জাসুস হরফন মির্জা তোবা তোবা বলতে বলতে ফেরারী শেঠের মহল থেকে বেরোচ্ছিল। আধ ঘন্টা ধরে ফেরারী তার সমস্ত প্রশ্নের শুধু একটাই কাজের উত্তর দিয়েছে। মোহর-ভর্তি রেশমের থলে। সেটাকে আচকানের জেবে ঢুকিয়ে হরফন ভাবছিল ফেরারী শেঠের মতো আর কিছু মক্কেল জুটলে পঁচিশ বছর বয়সেই তার মাথার চুলগুলো পেকে যাবে।
ফেরারী এসেছিল দূরের কোনো মুলুক থেকে। দুই দুনিয়ায় আপন বলে কেউ নেই। ঘর থেকে ফেরার, বলত সবাই। স্বাভাবিক চিন্তার জগৎ থেকেও ফেরার, ভেবেছিল হরফন। কারণ ছোকরা বয়সের হলেও, বাদশার মতো রঈস মানুষটার কী দুরন্ত জেদ! একটা হারানো চটি খুঁজে বার করা চাই। এই হল তার দাবি। অথচ সেটাকে খোঁজার জন্য কোনো রকম সাহায্য করতে সে নারাজ। কীরকম চটি? কোথায় বানানো? কোথা থেকে এল শেঠের কাছে? কোথায় গেল? এসব প্রশ্নের উত্তরে ফেরারী শুধু স্মিত হাসি উপহার দিয়েছিল। হরফন প্রথমে ভেবেছিল শেঠ কানে কম শোনে, তাই সে একটা আলিগড়ী কাগজ আর কলম চেয়ে নিয়ে তার প্রশ্নটা লিখে পেশ করে।
দেখা গেল শেঠ পড়তেই জানে না। কিন্তু ব্যবসার বুদ্ধিতে প্রখর। কাগজটা হাতে নিয়ে বলল – পান খান মির্জা। সব সওয়ালের কি জবাব হয়? একটা এমন কিছু জিজ্ঞেস করুন যার জবাব আজ দিতে পারি। তাহলে আমার কান আর দিমাগ দুই-ই খুলে যাবে।
- চটিটা দেখতে কেমন?
- খুব সাধারণ। ময়লার যা রং হয় সেই রং। দুপুরে ধুলোর মতো, রাতে কালির মতো। মেয়েরও হতে পারে, আদমীরও হতে পারে। মাঝারি আকারের। সরুও না, মোটাও না। চামড়ার পট্টি লাগানো। বাঁ-দিকের বুড়ো আঙুলের কাছে পট্টিটা একটু ছেঁড়া। গড় গড় করে বেরিয়ে এল বেশ কিছু তথ্য এবার।
- এটা আপনি অনেক দিন ব্যবহার করেছেন তার মানে। শেষ কবে দেখেছেন বস্তুটাকে?
- বিলকুল না জনাব। আমার কাছে ছিল মাত্র এক বেলা। গোটা দিনটাও নয়। শেষ দেখেছি তিন বছর আগে। যখন আমি এই শহরে প্রথম আসি। মোট কথা এটাকে আমি ফেরত চাই। আবার মাত্র এক বেলার জন্য যদি পাই তাও সই।
এইভাবে দিনটা শুরু হরফনের।
হরফন শহরের মুচিদের কাছে গেল আগে। প্রত্যেকের কাছে চার পাঁচটা করে চপ্পল পাওয়া যাচ্ছে যা ফেরারী শেঠের বর্ণনার সঙ্গে মিলে যায়। তবে বাঁ-দিকের বুড়ো আঙুলের পট্টি কারো ছেঁড়া বা সেলাই করা নয়। চটিটা কোথায় ছেঁড়া হওয়া চাই সেটা হরফন কাউকে বলতে পারছিল না। কারণ মুচিরা মহা সেয়ানা। যে কোনো একটা চপ্পল ঠিক সেই জায়গায় ছিঁড়ে নিয়ে চলে আসবে হরফনের কাছে চড়া দামে বিক্রী করার আশায়।
কয়েক দিন ধরে সারা বাজার চষে বেড়াবার পর হরফন বুঝল এই শহরে এরকম চটি অন্তত কয়েক হাজার আছে। শস্তা, টেঁকসই, আর আরামদায়ক। কেন লোকেরা পরবে না? তিন দিনের দিন হরফন নিজের জন্যই একটা কিনে ফেলেছিল প্রায়। এই অচিন শহরের সঙ্গে বেশি জড়িয়ে পড়া উচিত হবে না বলে আটকায়।
বেলা গিয়ে সন্ধ্যে। সন্ধ্যে গিয়ে রাত। যেখানেই যায় হরফন, তার নজর মানুষের পায়ের দিকে। ঠেলাওয়ালা, নাপিত, হাকিম, আদালতের মুহুরি, পর্দানশীন বেগম, বেপর্দা খানাবদোশের মেয়ে, মাদ্রাসার আলিম, কাউকে ছাড়তে পারছে না সে। চটিটা যেকোনো পায়ে থাকতে পারে। শুধু নতুন চটির দোকানে খুঁজতে যাওয়া বৃথা। তিন বছর আগেই যে চটি নতুন ছিল না, আজ তার বয়স কত? একটা সামান্য চটির আয়ুই বা কতদিন? হরফনের বড়ো ভয়টা হল এই যে সেটা বহুদিন আগেই রদ্দির সাথে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
এইভাবে দুটো সপ্তাহ কেটে গিয়েছিল। অন্বেষণ এক পাও এগোয়নি। হরফন ফেরারী শেঠের কাছে ফিরে যায় মোহরের থলিটা সঙ্গে নিয়ে। - এটা আপনি রাখুন শেঠজী। সে চটি আর পৃথিবীতে নেই। এতদিনে সেটাকে ইঁদুরে কি ছাগলে কেটেছে।
ফেরারী শেঠ নিজেকে বলে অনাথ। কচি কচি দাড়ি। বয়স অতি অল্প। হরফনের চেয়ে ছোটই হবে। এত কম বয়সে এরকম রঈস হতে গেলে কতটা মাথা লাগে? সেই বৃদ্ধ বালক গদী থেকে নেমে এসে হরফনের দুটো হাত জড়িয়ে ধরে বলল – মোহর ফেরত দেবেন না মির্জা। যেদিন ইচ্ছে কাজে ইস্তফা দিতে পারেন। আমি কিচ্ছু মনে করব না। মোহরের কী মূল্য? আজ আছে কাল নেই।
হরফন মনে মনে বলল – মূল্য আছে তো রদ্দি চটির। মুখে সে বলল – জাসুসরা হারানো মানুষ খুঁজে বার করে। তার একটা তরীকা আছে। একটা আদব আছে। হারানো চটি খোঁজার কোনো নুস্খা নেই।
ফেরারী শেঠ বলল – আচ্ছা এটা যদি হারানো মানুষ হত তাহলে আপনি কোথায় খুঁজতে যেতেন?
- সরাইখানা আর শুঁড়িখানাগুলো দিয়ে শুরু করতাম জনাব।
- দয়া করে সেখান থেকেই আবার একটা চেষ্টা করে দেখুন মির্জা সাহিব।
হরফন আর কী করে? ফেরারী শেঠের সনির্বন্ধতা দেখে তার মায়া হচ্ছে। মোহরগুলো যখন রাখতেই হবে তখন একটা চেষ্টা তো করা উচিত। শুঁড়িখানাগুলোতে টহল দিয়ে এল সে। এমন তো নয় শেঠজী নিজেই এখানে এসে চটিটা ফেলে গেছেন? কিন্তু তাহলে সেটা সোজাসুজি হরফনকে বলতে আপত্তি কীসের?
এখানে কোনো অল্প বয়সের সাহিবজাদা এসে একটা সাধারণ চটি কি কখনো ফেলে গেছেন? এই প্রশ্নের উত্তরে সবাই বলল – শুধু চটি? লোকেরা নিজেদের কোলের বাচ্চা ভুলে ফেলে গেছে হুজুর, বুড়ো বাপকে মদ খাওয়ার পর চিনতে না পেরে আমাদের গছিয়ে দিয়েছে, এমনকি গালের চাপদাড়িটা পর্যন্ত...। দেখুন মির্জা, আমাদের নিয়ম হল, যে যাই ফেলে যাক, সাত দিন সামনের গাছতলায় জমা রাখি। তারপর জমাদার ঝাড়ু মেরে সরিয়ে দেয়।
শুঁড়িখানার শলা হজম করে হরফন সরাইখানাগুলো ধরল। শহরে বারো চৌদ্দটা তো আছেই। খুঁজতে খুঁজতে দিন কাবার। পড়ন্ত বিকেলে শহরের পশ্চিম প্রান্তে একটা আর্মানী মুসাফিরখানায় ঢুকে সে বুঝতে পারে আর এক পা হাঁটার ক্ষমতা নেই তার। রাতের মতো মাথা গোঁজার একটা জায়গা চাইতে ঘরও জুটে গেল একখানা। সেটা পাওয়ার পর বিকেল বিকেল দুটো রুটি খেয়ে নিয়ে লম্বা ঘুম দেওয়ার আশায় হরফন সবার আগে চলে এসেছিল রসোইঘরে। কিস্মত-সে সেদিন সেখানে সরাইখানার মালিক বুড়ো জাকারিয়া তার কুলচা আর লস্যি নিয়ে উপস্থিত। হরফন অভ্যাসবশত চটির প্রসঙ্গটা তুলে ফেলে লক্ষ্য করল, বুড়ো জাকারিয়া নিজেও একটা প্রাচীন চপ্পল পরে পা নাড়াচ্ছে। শুধু তাই নয়, তার দু পায়েরই বুড়ো আঙুলের ফিতে নতুন করে বাঁধানো।
- চটি নয়। অন্য কিছু খুঁজছে সে। জাকারিয়া কুলচার টুকরো ধীরে সুস্থে গেলার পর এই নতুন সম্ভাবনাটা ঢোকাল হরফনের মাথায়।
- অন্য কিছু খুঁজছে? হরফন একটু থতমত খেয়ে বলল – সেটা কী?
- রাত হোক। কাছে পিঠে থেকো। তোমাকে একটা জিনিস দেখিয়ে আনব।
তারপর আর ভয়ের চোটে ঘুমোতে পারেনি হরফন, পাছে বুড়ো জাকারিয়া তাকে ফাঁকি দিয়ে কোথাও সরে পড়ে। রসোইঘরের কাছাকাছি সে একটা জায়গা খুঁজে নিয়ে গালচেতে বসে পড়েছিল। সরাইখানাটা শহরের নিরিবিলি প্রান্তে বলে এতক্ষণ জানত হরফন জাসুস। যতই সন্ধ্যে হচ্ছে, ততই সে বিশ্বাস ভাঙতে লাগল তার। কখনো চারটে, কখনো ছটা করে মানুষ ঢুকে পড়ছে রাস্তা দিয়ে। কেউ ঠান্ডা শরবতের জন্য। কেউ দুটো রুটি নিয়ে বসে গেছে কিছু ঘটার অপেক্ষায়। সরাইখানা ক্রমশ ব্যস্ত হয়ে পড়ছিল।
জাকারিয়া চট করে একবার ঘুরে গেল। - দেখছ জাসুস কী হচ্ছে?
হরফন অবাক হয়ে ভাবল বুড়ো তার পেশা কী সেটা জানল কী করে? জাসুসের উপর জাসুসী করছে নাকি? জাকারিয়াকে সে জিজ্ঞেস করল – এত লোক রোজ হয় এখানে?
- শহরে নতুন না হলে এই প্রশ্নটা করতে না। বছরে একটা সপ্তাহ মাত্র। এই বসন্তের দিনে। পূর্ণিমার ঠিক আগে।
- কী হয় বলুন তো এই সপ্তাহে?
- হামামগুলো খোলে।
- বছরের বাকি দিনগুলোতে হামাম বন্ধ থাকে নাকি?
- এই হামামগুলো খাস, হরফন মিঁঞা। এতে জল নেই। শুধু কাদা। দেশ বিদেশ থেকে ছেলে ছোকরারা এখানকার কাদা মাখতে আসে।
- কাদা? হরফন তাজ্জব হয়ে জিজ্ঞেস করল। - কী গুণ এই কাদার জনাব যে দেশ বিদেশ থেকে ছেলেরা চলে আসে তার জন্য?
- ফুটন্ত কাদা। মাটির ভিতর থেকে ফোয়ারার মতো বেরোয়। এই কাদাটা যে মাখে তার সাতটা আগের আর সাতটা পরের জওয়ানী-কা-গুনাহ মাফ হয়ে যায়। কিন্তু কাজটা সহজ নয়। জানের খতরা আছে। যারা হামামে নাহাতে এসেছে তাদের অনেকেই বেঁচে ফিরবে না।
- জওয়ানী-কা-গুনাহ কথাটার মানে কী মালিক? সেটাও একটু বুঝিয়ে বলুন।
- যে এই গুনাহ করে সে জানে। যে জানে না, তাকে বুঝিয়ে লাভ নেই। বলে বুড়ো জাকারিয়া হ্যা হ্যা করে হাসতে লাগল যেন সারাজীবন ধরে পাপ করেও তার কোনো অনুশোচনা নেই।
আকাশে নিভন্ত উনুনের মতো আলো থাকলেও আধখানা বেপরোয়া চাঁদ চলে এসেছিল মজা দেখবে বলে। বুড়ো জাকারিয়া হরফনকে নিয়ে গিয়েছিল শহরের বাইরে ভাঙা তোপের মতো ফেলে রাখা টিলাগুলোর মাঝখানে একটা ওয়াদি, অর্থাৎ উপত্যকার মতো সমান জায়গায়। ওয়াদির মাটি থেকে নাকি বেরিয়ে আসে আগুন আর আগুনের চেয়েও গরম জল। একদিকে জমিটা নিচু হয়ে গিয়েছে। বর্ষায় সেখান দিয়ে একটা পাহাড়ি নদী নির্গত হয়। এখন মাটির সেই ফাটলগুলো থেকে বেরোয় কাদা আর ছাই। বসন্তে যে দু-এক বার বৃষ্টি হয় তাই থেকে জন্ম নেয় সেটা।
হরফন দেখল উপত্যকার ভিতরে একের পর এক একুশটা ছাদ খোলা হামাম বানানো আছে। এক-একটা হামামের ভিতরে এক-একটা কুণ্ড। কাদায় ভর্তি। প্রত্যেকটা কুণ্ড তার আগেরটার চেয়ে গভীর আর গরম। শেষেরগুলো তো ফুটছে। জাকারিয়া হরফনকে টেনে নিয়ে গিয়ে বসাল একটা টিলার উপর। আকাশে তখনো পোড়া তামাক ছড়িয়ে রেখেছিল যত রাজ্যের বুড়ো গুনাহ্গাররা। সেই উচ্চতা থেকে দেখা যাচ্ছিল ইঁদুরের মতো একুশটা দারোয়ান হলুদ আর লাল রঙের একুশটা লন্ঠন জ্বালিয়ে তাদের হামামের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছে মানুষের।
কিন্তু সে মানুষগুলো কোথায়?
- সারাদিন ধরে শ’য়ে শ’য়ে ছোকরা এসে আশপাশের মুসাফিরখানা আর বাড়িগুলোতে সেঁধিয়েছে। বলল সরাইখানার মালিক। - মুখ দেখতে পাবে না কারো। অন্ধকারে গা ঢেকে ধুলো আর কাদা মাখা গায়ে বেরিয়ে আসে তারা। বসে থাকে টিলার পূর্বদিকের পিঠ জুড়ে। যেখান থেকে উপত্যকায় ঢুকতে হয়।
হরফন চোখ কুঁচকে দেখার চেষ্টা করল। পাহাড়ের সেই অংশটা অন্ধকারের চাদর মুড়ি দিয়ে আছে। একটা অদ্ভুত বিষন্নতা নীরব আকাশের টুঁটি চেপে ধরেছিল।
- কান খোলা রাখো। ঢোল বাজার আওয়াজ শুনবে। তার মানে হামামগুলোর দরজা খুলল। যতক্ষণ খোলা থাকে বাজার, সেই বাজনাটাও চলবে।
- ফুটন্ত কাদার তালাবে নেমে কি মানুষ বেঁচে থাকতে পারে? জিজ্ঞেস করল হরফন।
- অর্ধেক পারে না। কিন্তু যারা বেঁচে যায় তাদের ভবিষ্যতেও সাত-সাতটা জওয়ানীর গুনাহ মাফ। কোনো অপরাধের আশঙ্কা না করে খুল্লমখুল্লা শরীফ লোকের বলার অযোগ্য মজাগুলো লুটে নেওয়ার সুখ কি কম? কিছু পেতে গেলে কিছু বাজিতে লাগাতেই হয় মিঁঞা। তোমার তো বয়স আছে এখনো। কাল একবার দেখবে নাকি জাহান্নুমের একুশটা তালাব পেরোতে পারো কিনা?
হরফন বলল – জনাব আমি সাতটা গুনাহ মাফ করাতে আসিনি। একটামাত্র চটি খুঁজতে এসেছিলাম। সেটা কি আপনি ভুলে যাচ্ছেন?
- ও, হ্যাঁ চটি! হামামের বাইরে ডাঁই করে কী রাখা আছে সেটা দেখতে পাচ্ছ তো? কয়লা নয়। পৃথিবীতে আর কোথাও একসঙ্গে এত চটি হারায় না। এগুলো তো আগের হারানো পাটিগুলো। আজ যোগ হবে আরো কিছু। সব এক রকম দেখতে সেটা লক্ষ্য করে দেখো।
- ঠিক যেরকমটা আপনি পরে আছেন।
- বিলকুল ঠিক! শহরের খাস উৎপাদ হল এই চপ্পল। কুণ্ডের কাছে পাথরের চাঁইগুলো আগুনের চেয়েও গরম হয়ে যায়। ফুটন্ত কাদা আর গনগনে পাথরের উপর দিয়ে দৌড়োবার জন্য এর চেয়ে টেঁকসই আর শস্তা কোনো জিনিস হয় না।
ডাম-ডুম-ডাম-ডুম করে বাজনার শব্দ শুরু হয়েছে। হঠাৎ পাহাড়ের একটা দিক জ্যান্ত হয়ে উঠে ধসের মতো নামতে লেগেছিল। কাতারে কাতারে জিন আর ভূত নেমে আসছে যেন আসমান থেকে।
হরফন বলল – এগুলো কি মানুষ?
- মানুষই তো। সারা গায়ে ধুলো মেখে বসেছিল এতক্ষণ। তাই দেখতে পাওনি।
গায়ের আলখাল্লা ফেলে দিয়ে মূর্তিগুলো ছুটছে। কে আগে প্রথম হামামটাতে ঢুকতে পারে। পিঁপড়ের মতো যে যেখান দিয়ে পারে ঢুকতে শুরু করল। এক-একটা কুণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেটাকে আড়াআড়ি পার হতে গিয়ে ডুবে যাচ্ছে কেউ। বাকিরা কাদা ভেঙে চলেছে অন্য পাড়ে। একদিক থেকে যতজন উঠছে অন্যদিক থেকে তারও বেশি নেমে পড়ছে তালাবের ভিতর।
প্রথম হামাম থেকে বেরিয়ে একদল এবার দৌড়োল দ্বিতীয়টার দিকে।
বুড়ো জাকারিয়া বলল – মিঁঞা লক্ষ্য করো। বেশিরভাগ চটি খুলে নেমেছিল তালাবে। তারপর বেরিয়ে এসে যে যেটা পারে পায়ে গলিয়ে নিয়ে পরেরটার দিকে ছুটেছে। কতবার যে চটিগুলো পা বদল হবে তার ইয়ত্তা নেই। কেউ কেউ চটি শুদ্ধুও ঢুকে যাবে কুণ্ডে। ভাগ্য যদি মন্দ হয় চটি সমেতই সিদ্ধ হবে ফুটন্ত কড়াইতে।
দেখতে দেখতে বাঁ-দিক থেকে ছেলেদের দল সব কটা হামাম দখল করতে শুরু করেছিল। এক-দুই করে দশ-পনেরো অবধি সব ভর্তি। তারপর আঠেরো-কুড়ি। একুশতম তালাব থেকেও তপ্ত লোহার মতো দেহ নিয়ে কয়েকজন উঠতে পারছে দেখা গেল। সব গুনাহ গোল করার পর এক টুকরো কাঠকয়লার মতো জ্বলতে জ্বলতে যে নদীটাতে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ছিল সেটা এই মাটি আর মানুষের ধ্বংসের অবশেষ দিয়ে তৈরি।
হরফনদের চোখের সামনে অগুনতি অল্পবয়সী যুবকদের ভিড় কমতে শুরু করে। জাসুসের মনে হল অর্ধেককে সে ধোঁয়া হয়ে উড়ে যেতে দেখছে। বাকি অর্ধেক ছাই হয়ে তাদের পাগলামির স্রোতে ভেসে যাচ্ছিল। কজন যে শেষ পর্যন্ত বাঁচবে তার ঠাহর পেল না হরফন।
- আমি এখান থেকে একটা চটি তুলতে পারি? হরফন জিজ্ঞেস করেছিল।
- যে কেউ নিতে পারে। পরবার ইচ্ছে হয়েছে নাকি?
- হ্যাঁ।
- নিচে যেতে হলে আমার চটিটা পরে যাও। তোমার দামি জুতো ওই গরম পাথরে পড়লে নষ্ট হয়ে যাবে।
- চিন্তা নেই, এটা আমি নিজেই সারাতে পারি। আপনি ঘুমোতে যান জাকারিয়া সাহিব। আমি এখানে একটু থাকব।
- এই ভয়ই করেছিলাম। কিন্তু উপায় কী? বিষন্ন হেসে বিড়বিড় করে বলে বুড়ো জাকারিয়া। - সাবধানে থেকো জাসুস। রাতের প্রথম দিকটা আমার ঘুম আসে না। পুরোনো জিনগুলো বড্ড জ্বালায়।
তারপর জাকারিয়া নিজের মনে হাসতে হাসতে চলে গিয়েছিল।
হরফন একুশটা হামামের সামনে দিয়ে একবার হেঁটে এল। কানফাটা কোলাহল এখানে। মাটির নিচ থেকে আগুন আর জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে মিশেছে শত শত উন্মত্ত তরুণের গলা ফাটানো উল্লাসধ্বনি। হরফন সযত্নে তাদের ধাক্কা এড়িয়ে চটির স্তূপগুলো পরীক্ষা করে দেখতে থাকে। কুণ্ড থেকে ফিরে আসা বদকিস্মত চপ্পলের জোড়াগুলো বাষ্পে সিদ্ধ পালং শাকের মতো নরম হয়ে গেছে।
হাজার হাজার চপ্পলের মধ্যে নাছোড়বান্দা হরফন বাঁ-পায়ের পট্টি ছেঁড়া পুরোনো একটা পাটি খুঁজে বার করেই ছাড়ল।
অনেক রাতে হরফন ফিরে এসেছিল মুসাফিরখানায়। ফেরারী শেঠের কাছ থেকে পাওয়া দুটো মোহর সে জাকারিয়াকে দিয়েছিল কৃতজ্ঞতার নিদর্শন হিসেবে। জাকারিয়া তার একখানা ফেরত দিয়ে বলল – বরং পারলে আমাকে একটা খবর দিয়ে যেও। এই চপ্পলটা পেয়ে তোমার মক্কেল কী বলে সেটা আমি জানতে উৎসুক।
- আপনার মনে হয় তিনি চপ্পল খুঁজছেন না?
- চপ্পলটা তো বাহানা মির্জা সাহিব। আসলে সবাই খোঁজে অন্য কিছু।
- সেটা কী মেহের আলী?
- জওয়ানীর না করা জুর্মগুলো।
পরের দিন ফেরারী শেঠের বাড়ি গিয়ে হরফন শুনল শেঠ তার নিজস্ব হামামে আরাম করছে। হরফনকে সেখানেই পাঠিয়ে দেয় ভৃত্যরা।
গোলাপ বাগানের মাঝখানে আগাগোড়া শ্বেতপাথরের তৈরি সেই ঘরে একটা প্রমাণ আকারের চৌবাচ্চা থেকে গরম জলের ধোঁয়া উঠছিল। হরফন গিয়ে দেখল ফুলের পাপড়ি ভেজানো জলের ভিতর ডুবে গেছে ফেরারী। হরফন চৌবাচ্চার পাশে বসে পড়ে।
একটু পরে নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য মাথা তুলেছিল বাচ্চা শেঠ।
- ফুলের খুশবু আমি ভীষণ ভালোবাসি। হরফনকে দেখে বলল তার তরুণ মক্কেল। - আপনি যেমন ভালোবাসেন রহস্যের গন্ধ। কিছু পেলেন জাসুস?
হরফন জেব থেকে পুরোনো চটিজোড়া বার করে। বাঁ পায়ের ছেঁড়া পট্টি থেকে চামড়ার একটা ফালি দাঁত বের করে হাসছিল।
- এটাই সেটা বুঝলেন কী করে? চামেলির বালিশে মাথা রেখে জিজ্ঞেস করল ফেরারী। গোলাপের পাপড়ির নিচে তার শরীরের পুরোটাই লুকিয়ে রেখেছিল সে। মাথা আর পায়ের আঙুলগুলো ছাড়া।
- আমি বুঝব কী করে শেঠজী? আপনাকে দেখাতে নিয়ে এলাম তো সেইজন্য।
- কোথায় ছিল?
- পনেরোটা পেরিয়ে ষোলোতম কুণ্ডের বাইরে। কালকেও কেউ পরেনি। পরবে কেন? ছেঁড়া শুধু নয়। বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলে বেশ ব্যথা লাগে পরতে গেলে।
ফেরারী হরফনের চোখের দিকে তাকিয়ে ম্লান একটা হাসি হাসছিল কথাটা শুনে।
- ষোলোটার বেশি আমি যেতে পারিনি। পরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল পাপড়ির জলে ভেজা বাচ্চা শেঠ। - আমাকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়।
- কেন, ফেরারী শেঠ? আপনার তো মনের জোর কম ছিল না।
- পায়ের বুড়ো আঙুল কেটে রক্ত পড়ছিল যে। সাতটা আগে আর পিছের গুনাহ মাফ করিয়ে দেয় যে হামামবাড়া তার নিয়ম হল এই যে রক্তের গুনাহ নিয়ে তাতে ঢোকা যাবে না। যা হোক সেখানকার খবর জানার জন্য আমি সকাল থেকে বসে আছি জাসুস! আর কী দেখলেন? আমার মতো বোকা ছেলে ছাড়াও আর কেউ ছিল কি?
- শেঠজী আমি উপত্যকা থেকে বেরিয়ে একটা মাঠে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। নদীটা যেখান দিয়ে বয়ে যায়। যত রাজ্যের শকুন এসে জমা হচ্ছিল সেখানে।
- আরেকটু এগিয়ে যাননি তারপর?
- জী হাঁ, জনাব। এতদূর এসেই পড়েছি যখন, ভাবলাম জায়গাটা ভালো করে চিনে নিই। আর একটু এগিয়ে একটা ঠান্ডা কালো তালাব পেয়েছিলাম। যার বুকে চাঁদ দেখা যায়। ওপ্রান্তে একটা নির্জন সাদা বাড়ি সেই তালাবের উপর ঝুঁকেছে। জলের ধার থেকে আমাকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছিল তারা।
- কারা?
- ধুলোর পুতুলরা। তারা আমাকে বাড়িটাতে নিয়ে গেল। আশ্চর্য, সেখানে ঠিক এরকম একটা শ্বেতপাথরের চৌবাচ্চা ভর্তি পাপড়ির জল। ছোট্ট রুপোর ছুরি হাতে নিয়ে তারা বলল সেখানে নামতে চাইলে সামান্য একটু ব্যথার মূল্য দিতে হয়। সেটা আমি সহ্য করতে পারব কি? আমি রাজি হলাম না।
হরফন থামতে বাধ্য হয় কারণ, কী মুশকিল, তার নিরহঙ্কার মক্কেলের চোখ দুটোতে শিশিরের ফোঁটা টলমল করছে। তার মানে এবার জাসুসের শোনার পালা। যা করতে গেলে ধৈর্য লাগে। ফেরারী জলের তলায় একটা ডুব দিয়েছিল আবার।
পরে তার তরুণ মক্কেল যখন মাথা তুলল, হরফন অপেক্ষা করতে করতে ভাবছিল জলের রংটা পালটাচ্ছে কি। ফেরারী অন্য দিকে তাকিয়ে বলে – একটা গল্প শোনো জাসুস। ধুলোর পুতুলরা আমার হাত ধরে কানের কাছে কী বলেছিল জানো? বলেছিল তাদের সেই সাদা বাড়ির হামামে কাটা-ছেঁড়া অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়েই নামতে পারি আমি। তাতে নাকি কোনো দোষ হয় না। কত যে রক্ত বেরিয়েছিল সেই গরম চৌবাচ্চার জলে! এতখানি যে জলের রং হয়ে গিয়েছিল গোলাপি। তখন ওরা হাসতে হাসতে কোথা থেকে ধুলোর হার আর চুড়ি নিয়ে আসে। মাটির পুঁতি দিয়ে তৈরি মালা।
- পুঁতির মালা? কেন শেঠজী?
- কারণ আমি একুশটা তালাব পেরোতে পারিনি বলে হতাশায় কাঁদছিলাম। আমার একটাও গুনাহ মাফ হবে না কোনোদিন। নিজের বন্ধুবান্ধবদের কাছে আর ফিরে যাব না এর পর। এসব ওরা বুঝেছিল। ওরা সেই মালা, হার আর চুড়িগুলো আমার রক্তের মধ্যে ডুবিয়ে নিজেদের গায়ে পরে নিতে শুরু করে।
- লা হওল বিলা কুব্বৎ! কী জালিমের মতো কাজ!
- সেগুলো সব সোনার হয়ে গিয়েছিল জাসুস! খাঁটি চমকিলা গয়নার সোনা। আমার বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলের সেই ঘা আর শুকোত না। যখনই রক্ত বেরোত আমি সোনা বানাতে পারতাম। একটা সতেরো বছরের ঘর থেকে পালানো ছেলে রাতারাতি হয়ে গেল কড়োরপতি শেঠ।
- তাহলে আজ এই পাগলপনের কাজটা করছেন কেন মালিক? আপনি তো চিরকালের জন্য ধনী।
- চিরকাল কি কিছু থাকে মির্জা? এই বসন্তের মরসুমে ঘা-টা শুকিয়ে গেল যে। গুস্তাখী মাফ করে চটিদুটো নিজের হাতেই আমার পায়ে গলিয়ে দিন না।
হরফন চটিদুটো তার তরুণ মক্কেলের দুপায়ে গলিয়ে দেয়। খুশী হয়ে আবার জলের তলায় ডুব মেরেছিল সেই মনমৌজী আরামপ্রিয় মানুষটা। আস্তে আস্তে চৌবাচ্চার জলটাও গোলাপি হয়ে আসছিল। হরফন জানত সে রঙের উৎস কোনো তরুণ কবজীর নলি, যা তার আসার আগেই কেটেছিল বাড়ি থেকে পালানোয় ওস্তাদ আর খোদ মর্জির কট্টর মালিক ফেরারী শেঠ। একটা জাসুসকে দেওয়ার মতো কাজ ফুরিয়েছে যার।
জাসুস হরফন শ্বেতপাথরের হামাম থেকে বেরিয়ে আসার পথে শুনল শেঠজী পিছন থেকে বলছে – মোহরগুলো রাখবেন মির্জা। আপনার জাসুসী জবরদস্ত্ কাময়াব হয়েছে। এটাই আমার হারানো চপ্পল।
শ্বেতপাথরের সিঁড়ি দিয়ে নেমে সাদা চূনাপাথরে সাজানো একটা রাস্তা। দুদিকে গোলাপ আর চামেলির ফুলগুলো কালকের পরোয়া না করে প্রতিটি হাওয়ার দমকাকে নিজের গা থেকে পাপড়ি ছিঁড়ে ছিঁড়ে উপহার দিচ্ছে। হরফন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেই বাগানটা পেরিয়ে যেতে চাইছিল।
শহরটা সেদিনই ছাড়ল হরফন। পরে সে মনেও করতে পারত না, কখন কীভাবে ওই অজীবো-গরীব জায়গাটাতে গিয়ে হাজির হয়। মুসাফিরখানা থেকে বেরিয়ে আসার সময় বুড়ো জাকারিয়া বলেছিল – মির্জা, আমি দেশ ছেড়ে চল্লিশ বছর হল এখানে এসেছি। একদিনের জন্য যাইনি কোথাও।
- কেন জনাব? এতই ভালো নাকি জায়গাটা?
- তার চেয়ে কিছু বেশি মির্জা। লক্ষ্য করোনি তুমি? এখান থেকে বেরোবার একটা রাস্তা আছে। কিন্তু ঢোকার পথটা জানে না কেউ। পৃথিবীর দশটা শহরে যে সব গুস্সায় লাল-পীলা মহিলা আর পাওনাদাররা আমায় খুঁজছে তাদের কেউ হুট্ করে আসমান থেকে টপকে পড়বে সে ভয় নেই। এই বলে হ হ করে হাসতে গিয়ে জাকারিয়া হঠাৎ ঝুঁকে এমন খ খ করে কাশতে শুরু করল যে হরফনের মনে হয়েছিল শহর ছাড়ার আগে তাকে বুড়োটাকে দফন করে যেতে হবে।
যা হোক বুড়ো জাকারিয়া সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। হাসিটা একটু কমের দিকে রেখে সে বলল – এখানে কেউ মরে না।
জাসুস এ সবের অর্ধেক বিশ্বাস করেছিল। অর্ধেক করেনি। শহর থেকে বেরোবার একটা মাত্র রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হরফন ভেবেছিল – সত্যি তো, শহরটাতে ঢোকার রাস্তা তার মনে পড়ে না। অর্থাৎ পরে ইচ্ছে থাকলেও জাকারিয়াকে খুঁজে বার করার কোনো উপায় নেই কাছে। তাহলে কি ঘটনাগুলো আদৌ ঘটেনি? এই মোহরগুলো তবে কি হরফন নিজের সঙ্গে লুকিয়ে নিয়ে এসেছিল? আর হরফনের মনের ভিতরের এই অর্ধেক সুখ আর অর্ধেক বে-সুখ? সেগুলো কোত্থেকে এল?
নাঃ, বে-সুখটা হরফনের নিজস্ব হতে পারে। জন্ম থেকে বয়ে বেড়াচ্ছে সন্দেহ নেই। কিন্তু সুখটা এসেছিল ফেরারীর কাছ থেকে। যাকে দেখে হরফন বুঝেছিল মাফ না হওয়া গুনাহের ক্ষতগুলো শরীরে নিয়ে কীভাবে বাঁচতে হয় সেটা একমাত্র তরুণ আর ধনী শেঠরাই ঠিকমতো জানে।
বসন্তের ব্যর্থ রাতগুলোতে যাদের রক্ত ঝরাতে শিখিয়ে দেয় কোনো সাদা বাড়ির ধুলোর পুতুলরা।