যশস্বিনী ভরতনাট্যম শিল্পী যামিনী কৃষ্ণমূর্তি সেটাই ব্যক্ত করেছেন তাঁর Communion কবিতায়। মঞ্চের উপরে শিল্পী পরিবেশন করছেন নৃত্য তাঁর মনপ্রাণ আবেগ নিঃশেষিত করে। সামনে অডিটোরিয়ামে বসে আছেন দর্শকেরা। শিল্পীর নিবেদন সার্থক হবে যখন তাঁর আবেগ সঞ্চারিত হবে দর্শকের মনে। যামিনী কৃষ্ণমূর্তি সনেটটি শেষ করেছেন এই দুলাইন দিয়ে –
For the communion is not done
Till you and I are one!
এই একই অভিব্যক্তি প্রতিফলিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের ‘গানভঙ্গ’ কবিতায়। নবীন যুবা কাশীনাথ কণ্ঠে সাতটি সুর সাতটি পোষা পাখির মতো খেলিয়ে সভাগৃহ ধ্বনিত করে সংগীত পরিবেশন করলেন। রাজসভা মন্ত্রমুগ্ধ, শুধু বৃদ্ধ রাজা প্রতাপ রায় ছাড়া। তিনি বৃদ্ধ শিল্পী বরজলালের কানে কানে বললেন ‘গানের মতো গান’ শোনাতে। তানপুরা নিয়ে তাঁর মন্থর আলাপে শ্রোতারা অসহিষ্ণু। এক এক করে সভাগৃহ পরিত্যাগ করতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত রইলেন শুধুমাত্র রাজা। বেদনাহত অশ্রুপ্লুত শিল্পী রাজাকে নিবেদন করলেন—
জগতে আমাদের বিজন সভা কেবল তুমি আর আমি—
সেখানে আনিয়োনা নতুন শ্রোতা মিনতি তব পদে স্বামী।
একাকী গায়কের নহে তো গান মিলিতে হবে দুইজনে—
গাহিবে একজন ছাড়িয়া গলা আরেকজন গাবে মনে।
বরজলাল ঠিক – তাঁর গানের সঙ্গে রাজার চিত্তসংযোগ ঘটে বলেই রাজাকে গান শোনানো সার্থক। সেই চিত্তসংযোগ অন্য শ্রোতাদের সঙ্গে ঘটে নি – তাই তাদের অসহিষ্ণুতা। তবে এটাও তো ঠিক যে অন্যান্য শ্রোতা কাশীনাথের গান শুনে মুগ্ধ হয়েছে, বাহবা দিয়েছে, এবং সেটা কাশীনাথের গানের সঙ্গে তাদের চিত্তসংযোগের কারণেই। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে ‘my music, his music’ কথাটা খাটে।
ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁ তাঁর এক অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছিলেন। শিল্পী হিসাবে খ্যাতিলাভের প্রাথমিক পর্বে এক শেঠজি তাঁর বাড়িতে এসে তাঁর গান একান্তভাবে শোনার আগ্রহ জানালেন। বড়োলোকের খেয়াল ভেবে ওস্তাদজি বললেন, তিনি অবশ্যই গান শোনাতে পারেন, তবে তার জন্য পাঁচশো টাকা নেবেন। শেঠজি রাজি হলেন। ওস্তাদজি গান শুরু করলেন, কিন্তু সেরকম মন না লাগিয়ে। আধঘণ্টা গান শোনার পর শেঠজি তাঁকে থামিয়ে বললেন, গতরাত্রির অনুষ্ঠানে ওস্তাদজির গান শুনে তিনি যে আনন্দ পেয়েছিলেন এখন তা পাচ্ছেন না। পাঁচশো টাকা ওস্তাদজির হাতে দিয়ে তিনি চলে গেলেন। খাঁ সাহেব বলেছিলেন, এই ঘটনা থেকে তিনি এক বিরাট শিক্ষালাভ করেছিলেন—শিল্পীকে সর্বদাই চেষ্টা করতে হবে তাঁর পরিবেশনায় যেন নিষ্ঠার ঘাটতি না থাকে, কেননা হাজার শ্রোতার মধ্যে প্রকৃত গুণগ্রাহী একজনও থাকলে তিনি তাঁকে বঞ্চিত করতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে চিত্তসংযোগের অভাব ঘটেছিল শিল্পীর গাফিলতির কারণে।
সঙ্গীতের ক্ষেত্রে যেমন, সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এই চিত্তসংযোগের গুরুত্ব অপরিসীম। ‘মালতীমাধব’ কাব্যের প্রস্তাবনায় ভবভূতি লিখেছিলেন—
উৎপৎস্যতেহস্তি মম কোহপি সমানধর্মা।
কালোহ্যয়ং নিরবধির্বিপুলা চ পৃথ্বী ।।
কী জানি মিলিতে পারে মম সমতুল,
সময় অসীম আর বসুধা বিপুল। (রবীন্দ্রনাথ কৃত অনুবাদ)
এটিকে কোন অহংকারপ্রসূত উক্তি ভাবলে হয়তো ভুল হবে। কবির আর্তি, তাঁর কাব্য যেন পাঠকের চিত্তবিনোদন করে, তাঁর কাব্যের সঙ্গে যেন পাঠকের চিত্তসংযোগ ঘটে – বিপুল পৃথিবীতে নিরবধি কালের কোন এক সময়ে এমন ঈপ্সীত পাঠক মেলা অসম্ভব নয়।
কালিদাসের ‘রঘুবংশ’ কাব্যে সমুদ্রদর্শনে অভিভূত রামচন্দ্র সমুদ্রের বর্ণনা দিয়েছেন--
দূরাদয়শ্চক্রনিভশ্চ তন্বী তমালতালীবনরাজিনীলা
আভাতি বেলা লবণাম্বুরাশের্ধারানিবদ্ধেব কলঙ্করেখা।
বহু শতাব্দী পরে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’য় সমুদ্রদর্শনে অভিভূত নবকুমার এই শ্লোকই উচ্চারণ করেছে। এটি আসলে কালিদাসের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের চিত্তসংযোগ। সমুদ্রদর্শনে একজনের অনুভুতি অনায়াসে সঞ্চারিত হয়েছে অন্যজনের মনে।
পাঠকমহলে তেমনভাবে পরিচিত নন এমন এক কবি কালীপদ কোঙার তাঁর ‘প্রিয় কবিকে’ কবিতায় লিখেছিলেন—
তোমার কবিতা পড়ি তন্ময় হয়ে,
মনে হয় পড়ে যাচ্ছি স্বরচিত অপূর্ব কবিতা।
পড়া শেষ হলে ভুল ভাঙে, লজ্জা হয়—
এগুলি আমারই কথা,
অথচ এমন ভালো করে বলি
সেই শক্তি বিন্দুমাত্র ছিল না আমার।
এই ধরনের চিত্তসংযোগ ঘটলেই যে কোন কবিতা অথবা যে কোন সাহিত্য সার্থক সৃষ্টি হয়ে ওঠে—কালের সীমানা অতিক্রম করে সেগুলি চিরন্তন হয়ে ওঠে।
কথাসাহিত্যিক পাঠককে একাত্ম করতে পারেন তাঁর সৃষ্ট চরিত্রদের সঙ্গে, কিংবা নিয়ে যেতে পারেন তাঁর বর্ণিত ঘটনাস্থলে। তাই আমরা অভিভূত হয়ে পড়ি শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাসের’ ট্র্যাজিক উপসংহারে, বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালি’তে বড়োলোকের বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে গিয়ে দিদি দুর্গার জন্য অপুর বেদনা অনুভবের বৃত্তান্তে। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’য় ‘পথিক, তুমি কি পথ হারাইয়াছ?’ আমাদের টেনে নিয়ে উপস্থিত করে সাগরতীরবর্তী বিজন অরণ্যে, কিংবা ‘দুর্গেশনন্দিনী’তে যখন শুনি ‘ এই বন্দী আমার প্রাণেশ্বর’ তখন আমরা দীপ্তিময়ী আয়েষাকে মুখোমুখি প্রত্যক্ষ করি। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ কালের ব্যবধান পেরিয়ে আমাদের নিয়ে গিয়ে ফেলে অতীতের গৌরবমুখর বিজয়নগরে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’য় শশী যখন প্রশ্ন করে ‘শুধু শরীর আর শরীর! তোমার কি মন নাই কুসুম?’তখন আমাদের চেতনায় কি আমরা এক বিপুল অভিঘাত অনুভব করি না? এরকম উদাহরণ অজস্র – আমাদের সাহিত্যে কিংবা বিশ্বসাহিত্যে।
আধ্যাত্মিকতার জগতে চিত্তসংযোগই শেষ কথা। দার্শনিকের প্রশ্ন, ‘কোহয়ম্? কুতঃ আয়াত;?’ – আমি কে, কোথা থেকে এসেছি? তার উত্তর খুঁজতে গিয়ে এসেছে জীবাত্মা-পরমাত্মার প্রসঙ্গ—জীবের উৎপত্তি পরমাত্মা থেকে, পরমাত্মায় বিলীন হওয়াতেই তার মুক্তি। ভক্ত দার্শনিক মনে রাখেন এবং মনে করিয়ে দেন ‘এই কথাটা ধরে রাখিস, মুক্তি তোরে পেতেই হবে’। মুক্তির প্রয়াস তাঁর চলে অহরহ। যতক্ষণ তা না হয়, থেকে যায় অতৃপ্তি –
লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখলু
তব হিয়া জুড়ন ন গেলি।
যখন একাত্মতা ঘটে, তখন তিনি সোচ্চার হয়ে বলে ওঠেন--‘এই জনমে ঘটালে মোর জন্ম- জনমান্তর’।