• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৮ | অক্টোবর ২০২২ | গল্প
    Share
  • চেক মেট ইন সমারসেট : পরমার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়


    ১)

    এ বছর দুর্গাপুজো তো দরজায় কড়া নাড়ছে। অক্টোবর মাস পড়তে না পড়তেই হুড়মুড় করে এসে পড়বে। তাই গত শনিবার অফিস ফেরতা কলেজস্ট্রিটে ঢুঁ মারলাম, উদ্দেশ্য কয়েকটা শারদীয় সংখ্যা কেনা আর তার সঙ্গে আমার প্রকাশকের অফিস থেকেও ঘুরে আসা, যদি পুজোর আগে কিছু টাকা পয়সা পাওয়া যায়। ইদানীং, মাইক ব্রিয়ারলির রহস্য কাহিনি লিখে টু পাইস আমদানি হচ্ছে। তা সে পরিমাণ যতই নগণ্য হোক না কেন। তবে আমার মতন কুল মানহীন লেখককে টাকার জন্য একটু তাগাদা করতে হয়। আমার নামে তো আর বই বিক্রি হয় না; সবটাই স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের মহা গোয়েন্দা, মাইক ব্রিয়ারলির ক্ষুরধার মস্তিষ্কের ক্যারিশমা। যেকোনও রহস্যের জট ছাড়িয়ে অপরাধের কিনারা করতে ব্রিয়ারলি সাহেবের অকল্পনীয় বিশ্লেষণী ক্ষমতা, তাঁর সহকারী অ্যান্ড্রিউ রবার্টসনের তৎপরতা, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড চিফ, টনি অ্যাডামসের ব্যক্তিত্ব আর মাইক ব্রিয়ারলি পত্নী লিলিয়ান ব্রিয়ারলির সামনে ব্রিয়ারলি সাহেবের কেঁচো হয়ে থাকা, সব মিলিয়ে একটা রসায়ন গড়ে উঠেছে।

    তা গোটা চারেক শারদীয় সংখ্যা আর কতিপয় লিটল ম্যাগাজিন বগলদাবা করে প্রকাশকের অফিসে পৌঁছে দেখি, বাংলা সাহিত্যের মহীরুহ পরম শ্রদ্ধেয় সেই সাহিত্যিক, হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, সেই তিনি ঘর আলো করে বসে আছেন। আরও দেখলাম, দেখে চক্ষু সার্থক করলাম যে, আমার সামনে দোর্দণ্ডপ্রতাপ সেই প্রকাশক, যিনি দশ বার না ঘুরিয়ে এক টাকাও দিতে চান না, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলেন, পারলে হাতে মাথা কাটেন, তিনিই মহীরুহের সামনে দাঁড়িয়ে হাত কচলাচ্ছেন আর সমানে হেঁ-হেঁ করে দেঁতো হাসি হেসে চলেছেন। আমার ঘাড়ের ওপর দিয়েই প্রকাশকের ডান হাত মন্টু সামন্ত নিজেই প্লেট-ভর্তি মিষ্টি নিয়ে গিয়ে মহীরুহের সামনে রাখল, বাজে কথা বলব না, আমি যখন প্রকাশক মহাশয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাই, তখন প্রতিবারই এক কাপ চা জুটে যায়, দু’-একবার তো সঙ্গে লেড়ো বিস্কুটও ছিল। যাই হোক, কী আর করা যাবে। বুঝলাম আজ আর আমার আশা নেই, ভাগ্য ভালো, আমাকে প্রকাশক মহাশয় দেখেননি, মন্টু সামন্তর মতো শ্যেনদৃষ্টির ঘুঘুও আমাকে নজর করেনি। সব কর্মচারী মহীরুহকে নিয়েই ব্যস্ত। আমি দূর থেকে দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে নমস্কার করে বেরিয়ে এলাম, পিঠটান দিলাম বললেই ভালো হয়। ভাবছি এ বার কী করব, হাতে তো খানিকটা সময় আছে, তবে পকেটের রেস্ত তো পত্রিকা কিনতেই বেরিয়ে গেছে, আজ প্রাপ্তিযোগও কপালে নেই, ভাবলাম ফুটপাথে দাঁড়িয়ে এককাপ চা সহযোগে সিগারেটের সদ্ব্যবহার করাতে তো অসুবিধা নেই, পায়ে পায়ে চায়ের দোকানের দিকে এগোচ্ছি, সেই সময় অধীরদার ফোনটা এল, “কী অতনুদা, এখনও কলেজস্ট্রিটে পড়ে আছেন? কী আক্কেল মশাই আপনার, এ বার মা দুর্গা যে অনেক আগে বাপের বাড়ি এসে পড়বেন সে খেয়াল আছে আপনার? ওদিকে ডাবলিন থেকে প্রকাশিত রহস্য রোমাঞ্চ পত্রিকা, দি ইনভেস্টিগেটরের লেটেস্ট কপি তো আমার ঠিকানায় এসে গেছে, আপনার অপেক্ষায় এখনও মোড়ক খুলিনি, একবার পারলে কলেজস্ট্রিট থেকে ফেরার পথে যদি সোদপুর স্টেশনে নামার পরে আমার বাড়িতে পায়ের ধুলো দেন, তবে একবার খুলে দেখব, আপনার মাইক ব্রিয়ারলি সাহেব এ বার কোন খেলা দেখালেন। আপনাকে তো আবার ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে, ব্রিয়ারলি সাহেবকে সুপার হিরো বানিয়ে পুজোর আগে সে গল্প লিখে ফেলতে হবে, হাতে সময় তো বেশি নেই। আজ থেকে গল্প পড়া শুরু করে দিই, আপনি তবে রাত থেকেই ব্রিয়ারলি ভজনা শুরু করে দিতে পারবেন।

    কাল রবিবারের সকালে নয় গল্প পড়া শেষ করা যাবে।” অধীরদা আমার ব্রিয়ারলি প্রীতিকে কোনও সময়ই খোঁচা দিতে ছাড়েন না, আবার নিজেই মাইক ব্রিয়ারলির অন্ধ ভক্ত, তবে মুখে স্বীকার করবার পাত্র নন। আমি সেটা ওঁকে মনে করিয়ে দিতে, খুব একচোট হেসে বললেন, “কী করব বলুন, ব্রিয়ারলি সাহেব একজন ধুরন্ধর গোয়েন্দা সেটা মানতেই হবে। গল্পের গোয়েন্দার সঙ্গে যাকে বিন্দুমাত্র মেলানো যায় না, কখন কী করতে চলেছেন মোটেই টের পাওয়া যায় না। লোকটার এলেম আছে। এখন ফোন রাখছি, তাড়াতাড়ি চলে আসুন। আপনার গিন্নি, আমার গিন্নি দু’জনে মিলে পুজোর বাজার করতে বেরিয়েছে সেটা তো জানেন নিশ্চয়ই, সন্ধ্যা বেলাটা আমাদের নিরবচ্ছিন্ন ব্রিয়ারলিচরিত চর্চায় ভালোই কাটবে, নো ডিস্টার্বেন্স যাকে বলে।”

    অধীরদা বিস্তারিতভাবে ওঁর মত বিস্তার করে ফোনটা কেটে দিলেন। বুঝলাম কিছু দিন পূর্বে স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর উদযাপনের রেশ নিজের গিন্নির অনুপস্থিতিতে আবার অধীরদার ভেতর মাথা চাড়া দিয়েছে। ওঁকে দোষ দেওয়া যায় না, আমিও যে পড়িমড়ি করে ছুটলাম শিয়ালদহ স্টেশনের দিকে ট্রেন ধরতে, তার পিছনে এক দিকে যদি হয় মাইক ব্রিয়ারলির রহস্য কাহিনি, তবে আর এক দিকে ওই স্বাধীনতা।

    ২)

    ফিস ফিঙ্গারে একটা কামড় দিয়ে অধীরদা বললেন, “অতনুদা, একদম খাসা জিনিস। সোদপুরে এ মহার্ঘ বস্তু পাওয়া যায় বলে ধারণাই ছিল না। আপনার দৌলতে এর স্বাদ পেলাম। এখন চলুন, কফিটা শেষ করে দেখি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দা চূড়ামণি, মি. মাইক ব্রিয়ারলির এ বারের কাহিনি আমাদের জন্য রহস্যের কোন স্বাদের পসরা সাজিয়েছে।

    ঘটনার সূত্রপাত, গত জুলাই মাসের চার তারিখে দক্ষিণ-পশ্চিম লন্ডনের সমারসেট কাউন্টিতে। সেখানকার একটি গাড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থার অফিসের কর্মচারী, লিয়া উইলিয়ামসন সপ্তাহ শুরুর প্রথম দিনটিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং থাকা সত্ত্বেও বিনা নোটিসে অফিসে অনুপস্থিত হওয়ায়। লিয়া অত্যন্ত দায়িত্বশীল কর্মচারী, এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ করার মতো মহিলা নন। লিয়ার বস লরা ফ্র্যাঙ্ক, লিয়ার মোবাইলে ফোন করে দেখেন সেটি বন্ধ করা আছে। লরার কাছ লিয়ার মায়ের ফোন নম্বর ছিল। তিনি লিয়ার মাকে ফোন করে জানতে পারেন, উইকএন্ডে শুক্রবার রাতে লিয়া লন্ডনে তাদের বাড়িতে গেছিল, শনিবার রাতে ফিরে আসে। রবিবার সন্ধ্যায় তার মায়ের সঙ্গে ফোনে শেষ বারের মতো কথা হয়। লরা তখন ঠিক করেন, তিনি লিয়ার বাড়িতে গিয়ে নিজেই খোঁজ-খবর করবেন। লিয়া সমারসেটের গ্রিন পার্ক এলাকার একটি একতলা বাড়িতে ভাড়া থাকতেন।

    লরা লিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখেন সেটি বন্ধ, বেল বাজালেও কেউ দরজা খোলে না।

    লিয়া উইলিয়ামসনের গাড়িটি কিন্তু বাড়ির হাতায় পার্ক করা ছিল।

    লরা আশপাশের বাড়িতে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেন, সেদিন সোমবার, সপ্তাহ শুরুর দিন, বেশিরভাগ মানুষই অফিস বেরিয়ে গেছেন, লরা খুব একটা সুবিধে করতে পারেন না। শুধু লিয়ার বাড়ির উল্টোদিকে একটা বাড়ি ছেড়ে এক বয়স্ক দম্পতি থাকেন, মি. অ্যান্ড মিসেস গ্রেগ। মিসেস গ্রেগ বলেন, রবিবার সন্ধ্যায় তিনি লিয়াক নিজের গাড়ি ড্রাইভ করে বাড়ি থেকে বেরোতে দেখেছেন। তার বেশি কিছু জানেন না। নিরুপায় লরা, পুলিশে ফোন করেন।

    পুলিশ এসে দরজা ভেঙে বাড়িতে ঢুকে ড্রইং রুমের সোফায় লিয়াকে মৃত অবস্থায় আবিষ্কার করে, শ্বাসরোধ করে লিয়াকে খুন করা হয়েছিল বলে পুলিশ নিশ্চিত।

    লিয়া উইলিয়ামসনের বাবা, মার্ক উইলিয়ামসন নিজে সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও একজন প্রভাবশালী মানুষ এবং ব্রিটেনের শাসক দলের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। সমারসেট পুলিশ তদন্ত শুরু করলেও উপর মহলের চাপে লিয়ার মৃতদেহ আবিষ্কারের দু’দিন পরে, এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তের ভার স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে এবং স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড চিফ, মি. টনি অ্যাডামস কাল বিলম্ব না করে এই হাই প্রোফাইল কেসের ভার তার সেরা অস্ত্র আমাদের সুপরিচিত গেয়েন্দা চূড়ামণি মি. মাইক ব্রিয়ারলি এবং তার সহকারী মি. অ্যান্ড্রিউ রবার্টসনের হাতে তুলে দিয়েছেন। দুই গোয়েন্দাই এই মুহূর্তে টনি অ্যাডামসের ঘর থেকে বেরিয়ে আসছেন এবং আমরা দেখতে পাচ্ছি, রবার্টসন উত্তেজিতভাবে তার বস মাইক ব্রিয়ারলি সাহেবকে কিছু বলছেন। চলুন অতনুদা, আমরা সরাসরি রবার্টসনের বক্তব্যর মধ্যে আমাদের কান গলিয়ে দিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করি।

    আমি অধীরদাকে বললাম, “চলুন, সেই ভালো।”

    ৩)

    “আচ্ছা বস, বলতে পারেন, যত গোলমেলে তদন্তর ভার টনি অ্যাডামস স্যার যখন আমাদের ঘাড়ে ফেলবেনই, তখন ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে সেটা করলে কি একটু উপকার হয় না? লিয়ার লাশ পাওয়া গেছে সোমবারে, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে লিয়া খুন হয়েছেন রবিবার রাত্রি সাড়ে ন’টা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে, আর আজ বুধবার। মাঝে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘণ্টা নষ্ট হয়ে গেছে, আপনি অকুস্থলে গিয়ে কোন প্রমাণটা জোগাড় করবেন? কাজটা কোথা থেকে শুরু করবেন? পুলিশ ওখানে যা দাপাদাপি করেছে, কোনও ক্লু পড়ে আছে নাকি মাইক ব্রিয়ারলির জন্য? লিয়া উইলিয়ামসনের বাবা প্রভাবশালী বলেই এই কেসের ভার স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের উপর এসে পড়েছে, নয়তো এ ধরনের ঘটনা তো বিরল নয়। এ বার ঠিক আপনার বদনাম হবে। এই অপরাধীকে ধরা আর খড়ের গাদায় সুচ খোঁজা একই বস্তু।”

    ব্রিয়ারলি হাসলেন, “রবার্টসন, তোমার উত্তেজনার সঙ্গত কারণ আছে, কিন্তু টনি অ্যাডামস স্যারকে, অনেক বাধ্যবাধকতার মধ্যে দিয়ে কাজ করতে হয়। সমারসেটে কোনও অপরাধ সংগঠিত হলে, ওখানকার পুলিশেরই প্রথমে তদন্ত করার কথা। বরং ধরে নাও, ওরা সাফল্য পায়নি তাই স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের তলব হয়েছে। আর একদম নিকষ অন্ধকারের ভেতরেও কোথাও না কোথাও থেকে যায় আলোর দু’-একটি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিন্দু, গোয়েন্দার কাজ সেই সূচ্যগ্র সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে বৃহত্তর আলোকবৃত্তের সন্ধান করা, অপরাধীকে অন্ধকার থেকে টেনে বার করে সর্ব সমক্ষে তার চেহারা উন্মোচিত করা।”

    রবার্টসন বোধহয় একটু শ্লেষাত্মকভাবেই বলে ওঠে, “এখানে কিন্তু সন্দেহভাজন তেমন কেউ নেই। বস, মনে রাখতে হবে লিয়া একাই থাকত। সেই সুযোগে অপরাধী তার উপর হামলা চালিয়ে হত্যা করেছে। আমরা অপরাধীকে খুঁজে বার করার চেষ্টা করব, কিন্তু শুরু করব কোথা থেকে ভেবেছেন? আমাদের হাতে তথ্য বলতে আছে, লিয়া উইলিয়ামসন সাতাশ বছর বয়সী সুন্দরী অবিবাহিত একজন যুবতী, সমারসেটে একটি গাড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থার অফিসে চাকরি করতেন এবং একা একটি বাড়ি ভাড়া করে থাকতেন। তাকে কেউ বা কারা তার বাড়িতে ঢুকে শ্বাসরোধ করে খুন করেছে। লিয়ার মোবাইল ফোন পুলিশ খুঁজে পায়নি, সেটা ট্র্যাক করাও যায়নি। লিয়া বাড়িতে কোনও ল্যাপটপ ব্যবহার করত না। অতএব সেখান থেকে কোনও তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। লিয়ার একজন বয়ফ্রেন্ড আছে, ‘রজার উইলিস’।

    তার পরিষ্কার অ্যালিবাই আছে, সেদিন সে স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে একটা রিইউনিয়ন পার্টিতে অংশ নিয়েছিল। ইভনিং স্টার নামক রেস্তরাঁয় ওই পার্টির সিসিটিভি ফুটেজ পুলিশ খতিয়ে দেখেছে এবং ওখানে উপস্থিত অন্যদের সাক্ষ্য থেকে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, রজার খুন করেনি।”

    ব্রিয়ারলি বললেন, “রবার্টসন, সমারসেট পুলিশ কেসটা নিয়ে যে ব্রিফিং দিয়েছে তা তো টনি অ্যাডামস স্যার আমাদের জানালেন। সেখানে স্পষ্টই বলা হয়েছে, কেউ জোর করে লিয়ার বাড়িতে ঢুকে পড়েছিল তেমন কোনও প্রমাণ নেই। অর্থাৎ অপরাধী লিয়ার পরিচিত, সে স্বেচ্ছায় অপরাধীকে বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছিল। আমাদের সেখান থেকেই শুরু করতে হবে। আর, আমরা পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পেয়েছি, ফরেনসিক সেরোলজি রিপোর্ট এখনও হাতে এসে পৌঁছোয়নি। সমারসেট পুলিশ জানিয়েছে আগামী কাল তারা এই রিপোর্ট হাতে পাবে। প্রাথমিকভাবে ধস্তাধস্তির কোনও চিহ্ন সমারসেট পুলিশ খুঁজে পায়নি, তবু হিসেব থেকে কিছুই বাদ দিলে হবে না, দেখতে হবে ফরেনসিক সেরোলজি রিপোর্টে আততায়ীর শরীর নিঃসৃত কোনও তরলের উপস্থিতি পাওয়া যায় কি না।

    সুতরাং, আমরা আগামী কাল সমারসেট যাচ্ছি, হতভাগ্য লিয়ার হত্যার অকুস্থল খুঁটিয়ে দেখতে। সেই মতো সমারসেট পুলিশকে নির্দেশ দিয়ে রাখো।

    এখন চলো কাজে লেগে পড়ি। আজ আমাদের প্রথম কাজ হল, লিয়া উইলিয়ামসনের বাবা, মার্ক উইলিয়ামসন এবং মা, থেরেসা উইলিয়ামসনের সঙ্গে কথা বলা, টনি অ্যাডামস স্যার অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রেখেছেন।”

    অধীরদা আর আমি একটা কফি ব্রেক নিতে থেমেছিলাম। অধীরদা বললেন, “আজ তবে এই অবধি থাক, আপনাকে বেশ ক্লান্ত লাগছে, বাকিটা আগামী কাল রবিবারের সকালে পড়া যাবে।” আমি মোটেই সেই প্রস্তাবে সাড়া দিলাম না। গল্পের পুরোটা না জেনে বাড়ি গেলে, রাতে আমার ঘুম হবে না। যত রাতই হোক, এ গল্পের শেষ দেখে ছাড়ব, আমি পরিষ্কার করে আমার মতামত ব্যক্ত করি।

    অধীরদা হেসে বললেন, “তবে চলুন অতনুদা, আর সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। ওদিকে রবার্টসনের গাড়ি, লন্ডনের নটিং হিলে উইলিয়ামসনদের প্রাসাদোপম বাংলোয় পৌঁছে গেছে।

    রাজসিক ড্রইংরুমে গৃহস্বামীর বৈভবের ছাপ সুস্পষ্ট। নামে ড্রইংরুম হলেও, হল ঘর বলাই ভালো।

    পারস্য দেশের গালিচা, দেওয়াল জোড়া ভারতীয় হস্তশিল্প এবং তৈলচিত্রের প্রদর্শন বা বেলজিয়ান কাচের ঝাড়বাতির বর্ণনায় সময় নষ্ট না করে আমরা সরাসরি ব্রিয়ারলি সাহেবের জেরায় কান পাতি। মি. এবং মিসেস উইলিয়ামসন দু’জনেই ড্রইংরুমে উপস্থিত আছেন। মি. মার্ক উইলিয়ামসনই প্রথমে মুখ খুললেন, “অফিসার্স, লিয়া আমাদের একমাত্র সন্তান ছিল, আপনারা নিশ্চয়ই আমাদের মনের অবস্থা বুঝতে পারছেন, কিন্তু আমরা চাই খুনী ধরা পড়ুক, তার কঠোর শাস্তি হোক। তাই যত কষ্টই হোক, আমরা আপনার প্রতিটি প্রশ্নের জবাব দিতে তৈরি।”

    ব্রিয়ারলি বললেন, “মি. উইলিয়ামসন, আপনারা স্বামী-স্ত্রী উভয়েই দেশের শাসক দলের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত, আপনি নিজে সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে অংশ না নিলেও, মিসেস থেরেসা উইলিয়ামসন অতীতে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিয়েছেন। আপনাদের কী মনে হয় রাজনৈতিক জগতের কোনও শত্রুতার জেরে লিয়ার উপর আঘাত নেমে আসতে পারে? অথবা ব্যবসায়িক কোনও শত্রুতার জের?”

    মি. উইলিয়ামসন বললেন, “থেরেসা শেষ বার কোনও রাজনৈতিক প্রচারে অংশ নিয়েছে দশ বছর আগে। আমাদের রাজনৈতিক কার্যকলাপ এমন পর্যায়ের নয় যে তাতে বিরাট ব্যক্তিগত শত্রুতার সৃষ্টি হবে। রাজনীতির জগতে আমাদের কিছু বন্ধু আছেন, শত্রু নয়। আর ব্যবসায়িক রেষারেষি তো থাকেই, তবু এমন কাউকে মনে করতে পারছি না যে এত বড় ক্ষতি করতে পারে।”

    ব্রিয়ারলি মিসেস উইলিয়ামসনকে জিজ্ঞাসা করলেন, “লিয়ার সমারসেটে চাকরি করতে যাওয়ার কারণ কী? পারিবারিক ব্যবসাতেই তো সে যোগ দিতে পারত? লিয়ার বন্ধুবান্ধবদের সম্বন্ধে যা জানেন সেটাও বলুন। আপনারা কাউকে লিয়ার খুনী হিসেবে সন্দেহ করছেন?”

    মিসেস উইলিয়ামসন কথা শুরু করতে সময় নিলেন। একটা প্রচণ্ড কষ্টকে গিলে ফেলে উনি ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন, “সামনের মাসে লিয়া, সাতাশ পূর্ণ করে আঠাশে পা দিত। সেই জন্মদিন আর আসবে না। লিয়া দু’বছর আগে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করার সিদ্ধান্ত নেয়। লিয়া বলেছিল, পারিবারিক ব্যবসায় এখনই যুক্ত হলে ও কোনও কাজই শিখতে পারবে না। কোম্পানির বাকি স্টাফরা তাকে বস হিসেবেই ট্রিট করবে, কোনও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন লিয়াকে হতে হবে না। এই কারণে ও মূল লন্ডনেই থাকতে চায়নি, বলেছিল মার্ক উইলিয়ামসনের কন্যা হিসেবে সে কোনও অহেতুক সুবিধা নিতে চায় না, অনলাইনে অ্যাপ্লাই করে লিয়া সমারসেট কাউন্টিতে এই কাজটা পেয়ে যায়। সমারসেট এখান থেকে ঘণ্টা তিনেকের রাস্তা, প্রতি উইকএন্ডে অনায়াসে যাতায়াত করা যায়। লিয়ার পরিকল্পনা ছিল, পাঁচ বছর সমারসেটের কোম্পানিতে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে পারিবারিক ব্যবসায় যোগ দেওয়ার। আমার এবং মার্কের লিয়ার সিদ্ধান্তে পূর্ণ সমর্থন ছিল। ভাগ্যদেবী যে অলক্ষ্যে অন্য পরিকল্পনা করে রেখেছেন, তা কী করে জানব!

    আর, সন্দেহ কাকে করব, সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না। রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা নাগাদ তো আমার সঙ্গে ফোনে কথা হল, ওর এক কলিগ, অলিভিয়ার আমন্ত্রণে সমারসেটের একটা রেস্তরাঁয় গান শুনতে আর খেতে গেছিল। লিয়া এমনিতে হাসিখুশি, তবে নিজের কাজের ব্যাপারে সিরিয়াস। বই পড়তে, গান শুনতে ভালোবাসত। বন্ধুত্ব করার ব্যাপারে একটু সিলেকটিভ। বন্ধু বলতে সমারসেটে ওর বস, লরা ফ্র্যাঙ্ক, লিয়ার থেকে বছর পাঁচেকের বড় হলেও অফিসের বাইরেও লিয়ার সঙ্গে হৃদ্যতা ছিল। আমার সঙ্গে কয়েকবার ফোনে কথা হয়েছে। তিনি লিয়াকে পছন্দ করতেন। আর এক কলিগ, অলিভিয়া হ্যামিলটনের সঙ্গে লিয়ার প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল, যার আমন্ত্রণে সেদিন সন্ধ্যায় লিয়া গান শুনতে গেছিল। অলিভিয়া আমাদের বাড়ি থেকে ঘুরে গেছে, পরে লিয়া এবং লিয়ার বয় ফ্রেন্ড রজার উইলিসের সঙ্গেও এখানে এসেছে। লিয়ার সঙ্গে ওর বয় ফ্রেন্ড রজার উইলিসের আলাপ মাস ছ’-সাত মাসের বেশি নয়, অস্বীকার করব না যে রজারের আর্থসামাজিক অবস্থা উইলিয়ামসন পরিবারের ধারে-কাছে আসে না, তবে ছেলেটির ভদ্র, মার্জিত ব্যবহার। এই বয়সের ছেলে-মেয়েদের বন্ধুত্ব হওয়াই স্বাভাবিক, আমরাও তাই রজারের সামাজিক অবস্থান নিয়ে মাথা ঘামাইনি, এমনিতে রজারকে ওর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের জন্য মানুষের পছন্দই হবে।

    এই ঘৃণ্য কাজ সে করেনি বলে পুলিশও জানিয়েছে, তবে ইদানীং লিয়ার সঙ্গে রজারের সামান্য দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে। সেটা সব বন্ধুত্বেই হয়।”

    ব্রিয়ারলি জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনার কেন মনে হল যে, ইদানীং রজার এবং লিয়ার মধ্যে একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল?”

    মিসেস উইলিয়ামসন বললেন, “কিছুদিন ধরে লক্ষ করছিলাম ওরা দু’জনে রবিবারগুলো এক সঙ্গে কাটাচ্ছে না। সাধারণত, লিয়া শুক্রবার সন্ধ্যায় লন্ডন আসত এবং শনিবার রাত বা রবিবার সকালে ফিরে যেত। রবিবারটা লিয়া আর রজার আড্ডা মেরে, বাইরে খেতে গিয়ে কাটিয়ে দিত। দু’-একজন কমন ফ্রেন্ড, সিংহভাগ ক্ষেত্রেই সেটা অলিভিয়া, অনেকসময় ওদের সঙ্গে থাকত। আমি রবিবার সন্ধ্যায় ফোন করে একবার লিয়ার খোঁজখবর করতাম, শেষ কয়েক সপ্তাহ শুনতাম রজার সঙ্গে নেই, অন্য কেউ, যেমন অলিভিয়াই বেশিরভাগ সময় লিয়ার সঙ্গে আছে।

    রজার বয়সে লিয়ার থেকে মাত্র বছর দুয়েকের বড়। রজার নিজের অফিসের কাজে লিয়াদের অফিসে যাতায়াত করত, সেই সূত্রেই ওদের আলাপ এবং বন্ধুত্ব। রজারের বাড়িও সমারসেটে। এই বয়সী দু’জন ছেলে মেয়ে যদি উইকএন্ড একত্রে না কাটায়, তবে বুঝতে হবে কোনও গোলমাল আছে। লিয়া আর রজারের যে কথাবার্তা বন্ধ হয়ে গেছিল বা দেখা-সাক্ষাৎ হচ্ছিল না, তা কিন্তু নয়। গত বুধবারও অফিস শেষে ওরা দু’জন ডিনারে গেছিল। আমি লিয়াকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলেত ও বলে, এটা তেমন কোনও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়। রজার নাকি নিজের পড়াশোনা নিয়ে একটু ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। রজার নিজে একজন সেলস ম্যানেজার হলেও, প্রাচ্য সংস্কৃতি নিয়ে ওর চর্চা আছে এবং সে নাকি এ বিষয়ে একটা বই লেখার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তাই উইকএন্ডই তার জন্য প্রশস্ত সময়, অন্যান্য দিন অফিসের চাপে অতটা সময় দেওয়া যায় না।

    তা সত্ত্বেও একটা বছর তিরিশেকের যুবক, তার সুন্দরী বান্ধবীকে ফেলে উইকএন্ডে লেখাপড়া করছে, সেটা মানতে মন চায়নি। তবে এই নিয়ে আর অতিরিক্ত কৌতূহল দেখাইনি।

    আমার শঙ্কা যে ঠিক ছিল, তা এখন প্রমাণিত। লিয়া যেদিন রাতে মারা যায়, সে দিনটা ছিল রবিবার, সেদিন রজার অন্যত্র বন্ধুদের সঙ্গে পার্টি করছিল। অর্থাৎ, লিয়া যে উইকএন্ডে রজারের পড়াশোনার অজুহাত দিয়েছিল, সেটা ধোপে টিঁকছে না।”

    ব্রিয়ারলি জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি বললেন, লিয়া আর রজারের সঙ্গে অলিভিয়া এ বাড়িতে এসেছিল। আচ্ছা, অলিভিয়ার সঙ্গে রজারের সম্পর্ক কেমন ছিল? অলিভিয়ার বয়স কত? তার কি কোনও বয়ফ্রেন্ড ছিল?”

    মিসেস উইলিয়ামসন বললেন, “অলিভিয়া মোটামুটি লিয়ার বয়সীই হবে। লিয়ার সঙ্গে রজারের পরিচয় হওয়ার আগেও সে এ বাড়িতে লিয়ার সঙ্গে এসেছিল; আবার পরে রজার এবং লিয়ার সঙ্গেও এসেছে।

    রজার এবং অলিভিয়ার মধ্যেও বন্ধুত্ব ছিল। সাত-আট মাস আগে অলিভিয়া যখন প্রথম এ বাড়িতে আসে তখন তার কোনও বয়ফ্রেন্ড ছিল বলে শুনিনি। আগে ছিল কি না সেটা বলতে পারছি না। তবে মাস দুয়েক হল, অলিভিয়ার একজন বয়ফ্রেন্ড হয়েছে। লিয়ার মুখে শুনেছি সে বয়সে অলিভিয়ার থেকে অনেক বড়। ভদ্রলোক একজন বার সিঙ্গার। তার গান শুনতেই অলিভিয়া আর লিয়া সেদিন গেছিল। অলিভিয়া কয়েকবার তাকে নিয়ে লিয়ার বাড়িতেও এসেছিল।”

    ব্রিয়ারলি জিজ্ঞাসা করলেন, “আর লিয়ার লন্ডনের বন্ধুবান্ধব?”

    মিসেস উইলিয়ামসন বললেন, “লিয়া দীর্ঘ সময় ধরে আমেরিকায় পড়াশোনা করেছে, ফিরে এসে সমারসেটে চলে গেছে, লন্ডনে বরং লিয়ার তেমন উল্লেখযোগ্য কোনও বন্ধু নেই।”

    ব্রিয়ারলি বললেন, “আর কিছু জানার নেই। আমি একবার এ বাড়িতে লিয়ার ঘরটা দেখতে চাই।”

    উইলিয়ামসন দম্পতির দু’জনেই ব্রিয়ারলি এবং রবার্টসনকে সঙ্গে করে লিয়ার ঘরে নিয়ে গেলেন। তিন তলা বাড়ির দোতলায় লিয়ার ঘরে ঢুকলেই বোঝা যায় সে সঙ্গীতপ্রেমী ছিল। প্রচুর লং প্লেয়িং রেকর্ড এবং সঙ্গীত সংক্রান্ত বই সারা ঘরের মেঝেতে, বিছানায় এবং সোফাতে ছড়ানো আছে।

    ঘরে আসবাব বলতে একটা খাট, একটা লম্বা সোফা, একটা ওয়ার্ড্রোব ছাড়া কিছু নেই, ঘরটা একজনের পক্ষে বেশ বড়, সারা দেওয়াল জুড়ে অনেক সঙ্গীত তারকাদের পোস্টার লাগানো রয়েছে, তার মধ্যে একটা গ্রামাফোনের পাশে বসে থাকা দু’জন যুবতীর একটা ছবি, ব্রিয়ারলি সাহেব খুব খুঁটিয়ে দেখলেন, মিসেস উইলিয়ামসনের থেকে জেনে নিলেন তাদের পরিচয়। লিয়াকে যদিও দেখেই চেনা যায়, মিসেস উইলিয়ামসনের মতনই কোঁকড়ানো চুল, পাতলা ঠোঁট আর টানা টানা চোখের ক্লাসিকাল সুন্দরী। সঙ্গের মেয়েটি অলিভিয়া হ্যামিলটন। সেও সুন্দরী। বাদামী চোখ, আবেদনময়ী ঠোঁট, স্ট্রেট হেয়ারের আধুনিকা। ব্রিয়ারলি

    একবার ওয়ার্ড্রোব খুলে পরীক্ষা করলেন, লিয়ার পোশাক ছাড়া কিছুই নেই। তারপর লং প্লেয়িং রেকর্ড, গ্রামোফোন যন্ত্র, বইপত্র খুঁটিয়ে দেখলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, “রেকর্ড আজকাল সাধারণত কেউ শোনে না, যদি না গানের বিশেষ ভক্ত এবং বোদ্ধা হয়, লিয়ার সে শখ ছিল বোঝাই যাচ্ছে, বইপত্রও সে সাক্ষ্য বহন করছে, কিন্তু লিয়ার সঙ্গে যে গ্রামোফোনের ছবি দেখা যাচ্ছে সেটা কোথায়? এ ঘরে এখন যে গ্রামোফোন যন্ত্র আছে, সেটা তো ছবির গ্রামোফোন নয়।”

    মি. উইলিয়ামসন বললেন, “দু’টো গ্রামোফোনই ছিল। ছবিতে যেটা দেখছেন, সেটা গত শনিবার লিয়া সমারসেটে নিয়ে গেছে, ও আদ্যিকালের জিনিস, আমার পিতামহর সংগ্রহ। সব রেকর্ড বোধহয় ওতে চলত না, আমরা অবশ্য অতটা বুঝি না। আমার পিতামহর গান-বাজনার শখ ছিল, ওঁর পরে লিয়ার মধ্যেই ওই ঝোঁক এই বংশে ফিরে আসে।”

    ব্রিয়ারলি জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনাদের পরিবারের সঙ্গে ভারতবর্ষের একটা সম্পর্ক রয়েছে। ড্রইংরুমে একটা অয়েল পেন্টিং একজন ভারতীয় রাজপুরুষের বলে বোঝা যায়। আর একটাতে ওই রাজপুরুষের সঙ্গে পাশাপাশি দু’টি ঘোড়ায় একজন ব্রিটিশ পুরুষ সম্ভবত আপনাদের পূর্বপুরুষ হবেন। বাকি চারটি অয়েল পেন্টিং সবই ওই রাজ পরিবার সংক্রান্ত। ড্রইংরুম থেকে লিয়ার ঘরে আসার পথের করিডরেও রবীন্দ্রনাথ টেগোর আর রবিশঙ্করের ছবি চোখে পড়েছে।”

    মি. উইলিয়ামসন বললেন, “ঠিকই বলেছেন। ওই ভারতীয় রাজপুরুষ হচ্ছেন নেটিভ ইন্ডিয়ান স্টেট মাইসোরের মহারাজা, ‘কৃষ্ণরাজা ওদেয়ার চতুর্থ।’ আমি উচ্চারণ ঠিক করলাম কি না জানি না। লিখতে গেলে, লিখতে হবে, ‘Maharaja Krishnaraja Wodeyar IV.’” মি. উইলিয়ামসন তাঁর মোবাইলে টাইপ করে ব্রিয়ারলিকে দেখালেন।

    “পেন্টিংয়ের তলায় মহারাজের নাম লেখাই আছে, তবে সেটা মাটিতে দাঁড়িয়ে খালি চোখে দেখা সম্ভব নয়। ওঁর সঙ্গের ব্রিটিশ পুরুষটি আমার পিতামহ, ‘রিচার্ড উইলিয়ামসন’। আমার পিতামহ ঊনবিংশ শতকের শেষ ভাগে বাণিজ্য করতে মাইসোরে যান, উনি অত্যন্ত গুণী বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ ছিলেন। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণরাজা মাইসোরের মহারাজা হলে দু’জনের মধ্যে সখ্যতা গড়ে ওঠে। কৃষ্ণরাজা ছিলেন আধুনিক মনোভাবাসম্পন্ন, মহারাজাসুলভ গাম্ভীর্যের আড়ালেও গুণীর কদর করতেন। ওঁর রাজত্বকালেই মাইসোরে ভারতের প্রথম হাইড্রো-ইলেকট্রিক পাওয়ার প্রকল্প গড়ে ওঠে, এশিয়ার প্রথম শহর হিসেবে মাইসোরে স্ট্রিট লাইট লাগানো হয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, ফাইন আর্টস সবেতেই কৃষ্ণরাজার রাজত্বে মাইসোরের স্বর্ণযুগের শুরু, আর সেই কর্মযজ্ঞকে ভালোবেসে রিচার্ড উইলিয়ামসনও তাতে সামিল হয়ে পড়েন। ব্রিটিশ শাসকের দম্ভ রিচার্ডের মধ্যে ছিল না বলেই হয়তো কৃষ্ণরাজা তাঁকে বন্ধুর মর্যাদা দিয়েছিলেন। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে, মহারাজা কৃষ্ণরাজা দেহ রাখলে, রিচার্ড ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন, তখন তাঁর সত্তর বছর বয়স। আমার পিতা মাইকেল উইলিয়ামসনেরও জন্ম হয়েছিল মাইসোরে।

    পূর্বপুরুষের ভারতপ্রেম লিয়ার মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল। লিয়া ইউএসএতে পড়াশোনা করলেও, একাধিকবার ভারতে গেছে। বলত, শেষ জীবনে পাকাপাকিভাবেই ভারতে চলে যাবে। জীবন যে তার আগেই শেষ হয়ে যাবে কে জানত?”

    উইলিয়ামসন ম্যানসন থেকে বেরিয়ে ব্রিয়ারলি রবার্টসনকে বললেন, “আমাকে একটু সমারসেট নিয়ে পড়াশোনা করতে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড আর্কাইভে ফিরতে হবে।”

    রবার্টসন মনে মনে বলল, “শুরু হল বুড়ো ছুঁচোর পাগলামি, খুন হল সমারসেটে, উনি চললেন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড আর্কাইভে তার তদন্ত করতে।” মুখে বলল, “বস, মনে হচ্ছে কিছু একটা গন্ধ পেয়েছেন?”

    ব্রিয়ারলি বললেন, “হ্যাঁ, গানের। ওদিকে তোমার কাজ শুরু করে দাও। তোমাকে কিছু বিস্তারিত বোঝানোর দরকার নেই, সেটা আমি জানি।”

    অধীরদা সিগারেট ধরাতে থামলেন। আমি বললাম, “অধীরদা, আজকাল গুগল করলেই যেকোনও জায়গা সম্বন্ধে সব তথ্য পাওয়া যায়। তার মানে ব্রিয়ারলি সাহেব এমন কিছু নিয়ে জানতে চান, সেটা গুগলে পাওয়া সাধারণ তথ্য নয়।”

    অধীরদ চোখ বুজে কয়েকটা সুখ টান দিয়ে বললেন, “অবশ্যই এবং ব্রিয়ারলি সাহেব তদন্তের খুব প্রাথমিক অবস্থা থেকেই একটা প্যাটার্ন দেখতে পান, সেটা হয়তো আমরা শেষ অবধি বুঝে উঠতে পারি না। আমি আগেও আপনাকে বলেছি, মাইক ব্রিয়ারলি যদি গোয়েন্দা না হয়ে অপরাধী হতেন, তবে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড মহা সমস্যায় পড়ে যেত।

    ব্রিয়ারলির ছায়াসঙ্গী, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দক্ষ ও প্রশিক্ষিত অফিসার, অ্যান্ড্রিউ রবার্টসনের কাছেও ব্রিয়ারলির চাল অনেক সময়ই পাগলামিরই নামান্তর মনে হয়। কিন্তু দেখা যায় শেষে গিয়ে সেসব চাল মোক্ষম চালে পরিণত হয়েছে। আমরা ইতিপূর্বেও মাইক ব্রিয়ারলিকে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড আর্কাইভের সাহায্য নিতে দেখেছি। ওখানে এমন অনেক তথ্য থাকে যা সংবাদপত্র অবধি পৌঁছোয় না বা সাংবাদিকরা তার খবর রাখেন না।”

    ৪)

    "চলো রবার্টসন, তোমার গাড়ি স্টার্ট দাও, এখন বেলা এগারোটা বাজে, ঘণ্টা তিনেক লাগবে লন্ডন থেকে সমারসেট পৌঁছতে; লিয়া উইলিয়ামসনের বাড়ি, গাড়ি দেখে আসি চলো। বুঝলে রবার্টসন, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড আর্কাইভ একটা ট্রেজার আইল্যান্ড। মণি-মাণিক্যর কোনও অভাব নেই। শুধু চাই জহুরির চোখ দিয়ে ঠিক সময় ঠিক রত্নটিকে বেছে নেওয়া। আমরা এখন সোজা যাব লিয়ার বাড়িতে, সমারসেট পুলিশ সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে। তারপর সমারসেট পুলিশ স্টেশন, ফরেনসিক সেরোলজি রিপোর্ট দেখব, রজার উইলিস, অলিভিয়া, লরা ফ্র্যাঙ্ককে জিজ্ঞাসাবাদ করব।”

    “সে তো বুঝলাম বস, কিন্তু স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের আর্কাইভে আপনি লিয়া উইলিয়ামসন হত্যার কোন সূত্র খুঁজে পেলেন তো বললেন না, আর কাল বললেন আপনি নাকি গানের গন্ধ খুঁজে পেয়েছেন। সেটা আবার কেমন ধারার গন্ধ?”

    “রবার্টসন, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের আর্কাইভে আমি কিছু পুরনো নথিবদ্ধ কেস স্টাডি করছিলাম, আর ওই গানের গন্ধই আমার মস্তিষ্ককে সেটা খুঁজে দেখার নির্দেশ পাঠিয়েছে। ভালো গোয়েন্দার খুব ভালো পাঠক হওয়া ভীষণ জরুরি। শুধু পুলিশি বা আদালতের নথি নয়; সঙ্গে সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, খেলাধুলো, খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন, সিনেমার পোস্টার, রেস্তরাঁর মেনু কার্ড সব পড়া চাই।

    সেই পাঠ, তার মস্তিষ্ক সঞ্চয় করে রাখবে; আর প্রয়োজনে সেই রসদকে ভাঁড়ার থেকে টেনে বার করবে। তুমি তো জানো, আমি প্রায় পড়াশোনা জগতেরই লোক। মাইসোরের মহারাজার সঙ্গে রিচার্ড উইলিয়ামসনের যোগাযোগের ব্যাপারটাও ভারী ইন্টারেস্টিং লাগল। অধিকাংশ সময় দেখা যায় লোকে পূর্বপুরুষের কীর্তি ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে গল্প করে, তবে বইপত্র ঘেঁটে দেখলাম মার্ক উইলিয়ামসন মোটামুটি ঠিকই বলেছেন।

    লিয়া আর অলিভিয়া যে গ্রামোফোনটার পাশে বসে ছবি তুলেছে, ওটায় মাইসোর মহারাজার প্রতীক আর সইও রয়েছে, তুমি বোধহয় লক্ষ করোনি। তখনই বুঝে গেছি উইলিয়ামসনদের ড্রইংরুমে রাজপুরুষের তৈলচিত্র মাইসোরের মহারাজার, তবুও মি. উইলিয়ামসনের থেকে জেনে নিয়ে নিশ্চিত হলাম। বিবিসি, মাইসোর মহারাজ কৃষ্ণরাজার উপর একটা তথ্যচিত্র বানিয়েছিল এবং তাতে উইলিয়ামসন পরিবারের সঙ্গে মহারাজের সম্পর্কের কথাও উল্লেখ করেছিল। এইসব তথ্যচিত্র দেখলে কিন্তু অনেক কিছু শেখা যায়। তুমিও শিখতে পারো, বিবিসি আর্কাইভে গেলেই দেখতে পাবে।”

    রবার্টসন বলল, “হুম, সে নাহয় হল। কিন্তু বস, কি আজকাল গানটান গাওয়া শুরু করলেন নাকি? আপনি যে পড়াশোনা জগতের লোক সে তো জানি, এক প্রকার ভুল করেই যদি গোয়েন্দাগিরিতে না এসে পড়ে সাহিত্য চর্চা করতেন, তবে বুকার পুরস্কার বাঁধা ছিল। গানের ব্যাপারটা অবশ্য জানা ছিল না।” রবার্টসন খোঁচা দিতে ছাড়ে না।

    ব্রিয়ারলি হেসে বললেন, “রবার্টসন, ঘটনাটা শুনলে তোমারও এখনই মনে পড়ে যাবে, আর যোগসূত্রটা বুঝতে পারবে। সব সংবাদপত্রেই সেই সময়ে এ সব খবর বেরিয়েছিল, কিন্তু তার বাইরেও ভিতরের আরও খবর পুঙ্খানুপুঙ্খ জানার জন্যই স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড আর্কাইভের শরণাপন্ন হওয়া।

    ২০১৬-তে সমারসেটে সারা মিচেল নামে এক যুবতীকে শ্বাস রোধ করে হত্যা করা হয়, সারা মিচেলও একা থাকত এবং সেও সেদিন সন্ধ্যায় সমারসেটের একটি বার কাম রেস্তরাঁয় গেছিল। সমারসেট পুলিশ ওই বারের সঙ্গে এই খুনের যোগসূত্র আছে বলে সন্দেহ করে ব্যাপক ধরপাকড় করে, কিন্তু কারও বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা যায়নি।

    ২০১৭-তে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি, এ বারের শিকার সোফিয়া জোন্স। এক বছর চুপচাপ থাকার পর, ২০১৯-এ খুনী আবার আঘাত হানে। শিকারের নাম অ্যামি স্মিথ। তিনটি ক্ষেত্রেই শিকার, একজন একা বসবাসকারী যুবতী এবং যারা সমারসেটের টনটন অঞ্চলের বারে গান শুনতে এবং খেতে যেতে অভ্যস্ত ছিলেন। প্রথম হত্যার পর থেকেই সমারসেট পুলিশ টনটনের কয়েকটি বার কাম রেস্তরাঁর ওপর কড়া নজর রাখে, তবু আরও দু’টি একই ধরনের হত্যা রোধ করা যায়নি, খুনীও ধরা পড়েনি। ইংল্যান্ডের অন্য কোনও স্থানে, এই সময়কালে এমন ধরনের ঘটনা ঘটেনি। সমারসেট এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের কোনও পরিচিত অপরাধী এই খুনগুলো করেনি বলে পুলিশ নিশ্চিত এবং একজনই তিনটি খুন করেছে। তিনটি ক্ষেত্রেই শিকার, শিকারীকে স্বেচ্ছায় বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছে। তিনটি ক্ষেত্রেই খুনের আগে যৌন সঙ্গমের প্রমাণ পাওয়া গেছে, কিন্তু জবরদস্তির নয়, অর্থাৎ ধর্ষণে বাধা দেওয়ার ফলে খুনের তত্ত্ব দাঁড়ায় না, কোনও বহুমূল্য জিনিসও চুরি যায়নি। তিনটি ক্ষেত্রেই শ্বাস রোধ করে খুন করা হয়েছিল। রবার্টসন, এ ক্ষেত্রে একটা সম্ভাবনার কথা মাথায় আসে, খুনী ওই মহিলাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক গোপন রাখতে আগ্রহী ছিল এবং যখনই সেই গোপনীয়তা বিপন্ন হওয়ার দিকে এগিয়েছে, তখনই সে মেয়েটিকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়ে সেই রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। মিসেস উইলিয়ামসনের বয়ান অনুসারে, লিয়াও সেদিন সমারসেটের বারে গান শুনতে গেছিল। আর, তার ঘর থেকে কোনও মূল্যবান সামগ্রী খোয়া গেছে বলে পুলিশ জানায়নি। তাকেও শ্বাস রোধ করে হত্যা করা হয়েছে।”

    রবার্টসন বলল, “হ্যাঁ বস, এটা মাথায় আসা উচিত ছিল। লিয়ার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ওই ঘটনাগুলোর মিল আছে। একটা জায়গাতেই শুধু অমিল। পূর্বে খুন হয়ে যাওয়া তিনজনই সাধারণ ঘরের মেয়ে ছিল আর তাই স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের মহা গোয়েন্দা মাইক ব্রিয়ারলির হাতে সেইসব তদন্তের ভার এসে পড়েনি। এ বারে হাই প্রোফাইল পরিবারের ওপর আঘাত নেমে আসায়, হাই প্রোফাইল গোয়েন্দার ডাক পড়েছে। ঘটনাটা দুঃখজনক হলেও সত্যি।”

    ব্রিয়ারলি বললেন, “কী আর করা যাবে রবার্টসন? আগের তিনবারই আমরা অন্য তদন্তে ব্যস্ত ছিলাম। সমারসেট পুলিশ শেষ দু’টো কেসে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সাহায্য নিয়েছিল। আমরা দু’জনেই তো আর শুধু স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দা নই। অন্য অফিসাররা তদন্ত করেছেন, খুনী ধরা না পড়ার এক ডজন কারণ আমি তোমাকে এখনই বলতে পারি।”

    রবার্টসন বলল, “সে কারণ যাই থাক বস, লিয়ার খুনও যদি সেই ব্যাটা করে থাকে তো ধনেপ্রাণে মারা গেছে। আমি খড়ের গাদায় সুচ খোঁজা অসম্ভব বলেছি বটে, তবে আপনি সেটা করতে পারেন সেটাও জানি।”

    ব্রিয়ারলি সাহেবের বিগলিত হাসি দেখলেই বোঝা যাচ্ছে তিনি যারপরনাই খুশি হয়েছেন। মুখে শুধু বললেন, “রবার্টসন, তোমার কাজ নিশ্চয়ই জোর কদমে এগোচ্ছে?”

    রবার্টসন মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠল, “তুমি বাবা সাক্ষাৎ শয়তান, কেউ জানুক না জানুক আমি হাড়ে হাড়ে জানি। মনুষ্যজাতির পক্ষে অসম্ভব সব কাজ তুমি করতে পার। একমাত্র নিজের গিন্নি, মিসেস লিলিয়ান ব্রিয়ারলির সামনে পড়লেই তোমার বুদ্ধি দেহ রাখে।”

    আমি বললাম, “অধীরদা, এই গানের গন্ধ ব্রিয়ারলির মস্তিষ্কে কী সংকেত পাঠাল, সেটা বোধহয় বোঝা গেল। তাই না?”

    অধীরদা বললেন, “কী জানি! মাইক ব্রিয়ারলির চিন্তার তরঙ্গ ঠিক ধরা যায় না। ভদ্রলোক নানারকম ছল-চাতুরির মধ্যে দিয়ে একটা ধোঁয়াশা বজায় রাখতে ভালোবাসেন। ওদিকে রবার্টসনের গাড়ি, সমারসেটে লিয়ার বাড়ির চত্বরে ঢুকে পড়েছে। সমারসেট পুলিশের দুই অফিসার, ক্রেগ হিউজ এবং জেফ্রি কুকের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের পর, ব্রিয়ারলি সোজা লিয়ার গাড়ির দিকে এগিয়ে গেছেন। প্রসঙ্গত, ক্রেগ হিউজ সমারসেট পুলিশের পক্ষ থেকে লিয়া হত্যাকাণ্ডের দায়িত্বে আছেন।

    আমরা ব্রিয়ারলি, রবার্টসনদের কথোপকথনে বরং কান পাতি।”

    ব্রিয়ারলি সমারসেট পুলিশের মি. হিউজকে জিজ্ঞাসা করলেন, লিয়ার গাড়ির ফরেনসিক পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে এসেছে কি না। হিউজ জানালেন, এসে গেছে।

    ফরেনসিক সেরোলজির রিপোর্টও তৈরি। সমারসেট পুলিশ স্টেশনে গেলে তিনি সব রিপোর্টের কপি ব্রিয়ারলির হাতে তুলে দেবেন। তবে সমারসেট পুলিশের পক্ষ থেকে কাউকে এখনও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি, তারা প্রাথমিক তদন্ত শুরু করলেও, প্রথম দিন থেকেই উচ্চতর কর্তৃপক্ষর ইঙ্গিত ছিল এই তদন্তের ভার স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের হাতে যাবে, শুধু সরকারি পর্যায়ের নির্দেশ আসার অপেক্ষা। সমারসেট পুলিশ তাই ক্ষেত্র প্রস্তুতের কাজটুকু সেরে রেখেছে।

    হিউজ গাড়ির দরজা আনলক করার পর ব্রিয়ারলি গাড়িতে ঢুকে পরীক্ষা করলেন, তারপর বাইরে বেরিয়ে গাড়ির চাকাগুলো পরীক্ষা করলেন, বাড়িটাকে একটা চক্কর দিলেন, বাড়ির পিছন দিকে একটা জায়গায় নিচু হয়ে কিছু দেখলেন, তারপর হিউজকে বললেন, লিয়ার ঘরটা দেখবেন।

    লিয়ার ভাড়া করা বাড়িটি একতলা, তিনটে বড় বড় ঘর, কিচেন, দু’টো টয়লেট।

    একটা ঘরকে লিয়া বেডরুম হিসেবে ব্যবহার করত, একটা গেস্টরুম, একটা ড্রইং রুম। লিয়ার বেডরুমের দেওয়াল এখানেও তার লন্ডনের ঘরের মতো মিউজিকাল স্টারদের পোস্টারে ভর্তি। একটা গ্রামোফোনও রয়েছে।

    সঙ্গীত সংক্রান্ত ম্যাগাজিন, আসবাবপত্রে সে ঘর লিয়ার লন্ডনের বাড়ির ঘরের প্রায় অনুরূপ, শুধু লন্ডনের উইলিয়ামসন ম্যানসনে লিয়ার ঘর আকারে আরও বড় ছিল। বিছানার উপর কিছু জামা কাপড় ছাড়া, বোধহয় লিয়ার শেষ পোশাক পরিবর্তনের নিদর্শন।

    ড্রইং রুমের সোফাতেই পুলিশ লিয়াকে মৃত অবস্থায় আবিষ্কার করে। ড্রইংরুমের সেন্টার টেবিলে আর একটা গ্রামোফোন রাখা, দেখেই বোঝা যায় এটাই লিয়া তার লন্ডনের বাড়ি থেকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন, এটার ছবিই ব্রিয়ারলিরা লন্ডনে লিয়ার বেডরুমে দেখেছিলেন।

    তাতে তখনও জন লেননের মাইন্ড গেমস অ্যালবামের রেকর্ড চাপানো। জীবনের খেলা ফুরিয়ে যাওয়া লিয়ার আর কখনও সেই গান শোনা হবে না। ড্রইং রুমে আসবাব বলতে দু’টো সোফা সেট এল শেপ-এ সাজানো, একটা সেন্টার টেবিল, একটা হ্যাট, কোট, আমব্রেলা এবং ব্যাগ স্ট্যান্ড। তাতে একটা সাদা হ্যাট, একটা কনিয়াক লেদার ফ্যাশন ব্যাগ, একটা রেড লেদার, অফ হোয়াইট ক্যানভাস ব্যাগ, একটা ফ্লোরাল প্রিন্টের ছাতা, তবে কোনও কোট রাখা নেই।

    আর দেওয়ালে একটা এলইডি টিভি। ব্রিয়ারলি নিজের মোবাইলে বেশ কয়েকটা ছবি তুললেন।

    তারপর বললেন, “এ বার যাওয়া যেতে পারে। অফিসার্স, যাদের জেরা করা হবে, তারা উপস্থিত আছে তো?” হিউজ জানালেন, সকলেই উপস্থিত থাকবে।

    সমারসেট পুলিশ স্টেশনে ব্রিয়ারলি প্রথমে ফরেনসিক রিপোর্টে চোখ বুলিয়ে নিলেন। লিয়ার মৃত্যুর সন্ধ্যায় রজারদের পার্টির সিসিটিভি ফুটেজ দেখলেন, তারপর হিউজকে বললেন, প্রথমে রজার উইলিসকে দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা যাক। আমি রজার, অলিভিয়া এবং লরাকে আলাদা আলাদা জেরা করব, প্রয়োজন বুঝলে ওদের মুখোমুখি বসানো যাবে।

    রজারকে দেখলে এক কথায় মনে হয় সৌম্য দর্শন, কিন্তু চোখে মুখে মানসিক উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট। জেরার জন্য নির্দিষ্ট ঘরে ঢুকে, তার ছ’ফুটের কাঠামোটাকে যেন কষ্ট করে টেনে এনে টেবিলে বসল।

    ব্রিয়ারলি সোজা কাজের কথায় চলে এলেন, “রজার, লিয়ার মা আশঙ্কা করেছিলেন যে গত কয়েক মাস ধরে আপনার সঙ্গে লিয়ার সম্পর্কের অবনতি হয়েছিল। সেটা সত্যি হলে, ঠিক কতদিন সেটা হয়েছিল, কেন হয়েছিল বলে আপনার মনে হয়?”

    রজার বলল, “লিয়ার মায়ের আশঙ্কা ঠিক। আমরা সাধারণত রবিবারে টনটনের ইভনিং স্টার রেস্তরাঁয় আড্ডা মারতাম, ওখানকার পরিবেশ আমাদের পছন্দ ছিল। লিয়া, আর আমি দু’জনেই গান-বাজনা পছন্দ করি, ইভনিং স্টারের লাইভ মিউজিক সমারসেটে বিখ্যাত। অলিভিয়া হ্যামিলটনও কমন ফ্রেন্ড হিসেবে অনেকসময় আমাদের সঙ্গে গেছে, অন্যান্য বন্ধুবান্ধবরাও যেত। মাস দেড়েক হল লিয়া ইভনিং স্টারের রাস্তা মাড়ায়নি, সেটা বড় কথা নয়, এই সময় কোনও উইকএন্ডেই ও আমার সঙ্গে বেরোতে রাজি হয়নি। আমাদের মধ্যে কোনও ঝগড়া হয়নি, কিন্তু লিয়া আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছিল। গত বুধবার একটা হেস্তনেস্ত করার জন্য আমি লিয়াকে ইভনিং স্টারেই ডিনারে ডাকি। লিয়া এসেছিল, সেদিন লিয়া আমার কাছে কিছুটা সময় চেয়ে নেয়। বলে ও একটা সমস্যার মধ্যে আছে, কিছু দিনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি সেই সময় দিতে রাজি ছিলাম, লিয়াকে আমি ভালোবাসতাম, কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য সেই সময় পাওয়া গেল না। লিয়া কি কিছু আঁচ করে সমস্যার কথা বলেছিল? তা আর জানার উপায় নেই।”

    “লিয়া কেন আপনাকে এড়িয়ে চলছিল তার খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেননি? যেদিন সন্ধ্যায় লিয়া খুন হয়ে যায় সেদিন আপনার সঙ্গে লিয়ার কোনও কথা হয়নি?”

    “দেখুন অফিসার, আমার একটা আত্মসম্মান তো আছে। কেউ যদি আমার ডাকে না সাড়া দেয়, তবে আমি তার পিছন পিছন ঘুরতে পারি না। এই না যে লিয়া আমার ফোন ধরত না বা আমাদের দেখাসাক্ষাৎ বন্ধ হয়ে গেছিল। আমার পেশাগত কারণেই আমাকে লিয়ার অফিসে যেতে হত। লিয়া সেখানে কোনও অসৌজন্য দেখিয়েছে, সেটা বলতে পারব না। এমনকি ওর অফিস থেকে আমরা একসঙ্গে বেরিয়ে কোথাও কিছুটা সময় কাটিয়েছি, তেমনও হয়েছে। আমি লক্ষ করেছি, লিয়া আমাকে রবিবারগুলোয় এড়িয়ে চলছিল এবং সেক্ষেত্রে মিথ্যা বলছিল বলেও টের পেয়েছিলাম। লিয়া বলত, ওর মায়ের শরীর খারাপ বলে প্রতি শুক্রবার লন্ডন যাচ্ছে, একদম রবিবার রাত ওখানে কাটিয়ে, সোমবার সকালে সোজা অফিস জয়েন করছে। আমি সঙ্গে যেতে চাইলে বলত, এখন নয়। মা একটু সুস্থ হলে যেও।

    অথচ একদিন আমি ওর মাকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, শরীর কেমন আছে? উনি বললেন, দিব্যি আছি। আর জিজ্ঞাসা করলেন, যে আমি কি পড়াশোনা নিয়ে এতই ব্যস্ত যে লিয়ার সঙ্গে বেরতে পারছি না? লিয়া সাধারণত উইকএন্ডে শুক্রবার সন্ধ্যায় লন্ডন যেত, শনিবার রাতে ফিরে আসত, রবিবারটা আমার সঙ্গে কাটাত। আমি কথা বলে বুঝতে পারি, লিয়ার মায়ের কোনও শারীরিক সমস্যা নেই।

    লিয়া আমাকে বলছিল মায়ের শরীর খারাপ বলে ব্যস্ত, ওদিকে ওর মাকে বলছিল আমি পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত বলে ওকে সময় দিতে পারছি না। না, রবিবার রাতে আমি লিয়াকে ফোন করিনি, কারণ ওইদিন দুপুরে আমি অলিভিয়ার সঙ্গে লিয়ার বাড়িতে গেছিলাম, রাতে আমাদের বন্ধুদের গেট টুগেদারে লিয়া আর অলিভিয়াকেও ডেকেছিলাম। লিয়া বলেছিল অলিভিয়ার সঙ্গে চলে যাবে, সুতরাং ফোন করব কেন? অলিভিয়া রাতে একাই এসেছিল, বলেছিল যে লিয়া শেষ পর্যন্ত আসতে রাজি হয়নি। আমিও আর ফোন করিনি।”

    এই সময় আমার ফোনটা বেজে ওঠায় অধীরদাকে থামতে হল। দেখি গিন্নির ফোন, রাত্তির আটটার সময় ওনার সারাদিন বাদে আমার কথা খেয়াল হল, উনি আমার অবস্থান অধীরদার বাড়িতে জেনে নিশ্চিন্ত হলেন। আমি তো আগেই ওঁর অবস্থান অধীরদার গিন্নির সঙ্গে পুজো মার্কেটিংয়ে বলে জানি। তা তিনি বললেন, তাঁরা আমাদের জন্য বিরিয়ানি নিয়ে ফিরবেন। বুঝলাম ভাগ্য সুপ্রসন্ন, অধীরদাকে সে কথা বলায়, অধীরদা বললেন ব্রিয়ারলি সাহেবের পরই নাকি বিরিয়ানি ওঁর প্রিয়। আমি তাতে একমত হলাম না, বিরিয়ানি ভালো, তবে তার থেকে উপাদেয় পঞ্চাশটা খাবারের নাম আমি করতে পারি। কিন্তু তর্ক জুড়লে ব্রিয়ারলি চরিতামৃতে বাধা পড়বে বলে সে রাস্তায় গেলাম না।” অধীরদা পড়া শুরু করলেন, “অলিভিয়া হ্যামিল্টন কিন্তু সমারসেট পুলিশের মি. হিউজের ডাকে ব্রিয়ারলি সাহেবের জেরার সম্মুখীন হয়েছে। দেখা যাক, তার কী বলার আছে।”

    ব্রিয়ারলি জিজ্ঞাসা করলেন, “অলিভিয়া, আপনার সঙ্গে তো লিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল। আপনি কী কাউকে লিয়ার হত্যার ব্যাপারে সন্দেহ করছেন? রজার উইলিসকে নাকি লিয়া শেষ দিকে রবিবারগুলোয় এড়িয়ে যাচ্ছিল। এটার কারণ কী ছিল বলে আপনার মনে হয়?”

    “দেখুন অফিসার, এখন আর কোনও কথা গোপন করে লাভ নেই, মাস দুয়েক আগে একটা রবিবারে আমি আর লিয়া একদিন টনটনে কিছু কেনাকাটা করতে গেছিলাম, রজারেরও সঙ্গে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ওর শরীর খারাপ লাগায় শেষ পর্যন্ত যায়নি। কেনাকাটা সেরে আমরা টনটন হেভেন বলে একটা বারে গলা ভেজাতে ঢুকে পড়ি, তখন ওই বারের গায়ক, টেরি লসন, জন লেননের গান গাইছিল। মধ্য চল্লিশের লসন, সত্যিই ভালো গান গায়, চেহারাটিও খাসা, ওদিকে আমাদের লিয়াও জন লেননের অন্ধ ভক্ত। লিয়া প্রথম দর্শনেই লসনের প্রেমে পড়ে যায়। ওদিকে লসন বিবাহিত এবং সন্তানের পিতা, কিন্তু লিয়ার মতন সুন্দরী যুবতীর হাতছানি সে অস্বীকার করতে পারেনি। শুরু হয় দু’জনের লুকিয়ে চুরিয়ে প্রেম পর্ব। লিয়া রজারের মতো ভদ্র ছেলেকে মুখের ওপর কথাটা বলতে পারেনি।

    রবিবার সন্ধ্যায় লসনের শো থাকত। তাই সে রবিবারে রজারকে এড়িয়ে চলে যেত লসনের গান শুনতে, আমাকেও সঙ্গে যেতে হত। লসনের গান শেষ হলে ওরা ফিরত লিয়ার বাড়িতে, সঙ্গে অনেক সময় আমি। লিয়া জোর করে নিয়ে আসত, আমি ওদের অনেক উদ্দাম প্রেমের সাক্ষী থেকেছি। লিয়া আবার ওর মাকে বলেছিল, আমার একজন বয়স্ক প্রেমিক জুটেছে, মানে লসনকে আমার প্রেমিক বানিয়ে দিয়েছিল। লিয়া কিন্তু লসনের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে সিরিয়াস ছিল, যেটা রজারের ব্যাপারে ছিল না।

    ও চেয়েছিল সবদিক গুছিয়ে নিয়ে হাটে হাঁড়ি ভাঙবে, তার আগে আমাকে লসনের প্রেমিকা সেজে প্রক্সি দিতে হবে। একটা সত্যি কথা বলা উচিত, লিয়ার আড়ালে আমার সঙ্গেও কয়েকবার লসনের শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে। লসন বিছানায় দারুণ, আমি ওর সঙ্গ উপভোগ করেছি। লসন লিয়ার সঙ্গেও শারীরিক সম্পর্কেই আগ্রহী ছিল, তার বেশি কিছু নয়। আমি জানতাম এ সব সম্পর্ক ক্ষণস্থায়ী, আজ আছে কাল নেই।

    লিয়া কিন্তু একদম প্রথম থেকেই চাইছিল, লসন ওর সংসার ভেঙে এসে ওকে বিয়ে করুক, এই জন্য নিজের পরিবারের বৈভবের লোভও লসনকে দেখিয়েছিল, তবু লসন ওর দু’টো ছোট ছোট মেয়ে আর স্ত্রীকে ছেড়ে লিয়ার সঙ্গে পাকাপাকিভাবে সংসারে করতে চায়নি, এ নিয়ে একদিন লিয়ার সঙ্গে ওর উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। লিয়া লসনের বউকে সব জানিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। লসন বলে, তা হলে সে লিয়াকে খুন করে ফেলবে। রজারের খারাপ লাগতে পারে ভেবে আমি কথাটা আগে বলিনি। এখন বললাম, যদি তদন্তর কাজে কোনও সাহায্য হয়।”

    ব্রিয়ারলি বললেন, “সেই অভিশপ্ত রবিবারের কথা বলুন। সেদিনও কি আপনারা টনটন হেভেন বারে গেছিলেন?”

    “সেদিন দুপুরে রজার আমাকে, আমার ভিলা অ্যাভিনিউয়ের বাড়ি থেকে পিক আপ করে লিয়ার বাড়িতে আসে। ওর পুরনো কয়েকজন বন্ধু মিলে সেদিন রাতে একটা গেট টুগেদার মতন করেছিল, সেইজন্য টনটনের ইভনিং স্টার রেস্তরাঁয় রজার আমাদের দু’জনকেও যেতে অনুরোধ করেছিল। লিয়ার যে খুব একটা যাওয়ার ইচ্ছে নেই, সেটা টের পেয়েছিলাম। তবে লিয়া রজারকে বলেছিল যাবে।”

    ব্রিয়ারলি জিজ্ঞাসা করলেন, “এই আমন্ত্রণটুকু তো রজার ফোনেও জানাতে পারত। তার জন্য আপনাকে পিকআপ করে লিয়ার বাড়ি আসতে হল কেন?”

    “রজার কেন ফোনে না বলে সশরীরে এল, সেটা রজারকেই জিজ্ঞাসা করুন। এর মধ্যে তো কোনও অস্বাভাবিকত্ব নেই। লিয়ার সঙ্গে তো রজারের কোনও ঝগড়া হয়নি। লিয়া আর আমি সেদিন সন্ধ্যায় টনটন হেভেন বারে লসনের গান শুনতে যাই। লসনের প্রোগ্রাম ছিল পাঁচটা থেকে সাতটা, তারপরে আমরা তিনজন লিয়ার বাড়িতে ফিরে আসি। আমি চেয়েছিলাম, বাড়ি ফিরে ফ্রেস হয়ে রজারের পার্টিতে চলে যেতে। লিয়া বলেছিল, আগে ওর বাড়িতে যেতে, তারপর নয় দু’জনে মিলে একটু রাত করে রজারের পার্টিতে যাওয়া যাবে। রজারদের পার্টি মধ্য রাত অবধি চলার কথা ছিল। আমরা সাতটা পনেরো নাগাদ বার থেকে বেরিয়ে সাতটা পঁয়ত্রিশ নাগাদ লিয়ার বাড়িতে ফিরি। কিছুক্ষণ বাদে লিয়ার সঙ্গে লসনের সেই বিয়ে ডিভোর্স নিয়ে একই বাদানুবাদ শুরু হয়। আমি তখন লসনকে কায়দা করে লিয়ার বাড়ি থেকে নিয়ে বেরিয়ে যাই, আমার সঙ্গে সেদিন গাড়ি ছিল না, কারণ দুপুরে রজার আমাকে পিকআপ করায়, গাড়ি বার করিনি। লসন ওর গাড়িতে আমাকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে বেরিয়ে যায়। লিয়ার বাড়ি থেকে আমার বাড়ি, গাড়িতে দশ মিনিট মতন লাগে। তখন সম্ভবত রাত ন’টার কাছাকাছি বাজে। আমি যখন রেডি হচ্ছি, তখন লিয়া ফোন করে বলে ওর মাথাটা ধরেছে, আর বেরোবে না।

    আমি ফ্রেস হয়ে, নিজের গাড়ি নিয়ে রজারের পার্টিতে চলে যাই। তারপর কখন কী হয়ে গেল!”

    অধীরদা কফির কাপ দু’টো টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন, “অতনুদা, এ তো ত্রিকোণ প্রেমের গল্প শুরু হয়ে গেল।” আমি বললাম, “হুঁ, লসনের স্ত্রীকে হিসেবে ধরলে চতুষ্কোণও বলতে পারেন। লসন যে ফিরে এসে লিয়াকে খুন করেনি তা কে বলবে? খুনটা হয়েছে রাত ৯.৩০-১০.৩০-এর মধ্যে। অলিভিয়াকে বাড়িতে নামিয়ে লসন ফিরে এসে খুনটা করার যথেষ্ট সময় পেয়েছে। লসনের অ্যালিবাই ব্রিয়ারলি সাহেব নিশ্চয়ই খতিয়ে দেখবেন। কারণ লিয়াকে খুন করার পিছনে লসনের যথেষ্ট মোটিভ আছে।”

    অধীরদা দি ইনভেস্টিগেটরের পাতায় চোখ বুলোতে বুলোতে বললেন, “অতনুদা, লরা ফ্র্যাঙ্কের সঙ্গে ব্রিয়ারলির কথোপকথন আপাতত আমরা স্বচ্ছন্দে এড়িয়ে যেতে পারি। কারণ, বেশিরভাগটাই ওই অফিস সংক্রান্ত কচকচি। লিয়া অফিসে কী করত, অলিভিয়ার কাজ কী আর রজার উইলিসের সঙ্গে লরার অফিসের কী যোগাযোগ। ব্রিয়ারলি সাহেব আপাতত গেছেন টনটন হেভেন বারে টেরি লসনের সঙ্গে কথা বলতে আর, রবিবার রাতের সিসি টিভি ফুটেজ চেক করতে।

    “রাত বাড়ছে, যেকোনও সময় আমাদের গিন্নিরা, বহু কাঙ্ক্ষিত বিরিয়ানি নিয়ে ঢুকে পড়বেন এবং গল্প পাঠে বাধা সৃষ্টি করবেন, তাই আমরা বরং রাত্রি আটটার সময় রবার্টসনের গাড়ি যখন সমারসেট থেকে লন্ডন অভিমুখে ফিরছে, আর ব্রিয়ারলি সাহেব স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড প্রধান টনি অ্যাডামসের সঙ্গে কথা বলছেন, জাম্প কাট করে, সেই ফোনালাপে মন দিই।”

    “হ্যাঁ স্যার, কাল একবার ব্রিস্টল যাব। রবার্টসনের এ দিকে কয়েকটা কাজ দেখছে, যেটা ওর থেকে ভালো কেউ বোঝে না, সমারসেট পুলিশকে দু’-তিনটে ফরেনসিক সেরোলজির রিপোর্ট মিলিয়ে দেখতে বলেছি। আমার মনে হচ্ছে দু’-তিনটে দিন লেগে যেতে পারে সব মিলিয়ে। তা আজকে হচ্ছে শুক্রবার, ওই ধরুন মঙ্গলবার গিয়ে খুনীকে আপনার হাতে তুলে দেব। হ্যাঁ স্যার, গুড নাইট।”

    অধীরদা বললেন, “ওই শুরু হয়ে গেছে আপনার মাইক ব্রিয়ারলির বাগাড়ম্বর। নাটক না করে লোকটা কথা বলতে পারে না।” আমি বললাম, “লক্ষণটা যদিও খুব চেনা, মঙ্গলবার খুনীর জীবনে মহা অমঙ্গল হয়ে দেখা দেবে।

    ব্রিয়ারলি সাহেব জাল গুটিয়ে আনছেন, কোন মহাশোল যে সেই জালে ধরা পড়বে, তা যদিও বিন্দুমাত্র আঁচ পাওয়ার উপায় নেই। আমি কি আর সাধে লেখার সময় মাইক ব্রিয়ারলির নামের আগে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ধুরন্ধর গোয়েন্দা কথাটা জুড়ে দিই!” অধীরদা ফোড়ন কাটলেন, “ওটা, মহা ধুরন্ধর হবে।”

    মাটন বিরিয়ানি আর চিকেন চাপ সহযোগে ডিনার সেরে সিগারেটে সুখটান দিচ্ছি, এমন সময় অধীরদার বৈঠকখানার গ্র্যান্ড ফাদার ওয়াল ক্লকটা ঢং ঢং শব্দে বেজে উঠে রাত দশটা বাজার খবর জানিয়ে দিল। এ বার উঠতে হয়। অধীরদার স্ত্রী, নন্দিতা বৌদি বোধহয় আমার উশখুশ লক্ষ্য করেই বলে উঠলেন, “অতনুদা, আপনার গিন্নির সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে, আপনারা আজ রাতে আমাদের বাড়িতেই থেকে যাচ্ছেন। আমরা চললাম ওপরে, আপনারা দুই বন্ধু মাঝ রাত অবধি খুন জখম করতে থাকুন, কাল তো ছুটি আছে, তা এখানেই রাত কাটিয়ে দেবেন না, আমার বাড়িতে ঘরের কোনও অভাব নেই, ব্যবস্থা করে রাখছি। আপনার অধীরদাকে বলবেন খুনোখুনির শেষে আমাকে একটা ডাক দিতে।”

    ৫)

    মঙ্গলবার সন্ধ্যায় স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড প্রধান টনি অ্যাডামসের প্রশস্ত কক্ষে জড়ো হয়েছেন লিয়া উইলিয়ামসন হত্যাকাণ্ডে জড়িত সমস্ত কুশীলব। আছেন লিয়ার বাবা-মা, মি. এবং মিসেস উইলিয়ামসন, আছেন সমারসেট পুলিশের দুই প্রতিনিধি মি. হিউজ এবং মি. কুক, রজার উইলিস, অলিভিয়া হ্যামিলটন, লরা ফ্র্যাঙ্ক, টেরি লসন, মাইক ব্রিয়ারলি এবং তার সহকারী অ্যান্ড্রিউ রবার্টসন, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দু’জন ভিডিয়োগ্রাফার আর স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড প্রধান টনি অ্যাডামস স্বয়ং। টনি অ্যাডামস নির্দেশ দিলেন, “শুরু করো ব্রিয়ারলি।”

    মাইক ব্রিয়ারলি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ নাটকীয় ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে, সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে টনি অ্যাডামসকে অভিবাদন জানালেন, তারপর উপস্থিত সকলকে একে একে নিরীক্ষণ করে নিয়ে শুরু করলেন, “স্যার, এই রহস্যের মূলে পৌঁছতে গেলে, আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে ভারতের মাইসোর রাজ্যে। রিচার্ড উইলিয়ামসন নামক এক ব্রিটিশ যুবক ভাগ্য অন্বেষণে গিয়ে পৌঁছলেন সেই মাইসোরে, যিনি সম্পর্কে লিয়া উইলিয়ামসনের প্রপিতামহ।

    ভারতে তখন ব্রিটিশ শাসন। ইতিহাস থাক, শুধু এইটুকু জেনে রাখা যাক যে ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে মাইসোরের সিংহাসনে বসলেন মহারাজা কৃষ্ণরাজা, ব্রিটিশ

    শাসকরাই পরবর্তীতে গোলটেবিল বৈঠকের সময় যাঁকে শ্রেষ্ঠ প্রশাসক আখ্যা দিয়েছিল। ঘটনাচক্রে রিচার্ড, মহারাজা কৃষ্ণরাজার উন্নয়নমূলক কাজে যুক্ত হয়ে পড়লেন এবং সমস্ত রাজকীয় প্রোটোকলের ঘেরাটোপ সত্ত্বেও দু’জনের মধ্যে একটা সখ্যতা গড়ে উঠল।

    স্যার, এ বার আমি আপনাকে একটা ছবি দেখাব। মি. উইলিয়ামসন, আপনাকে যে ছবিটা সঙ্গে আনতে বলেছি, সেটা একটু কষ্ট করে অ্যাডামস স্যারের হাতে দিন। স্যার, ছবিতে যে দু’জন যুবতীকে দেখছেন, তার একজন অলিভিয়া হ্যামিলটন এখন এই কক্ষেই আছেন, অপর যুবতীটিই হলেন হতভাগ্য লিয়া উইলিয়ামসন। আজ থেকে আন্দাজ সাত-আট মাস আগে লিয়ার কলিগ অলিভিয়া, লিয়ার সঙ্গে উইকএন্ডে লন্ডনের উইলিয়ামসন ম্যানসনে বেড়াতে আসেন, তখন তাদের এই ছবিটি মোবাইলে তুলেছিলেন মিসেস উইলিয়ামসন, তারপর সেই ছবি হোয়াটসঅ্যাপে লিয়া এবং অলিভিয়াকে শেয়ারও করেন, যেমন আজকাল হয়, ছবিটি খুব সুন্দর হয়েছিল বলে মিসেস উইলিয়ামসন সেটা প্রিন্ট করে লিয়ার

    ঘরের দেওয়ালে টাঙিয়ে দেন।

    ছবিতে আসল দ্রষ্টব্য কিন্তু গ্রামোফোন যন্ত্রটি। অরিজিনাল, Emile Berliner; তা গ্রামোফোনের আবিষ্কার তো এমিলে বারলিনার ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে করেছিলেন, কালের নিরিখে একশো পঁয়ত্রিশ বছর সময়কাল খুব বেশিদিনের কথা নয়, ছবির গ্রামোফোনটি আরও অনেক পরের দিকের, এমিলে তখন আমেরিকা থেকে তাঁর কোম্পানি নিয়ে কানাডা চলে গেছেন, মানে ১৯০৪-এর পরের সময়ের হবে। অর্থাৎ, এমনিতে এর অ্যান্টিক ভ্যালু খুব বেশি হওয়ার কথা নয়। কিছু কিছু পুরনো রেকর্ড, অ্যান্টিক বাজারে হাজার-দেড় হাজার পাউন্ডে বিকোয়। গ্রামোফোন যন্ত্রের দাম আরও কিছু বেশি হতে পারে, যদিও স্বীকার করি, আমি গ্রামোফোন বিশেষজ্ঞ নই, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে অনেক দক্ষ অফিসার আছেন, যাঁরা ওটা আরও ভালো বলতে পারবেন, তবে আমি এই নির্দিষ্ট গ্রামোফোনটির দাম বলতে পারব, লক্ষাধিক পাউন্ড। স্যার, গ্রামোফোনটির বেসে দেখুন, মাইসোর রাজের প্রতীক খোদাই করা আছে, তলায় মহারাজ কৃষ্ণরাজার সই, গ্রামাফোনের পুরো বেস ঘিরে সোনার সূক্ষ্ম কারুকাজ করা। মাইসোর রাজ ছিলেন হায়দ্রাবাদের নিজামের পর ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ধনী রাজপুরুষ। তিনি রিচার্ড উইলিয়ামসনকে এটি প্রীতি উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন।

    বিবিসি ১৯৯৭-তে, ভারতের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর উপলক্ষ্যে, ‘ব্রিটিশ রাজ অ্যান্ড দা গ্রেট মহারাজাস অফ ইন্ডিয়া’ শীর্ষক একটা সিরিজের প্রযোজনা করেছিল, সেখানেই এই গ্রামাফোনের দাম বলা হয়েছিল এক লক্ষ পাউন্ড। এখন সেটা আরও বাড়তে পারে। শুধু বেস-এ সোনার কাজের জন্য গ্রামোফোনটি বহুমূল্য নয়, মাইসোরের মহারাজার প্রতীক ও সইয়ের জন্য এর মূল্য বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

    তবে তা কখনও একটা অমূল্য প্রাণের থেকে বেশি হতে পারে না, কিন্তু লিয়ার জীবনটা সেই কাঞ্চন মূল্যের জন্য বলি হয়ে গেল।

    বিবিসি এইসব অনুষ্ঠান মাঝে মাঝে পুনঃপ্রচার করে। রবার্টসনকে বিবিসি জানিয়েছে গত বছরের ডিসেম্বরেও তারা অনুষ্ঠানটি সম্প্রচার করেছিল। অনেকের মতন অনুষ্ঠানটি এই ঘরে উপস্থিত একজনও দেখেছিল। এই গ্রামোফোনটির ঐতিহাসিক মূল্য সম্বন্ধে উইলিয়ামসন দম্পতি এবং লিয়া উইলিয়ামসনের কোনও ধারণাই ছিল না। বিবিসি যখন মাইসোর মহারাজা সংক্রান্ত তথ্যচিত্র তৈরি করেন, তখনও মি. উইলিয়ামসনের পিতা এবং রিচার্ড উইলিয়ামসনের পুত্র মাইকেল উইলিয়ামসন বেঁচে ছিলেন, তিনিই বিবিসিকে ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে গ্রামোফোনটি উইলিয়ামসন পরিবারে পূর্বপুরুষের স্মৃতি হিসেবে সযত্নে রক্ষিত ছিল কিন্তু সেটি যে বহুমূল্য তা বুঝতে তারা অপারগ ছিলেন। উইলিয়ামসন দম্পতির সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি, বিবিসি এ রকম তথ্যচিত্র বানিয়েছিল সেটাই তাঁরা জানেন না।

    লিয়া যদিও ভারত সম্পর্কে আগ্রহী ছিল, সেটা তার পূর্বপুরুষের ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের ইতিহাসের জন্য। লিয়ার মূল আকর্ষণ ছিল ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত এবং টেগোরের গান। লিয়ার ঘরের পোস্টারগুলো সবই ভারতীয় সঙ্গীত শিল্পীদের। বইপত্রও তাই। লিয়ার লন্ডনের ঘরে, গ্রামোফোন স্রষ্টা Emile Berliner-এর জন্য প্রথম দিকে গান রেকর্ড করা কয়েকজন শিল্পীর রেকর্ড রয়েছে, যেমন George Club এবং Billy Golden; তবে সেগুলো বোধহয় লিয়ার প্রপিতামহর সংগ্রহ।

    ছবির এই গ্রামোফোনটি সম্ভবত আর কর্মক্ষম ছিল না, তাই লিয়া আর একটি গ্রামোফোন ব্যবহার করত। সমারসেটে লিয়ার ভাড়া করা বাড়িতেও একটি গ্রামোফোন ছিল। এই যুগে তরুণ প্রজন্মের বেশিরভাগ প্রতিনিধিরা গ্রামাফোনে রেকর্ড বাজিয়ে গান শোনেন না, তবে কেউ কেউ নিশ্চয়ই শোনেন। আর সেই জন্যই ব্রিস্টলের সেন্ট নিকোলাস মার্কেটের রেকর্ড আর গ্রামোফোনের দোকানগুলোর খ্যাতি। সমারসেট থেকে মাত্র এক ঘণ্টার ড্রাইভ, ব্রিস্টল সিটির একটি রেকর্ডের দোকান, এই মামলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। যাই হোক ঘরে উপস্থিত সেই বিশেষ ব্যক্তি যিনি বিবিসির তথ্যচিত্রটি দেখেছিলেন, তিনি অলিভিয়ার কাছে সেই গ্রামোফোন সহ ছবিটি দেখেই সেটিকে হস্তগত করার দীর্ঘমেয়াদী মাস্টার প্ল্যান ছকে ফেলেন। সেই লিয়াকে হত্যার জন্য দায়ী, যদিও খুন করেছে অন্য এক জন।”

    মিসেস উইলিয়ামসন এইসময় ফুঁপিয়ে উঠে বললেন, “মি. ব্রিয়ারলি, তার পরিচয় বলে দিন। যে কসাইয়ের জন্য আমার ফুলের মতন মেয়েটা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল, তাকে কারণটা জিজ্ঞাসা করতে চাই। সে গ্রামোফোনটা নিয়ে নিতে পারত। খুন কেন করতে হল?”

    ব্রিয়ারলি একটু চুপ করে থেকে বললেন, “আপনার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। আর একটু অপেক্ষা করুন। এই কক্ষের সমস্ত ঘটনা ভিডিয়োগ্রাফি করা হচ্ছে। অপরাধীর সমস্ত বাঁচার রাস্তা আমি একেবারে বন্ধ করে দেব। এই ভিডিয়ো সোজা আদালতে পেশ করা হবে।”

    তারপর টনি অ্যাডামসের দিকে ফিরে বললেন, “এমন একজন অপরাধীর সঙ্গে আমি সকলকে পরিচয় করিয়ে দেব, যার কেস হিস্ট্রি ভবিষ্যতে ক্রিমিনোলজির ছাত্রদের অবশ্যপাঠ্য হবে। তার প্রত্যেক পদক্ষেপের পিছনে রয়েছে নিখুঁত গবেষণা, প্রতিটি সূক্ষ্ম ডিটেলসের দিকে তার নজর ছিল, নিজেকে সম্পূর্ণ ধরা ছোঁওয়ার বাইরে রাখতে সে একের পর এক মাস্টার স্ট্রোক দিয়ে গেছে।

    ধরা সে পড়ত না, যদি না স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড, টনি অ্যাডামস স্যারের নেতৃত্বে এই তদন্ত হাতে নিত।”

    রবার্টসন, বিড়বিড় করে উঠল, “উফ অসহ্য! বুড়ো ছুঁচোটা টনি অ্যাডামস স্যারকে তেল দেওয়ার একটা সুযোগও হাতছাড়া করতে চায় না। তেল মেরে মেরেই একদিন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড প্রধান হওয়ার স্বপ্ল দেখছে। আসল কথা তো আমি জানি, মাইক ব্রিয়ারলি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড অফিসারের ছদ্মবেশে সাক্ষাৎ শয়তান। এই কেসের ভয়ঙ্কর অপরাধীটি চূড়ান্ত অমানুষ বটে, কিন্তু মাইক ব্রিয়ারলির সম্বন্ধে তার কোনও সম্যক ধারণা নেই। শয়তানের নাগাল কবেই বা কে পেয়েছে!”

    টনি অ্যাডামস রক্ত মাংসের মানুষ, ব্রিয়ারলির তৈলমর্দনে পুলকিত হয়েও স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড প্রধানসুলভ গাম্ভীর্য চেহারায় ফুটিয়ে তুলে বললেন, “ঠিক আছে ঠিক আছে ব্রিয়ারলি, দ্রুত শেষ করো।”

    ব্রিয়ারলি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে (কেন কে জানে! এটাও ব্রিয়ারলির ট্রেড মার্ক নাটকের অঙ্গই হবে।) আবার শুরু করলেন, সমারসেটে ২০১৬-২০১৯ সময়কালের মধ্যে তিন জন যুবতী খুন হয়ে যায়। সমারসেট পুলিশের ধারণা এই তিনটি হত্যাকাণ্ডের মূল সূত্র লুকিয়ে আছে সমারসেটের টনটন অঞ্চলের বার কাম রেস্তরাঁগুলোর আলো আঁধারিতে। আসুন, আপনাদের আলাপ করিয়ে দিই টনটন হেভেন বারের গায়ক টেরি লসনের সঙ্গে। মি. লসন একবার উঠে দাঁড়ান। ঠিক আছে এ বার বসে পড়ুন। মিসেস উইলিয়ামসন, আপাতত আপনার পায়ের জুতো, হাতে নেবেন না। আপনাকে সে সুযোগ আমি করে দেব, তখন আপনি সিদ্ধান্ত নেবেন জুতো ছুঁড়বেন; না জুতো নোংরা করবেন না।

    টেরি লসন বারে সাধারণত জন লেননের গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন, বিবাহিত এবং দু’টি কন্যা সন্তানের জনক। আদ্যন্ত নারীলোলুপ, কিন্তু নিজের সংসার বজায় রেখে তবেই লীলা খেলায় বিশ্বাসী। এই তথ্যগুলো টনটনের বারে নিয়মিত আনাগোনা করা অনেকেই জানে।

    আমাদের অপরাধী এই সুযোগ হাতছাড়া করলেন না, তার মস্তিষ্ক কোনও সাধারণ অপরাধীর থেকে সহস্র যোজন এগিয়ে, তিনি নিজের বান্ধবীকে লসনের দিকে এগিয়ে দিলেন, নারী লোলুপ লসন সেই টোপ গিলতে বিন্দুমাত্র দেরি করেনি, সেটা যে তার জন্য পাতা মৃত্যু ফাঁদ, তা লসনের দুঃস্বপ্নের বাইরে ছিল। সে মাঝে মাঝে লিয়ার বাড়িতে এসে তার বান্ধবীর সঙ্গে মিলিত হতে লাগল, যে রবিবার রাতে লিয়া খুন হয়ে যায়, সেদিনও সন্ধ্যায় টনটন হেভেন বার থেকে লসন, লিয়া আর অলিভিয়ার সঙ্গে লিয়ার বাড়িতে এসেছিল।

    মিসেস উইলিয়ামসন এই সময় বলে উঠলেন, “মি. ব্রিয়ারলি, আপনি আমার মৃতা মেয়ের চরিত্র হনন করছেন। এই লম্পটটার সঙ্গে লিয়া মিলিত হত, এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।”

    ব্রিয়ারলি বললেন, “আপনার ধারণা একদম ঠিক। আমি কখন বললাম, লসনের বান্ধবীর নাম লিয়া উইলিয়ামসন? লিয়া কোনওদিন লসনের সঙ্গে মিলিত হয়নি। লসনকে একটা বোড়ে হিসেবে দু’মাস ধরে ব্যবহার করা হয়েছে, ওই চূড়ান্ত সময়ে লসনের চিহ্ন লিয়ার ঘরে রেখে দেওয়ার জন্য এবং সেটাই ছিল লসনের তথাকথিত বান্ধবী এবং বান্ধবীর আসল বন্ধুর পরিকল্পনার অঙ্গ। আরও পরিকল্পনা ছিল, পুলিশি জেরার সময় সুকৌশলে লিয়াকে, লসনের বান্ধবী হিসেবে তুলে ধরার এবং লিয়া যে লসনকে বিয়ে করার চাপ দিয়ে ব্ল্যাকমেল করছিল সেই গল্প ফেঁদে, খুনের মোটিভ তৈরি করে লসনের বাঁচার সব রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া। আসুন, আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই লিয়ার হত্যাকারী অলিভিয়া হ্যামিলটনের এবং পুরো চিত্রনাট্যর মাস্টার মাইন্ড, রজার উইলিসের।”

    আমি বললাম, “অধীরদা, ঘটনা কোন দিকে মোড় নিল দেখেছেন? লিয়া তো রজারের বান্ধবী ছিল, আবার অলিভিয়াও তাই। দু’জনে পরিকল্পনা করে টাকার লোভে আর এক বান্ধবীকে খুন করে দিল!”

    অধীরদা বললেন, “অলিভিয়া এখন দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে আছে। রজার উইলিসকে দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। সে নিরাসক্ত মুখে ব্রিয়ারলি সাহেবের কথা শুনছে, যেন এই ঘরে যে চিত্রনাট্য অভিনীত হচ্ছে, সে তার একজন নিরপেক্ষ দর্শক মাত্র। অতনুদা, চলুন শেষটুকু পড়া যাক।”

    টনি অ্যাডামস বললেন, “ব্রিয়ারলি তোমার অভিযোগের সপক্ষে যুক্তিগুলো উপস্থাপনা করো।”

    ব্রিয়ারলি বললেন, “এ বার সেটাই করছি স্যার। আমরা প্রথম থেকেই নিশ্চিত ছিলাম, লিয়ার হত্যাকারী তার অত্যন্ত পরিচিত এবং আস্থাভাজন। লিয়া হত্যাকারীকে স্বেচ্ছায় বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছে এবং প্রাণঘাতী আক্রমণের সময়ও বিন্দুমাত্র বাধা দিতে পারেনি। অর্থাৎ, সে অন্তিম মুহূর্তেও খুনীর মতলব বুঝতে পারেনি। পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে লিয়ার শরীরে কোনও মাদক বা ঘুমের ওষুধের অস্তিত্ব ধরা পড়েনি, অর্থাৎ সে সজ্ঞানে ছিল। সমারসেটে লিয়ার উল্লেখযোগ্য বন্ধুর সংখ্যা মাত্র তিনজন। রজার, অলিভিয়া এবং লরা ফ্র্যাঙ্ক। লরার তৎপরতাতেই লিয়ার মৃত্যুর খবর দ্রুত সামনে আসে, তাকে অনেকটাই সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যায়। আপাতদৃষ্টিতে তার কোনও মোটিভও নেই। এ বার হাতে থাকে দু’টো নাম, রজার উইলিস এবং অলিভিয়া হ্যামিলটন। এ সব কিন্তু প্রমাণ নয়, বরং সম্ভাবনার তত্ত্ব, যার উপর নির্ভর করে প্রাথমিক তদন্ত শুরু হয়, যার উপর ভর করে রজার আর অলিভিয়া ঢুকে পড়ে রবার্টসনের রাডারে।

    এই সম্ভাবনার তত্ত্ব, রজার আর অলিভিয়ার মতো ধুরন্ধর অপরাধীদেরও হিসেবে ছিল। তাই তাদের মাস্টার ব্লু প্রিন্টে ঢুকে পড়ে সমারসেটে ঘটে যাওয়া তিনটি হত্যাকাণ্ড এবং তারা ফ্রেম করে টনটনের সুপরিচিত গায়ক টেরি লসনকে। রজার একদিনে এই মারাত্মক প্ল্যান করেনি। সে লন্ডনে গ্রামোফোন দেখে আসে ছ’মাস আগে আর তার খেলা শুরু হয় মাত্র দু’মাস আগে। সুতরাং, অলিভিয়াকে হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে ফেলতে রজারের সময় লেগেছে। সমারসেটের স্থানীয় বাসিন্দা হিসেবে সে বহুচর্চিত ওই তিনটি খুনের কথা জানত। একদিন টনটন হেভেন বারে রজার আর অলিভিয়া খেতে গেলে, রজার আবিষ্কার করে যে বার সিঙ্গার লসন আবেদনময়ী অলিভিয়াকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করছে, রজারের মাথায় বিদ্যুতের মতো খেলে যায় এক ঢিলে দুই পাখি মারার পরিকল্পনা।

    লসন স্বীকার করেছে সে প্রথম থেকেই অলিভিয়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল এবং মাত্র দু’মাস আগে অলিভিয়াকে প্রথমবার দেখার কথা তার স্পষ্ট মনে আছে। অলিভিয়ার সঙ্গের সেদিনের পুরুষটিকে পরে সে আর দেখেনি। লসন সেসব নিয়ে মাথা ঘামাবার বান্দা নয়, তার আকর্ষণ নারীতে। তবে তার বর্ণনা শুনলেই বোঝা যায় যে সেদিনের অলিভিয়ার সঙ্গী ব্যক্তিটি রজার উইলিস।

    উইলিয়ামসন দম্পতির সঙ্গে কথা বলার পরে, আমার সামনে দু’টো রাস্তা খুলে যায়। সমারসেটের তিনটি খুন এবং মাইসোর মহারাজের গ্রামোফোন। পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট থেকে পরিষ্কার, লিয়ার সঙ্গে সেদিন যৌন সঙ্গমের কোনও ঘটনা ঘটেনি। যেটা পূর্বের তিনটি খুনের ক্ষেত্রেই ঘটেছিল। তাই প্রথম সম্ভাবনা ব্যাকফুটে চলে যায়, দ্বিতীয়টি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে ফরেনসিক রিপোর্ট বলে দেয়, লসন আর পূর্বের তিন হত্যাকাণ্ডের ভিলেনটি ভিন্ন লোক।

    লিয়া উইলিয়ামসনের ঘর থেকে লিয়া ছাড়াও তিনজন ব্যক্তির হাতের ছাপ পাওয়া গেছে এবং ফরেনসিক সেরোলজির রিপোর্টেও কোনও চতুর্থ ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া যায়নি। আমরা গোয়েন্দা বিভাগের অফিসার হিসেবে, অধুনা ফরেনসিক সেরোলজির ক্ষমতা সম্বন্ধে সকলেই ওয়াকিবহাল। সামান্য মাথার চুল, মুখের লালা থেকেও মানুষকে চিহ্নিত করা জলভাত। এই নিয়ে এখানে বিস্তারিত আলোচনা করে কোনও লাভ নেই।

    রজার এবং অলিভিয়ার বয়ান থেকে আমরা জেনেছি যে তারা দু’জনেই সেদিন লিয়ার বাড়িতে গেছিল এবং অলিভিয়ার বয়ান অনুযায়ী অভিশপ্ত সেই সন্ধ্যায়,

    টনটন হেভেন বারের সিঙ্গার, মি. টেরি লসনও তার এবং লিয়ার সঙ্গে লিয়া উইলিয়ামসনের সমারসেটের বাড়িতে এসেছিল। লসন নিজেও সে কথা স্বীকার করেছে। অর্থাৎ, খুনীও এই তিনজনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে, এখন আমাদের কাজ ঠিকঠাক তাকে চিনে নেওয়া, কারণ লসন আগের তিনটি খুন করেনি বলেই লিয়াকে খুন করেনি, সেটা প্রমাণ হয় না।

    অলিভিয়া হ্যামিলটন হচ্ছে একটি বিখ্যাত গাড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থার সমারসেট অফিসের পার্চেস ম্যানেজার। লিয়া উইলিয়ামসনও ওই অফিসেই কাজ করত, তবে অন্য বিভাগে। বিভাগ আলাদা হলেও এক অফিসে দেখা সাক্ষাৎ তো হয়েই থাকে, দু’জন প্রায় সমবয়সী নারীর বন্ধুত্বও গড়ে ওঠে। ওদিকে রজার উইলিস হচ্ছে একটি গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানার সেল্স ম্যানেজার, সে অর্ডার ধরার জন্য অলিভিয়ার কাছে আসত এবং দু’জনের পারস্পরিক লাভের জন্য এদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। অলিভিয়া যে রজারের কোম্পানির থেকে কমিশন নিয়ে কিছু অনৈতিক সুবিধা পাইয়ে দিত সেটার প্রমাণ দেবে রবার্টসন, লিয়াদের অফিসের প্রধান লরা ফ্র্যাঙ্কও এমন কিছু আশঙ্কা করেছিলেন এবং অলিভিয়াকে অন্য বিভাগে বদলির কথা চিন্তা করছিলেন।

    তবে তা অন্য গল্প। মূল কাহিনিতে ফেরা যাক। অলিভিয়া একদিন লিয়ার সঙ্গে তাদের লন্ডনের বাড়িতে গেলে, মিসেস উইলিয়ামসন আমাদের পূর্বে বর্ণিত ছবিটি তোলেন। রজার উইলিসের সেই ছবির গ্রামোফোনটি দেখামাত্র চিনতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়নি। সে ঠিক করে বহুমূল্য এই গ্রামোফোনটি হস্তগত করতে হবে। অলিভিয়াকে সে তার পরিকল্পনা খুলে বলে। অলিভিয়ার কাছে লিয়ার ভারত প্রীতির কথা জানতে পেরে রজার নিজের পরিকল্পনা ঠিক করে ফেলে। অলিভিয়া রজারকে লিয়ার সঙ্গে প্রাচ্য দেশীয় বিদ্যায় আগ্রহী বলে পরিচয় করিয়ে দেয়। রজার বইপত্র পড়ে নিজেকে তৈরি করেছিল। অলিভিয়া আর লিয়ার সঙ্গে রজার লন্ডনে লিয়ার বাড়িতে এসে বুঝতে পারে, উইলিয়ামসনরা ওই গ্রামাফোনের অ্যান্টিক ভ্যালু বোঝেন না, সম্পদশালী উইলিয়ামসনরা এমনকি গ্রামোফোনটির পরিধি ঘিরে সোনার পাতের কাজের জন্য বস্তুটির যে মূল্য হয়, সেটা নিয়েও মাথা ঘামাননি, কিন্তু পারিবারিক ঐতিহ্যর প্রতীক হিসেবে এবং পূর্বপুরুষের স্মৃতি হিসেবে কদর করেন।

    রজার বোঝে এই গ্রামোফোন সমারসেটে কৌশলে না নিয়ে যেতে পারলে তা হস্তগত করা যাবে না। সে অলিভিয়াকে বলে কৌশলে একবার গ্রামোফোন সমারসেটে নিয়ে যেতে পারলে, লিয়াকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হবে। আসল গ্রামোফোনটির একটি রেপ্লিকা রেখে দিলে, উইলিয়ামসন দম্পতি কিছু ধরতে পারবেন না, কিন্তু ভারতপ্রেমী এবং গ্রামোফোনপ্রেমী লিয়া মাইসোর মহারাজের দেওয়া গ্রামাফোনের যত্ন করত, রেপ্লিকা দিয়ে তার চোখকে ফাঁকি দেওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। আগেই বলেছি, অলিভিয়া প্রথমে কিছুতেই লিয়াকে খুন করার ঝুঁকিতে ঢুকতে চায়নি। রজারের অলিভিয়াকে রাজি করাতে সময় লেগেছে। তারপর রজার যখন সমারসেটে পূর্বে ঘটে যাওয়া তিন যুবতীর হত্যার ঘটনাকে সফলভাবে লিয়াকে খুন করার ক্যামুফ্ল্যাজ হিসেবে ব্যবহার করার পরিকল্পনা বুঝিয়ে দেয়, তখন অলিভিয়া লোভের কাছে নতি স্বীকার করে এবং টেরি লসনকে শিখণ্ডী বানাতে নিজেকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে। লসন টোপ গিলতে দেরি করেনি।

    অলিভিয়া মাঝে মাঝে লিয়াকে নিয়ে লসনের গান শুনতে যাওয়া শুরু করে, লিয়াকে বোঝায় সে লসনের প্রেমে পড়েছে। লিয়া তাই মিসেস উইলিয়ামসনকে বলেছিল, অলিভিয়ার একজন বয়স্ক বয় ফ্রেন্ড জুটেছে। রজার আর অলিভিয়ার প্রতিটি পদক্ষেপে ছিল অঙ্কের খেলা। মিসেস উইলিয়ামসনকে রজারের ফোন করে শারীরিক কুশল জিজ্ঞাসা করাও এই অঙ্কের অঙ্গ।

    রজার লিয়াকে বলে সে ভারত বিষয়ে একটি বই লিখছে, তাই উইকএন্ডে আড্ডা দিতে আসছে না। উইলিয়ামসনদের গ্রামোফোন বিষয়ে একটা প্রবন্ধ লিখবে বলে, লিয়াকে গ্রামোফোনটি সমারসেটে নিয়ে আসতে অনুরোধ করে। রজার লিয়াকে বুঝিয়েছিল লন্ডন যেতে গেলে ওর একটা দিন নষ্ট হয়ে যাবে। লিয়া এই অনুরোধ খুশি মনে মেনে নিয়েছিল। আমার ব্যখ্যায় আপত্তি থাকলে রজার আর অলিভিয়া স্বচ্ছন্দে বলতে পারে, তবে ওরা বুঝতে পারছে তাতে লাভ হবে না।

    রজার আর লিয়া মোটেই তথাকথিত প্রেমিক প্রেমিকা ছিল না, রজারের যে চারজন বন্ধু ইভনিং স্টার বারের পার্টিতে সেই সন্ধ্যায় উপস্থিত ছিল, তারা একজনও রজারের সঙ্গে লিয়ার কোনও বিশেষ সম্পর্কের কথা জানে না।

    রজারেরও ভারত সম্বন্ধে আগ্রহ আছে জেনে লিয়া তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে। প্রেমিক হওয়ার গল্প সুকৌশলে রজারই জেরার সময় জানিয়েছিল। লিয়াকে রজার বলেছিল, সে গবেষণায় ব্যস্ত, আমার জেরায় বলেছে লিয়া ওকে শেষ দু’মাস এড়িয়ে চলত। শেষ বুধবার হেস্তনেস্ত করতে লিয়াকে ডিনারে ডাকাও মিথ্যা কথা, মনোমালিন্যের গল্প হিসেবে খাড়া করতেই এই চাল। মিসেস উইলিয়ামসনও রজারের এই লিয়াকে উইকএন্ডে সময় না দেওয়াকে প্রকারান্তরে মনোমালিন্য বলেই ব্যখ্যা করেছিলেন। রজারের অভিনয় তিনি ধরতে পারেননি। অলিভিয়া জেরায় সময় বলেছিল, লসন আর লিয়া প্রেম করছিল বলেই লিয়া রজারকে এড়িয়ে চলছিল। দারুণ পরিকল্পনা, কিন্তু রজারদের গল্পের মারাত্মক ফাঁক ওখানেই নিহিত আছে।”

    অধীরদা বললেন, “অতনুদা, চ্যালেঞ্জটা নেবেন নাকি? ফাঁকটা আপনিই বলুন।” আমি বললাম, “না বাবা, তার থেকে পাঠকরা যখন এই গল্প পড়বে, তখন নিজেরাই ফাঁকটা বার করে মিলিয়ে নেবে। শেষটা তার মতো হল কি না। আপনি পড়তে থাকুন।”

    টনি অ্যাডামস একটু বিরক্ত হলেন, “এখানে তুমি আবার কী ফাঁক খুঁজে পেলে ব্রিয়ারলি? রজারদের ব্লুপ্রিন্ট তো ত্রুটিহীন মনে হচ্ছে।”

    ব্রিয়ারলি বললেন, “জন লেননের গান। জন লেনন খুব বড় সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন, কিন্তু তিনি লিয়ার প্রিয় শিল্পী নন। লিয়ার লন্ডনের ঘরে জন লেননের একটাও রেকর্ড বা ছবি নেই। লিয়ার পছন্দ সম্পূর্ণ আলাদা ছিল, সেসব আগেই বলেছি। তাই অলিভিয়া যখনই লিয়ার জন লেননের গান শুনে লসনের প্রেমে পড়ার কথা বলে, তখনই আমি জানি অবশেষে ছিদ্রের দেখা পেয়েছি। আর দু’মাসের ভিতরে লিয়া লসনকে বিয়ে করার জন্য ব্ল্যাকমেল আরম্ভ করবে, সেটা লিয়ার শিক্ষা, রুচি, পারিবারিক মর্যাদার সঙ্গে যায় না। রজারও জানত, সে লিয়ার নাগাল পাবে না। বন্ধুত্ব ঠিক আছে, লিয়ার স্বামী হয়ে সম্পত্তি দখলের সম্ভাবনা নেই। ইভনিং স্টার রেস্তরাঁয় একসময় লিয়া তার সঙ্গে গান শুনতে যেত বলে রজারের দাবিও সর্বৈব মিথ্যা। ওই রেস্তরাঁ গান বাজনার জন্য বিখ্যাত, কিন্তু সেটা পপ মিউজিক, লিয়ার রুচির সঙ্গে খাপ খায় না। এমনিতে কোনও সময় ওখানে লিয়া খেতে যেতেই পারে, যেমন সবাই যায়। সমারসেটে লিয়ার ঘরেও জন লেননের একটিই রেকর্ড ছিল, লিয়ার লেনন ভক্ত হওয়ার প্রমাণ হিসেবে

    যেটা অলিভিয়ারাই রেপ্লিকা গ্রামাফোনে লাগিয়ে দিয়েছিল। আমি সেদিন গাড়িতে ফিরতে ফিরতে আপনাকে বলেছিলাম, একবার ব্রিস্টলে যেতে হবে। কারণ রেপ্লিকা গ্রামোফোনটিও অরিজিনাল এমিলে বারলিনার। রেপ্লিকাটি হুবহু নিখুঁত হলেও বেসে সোনার পাত গিল্টি করা সোনার। আমার এই সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ ধারণা আছে। সমারসেট পুলিশের মি. কুক, স্থানীয় স্বর্ণকারকে দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে, আমার ধারণা নির্ভুল বলেছেন।

    এই ধরনের রেপ্লিকা তৈরি করতে ব্রিস্টলের সেন্ট নিকোলাস মার্কেটের খ্যাতি সর্বজনবিদিত। যেকোনও ছবি দেখেই ওরা তার হুবহু নকল বানিয়ে দিতে পারে। মাইসোরের মহারাজার প্রতীক অবধি নিখুঁত নকল কিন্তু মহারাজার সইতে, ‘r’ অক্ষরটি সামান্য আলাদা, অরিজিনাল সইতে যেভাবে ‘r’ লেখা হয়েছিল সেই লেটারিং রেপ্লিকা প্রস্তুতকারকের কাছে ছিল না। রেপ্লিকা তৈরি কোনও বেআইনি কাজ নয়।

    অ্যাটকিনসন ব্রাদার্সের দোকানে গত এক মাস ধরে তৈরি হওয়া রেপ্লিকার তদারকি করতে রজার কয়েকবার গেছে, জন লেননের রেকর্ড ওই একই দোকান থেকে কেনা। লিয়া খুনের আগের রবিবারে রজার ওই রেপ্লিকা ডেলিভারি নেয়।

    সেসব বিস্তারিত প্রমাণ, রবার্টসন যথাসময় পেশ করবে।

    এ বার আসি খুনের দিনের ঘটনায়। খুনের আগের দিন, অর্থাৎ শনিবার রাতে লিয়া লন্ডনের বাড়ি থেকে গ্রামোফোন নিয়ে সমারসেটে আসে, রজার রেপ্লিকা হাতে পাওয়ার পরের উইকএন্ডেই আঘাত হানার জন্য লিয়াকে গ্রামোফোনটি নিয়ে আসতে অনুরোধ করেছিল। খুনের দিন দুপুরে রজার, অলিভিয়ার সঙ্গে এসে গ্রামোফোন দেখে নিশ্চিত হয়। রাতে ইভনিং স্টার রেস্তরাঁয় লিয়াকে পার্টিতে যেতে বলে, নিজেদের অ্যালিবাই পাকা করতেই এই পার্টি।

    বিকেলে অলিভিয়া লিয়াকে নিয়ে টনটন হেভেন বারে লসনের গান শুনতে যায় এবং সন্ধ্যায় শিকারটিকে বগলদাবা করে লিয়ার বাড়িতে ফিরে আসে। যখন টনটন হেভেন বারে লসনকে জেরা করতে গিয়ে লিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্কর কথা বলি, তখন সে আকাশ থেকে পড়ে। অলিভিয়া সুকৌশলে জানিয়ে দিয়েছিল লিয়ার আড়ালে তার সঙ্গেও লসনের শারীরিক সম্পর্ক আছে। কারণ, লসন সহজেই অলিভিয়ার এমন কোনও শারীরিক বৈশিষ্ট্যর কথা বলতে পারত, যা বাইরে থেকে দেখতে পাওয়া সম্ভব নয়। এটা আমার বিশ্লেষণ এবং তাতে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা শূন্য।

    তদন্তের স্বার্থেই সমস্ত তথ্য সংবাদপত্রে ছাপা যায় না। সমারসেট পুলিশ এবং স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড সমারসেটে এর আগে হওয়া তিনটি হত্যাকাণ্ডের কিনারা না করতে পারলেও ফরেনসিক সেরোলজির সাহায্যে একজনই তিনটে খুন করেছিল বলে নিশ্চিত ছিল। হতভাগ্য তিন খুন হওয়া যুবতীর শরীরে খুনী তার একাধিক শারীরিক চিহ্ন ছেড়ে গেছে। টেরি লসনের বীর্যের সঙ্গে খুনীর বীর্যের মিল পাওয়া যায়নি। লসন এবং সমারসেটের সেই খুনীর রক্তের গ্রুপও আলাদা।

    পূর্বের তিনটি হত্যাকাণ্ডের শিকার যুবতীই, খুন হয়ে যাওয়ার পূর্বে খুনীর সঙ্গে শারীরিক মিলনে লিপ্ত হয়েছিলেন, লিয়ার ক্ষেত্রে পোস্টমর্টেমে তার কোনও উল্লেখ ছিল না।

    লিয়ার লন্ডনের ঘরে মাইসোর রাজের গ্রামাফোনের ছবি আমার মস্তিষ্কে ছিল, ওটা কক্ষচ্যুত হয়ে লিয়ার মৃত্যুর ঠিক একদিন আগে সমারসেটে চলে যাওয়ার কথা শুনেই আমার সন্দেহ হয়েছিল আর সমারসেটে এসে ওই বিখ্যাত গ্রামোফোনের রেপ্লিকা ধরতে আমার সময় লাগেনি। তখনই আমি বুঝে গেছি যে লসনকে ফাঁদে ফেলা হয়েছে। এই ফাঁকে বিবিসিকে ধন্যবাদ জানাতে চাই, তারা রবার্টসনকে একগুচ্ছ ঐতিহাসিক গ্রামোফোনটির ক্লোস রেঞ্জ ছবি দিয়ে গ্রামোফোনটিকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে চিনতে সাহায্য করেছিল।

    যাই হোক পূর্ব পরিকল্পনামতো, অলিভিয়া লসনকে তার বাড়িতে ড্রপ করতে বলে, লিয়াকে বলে যায় তৈরি হয়ে থাকতে, সে বাড়ি থেকে চেঞ্জ করে এসে রজারদের পার্টিতে এক সঙ্গে যাবে। লিয়ার বাড়ি থেকে অলিভিয়ার বাড়ি গাড়িতে দশ মিনিটের পথ।

    পোশাক বদলে সময় নষ্ট না করে, লসন বেরিয়ে যাওয়া মাত্রই অলিভিয়া নিজের গাড়িতে লিয়ার বাড়িতে ফিরে আসে। এ বার আমাদের স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ভিডিয়ো অ্যানালিস্ট মি. জনসন দু’টো সিসিটিভি ফুটেজ দেখাবে। প্রথমটা লক্ষ করুন; লিয়া, অলিভিয়া এবং টেরি লসন তিনজনে সেদিন সন্ধ্যায় টনটন হেভেন বারের পার্কিং লটে। লসন নিজের গাড়িতে উঠছে। লিয়ার গাড়িতে লিয়া আর অলিভিয়া। লিয়ার পরনে অফ হোয়াইট স্কার্ট, রেড অ্যান্ড হোয়াইট ফ্লোরাল টপ, রেড স্কার্ফ।

    অলিভিয়ার পরনে ব্ল্যাক স্কার্ট, ম্যাজেন্টা কালারের টপ, কোনও স্কার্ফ নেই।

    এ বার পরের ফুটেজ দেখুন। সেদিন রাতে টনটনের ইভনিং স্টার রেস্তরাঁর পার্কিং লটে অলিভিয়া গাড়ি থেকে নামছে, তার পরনের পোশাকে পরিবর্তন হয়নি,

    ঘড়িতে সময় তখন রাত দশটা পনেরো। অঙ্কের হিসেবে অলিভিয়া খুন করার মতো যথেষ্ট সময় পেয়েছে। সেদিন সন্ধ্যায় লিয়ার পরনের পোশাকট আমরা তার বিছানার উপর রাখা দেখেছি, কিন্তু লাল স্কার্ফটি ছিল না।

    লিয়া নিশ্চয়ই একই পোশাকে অলিভিয়াকে দেখেও কিছু সন্দেহ করেনি. বিস্ময় প্রকাশ করেছিল কি না সেটা অলিভিয়া বলতে পারবে। পোস্ট মর্টেম বলছে খুন হয়েছে রাত ৯.৩০-১০.৩০-এর মধ্যে। সিসিটিভি ফুটেজের সময় হিসেব করলে বলা যায় ওটা ৯.৩০-৯.৪০-এর মধ্যে। অলিভিয়া, লিয়ার তুলনায় শারীরিকভাবে অনেক শক্তিশালী, আর লিয়া শেষ অবধি অলিভিয়ার মতলব বুঝতে পারেনি। সাধারণত বাইরে থেকে ঘরে ঢুকে, স্কার্ফ বা হ্যাটের মতো বস্তু লোকে হ্যাট অ্যান্ড আমব্রেলা স্ট্যান্ডেই ছেড়ে রাখে। অলিভিয়া লিয়ার ছেড়ে রাখা লাল স্কার্ফ গলায় ফাঁস দিয়েই লিয়াকে হত্যা করে। ফরেনসিক রিপোর্টে সেই প্রমাণ আছে, স্কার্ফের ফাইবার অলিভিয়ার গলায় তার চিহ্ন রেখে গেছে।

    রেপ্লিকা গ্রামোফোন ছিল অলিভিয়ার গাড়িতে, লিয়াকে হত্যা করে

    গ্রামোফোন বদলা বদলি করে, অলিভিয়া সোজা ইভনিং স্টার রেস্তরাঁয় রজারের পার্টিতে চলে যায়।

    মিসেস গ্রেগ লিয়াকে নয়, গাড়ি নিয়ে বেরতে দেখেছিলেন অলিভিয়াকে। মিসেস গ্রেগ লরা ফ্র্যাঙ্ককে জানিয়েছিলেন তিনি সেদিন সন্ধ্যায় লিয়াকে গাড়ি নিয়ে বেরতে দেখেছিলেন। সময়টা লরা জিজ্ঞাসা করেননি এবং মিসেস গ্রেগও বলেননি। পরে আমাদেরও উনি ঠিক করে সময়টা বলতে পারেননি, অশীতিপর একজন বৃদ্ধার পক্ষে সেটা অস্বাভাবিক নয়। সময়টা আন্দাজ ৯.৪৫ নাগাদ হওয়ার কথা। ওটা কারও কাছে সন্ধ্যা, কারও কাছে রাত্রি।

    লরা ফ্র্যাঙ্কের থেকে আমরা জানতে পেরেছি, তাদের অফিসের সমস্ত কর্মচারী, তাদের কোম্পানির নিয়ম অনুযায়ী একই রঙের একটি বিশেষ মডেলের গাড়ি ব্যবহার করে। মিসেস গ্রেগ তো গাড়ির ভিতর অত খুঁটিয়ে দেখেননি, তিনি নিজের বাড়ির বাউন্ডারি ওয়ালের মধ্যে ছিলেন, চেনা রঙের চেনা মডেলের গাড়ি দেখে লিয়া চালাচ্ছে ভেবে নিয়েছিলেন। অলিভিয়া ভেবেছিল তাকে সন্দেহ করার কোনও রাস্তা নেই। খুন করে রজারের পার্টিতে চলে গেলে নিশ্চিন্ত।

    আসলে রজার আর অলিভিয়া মনে করেছিল লসনের পক্ষে অ্যালিবাই জোগাড় করা কঠিন। গ্লসটারশায়ারের যে বাড়িতে সে থাকে তা অলিভিয়ার বাড়ি থেকে দেড় থেকে পৌনে দু’ঘণ্টার পথ। লিয়ার বাড়ি থেকেও ওই কাছাকাছি সময়। ন’টার পর থেকে এগারোটা অবধি সময়টা তার জন্য গোলমেলে। গলায় ফাঁস লাগিয়ে খুন করার মধ্যেও পুরুষালি ছোঁয়া আছে। অলিভিয়া লসনকে জড়িয়ে যে গল্প ফেঁদেছে এবং লসনের নারীঘটিত যা বদনাম তাতে পুলিশ লসনকে নিষ্কৃতি দেবে না। আর লসন আগের তিনটি খুন করেনি মানেই প্রমাণ হয় না যে সে লিয়াকে খুন করেনি।

    লসনের কিন্তু স্পষ্ট অ্যালিবাই আছে, অলিভিয়াকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে সে আর এক বান্ধবীর সঙ্গে টনটনের হোয়াইট শার্ক বারে রাত ৯.৩৫ নাগাদ মিট করে, রবার্টসন তার সত্যতা যাচাই করেছে। লসনের চারিত্রিক লাম্পট্য এ ক্ষেত্রে তার রক্ষাকবচ হয়ে গেছে।

    উল্টে রাত ৯.১০-১০.১৫ অবধি সময়ে অলিভিয়ার কোনও অ্যালিবাই নেই। অলিভিয়ার বয়ান অনুসারে লিয়া নাকি তাকে ফোনে বলেছিল, তার মাথা ধরেছে সেই জন্য রজারের পার্টিতে যাবে না এবং সেইজন্য অলিভিয়া বাড়ি থেকেই রজারের পার্টিতে চলে যায়। লিয়ার মোবাইল উদ্ধার করা যায়নি, কিন্তু রবার্টসন এই ঘরে উপস্থিত বাকি কুশীলবদের সবারই ফোন, মেল হ্যাক করেছে। হ্যাঁ, উইলিয়ামসন দম্পতিরও। রজারদের সতর্কতায় বেশি তথ্য তার থেকে পাওয়া যায়নি, কিন্তু লিয়া যে অলিভিয়ার বর্ণিত সময়ে তাকে কোনও ফোন করেনি সেটা নিশ্চিতভাবে জানা গেছে। লিয়া কিন্তু পার্টিতে যাবে বলে পুরোপুরি তৈরি হয়েছিল, মৃত্যুর সময় তার পরনে ছিল স্কাইব্লু কালারের পার্টি গাউন।

    মাইসোরের মহারাজার গ্রামোফোন সরানোর সুযোগ এখনও রজার উইলিস পায়নি। ওটা রজারের কাছ থেকেই পাওয়া যাবে, অলিভিয়ার কাছে ওই সম্পদ রজার গচ্ছিত রাখবে না। ও জিনিসের ক্রেতা রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় না, আর লসন খুনের দায়ে গ্রেফতার হলে তবেই নিশ্চিন্তে রজার ওটা বিক্রির চেষ্টা করত।

    তবে লিয়ার মোবাইল পাওয়া যাবে না, অলিভিয়ারা ওটা নষ্ট করে ফেলেছে। স্কার্ফ নষ্ট করা কিন্তু প্রায় অসম্ভব, পুড়িয়ে ফেললেও নিষ্কৃতি নেই। যদি রজার বা অলিভিয়ার বাড়িতে না পাই, তবে সারা সমারসেট চষে ফেলা হবে। খুনীদের নিস্তার নেই।

    মি. অ্যান্ড মিসেস উইলিয়ামসন, আপনাদের জন্য কোনও সান্ত্বনাই যথেষ্ট নয়, তবু বলছি, রজার আর অলিভিয়া যাতে কড়া শাস্তি পায় তার সব ব্যবস্থা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড করবে। স্যার তবে অনুমতি করুন, চলো হে রবার্টসন এ দিকের ফর্মালিটি শেষ করি। রাত বাড়ছে, বাড়ি ফিরতে হবে।”

    অধীরদা বললেন, “অতনুদা, রজার আর অলিভিয়ার অসাধারণ দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ওদের প্রায় সাফল্য এনে দিয়েছিল আর টেরি লসনকে অবধারিতভাবে বড় বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। ব্রিয়ারলি সাহেবের ক্ষুরধার বুদ্ধি সেসব অনায়াসে ব্যর্থ করে দিল। একে আপনি এক কথায় কী বলবেন?”

    আমি বললাম, “চেক মেট ইন সমারসেট”।

    অধীরদা যখন বই বন্ধ করলেন, তখন রাত দু’টো বেজে গেছে। ব্রিয়ারলি চরিতামৃতের এমনই নেশা, সময় কোথা দিয়ে বয়ে গেছে আমরা টের পাইনি।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments