• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৯ | জানুয়ারি ২০২৩ | গল্প
    Share
  • বহুরূপে : অনিরুদ্ধ সেন



    ঝড়বৃষ্টিটা একটু আচমকাই এল। তেমন কিছু পূর্বাভাষ ছিল না। তবে পুণে থেকে রওনা হওয়ার সময়েই অলক দেখছিল পশ্চিম আকাশে খণ্ড খণ্ড মেঘ জমছে। এক্সপ্রেসওয়ে ধরে ড্রাইভ করে মুম্বইয়ের দিকে এগোবার সময় সেগুলো বাড়তে বাড়তে দিগন্ত ঢেকে ফেলেছিল। আর লোনাওলা ছাড়াতেই শুরু হল ঘোর দুর্যোগ।

    অলকের কপালে চিন্তার রেখা। সূর্য সবে ডুবেছে। হাইওয়ের পাশে এখন যেটুকু আলো আছে, ঘাটের পাহাড়ি পথে পড়লে তাও মুছে যাবে। তার ওপর তুমুল বৃষ্টিতে সামনের ভিউ অস্পষ্ট। ঝড়ের ঝাপটা ছোট্ট গাড়িটাকে ট্রাক থেকে ঠেলে ফেলতে চাইছে। আর মাঝেমধ্যে আশপাশে বাজ পড়ে বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। এ আবহাওয়ায় এই পথে মানুষ দুর্ঘটনা না ঘটিয়ে গাড়ি চালায় কীভাবে?

    ভাবতে ভাবতেই ট্রাফিক স্লো। হাইওয়ে পুলিশ হাত দেখিয়ে সাইড নিয়ে ধীরে ধীরে চালাতে বলছে। সামান্য এগোতেই চোখে পড়ল দুর্ঘটনাস্থলটা। একটা ছোট কার, একপাশে কেমন তুবড়ে গেছে। ড্রাইভারের সিট থেকে অ্যাম্বুলেন্স কর্মীরা টেনে বের করার চেষ্টা করছে এক বিধ্বস্ত নারীদেহ। অপরাধী ট্রাকটা একটু দূরে গ্রেফতার হয়ে যানজট বাড়াচ্ছে।

    নাঃ, আর নেওয়া যাচ্ছে না। কোনওমতে বীভৎস দৃশ্যটার থেকে চোখ ফিরিয়ে স্পটটা পেরোল অলক। সামনের পাহাড়ি পথ বেয়ে নামার নার্ভ তার আর নেই। কোথাও জার্নি ব্রেক করতে হবে। কিন্তু করে কোথায়? লোনাওলা পেরিয়ে এসেছে। এখন খাণ্ডালার কয়েক মাইল পেরোলেই ঘাট, সেখানে কোনও এক্সিট নেই।

    ধীরগতিতে এগোতে এগোতে হঠাৎ চোখে পড়ল রাস্তার পাশে ব্যারিকেড ভেঙে তৈরি একটা 'জনতা' এক্সিট। সম্ভবত স্থানীয়রা হাইওয়ে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে বানিয়ে নিয়েছে। ওখান দিয়ে বেরোলেই হাইওয়ের প্রায় সমান্তরাল এক সরু পথ, এই অব্দি এসে কিছুটা বাঁয়ে বেঁকে গেছে। পথের বাঁপাশে বোধহয় শস্যখেত, তার ওপর সন্ধ্যার আবছায়া নেমে এসেছে। আর বৃষ্টিধারা ভেদ করে চোখে পড়ছে একটু দূরে একটা ছায়া ছায়া একতলা বাড়ি — যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। মুহূর্তে দ্বিধা কাটিয়ে অলক ভাঙা ব্যারিকেডের মধ্য দিয়ে গাড়ি গলিয়ে দিল।

    বাড়িটায় একটাও আলো জ্বলছে না। কেউ নেই, নাকি ঝড়ে কারেন্ট চলে গেছে? এবার চোখে পড়ল বাড়ির কম্পাউন্ডে পার্ক করা একটা গাড়ি। তাহলে নিশ্চয়ই কেউ আছে। অলক নিজের গাড়িটাও পার্ক করে নেমে দরজায় ধাক্কা মেরে চেঁচিয়ে বলল, "শুনছেন?"

    কোনও সাড়া নেই। বেপরোয়া ধাক্কার চোটে এক সময় দরজাটা নিজে থেকেই খুলে গেল। এবার অলক পেছন ফিরে কম্পাউন্ডে পার্ক করা অন্য গাড়িটার দিকে তাকাল আর মনে হল গাড়িটা কেমন যেন তেড়াবেঁকা। তাহলে কি এটা পরিত্যক্ত বাড়ি, আর গাড়িটাও তাই?

    যাই হোক, আর বিশেষ কিছু না ভেবে অলক ভেতরে পা বাড়াল। ঝড়বৃষ্টিতে অন্তত মাথা গোঁজার একটা ছাদ তো পাওয়া যাচ্ছে। তারপর আবহাওয়া একটু ভালো হলেই নয় কেটে পড়া যাবে।

    বাইরের ঘরে একটা কাউচ। তাতে ধুলোর আস্তরণ আছে কি না ভেবে লাভ নেই। অলক একটু ঝেড়েঝুড়ে বসে পড়ল। ইচ্ছে করছে ভেতরে গিয়ে দেখে আসে কেউ আছে কি না। কিন্তু পরিত্যক্ত বাড়িতে ইঁদুর বা অন্য প্রাণী থাকতে পারে ভেবে ইচ্ছেটা দমন করল। বাইরে বৃষ্টি থামার কোনও লক্ষণ নেই। কী করে ভাবছে, হঠাৎ একটু দূরে চাপা নারীকণ্ঠে ডাক, "অলক না?"

    চমকে পেছন ফিরে দেখল, ধূসর পোশাকে এক নারীমূর্তি। এবার একটা খিলখিল হাসি, "কীরে, চিনতে পারলি না?"

    "এষা!" অবাক বিস্ময়ে বলল অলক।

    "মুম্বই লিটফেস্টে যাচ্ছিস তো?"

    "কীভাবে জানলি?"

    "তুই ভাবতে পারবি না এখন আমি কত কী জানতে পারি।" উদাস ভঙ্গীতে বলল এষা। আচ্ছা, ঐ গাড়িটা তবে এষার! "কিন্তু তুই অমন ভাঙাচোরা গাড়ি নিয়ে, এই রাস্তায় –"

    "ও কিছু না। পথে একটু টোকা লেগেছিল, সামনে কোথাও সারিয়ে নেব। তা, তুই তো আমার জন্যেই মুম্বই যাচ্ছিলি, তাই না? দ্যাখ, তার আগেই কীভাবে দেখা হয়ে গেল।"

    ***

    সত্যিই এষার প্রতি এক অর্থহীন কিন্তু অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণে উইক-এন্ডের আয়াস অগ্রাহ্য করে অলক ছুটেছিল মুম্বইয়ের পথে।

    এষার সঙ্গে অলকের প্রথম দেখা বছর পাঁচেক আগে। অলক তখন এক নামকরা সর্বভারতীয় ইংরেজি সংবাদপত্রের পুণে অফিসে সাব এডিটর, ম্যাগাজিন সেকশন দেখাশোনা করে। আর এষা সদ্য জার্নালিজম পাশ করা এক 'ওয়ান্নাবি'। 'বং কানেকশন' খুঁজেপেতে সে অলককে ধরেছিল একটা এন্ট্রির জন্য। 'বং' অবশ্য নামেই। বাংলার বাইরে বর্ন অ্যান্ড ব্রট আপ ছেলেমেয়ে দুজন বাংলায় চলতা হ্যায় কিন্তু তুখোড় ইংরেজিতে।

    অলক বুঝেছিল, উচ্চাকাঙ্ক্ষী মেয়েটি তাকে ধরেছে স্রেফ উঁচুতে ওঠার মই হিসেবে, সম্পর্ক গড়ে ওঠার বিশেষ কোনও সম্ভাবনা নেই। তবু ছটফটে মেয়েটার টগবগে সান্নিধ্যটুকুই তার ভালো লাগত, তাই তাকে যথাসাধ্য সাহায্য করে খুশি রাখতে চাইত।

    এমন একটা অলিখিত মিউচুয়ালের মধ্য দিয়েই ওদের টাইম পাস চলছিল। কিন্তু তারপর দুজনেরই অজান্তে কী যেন ঘটে গেল। এই কেজো সম্পর্ক ছাপিয়ে দেখা দিল প্রথমে একটা হালকা টান, তারপর এক অবাক বিস্ময় আর সবশেষে টনটন বুক। এই অস্থায়ী পর্বে দুজন দুজনের কাছে দরকারে-অদরকারে চলে যেত। আর দুজনের বুকে জমা করা বোকামোর ইতিহাস, পেছনে তাড়া করা অন্ধকার আর বালসুলভ স্বপ্নগুলি পরস্পরের কাছে উজাড় করে দিত।

    ইকনমিকসে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট অলক বুঝত না একেই প্রেম বলে কিনা। বুঝলে বুঝতে পারত এষা, যার প্যাশন ছিল লেখক হওয়ার। কিন্তু সে কখনও মুখ খোলেনি। সে শুধু নানা 'জঁনর'-এর গল্প এন্তার এখানে-ওখানে পাঠাত আর আশার রামধনু আঁকত। সেগুলোর দু-চারটে মনোনীত হত, বাকিগুলি মার খেত। সাহিত্যবোদ্ধা না হয়েও তাকে অনবরত আশা জুগিয়ে যাওয়া ছিল অলকের অন্যতম দায়িত্ব।

    তারপর এই পর্ব যেমন হঠাৎ শুরু হয়েছিল তেমন হঠাৎ শেষও হয়ে গেল। এষার একটা গল্প এক নামী আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সেকেন্ড হল।

    এষার সামনে হঠাৎ অনেকগুলি দরজা খুলে গেল। অনেক জায়গার থেকে সাদর আমন্ত্রণ আসতে লাগল। অতীতে যেসব সম্পাদক দুঃখপ্রকাশের সৌজন্যটুকুও দেখাননি তাঁরা লেখা পাঠানোর জন্য ঝোলাঝুলি করতে লাগলেন। উৎসাহ পেয়ে এষাও হাত খুলে লিখতে লাগল। শিগগিরই সে ইন্ডিয়ান ইংলিশ লিটারেচারের খাসমহলে জায়গা করে নিল।

    আর অলক এখনও সাব এডিটরের ডেস্কেই ঘষছে। দেশ-বিদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু প্রবন্ধ লেখে। তাদের কাগজ ছাড়া আর দু-চার জায়গায় ছাপা হয়, ব্যস।

    এষা অবশ্য অলককে কিছু বলেনি। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহের স্বাভাবিক নিয়মেই তারা দূরে সরে যাচ্ছিল। এ নিয়ে প্রথম প্রথম অলক কিছু অনুযোগ করলে এষা আহত হয়ে বলত, "তুই কি চাস না আমি বড় হই? তুই কি আমার প্রতি জেলাস?"

    "না, তা কেন!" অলক বলত। যা মুখে বলত না তা হচ্ছে, "শুধু আমাকে একটিবার জানিয়ে দে যে তুই আর –"

    না, এষা কিছু জানায়নি। তখন নয়, এখনও না। তবে অলকের সঙ্গে তার দেখাসাক্ষাৎ, ফোনালাপ ও সর্বশেষে চ্যাটও কমতে কমতে এখন কার্যত শূন্য — যদিও অনবরত হিল্লিদিল্লি করে বেড়ানো এষার স্থায়ী ঠিকানা এখনও পুণেতেই।

    তা সত্ত্বেও অলক এষাকে মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি। তাকে এক সূক্ষ্ণ দুরাশার সুতোয় ঝুলিয়ে রেখেছে। মাঝে মাঝে এষার প্রোফাইল দেখে। সেখানে 'ম্যারিটাল স্টেটাস'এ ম্যারেড, সিঙ্গল, ইন রিলেশনশিপ কিছুই লেখা নেই।

    তবে সম্প্রতি যখন অলক দেখল এক বিখ্যাত লিটফেস্ট-এ এষাকে সম্বর্ধনা দেওয়া হবে, কী ভেবে ঠিক করে ফেলল সেও ফেস্টে যাবে আর যেভাবে হয় এষার মুখোমুখি হয়ে ব্যাপারটার ফয়সালা করে ফেলবে। আর্জি নিয়ে সে চিফ এডিটরের দরবারে হাজির হল।

    এডিটর একটু ইতস্তত করে বললেন, "উইক-এন্ডে তো তোমার বিশেষ কাজ নেই, যেতেই পারতে। কিন্তু মুম্বই অফিস যেখানে ফেস্ট কভার করতে বিবেক মাথুরের মতো লোককে পাঠাচ্ছে সেখানে আরেকজনকে উইথ এক্সপেন্স পাঠাতে হেড অফিস রাজি হবে কেন?"

    "আপনি শুধু প্রেস কার্ডটার ব্যবস্থা করুন। যাতায়াত, থাকাখাওয়ার দায়িত্ব আমার নিজের।"

    "বেশ।" বলে এডিটর অলকের পিঠে স্নেহের হাত রেখে বলেছিলেন, "এষাকে তুমি এখনও ভুলতে পারোনি, তাই না? টেক ইট ইজি, মাই বয়। অনেক কিছু ভুলতে হয়।"

    "এই শেষবার, স্যার।" ধরা গলায় বলে বেরিয়ে এসেছিল অলক।

    ***

    "তুই তো জানতে চাইছিলি, আমি তোকে ভালোবাসি কিনা?"

    অলক চুপ। এষা ফিসফিসিয়ে বলল, "ইডিয়ট! সবকিছু কি ক্লাসিফায়েড অ্যাড দিয়ে বলতে হয়? দ্যাখ, এখানে কীসের গন্ধ পাস।"

    এষার বৃষ্টিভেজা স্তন থেকে ভেসে আসছে এক ঝিম ধরানো মিষ্টি গন্ধ। সে এবার অলককে জড়িয়ে ধরে বলল, "নে, খুলে দ্যাখ, খুঁড়ে দ্যাখ, ভালোবাসা পাস কিনা।"

    এক সর্পিণীর নিবিড় আলিঙ্গন, এক মহুয়ার মাতাল করা আমেজ নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে। তবু অলক শেষ প্রতিরোধের চেষ্টায় বলল, "কিন্তু এখানে, এই সময় –"

    "জীবনে সময় বড় কম, রে। আরও কম ভালোবাসার আয়ু। কে জানে, আজই হয়তো পৃথিবীর শেষ দিন।"

    বলতে না বলতেই খুব কাছে বাজ পড়ল, প্রায় মাথারই ওপর। বুকের চমক কাটলে অলক বুঝল তারা দুজনেই বেঁচে আছে, শুধু পরস্পরকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে। তারপর তারা আরও নিবিড় হতে হতে, আরও কাছে পৌঁছোতে পৌঁছোতে এক সময় গভীর আচ্ছন্নতায় ডুবে গেল।

    হঠাৎ অলকের চেতনায় ভেসে এল এক নারীকণ্ঠের বিলাপ, "হা তো নাহি, তো নাহি!" এ তো সে নয়, সে নয়! তারপর আবার, "মগ মলা কায় ওয়াটলঁ কি আজ মী মোকলা হউন?" তবে কেন মনে হল যে আজ আমি মুক্তি পাব?

    কে? অলক চেঁচিয়ে বলতে গেল, "বাই, তুমহি কুঠে আহাত?" মেয়ে, তুমি কোথায়? কিন্তু তার গলা দিয়ে স্বর বেরোল না। তবে এবার চেতনা ফিরে এল। প্রথমেই পাশ হাতড়ে এষার কমনীয় অস্তিত্ব খুঁজল, পেল না।

    তাহলে এসব স্বপ্ন, সবটাই? কী ভেবে সে বাইরে উঁকি মারল। নিকষ অন্ধকারে অন্য গাড়িটা চোখে পড়ল না। তবে কি এষা সত্যিই এসেছিল, আবার চলেও গেছে?

    কিন্তু এই আবহাওয়ায়, অন্ধকারে, পাহাড়ি পথে একা একা ঐ তোবড়ানো গাড়ি নিয়ে? মেয়েটা কি পাগল? আবহাওয়ার কথা মনে পড়ায় সে তাকিয়ে দেখল ঝড় থেমেছে। বৃষ্টি না থামলেও কমেছে, তবে আকাশ থমথমে। প্রকৃতি সামান্য বিরতি দিয়েছে। এই সুযোগে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ঘাটের পাহাড়ি পথ পেরিয়ে যেতে পারলে আর চিন্তা নেই। বাকি রাস্তাটুকুতে বৃষ্টিবাদল হলেও তেমন সমস্যা হবে না। এই নিঝুমপুরীতে গা কেমন ছমছম করছে। এষা নয় সত্যি হল, ঐ নারীকণ্ঠটা? নিছক স্বপ্ন?

    না, আর ভেবে কাজ নেই। অলক চটপট গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। আর সত্যিই ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ঘাট পেরিয়ে গেল। এতক্ষণে মোবাইলে সিগনাল এসেছে। রাত দশটায় নয়, পৌঁছোতে পৌঁছোতে দুটো বাজবে জানিয়ে তার হোস্ট সলিলদাকে একটা মেসেজও করে দিল।

    ***

    শুতে রাত হলেও সকাল সকাল উঠতে হল। দশটা থেকে ফেস্ট, তার আগেই গিয়ে মজুত থাকতে হবে। কাল রাতের বিচিত্র অভিজ্ঞতার স্বাদ এখনও দেহেমনে লেগে রয়েছে। আবার তার সঙ্গে একটা চাপা আশঙ্কা, মেয়েটা ঠিকমতো পৌঁছেছে তো? অত রাতে ঐ পথে ঐ গাড়ি নিয়ে?

    ঘাঁতঘোত জানাই ছিল। দশটার একটু আগে সোজা গিয়ে হাজির হল এষার দেখভালের দায়িত্বে থাকা ছেলেমেয়েগুলির কাছে। বলল, "এষা ম্যাডাম এসেছেন? আমি ওঁর বহুদিনের কলিগ-ফ্রেন্ড। অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে, উনি জানেন।"

    একটি ছেলে চিন্তিতমুখে বলল, "ম্যাডামের আসার তো কথা ছিল কাল রাতেই। কিন্তু এখনও এসে পৌঁছোননি, আমাদের সঙ্গে যোগাযোগও করেননি। ওঁর মোবাইলও সুইচড অফ।"

    "ওঁর কীভাবে আসার কথা ছিল, ট্রেনে না ফ্লাইটে? কালকের ঝড়বৃষ্টিতে যদি কোথাও আটকে পড়ে থাকেন?" অলক না জানার ভাণ করল।

    "সেটাই তো চিন্তার বিষয়। উনি বলেছিলেন নিজে ড্রাইভ করে আসবেন। সেই সময় ঝড়বৃষ্টি হয়েছে, পুণে এক্সপ্রেসওয়েতে অ্যাক্সিডেন্টও হয়েছে।" বলল একটি মেয়ে।

    অলকের গলা শুকিয়ে গেল। বলল, "অ্যাক্সিডেন্ট, কোথায়?"

    "লোনাওলা আর খাণ্ডালার মধ্যে। এখনও ডিটেইলস খবর আসেনি, তবে বোধহয় একটা কার আর ট্রাকের সংঘর্ষ।"

    "লোনাওলা আর খাণ্ডালার মধ্যে? তবে এষা নয়।" অলক স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।

    "কেন স্যার, আপনি দেখেছেন?"

    "হ্যাঁ, আমি তো তারপরই ওখান দিয়ে আসছিলাম। ট্র্যাফিক স্লো হয়েছিল।"

    বলেই অলকের মনে পড়ল, দোমড়ানো কার থেকে বের করা মৃতদেহটা সে ভয়ে তাকিয়ে দেখেনি। হঠাৎ তার মাথায় বিদ্যুৎঝলকের মতো খেলে গেল এক অ-সম্ভাবনার লাল সঙ্কেত। প্রথমে রাস্তায় একটা দুর্ঘটনাগ্রস্ত গাড়ি, তাতে এক মহিলার মৃতদেহ। তারপর এক অন্ধকার পোড়োবাড়িতে এক দোমড়ানো গাড়ি। তারপর এষার আচমকা আবির্ভাব, কামোন্মত্ত আচরণ। তার হেঁয়ালিভরা সব উক্তি – আমি এখন অনেক কিছু জানতে পারি, ভালোবাসার সময় বড় কম আর আজই যদি পৃথিবীর শেষ দিন হয়? সবশেষে, এষার আবার আকস্মিক অন্তর্ধান আর ধরার সীমার বাইরে চলে যাওয়া। তাহলে কি — সব মিলিয়ে এক সৃষ্টিছাড়া সম্ভাবনা বিবমিষা হয়ে খাদ্যনালী বেয়ে ঠেলে উঠতে চাইছে। কুল কুল ঘাম ঝরছে। টয়লেট কোথায় জিগ্যেস করবে ভাবছে। এমন সময় ডায়াসের বাঁদিক দিয়ে দুষ্টু হাসি মুখে ঢুকল এষা।

    ছেলেমেয়েগুলো মুখ টিপে হাসছে। একজন বলল, "স্যার, আমাদের দোষ নেই। গেটের কাছে আপনাকে দেখে ম্যাডাম বললেন আমার এক পুরনো দোস্ত আসছে, একটু লেগ পুল করব। ম্যাডাম তো আজ আর্লি মর্নিং ফ্লাইটে এসেছেন।"

    এষার মুখের দিকে তাকিয়ে অলক বৃথাই বুঝতে চেষ্টা করল কোনটা সত্যি, কোনটা মিথ্যে। সে অলকের পাশে বসে উচ্ছ্বল ভঙ্গীতে বলে যাচ্ছে, "ভাগ্যিস তুই এলি। কতদিন পর দেখা হল, বল তো?" তারপর আড়চোখে ঘড়ি দেখে বলল, "এখন ঘণ্টাখানেক আমি ফ্রি, গুছিয়ে গল্প করা যাবে। তারপর, নতুন কিছু লিখলি?"

    এষার চলনেবলনে কাল রাতের কোনও ছাপ নেই। তবে অলক ইতিমধ্যে খেয়াল করেছে, ওর গলায় মঙ্গলসূত্র বা বাঁহাতের অনামিকায় আংটি নেই।

    কিছুটা বিভ্রান্তির মধ্যেই অলক ধীরেসুস্থে কথাবার্তা চালাতে লাগল। এষার শরীরী ভাষায় ভবিষ্যতের স্বপ্ন ঠিকরে বেরোচ্ছে। এভাবে আধঘণ্টাটাক কাটার পর সেখানে উঁকি মারল একজন স্মার্ট, বছর ত্রিশের যুবক আর উচ্ছ্বসিত এষা ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। তারপর তাকে হাত ধরে টানতে টানতে অলকের সামনে নিয়ে এসে বলল, "মীট শচীন, মাই –"

    অলকের বুকে রক্তোচ্ছাস, মুখ লাল। কোনওমতে হাত এগিয়ে দিয়ে 'নাইস টু মীট ইউ' গোছের কিছু একটা বলে ভাবছে কী অজুহাতে এখান ত্থেকে পালানো যায়। তখনই কী বরাত, অজুহাতটা জুটে গেল।

    "এক্সকিউজ মী ফর অ্য মিনিট এষা, আমার নিউজ ডেস্ক থেকে একটা ইমপরটেন্ট নিউজ ফ্ল্যাশ। একটু দেখেই আসছি।"

    ডায়াসের পাশের নিরালায় দাঁড়িয়ে অলক ওর কলিগ রামের পাঠানো নিউজফ্ল্যাশটা নিয়ে গভীর চিন্তামগ্ন, হঠাৎ কাঁধে একটা হাত। এষা।

    "কী রে, আমার পাবলিশারের সঙ্গে তোর আলাপ করিয়ে দিচ্ছিলাম, হঠাৎ পালিয়ে এলি যে? ছেলেটা খুব প্রফেশনাল আর ভদ্র। তা, তুইও তো নাকি ভারত আর পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে কীসব গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ লিখিস, বই করে ছাপাবার চিন্তা নেই?"

    "নে, পড়।" অলক তার ট্যাবলেটটা এষার হাতে তুলে দিল।

    "কাল ঝড়বৃষ্টির সময় খাণ্ডালায় এক পরিত্যক্ত বাড়িতে এক ব্যক্তির বজ্রপাতে মৃত্যু হয়েছে। অনুমান, দুর্যোগ দেখে ঐ মোটরচালক এক্সপ্রেসওয়ের পাশের বাড়িটিতে আশ্রয় নিয়েছিল। তখন বাড়ির একাংশে বজ্রপাত হওয়ায় সম্ভবত তড়িতাহত হয়ে তার মৃত্যু হয়েছে।

    ঐ বাড়িটির একটি ইতিহাস আছে। ওটি ছিল পুণের এক ভদ্রলোকের আউটহাউস। বিপত্নীক ভদ্রলোক তাঁর মেয়েকে নিয়ে ছুটিছাটায় ওখানে আসতেন। একদিন তিনি মেয়েকে বাড়িতে রেখে লোনাওলায় কিছু কাজে গিয়েছিলেন। এই সুযোগে কোনও দুষ্কৃতী মেয়েটিকে ধর্ষণ করে খুন করেছিল। বাবার নিষেধ সত্ত্বেও মেয়েটি দরজা খুলে দিয়েছিল দেখে পুলিশের অনুমান, দুষ্কৃতী তার পূর্বপরিচিত। তার পুণের পাড়ার ও কলেজের কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে পুলিশ সন্দেহক্রমে জেরা করে আবার প্রমাণাভাবে ছেড়ে দিয়েছিল।

    এই ঘটনার আঘাতে মেয়েটির বাবার মানসিক বৈকল্য দেখা দিয়েছিল। বাড়িটিও সেই থেকে অযত্নে পড়ে আছে। মধ্যে কিছু দুষ্কৃতী ওখানে আস্তানা গেড়েছিল। কিন্তু কোনও অজানা কারণে, হয়তো পুলিশি তৎপরতায় তারা স্থানটি পরিত্যাগ করে।

    কাকতালীয়ভাবে, মৃত যুবকটি মেয়েটির হত্যায় সন্দেহভাজনদের একজন। আশ্চর্যের ব্যাপার, মৃতের অবিকৃত মুখে তৃপ্তির ছাপ ছিল। হয়তো বজ্রপাতের আগে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল।

    বজ্রপাতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিত্যক্ত বাড়িটিকে মিউনিসিপ্যালিটি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।"

    "তো, কী?" এক নিশ্বাসে রিপোর্টটা পড়ে এষা অবাক হয়ে জিগ্যেস করল।

    "ন্যাকা! ঐ যে কাল রাতে –"

    "কাল রাতে, কী ব্যাপার?" এষা চোখ কপালে তুলল।

    তার মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে অলক বলল, "এষা, তুই এ অব্দি আমাকে ক'বার ব্লাফ দিয়েছিস?"

    আকাশের দিকে চোখ তুলে এষা বলল, "অলক, তুই এ অব্দি আমাকে ক'বার চুমু খেয়েছিস?" তার বাঁকা ভুরু আর চোখের ঝিলিকের মানে খোঁজার চেষ্টা করতে করতে ক্লান্ত অলক শেষে হাল ছেড়ে দিল। সব মিলিয়ে, ব্যাপারটা কেমন ঘেঁটে ঘ হয়ে গেল। আর এষাও ঝুলেই রইল।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments