প্রথম খণ্ডের প্রথম নিবন্ধ ‘রবীন্দ্রনাথের ছবি; অন্ধকারের উৎস হতে’। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন—‘আমার ছবি যখন বেশ সুন্দর হয়, মানে সবাই যখন বলে-‘বেশ সুন্দর হয়েছে’... আমি তা নষ্ট করে দিই। খানিকটা কালি ঢেলে দিই বা এলোমেলো আঁচড় কাটি। যখন ছবিটা নষ্ট হয়ে যায়, তখন তাকে উদ্ধার করি। এমনি করে তার একটা রূপ বের হয়’। রবীন্দ্রনাথের ছবির এই অন্ধকারময়তার প্রেক্ষিত লেখক স্বল্প পরিসরে ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ছবিতে অন্ধকারই যে শেষ কথা নয়, সেই অন্ধকার থেকে আলোর উদ্ভাসনের কথাও লেখক বলেছেন।
গগনেন্দ্রনাথের শিল্পবৈভব নিয়ে সঞ্জয় ঘোষের নিবিড় পাঠ ‘গগনেন্দ্রনাথ: ভারতীয় চিত্রকলার উজ্জ্বলতম ব্যতিক্রম’ আমাদের চমৎকৃত করে। ভারতীয় চিত্রকলায় প্রথম আধুনিকতার বীজ তাঁর হাতেই—একথা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন সঞ্জয়। অনেক অজানা তথ্যে সমৃদ্ধ এই অধ্যায়। যেমন রাঁচিতে গগনেন্দ্রনাথ শেষ ছবি আঁকেন মোমবাতির আলোয়, নিজের মুখের ‘সিল্যুট’, কালো কালিতে। এরপরেই পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হন। অবনীন্দ্রনাথ ও গগনেন্দ্রনাথ দুই সহোদর হলেও দুজনের শিল্পসত্তার মূল পার্থক্য ছিলই—এ বিষয়ে সঞ্জয় ঘোষ নির্দিষ্ট ভাবে আলোচনা করেছেন। অবনীন্দ্রনাথ যখন যামিনী রায়ের ছবির প্রদর্শনীতে গিয়ে যামিনী রায়কে টিপ্পনী কাটছেন ‘অতঃ কিম’ বলে, তখন পক্ষাঘাতগ্রস্ত গগনেন্দ্রনাথ সেই সব ছবির সামনে দাঁড়িয়ে, যামিনী রায়ের হাত ধরে কেঁদে ফেলছেন।
‘মোনালিসা’ ও ‘দ্য লাস্ট সাপার’ ছবির স্রষ্টা ‘লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ছবি ও জীবনের এক আখ্যান নির্মাণ করেছেন লেখক সঞ্জয় ঘোষ। লিওনার্দো-এর আগে পাশ্চাত্য দেশে শিল্পকলাকে সাহিত্য-সংগীতের সমান মর্যাদা দেওয়া হতো না। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে শিল্পকলা কাব্যের চেয়েও মহান। এক জারজ সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করলেও ছোটবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে শিল্পকলার অসাধারণ প্রতিভার স্ফুরণ লক্ষ্য করা যায়। সেতার বাজানো বা তাৎক্ষনিক কবিতা রচনাতেও তিনি ছিলেন পারদর্শী। শুধু শিল্পচর্চা নয়, পৃথিবীর জ্ঞানের এমন কোনো শাখাপ্রশাখা নেই যার মধ্যে তিনি বিচরণ করেননি।
লিওনার্দোর চরম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আর এক পৃথিবী বিখ্যাত শিল্পী মিকেলঅ্যাঞ্জেলো। দুজনের সম্পর্ক কখনোই আন্তরিক ছিল না। লিওনার্দো বয়েসে মিকেলঅ্যাঞ্জেলোর চেয়ে প্রায় কুড়ি বছরের বড় ছিলেন। মিকেলঅ্যাঞ্জেলো নিয়ে সঞ্জয় ঘোষের বিস্তৃত আলোচনা ‘মিকেলঅ্যাঞ্জেলো: পাথর, কবিতা, প্রেম কিংবা শারীরিক সংলাপ’। উনিশ বছর বয়েসে মিকেলঅ্যাঞ্জেলো ফ্লোরেন্স থেকে রোমে আসেন। তার কয়েক বছর পরেই একটি মাত্র পাথর কেটে নির্মাণ করলেন ‘পিয়েতা’ নামের ম্যাডোনা আর যিশুর মূর্তি। রবীন্দ্রনাথের মতো মিকেলঅ্যাঞ্জেলো স্কুল পালিয়ে বেড়াতেন। তাঁর পছন্দ ছিল গির্জার দেয়ালে শিল্পীদের আঁকা ছবি পর্যবেক্ষণ করা। ছবির প্রতি সন্তানের এই আগ্রহ অনুধাবন করে মিকেলঅ্যাঞ্জেলোর বাবা তাঁর ব্যাবসায়ে না ঢুকিয়ে ছেলেকে ফ্লোরেন্সের এক শিল্পীর ওয়ার্কশপে শিক্ষানবিশ হিসাবে নিযুক্ত করে দেন। মিকেলঅ্যাঞ্জেলো ছিলেন ভীষণ একাকী। বরং বলা যেতে পারে তিনি একা থাকতেই বেশি ভালবাসতেন, তাই তিনি লিখেছিলেন ‘আমি এখন তীব্র সংকটের মধ্যে আছি, শারীরিক যন্ত্রণায়, আমার কোনো বন্ধু নেই, এবং আমি তাঁদের চাইও না’। শিল্পী হলেও তাঁর মধ্যে সবসময় একটা কবিমন বিরাজ করত। তার স্বাক্ষর ফুটে উঠত ভাস্কর্যে ও ছবিতে। আশি বছর বয়েসে মিকেলঅ্যাঞ্জেলো অসুস্থ শরীরে তাঁর জীবনের শেষ ভাস্কর্য নির্মাণ করতে বসেন— সেই যিশু আর ভার্জিন মেরির চিরকালীন ‘পিয়েতা’কে তিনি নতুন করে সৃষ্টি করতে চাইলেন।
‘কালীঘাটের পট : সমাজের করুণ মুখচ্ছবি’ আলোচনায় লেখক উল্লেখ করেছেন শহুরে যাঁতাকলে কালীঘাট পট লৌকিক শিল্পের খাঁচা থেকে বেরিয়ে ডানা মেলল এক নতুন শিল্পের আকাশে। কালীঘাটের পট কি লোকশিল্প থেকে (উত্তরণ?) নাকি অর্থনৈতিক চাপে শিল্পীরা পুরোনো পোশাক বদলে ফেলতে চাইলেন। কারণ কুড়ি ফুট দীর্ঘ যে জড়ানো পট তাঁরা আগে বিক্রি করতেন না, শুধু কবিতার সুরে পাঠ করতেন, কলকাতায় প্রথম এসে তাঁরা সেই পট দেখিয়ে রোজগার করতে শুরু করলেন। স্বাভাবিকভাবেই গুরুসদয় দত্তের মতো লৌকিক শিল্পের তন্নিষ্ঠ সংগ্রহকারী মেনে নিতে পারেননি কালীঘাটের পটের এই শহুরে পট পরিবর্তনকে। শহুরে তকমা অর্জন করলেও কালীঘাট পট কিন্তু দুহাত দিয়ে আঁকড়ে থেকেছে লোকচিত্রের জীবন। একটা সময় ভারতবর্ষের অন্য বিখ্যাত চিত্রকলার মতো এ শিল্প পুষ্ট হয়নি প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে, পরবর্তী সময়ে কালীঘাট পট যখন তুমুলভাবে নন্দিত ও জনপ্রিয়, তখন বিদেশী চিত্রসংগ্রাহকেরা ভারতবর্ষের দেশীয় শিকড়ের নির্যাসের জন্য গোছা গোছা কালীঘাট পট নিয়ে গেছেন নিজেদের দেশে। লেখক বিশ্বাস করেন কালীঘাট পটশিল্প পৃথিবীর ইতিহাসে যৌথ চিত্রকলার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। এলিট সমাজের অবজ্ঞা উপেক্ষা করে একশো বছরের বেশি সময় ধরে এই পটশিল্প সগর্বে টিকে থেকেছে।
ছবি ও কবিতার এক স্বপ্ননীল বিপ্লবী— উইলিয়াম ব্লেকের জীবন সঞ্জয় ঘোষ তুলে এনেছেন এক মর্মস্পর্শী বর্ণনায়। তাঁর চোখ স্বপ্নের খোঁজে ঘুরে বেড়ালেও তিনি সবসময় সজাগ থাকতেন সমাজের অন্যায়, অবিচারের দিকে। রাজতন্ত্রের বিরোধিতায় সোচ্চার হয়েছেন লেখায় ও রেখায়। ইংল্যান্ডে থাকার সময় বইয়ের সচিত্রকরণের নির্মম ছবিতে ধরা পড়েছে ক্রীতদাসের ওপর অত্যাচারের দৃশ্য। ব্লেক এক অদ্ভুত মানুষ—যীশুখ্রিস্টের কাছে, বাইবেলের কাছে নতজানু থাকেন সারাজীবন কিন্তু গির্জার অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন বারবার। এইভাবে মার্কসের আগে লিখে যান ‘কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ নিজস্ব স্বরে। ব্লেক রবীন্দ্রনাথের মতো জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আস্থা রেখেছেন মানুষের ওপর। কবিতা রচনা ছিল ব্লেকের সহজাত প্রবৃত্তির মধ্যে, শিল্পকলারও পাঠ ছোটোবেলা থেকে। জীবিতকালে ব্লেক তাঁর শিল্পকার্যের সমাদর পাননি। আসলে তাঁর কবিতায় ও ছবিতে, ব্যক্তিগত মিথকে সমালোচকেরা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হননি।
‘ছবি যখন ‘ছবি’ হয়’ অধ্যায়ে লেখক সঠিকভাবেই বলেছেন সারা পৃথিবী জুড়ে প্রতিদিন কত কত চিত্রকরের তুলিতে সৃষ্টি হচ্ছে অজস্র ছবি, কিন্তু সব ছবিই ছবি নয়, তার মধ্যে কিছু কিছু ছবি হয়ে উঠেছে অভিনব, অনন্য ও পৃথিবী বিখ্যাত। এ প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেছেন এডভার্ড মুঙ্খের ছবি ‘দ্য স্ক্রিম’, মার্ক শাগালের ‘আই এন্ড দ্য ভিলেজ’, পল সেজানের ‘স্টিল লাইফ উইথ অ্যাপলস’, হেনরি মাতিসের ‘লার্জ রিক্লিইনিং ন্যুড’, ত্রয়োদশ শতাব্দীর চিত্রকর জিয়েত্তর ‘দ্য রোড টু ক্যালভারি’, ফ্রান্সিস বেকনের ‘দ্য স্ক্রিমিং পোপ’ প্রভৃতি।
‘ভারতীয় চিত্রশিল্পে আধুনিকতাঃ একটি ব্যক্তিগত পরিক্রমণ’ পর্যায়ে লেখক শুরু করেছেন রবি বর্মার ছবি নিয়ে। একটা সময় রবি বর্মার ছবি বহু মানুষের ঘরের দেয়াল অলংকৃত করেছে। তাঁর ছবির সস্তা জনপ্রিয়তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ এবং রবি বর্মার ছবির হাত থেকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন ভারতীয় শিল্পকে। সে দায়িত্ব বর্তেছিল নিবেদিতার ওপর যার উষ্ণ প্রেরণায় নন্দলাল বসু, অসিত হালদাররা ছুটে গিয়েছিলেন অজন্তা-ইলোরায় ভারতীয় শিল্পের মূল শিকড়ের সন্ধানে। এরপর পর্যায়ক্রমে আলোচনা করেছেন নন্দলাল, অবনীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, বিনোদবিহারী ও রামকিঙ্কর যাঁদের আধুনিক চিত্রভাষা ও চিত্রবোধ উন্মোচিত করেছিল ভারতীয় চিত্রকলার নতুন দিগন্ত।
ভারতীয় চিত্রকলায় এক কিংবদন্তী শিল্পী যামিনী রায়। প্রথম জীবনে বিদেশী পন্থায় ছবি এঁকে খ্যাতি ও যশের শীর্ষে পৌঁছেও ফিরে এসেছেন বাংলার মাটির টানে, বাঁকুড়া জেলার গ্রামীণ শিল্পসত্তায়। নিশ্চিন্ত জীবনের হাতছানি উপেক্ষা করে, পরিবারকে অভুক্ত রেখে তিনি হাঁটতে থাকলেন চিত্রকলার এক নির্জন পথে। কালীঘাট চিত্রের অনুপ্রেরণায় তিনি সে আমলের মানুষের জীবনের সহজ মোটিভ রূপান্তরিত করতে চাইলেন ছবির বিশুদ্ধ্বতায়। রেখা আর রঙের তীব্রতা হয়ে উঠল তাঁর ছবির অন্যতম প্রধান বিষয়। তাঁর এই শিল্পসত্তায় মুগ্ধ হলেন বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, নরেশ গুহ, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিক। ‘যামিনীবাবুর ছবিগুলি ভারতশিল্পের উজ্জ্বলতম নিদর্শন’— সুধীন্দ্রনাথের এ স্বীকৃতির পাশাপাশি তিনি নির্মোহভাবে যামিনী রায়ের ছবির সমালোচনাও করেছেন তাঁর সংগ্রামবিমুখতার জন্যে। একইভাবে বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে যামিনী রায়ের গভীর অন্তরঙ্গতা থাকলেও যামিনী রায়ের শিল্পভাবনা ও সাংস্কৃতিক চেতনার কখনোই শরিক ছিলেন না বুদ্ধদেব বসু। লেখক সঞ্জয় ঘোষ এই সমস্ত বিষয়গুলি সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন ‘যামিনী রায়ের ছবিঃ পটচিত্রের আন্তর্জাতিক মুখ’ ও ‘যামিনী রায় ও তাঁর কবিবন্ধুরা’ শীর্ষক আলোচনায়।
প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামে সঞ্জয় ঘোষ কোনো এক সময়ে পা রেখেছিলেন, সেই অভিজ্ঞতার আনুপূর্বিক বর্ণনা রয়েছে ‘ল্যুভর : এক অলৌকিক শিল্পগ্রহে’ অধ্যায়ে। তিনি লিখছেন ল্যুভর মিউজিয়াম সেই পবিত্র স্থান, যেখানে পিকাসো, মাতিস, মিরো তাঁদের যৌবনবেলায় ওল্ড মাস্টারদের ছবির কপি করে দিনের পর দিন হাত মকশো করেছিলেন। এখানে লিওনার্দোর ‘মোনালিসা’ ছবির সামনে দর্শকের ভিড় দেখে সঞ্জয়ের সরস মন্তব্য—‘ভাগ্যিস উনিশশো এগারো সালে মোনালিসা ছবিটা ল্যুভর থেকে চুরি এবং পুনরুদ্ধার হয়েছিল, না-হলে এই ছবিটার জন্যে এত ক্রেজ তৈরি হত কি না সন্দেহ’। এই মিউজিয়ামে তিনি দেখেছিলেন রেমব্রানটের ‘নাইট ওয়াচম্যান’, রাফায়েলের ‘দ্য ভার্জিন অ্যান্ড চাইল্ড উইথ সেন্ট জন দ্য ব্যাপটিস্ট’, দেলাক্রোয়ার সেই মর্মান্তিক ছবি ‘দ্য ডেথ অব সারডানাপালুস’। এই ছবিগুলির প্রেক্ষাপট বিবৃত হয়েছে সঞ্জয় ঘোষের মরমী অক্ষরে যা পাঠককে ঋদ্ধ করবে। ল্যুভরের তিনতলার সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে তাঁর চোখে পড়েছিল এক অসামান্য গ্রিক ভাস্কর্য ‘ভিকট্রি অব সামোথরেস’, আর তখনই তাঁর মনে পড়েছিল রামকিঙ্করের ‘ধান ঝাড়াই’ ভাস্কর্যটির কথা, কোথায় যেন রয়েছে এক আশ্চর্য অন্তর্লিন মিল। রামকিঙ্কর তো ল্যুভর দেখেননি, তাহলে কি করে অর্জন করলেন এই প্রভাব! অনেকেই জানেন ভাস্কর্য ও ছবি আঁকার ফাঁকে রামকিঙ্কর অনেকটা সময় কাটাতেন বিশ্বভারতীর লাইব্রেরিতে বিদেশি ছবি ও ভাস্কর্যের বই পড়ে, হয়তো তারই প্রভাব।
পশিম মেদিনীপুরের নয়া গ্রাম-এই গ্রামের ছয় থেকে ষাট বছরের সদস্যরা সবাই বিভোর হয়ে আছে শিল্পচর্চায়, শিল্পকর্মে। শিল্পই তাদের রুটি-রোজগার, শিল্পই তাদের ধ্যান-জ্ঞান। পঁয়ষট্টিটা পরিবার একসঙ্গে বাস করে এই গ্রামে। পৃথিবীর শিল্প ইতিহাসে এ এক বিরল চিত্র। সঞ্জয় ঘোষ ‘নয়া: এক অ-লৌকিক শিল্পগ্রামে’ নিবন্ধে অসাধারণ মরমী ভাষায় তুলে এনেছেন সেই গ্রামের জীবনের ছবি, তাদের প্রবল চিত্রবোধ।
১৯২৫ সালে স্প্যানিশ শিল্পী জন মিরো এঁকেছিলেন ‘দ্য বার্থ অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ ছবিটা। স্যুরারিয়ালিজম দর্শন যখন তাঁকে আচ্ছন্ন করেছে এবং তাঁকে বলা হচ্ছে স্যুরারিয়ালিস্ট শিল্পীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্যুরারিয়ালিস্ট। স্যুরারিয়ালিস্ট আবরণ ছিন্ন করে ১৯২৭-এ মিরোর ঘোষণা ‘আমি চিত্রকলাকে খুন করতে চাই’। আসলে তিনি প্রথাগত চিত্রকলার সমস্ত আবরণ সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন ব্যাকরণসম্মত ফর্মের ভাঙচুর। মিরোর এই বিতৃষ্ণার পেছনে কাজ করেছে নানান রাজনৈতিক ঝড়ঝঞ্ঝা। পৃথিবীর যুদ্ধ-বিধ্বস্ত চেহারা মিরোর শিল্পচেতনাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিল। মিরো কিন্তু কখনোই চিত্রকলাকে ধ্বংস করতে চাননি, চিত্রকলাকে বারবার আক্রমণ করেও শেষপর্যন্ত তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন চিত্রকলারই চারপাশে। লেখক সঞ্জয় ঘোষ মীরোর জীবন ও চিত্রকলা নিয়ে আলোচনা করেছেন ‘মীরো: চিত্রকলার হত্যাকারী এক শিল্পী’ নিবন্ধে।
ভারতীয় ভাস্কর্যের কিংবদন্তী শিল্পী রামকিঙ্কর। লেখক ‘রামকিঙ্করঃ নীল মাটির অভিমান আর লাল পলাশের হাহাকার’ শীর্ষক আলোচনায় রামকিঙ্করের অস্তিত্বের সংকট, বংশ পরিচয়, সৃষ্টির পিছনে তাঁর অমানুষিক নিরলস শ্রম, শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের আশ্রয়, গুরু নন্দলালের সঙ্গে মতানৈক্য আবার একই সঙ্গে পারস্পরিক সৌহার্দ্য, তাঁর যৌনতা, তাঁর প্রেম, সবকিছু তুলে ধরেছেন।
লেখক ‘দালির ছবি: উদ্ভটের কাব্যকূট’ প্রসঙ্গে বলেছেন, দালি এক আশ্চর্য শিল্পী যিনি স্যুরারিয়ালিজম মতাদর্শের মধ্যে তীব্রভাবে থেকেও তিনি তুলি চালনা করেছেন নিজের খেয়ালে। বিরোধ বেঁধেছে স্যুরারিয়ালিজম আন্দোলনের সদস্যদের মধ্যে। তাঁর জীবন জুড়ে চরম বৈপরীত্যের প্রেক্ষিতে লেখক যে সমস্ত তথ্য সন্নিবেশিত করেছেন তাতে বোঝা যায় দালি ‘দালি’ হয়ে শেষপর্যন্ত থেকে যান তাঁর সর্বগ্রাসী প্রতিভা ও সীমাহীন খামখেয়াল নিয়ে।
পাবলো পিকাসো বিশ্ববন্দিত শিল্পী হিসেবে পৃথিবীর কাছে পরিচিত হলেও তিনি যে কবিতা লিখতেন সে হদিশ আমরা পেয়ে যাই ‘পিকাসোর কবিতাঃ তালি মারা শব্দের গাঢ় কুহক-জাল’ নিবন্ধে। ১৯৩৫-এর শুরুতে, পিকাসোর বয়েস যখন চুয়ান্ন, প্রথম কবিতা লেখা শুরু করলেন এবং দৈনন্দিন পূজাপাঠের মতো রোজ কবিতা লিখে গেলেন ১৯৫৯ পর্যন্ত। তাঁর কবিতার ভাষা, কবিতায় স্যুরারিয়ালিজমের প্রভাব, বিভিন্ন কবির সঙ্গে যোগাযোগ, তাঁর কবিতার বিরুদ্ধতা, ফরাসি তরুণ কবিদের আগ্রহ-সব কিছু নিয়েই একটি মনোজ্ঞ আলোচনা উঠে এসেছে।
জয়নুল আবেদিন, চিত্তপ্রাসাদ, এবং সোমনাথ হোর— তিনজনই সমসাময়িক শিল্পী। মন্বন্তর, দাঙ্গা, দেশভাগের নির্মম ছবি উঠে এসেছে এঁদের তুলির আঁচড়ে। কম্যুনিস্ট ভাবধারায় জারিত মননের অভিঘাতে এঁদের ক্যানভাস ঝলসে উঠেছে নিপীড়িত, শোষিত মানুষের অবয়ব। ছবি আঁকার পাশাপাশি চিত্তপ্রসাদের কবিতার কথাও লেখক উল্লেখ করেছেন। তিনটি পৃথক অধ্যায়ে তিন চিত্রকরদের নিয়ে আলোচনা রয়েছে।
দিনকর কৌশিকের ‘শান্তিনিকেতনের দিনগুলি’ একটি অসামান্য গ্রন্থ। এই বইয়ের প্রবন্ধগুলিতে দিনকর কৌশিক তাঁর দীর্ঘ শান্তিনিকেতন বাসের জীবনকে বর্ণনা করেছেন সহজ সরল ভঙ্গিতে। আমরা জানি নন্দলালের পর কলাভবনের দায়িত্ব অর্পিত হয় দিনকর কৌশিকের ওপর ১৯৬৭ সালে। নন্দলাল বসুর প্রয়াণের পর কলাভবনকে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যাবার ক্ষেত্রে একজন দক্ষ প্রশাসক প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজন ছিল দিনকর কৌশিকের মত ব্যক্তিত্বের। লেখক সঞ্জয় ঘোষ সেইসময়ের শান্তিনিকেতনের ছবিগুলি তুলে ধরেছেন— খোলা আকাশের নীচে নন্দলাল ছাত্রদের স্কেচ শেখাচ্ছেন, দেয়ালে ম্যুরাল আঁকছেন বিনোদবিহারী, কাঁকর-সিমেন্টের ভাস্কর্য করছেন রামকিঙ্কর, সঙ্গীতভবনে এসরাজ বাজাচ্ছেন অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায়, আর ছাত্রাবাসে সত্যজিৎ রায় পৃথ্বীশ নিয়োগী ও মুত্থুস্বামির সঙ্গে দিন কাটাচ্ছেন দিনকর কৌশিক।
সঞ্জয় ঘোষের ‘চিত্রকলা এবং’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে সংকলিত হয়েছে চিত্রকলার সঙ্গে কবিতা ও চলচ্চিত্র বিষয়ক নিবন্ধ। লেখাগুলি যে পরস্পর সম্পর্কিত তা কিন্তু নয়। আলোচনার নানামুখী বিস্তার সংকলনে ভিন্ন স্বাদ আনে। এই খণ্ডের প্রথম নিবন্ধ ‘এডভার্ড মুঙ্খের ছবিঃ বিষাদ, ভালোবাসা আর মৃত্যুর কবিতা’। লেখক শুরুতেই বলে দিয়েছেন ‘দ্য স্ক্রিম’— এই একটি চিত্রকলার জন্যই পৃথিবীর শিল্পবোদ্ধারা মুঙ্খকে কোনোদিন ভুলবে না। মুঙ্খ নরওয়ের শিল্পী। তাঁর ছবি মনস্তাত্ত্বিক বিষাদ ও আত্মিক সংকটের উচ্চারণ। প্রথম জীবনে মুঙ্খ ইম্প্রেশনিস্টদের ছবির অন্ধভক্ত ছিলেন কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি অবশ্য ইম্প্রেশনিস্টদের ওপর শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলেন। সারাজীবন ধরে মানসিক অস্থিরতা, তীব্র উৎকণ্ঠা, বিষাদ, মা ও দিদির অকাল প্রয়াণ, এবং ছোটবেলায় নানা অসুখে আক্রান্ত অসহায় দিনগুলো থেকে মুক্তি পেতে মুঙ্খ তুলে নিয়েছিলেন তুলি আর রং। নিজের জীবনকে পুড়িয়ে যে ক্ষত সৃষ্টি করেছিলেন তারই ছায়া যেন তাঁর সৃষ্টি। মুঙ্খের ছবি ও জীবন নিয়ে লেখক সঞ্জয় ঘোষ মর্মস্পর্শী আলোচনা করেছেন।
ফরাসি ভাস্কর রঁদ্যা ও জার্মান কবি রিলকের সম্পর্ক একটা সময় প্রায় কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিল। দুজন দুই প্রজন্মের, ভিন্ন মানসিকতার এবং পৃথক মাধ্যমের মানুষ হলেও, পৃথিবীর শিল্প-সংস্কৃতির ইতিহাসে এ এক আশ্চর্য বন্ধন। রিলকের জীবন ও কবিতা যেভাবে শিল্পী রঁদ্যার প্রভাবে আমূল পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছিল তার নিদর্শন পৃথিবীতে বিরল। তাঁর কবিতাতে এসেছিল প্রত্যক্ষতা ও ভাস্কর্যগুণ। দুজনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পরস্পরকে আরও নিকটে নিয়ে এল। রিলকে রঁদ্যার সেক্রেটারি হলেন। কিন্তু দুজন সংবেদনশীল প্রতিভাধর মানুষ যখন পরস্পরের কাছে আসেন তখন তাঁদের মধ্যে কিছু বিদ্যুৎচমক ঘটতেই পারে। রিলকের মনে হচ্ছিল যে তাঁর কাজের ভার যেন খুব বেড়ে যাচ্ছে, তাঁর নিজের সৃষ্টির জন্যে সময় যেন খুব কমে যাচ্ছে। দুজনের মধ্যে ঘটে গেল অনিবার্য বিচ্ছেদ। এই দুই প্রতিভার বিনিময়ের আখ্যান বর্ণিত হয়েছে ‘রিলকে ও রঁদ্যা: একটি ঝড়ো সম্পর্ক ও কিছু বজ্রবিদ্যুৎ’-এ।
নন্দলাল বসুকে নিয়ে আলোচনা ‘নন্দলাল: এক প্রাচীন বৃক্ষ ও শান্তিনিকেতনের আলোবাতাস’ ভারতীয় চিত্রকলার আধুনিকতার পরিচয় বহন করে। নন্দলালের সঙ্গে অবনীন্দ্রনাথের গুরুশিষ্যের সম্পর্ক আবার নন্দলালকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ-অবনীন্দ্রনাথের মতপার্থক্য লেখক নির্মোহ দৃষ্টিতে ফুটিয়ে তুলেছেন। এটা ঠিক, রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে না এলে নন্দলালের পূর্ণ বিকাশ যেমন ঘটত না, তেমনি নন্দলালের সাহচর্য না পেলে কলাভবনের হয়তো স্বাভাবিক ছন্দে অগ্রসর সম্ভব হত না। আর ভারতবর্ষের চিত্রসমাজও পেত না রামকিঙ্কর ও বিনোদবিহারীকে। এটা ঠিক, রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে কাউকে চাকরি করতে ডাকেননি, তিনি চেয়েছিলেন প্রত্যেকের প্রতিভার বিকাশ ঘটুক নিজস্ব ছন্দে। বিনোদবিহারীকে একটি আলাদা নিবন্ধে সঞ্জয় ঘোষ বিনোদবিহারীর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘চিত্রকর’ বইয়ে উল্লেখিত কিছু ঘটনা বা উপলব্ধির কোলাজ সাজিয়ে দিয়েছেন যাতে স্পষ্ট হয়ে উঠে বিনোদবিহারীর শিল্পী ও শিল্পবোদ্ধা হয়ে ওঠার ইশারাটুকু। জানা যায়, দাদা বিজনবিহারীর কাছেই বিনোদবিহারী শিল্পশিক্ষার প্রথম পাঠটি নিয়েছেন। কলাভবনে ভর্তির পর নন্দলাল বিনোদবিহারীকে বিশেষ সুনজরে দেখেননি তার ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তির জন্যে, ‘যার চোখই ভালো নয়, সে ছবি আঁকবে কি করে’— বিনোদবিহারী সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের কাছে এরকমই অভিযোগ ছিল নন্দলালের। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের সেই অমোঘ উচ্চারণ মনে পড়ে, ‘ও যদি নিয়মিত আসনে বসে এবং মনোযোগ দিয়ে কাজ করে তবে ওকে স্থানচ্যুত কোরো না। ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা কোরো না। সকলকে নিজের পথ খুঁজে নিতে দাও’। মনে রাখতে হবে প্রথম দিকে অবহেলা পেলেও তিনিই পরবর্তী সময়ে হয়ে উঠেছিলেন নন্দলালের একজন শ্রেষ্ঠ শিষ্য। এরকমই কয়েকটি ঘটনার উল্লেখে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে বিনোদবিহারীর একাকীত্ব, নির্জনতা, বাইরের অনেক বাধা অতিক্রম করে নিজের শিল্পীসত্তাকে জাগিয়ে তোলার অদম্য প্রয়াস। পুরোপুরি দৃষ্টিশক্তি চলে যাবার পর বিনোদবিহারী হয়ে উঠলেন আলোর জগতে অন্ধকারের প্রতিনিধি। তবু তাঁর সৃষ্টিকর্ম থেমে থাকেনি। অন্ধকারের জগতে বসবাস করেও তিনি রেখে গেলেন আশ্চর্য সব শিল্পকর্ম, শিল্পের শ্রেষ্ঠ সব ধ্রুবতারা।
শার্ল বোদলের (১৮২১-১৮৬৭) ছিলেন একজন ফরাসি কবি, প্রবন্ধকার ও শিল্পকলা বিষয়ের লেখক। সাহিত্য ছাড়াও বোদলের ছিলেন একজন বিখ্যাত চিত্রসমালোচক। বোদলের চেয়েছিলেন মধ্যবিত্ত মানুষ চিত্রকলার দর্শক বা সাহিত্যের পাঠক হোক, শুধুমাত্র বোদ্ধা দর্শক বা পাঠককে তিনি সহ্য করতে পারতেন না। বোদলের ছিলেন নাগরিক জীবনে আসক্ত, তিনি প্রকৃতির উপাসক ছিলেন না। বাস্তবকে তিনি কল্পনার মধ্যে দিয়ে পরিস্রুত করে নির্মাণ করতেন নতুন এক জগৎ যা তিনি কল্পনায় দেখতে পেতেন। তিনি পথে পথে ঘুরে সভ্যতার যে সংকট দেখেছেন, তাকেই কবিতায় উপজীব্য করেছেন। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য বোদেলের কবিতা পছন্দ করেননি, আবু সইদ আইয়ুব ব্যাখ্যা করেছেন বোদলের কবিতার সীমাবদ্ধতা, আবার বুদ্ধদেব বসু বোদলের কবিতা অনুবাদ করে বাংলা কবিতার জগতকে সমৃদ্ধ করেছেন। যাইহোক, সঞ্জয় ঘোষ কিন্তু নিপুণ মুন্সিয়ানায় বোদলের জীবন ও সাহিত্যকে সাধারণ পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন।
পরিতোষ সেন চল্লিশ দশকের প্রথিতযশা শিল্পী। জন্ম পূর্ববঙ্গের ঢাকায়। ওখানেই শৈশব কেটেছে একটি বড় যৌথ পরিবারে। তাঁর ছবি আঁকার ফর্ম ও রঙ ব্যবহারের ক্ষেত্রে কাজ করেছে তাঁর ছোটোবেলাকার ঘুড়ি ওড়ানোর প্রভাব। শিল্পশিক্ষা তদানীন্তন মাদ্রাজ আর্ট কলেজে। দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী তখন অধ্যক্ষ। দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী শিল্পগুরু হলেও পরিতোষ সেন ওনাকে পছন্দ করতেন না, কারণ তিনি তাঁর ছাত্রদের পশ্চিমের চিত্রজগতে ঘটে যাওয়া পরিবর্তন থেকে অন্ধকারে রেখেছিলেন। পরিতোষ সেন প্যারিসে গিয়েছিলেন আধুনিক শিল্পধারার সঙ্গে পরিচিত হতে। ওখানে শেখা, ছবি দেখা ছাড়াও পিকাসোর সঙ্গে পরিচয় তাঁর জীবনে নতুন উদ্দীপনা এনে দেয়। প্যারিসে থাকাকালীন পরিতোষ সেন একবার ওখানকার ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। পুলিশের হাতে বন্দিও হয়েছিলেন। ভাবতে অবাক লাগে, এত উচ্চস্তরের শিল্পীর কোনো আলাদা স্টুডিয়ো ছিল না। বাড়ির একটা অপ্রশস্ত ঘরই ছিল তাঁর স্টুডিয়ো। শুধু রং-তুলি নয়, পরিতোষ সেন হাতে কলমও তুলে নিয়েছিলেন। জানা যায়, সত্যজিৎ রায়ের উৎসাহেই পরিতোষ সেন লিখেছিলেন ‘জিন্দাবাহার’। সঞ্জয় ঘোষ ছিলেন শিল্পী পরিতোষ সেনের বিশেষ বন্ধু। সুতরাং তাঁর জীবন সম্পর্কে অনেক খুঁটিনাটি বিষয় বড় আন্তরিক ভাবে তুলে ধরেছেন এই নিবন্ধে। এই কারণেই লেখাটি পাঠককে বিশেষ ভাবে স্পর্শ করবে।
পল ক্লি কবি না শিল্পী এই প্রশ্নে- তাঁর সহজ উচ্চারণ ‘আমি জানি যে আমি মূলত একজন কবি, এবং এই জানা আমার ছবি আঁকার কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে না’। তাঁর ছবিগুলো আসলে কবিতাই। কবিতায় মিশে আছে হাস্যরস, অতীন্দ্রিয়বাদ এবং তাঁর কবিতা কিছুটা আয়রনিক। কিন্তু পল ক্লির জীবদ্দশায় তাঁর কোনো কবিতাই প্রকাশিত হয়নি। ক্লির ডায়েরিতে প্রায় একশোর বেশি কবিতা ছিল। তাঁর ছেলে ফেলিস্ক উনিশশো ষাট সালে কবিতাগুলো একত্রিত করে প্রকাশ করে। পার্থিব জগৎ ও তার অনিশ্চয়তার ঊর্ধ্বে উঠে পল ক্লি বিচরণ করতে চাইলেও যৌনতাই তাঁকে মাটির সঙ্গে যেন বেঁধে রাখতে চাইত। লেখক সঞ্জয় ঘোষ আলোচনা করেছেন পল ক্লির কবিতা: সংগীত, চিত্রকলা, যৌনতা আর বিমূর্ততার ভাষা।
দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের শিল্পীজীবন নিয়েও লেখক কলম ধরেছেন। শিল্পী যখন বলেন ‘আমার ছবি মানুষের ছবি, মানুষের জন্য ছবি’, তখন সহজেই অনুমেয় শিল্পী হলেও তিনি পুরোদস্তুর একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। মার্কসবাদ লেনিনবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি শ্রমজীবী মানুষের স্বপক্ষে দাঁড়িয়েছেন। দেবব্রত মুখোপাধ্যায় তাঁর বাবার প্রভাবে ছবিজীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন মানবতার মুক্তির জন্যে, কিন্তু পার্টির কঠিন শৃঙ্খল তিনি শিল্পী হিসেবে সবসময় মানতে পারেননি। আর্ট কলেজে অল্পদিন শিক্ষা নিলেও মূলত তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। রাজনৈতিক ও প্রতিবাদী শিল্পী হিসেবে পরিচিত হলেও তাঁর ক্যানভাস জুড়ে রয়েছে প্রকৃতির ছবিও। রং ও রেখার অমোঘ টানে দেবব্রত লিখেছিলেন শিল্প-রূপকথার গ্রন্থ ‘রূপকথা’।
১৯৫১য় মনোহরপুকুর রোডের বাড়ির দেয়ালে জীবনের প্রথম ড্রইং করেছিলেন শিল্পী যোগেন চৌধুরী। লাল নীল পেন্সিল দিয়ে একটা ময়ূর। এরপরে তাঁর ছবিতে ময়ূর এসেছে বারবার কিন্তু ভিন্ন অর্থে, ভিন্ন প্রতীকে, ভিন্ন বাঞ্জনায়। জীবনের প্রথম ড্রইংকে ভুলতে পারেননি তিনি। যৌবনে তাঁকে ছবি আঁকতে হয়েছে নিদারুণ দারিদ্রে, যন্ত্রণায় ও লন্ঠনের মৃদু আলোয়, হয়তো সেজন্যই তাঁর ছবিতে এত কালো রঙের প্রাচুর্য, এবং কালো রেখা বা বুনোটের এত ঘনত্ব। তাঁর ছবিতে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব যোগেন চৌধুরী স্বীকার করেছেন। যোগেন চৌধুরীর ছবি জুড়ে শুধুই মানুষ, মানুষের পুরো ইতিহাস ও মানুষের যন্ত্রণা। ছবি আঁকার সঙ্গে কৈশোর থেকেই কবিতা লেখার শুরু এবং কলেজে পড়ার সময় থেকে জীবনানন্দের কবিতার বিমুগ্ধ পাঠক।
ব্যতিক্রমী কবি ও গদ্যকার হিসেবে মণীন্দ্র গুপ্তের বিপুল পরিচিতি সর্বজনবিদিত। তাঁর বিখ্যাত আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘অক্ষয় মালবেরি’তে মনোনিবেশ করলেই জানা যায়, শৈশব থেকেই প্রখর ভালোবাসা ছিল ছবি আঁকার দিকে, তাঁর মনের গভীরে চিত্রকলা যেন নির্বাক জেগেছিল আজীবন তানাহলে কেন ‘ধর্মতলা মোড়ের জি সি লাহার দোকান থেকে, মাইনে পেয়েই স্কেচ বই, কেন্ট পেপারের শিট, বেছে বেছে উইনসর নিউটনের জলরঙের কেক, সেবল লোমের এক সেট তুলি, চিনে কালি, নেপালি কাগজ কিনতে যাবেন! শিল্পভাবনার নির্দিষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর কবিতায়, এবং সেটাই তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছে চিত্র-ভাস্কর্য নিয়ে তন্নিষ্ঠ ভাবনা ও গবেষণায়। তাই তিনি শান্তিনিকেতনে গেছেন রামকিঙ্কর ও নন্দলাল বসুর সঙ্গে দেখা করতে। রামকিঙ্কর প্রাণ খুলে নিজের আঁকা ছবি দেখিয়েছেন আর নন্দলাল বসু মণীন্দ্র গুপ্তের ছবি স্বেচ্ছায় সংশোধন করে দিয়েছেন। সঞ্জয় ঘোষ বলেছেন, নন্দলাল বসুর ছবির আত্মার সঙ্গে মণীন্দ্র গুপ্তের শিল্পচেতনার প্রগাঢ় সাযুজ্যের কথা। ছবির প্রতি ভালোবাসার জন্যই মণীন্দ্র গুপ্ত যেমন নিজের বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন, অলংকরণ করেছেন তেমনি অসংখ্য কবি ও লেখকের অনুরোধে তাঁদের বইয়ের প্রচ্ছদ করে দিয়েছেন। মনেপ্রাণে তিনি একজন শিল্পী ছিলেন কিন্তু বিভিন্ন কারণে তিনি পরিপূর্ণ শিল্পচর্চা করে উঠতে পারেননি। সঞ্জয় ঘোষ সঠিকভাবেই আক্ষেপ করেছেন, মণীন্দ্র গুপ্ত যদি আরও বেশি করে শিল্পচর্চায় নিজেকে ব্যাপৃত রাখতে পারতেন, তাহলে হয়তো কবি মণীন্দ্র গুপ্তের পাশাপাশি শিল্পী মণীন্দ্র গুপ্তকেও আমরা পেতে পারতাম।
কবি ভাস্কর চক্রবর্তী সম্পর্কিত নিবন্ধটি ‘ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতার চিত্রকল্পঃ সাদা কাগজের পাখি, নৌকো আর অন্ধরাত্তির’ ২০২০ সালে সঞ্জয় ঘোষ ভাস্কর চক্রবর্তী স্মারক বক্তৃতায় পাঠ করেছিলেন। কবিতার নানা দিক এবং বাংলা ভাষা ও পাশ্চাত্যের অনেক কবির প্রসঙ্গ এসেছে এই আলোচনায়। ভাস্কর চক্রবর্তী ষাট দশকের এক বিশিষ্ট কবি, তাঁর কবিতা জুড়ে আছে শিল্পকলার সঙ্গে আত্মীয়তা, উত্তর আধুনিকতা, রং, সত্তর দশক, সুররিয়ালিজম এবং ভীষণভাবে মৃত্যুবোধ। কারণ ছোটবেলায় তাঁর বোনের মৃত্যু সারাজীবন তাঁকে তাড়া করে বেড়িয়েছে। তাই তাঁর কবিতায় পাই ‘আমি কি পাহারা দেব/ ছোটো বোন ঘুমায় যখন ... আমি কি ঘুমাব পাশে / ছোটো বোন ঘুমায় যখন’। তাছাড়া, কলকাতার সরু গলির ঘ্রাণ, তার রহস্যের একটা নিবিড় আত্মিক টান ভাস্কর অনুভব করেন। তাঁর বহু কবিতায় ‘গলি’ শব্দটা অবিরল ঘুরে ফিরে এসেছে। ‘আমার কবিতা এখন মর্গ থেকে সেলুন পেরিয়ে আরো কিছু দূরে ভ্রমণ করে চাইছে’- ভাস্কর চক্রবর্তীর হাত ধরে বাংলা কবিতায় এসেছে নতুন সব দৃশ্যকল্প। বাংলা কবিতার আপামর পাঠক ভাস্কর চক্রবর্তীকে মনে রাখবে তাঁর অসামান্য কবিতা পংক্তি, যিনিই বলতে পারেন ‘আমি বিষণ্ণতার ভেতর দিয়ে আনন্দের দিকে, মরুভূমির ভেতর দিয়ে গাছের দিকে, মৃত্যুর ভেতর দিয়ে জীবনের দিকেই তো চলেছি’।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত কবি না চলচ্চিত্রকার— এ প্রশ্নের মীমাংসা সহজ নয়। তাঁর খ্যাতি অবশ্যই চলচ্চিত্রকার হিশাবে, কিন্তু তাঁর কবিতার জগৎ যেন স্বপ্ন ও বাস্তবের এক অনাবিল উন্মোচন যা কোনোভাবেই উপেক্ষণীয় নয়, বরং বিশেষ মর্যাদার দাবি রাখে। সঞ্জয় ঘোষ বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের চলচ্চিত্র ও কবিতা উভয় দিক নিয়েই আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবি এক ব্যতিক্রমী স্বর, তেমনি কবিতার ক্ষেত্রেও এনেছেন এক নিজস্ব উচ্চারণ। কবিতা ও চলচ্চিত্রে তাঁর এই জার্নি যেন সমান্তরাল, অথচ পরিপূরক।
সঞ্জয় ঘোষ পঞ্চদশ নিবন্ধ লিখেছেন ‘চলো ছবি দেখি’ শিরোনামে। লেখার স্টাইলটা যেন তিনি ছোটোদের কাছে বলছেন পৃথিবীর বিখ্যাত শিল্পীদের ছবি ও আর্ট গ্যালারির কথা— যেমন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ‘মোনালিসা’, নিউইয়র্কে ‘মোমা গ্যালারি’ ও অ্যামস্টারডার্মে ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের নামাঙ্কিত গ্যালারি ইত্যাদি। পাবলো পিকাসোর বিখ্যাত ছবি ‘গুয়ের্নিকা’ নিয়ে সংক্ষিপ্ত ও মনোজ্ঞ আলোচনাটি এই গ্রন্থের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়।
শেষ নিবন্ধ ‘দিল্লির ন্যাশানাল গ্যালারি অব মডার্ন আর্ট’ নিয়ে। এই গ্যালারি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৫৪-র ২৯ মার্চ। আধুনিক ভারতীয় শিল্পের প্রায় সতেরো হাজার শিল্প নিদর্শনে এই গ্যালারি। বিদেশের গ্যালারির সঙ্গে তুলনা করলে এর বৈভব কিছু কম নয়। কিন্তু দর্শক কোথায়! এই গ্যালারি উজ্জ্বল করে আছে রবীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, নন্দলাল, বিনায়ক মাসোজি, যামিনী রায়, রামকিঙ্কর, বিনোদবিহারী, মকবুল ফিদা হুসেন, গনেশ পাইন প্রমুখ শিল্পীদের ছবি। লেখক সঞ্জয় ঘোষ অত্যন্ত সঠিক ভাবেই প্রশ্ন তুলেছেন, এই গ্যালারিতে রামকিঙ্কর আর নীরদ মজুমদার ছাড়া ক্যালকাটা গ্রুপের আর কোনো শিল্পীর ছবি নেই কেন? পরিতোষ সেন, গোবর্ধন আশ, চিত্তপ্রসাদের ছবি বাদ যায় কেন? গনেশ হালুই, রবিন মণ্ডল, সুহাস রায়, শ্যামল দত্তরায়ের ছবি কি পাকাপাকিভাবে এই গ্যালারির দেয়ালে ঝুলতে পারে না! এসব সত্ত্বেও, লেখক বলেছেন ভারতীয় শিল্পের এই তীর্থক্ষেত্র না দেখলে শিল্পপ্রিয় মানুষের শিল্পযাপন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
দুটি খণ্ডের আধারে সঞ্জয় ঘোষের ‘এবং চিত্রকলা’ গ্রন্থটি পাঠক মহলে সমাদৃত হবে কারণ লেখক অজানাকে জানার সেতুবন্ধন ঘটিয়েছেন মননশীল দক্ষতায়, তৈরি হয়েছে পৃথিবীর চিত্রকলার নতুন দিগন্ত। বেশ কিছু মুদ্রণ প্রমাদ ও তথ্যের পুনরাবৃত্তি রয়েছে যা সুসম্পাদনায় অনায়াসে এড়ানো যেত। আবারো বলি, ‘এবং চিত্রকলা’ গ্রন্থটি শিল্পকলা সম্পর্কিত একটি মূল্যবান বই।