• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৯ | জানুয়ারি ২০২৩ | গ্রন্থ-সমালোচনা
    Share
  • "কারাবাস" - রিপুতাড়িত কারাজীবনের ইতিকথা : রঞ্জন ভট্টাচার্য

    কারাবাস — অহনা বিশ্বাস; গাঙচিল, কলকাতা; প্রচ্ছদ ও পরিকল্পনা— বিপুল গুহ; প্রথম প্রকাশ- জানুয়ারি ২০১৯, ISBN: 978-93-88380-12-6

    মানব জীবন এক আশ্চর্য ভুলভুলাইয়া। কখনও সেখানে উদিত সূর্যের আলোক উদ্ভাস। আবার কখনও কানা গলির ক্লেদাক্ত দুর্গন্ধ। বেশিরভাগ সাহিত্য সৃষ্টিতেই এই দু'য়ের ভারসাম্য বজায় থাকে। আবার ব্যতিক্রম্যতাও আছে। যেখানে শুধুই মানুষের অন্ধকার পিচ্ছিল জীবনের কলঙ্করেখা। প্রসঙ্গত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ' সরীসৃপ' বা ' প্রাগৈতিহাসিক' গল্পের কথা বাংলা সাহিত্যের পাঠকের সহজেই মনে পড়বে। অহনা বিশ্বাসের উপন্যাস 'কারাবাস' সেই ধারারই আধুনিক প্রজন্ম। অবচেতনে লুকিয়ে থাকা অন্ধকার প্রবৃত্তির শিহরণ জাগানো বহিঃপ্রকাশে এই উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে ব্যতিক্রমী। পাঠ করার পর সারা শরীর জুড়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে এক ধরনের অসহায় অস্তিত্বের সংকট। প্রাণীজগতে মানুষ হিসেবে নিজেকে নিকৃষ্ট মনে হয়। আর এই সমস্ত কিছুর মূলে এক নারী --পরী, 'কারাবাস'- এর প্রধান চরিত্র। জীবনের শেষ প্রান্তে 'হাত, কোমর নির্জীব' পরী যেন কনফেশন বক্সে স্বগত- স্বীকারোক্তি করে চলেছে তার সারা জীবনের পাপের বৃত্তান্ত। কোনো ধর্মযাজক নয়, এখানে অশরীরী শ্রোতা তার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা জীবিত ও মৃত কিছু চরিত্র। তবে শেষ পর্যন্ত মনে হয় এরা উপলক্ষ্য মাত্র। আসলে পরী নিজের বিবেকের কাছেই স্বীকারোক্তি করতে চেয়েছে।

    গাঙচিল প্রকাশিত একশো এগারো পাতার ক্ষুদ্র উপন্যাস 'কারাবাস'-এর কাহিনী ছড়িয়ে রয়েছে বাবা, সুশীল, জনার্দন, রুণা ও মনা নামাঙ্কিত পাঁচটি অধ্যায়ে। প্রথম চারটি পরীর চিন্তাসূত্রের স্বগত মনোলগে লেখা। শেষ অধ্যায় 'মনা' ফিরে এসেছে বর্তমানে। লেখা হয়েছে চলৎশক্তিহীন পরী ও তার মেয়ে মনার প্রত্যক্ষ উক্তিতে। অতীত ও বর্তমান, স্মৃতির প্রবহমানতা ও উপসংহারে বাস্তবের প্রত্যক্ষ অভিঘাতে লেখা বিশেষ আঙ্গিকের এই উপন্যাসের পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে মানব মনের জটিল রহস্যময়তার আলো-অন্ধকার । মানব মনের অনালোকিত পিচ্ছিল গলিঘুঁজি।

    শৈশব থেকেই পরী জেনে গিয়েছিল সে গ্রাম্য জীবনে বেমানান সুন্দরী। অত্যন্ত কুশ্রী মায়ের ভালোবাসা তার জোটেনি এই রূপের কারণেই। রূপে মায়ের মতই দিদিদের ভালোবাসা থেকেও সে বঞ্চিত একই কারণে। শুধুমাত্র গোপনে ভ্রূণ হত্যা করাই যার জীবিকা সেই হাতুড়ে ডাক্তার বাবার নয়নের মণি ছিল পরী। রূপ, বাবার ভালোবাসা ও বিপুল অর্থের অপ্রতিদ্বন্দ্বী অধিকারবোধ তার মনের মধ্যে জ্বালিয়ে দিয়েছিল প্রবল ক্ষমতার লোভ। সেই ক্ষমতার আস্ফালন ও রূপের অহংকারে সে পুরুষদের শাসন করতে চেয়েছে। দরিদ্র দীনু থেকে বাবার ভ্রণ হত্যার নিত্য সহচর মুনীরকে পরী বশ করেছে শরীরী মোহে। ক্ষমতার লোভ, তীব্র অধিকারবোধ তার মধ্যে তৈরি করেছে মানসিক জটিলতা। যখনই তার মনে হয়েছে কেউ তার এই জগতে ভাগ বসাতে আসছে তখনই সে তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছে। তার প্রথম শিকার মানসিক প্রতিবন্ধী ছোটো ভাই। প্রৌঢ়ত্বের চৌকাঠে বাবা-মা পুত্র সন্তানের জন্ম দেবার পরই বাবার ভালোবাসার একাধিপত্যে ফাটল ধরতেই পরী ভাইকে পরিকল্পনা করে ডুবিয়ে দেয় পুকুরের জলে। সরাসরি না হলেও, এই ঘটনার মাধ্যমেই হত্যায় হাতেখড়ি হয় তার।

    পরীর বয়স যতই বেড়েছে ততই তার মনে প্রবল থেকে প্রবলতর হয়েছে রিরংষা আর জিঘাংসা। শরীরী লালসায় সে পুড়িয়েছে ভাসুরপো সুশীল, শান্তিনিকেতন হসপিটালের ডাক্তার করকে। হত্যা করেছে শ্বশুর, স্বামী, ডাক্তার কর এমনকী একমাত্র পুত্র বাবলুকে, যে মাকে দেখে ফেলেছিল বাবাকে খুন করতে। ক্রমশ পরী বন্দী হয়ে পড়েছে জিঘাংসার চক্রব্যূহে। আইন তাকে শাস্তি দিতে পারেনি প্রমাণের অভাবে কিন্তু পাপের লৌহ শৃঙ্খলে বন্দি অবচেতন আত্ম অনুশোচনার কারাগারে সে ভোগ করেছে কারাবাসের যন্ত্রণা। পরী মেয়ের কাছে নিজের মুখেই স্বীকার করেছে তার এই যন্ত্রণার কথা, "তুই হয়তো ভাবছিস, আমি নানাভাবে জেল এড়িয়ে গেছি, আসলে কি জানিস, আমি চিরদিন জেলেই ছিলাম। আমার নিজের চারদিকে জেল তৈরি করে নিয়েছিলাম। আমার কেউ আত্মীয় বা বন্ধু ছিল না, কারুর সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতাম না -- সব সময় অভিনয় করতাম। সব সময় আতঙ্কে থাকতাম। কেউ দেখতে পেত না, হাতে- পায়ে আমার ভারী কড়া পরানো ছিল। আমি নিজেই তা পরেছিলাম।" ( পৃ ১০৪) পরীর এই পাপ তাড়িত যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ লেখিকার কলমে মূর্ত হয়েছে এই অসাধারণ উপন্যাসের পাতায় পাতায়।

    পরীকে বলয়ের মত ঘিরে রেখেছে বেশ কিছু চরিত্র-- ওর শরীর- এবং সম্পত্তিলোভী মুনির ও সুশীল, সৎ, আদর্শবাদী ভদ্রলোক স্বামী জনার্দন, বাবার খুনি মার স্নেহসঙ্গকে প্রত্যাখ্যান করা নীরব প্রতিবাদী বাবলু, জনার্দনের সততায় ক্ষুব্ধ পরীর রূপলুব্ধ সহকর্মীরা, ডাক্তার কর - এরা সকলেই চরিত্রগত ভাবে সরলরেখার মত জটিলতাহীন। ব্যতিক্রম মনা - পরীর একমাত্র মেয়ে। বোধহয় এই উপন্যাসের সবচেয়ে জটিল চরিত্র। দাদার খুনের সাক্ষী মনা মাকে বিশ্বাস করে না। সে খুন হলে মা-ই দায়ী থাকবে এই মর্মে মনা ডায়রি করে। খুনি মায়ের আক্রোশের হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য সঙ্গে লাইসেন্সড রিভলবার রাখে। আবার বৃদ্ধ অসুস্থ মাকে যত্নে আগলে রাখে। পরীরও বিশ্বাস মেয়ে তাকে অসম্ভব ভালোবাসে। সে চায় না মা মারা যাক। "তুই কী আমাকে মৃত্যু থেকে ফিরিয়ে আনতে চাস। আর কত যন্ত্রণা পাব আমি? -- বাঁচা বা মরা কোনওটাকেই তো আমি হাতে রাখিনি মা।" (পৃ ১০৩) মায়ের প্রতি মনার এই দ্বিধাবিভক্ত মানসিকতার কারণ কি মাকে বাঁচিয়ে রেখে আত্মগ্লানির যন্ত্রণায় ক্রমশ দগ্ধ করা? এভাবেই কি সে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছে প্রত্যেকটি খুনের? কাহিনীতে স্পষ্ট কোনো উত্তর নেই। এরকমই অসংখ্য উত্তরহীনতায় ক্রমাগত পাঠক হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হবে 'কারাবাস' উপন্যাসের নানা পাঠ মুহূর্তে। জীবন অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয় অসংখ্য প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতে। 'কারাবাস' কোনো সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার নয়, এরকমই এক অননুভূত জীবন জিজ্ঞাসা। যার প্রবল অভিঘাত পাঠককে মানুষ হিসেবে আত্মসংকটের এক অসহায় মরুভূমিতে দাঁড় করিয়ে দেয়।

    লেখিকা অহনা বিশ্বাস সৃষ্টিশীলতায় বহুপ্রসূ। বিচিত্রগামী তাঁর প্রতিভা। উপন্যাস, ছোটগল্প, আত্মজীবনী, প্রবন্ধ প্রভৃতি গদ্য নির্ভর রচনার পাশাপাশি লিখেছেন কবিতা, এঁকেছেন ছবি। 'কারাবাস' উপন্যাসের সূচনায় রয়েছে চিত্রী অহনা বিশ্বাসের আঁকা একটি ছবি। নামহীন সেই ছবি যেন অপরাধী হৃদয়ের আত্মযন্ত্রণার কারাগারে আবদ্ধ নায়িকা পরীর জটিল অবচেতনের রহস্যাবৃত অবয়ব। বিপুল গুহর পরিকল্পিত ও রূপায়িত প্রচ্ছদ, লেখিকার আঁকা ছবি ও কাহিনীর যুগলবন্দীতে 'কারাবাস' একটি অনন্য প্রকাশনা। রহস্যময় মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার অনবদ্য কাহিনী রূপ।

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments