যে চরাচরে আমার ভ্রমণ, সেই ভ্রামণিকদের মধ্যে আমিই বোধ হয় বরাবর ট্রাম ভালোবেসে বেড়ে উঠলাম। জেটের ফেলে যাওয়া ধোঁয়ার দুটো রেখার দিকে অপলক তাকিয়ে খুঁজেছি, জেট কোথায়। দেখা পাইনি। শুধু ধোঁয়ার দাগটুকু রেখেই সে মুহূর্তে চলে গেছে। সেই সাদা দাগও পলকে নীলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেছে।
‘আরে কী হল? একটু পা চালিয়ে। গাড়ি যে . . .’
কীসের এত তাড়া? ক-টার গাড়ি ধরবে?
তারপর একদিন কল্পনায় রাতের শেষ ট্রাম দেখা দিল।
বলে উঠল, ‘আরে, আরে, কর কী! ছুটছ কেন? পড়ে যাবে যে! আমায় দেখো। আমি কেমন “দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে” ছুটছি। তুমিও ছোটো, আমার মতো করে। না হলে, ফুটপাথের ধারে যে ক্লান্ত কুকুরটা বিশ্রাম নিচ্ছে, তোমার পায়ের শব্দে চমকে যাবে যে!’
ছোটো!
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছোটো! পড়ে যাবে যে!
ততদিনে ঘড়ি দেখতে শিখে গেছি। চারটে থেকে তাড়া দিতে থাকতাম। শেষমেষ একটা সময়ে বেরিয়ে বাবার স্কুটারে চেপে সিধে সেজজেঠুর বাড়ি এবং বাড়িতে ঢুকেই এক দৌড়ে বারান্দায়।
এক এক করে লাইন করে ক্লাবের ঠাকুর আসতে থাকে। কোনো কোনো ক্লাবের ঠাকুরের সঙ্গে আলোর বিশাল বিশাল গেট। কোনো কোনো ক্লাব আবার জেঠুর বাড়ির সামনে বাজি ফাটাচ্ছে। আমার বাবা, জেঠু, কাকারা যে ক্লাবের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল তার নাম ‘হাওড়া সেবা সংঘ’। এই ক্লাবের ঠাকুরের বিসর্জনে ক্লাবের নিজস্ব ব্যান্ড বেরোত। সেই ব্যান্ডে আমার জ্যাঠতুতো দাদা শৌভিক রায়কে ড্রাম বাজাতে দেখে আমার খুব আনন্দ হত। সবচেয়ে মজা লাগত, পুরো দলটার সামনে যে থাকত, বিশাল বড়ো একটা ড্রাম নিয়ে তাকে দেখে।
অপেক্ষাকৃত ছোটো ক্লাব যেগুলো, তাদের লরির পেছনে কিছু অল্পবয়েসি ছেলে রাস্তায় নাচতে নাচতে যেত। মা দেখে রেগে যেত, আমাকে ওখান থেকে সরিয়ে নিয়ে আসতে চাইত। কিন্তু, আমার যে তখন ওদের মতো নাচতে ইচ্ছে করতে। আসলে, তখন আবাহন আর বিসর্জনের একটা টানাপোড়েন চলত।
ব্যাঁটরা থানার একটু আগে, এক ভদ্রলোক আমার পথ আটকালেন। কোনো ভূমিকা ছাড়াই ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, সবিতাদি এখন কেমন আছেন?’ কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘সবিতাদি কে?’ তিনি আরও অবাক হয়ে বললেন, ‘আরে, আপনাদের ওপরের ফ্ল্যাটেই থাকেন তো!’ সেদিন, সেই মুহূর্তে আমার তাঁকে বলা উচিত ছিল, ‘কাকু, আপনি বোধ হয় ভুল করছেন! আমি ফ্ল্যাটে থাকি না। বহুদিনের পুরোনো বাড়িতে থাকি। দোতলা বাড়ির দুটো তলা মিলিয়েই শুধু মা, বাবা আর আমি।’ সেই কথাটাই বলা আমার উচিত ছিল। কিন্তু কেন তা আমি আজও জানি না, হয়তো অল্প বয়েসের ফাজলামির দোষ, মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ‘ও! ভালো আছেন।’ আর একটাও কথা জিজ্ঞেস না করে ভদ্রলোক চলে গেলেন। আমিও বাজারের ফর্দের শেষ আইটেম গরম গরম বেগুনি, শিঙাড়া, আলুবড়া, চপ আর সেদ্ধ কড়াই কিনে রিকশায় উঠে পড়লুম। সবিতাদি এপিসোড শেষ।
কিন্তু সবিতাদি যে আরও কিছু দিয়ে গেলেন সেটা আরও বেশ কিছুদিন পরে বুঝলুম।
তখন ইংরেজিতে মেজর করছি ইগনু থেকে। আমি যখন গ্র্যাজুয়েশন করি, তখন চট করে ইগনুর ছাত্রছাত্রী পড়ানোর জন্য টিচার পাওয়া ছিল খুবই দুষ্কর। প্রচলিত সিলেবাসের বাইরের সিলেবাস, আর শুধু সিলেবাসই নয়, নম্বরের হিসেব-টিসেবগুলোও একেবারেই আলাদা। তাই ইংরেজি মেজরের প্রাইভেট টিউটর খুঁজে পেতে আমাকে এবং আমার সঙ্গী আরও দু-তিনজন বন্ধুকে বেশ খানিকটা কাঠখড় পোড়াতে হল। একবার একটা ফাঁদেও পড়তে হয়েছিল। সে আলাদা গল্প। সেকথা এখন থাক।
অবশেষে আমাদেরই মধ্যে একজন খুঁজে বের করল ইগনুরই এক ম্যাডামকে, যিনি আমাদের স্টাডি সেন্টারেই ক্লাস নেন। বাড়ি সাদার্ন অ্যাভিনিউতে। প্রাথমিক কথাবার্তা সারা হয়ে যাওয়ার পর আমাদের ক্লাস শুরু হল।
হাওড়া ময়দান থেকে বৈষ্ণবঘাটার মিনিতে উঠি, টালিগঞ্জ থানা স্টপেজে নামি। তারপর একটু পিছিয়ে এসে, সাদার্ন অ্যাভিনিউ ধরে সামান্য একটু হেঁটে নব নালন্দা স্কুল পেরিয়েই বাঁ-দিকের প্রথম রাস্তায় ম্যাডামের বাড়ি। এভাবেই যাওয়া-আসা চলতে থাকে। ফেরার পথে মোড়ের মাথায় বন্ধুরা মিলে চায়ের সঙ্গে কোনোদিন হাফ-প্লেট চাউমিন, কোনোদিন দশ টাকায় দুটো পরোটা। যাওয়ার সময় কোনো কোনোদিন ফোনে বন্ধুদের বলা, ‘আজ একটু আগে আসিস।’ তারপর আধ ঘণ্টা নব নালন্দার গেটের ঠিক পাশেই রকটায় বসে বেশ খানিকটা এলোমেলো আড্ডার পর ম্যাডামের ফ্ল্যাটের দরজায় ‘টিং-টং’। এটা ছিল প্রতি সপ্তাহের রুটিন।
একদিন আমার ইচ্ছে হল, গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশনের লাইব্রেরিতে গিয়ে মেম্বারশিপের ব্যাপারে একটু খোঁজখবর নেব। আগে কোনোদিন ওখানে যাইনি। তাই সময়ের একটু বেশি আগে বেরিয়ে আমাদের চা-পরোটার আড্ডার মোড়ে পৌঁছে অটো স্ট্যান্ড থেকে একটা অটোয় উঠলাম। বললাম, ‘গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশন যাব।’ একইসঙ্গে আর একজন ভদ্রলোকও উঠলেন।
কিছুটা যাওয়ার পরেই তিনি আমায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি তো বহুদিন যাচ্ছেন গোলপার্কের লাইব্রেরিতে। ওদের বইয়ের কালেকশনটা কেমন? মেম্বারশিপ কত? একসঙ্গে ক-টা বই দেয়? কতদিনের জন্য?’
হয়তো আরও কিছু তথ্য ওঁর জানার ছিল। কিন্তু কাউকে খুব বেশি হতাশ করতে আমার কোনোদিনই ভালো লাগে না। তাই তাঁকে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে একটু গম্ভীরভাবে বলি, ‘আমি আজ ওখানে মেম্বারশিপের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে যাচ্ছি।’ বলে আড়চোখে একবার ওঁর দিকে তাকাই। ওরকম হতভম্ব মুখ এখনও অবদি আমি খুব কমই দেখেছি।
আর একদিনের কথা। সেদিন ম্যাডামের বাড়ি থেকে ফিরছি। কালীঘাট মেট্রো স্টেশন থেকে মেট্রোয় চেপে এসপ্ল্যানেডে নেমে, ভূগর্ভ থেকে ভূপৃষ্ঠে উঠে, একটু অপেক্ষার পর মেট্রো সিনেমা হলের সামনে থেকে একটা দাশনগর-ধর্মতলা মিনিতে উঠে জানলার ধারের প্রিয়তম সিটটায় বসি। ইডেন গার্ডেনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ভিড় বাসের মধ্যে জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক ভদ্রলোক আচমকাই জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি শিবপুর বি ই কলেজে ফিজিক্স পড়ান না?’ আমি মুখ তুলে তাকিয়ে গম্ভীরতম ভাব করে শুধু বলি, ‘না।’ তারপর জানলা দিয়ে বাইরের রাস্তার দিকে মুখ ফেরাই।
ততক্ষণে তিনি যা করার করে ফেলেছেন। অর্থাৎ, আমার এক গভীর ব্যথার জায়গাকে আলতো করে ছুঁয়ে দিয়েছেন। এ জীবনের একাধিক সাধের মধ্যে অন্যতম একটা সাধ ছিল, অ্যাস্ট্রোফিজিক্স নিয়ে পড়াশোনা করে মহাকাশবিজ্ঞানী হব। সুদূর ছেলেবেলার কোনো এক রাতে পড়াশোনার পর ন্যাড়া ছাদে মাদুর পেতে মা আর ছেলে পাশাপাশি শুয়ে তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে সে-এক স্বপ্ন দেখেছিলাম। যেকোনো কারণেই হোক, সে-স্বপ্ন সফল হয়নি। অনেকদিন ধরে নিজের সঙ্গে লড়াই করে সে-ব্যর্থতাকে ভোলার চেষ্টা করেছি। অজান্তেই ভদ্রলোক সেই ব্যথার জায়গাটা ছুঁয়ে দিলেন।
মাত্র তিনটে ঘটনার কথা বললাম। কিন্তু এই ‘অন্য অনমিত্র’ এর আগে ও পরে বহুবার আমার মুখোমুখি হয়েছে। তখন তখনই লিখে ফেললে গল্প হয়তো আরও একটু বাড়তে পারত, কিন্তু লেখা হয়নি। আজ বহু চেষ্টা করেও স্মৃতি খুঁড়ে তার সন্ধান পাচ্ছি না।
আমার ডাকনাম পাপ্পু। যারা আমায় খুব ভালোবাসে, তারা কেউ কেউ দ্বিতীয় বা তৃতীয় ‘প’-টা বাদ দেয়। আমি হয়ে যাই ‘পাপু’। তাতে আমার বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই।
আমার বাবার ডাকনাম বাবলু। একদিন বাবার এক বন্ধু, যিনি আমারও পরম বন্ধু ল্যান্ডফোনে ফোন করলেন। আমি ধরে ‘হ্যালো’ বললাম। অমনি কাকু বললেন, ‘বাবলু?’ আমি তড়িঘড়ি উত্তর দিলাম, ‘না, আমি বাবলুর ছেলে।’ তখন সেই কাকু বললেন, ‘ও, পাপু? বাবলু আছে?’
এর পর থেকে মাসি, পিসি, কাকু, জেঠু এবং আরও যে যে বাবলুকে চেয়ে পাপ্পুকে পেয়ে বলেছে, ‘কে? বাবলু?’, আমি সবাইকেই উত্তর দিয়েছি, ‘না, আমি বাবলুর ছেলে।’ অনেক পরে একাধিক জন আমাকে বলেছে, ‘ফোনে তোর আর তোর বাবার গলাটা একদম এক শোনায়। বোঝা যায় না।’
একদিন সকালে মা বাজারে গেছে। বেশ খানিকটা পরে মোবাইল থেকে ল্যান্ডফোনে ফোন করেছে। আমি ধরেছি।
--‘হ্যাঁ গো, শুনছ . . .?’
আমি বললাম, ‘আমি “হ্যাঁ গো”-র ছেলে বলছি, বলো। “হ্যাঁ গো”-কে দেব?’
এর পরেই পাকাপাকিভাবে আমার মনে প্রশ্নটা জাগে,
‘আমি কি আমি-ই?’