মহিলা না বলে মেয়ে বললাম কারণ বেশি বয়স নয় তার, দেখে যা মনে হলো।
কিন্তু পাক্কা মনে হচ্ছে সে বিবাহিতা, যদিও সেকালের মতো শাঁখা সিঁদুর যে রয়েছে তা তো নয়।
সাদা সালওয়ার কুর্তা ও উদ্ধত যৌবনবতী রূপের মধ্যে একটা অবাঙালী ছাপ রয়েছে, যদিও এমন মনে হওয়ার কোন স্বাভাবিক যুক্তি নেই।
ঘটনাটা এই যে প্রখর গ্রীষ্মের রৌদ্রে সুদূর দাক্ষিণাত্য (পড়ুন, নিউ গড়িয়া) থেকে গাড়ি চালিয়ে আমার নিউ টাউনের এই নতুন ফ্ল্যাটে যখন এসে পৌঁছেছি ঘড়ির কাঁটা তখন দুপুর দুটো দেখাচ্ছে। গাড়ির এসি খারাপ, সারাতে দিতে হবে শীগগরিই, গড়িমসিতে দেওয়া হচ্ছে না।
সন্ধ্যে ছ’টার মধ্যে নন্দনে পৌঁছতে হবে কারণ নমিতা দাঁড়িয়ে থাকবে সিনেমার টিকিট হাতে নিয়ে…..এমন ভাবতে ভাবতে আলগোছে মেয়েটির ‘নমস্তে’ দেখে কিছুটা ইতস্তত করেও লিফটে ঢুকে এলাম কারণ আমি যখন লিফটের দরোজার সামনে হেঁটে এসে গেছি প্রায়, মেয়েটি ততক্ষণে লিফটের কোলাপ্সিবল গেট টেনে দিয়ে বাটন টিপতে যাচ্ছিল, আমাকে দেখে থমকে গেল ভদ্রতার খাতিরে।
আলগোছে ‘থ্যাঙ্কু’ বলে ঢুকে এলাম লিফটে, গ্যাপ রেখে দাঁড়ালাম।
আমার সাত, ওর বারো তলার সবুজ বাটন জ্বলে রয়েছে দেখতে দেখতে উঠতে লাগলাম। লিফটে আর কেউ ওঠেনি।
দশ-বারো তলার এমন টাওয়ার নূতন এই হাউজিং কমপ্লেক্সটিতে পাঁচটা আছে। বম্বের নামী ডেভেলপারের করা লাক্সারিয়াস কমপ্লেক্স এটি, চার বছর আগে বুক করে হালে চাবি পেয়েছি হাতে, এবং শিফট করে এসেছি । এখনও বারো আনা ফ্ল্যাট ফাঁকা পড়ে আছে, লোক আসেনি।
কোনো কারণ নেই, ভদ্রতাতেও বাধে, তবু অকারণেই মেয়েটির শরীরের দিকে চোখ চলে যাচ্ছে। কারণটা নিজের বয়স, আর কিছু নয়। আর হ্যাঁ, ‘কিছু’-টা হলো, মেয়েটির বাম চিবুকে এক কপিবুক আঁচিল!! চোখে কালো রোদ-চশমা।
সদ্য রিটায়ার করেছি চাকুরি থেকে, কিন্তু…….…না, কিছু না।
শীগগিরই স্নান খাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়তে হবে। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যাবে আজ।
নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকে প্রথমেই ফ্রিজ থেকে একটা বাডউইজারের ক্যান বের করে শিপ্ দিলাম। অতঃপর স্নান-টান হবে’খনি।
খাবারটাও ফ্রিজ থেকে বের করে টেবিলে রাখলাম। মাইক্রো ওভেনে গরম করে খেয়ে নেবো স্নান সেরে।
চানে যাবো, ধড়াচুড়ো ছেড়ে তোয়ালে পরতে পরতে হঠাৎ কী খেয়ালে প্যান্টের পকেটে ফের হাত ঢোকালাম। গাড়ির চাবিটা বের করে দেওয়ালের নির্দিষ্ট হুকে ঝুলিয়ে রাখতে হবে।
পেলাম না।
এ’পকেট ও’পকেট হাতড়াতে রাখলাম। নেই। কী কাণ্ড!
কিছুদিন আগেই এমন হয়েছিল, এক বন্ধুর ফ্ল্যাটে সান্ধ্য আড্ডা সেরে নেমে ঘোরের মধ্যে পার্কিং লটে নিজের গাড়ির সামনে এসে পকেট থেকে চাবি বের করতে গিয়ে না পেয়ে তাকিয়ে দেখি তিনি আমার গাড়ির গায়ে দিব্যি ঝুলিতেছেন! মাই গাড!! মনে পড়ে গিয়েছিল, আসবার সময়ে গাড়ি পার্ক করতে করতে প্রাক্তন বসের একটা ফোন এসে যাওয়ায় ঐ গাড়িতে ঝুলন্ত অবস্থায় চাবিগাছা রেখেই চার ঘন্টার সান্ধ্য আড্ডা সেরে ফিরেছিলাম, তার মানে?!
বুড়ো বয়সের বেভভুল অবস্থা, আর কি!
আজকেও কি তেমন হলো নাকি?
এক্ষুণি দৌড়ে গাড়ির কাছে গিয়ে দেখা উচিত কি যে চাবিটা আজও গাড়ির দরোজাতেই ছেড়ে এসেছি কিনা? ভাবতে ভাবতে ডিং ডং করে ডোর বেলটা বেজে উঠল।
দরোজার কী-হোল দিয়ে তাকিয়ে দেখি সামনেই সেই শ্বেতবসনা সুন্দরী দাঁড়িয়ে আছেন!
কী ব্যাপার? হঠাৎ ইনি?
চোখের কালো চশমাটা এখন মাথার উপরে তোলা।
এই মুহুর্তে দরজা খুলি কী করে? খালি গায়ে তোয়ালে পরে আছি যে! গৃহিনীও আজই গেছেন…..কোথায় যেন গেছেন?
ডোর চেইন লাগিয়ে আলগোছে দরজাটা খুলতেই উনি হাত বাড়িয়ে আমার গাড়ির চাবিটি এগিয়ে দিলেন! বিস্ময়, কৃতজ্ঞতা আরও কী কী সব যেন মিশিয়ে কিছু বলতে গেলাম। বাক্যি জড়িয়ে এলো।
‘থ্যাঙ্কু দিতে হবে না। আপনার এই সাত তলার বাকি তিনটে ফ্ল্যাটে তো তালামারা, তাই খুঁজতে অসুবিধে হয়নি।’ হিন্দিতে বললেন তিনি।
‘লিফটে আমার পকেট থেকে পড়ে গিয়েছিল নিশ্চয়ই?.....’ আমতা আমতা করে বললাম।
‘না, আমি পিক পকেট করেছিলাম’ মুক্তোর মতো হাসি ছড়িয়ে স্পষ্টতই কপটতা করে কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল মেয়েটি। মানে, ঐটুকু দরজার ফাঁক দিয়ে আমি আর তাকে দেখতে পেলাম না। সে বোধহয় পাশের ফ্ল্যাট ডিঙিয়ে ফের লিফটের দিকপানে হেঁটে চলে গিয়েছিল।
‘আসুন আসুন’-বলে তাকে এখনই কি ফ্ল্যাটের ভিতরে ডেকে এনে বসিয়ে চা অফার করা উচিত ছিল? মানে, সেটাই কি এটিকেট-দুরস্ত হতো?
ধুস্! এই তোয়ালে পরে??
সিনেমাটা কোরিয়ান! ভূতের! মানে, এট লিস্ট কেমন কেমন যেন অব্যাখ্যাতরসের। এক প্যারানয়েড নায়িকা সর্বদা যার মনে হয়……নাঃ, বলে দিয়ে স্পয়লার করবো না। তবে হ্যাঁ, নায়িকা ট্রান্সজেণ্ডার, শুধু তা-ই নয় তিনি যখন তখন তাহা চেঞ্জও করিতে পারেন। ভাবো!
শো শেষে লবিতে কফি খেতে খেতে নমিতাকে বললাম আজ দুপুরের সেই লিফট-তনয়ার অভিজ্ঞতাটার কথাটা, কারণ এই সিনেমাটার নায়িকার সারাক্ষণ মাথার ওপরে সানগ্লাস তুলে তুলে রাখা দেখে সকালের লিফটে ঐ মেয়েটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল।
সব শুনে নমিতা বলল, ‘সুন্দরী? খুব? তোর উচিত ওকে একটা ক্যাডবেরি সেলিব্রেশন উপহার দিয়ে আসা।’
নমিতা আমার কলেজের বান্ধবী। দীর্ঘকাল বরের সঙ্গে দিল্লিতে থেকে হালে কলকাতায় ফিরেছে।
ঠিক বলেছে নমিতা।
রাত সাড়ে দশটায় এক অপরিচিত মহিলার বারো তলার ফ্ল্যাটে ডিং ডং করা অনুচিত কার্য, কিন্তু সেটা আমার মনে থাকলে তো, কারণ ইয়ে মানে চারটে শট্ গলাধঃকরণ করার পরে…..[এই দ্বাদশ ফ্লোরেও বাকি তিনটে ফ্ল্যাটে তালা ঝোলানো, তাই চিনতে অসুবিধে হয়নি।]
ডোর চেইন লাগিয়ে এক বৃদ্ধা দরোজাটা হাফ-খুললেন, পরনে তাঁর সাদা থান, ডিগডিগে রোগা। মাথায় শনের মতো সাদা চুল। বয়স সত্তর -আশি যা খুশি হতে পারে। চোখে পুরু প্লাস পাওয়ারের চশমা।
ইনি কি মেয়েটির শাশুড়ি?
কেন যে আমার এমন মনে হলো, জানি না।
হাতের সেলিব্রেশনের প্যাকেটটা এগিয়ে দিয়ে বললাম, ‘মিসেস চন্দ্রবংশী?’
দরজার বাইরের নেমপ্লেটে ঐ নামটাই লেখা ছিল কিনাঃ ‘ঐল’, দ্য চন্দ্রবংশী’জ্।
‘ঐল’-টা কায়দার ক্যালিগ্রাফি করে দেবনাগরীর ঢঙে লেখা, বাকিটা রোমান অক্ষরে।
‘ইয়েস’। মুখে কোনো কথা না বলেও ঘাড় নেড়ে জানালেন বৃদ্ধা।
নির্দ্বিধায় চকোলেটের প্যাকেটটি এগিয়ে দিয়ে এক গাল হেসে ‘থ্যাঙ্কু’ বললাম।
সেটা না নিয়েই বুড়ি হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেল।
পর মুহূর্তেই দেখি দরজায় সেই সুন্দরী এসে দাঁড়িয়েছে!
গোলাপী সিফনের এক ঢোলা ঢোলা মাল্টি ফ্রিল নাইট ড্রেস পরে আছে এখন সে। পোশাকের দৈর্ঘ্য হাঁটুর একটু নিচেই শেষ। আর সে ঘরের মধ্যে দেওয়ালে সিলিং এ শতেক চন্দ্রের আনাগোনা---আলোর রোশনাই খেলা করছে। আজকাল এমন ধরনের ফ্যান্সি লাইট বেরিয়েছে, না?
মাথাটা বন বন করে ঘুরতে লাগল আমার।
ঠিক এমন সময়ে ‘টিং টং টিং টিং টং’ করে আমার মোবাইলে ফোন এসে গেল একটা। গৃহিনী। বম্বে থেকে। বাড়ি ফিরেছি কিনা খোঁজ নিচ্ছেন নিশ্চয়ই।
কেটে দিয়ে [এখন আমি গাড়ি চালাচ্ছ] এক গাল হেসে ‘থ্যাঙ্কু’ বলতে যেতেই হাত নেড়ে উনি ‘না না’ জানিয়ে চোস্ত্ ইংরিজিতে বললেন, ‘আমি যদি ভবিষ্যতেও আপনার কোন কাজে আসতে পারি, জানাবেন। আই এম আ কনসালট্যান্ট। এন্ড হিয়ার ইজ মাই কার্ড…’
পকেট তো নেই, কোত্থেকে যেন ফস্ করে এক ভিজিটিং কার্ড বের করে এনে উনি দরজার ফাঁক গলিয়ে আমার হাতে সেটা ধরিয়ে দিতে দেখলাম সেটা সাদা। কিছু লেখা নেই তাতে।
এই রকম আবার হয় নাকি? কেউ কি সাদা কার্ড ছাপাবে? সেটা আবার ভিজিটারকে দেবে? সন্ধ্যের পানাহারটা কি তাহলে আজ একটু বেশিই…….?
পরমুহূর্তে মনে পড়লো, চোখে চশমা পরিনি। বুকপকেট ঢুঁড়ে খুঁজে পেলাম না।
‘চাবি বা চশমা খুঁজে না পেলে তৎক্ষণাৎ কী করা উচিত বলুন তো?’
আবার মুক্তোর হাসি ছড়িয়ে বললে সে সুন্দরী।
‘কী?’ আমার গলা দিয়ে কিন্তু স্বর বেরোয়নি।
‘আয়াম আ কন্সালট্যান্ট, বললাম না? আপনি কি আমাদের এনুয়াল মেম্বারশিপ নিতে চান? আমাদের এপ্ টা ডাউনলোড করে নিন। কার্ডে ডিটেইল আছে। বছরে এক হাজার ৯৯৯ লাগবে মাত্র……’
সুযোগটা নিলাম। খেজুরে করবার।
কপট উৎসাহ দেখিয়ে বললাম, ‘তাই? আমার বিশেষ ইন্টারেস্ট আছে……’
‘কিসে?’ উৎকণ্ঠিত চোখে বললে সে রমণী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে । পিছনে সেই বৃদ্ধাও। আর ঘরের দেওয়ালে চাঁদ-তারার আলোর রোশনাই! খেলা!!
‘কিসের?’ তাইতো! মনে মনে প্রমাদ গণি। এঁর কন্সাল্টেন্সিটা কিসের সেটা জেনে নেওয়া হলো না তো। কার্ডটার দিকে ফের তাকিয়ে দেখি বিলকুল সাদা।
আমার থতমত ভাব দেখে ফের মুক্তোহাসি ছড়িয়ে উনি বলেন, ‘স্যর-জী, আপনি আমার কার্ডের ব্যাক সাইডটা দেখছেন তখন থেকে। সামনেটা দেখুন?’
মস্ত একটা জিভ কাটলাম। মনে মনে। বড্ড কাঁচা কাজ করে ফেলেছি তো!
দেখি, লেখা রয়েছেঃ
‘ঐল’
ইলা চন্দ্রবংশী
ট্রান্সফর্মেশন কনসাল্ট্যান্ট
‘উই চেঞ্জ লাইভস্!’
আরও কত কিছু লেখা ছোট ছোট অক্ষরে।
যাব্বাবাঃ! এর মানে কী? শুধালাম।
বললে সে সুন্দরী, ‘আমার নাম প্রেম। প্রেম মানে লাভ! লাভ ইজ ইউনিসেক্স!’
‘কিন্তু ইলা ?’
‘ওটা আমার ভালো নাম। শুভনাম। বন্ধুরা আমায় প্রেম বলেই ডাকে, তুমিও তাই ডেকো।’ হিন্দিতে বললে।
‘আপ’ না, ‘তুম’ বলল।
‘ও, তাই?’ খুশি হয়েছি মেয়েটির ঘনিষ্ঠ হবার প্রচেষ্টায়। বিজনেস বাড়াতে চায় আর কি? এপ্ টা ডাউনলোড করে নিতে হবে দেখছি।
‘কিন্তু কি করে জীবন ট্রান্সফর্ম করেন আপনারা?’ আমার জিজ্ঞাসাটা খাঁটি ছিল।
‘তার জন্য এপ্ টা ডাউনলোড করে এনুয়াল মেম্বারশিপটা নিতে হবে,স্যর।’
বুড়ো বয়সে এসে এখন আমার কলেজ জীবনের ক্রাশ্ নমিতাই হয়ে পড়েছে একমাত্র সম্বল, বিশেষ করে গৃহিনী মোর যদি চাকুরিসূত্রে আউট-অব্-স্টেশন যান। নমিতা যদিও এখন দুই নাতি-নাতনির দিদিমা পৃথুলা এক মহিলা, তবু এখনও মাঝে মাঝে ওর ডিজাইনার ব্লাউজের কাট-টা দেখার মতো হয়!
কলেজে দর্শনে অনার্স পড়তো নমিতা, পরে পি এচ ডি ফি কত কী সব নাকি করেছে (পোস্টাল কোর্সে কিনা জানিনে), আর ওর গবেষণার বিষয়টা ছিল শিখণ্ডী ! হ্যাঁ, মহাভারতের যুদ্ধে যাকে সামনে দেখে ভীষ্মপিতামহ অস্ত্রত্যাগ করেন, ও শেষে মার্ডার হয়ে যান। নমিতা বলে ভূভারতে শিখণ্ডীকে নিয়ে ডক্টরেট নাকি আর কেউ করে নাই! [সেটা জেনে আমি কী-ই বা করব? ]
কেতার নিউটাউন কফি হাউজে কফি খেতে খেতে নমিতাকে কালকের রাত্তিরের অভিজ্ঞতাটা বললাম।
‘তোর এখন উচিত হবে ওদের এনুয়াল মেম্বারশিপটা নিয়ে ট্রান্সফর্মড্ হয়ে যাওয়া। ভালো কথা, এপ্ -টা ডাউনলোড করেছিস কি?’ বললে সে।
‘কিন্তু কোত্থেকে কিসে ট্রান্সফর্মড না জেনেই….’
‘এই জন্যেই তোর কিছুই হলো না জীবনে। বাপু সনাতন, রিস্ক নিতে শেখ্ জীবনে। নো রিস্ক নো গেইন, মহাকবি শেক্সপীয়র বলে গেছেন।’
‘এটা আবার উনি কবে বললেন? কোথায়?’ শুধাই।
‘আরে উনি না বললে জর্জ বার্নার্ড শ’ বলে থাকবেন। কথাটা তো খাঁটি।….তোর আর বুড়ো বয়সে ভয়টা কী? তিনকাল গিয়ে তো এককালে ঠেকেছে। তোর কি আর রবি ঠাকুরের ইচ্ছাপূরণ গল্পের মতো হবে? লেগে পড়্ ।’
‘বলছিস?’
ওখানে বসেই গুগল প্লে স্টোর হাতড়ানো শুরু করে দিলাম। ইলা চন্দ্রবংশীর কার্ডখানা কোথায় যেন ফেললুম?!
ফ্ল্যাটে একা।
সকালে দেরিতে উঠে ব্যালকনিতে এক মাগ্ কফি বানিয়ে নিয়ে বসেছি, হঠাৎ নিনি-র ফোন!
নিনি?!
স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে অবাক হলাম।
কেন?
নিনি আমার ছোটছেলের এক্স!
আগে খুব হৃদ্যতা ছিল আমার সঙ্গেও, গত ছয় মাসে আর নেই, ছেলে হংকং চলে যাবার পরে।
‘কী গো! তুমিও তো ভুলেই মেরে দিয়েছ দেখছি; ‘গুড মর্নিং’ মেসেজ পাঠাও না তো আজকাল আর আমায় ?!’ বললে সে মেয়ে।
আজকালকার ছেলেমেয়েগুলো এতো স্মার্ট যে পাল্লা দেওয়াই মুশকিল। কী অবলীলায় কথা বলছে আমার সঙ্গে আমার কুড বী বৌমা!
‘পরশু মুম্বাই এয়ারপোর্টে মায়ের সঙ্গে দেখা হলো। তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিলুম।’
নির্ঘাৎ বিষম খেলাম একটা। কফি চলকে পড়ল পাজামায়।
মা?
আগেও বীথি-কে ঐ নামেই ডাকতো নাকি নিনি, ভালো নাম যার দেবস্মিতা?
সামলে নিয়ে বললাম, ‘তা হঠাৎ এই বুড়োকে মনে পড়ল যে বড়?’
‘বুড়ো? তুমি বুড়ো? ওঃ হ্যান্ডসাম!’
‘আর না ভাটিয়ে চট্ করে বলে ফ্যাল্ দিকি কেন ফোন করেছিস?’ শুধাই।
‘আয়াম ইন ক্যাল্ রাইট এট দিস মোমেন্ট, স্যর। ইউনিটের সঙ্গে এসেছি। কালকেই ফিরে যাবো। এ’ছবিটার এডিটিং এর কাজ চলছে এখন, আমার দম ফেলবার সময় নেই।’
‘এখনও বুঝতে পারিনি’। বাকি কফিটুকুতে চুমুক দিয়ে বললাম।
‘ঐরাবত কে?’ নিনি, ওরফে দেবস্মিতা ঘটকের প্রশ্ন।
‘কোন্ ঐরাবত? সেই স্বর্গের হাতি? সমুদ্র মন্থনে যে উঠে এসেছিল, আর ইন্দ্র যাকে কব্জা করে নিজের বাহন বানিয়ে নিলো?’
‘মিঃ মণ্ডল, এইটুকু ইনফো তো গুগল করলেই পাওয়া যায়, সেটা জানতে নিশ্চয়ই তোমায় এই সাত সকালে ফোন করবো না?’ বললে সেই নিনি সুন্দরী।
‘তবে?’
‘বছর দুয়েক আগে তোমার ঘরে একটা বড় পিকটোরিয়াল বই দেখেছিলুম অন ইণ্ডিয়ান মিথোলজী যাতে একটা এন্ট্রি ছিল রাবণের মতো মস্ত মুখ , যিনি কিনা সমগ্র দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় হিজড়াদের উপাস্য দেবতা বলে পূজিত হন। তাঁর নাম ঐরাবত। খুব অবাক হয়েছিলুম জেনে। তোমাদের সঙ্গে আলোচনাও হয়েছিল সেদিন এই নিয়ে।’
‘দিন না, সন্ধ্যে। মনে আছে আমার। টিটোর ছ’-সাত জন বন্ধুবান্ধবীর ডিনারের নেমন্তন্ন ছিল সে রাতে আমাদের বাগবাজারের বাড়িতে।’
‘বেশ। তবে ঐ বইটা নিয়ে আজ ঠিক বেলা এগারোটায় নিউ টাউন কফি হাউজে চলে আসছ তুমি। আমাদের এই ছবিটার কাজে ঐ ছোট্ট ইনফো-টা খুব দরকার। এক্ষুনি।…… গিন্নি তো পরশু ফিরবেন?’ স্মার্ট ভয়েস নিনির।
‘কিন্তু বাছা, নামটা যে ভুল বলছ বলে মনে হচ্ছে। ঐরাবত নয়, কাছাকাছি কিছু হবে একটা । আর, আমাদের বাড়ি-ফ্ল্যাট শিফটিঙের তালেগোলে সে বই এখন হাতে পেলে হয়।’
‘তুমি না, একটা যাচ্ছেতাই।……. ঠিক এগারোটা। মনে রেখো।’ ফোন কেটে দিল নিনি।
‘দু’হাত দোলাতে দোলাতে আসছ দেখেই ঠিক বুঝেছি যে বইটা খুঁজে পাওনি।’
‘ভাবলুম, বইটা এক্ষুনি খুঁজে পাচ্ছি না বলে নিনি-সুন্দরীর সঙ্গে দেখা হওয়াটা মিস্ করা উচিত হবে কি? আমি পঞ্চু-কে লাগিয়ে দিয়ে এসিচি। সে চারটে ট্রাঙ্ক খুলে খুলে বইগুলো শেলফে তুলতে শুরু করেছে। আমরা এক কাপ কফি খেয়ে ফিরতে ফিরতে…..’
‘আলাপ করিয়ে দিই, এ’ হলো প্রদ্যুম্ন। ছবিতে রিসার্চ ইনপুট দেওয়া ওর কাজ। এই নিউ টাউনেই থাকে।’
সঙ্গের ছেলেটি অতি সুদর্শন [আমার ছেলের চেয়েও নয় অবিশ্যি]। একটু মেয়েলী সৌন্দর্য। বাম চিবুকে একটা ছোট্ট তিল। অবাঙালী। ভাঙা ভাঙা বাংলায় বললে, ‘নিনির মুখে আপনার গল্প অনেক শুনেছি…..’
কী শুনেছ?
প্রশ্ন না করেও আমার মুখে প্রশ্ন ।
‘….এই…যেমন ভ্যরিড স্টাডি ইন্টারেস্ট আপনার….অনেক অনেক বিষয়ে পড়াশোনা আছে ….’
‘কিন্তু ঐরাবত বলে কোনো মানুষমুখী দেবতার কথা পড়িনি কোথাও', বললাম, 'বইটা পেয়ে গেলে তো সন্দেহের নিরসনই হয়ে যেত ; তা, এটা কি তোমাদের কোনো ডুকুমেন্টারি ফিল্মের কাজ চলছে এখন?’
‘না, ডকু নয়। ফীচার ফিল্মই বটে। ট্রান্সজেন্ডার নিয়ে। নায়িকা একজন হিজড়া।’
‘তাই? আরে, কালকেই নন্দনে একটা ছবি দেখলাম.....’
বলতে বলতে নিনির মোবাইলে একটা ফোন এসে গেল আর সে ওদিকপানে উঠে গিয়ে খুব উত্তেজিত ভঙ্গিতে কার সঙ্গে যেন কথা বলতে লাগল।
একটু পরে টেবিলে ফিরে এসে খুব তাড়াহুড়োয় বলল, ‘আমাকে এক্ষুনি একটু নিউ আলিপুর যেতে হচ্ছে। প্লিজ কিছু মনে কোর না তোমরা। ইউ ক্যারি অন্। পণ্ড্, তুই আঙ্কলের মোবাইল নম্বরটা রাখ্…..’
ঠিক হলো, বইটা খুঁজে পেলে আমি প্রদ্যুম্নকে জানিয়ে দোব। ও’ কালেক্ট করে নেবে। ও’ তো থাকে কাছাকাছিই।
বিকেল চারটে নাগাদ আমি ইজিচেয়ারে বসেই একটা ভাতঘুম দেবার পরে আমাকে বলে চলে গেল সব বই সাজানো হয়ে গেছে, পাঁচশোটা টাকা যেন ওকে পেটিএম করে দিই।
‘দরজাটা দিয়ে দ্যান্, সার।’ বলে বেরিয়ে গেল।
মনটা আনন্দে ভরে উঠল। একটা বড় কাজ হয়ে গেল। চার চারটে পেটি ভরতি বই শেলফে উঠে এলো---কম কথা নয় এটা। এবার না-হয় সাবজেক্ট-ওয়াইজ গুছিয়ে রাখতে হবে এ’গুলো। সে হবে এখন।
বর্তমান নিনির চাওয়া মিথোলজীর বইটা খুঁজে পেলেই হয়।
সাড়ে ছ’টায় সেই প্রদ্যুম্ন ছেলেটাকে ফোন করলাম---‘পেয়ে গেছি বইটা। এসে নিয়ে যাও।’
‘আমি তো এক্ষুনি একটু বেরোচ্ছি, আঙ্কল। রাত এগারোটা নাগাদ ফিরবো। উইল ইট বি টু লেট?’
না ভাই, অত রাতে আমার অসুবিধা হবে---কাঠ কাঠ জানিয়ে দিলাম ছেলেটাকে। গোড়া থেকেই ইরিটেটিং লাগছিল ওটাকে, ওর যে ঐ মেয়েছেলের মতো চিবুকে তিল…….
----‘তুমি থাকো কদ্দূর হে? ইজ ইট টুউ ফার?’
‘মিত্র-বরুণ এপার্টমেন্ট। একশন এরিয়া…..’
চমকে উঠলাম।
আরে! এ তো আমারই হাউজিং।
‘কোন্ ব্লক তোমার? কোন্ উইং?’
জবাব শুনে অবাক! আমরা একই বিল্ডিঙের বাসিন্দা, একই টাওয়ার; কিন্তু জানতামই না পরস্পরকে।
ফ্ল্যাট বাড়িতে এই রকমই হয়।
বইটি বগলদাবা করে নিজ ফ্ল্যাটে চাবি দিয়ে লিফটে চড়ে বারো তলায় উঠে অবাক হয়ে গেলাম। এ’ তো সেই ইলা চন্দ্রবংশীর ফ্লোর যেখানে গতকালই এসেছি আমি।
বাকি তিনটি ফ্ল্যাটে তালা লাগানো দেখে ঐ ফ্ল্যাটটাতেই বেল দিলাম যেটার গেট খুলে প্রদ্যুম্নলাল বেরিয়ে এলো। মেয়েলী মেয়েলী দেখতে সুন্দর ছেলেটা।
‘আসুন, আসুন, আসতে আজ্ঞা হৌক্ আঙ্কল’ বেশ কেতাদুরস্ত সাধু বাংলায় বললে সে ছোকরা।
ভ্যাবাচাকা অবস্থায় ফ্ল্যাটে ঢুকবো-কি-ঢুকবো না ভাবছি পিছন থেকে এক অতি বৃদ্ধা মহিলা এগিয়ে এসে হাত জোড় করে ‘পধারিয়ে পধারিয়ে’ বলতে বলতে এগিয়ে এলেন।
ডিগডিগে রোগা। পরনে তাঁর সাদা থান। মাথায় শনের মতো সাদা চুল। বয়স সত্তর -আশি যা খুশি হতে পারে। চোখে পুরু প্লাস পাওয়ারের চশমা।
ইনিই ইলার শাশুড়ি, না? কালই তো এঁকে দেখেছি এখানেই।
ইলা কৈ? প্রশ্নটা করলে কি বড়ই এটিকেট-ভাঙা হয়ে যাবে?
আমি থতমত খেতে খেতে মস্ত কফিটেবিল-বইটার ফ্ল্যাগ দেওয়া পৃষ্ঠাটা খুলতে খুলতে বললাম, ‘ঐরাবত নয়, ইরাবত । দক্ষিণ ভারত থেকে সমগ্র দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় পূজিত হন উভলিঙ্গের দেবতা হিসেবে! এই দেখ। এন্ট্রিটা পেয়েছি।’
‘বাঃ! দারুণ! দারুণ, আঙ্কল! এই নামটা নিয়ে আমাদের বহুত ব্রেইন স্টর্মিং হয়ে গেছে…..’
‘কত দিন হলো তোমরা এসেছ এই ফ্ল্যাটে?’ ওর প্রশংসা এড়িয়ে সরাসরি প্রশ্ন করলাম।
‘আসলে, আমরা তো গোড়া থেকেই আছি। এই বিবিস্যাট কোম্পানি যবে থেকে এই মিত্রবরুণ এপার্টমেন্ট-টা বানিয়েছে। ওরা আমাদেরই কাস্টের কিনা।’
‘একাই থাকো নাকি ?’ প্রশ্নটা করে ফেলেই বুঝতে পারলাম, বোকার মতো হয়ে গেল ।
‘একা কেন? আমার মা রয়েছেন, আর ছেলে। পুরু…পুরু…..’
‘পুরু? তোমার ছেলের নাম? সেই আলেকজান্ডারের কালের পরে আর কারোর নাম যে পুরু হতে পারে এই প্রথম শুনলুম’। বলি।
‘আসলে, ওর জন্ম এলাহাবাদে কিনা, তাই ওর মা নাম দিয়েছে পুরুরবা।’
‘ওর মা থাকেন না এখানে?’
‘সে কি? কেন থাকবে না? দাঁড়ান, ডাকছি।’ চেয়ার ছেড়ে উঠে ভিতরে চলে গেল প্রদ্যুম্ন।
আমি ড্রয়িং স্পেসের সোফায় বসে আছি। খোলা জানলা দিয়ে হু হু করে হাওয়া আসছে। টেবিলের উপরে রাখা বড় পিক্টোরিয়াল বইটার পাতা উড়ছে হাওয়ায় । ঘরের ভিতর থেকে ঢাঁই ঢাঁই ঢিস্ ঢিস্ আওয়াজ আসছে। নিশ্চয়ই ঐ পুরু ছেলেটা কম্পুটারে ফাইটিং গেমস খেলছে।
এরপরে যে বেরিয়ে এলো আমার সামনে, যে রূপে….প্রস্তুত ছিলাম না আমি একেবারেই।
ইলা চন্দ্রবংশী!!!
রূপসী তো সে বটেই। কালই তার নমুনা পেয়েছি। আজ অতি হ্রস্ব এক ডিজাইনার লহঙ্গায়….বিশেষত দেহের উপরিভাগে…..!
বাইরে সন্ধ্যা নেমে আসছে। আকাশের রঙ লালে লাল।
মুখ দিয়ে কথা সরলো না আমার আর কোনো! অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম আমি সেই নারীর পানে। আগুনের মতো লাল আজ তার পোশাক!
হঠাৎ দেখি এ’ফ্ল্যাটের দেওয়ালে সিলিং-এ চাঁদ আর তারকার খেলা শুরু হয়ে গেছে।
সেই স্পেশাল ল্যাম্পটা কি কেউ জ্বালিয়ে দিলো?
অ, এটা চন্দ্রবংশীয়দের আবাস কিনা। তাই চাঁদের খেলা চলছে---ভেবে নিলুম।
‘কী ট্রান্সফর্ম করি আমরা---বুঝতে পারলেন কি সেটা?’
ট্রান্সফর্ম করে? কে, কী ট্রান্সফর্ম করে---কিছুই তো বুঝলাম না আমি।
বোকার মতো ঘাড় নাড়ি।
‘আসলে, আপনি তো গ্রুপ মেম্বারশিপটা নেননি এখনও। এপ্ টাই বোধহয় ডাউনলোড করেননি । তাই না ?’ বললে সে নারী।
বোকার মতো ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে তাকিয়ে রইলাম তার মুখের দিকে।
‘বড্ড কঞ্জুষ আছো তুমি আঙ্কল।’ আমার চিবুকে এক ঠোনা মেরে বললে সেই নারী, যার নিজের চিবুকে আছে একটা তিল। বাঁ দিকে।
‘মোর ঘুম ঘোরে এলে মনোহর। নমো নমো নমো নমো……’
আমার মোবাইল ফোনটা বেজে উঠেছে।
কার ফোন এলো?
‘মা….মা….মাম্মি…..’ বলে ভেতর থেকে উচ্চৈঃস্বরে ডেকে উঠল কচি ছেলেটা, নাম নাকি যার ‘পুরু’, ‘পুরুরবা’! উঠে ভিতরদিক পানে চলে গেল সেই আলোকসামান্যা রূপবতী।
একটু পরেই প্রদ্যুম্ন বেরিয়ে এলো ঘরটা থেকে । বললে, ‘আমাদের এবারের এই সিনেমাটার থীম উভলিঙ্গতা ! নায়িকা উভলিঙ্গ। অসাধারণ গল্পটা লিখেছে নিনি, চিত্রনাট্যও ওর। জানেন তো? ’
না, জানি না। কী করে জানবো? নিনির সঙ্গে যে আমার ছেলের ব্রেক-আপ হয়ে গেছে সেটা এই অচেনাটাকে বলি কী করে? আমি তো ভেবেছিলাম প্রদ্যুম্ন নিনির প্রেজেন্ট বয়ফ্রেণ্ড। এখন দেখি এ’ ছেলে তো দিব্যি বিবাহিত, ছেলের বাপও বটে। বেশ।
‘আর, গল্পের টুইস্ট হচ্ছে, নায়িকা (বা, নায়ক) অনায়াসে জেন্ডার চেঞ্জ করতে পারে। গোটা সিনেমা জুড়ে সে এই নারী তো এই পুরুষ।’
‘এ’রকম আবার হতে পারে নাকি?’ আমার প্রশ্ন, ‘হয় নারী থেকে পুরুষ হয়ে যায় নয়তো পুরুষ থেকে নারী। এমনটা তো শুনেছি। ’
‘হয়, হয়, আঙ্কল। আপনি খবর রাখেন না। ’
‘কী খবর রাখবো? আমারও পড়াশুনো কম নেই, হ্যাঁ।’ বেশ তেজের সঙ্গে বললাম।
‘এ’ছবির গল্পটা নিনি লিখেছে দক্ষিণভারতের পটভূমিকায়, ভারতীয় পুরানকে বেস্ করে।’
‘তোমাদের আবার দেরি হয়ে যাবে না তো? কোথাও বেরোবে বলছিলে?’ বলি।
‘প্লুরালে নয়, কাকা। লোক একটাই।’
‘অ। তুমি একা যাবে? গিন্নি যাবেন না? সাজুগুজু দেখে আমি ভাবলুম….’। বুড়োরা স্বাভাবিকই বেশি কথা বলে।
‘হ্যাঁ….বলে নিই আপনাকে। এই ঐরাবতের জন্ম হলো…..’
‘ঐরাবত নহে ভায়া, ইরাবত বা ইরাবান ওর নাম।’
‘হ্যাঁ, ইরাবতের জন্ম হয়েছিল সাপের পেটের মধ্যে!’
‘সাপের পেটে মানুষের জন্ম? বলো কী হে! আসবার আগে বইতে এই আর্টিকেলটা পুরো পড়ে আসা হলো না। বলো তো তুমি, শুনি।’
‘নাগকন্যা উলুপী ছিলেন এই ইরাবানের মা। বাবা মহাবীর অর্জুন। ইরাবান-কে দক্ষিণভারতে অ-রাবণ বলেও ডাকে, জানেন কি সেটা?’
না, জানি না। ঘাড় নাড়লাম।
‘পুরাণে আছে….’
‘কোন্ পুরাণ? পুরাণ তো আঠের-টা’। বলি। [ আমার জ্ঞানের পরিধি কি কম? ]
‘লিঙ্গ পুরাণ’
‘অ’। চেপে গেলাম।
‘লিঙ্গ পুরাণে আছে, বৈবস্বত মনু পুত্রাকাঙ্খায় মিত্রবরুণ যজ্ঞ করেন।’
‘তোমাদের আত্মীয় বিবিস্যাট এই মিত্রবরুণ এপার্টমেন্টটা করেছে ,না?’ ঠোক্ পাড়লাম।
‘শুনুন না,….সেই যজ্ঞ থেকে জন্মালো ইল্। ’
‘ছেলে?’
‘ছেলে বা মেয়ে।’
‘মানে?’
‘যজ্ঞে কিছু ত্রুটি থেকে যাওয়ায় ছেলে না হয়ে….’
‘ইল বা ইলা?!’ এই বুড়োর প্রশ্ন।
‘ছেলে না পেয়ে রুষ্ট বিবস্বান অভিযোগ জানালেন যজ্ঞদেব মিত্র-বরুণকে। পরে তাঁর স্তবস্তুতি করলে তাঁরা বর দিলেন ইচ্ছামতো নারী বা পুরুষের রূপ ধারণ করতে পারবে সে সন্তান। পুরুষরূপে তার শুভনাম হলো গিয়ে সুদ্যুম্ন!’
‘সুদ্যুম্ন আবার কারোর নাম হয় নাকি ? শুনিনি তো? প্রদ্যুম্ন নাম হয় শুনেছি। তোমারই তো নাম প্রদ্যুম্ন, নিনি তোমাকে পণ্ড্ বলে ডাকছিল, শুনেছি।’
‘কিন্তু নিনির সঙ্গে আপনার সুপুত্রের ব্রেক আপটা কেন হয়েছিল সেটা শুনেছেন কি?’
বিষম খেলাম একটা।
এ’ শালা সেটাও জানে? আর আমার সঙ্গে ডিসকাস করতে চায়?
‘নিনি এই ছবির স্টোরিটা নিজ জীবনের উপরে বেস্ করে লিখেছে। নায়িকা, ধরে নিন, নিনি-ই।’
‘বলো কী?! এই যে বললে এই সিনেমাটার নায়িকা একজন ট্রান্সজেন্ডার?’
‘তাই তো বললাম ,কাকু, যে আপনি জানেন-ই না কেন আপনার ছেলের সঙ্গে নিনি-সুন্দরীর ব্রেক-আপ হয়েছিল।’
কালবৈশাখী ঝড় আসে সাধারণত বিকেল-সন্ধ্যের মুখটায়। আজ এলো বেশ পরে। লিফটে চড়ে নয়, সিঁড়ি দিয়ে পায়ে হেঁটে হেঁটে ওদের বারো থেকে আমার সাত তলার ফ্ল্যাটে নামতে নামতেই জানলার ফাঁকে ফাঁকে দূর থেকে আসা ঝড়ের রুদ্ররূপ চোখে পড়ছিল। ফ্ল্যাটে ঢুকে একটি একক-শস্যের-পানীয় বানিয়ে নিয়ে বসেছি যখন টিটোর ফোনটা তখনই এসেছে।
‘তুমি কী করছ, বাবা?’
‘হঠাৎ বাপের খোঁজ করছিস যে বড়?’
‘এখানে প্রচণ্ড ঝড় হলো। ডেড়শ’ মাইলের চেয়েও বেশি উইণ্ডস্পীড। আমার পাশের বাড়িটার একটা অংশ ভেঙে পড়েছে---তৈরি হচ্ছিল সেটা….নাম্বার এইট সিগন্যাল জারি করেছে…’ ছেলের গলায় উৎকণ্ঠা!
‘বলিস কী? তুই ঠিক আছিস তো? হংকঙের খবর তো আমি রোজ ফলো করি। এটা তাহলে মিস্ করে গেছি। ....কলকাতাতেও কালবৈশাখী শুরু হলো একটু আগে….’
‘মা তো মুম্বাইতে। কথা হলো একটু আগে। কাল ফিরবে?’
আরও দুটো এ’কথা-সেকথার পরে বললাম, ‘তোমার বন্ধুনী দেবস্মিতার সঙ্গে দেখা হলো আজ। ফোন করেছিল আমায় সকালে।’
একটু চুপ করে গেল ছেলে আমার।
পরে বলল, ‘নিনি? কেমন আছে সে? এসেছে নাকি এখন কলকাতায়?.....বড় দুঃখী প্রাণ একটা!’
কেন?
সেটা আর জিজ্ঞেস করতে পারলাম না ছেলেকে। এটাও জেনে নিতে পারলাম না প্রদ্যুম্ন বলে উটকো একটা ছেলে কী করে জানল তার আর নিনির ব্রেক আপের কারণ।
ফোনটা রাখার পরে প্লে স্টোর থেকে ইলা চন্দ্রবংশীদের সেই এপ্ টা ডাউনলোড করে দেখছিলাম।
কত কত তথ্য রয়েছে। কত দেশের কত পুরাণ-কথা!
রাঘব রামচন্দ্রের পিতামহের পিতামহ মহারাজ দিলীপ সন্তানহীন হয়ে গত হলে শিবের বরে তাঁর দুই বিধবা রাণী পরস্পরের সঙ্গমে পুত্রলাভ করেন। সমলিঙ্গের , মানে , দুই নারীর ভোগ থেকে উৎপন্ন বলে নাম হয় তার ভগীরথ, যিনি শঙ্খ বাজিয়ে গঙ্গানদীকে ধরাধামে অবতীর্ণা করান, তাই না গঙ্গার অপর নাম ভাগীরথী!
অজ্ঞাতবাসকালের এক বছর অর্জুনের বৃহন্নলা ছদ্মবেশে থাকার কথা তো সবাই জানে, কিন্তু জাপানদেশে যে ‘শুঙ্গা’ নামে এক যৌনচিত্রের দীর্ঘ ধারা ছিল সেটা তো জানতাম না ; সমলিঙ্গের মিলনচিত্রের কত কত চিত্র সেখানে। তিতো বলে এক রাজপুত্র প্রেমে পড়ল নানা বা নানামির। পরে জানতে পারলো নানা আসলে এক বালক! বিয়োগান্তিক কাহিনী!
‘থ্যাঙ্কু ফর ভিজিটিং আওয়ার এপ্। আওয়ার এইম ইজ টু…’ টং করে একটা মেসেজ এসে গেল আমার মোবাইলে। লিখছে সেই সুন্দরী ইলা চন্দ্রবংশী!
সে কী ! সে জানলো কী করে যে আমি লগ ইন করেছি এখনই ? তাহলে সে-ই কি এডমিন?
বুঝলাম, উভলিঙ্গের প্রতি ঘৃণা দূর করাই এই সোসাইটির মুখ্য উদ্দেশ্য।
বাঃ! মহৎ উদ্দেশ্য। সত্যিই তো, কেহ যদি জন্মগতভাবে শারীরিক ভিন্নতা নিয়ে জন্মায় তাতে তার কী দোষ? অন্য অন্য অনেক প্রকার মানুষিক গুণাবলী থাকা সত্ত্বেও কেন তাকে ব্রাত্য হয়ে কাটাতে হবে সারাজীবন?
ট্যাঁ ট্যাঁ ট্যাঁ ট্যাঁ করে হঠাৎ চলে এলো বান্ধবী নমিতার কল।
শুনি, ফোঁস্ ফোঁস্ করে কাঁদছে সে।
‘কী হলো রে? কাঁদছিস কেন?’
‘তরুণ, একটা ছবি দেখলাম ডিজনী-হটস্টারেঃ বয়েজ ডোন্ট ক্রাই । দেখেছিস?’
‘না। কেন?’
….স্তম্ভিত হয়ে গেলাম ওর মুখে ছবিটার গল্প শুনে। দেখতে হবে তো!
পরের দিন কাগজে মিডিয়ায় হৈ হৈ হৈ হৈ!
বন্ধুদের সঙ্গে বাংলা নববর্ষের উৎসবে মাততে চলেছিল এক সুন্দরী তরুণী। পথে তাকে দু’জন যুবক পাকড়াও করে, ও হিজড়া সন্দেহে বিবস্ত্র করে দেখে। অতঃপর বলাৎকার ও নিধন। ছিছিঃক্কার মিডিয়া জুড়ে।
লজ্জায় বিবর্ণ হয়ে যাই! কোন্ সমাজে বাস করছি আমরা?
দুপুরের দিকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনতে বেরিয়েছিলাম।
পরিচিত গেটকীপার বলল, ‘সাব, শুনে হেঁ ন? ওহ্ ম্যাডাম তো এঁহীই রহতী থী। বারা তল্লা মেঁ।’