বাংলা গদ্যবই। রেলগাড়ির মতো। সময়ের স্টেশনে থেমে থেমে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে? কোনও নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই। নেই কারণ, লেখক এই সফরটুকুতেই খুঁজে নিচ্ছেন জীবন, কিংবা স্রেফ কিছু দুপুরের ঘুমের মতো আলসেমি। আর তা-ই ছাপা হচ্ছে অক্ষরে। যেমন ধরা যাক, প্রায়ান্ধকার বাড়িতে আচমকা বল খুঁজতে গেলে একটা বিশাল সময়খণ্ড সঙ্গে নিয়ে ফিরছেন লেখক। স্থানু মানুষের পাশে চলমান জানলায় ফুটে উঠছে না পাওয়া কিসসারা। এ বই-এর লেখাগুলি মূলত ব্যক্তিগত গদ্য হলেও ক্যাম্বিসের গায়ে গায়ে কাদার মতো, এ গদ্যের গায়েও লেগে আছে সময়ের দাগ, সমকালের-সমাজের দাগ। দেশজুড়ে এন আর সি-সি এ এ বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে হাওয়াই চটির উইকেটে লেখা হচ্ছে - ‘ক্ষতও একরকমের কাগজ। উলটেপালটে দেখলে, সেরকমভাবে ছুঁলে সাল-তারিখে ফিরে যাওয়া যায়। শরীর সময় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেখানে রয়েছে উজ্জ্বল-অস্পষ্ট ছবি অজস্র নিত্যনৈমিত্তিক কথার ঘূর্ণি, আপন করে নেয়া বাতিল-জঞ্জাল। অগণন ঢেউ-এর দরজা প্রতি পলে পলে খুলে দিচ্ছে কুয়াশাকম্বল দেশ। কোন ক্ষতের স্পর্শ দিয়ে তুমি কোন দেশে পৌঁছোতে চাও, তা ঠিক করতে হবে তোমাকেই। তোমার ঐ দাগই তোমার পরিচয়পত্র। কেউ তোমার দেশ দেখতে চাইলে তাকে নিয়ে চলো সেই দাগে, ঘুরিয়ে দেখাও। কেউ সন্দেহ করলে, তুমি সে দেশের ‘নাগরিক’ কিনা প্রমাণ চাইলে, দেখিও সেই দাগ। অযথা ইতস্তত কোরো না।’ - এই সপাটে ড্রাইভ আসলে বল হারিয়ে দেয়। গলি ক্রিকেটের ব্যক্তিগত অনুভূতির স্পর্শের ভেতর জেগে ওঠে দেশ। শুধুই কি দেশ? হাওয়াই চটির উইকেট যে সময়ে প্রকাশিত হয়েছে ধারাবাহিকভাবে, সে সময়ে আমরা দেখেছি দেশজোড়া কৃষক আন্দোলন, দেখেছি ভয়াবহ কোভিড মহামারি, দেখেছি জলে ভেসে যাওয়া লাশ। এ সময়ে লেখা হচ্ছে জাদুগদ্য, যার ছত্রে ছত্রে বর্ষাফলকের আঘাত। ‘নিজেকে সেই শেষ বিকেলের স্বদেশে পৌঁছে দিইয়ে দেখছি, এক-দুটো মৃতদেহ গঙ্গা দিয়ে আমাদের দিকেও ভেসে আসছে আজ।’
‘বিজ্ঞাপন, বিরতি’ গদ্যে একটি চমৎকার ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন লেখক, গাভাস্কারের সেঞ্চুরির পর তিনি হাতের তালুটা উল্লম্ব করে রেখেছিলেন চোখের দুপাশে, যেন ঘোড়ার ঠুলি। এই ঠুলি, অর্থাৎ ডান-বা দেখা না যাওয়ার এক চেনা কৌশল গাওস্কর রপ্ত করতে চাইছিলেন। হাওয়াই চটির উইকেট আসলে উইকেটের পিছন থেকে দৃষ্টিকে একেবারে সোজা রেখেছে, তাঁরও দুপাশে রয়েছে কোনও ঠুলি যা গদ্যকে বেঁকতে দিচ্ছে না কোনও প্রলোভনের দিকে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিষয় থেকে বিষয়কে আসতে হবে ক্রিজে, দৃষ্টি ক্রিজ ছেড়ে বাইরে যাবে না। গলির খেলার মাঝেই এসে বল পিটিয়ে যাবে বেপাড়ার ছেলের দল। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের চলে যাওয়া নিয়ে লেখা গদ্যটি সম্ভবত এ বই-এর শ্রেষ্ঠ গদ্য বলে আমার ব্যক্তিগত মত। ‘একলা একজন আম্পায়ার’; ‘আম্পায়ার হলে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত বল গুনতেন না। বরং বলতেন হিসেব করলে তিনি ভাল আম্পায়ার হতে পারবেন না…’- এক বাক্যে যেন ধরা থাকে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সমগ্র সিনেমা ভাবনাকে।
হাওয়াই চটির উইকেট পাওয়ার কথা বলে, না-পাওয়ার কথা বলে- এ যেমন সত্যি, তেমনই এক রেলের কামরায় আলাপ হওয়া মানুষের মতো কত চরিত্র রেখে যায় এ বই- একথাও মনে রাখা জরুরি। বিশ্বদা, সন্তু্, চন্দ্রশেখরের গুগলি গদ্যের খোকনদা, নন্দু আরও কত কে। লেখক একজায়গায় গলি ক্রিকেট প্রসঙ্গে বলছেন - ‘যৎসামান্যের সঙ্গে বন্ধুত্ব, গলি ক্রিকেটের এটাই আত্মোন্নয়নের মন্ত্রগুপ্তি…’; ভেবে দেখলে ভাল লাগে- এ বই-এর প্রোটাগনিস্ট যে হাওয়াই চটি, যা আবার উইকেটও তা ও আদতে এই যৎসামান্যে মানিয়ে নেওয়া গলির উপকরণ। সম্বিত বসুর প্রথম বই গদ্যলেন যেমন গলির বাঁকে ক্রিং মেরে চলে যাওয়া সাইকেলের মতো মসৃণ, এ বই তার বিপরীত, এখানে প্রতি বাঁকে বসে জিরিয়ে নিচ্ছেন লেখক। দু’চোখ ভরে দেখে নিচ্ছেন আবশ্যক উপকরণ ছাড়াও কীভাবে খেলা চলে এখানে। অনাবশ্যক জীবনে এসে লাগছে সময়ের আলো। হাওয়াই চটির উইকেটের উপর দিয়ে এক আধটা রোদ-বৃষ্টির তিরতির করে কেঁপে ওঠা ক্যাম্বিস হাতে এসে পড়ছে আনকোরা কিপারের। বাংলা গদ্যে একটি বই-এর ভেতর দিয়ে বিকেলের গলিতে নেমে আসার সু্যোগ বড় একটা আসে না। পাঠকও আসলে দল ভাগ হওয়ার আগেই এসে পড়েছে গলিতে। তাই গলি ক্রিকেটের শেষ বলের পর, প্রিয় জটলার মতো- এই বই আসলে বন্ধুত্বেরও…