• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | Shakti Chattopadhyay | প্রবন্ধ
    Share
  • শিশুর কাছে পারলে হারে : যশোধরা রায়চৌধুরী



    মৃত্যুর সাতাশ বছর পরেও তিনি তাৎপর্যময়?

    শক্তি কি তাঁর শাক্তদের চেয়েও দীর্ঘ ছায়া রেখে যেতে পারলেন?

    শক্তি কি কেবল আলোচিত হবেন মাতাল হয়ে তিনি কটা গ্লাস হাতের মুঠোয় চুরমার করেছিলেন সেই নিয়ে?

    পরের প্রজন্মের কবিরা শক্তিকে অনুসরণ করে খালাসিটোলায় গেলেন। কিন্তু পারলেন কি তাঁরা শক্তির মত কবিতা লিখতে?

    গত ২৫ ও ২৬ নভেম্বর জুড়ে এইসব প্রশ্নই আমার মনে খেলা করেছে। কারণ আমাদের শক্তি-উদযাপন চলল শুধু জন্মদিনই নয় তার পরের দিনও। কলেজ জীবনে আমরা শক্তির লাইন মুখস্ত বলার যে খেলায় মাততাম, সেই খেলা ফিরে এসেছিল সেদিন বাংলা আকাদেমির মঞ্চে, যখন বিনায়ক মনে করে করে বলার চেষ্টা করছিলেন আর খেই ধরিয়ে বা গুলিয়ে দেবার খেলায় মেতেছিলাম আমরা।

    তারও আগে পরে নানা কাগজে আলোচনা পড়লাম শক্তির কবিতা নিয়ে, পড়লাম জহর সেন মজুমদারের অব্যর্থ কথাটি, যার মূল অভিমুখ এইই যে শক্তির এক হাতে মৃত্যু, শ্মশান, ছাই, অন্য হাতে জন্ম, বালকবয়স, স্মৃতি। পড়লাম নানা লেখকের কলমে শক্তিকে নিয়ে সমালোচনা বা নিন্দা। বা ব্যাজস্তুতি। তাঁর জীবনানন্দ-প্রচ্ছায়া বা মায়াবাদী অবসেশন নিয়ে কথা। ফলে, দুই দিন তিন দিন শক্তির ঘোরে ঢুকে গেলাম। যে ঘোর অনিবার্য।

    কিন্তু কয়েকটি মাত্র বিখ্যাত, বহু চর্চিত, জনপ্রিয় কবিতা, যেমন অবনী বাড়ি আছ, যেতে পারি কিন্তু কেন যাব, একটি পরমাদ ( বহুকালের সাধ ছিল তাই কইতে কথা বাধছিল), বাঘ ( মেঘলা দিনে দুপুরবেলা যেই পড়েছে মনে), এই নিয়েই তো শক্তি নন। সামর্থ্যে ও অবলীলায়, সার্থকতায় ও অনায়াসসাধ্যতায়, এফর্টলেস কসরৎহীন কেরদানিতে শক্তি যে অকল্পনীয়, অতুলনীয়, অসম এক বিশালতায় পৌঁছেছিলেন, তাকে ধরার জন্য তাঁর জনপ্রিয়তাকেই শুধু যদি আমরা স্মৃতিতে আঁকড়ে থাকি তাহলে কী লাভ। তাঁর অনায়াসসাধ্য অটো রাইটিং বা স্বভাবকবিত্বের জন্য তাঁর শেষদিকের কবিতাকে লোকে বলেছে "অনুজ্জ্বল"। অথবা কোন বিখ্যাত মানুষ বলছেন, অভিনীত অপ্রকৃতিস্থতা ছিল তাঁর।

    বাস্তব জীবন আর কবিজীবন গুলিয়ে ফেলে দেখা, এই সব মন্তব্যে। আপত্তিকর সবকটিই, কিন্তু মাঝে মাঝে বুঝি, শক্তির অলৌকিক অতিসক্ষমতা থেকেই এসব ভুলবোঝার জন্ম। আমার কাছে শক্তির লেখা থেকে উঠে আসে এই কথাই, যে, এর পরেও তিনি আমাদের কাছে কেন এত অপরিহার্য৷ তিনি আচ্ছন্ন করেন ঠিকই, কিন্তু অরুণ কুমার সরকারের কথাকে মিথ্যে করে, ভাবানও বটে৷ ভাবান দ্বৈততার অনিবার্য সৌন্দর্য নিয়েই!

    উন্মাদ সন্ন্যাসীর সংগে সংসারীর দ্বৈততা৷ যা আমরা নব্বইয়ের কিছু কবি সেদিনই, অনুষ্ঠানের পরের আড্ডায় আলোচনা করছিলাম। শক্তি জাতে প্রমত্ত হলেও তালে একেবারেই ভ্রান্তিহীন ছিলেন। তিনি বাকি সবকিছুতে ভুলভাল হয়ে কবিতায় একেবারে ঠিকঠাক হতে পারতেন। তাঁর সমস্ত সংসার সমস্ত গোছানেপনা, সব ধনসম্পদ ছিল তাঁর বাক্য তাঁর শব্দ, তাতে তিনি শতাংশের হিসেবে ঢেলেছিলেন, কখনো একশো দশ শতাংশও দিয়েছিলেন, সুদসহ আসলকে রেখে গিয়েছেন জীবনের ভল্টে।

    আজ শক্তির কবিতা উল্টোতে উল্টোতে শুধু খুঁজি না তরুণ বয়সে পড়া সেইসব লেখা, যার ভেতরে আশ্রয় মিলেছিল আমার। শব্দের ব্যবহারে আজো শক্তির দাসত্ব আছে আমার, আমি জানি, অন্য কেউ জানুক না জানুক। খুঁজি নতুন করেও। খুঁজে পাই সব লাইন, পাঠকের যত বয়স বাড়ে ততই যা রূপ খোলতাই করে সামনে এসে দাঁড়ায়। যেমন "কবিতার তুলো ওড়ে" এই কবিতা। ১৯৭৬ সালে "কবিতার তুলো ওড়ে" কাব্যগ্রন্থের কবিতা।

    সেই শক্তিসুলভ খেলাভোলা শিশু আছে এই কবিতায়। সরল সপাট এক রূপক এখানে। কবি = শিশু, জীবন = বালিশ, এবং কবিতা = তুলো। এই ছবির ভেতরে কবি প্রথমে বলছেন কবিতার তুলো ওড়ানোতে শিশুটি সব সমর্পণ করছে তার। স্বপ্ন, পরিশ্রম, অশ্রু, হাসি। তারপর প্রশ্ন তুলছেন, শুধু কি ওড়ে না শিশু? সে 'ছুঁয়ে থাকে মাটির বাস্তব'?

    এরপর উত্তর পাচ্ছেন কবি নিজের ভেতরেই। "কিন্তু তা কী করে হবে... ও যে নখে বালিশ ছিঁড়েছে!"

    আসলে এখানেই তাঁর আত্মসচেতনতা। মাটির বাস্তব ছোয়াঁ, চাকরি করা স্ত্রী পুত্র প্রতিপালন করা কবিই নিজ নখে বালিশ ছেঁড়েন৷ আত্মবিদীরণের কথা। আত্মদীর্ণ কবিতা লেখার প্রক্রিয়া। ব্যাখ্যা করে বলে দিচ্ছেন কবি, এবং তাইই, জাতে প্রমত্ত কবিকে ভেতরে ভেতরে এতটাই আত্মস্থ পাই৷ দৃষ্টি নিমীলিত রেখে নিজের ওপর নিবদ্ধ রাখেন। ফলত, তালে ভ্রান্তিহীন মনে হল আমার। যেমন অনেক পরের আরেক কবিতায়; "শিশুর হাতে খুচরো, শিশু ছড়িয়ে দিচ্ছে সব উঠোনে"। "শিশুটির সন্ন্যাসী জামা/ উদোম গা সন্ন্যাসীর জামা"। সেই শিশুকেও দেখতে পারতে অন্তর্দৃষ্টি চাই। পাশাপাশি দেখা চাই তার ভুলও।

    কবির প্রায় সব কবিতাই "শ্মশান-বাল্যকাল" এই দ্বৈরথে বা দুই মেরুর মধ্যে আঁটিয়ে দিতে পারা যায় এমনই শুধু মনে হয়নি। আরো অনেক দ্বিবিভক্ত মেরু আছে। এক হল কলকাতা বনাম গ্রামবাংলার মেরু। কলকাতাকে ভালবাসার ফল যদি হয় "দুঃখ" কবিতা, যেখানে "রোজ যাকে কাঁদতে হয় সে কি আর দুঃখ পেতে জানে?" র মত পংক্তি আছে, আছে কলকাতার রাস্তায় মধ্যরাত্রে কান পেতে তলদেশ থেকে গোঙানির আওয়াজ শোনার কথা, তাহলে অন্যদিকে পাই অজস্র শব্দে কুয়োতলার কথা বহড়ুর কথা দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার শিকড়বাকলের কথা। গদ্যে যা বিস্তারিত, কবিতায় তা অতর্কিত। সেই গ্রামীণ মহল্লায় নদীতে পাথর পেতে পরীরা পা ঘষেন একলা, সেখানে উড়ে যায় ঝাঁকেঝাঁক টিয়ারা। বলেন পাড়ের কাঁথা, মাটির বাড়ি, নোনা হাওয়া-র কথা। "ফুল দেখলে মায়া জাগে না, কাদা দেখলে বুক আমার ফুটন্ত কেতলির মতন বাষ্পাকুল হয়ে ওঠে।"

    একদিকে শহরের পোত, আশ্রয়। চকচকে তুখোড় শিল্পিত ভাষা। "ইচ্ছা, তাই বলি, নয়তো অভিলাষও বলতে পারতাম" অথবা, "তৃষ্ণা, তাই বলি, নয়তো পিপাসাও বলতে পারতাম"। অন্যদিকে গ্রামীণ মফস্বলি সত্যকথন, যেখানে অনায়াসে বলা যায় "সত্যকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যাই গঙ্গার বাতাসে/ গা জুড়োতে, তারপর কষে মারি দু'গালে থাপ্পড়/ পোঁদের কাপড় তুলে ছেঁকা দিই দু'পাটা মাংসের/ উপরে কল্কের দাগ"।

    এই গ্রাম, এই গ্রামীণতা বহন করতে করতে শক্তি লিখতে পারেন তোমাকে নিয়ে আমি একবার রাসতলায় ঘুরে আসবো ভেবেছিলাম, অথবা, চাঁদ ও মেঘের সম্পর্ক নিয়ে হঠাৎ লিখতে পারেন, "যেন তালি তাপ্পি দেওয়া গরিবের কানি"। লিখতে পারেন, "একটু নেমে দাঁড়াও, যদি আমার কাছে দাঁড়াতে হয়।"

    তিনি কলকাতারও আবার গ্রামবাংলার ও । কিন্তু দুইকে মেলানোর কদর্যতা তাঁর না পসন্দ৷ "গাঁয়ে নাট্য চলে ঘোর, ডায়নামো মণ্ডপে শব্দ করে" এই বাস্তবতা লিখতে গেলে তাঁর ক্লেদ আসে, লেখা হয়, "কলকাতা এড়িয়ে এসে এখানেও কলকাতা পেতেছে/ শহর উচ্ছিষ্ট ভদ্র, হাঁড়ি সরা সসপ্যান পাঁউরুটি"।

    তেমনই আরেক দ্বিচারিতা তাঁর সমাজ সম্পর্কিত নির্মোহ বিচার ও চূড়ান্ত প্রতিবাদস্পৃহায়। বার বার আসে প্রতিষ্ঠান ভাঙার কথা, নিজেকে কুঠার করে তোলার কথা। শক্তি নিন্দিত হয়েছিলেন যথেষ্ট প্রতিবাদী সমাজ সচেতন না হবার জন্য। "প্রতিক্রিয়াশীল" কথাটি খুব চলত সেই সত্তর দশকে। যখন লিখেছিলেন, "মানুষের সঙ্গে আর মেলামেশা সঙ্গত নয় -/ মনে হয় , এর চেয়ে কুকুরের শ্লেষ্মাও মধুর।" অথচ এর চেয়ে বড় কশাঘাত কোথায় আছে, যখন লেখেন, "সত্য নয় শিশু, নয় রাজনীতি", বা, "চারিদিকে ঘুম আর অন্ধকার কাকশকুনের মতো বসে, ঘির আছে"। ঋত্বিক ঘটকের মৃত্যুতে যিনি লেখেন, "নিশ্চিন্ত এখন/উপদ্রুত বাংলাদেশ, আর কেউ নেই যে কড়কাবে/বিদ্যুচ্চাবুকে এই মধ্যবিত্তি সম্পদ, সন্তোষ /মানুষে। তুমি গেছো, স্পর্ধা গেছে, বিনয় এসেছে /"

    যেকালে লিখেছিলেন "মুন্ডহীন ধড়গুলি আহ্লাদে চিৎকার করে" - এক আমূল অকবিতায় আমরা পাঠক কেঁপে উঠেছিলাম এই লাইন পড়ে। তখনো জানিনা, বেলা অবেলা কালবেলার জীবনানন্দের মত এই পর্বের কবিতাও পাল্টে যেতে বাধ্য।

    মায়ায় তিনি নানা দ্বৈততার দ্বৈরথকে মানিয়ে গুছিয়ে থাকেন। সাঁকো বাঁধেন দুই প্রান্তের মধ্যে। মধ্যে নদীর চর জেগেছে, মধ্যিখানে সাঁকো - থাকো,/ একটি চরে কেন? দু-চর জুড়েই থাকো।

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments