পনেরো দিন হয়ে গেল আমরা বেরিয়েছি। এখনো সেই চড়াই আর পাকদণ্ডীই চলেছে। আর পাইনের বন। গ্রীষ্মের এই সময়টায় বড় ভয় করে, এখানে নাকি শুকনো পাইনপাতায় ঘষা লেগে আগুন ধরে যায়, মাইলের পর মাইল ছড়িয়ে যায়। আশপাশে গাঁও থাকলেও কেউ আগুন থেকে বাঁচাতে আসবে না। আর রসদের বোঝা পিঠে নিয়ে দৌড়ে পালানো অসম্ভব। যদিও যতটা ওজন কাঁধে নিয়ে পথচলা শুরু হয়েছিল, এখন তার অর্ধেকে এসে ঠেকেছে। এর পরে আমাদের স্থানীয় গ্রামগুলোয় হাত পেতে নিতে হবে, হয় রসদ, নয় মেহমানদারি। তাও এতজনের খাতির-যত্ন করার মত সম্পন্ন গেরস্ত কি আর রোজ রোজ পাওয়া যায়! রাজুকে বললে হেসে উড়িয়ে দেয়। দলের বাকি লোক আরো নিকম্মে। তুম জানো, বলে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন আমার বিয়ের বারাতিতে এসেছে সব শালা।
কবে যে এই জঙ্গুলে রাস্তা শেষ হয়ে বরফের দেশ আসবে, কে জানে! পাহাড়ের মধ্যে একটা সরু গিরিপথ, তার পরেই সমতল উপত্যকার মধ্য দিয়ে প্রায় দশ রাতের যাত্রা। রাজু বলেছিল শেষে একটা দরজা আছে। পথের কষ্ট স্বীকার করে গেলে, সে দরজা নাকি আপনি খুলে যায়। তার পরেই এক বিশাল সরোবর। তার ঝকঝকে জলে এমনিতে ছায়াটি পড়ে না। শুধু সন্ধ্যার একটুক্ষণ আগে জলে উঁকি দিলে নিজের ছায়ার পাশে দেখা যায় মা-বাবা, দাদা-দাদি, নানা-নানিরা সবাই এসে দাঁড়িয়েছে। এমনকি বিছড়ে হুয়ে ভাই-বোনরা পর্যন্ত চলে আসে। জনম কা বন্ধন যাবে কোথায়!
দিল্লিতে বসে বললে স্রেফ অবিশ্বাস করতাম। সালে ঝুটে কাঁহাকা, বলে দু ঘা বসিয়েই দিতাম। গজরৌলা কিংবা রুদ্রপুর হলেও, যা ভাই তু অপনা দেখ বলে আলাদা হয়ে যেতাম। কিন্তু বাগেশ্বরের আশ্রমের চবুতরায় বসে সন্ধের ঝুঁঝকো আঁধারে রাজুর কথা বিশ্বাস করতে খুব ইচ্ছে হল। দূরে তখন পাসনালা গ্রামের আলো জ্বলে উঠছে একটা-দুটো করে, বাকি উপত্যকা ডুবে যাচ্ছে অন্ধকারে। এতদিনে বাবার স্মৃতি প্রায় আবছা হয়ে এলেও দিনের এই সময়টায় মাকে দেখতে এখনো বড় সাধ যায়। আমাদের ছোট গ্রামটা, কী যেন সেই বেহুলা নদীর ধারে, চৌকায় মার টুকটাক বাসন নাড়াচাড়ার শব্দ, ভাঙা গমের জাউ জ্বাল দেবার ঘ্রাণ, সব ফিরে ফিরে আসে। দরজাটার কথাও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়েছিল, যেন সত্যি হয়, পাহাড়ের গোলু দেবতা। মা, মাগো।
দিল্লির শেল্টারে আবার এই সময়টাই ম্যাক্সিমাম কিচিরমিচির। ইনমেটদের হাজরি নেওয়া, সারাদিনে কাটাকুটি-চোট কিছু লাগলে ছানবিন, ওষুদবিষুদ, হাজার ফ্যাচাং। এর মধ্যেই ধেড়ে ইনমেট বা ওয়ার্ডেনরা দু-একটা চড়-চাপড় দিলে সেও মুখ বুজে হজম করো। তারপর সংক্ষিপ্ত প্রার্থনার পর জোলো খিচড়ি। সাধে কি পালিয়েছিলাম! তারপর পথেঘাটে ভিক্ষে, সাইকেলের-পাংচারের দোকানে, রাস্তার ধারের ধাবায় ফরমায়েশ খাটা। কিন্তু দিল্লি ফিরে যেতে সাধ হয়নি কখনো। আর ফিরলেই বা কি কলাটা হত! পুলিশ ঝুটো কেস-টেস দিয়ে দিলে তো কথাই নেই। তাই রুদ্রপুর পেরতে পেরতেই পাহাড়ের দিকে ঘুরে গেলাম।
রাজুর সঙ্গে এই সময়েই দেখা। বয়সে অনেকটা বড়, সেও এক ভগোড়ে, কোন গাঁও, কিছুতেই বলে না। উল্টে প্রথমে আমার হাঁড়ির খবর নেওয়ার চেষ্টা। কারণ বুঝেছি অনেক পরে। ততদিনে লোকের সাথে কথা বলে, নদীর নাম জেনে, আশপাশের খেতির খবর জেনে সে আমাকে বলেছে আমাদের গ্রামটা এখন আর নেই, ড্যামের জলের তলায় চলে গিয়েছে। বেহুলা নদীর উপর বিরাট ড্যাম হয়েছে। আমার মনে পড়ল খুব ছোটবেলাতে এক সন্ধে বেলায় গ্রামে পুলিশ ঢুকেছিল বটে, তারা তাড়িয়ে তাড়িয়ে আমাদের লরীতে তুলে দিচ্ছিল। ঘরে ঘরে আগুন লেগে গেছিল। গুলিতে কেউ কেউ মারাও গেছিল। আমার একটা বড়েভাই ছিল, তাকে দেখতে না পেলেও মা আর ছোট বোনটা আমার সঙ্গেই ছিল লরীতে। মা বুক চাপড়ে কাঁদছিল বড়ে ভাইয়ার জন্য। পরে রাজুকে যখন একটু একটু বলছিলাম, রাজু দাঁতে দাঁত ঘষছিল। ইনসাফ নেই কোথাও। – নেইই তো। সে কথা ভেবে কী হবে।
বাগেশ্বর থেকে বেরিয়েছিলাম বারো জন। আমাদের এত বড় একটা দল যে হয়ে যাবে, সেটাও আগে মনে হয়নি। বুদ্ধপূর্ণিমার দিন রওনা হবার কথা কে যেন এসে কানে কানে বলে গেল। পাশের গ্রাম থেকে রুকস্যাকের মত ঝোলা, ঠান্ডার জুতো, শুকনো খাবার, লাইটার....ফর্দ মিলিয়ে যোগাড় হল। এই কাজটা আমার বেশ ভালই লাগে, দিল্লি হোমের কিচেনে আমার ডিউটি করতে ভালই লাগত। ওজন-টোজন চটপট বুঝে ফেলতাম বলে ইনচার্জ আমাকেই ডেকে নিত খেলার মাঠ থেকে। কাজেই এবারও সর্দারিটা আমার ঘাড়েই পড়ল। প্রায় সবারই পকেট গড়ের মাঠ কাজেই একটা তঞ্চকতা করা হল, রুকস্যাক ইত্যাদি নেওয়া হল ভাড়ার চুক্তিতে। আমাদের কারো ফেরার প্ল্যান নেই জানলে ওসব কিনতে বাধ্য করত গ্রামের লোক। পুরো পয়সা নগদ ফেলতে হত। আমাদের সেই জোর কোথায়। এও না-ইনসাফি। রাজুকে বলাতে সে শুধু হাসল। স্বপ্ন দেখিয়ে আলগা দেওয়াটা যেন তার বাঁ হাতের খেল।
যাই হোক সেই বারো জনের মধ্যে এখন মোট আট জন টিঁকে আছি। রাজুকে হিসেবে ধরে। সে মাঝে মাঝে কোথায় চলে যায় বুঝতে পারি না। বিসাওয়ালের ত্রিসংসারে কেই নেই, অল্পবয়সী বউ সদ্য মারা গিয়েছে প্রসব হতে গিয়ে, প্রত্যন্ত গ্রামে। সে তার "ওয়াইফ"কে কেবল একবার দেখতে চেয়ে প্ল্যানে সামিল হয়ে গেছিল। পাহাড়ের লোকের রীতিনীতি সেই আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জানত। ভাষাও। মাপা গ্রামে পৌঁছে আমরা মন্দিরের পাশে বিশ্রাম করছিলাম। ঘুম থেকে উঠে তার পিঠের ব্যাগটা আর দেখতে পেলাম না।
যাদব বলল, গ্রামে ঢোকার সময়েই নাকি একটি পাহাড়ি মেয়ের সাথে সে অনেকক্ষণ কথা বলছিল। দুয়ে-দুয়ে চার করলে, আমাদেরও সেখান আর বেশিক্ষণ থাকা ঠিক নয়। গ্রামের লোক কেউ আসার আগেই আমরা পাকদণ্ডী বেয়ে অনেকটা ওপরে উঠে গেলাম।
নন্দুর পায়ে কোনো ঘা ছিল। পা–চাপা জুতো পরে সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সবার পিছনে হাঁটত। আটবা গাঁয়ে পৌঁছনোর আগেই তার পা ফুলে এমন হল যে জুতো থেকে বের করা যায় না। গাঁয়ে নাঈ-ই ছোটোখাটো চিকিৎসার কাজ করে। এখান থেকে গংগোলিহাট স্বাস্থ্যকেন্দ্রও অনেক দূর। কাজেই তাকে ফেলেই আসতে হল। নন্দু কাঁদছিল খুব, তার অনুশোচনা হচ্ছিল। ছেলেবেলাতেই বাবা নিখোঁজ হয়ে যায়, তাঁকে একটিবার দেখার আশাতেই সে এতদূরের পথ ধরেছিল । বাড়িতে বুড়ি মা একলা। সে যদি চলে যায় তাহলে মাকে কে দেখবে। একটা দুরাশা মেটাতে গিয়ে যে কী বিপদের মধ্যে পড়ে মানুষ। কিন্তু দুরাশা জেনেও মার সঙ্গে দুটো কথা বলার ইচ্ছে ছাড়তে পারছি কই!
দ্বিতীয় সপ্তাহ যেতে না যেতেই আরো দুজন পালালো। এই ক’দিনে দু-পাশের গ্রামের লোকজনের মনোভাব অনেক কঠিন হয়ে আসছে দেখতে পাচ্ছি। মাপা গ্রামের বদনাম আমাদের পিছু নিয়েছে বলেই মনে হয়। তাছাড়া পথে কোনো একটা আপেল খেত থেকে আমাদের কেউ কেউ অনেকগুলো আপেল পেড়ে নিয়েছিল। বারণ করেও কোনো কাজ হয়নি। রাজুকে এসব বলাও বোকামি। ও দরজার স্বপ্নেই মশগুল।
স্থানীয় মানুষজন যদি বেঁকে বসে তাহলে যে আমরা কতদিন রাস্তায় চলতে পারব, জানি না। আরো উত্তরে গেলে তো আবার পদে পদে আর্মির লোকজন...অবশ্য রাজু বলছে ওর নাকি এমন রাস্তা জানা আছে যা আর্মিও খোঁজ রাখে না। ভরোসা রাখ, ওর এক কথা। আর হাসি।
কিন্তু দলের মধ্যে যখন আমার ওপরেই কারো ভরসা নেই, তখন আর আমার কী করার থাকতে পারে! একটা ফিসফাস চলছে, টের পাচ্ছিলাম। কিন্তু আমি তো কাউকে বুডঢি কা বাল দেখিয়ে ঘর থেকে বের করে আনিনি, কাজেই পাত্তা দিচ্ছিলাম না।
সতেরোদিনের সকালে রাস্তায় একটা ঝরণা দেখে চান করার ইচ্ছে হল। সবাইকে বললামও। নিজের পুঁটলি থেকে লাইফবয় সাবান বের করলাম। কিন্তু রাজু ছাড়া সবাই বিবেকানন্দের স্টাচুর মত দাঁড়িয়ে রইল।
রাতে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ঘুম ভাঙল। কেউ বার বার লাথি মারছে, বলছে, কুত্তে কা আউলাদ, কালা জাদু করতা হ্যায়, অব চুপচাপ মরনা। হাল্কা পায়ের শব্দ, যেন অনেকগুলো পা-জোড়া দৌড়তে দৌড়তে মিলিয়ে গেল। আগুনের হল্কা, তাপ আসছে কোথাও থেকে। সম্বিত পেয়ে দেখি পাইনবনের মধ্যে পড়ে আছি। হাত পিছমোড়া করে বাঁধা, পা-জোড়াও।
গলা শুকনো, বড়ে ভাইয়া বলে ডাকলাম। সাড়া নেই।
অথচ সকালে সেই পীপলকোটে চান করার সময় একমাত্র রাজু, থুড়ি, বড়ে ভাইই এসে যোগ দিয়েছিল। এখানে নীল রঙের বড় বড় কাকের সাইজের একরকমের পাখির উপদ্রব। চানের মাঝখানেই একটা পাখি এসে ছোঁ মেরে সাবানটা নিয়ে চলে গেল। লাল, মোটা ঠোঁটে লাল রঙের সাবান। সে দিকে দেখতে দেখতে রাজু বলছিল, লল্লা, তু অপনে বড়ে ভাই কো পেহচানা নহি ইত্তে দিনো মেঁ?
--তুমি বড়ে ভাই? কী বলছো কী!
--অর নহি তো কেয়া। তেরা চেহরা মাম্মী পর গয়া। মেরা পাপা পর।
গ্রাম ছাড়ার সময় আমি সাত-সাড়ে সাত। বড়ে ভাই বারো তেরো হবে। চেনার মত কিছু না।
--আচ্ছা, মাম্মীকা নাম আশা দেবী। সহি? (ঠিকই বলেছে) ব্যহেন রাখী (এটাও ঠিক)। তাহলে এতদিন বলোনি কেন ভাইয়া, খুব অভিমান হচ্ছিল আমার। বড়ে ভাইয়া আমার মন যেন পড়ে ফেলছিল। বলল, আরে বুদ্ধু, আচ্ছে খবরও সইয়ে সইয়ে ভাঙতে হয়। এই তো অগর সরোবর মেঁ মাম্মী অর রাখী নহি মিলা তো দিল্লি যাকে যমুনাপারের বস্তিতে বস্তিতে খুঁজবো।
তখনই যাদব হাঁক পেড়ে বলেছিল, কার সাথে বতিয়া বানাচ্ছো হে সর্দার।
আমি সর্দার! বোঝো! সামলানোর আগেই দেখি রাজু, থুড়ি, বড়ে ভাইয়া আবার গায়েব। আপাতত জ্বলন্ত গাছের ডাল ভেঙে ভেঙে পড়ছে। এক গাছ থেকে আরেক গাছে আগুনের সুঁই ছুটে যাচ্ছে হাওয়ার তোড়ে। রজনে লপলপ গাছে আগুন লেগে যাচ্ছে মাচিসের মত। এত তাপ, ধোঁওয়া, চোখ খোলা রাখা, শ্বাস নেওয়া কষ্টের। ছেতরে পড়ে আছি, একদম মাটি ঘেঁষে। দৌড়তে পারছি না, ডান হাঁটুতে জ্বালা-পোড়া, চিৎকার চেপে রেখেছি। তাছাড়া পা তো বাঁধা।
গ্রামের দিক থেকে একটা হৈহৈ আওয়াজ ভেসে আসছে। সামনে জলের মধ্যে চারিদিকের আগুনের ছায়া, আর একটা কালিঝুলি মাখা মুখ। কিন্তু জলটা এল কোথা থেকে? এ কি সেই সরোবর? দরজাটা দেখলাম না তো? আরেকটু চেষ্টা করলে কি মাকে দেখতে পাব? দাদি? নানির হাতে উল্কিতে লেখা রাম? একটা সুন্দর গন্ধ পাচ্ছি, যদিও সেটা পোড়া রজনেরও হতে পারে। এখন তো দেখছি আগুন যে সবসময় নিজে থেকে লেগে যায়, তা নয়। সুখার দিনে কেউ একটু আগুন ঠেকালেও হোলির মত আগুন জ্বলে ওঠে। নিজেই জ্বলুক আর অন্যেই জ্বালাক, পোড়াতে কোন আগুনই কম যায় না।
রাজুর-ও (নাকি বড়ে ভাইয়া বলব?) দেখা নেই। সে-ই তো বলেছিল, সরোবরের জলে ছায়া না দেখতে পেলেও ক্ষতি নেই, ফিরে এসে আমার সঙ্গে যমুনা পারের বস্তিতে বস্তিতে মাকে খুঁজবে। আগে মনে হত সেরকম দরজা আর সেই আশ্চর্য আয়নার মত সরোবর না থাকলে এত ঝুঁকি নিয়ে এতদূর আসার কোনো মানেই হয় না। অথচ এখন মনে হচ্ছে আমার, বড়ে ভাইয়ার মধ্যে যদি মা পিতাজী থেকে যায় তাহলে এই আসা যাওয়ার রাস্তাটা, এই খোঁজটাই বা কী কম সুন্দর?
কিন্তু সেসব নিশানী আমাকে তো রক্ষা করতে হবে। না হলে কাল সকালে গ্রামের লোক যদি এসে পোড়া কাঠের মত শরীরটা দেখতে পায়, এই সুন্দর কহানীর এক ভয়ানক অন্ত হোগা কি নহি?
লাল হয়ে ওঠা আকাশের কালপুরুষ সাক্ষী, লল্লা প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছে অন্তত পায়ের বাঁধনটা খোলার।