• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৯ | জানুয়ারি ২০২৩ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • চিড়িয়াখানায় যাব না : অচিন্ত্য দাস



    যে সময়ের কথা হচ্ছে সে সময়ে কোলকাতায় হুটহাট করে ইলেক্ট্রিক চলে যেত। আর একবার গেলে তিনি যে কখন ফিরবেন তা কেউ জানত না। দিনটা ছিল শনিবার। সন্ধে সাতটা নাগাদ তিনি মানে ইলেক্ট্রিকবাবু চলে গেলেন। সন্ধে বেলা আলো চলে গেলে বড়রা বিরক্ত হতেন। প্রথম প্রথম ছোটরা মজা পেত কারণ পড়তে বসতে হতো না। কিন্তু সে সুখ বেশি দিন টেকেনি। এমারজেন্সি লাইট নামে এক যন্ত্র এসে গেল ঘরে ঘরে। সারাদিন সে ইলেক্ট্রিক খেত আর আলো চলে গেলেই ফস করে জ্বলে উঠত। সেই আলোতে আবার অঙ্ক করো রে, ইতিহাস মুখস্থ করো রে।

    ঘরের বড় আলো চলে গিয়ে এমারজেন্সি লাইট জ্বলে উঠতেই সুকু আর টুনু বাবাকে বলল আজ আর তারা পড়তে বসবে না। সুকুর চলছে সেভেন, আর তার বোন টুনুর থ্রী। বাবা বলতে যাচ্ছিলেন সন্ধে বেলায় পড়া নিয়ে না বসলে সব ভুলে যাবে ...

    এমন সময় মনে হল স্বয়ং ভগবান এসে সুকু-টুনুকে রক্ষা করলেন। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ।

    এমেরজেন্সি লাইট নিয়ে সুকু মানে সুকুমার দরজা খুলতে গেল। পেছনে টুনু। দরজা খুলে দুজনেই হকচকিয়ে গেল। দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন একজন ধুতি-পাঞ্জাবি পরা দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক। ইনি কে? শেষে বাবা এসে চিনতে পারলেন – ইনি তো বাবার ছোট ভাই, মানে সুকু আর টুনুর কাকা হন।

    কাকাবাবু সংসার করেননি। ভবঘুরে ধরনের মানুষ। বহু জায়গায় ঘোরার অভিজ্ঞতা। কিছুক্ষণের ভেতরেই ছোটদের সঙ্গে ওনার গল্পসল্প জমে উঠল। সুকু বলল “কাকাবাবু, কাল আমাদের মাসতুতো ভাই-বোন আর তাদের বন্ধুরা আসবে। আমরা সকলে দল বেঁধে চিড়িয়াখানা যাচ্ছি। তুমি থেকে যাও না, তুমিও যাবে সঙ্গে!”

    “না রে, আমার কালকের ভোরের ট্রেন ধরতে হবে। তার চেয়ে বরং তোদের একটা ঘটনা বলি, শুনলে গল্পের মতোই মনে হবে।”

    সুকু আর টুনু কাছ ঘেঁষে বসে বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ গল্প শুনব।”

    “এই ঘটনার প্রমাণ আমার পকেটেই আছে, ওটা তোদের দিয়ে যাব বলেই এসেছি। বাবা আর মাকে ডাক তো একবার।”

    বাবা, মা এলে কাকাবাবু পকেট থেকে কাগজের মোড়ক খুলে একটা চকচকে পয়সা বার করলেন। মার হাতে দিয়ে বললেন “বৌদি, এটা মোগল আমলের মোহর – এক জায়গা থেকে পেয়েছিলাম। তবে এ নিয়ে আমি আর কী করব বলো, তুমিই রাখো।”

    সুকু আর টুনুও হাতে নিয়ে দেখল। দেখতে ছোট হলেও বেশ ভারী। সোনার তো। দুপিঠে অজানা ভাষায় কীসব লেখা আছে।

    বাবা ওটা আলমারিতে তুলে রাখলেন আর মা গেলেন রান্নার দিকে। কাকাবাবু সুকু আর টুনুকে বললেন, “এই মোহরটা কোথায় কী করে পেয়েছিলাম সেই ঘটনাটাই তোদের বলি। আর এই যে তোরা চিড়িয়াখানা যাবার কথা বলছিলি, ঘটনাটার সঙ্গে তারও একটা সম্পর্ক আছে।”

    এমারজেনসি লাইটের তেজ কমে এসেছে। আধো-অন্ধকার ঘরে গল্প শোনার মজাই আলাদা। দেয়ালে অদ্ভুত সব ছায়া পড়ে, সেগুলোকেই মনে হয় গল্পের মানুষজন, পশুপাখি। টুনু দাদার কোল ঘেঁষে বসে বলল, “ভূতের গল্প নয় তো...”

    কাকাবাবু বললেন, “না রে না, ভূত নেই। রাজা, বনজঙ্গল, হরিণ এসব আছে। বলব?”

    টুনু মাথা নেড়ে সায় দিতে কাকাবাবুর গল্প শুরু হলো।

    “তখন মধ্যপ্রদেশে একটা পুরোনো রাজবাড়িতে কাজ করতাম। দেশ স্বাধীন হবার পর ছোটো ছোটো রাজ্যগুলি সব ভারত সরকারের এক্তিয়ারের মধ্যে নিয়ে আসা হয়েছিল। তাই রাজার বংশধরেরা আইন অনুযায়ী কেউ আর রাজা ছিলেন না। আমি যেখানে কাজ করতাম, সে রাজামশায় বেশ খারাপ অবস্থার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন। শরীর অসুস্থ, প্রায় শয্যাশায়ী। তার ওপর অনেক টাকা ধার বাজারে। রাজাগিরি তো আর করা যাবে না, ধার শোধ না করতে পারলে পাওনাদারেরা ছিঁড়ে খাবে।

    “রাজামশায়ের ছেলের নাম ছিল শনক। আমারই বয়সি হবে। শনক আর আমাকে রাজা একদিন ডেকে পাঠালেন। গেলাম। মনে হলো, কোনো একটা গোপন কথা বলতে তিনি আমাদের ডেকেছেন। ঠিকই আন্দাজ করেছিলাম।

    “বালিশে আধশোয়া হয়ে রাজাবাবু বললেন – চার-পাঁচ জন বিশ্বস্ত লোক নিয়ে তোমরা পুব দিকের জঙ্গলে যাবে। সেখানে বড় দিঘিটা দেখেছ তো তোমরা – তার পাড়ে এক জায়গায় একটা শিবলিঙ্গের মতো পাথর আছে। সেটা সরিয়ে ফেললে একটা লোহার বাক্স পাবে, ভেতরে আকবরী মোহর আছে বেশ কয়েকটা। সেই ছেলেবেলায় দাদামশায় আমাকে দেখিয়েছিলেন। দাদামশায় চিকিৎসা করতে জানতেন, এক ডাকাতকে প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন বলে সে মোহরগুলো দিয়েছিল। দস্যুর সোনা বলে দাদামশায় সেগুলো ঘরে রাখেননি। বলেছিলেন কোনোদিন যদি খুব খারাপ অবস্থায় পড়িস তাহলে এ দিয়ে নিজেকে বাঁচাবি। তোরা তো বুঝতেই পারছিস, আজ সেই অবস্থা এসেছে আমার।

    “শনক আর আমি অবাকই হলাম। এ হয় না কি! অত বড় জলাশয়, তার পাড়ে অজস্র পাথর থাকবে। এইটুকু সূত্র দিয়ে সে জিনিস খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। কাজটা করব কী করে?

    “আমরা জিগেস করলাম আর কোনো চিহ্ন বা হদিস আছে কি না।

    “উনি বললেন – হরিণডাঙ্গা।

    “শনক বলল – ও নামে তো কোনো গ্রাম আছে বলে শুনিনি।

    “রাজাবাবু বললেন – শোনার কথাও নয়। ওইখানটায় খুব ভালো ঘাস জন্মায়, মানে সে ঘাস হরিণ খুব পছন্দ করে। দাদামশায় বলেছিলেন – এখানটায় প্রায়ই হরিণের পাল দেখা যায়। চল রে, আমরা এ জায়গাটার নাম রাখি হরিণডাঙ্গা। এ নাম আর কেউ জানে না, কী করে যেন আমার মনে রয়ে গেছে।

    “মনে মনে বললাম – ধুস, এ দিয়ে কোনো কাজ হবে না।

    “যাই হোক, জোগাড়যন্ত্র করা হলো। এ জঙ্গলে বাঘ আছে। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র বলতে একটা বহু পুরনো বন্দুক। দরকার পড়লে সে বন্দুক চলবে কি না কে জানে। বাঘ এলে বন্দুকটা লাঠির মতো ব্যবহার করে বা ঢোল বাজিয়ে তাকে তাড়ানো যাবে কিন্তু মোহর পাওয়া নিয়ে শনক বা আমার কারোরই বিশেষ ভরসা হচ্ছিল না। সে কোনকালে হরিণ ঘাস খেত – সে হরিণ, সে ঘাস কি এখনো আছে? আর হরিণ তো অনেক জায়গাতেই ঘাস খেতে পারে।

    “আমি আর শনক চার জন লোক নিয়ে ‘অভিযান’ শুরু করলাম। ঠিক যা ভেবেছিলাম তাইই হলো। কাকভোরে বেরিয়ে সেই বিকেল অবধি কিস্যু খুঁজে পেলাম না। ফিরে আসার সময় মনে হলো যে আমরা বরং ওদিকের টিলাতে উঠে চারিদিকটা একবার দেখি। ওখান থেকে প্রায় পুরো জায়গাটা দেখা যেতে পারে। বাঘ আসেনি, তাই বন্দুক কাজে লাগেনি। তবে আমার মনে হলো শনকের ঝুলিতে অন্য যে যন্ত্রটা রয়েছে, সেটা কাজে লাগলেও লাগতে পারে। বললাম তুমি তো দূরবীন নিয়ে এসেছ। উঁচু জায়গা থেকে ওটা ব্যবহার করা যাক, যদি কিছু চোখে পড়ে।

    “মোহর পাওয়া যাবে কি না তখনও জানি না, তবে টিলার ওপর থেকে গোধূলিবেলার দৃশ্য বড় সুন্দর লাগল। যেন পটে আঁকা ছবি। দিঘিতে কতগুলো সারস আর বক তখনও অপেক্ষা করে রয়েছে। যদি আরও দু-একটা মাছ ধরা যায়। অরণ্যে ছায়া পড়ছে – সে ছায়া ক্রমশ ঘন হয়ে দিনের সব ছবি মুছে দেবে নিঃশেষে। এমন সময় দেখলাম, একটা মাঠের মতো জায়গায় কতগুলো চিতল হরিণ যেন চরে বেড়াচ্ছে। দূরবীনটা সেদিকে ভালো করে তাক করা হলো। সে কবেকার একচোখো দূরবীন। তবে সেটার ভেতর দিয়ে যে বাড়তি দৃষ্টিটুকু পাওয়া গেল তাতে মনে হলো ওই মাঠে সবুজ ঘাস আছে। আর কিছু কালো কালো মসৃণ পাথরও যেন দেখা যাচ্ছে। আর কী সুন্দর লাগছিল যে হরিণগুলোকে! ওটাই কি দাদামশায়ের হরিণডাঙ্গা?

    “এখনও আলো আছে, মেরেকেটে আর ঘন্টা দেড়েক হয়তো থাকবে। তার মধ্যে যা করার করতে হবে। আমরা ঠিক করলাম পা চালিয়ে হরিণডাঙ্গায় যাওয়া যাক। ওই পাহাড়-জঙ্গলে যত তাড়াতাড়ি পারা যায় হাঁটলাম। তবু আধ ঘন্টার ওপর লেগে গেল পৌঁছোতে। একটু দূরে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখলাম হরিণগুলো এক মনে ঘাস খেয়ে যাচ্ছে। আমরা আর একটু এগোতেই তারা টের পেয়ে নড়াচড়া শুরু করল। তারপর যেই আমরা ঘাসের জমিতে নেমেছি অমনি সব কটা দৌড়ে পালাল।

    “না, একটু ভুল বললাম। একটা বাচ্চা হরিণ ভয় পেয়ে উল্টো দিকে ছুটেছিল, সেটা পালাতে পারল না। আমাদের লোকগুলো তাকে ঘিরে ফেলল।

    “আমার আর শনকের হরিণ ছানার দিকে মন ছিল না, আমরা শিবলিঙ্গের মতো কালো পাথর কোথাও দেখা যায় কি না খুঁজছিলাম। হরিণের পাল তো আমাদের জায়গাটা চিনিয়ে দিয়েছে, এবার যদি ভাগ্য ভালো থাকে...

    “শনক হঠাৎ বলে উঠল, ‘দেখ দেখ ওই পাথরটা দেখ! চল, পাথরটার কাছে গিয়ে দেখা যাক। আকৃতিটা তো শিবলিঙ্গের মতোই।’

    “আমরা দুজন এগিয়ে গেলাম। হরিণশিশুটি ধরা পড়ে গেছে। হরিণের বাচ্চাটাকে জাপটে ধরে বাকি লোকেরা পেছন পেছন এল।। জানিস, সেই লোহার বাক্সটা আমরা কিন্তু সত্যিই পেলাম। আমার কাছে একটা বড় শাবল ছিল। সেটা দিয়ে মাটি-পাথর সরিয়ে বাক্সটা বার করলাম। দিনের আলো তখন যায় যায় – অস্তসূর্যের আলোতে আমি আর শনক দেখলাম লোহার বাক্সতে বেশ কয়েকটা সোনার মোহর! গুনে দেখা গেল সতেরোটা!

    “সন্ধের পরে আমরা বিজয়-বিক্রমে বাড়ি ফিরলাম। সঙ্গের লোকেরা মোটা পারিশ্রমিক পেল আর আমাকে একটা মোহর দিলেন রাজামশায়। বললেন, ‘সাবাস, ভাই, সাবাস। তোমরা একটা বিরাট কাজ করেছ। আর আমার ভাবনা নেই। এতগুলো মোহরে রাজবাড়ির দেনা মিটে যাবে। এবার শান্তিতে মরতে পারব।’

    “রাজবাড়ির লোকেরা যারা অভিযানে যায়নি, তারাও দেখলাম খুশিতে ডগমগ। মোহরের খবর না পেলেও হরিণের বাচ্চাটা তো দেখেছে। হরিণের মাংস দিয়ে আজ রাতে দারুণ ভোজ হতে চলেছে। যারা গিয়েছিল তারা তো ডবল খুশি। বেশ কিছু পারিশ্রমিক পকেটে এসেছে আর সঙ্গে হরিণের মাংস ফাউ!

    “এই হরিণগুলো জন্যই আমরা মোহর উদ্ধার করতে পারলাম, আর তাদের একটা শিশু পালাতে পারেনি বলে তাকে কেটে খেয়ে ফেলতে হবে। এই হলো মানুষের স্বভাব!

    “রাজামশায় চাকা-লাগানো চেয়ার গড়িয়ে গড়িয়ে বাইরে এলেন। মোহর পাওয়া গেছে বলে তিনি আজ খুবই খুশি। হরিণশিশুর ব্যাপারটা শুনে বললেন, ‘না, এটাকে খাওয়া চলবে না। বাগানের বাইরে যে গরাদ লাগানো খাঁচাটা আছে সেটা অনেক দিন খালি পড়ে আছে। এ সেখানে থাকবে। খাঁচায় একটা হরিণ থাকলে রাজবাড়ির শোভা বাড়বে। ভোজের অন্য ব্যবস্থা করে দেব।’

    “লোকেরা একটু নিরুৎসাহ হলো বটে কিন্তু এসব রাজ্যে রাজার কথা অমান্য করার সাহস কারোর থাকে না। রাজাবাবু যা বললেন সেই মতো হরিণশিশুটিকে বাগানের গরাদ দেওয়া খাঁচায় রাখা হলো।

    “অভিযান সফল, একটা মোহর পুরস্কার পেয়েছি আর হরিণটাও বেঁচে গেল। কিন্তু সত্যি কথা বলতে আমি মনে মনে খুশি হতে পারছিলাম না। একটা মন-খারাপের ভাব আমাকে বার বার ছেয়ে ফেলছিল। কেন এরকম লাগছে? গোধূলির আলোয় খোলা আকাশের নিচে একপাল হরিণের ঘাস খাওয়ার দৃশ্যটাই কি এর কারণ?সারাদিনের ক্লান্তিতে সেদিন শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু পরের দিন …”

    ইলেক্ট্রিকবাবু যেমন হঠাৎই চলে গিয়েছিলেন তেমনিই আচমকা ফিরে এলেন। দপ করে আলো জ্বলে উঠতেই গল্পের সুরটা কেটে গেল। কাকাবাবু গল্প থামিয়ে বললেন – “বৌদি, একটু চা দেবে…”

    চা বোধহয় তৈরিই ছিল। চায়ে চুমুক নিয়ে কাকাবাবু শুরু করতে যাবেন, সুকু বলল, “দাঁড়াও একটু। তারপর গিয়ে ঘরের আলোটা নিবিয়ে এলো। অন্ধকার ছায়াছায়া ঘরে গল্প জমে ভালো।”

    কাকাবাবু বললেন, “আলোটা নিবিয়ে ভালোই করেছিস। কারণ এবার যা হবে তা নিশুতি রাত্তিরে, কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকারে…

    “হ্যাঁ, যা বলছিলাম। দেউড়ির ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারোটা বাজল। আমি ঘাপটি মেরে একটু অপেক্ষা করলাম। যখন মনে হলো কেউ জেগে নেই তখন অন্ধকারের মধ্যে পা টিপে টিপে বেরিয়ে পড়লাম। সঙ্গে নিলাম আমার শাবলটা। মুখে একটা কালো কাপড় জড়িয়ে নিয়েছিলাম যাতে কেউ দেখে ফেললেও চিনতে না পারে। তখন সবে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঠেছে, চাঁদের ক্ষীণ আলোতে চুপি চুপি এলাম সেই খাঁচাটার সামনে। যা করার খু-উ-ব সাবধানে করতে হবে। এই সব ছোটোখাটো রাজারা সাধারণত বড় খামখেয়ালি স্বভাবের হতেন, অহং ভাবটাও খুব বেশি থাকত। রাজার কথা কেউ যদি না মানত তাহলে তাকে গুম করে খুন করে ফেলা অতি সাধারণ ব্যাপার ছিল। যদি রাজা কোনোক্রমে বুঝতে পারেন যে এই কাজটা আমি করতে যাচ্ছি বা করেছি, তাহলে প্রাণ নিয়ে এ দেশ থেকে আর ফিরতে হবে না।

    “হরিণরা রাত্তিরে ঘুমোয় না। আর জানিসই তো বন্যপশুরা খুব সজাগ হয়। মানুষের থেকে অনেক বেশি। তাই যতই পা টিপে টিপে আসি না কেন, অনেক দূরের থেকেই আমার সাড়া সে ঠিক পেয়ে গেছে। গরাদ থেকে কয়েক পা পেছিয়ে অবাক চোখে আমাকে দেখছে। হয়তো ভাবছে – এ দু-পেয়ে জীবটা এত রাত্তিরে কেন এসেছে?

    “আমি হরিণশিশুটিকে ভালো করে দেখলাম। কৃষ্ণপক্ষের টিমটিমে আলোয় কী সুন্দর যে লাগছিল ওকে, কী বলব। গায়ে তার হলদে-কালো নকশা কাটা যুবরাজের পোষাক। এত ঝলমলে যে চাঁদের আলো যেন পিছলে যাচ্ছে! তার ‘কালো হরিণ চোখ’ দুটো সেই থেকে সমানে একদৃষ্টে আমাকে দেখছে!

    “শাবলের চকচকে ফলাটায় হাত বুলিয়ে আস্তে আস্তে বললাম – ওরে হরিণশিশু আর একটু অপেক্ষা কর। তোর জীবনের সাধ, ইচ্ছে সব পূর্ণ করে দেব। হেইইইই করে শাবলটা তুলে গরাদের ভেতর …”

    টুনু আর সুকু একসঙ্গে আঁতকে উঠে বলল, “অ্যাঁ, তুমি ওকে মেরে ফেললে …”

    কাকাবাবু একটু থামলেন। রুমাল বার করে মুখ মুছলেন। তারপর বললেন, “না রে না, মারব কেন? আমি শাবলটা দিয়ে গরাদের তালাটা ভেঙ্গে দিলাম। তারপর খাঁচার দরজা হাট করে খুলে দিলাম। বললাম, ‘বনের হরিণ, তুই বনে ফিরে যা। যদি দল খুঁজে পেয়ে বাঁচতে পারিস তাহলে মনের খুশিতে মাঠেঘাটে বন-বাদাড়ে চরে বেড়াস। পেট ভরে ঘাসপাতা আর দিঘির জল খাবি, কারণে অকারণে দৌড়ে বেড়াবি। ভগবান তোদের যেমন ভাবে জীবন কাটাতে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে, তেমনি করেই জীবন কাটাবি।

    “‘আর যদি কাউকে খুঁজে না পেয়ে একা একা ঘুরেঘুরে মরতেই হয় তাহলে খোলা বাতাস আর খোলা আকাশের আনন্দ নিয়ে মরে যাস। খাঁচার ভেতর বছরের পর বছর মরে বেঁচে থাকার চেয়ে সে অনেক ভালো হবে রে, অনেক ভালো হবে!’

    “হরিণটা চারিদিক দেখল, আমাকে দেখল। ওরা মানুষকে বিশ্বাস করে না। আমি একটু দুরে সরে যেতে ও সন্তর্পণে বাইরে এল তারপর লাফিয়ে বনের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

    “জানিস, বনের পশুরা বনে থাকে স্বাধীন ভাবে। এই ধর হরিণ। এরা দল বেঁধে সারাটা দিন মাঠে আর বনে লতাপাতা ঘাস খেয়ে বেড়ায়। রাত্তিরে কিছু দেখতে না পেলে ভয় পেয়ে সকলে গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে থাকে। অন্ধকারে তাদের জোড়া জোড়া চোখ জ্বলজ্বল করে। কখনো বাঘ তাড়া করে। এরা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে থাকে। যে বেচারি দল থেকে আলাদা হয়ে যায় কিংবা পিছিয়ে পড়ে, সে যায় বাঘের পেটে। অন্যরা দুঃখ পায় ঠিকই তবে প্রকৃতির এই নিয়ম এরা মাথা পেতে মেনে নেয়। মানুষের মতো টাকা-পয়সা, হিরে-মানিক, মোহরটোহর কিছু জানে না এরা, চায়ও না। উন্মুক্ত প্রকৃতিতে নিজের খুশিতে ছুটে বেড়ানোর মজাটুকুই এদের সব।

    “খাঁচার ভেতর বন্দী করে রাখলে এদের যে কী কষ্ট হয়, মানুষ তা বোঝে না রে। পশুপাখিরা তো কিছু বলতেও পারে না। আর বলার চেষ্টা করলেও মানুষ তাদের ভাষা বোঝে না, বুঝতেও চায় না। চিড়িয়াখানাতে পশুপাখিদের আটকে রাখাকে মানুষ বীরত্ব বলে মনে করে। খাঁচার ভেতর তাদের অসহায় অবস্থা দেখে বাইরে দাঁড়িয়ে সবাই মিলে মজা করে চিনেবাদাম, পপ কর্ন, আইসক্রীম খায়।”

    ***

    গল্প শেষ হয়ে গেছে। রাত্তিরে বিছানায় শুয়ে সুকু আর টুনু দুজনেই কাকাবাবুর গল্পটা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছে। সকালে উঠে দেখল কাকাবাবু সেই কখন ভোরের ট্রেন ধরতে বেরিয়ে গেছেন।

    ***

    কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়িতে সুকু-টুনুর মাসতুতো ভাই-বোন, তাদের দু-এক জন বন্ধুদের আসা শুরু হলো। সবাই মিলে আজ হইচই করে চিড়িয়াখানা দেখতে যাওয়া হবে। সবাই ভালো ভালো রঙিন জামা পরেছে, কেউ নিয়েছে টুপি, কেউ কালো চশমা। এদের মধ্যে টুনুর কিন্তু দেখা নেই।

    টুনু কোথায়?

    এদিক-ওদিক খুঁজে শেষে দেখা গেল টুনু ছাদের আলসেতে হাত রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সুকু বলল, “কিরে টুনু, যাবি না? তৈরি হোসনি যে এখনও …”

    টুনু ঘুরে তাকাতে সুকু দেখল টুনুর চোখে জল। ধরা গলায় টুনু বলল, “খাঁচার ভেতরে পশুপাখিদের কত কষ্ট হয়। চিড়িয়াখানা মোটেই ভালো জায়গা নয়। আমি চিড়িয়াখানায় যাব না, কোনোদিন যাব না।”



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments