় রোজ রাতেই চলে আসে। গল্পগাছা হয়।
আজ একথা-সেকথার পর নিধিরাম বলল, “সিধুভাই আমাদের বাড়ি একদিন যাবে?”
“সে তো স্কুলের কাজ দেখতে রোজই যাচ্ছি,” সিধু বুঝতে না পেরে বলল।
নিধি হেসে বলল, “দিনের বেলা নয়, রাতে। আসলে তুমি আমাদের এত বড় উপকারটা করলে, বাড়ির আর সকলে তোমাকে একবার দেখতে চায়।”
সিধু প্রথমে আঁতকে উঠল। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে ফিক করে হেসে ফেলল। বলল, আমার তিনকুলে কেউ নেই। তোমরা হলে গিয়ে যাকে বলে আমার নিজের লোক। তো যাব বইকি, নিশ্চয়ই যাব।