কবিতার অন্তিম পঙ্ক্তিগুলো পড়া শেষ হতে না হতেই পাশের মসজিদ থেকে আওয়াজ এল “আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর”। উপস্থিত সকলের কণ্ঠে ধ্বনিত হল, ‘তেরি আওয়াজ় মক্কে অউর মদিনে’। আজানের শেষে সকলে দুয়া করে হাত তুললেন। মির্জ়া ফখরু আমন্ত্রিত গুণীজনদের উদ্দেশে বললেন: ‘সাহাবো! মুশায়রার সূচনা হয়েছিল ফতিহা খইর (শুভকামনামূলক প্রার্থনা) দিয়ে। আর কী আশ্চর্য সমাপতন যে সম্মেলনের সমাপ্তিও হচ্ছে সেই ফতিহা খইর দিয়ে!’ এতক্ষণ দুটি দীপ আমন্ত্রিতদের সামনে পর্যায়ক্রমে রাখা হচ্ছিল। কবি সম্মেলনের সমাপ্তিতে সে দুটি আবার তাঁর কাছে ফিরে এসেছে। মির্জা ফুঁ দিয়ে দীপগুলি নেভানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রহরীদের কণ্ঠস্বর শোনা গেল: ‘ভদ্রমহোদয়গণ, দিল্লির অন্তিম মুশায়রার এখানেই সমাপ্তি’।
ফরহতউল্লাহ্ বেগ দহল্ভি’র (১৮৮৩-১৯৪৮) মহাকাব্যিক দহ্লি কা এক ইয়াদগার মুশায়রা ইয়া দহ্লি কি আখরি শামাহ্-র শেষ পঙ্ক্তিগুলোর উদ্ধৃতি দেওয়া হল। আঠারো শো পঁয়তাল্লিশ সনে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের আমলের শেষ কবি-সম্মেলনের উজ্জ্বল অথচ বিষাদময় বর্ণনা আছে ফরহতউল্লাহ্ বেগের এই বইটিতে। বাস্তব আর কল্পনার সুমধুর সংমিশ্রণ ঘটেছে সে কেতাবে। পরিশীলিত সংস্কৃতি আর সুরুচির জন্য পরিচিত সে রাজধানীর সাহিত্যচর্চার বাহ্যিক প্রতিফলন ঘটত কবি-সম্মেলনে। যে দীপটি একে একে কবিদের সামনে রাখা হচ্ছিল আর তাঁরা স্বরচিত কবিতা পড়ছিলেন, সেই দীপ নেভানো আর পবিত্র কোরানের প্রথম সূরার আবৃত্তির মধ্যে দিয়ে যেন এক বিয়োগান্তক নাটকের শেষ দৃশ্যটি অবলোকন করলাম আমরা। এখানে লক্ষণীয় যে ফতিহা অর্থাৎ পবিত্র কোরানের প্রথম অধ্যায়টি মৃতদের উদ্দেশে প্রার্থনা জানানোর জন্যও পড়া হয়।
ঊনবিংশ শতাব্দের মধ্যভাগের সেই সময়ে একদা প্রায় সমগ্র উপমহাদেশে রাজত্ব করা মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছে। বাদশাহের নিয়ন্ত্রণ টিকে আছে শুধু দিল্লি শহর, হয়তবা কেবল লাল কেল্লার পরিধির মধ্যে। বাহাদুর শাহ আর বিশ্ববিজেতা মহান মুঘল সম্রাট নন, তিনি এখন কবি, পির ও মুরশিদ। কবি-সম্মেলনই অধুনা তাঁর দরবার। বহিঃশত্রুর ক্রমাগত আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত শহর দিল্লি, ক্ষতবিক্ষত কবিদের মন। রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে বিচক্ষণতার অভাবে দেখা দিয়েছে অবক্ষয়। অথচ কী আশ্চর্য সেই বিষণ্ণ, অবসন্ন সময়ে মার্বেল আর বেলেপাথরের স্থাপত্যশিল্পের তুলনায় আরও স্থায়ী কিছু নির্মিত হয়ে চলেছে ক্রমাগত। একদিকে গালিব, জ়ৌক, মোমিনের মত কবিদের মুখের ভাষা যেন আরোহণ করেছে উৎকর্ষের উত্তুঙ্গ শৃঙ্গে। অন্যদিকে উর্দু সাহিত্যের সে স্বর্ণযুগ প্রত্যক্ষ করছে নাগরিক জীবনে অবমাননা আর অপদস্থ হওয়ার লজ্জা। যে অপমানের ভাগীদার বাদশাহ থেকে ফকির পর্যন্ত সকলেই। এও এক অদ্ভুত সমাপতন।
মুঘল সূর্য অস্তাচলগামী। বাহাদুর শাহের দিন গুজরান হয় ব্রিটিশদের আনুকূল্যে প্রাপ্ত সামান্য পেনশনে। তবু রাজপ্রাসাদে এখনও তিনি সম্রাট তো বটে। কেল্লায় নিয়মিত দরবারও বসে। মুশায়রার আয়োজক করিমউদ্দিনের মত মানুষদের অবশ্যই আসতে হয় সম্রাটের প্রতিনিধি উজ়ির-এ-আজ়ম বা প্রধানমন্ত্রীর কাছে। সম্রাটের দুই গুণী পুত্র বর্তমান। প্রতীত উত্তরাধিকারী শাহজ়াদা দারা মহম্মদ বখত্ বাহাদুর, যিনি মির্জা শাব্বু নামে পরিচিত। ততোধিক গুণী দ্বিতীয় পুত্রটি হলেন ফখরউদ্দিন বা মির্জা ফখরু। করিমউদ্দিনের মুশায়রায় এই শাহজ়াদা ফখরুই সম্রাটের প্রতিনিধিত্ব করবেন। বোঝা যাবে মুশায়রার জটিল আদব-কায়দার ব্যাপারে তিনি যে শুধু সিদ্ধহস্ত তাই নয়, নিজেও একজন কৃতবিদ্য কবি।
ফখরুর পিতা সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ বিজ্ঞান ও শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পূর্বসূরি মুঘল বাদশাহদের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। তিনি নিজে হস্তলিপিশিল্পে দক্ষ। গজ়ল-লিখিয়ে কবি তো বটেই। করিমউদ্দিনের মুশায়রায় তিনি যে গজ়লটি পাঠিয়েছেন সেটি নিশ্চয়ই তাঁর অপূর্ব সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা। 'জ়ফর' এই তখল্লুস্ বা ছদ্মনাম তাঁর। ওস্তাদ কবি জ়ৌকের পৃষ্ঠপোষক ও শাকরেদ তিনি। রাজকার্য পরিচালনার ব্যস্ততার মধ্যেও সময় বার করে তিনি ফারসি কবি সাদি'র গুলিস্তান নিয়ে বিদগ্ধ ভাষ্য লিখেছেন। বাহাদুর শাহের দিল্লি শহরে গুণী মানুষদের কদর আছে। পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ, কবি, ঐতিহাসিক, দার্শনিক, আইনজ্ঞ, গণিতজ্ঞদের নিয়ে যেন নক্ষত্র সমাবেশ। অথচ গরিবগুরবো আর বাইরে থেকে আসা আগন্তুকদের কাছে সে শহর বড়ই কঠিন ঠাঁই। ফরাহ্তুল্লাহ'র বইয়ের কেন্দ্রীয় চরিত্র করিমউদ্দিন মগফুর স্বীকার করেছেন যে তিনি দরিদ্র। জ্ঞানস্পৃহা আর মনের চঞ্চলতার কারণেই তিনি পানিপত থেকে দিল্লি এসেছিলেন। পুরোনো দিল্লি কলেজে অধ্যয়নের পর একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে ধ্রুপদী আরবি সাহিত্যের সুপরিচিত রচনাগুলি মুদ্রিত হত। তবকত-উল-শোরা-এ-হিন্দ (হিন্দুস্থানের কবিদের জীবনচরিত) ছাড়াও এই মুশায়রা যে সময়ে অনুষ্ঠিত হয় তখন তিনি ঐতিহাসিক গ্রন্থ তারিখ-এ-আবুল ফিদা অনুবাদের কাজে ব্যস্ত ছিলেন।
তাঁর বইয়ের ভূমিকায় হিন্দু কলেজ, সেণ্ট স্টিফেন্স কলেজের বিজ্ঞানের ছাত্র, পরবর্তীকালে সরকারি আমলা ফরহতউল্লাহ্ বেগ বলেছেন দহ্লি কি আখরি শামাহ্ রচনার কাহিনি। উর্দু কাব্যের শেষ প্রদীপটি জ্বালানো আর মুঘল গরিমার অন্তিম দিনগুলিতে উর্দু কবিদের কাব্যচর্চার স্মৃতিকে ধরে রাখার প্রচেষ্টার উপাখ্যান সেটি। ফরহতউল্লাহ্-র মনে হয়েছিল এমন বৃদ্ধরা তখনও তাঁর চারপাশে আছেন যাঁদের সঙ্গে গালিব, মোমিন, জ়ৌক, দাগ, শৈফ্তার মত কবিদের ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল। তাঁরা হয়ত এমন মানুষদেরও দেখেছেন যাঁদের লাল কেল্লায় অনুষ্ঠিত শাহি মুশায়রায় উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। ফরহতউল্লাহ্'র রঙিন কাহিনির কতগুলি তিনি মুখে-মুখে শুনেছিলেন। স্বচক্ষে হাকিম মোমিন খান মোমিনের বসতবাড়ির ধ্বংসাবশেষ এবং তাঁর স্মৃতিসৌধ দেখেছেন বলে তিনি জানিয়েছেন। আবার গালিবের পোশাকের বর্ণনা দেওয়ার সময় লাল কেল্লার জাদুঘরে সংরক্ষিত কবির প্রতিকৃতি তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছে।
তবে সেই কাল্পনিক মুশায়রার কাহিনি বিবৃত করার মূল অনুপ্রেরণা ছিল হিজরি ১২৬১ (ইংরেজি ১৮৪৫)-তে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত একটি আসল মুশায়রার বর্ণনা। সে বর্ণনা পাওয়া যায় মৌলবি করিমউদ্দিন রচিত তবকত-উল-শোরা-এ-হিন্দ গ্রন্থে। বস্তুত, মুশায়রার বর্ণনা করার সময় ফরহতউল্লাহ্ যেন পর্দার আড়ালে চলে গেলেন। মঞ্চের ওপর দাঁড় করিয়ে দিলেন মৌলবি করিমউদ্দিনকে। কবি সম্মেলনের সূচনা আর সমাপ্তির সব দায়িত্ব যেন করিমউদ্দিনের। দহ্লি কি আখরি শামাহ্-র পাঠকরা যখন পড়েন, 'আমি করিমউদ্দিন। আমার জন্ম পানিপতে....' তখন তাঁরা যেন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা শুনছেন। পাঠক নিজেও যেন সেই মুশায়রার শ্রোতা বনে যান।
১৩২৭ শতাব্দে দিল্লির খামখেয়ালি সম্রাট মুহম্মদ বিন তুঘলক রাজধানী দৌলতাবাদ থেকে দক্ষিণ ভারতে সরিয়ে নিয়ে গেলে খরিবোলির প্রভাব বাড়ল সেখানেও। তার নতুন নামকরণ হল 'দখ্নি'। চতুর্দশ শতকেই দিল্লিতে এই নতুন ভাষাকে 'উর্দু-এ-মুঅল্লা' (অর্থাৎ উচ্চকোটির মানুষদের মুখনিঃসৃত উর্দু ভাষা) এবং 'রেখতা' নামে অভিহিত করা হত। এই উদীয়মান ভাষার বাক্যগঠন বিধি আর ব্যাকরণের নিয়মাবলীর ভিত তৈরি হয়েছিল উত্তর ভারতের দেশজ ভাষাগুলি থেকে। ধ্বনিমাধুর্য সমন্বিত, রাজসিক শব্দগুলি এসেছিল আরবি থেকে, মনোহর, তাৎপর্যময়, কাব্যিক শব্দভাণ্ডারের উৎস ছিল ফারসি ভাষা। তা সত্ত্বেও দিল্লির অভিজাত শ্রেণি আর রাজ দরবার তখনও ফারসির পরিশীলিত ভঙ্গিমায় মজেছিল। উর্দুর আরও অগ্রগতির জন্য নির্ভর করতে হল দাক্ষিণাত্যের ওপর। সেখানে, দিল্লির প্রভাব থেকে দূরে, উর্দু দ্রুত বিকশিত হতে শুরু করল।
গোলকোণ্ডার সুলতান হায়দ্রাবাদের স্থপতি মুহম্মদ কুতব শাহ কুলি নিজে কবি ছিলেন। তিনি এবং তাঁর পরবর্তী তিন প্রজন্মের সুলতানদের কাব্যচর্চার প্রতি যে আগ্রহ ছিল, গোলকোণ্ডা আর বিজাপুরের দরবারে তাঁরা কবি-লেখকদের যে সম্মানের আসনে বসিয়েছিলেন, তারই পরিণামে উর্দু হয়ে উঠল আরও সমৃদ্ধ একটি ভাষা। বিজাপুর-গোলকোণ্ডার কবিসমাজ সংস্কৃত, ফারসি, স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষাগুলি থেকে আমদানি করলেন অজস্র শব্দ। মরসিয়া, কাসিদা, মসনভি, গজ়ল, আফসানা রচনার উপযুক্ত মাধ্যম হয়ে উঠল উর্দু।
১৬৮৬-৮৭-তে আওরঙ্গজেব পুনরায় দাক্ষিণাত্য জয় করলে দক্ষিণী কবি-লেখকদের সঙ্গে আবার দিল্লির সম্পর্ক দৃঢ় হল। ততদিনে, মুহম্মদ বিন তুঘলকের খেয়ালি সিদ্ধান্তের পরে প্রায় সাড়ে তিন শো বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এই তিন শো বছরে উর্দু ভাষার রূপের আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। এবারে দিল্লির কবিরা, যাঁরা এতদিন ধরে ফারসিকেই কাব্যচর্চার উপযুক্ত মাধ্যম বলে গণ্য করে এসেছেন, উর্দুর প্রেমে পড়ে গেলেন। দখ্নি উর্দুর সরলতা, রমণীয়তা আর মাধুর্য তাঁদের মন জয় করে নিল।
কেউ কেউ ১৭৫০ – ১৮৫০ এই এক শো বছরকে উর্দু কাব্যের স্বর্ণযুগ বলেন। সেই এক শো বছরই আবার মুঘল সাম্রাজ্যের ক্রমান্বয়ে ভেঙে পড়ার ইতিহাস। তৎকালীন স্বর্ণালি কবিতার ঝলক পাওয়া যায় খ্বাজা মির দর্দের সুফি কাব্যে, মির তকি মির আর মির মুহম্মদ সোজ় এর গজ়লে, মির্জা রফি সৌদার ব্যঙ্গাত্মক কবিতায় আর মির হাসানের মসনভি, অর্থাৎ অন্ত্যমিলবিশিষ্ট দ্বিপদী কাব্যে।
ঊনবিংশ শতাব্দের মধ্যভাগেও উর্দু ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি মির্জা গালিব ছিলেন ফারসি ভাষা ও কাব্যের প্রতি নিবেদিত। ফারসি ভাষায় তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা আর দীর্ঘদিন ধরে ফারসি চর্চাই হয়ত তার কারণ। তিনি ফারসির আভিজাত্যে মজেছিলেন। উর্দুকে কিছুটা হীন চোখে দেখতেন। ভাগ্যের কী পরিহাস যে ভবিষ্যৎ তাঁকে চিনবে উর্দু-আকাশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র বলে! বাহাদুর শাহ জাফরের মুঘল দরবারের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগই গালিবকে উর্দু ভাষায় লিখতে প্রবৃত্ত করেছিল। বন্ধু নবি বকশ হাকির-কে ১৮৫১-এ লেখা একটি চিঠিতে গালিব বলছেন: ‘আমি জাহাঁপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তিনি সাধারণত আমাকে উর্দু কাব্য আনতে বলেন।’ শেষ পর্যন্ত যখন গালিব উর্দুতে কাব্য রচনা শুরু করলেন, তখন ‘উর্দু সাহিত্যের যাদু’ তাঁকে আচ্ছন্ন করল। শুধু তাই নয়, স্বরচিত চিঠিতে তিনি প্রকাশ করে চললেন উর্দু গদ্যের এক অনবদ্য শৈল্পিক রূপ। ঊনবিংশ শতকে শেষ মুঘলদের সময়েই উর্দু কাব্য আরোহণ করল উৎকর্ষতার শৃঙ্গে। জ়ৌক, জাফর, গালিব, মোমিন, দাগ, শেফতাহ্-র মত কবিরা উর্দু কাব্যে যে পদচিহ্ন রেখে গেলেন, তা আজও বিদ্যমান।
অর্থাৎ দিল্লিতে উদ্ভবের পরে দাক্ষিণাত্যে লালিত-পালিত হয়ে দিল্লি ও লখনউয়ে আরও পরিশীলিত, ক্ষুরধার ও সমৃদ্ধ যে ভাষাটির সৃষ্টি হল করিমউদ্দিনের মুশায়রা অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় তার ফারসির সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা ছিল। বস্তুত সেই মুশায়রায় ফারসি আর উর্দুর ভাগ্যের নাটকীয় পট-পরিবর্তন পরিলক্ষিত হল। প্রায় ষাট জন কবির সেই সম্মেলনে ফারসি ভাষায় মাত্র একটি গজ়ল পড়া হলেও তা দর্শকদের অনুপ্রাণিত করতে পেরেছিল বলে মনে হয়নি। বোঝা গেল যা একদা ছিল মুঘল রাজদরবারের ভাষা, তা ক্রমশ জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। করিমউদ্দিনের মুশায়রায় দিল্লির আকাশে উর্দুর নবীন সূর্যের উদয় হল।
করিমউদ্দিনের শেষ মুশায়রার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল আগাগোড়া উর্দু ভাষার প্রয়োগ। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যটি অবশ্যই গজ়ল নামে একটি বিশেষ কাব্যিক রীতি বা জ়ঁর। আবু সয়ীদ আইয়ুব বহু দশক আগে তাঁর গালিবের কবিতার অনুবাদের ভূমিকায় 'অপরিচিত বাঙালি পাঠকের' যাতে উর্দু শের-এর অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে সুবিধা হয় সেই প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন। তাঁর বই থেকে একটি অনুচ্ছেদের উদ্ধৃতি বোধহয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না:
‘মনে রাখা ভালো যে প্রায় কোনো গজলই পরিচিত অর্থে এমন-কি আধুনিক কবিতার নজীরেও একটি কবিতা নয়, পাঁচ-সাতটি বা পনেরো-কুড়িটি শের-এর সমষ্টি, কেবলমাত্র ছন্দ ও মিলের ঐক্যে একত্রিত; ভাবের ঐক্য না-থাকারই কথা, থাকাটা ব্যতিক্রম। শাস্ত্রমানা ধার্মিক ও ধর্মোপদেষ্টাকে নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ, দার্শনিক তত্ত্বকথা, মরমিয়া রাজসিকতা, প্রিয়ার কোমল কান্তি এবং জল্লাদী নিষ্ঠুরতার বর্ণনা, নিজের কবিপুরুষ সম্বন্ধে অহঙ্কার বা মৃদু ঠাট্টা — সবই একটি গজলে পাশাপাশি স্থান পেতে পারে। প্রকৃত প্রস্তাবে দুই পঙ্ক্তি-সংবলিত শেরই একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কবিতা। জাপানী হাইকুর কাছাকাছি, তবে তুলনায় একটু দীর্ঘ এবং বেশ-একটু জটিল। এই কাব্যকণিকাগুলির পরিসর অতিসীমিত ব’লে শব্দের চয়নে ও বিন্যাসে অতিশয় দক্ষতার প্রয়োজন বোধ করেছেন উর্দু শায়েররা। রসস্রষ্ট হোন আর না-ই হোন, রূপদক্ষ তাঁদের হ’তেই হয়।’ (বানান অপরিবর্তিত) [তথ্যসূত্র: ২]
গঠনরীতির দিক থেকে গজ়লকে বেঁধে রেখেছে তার শব্দসমষ্টি আর ছন্দের বিন্যাস। ফারসি আর উর্দু কাব্যে এই ছন্দের বিন্যাসের মূল ভিত্তি হল কাফিয়া আর রদিফ। আর এই বিন্যাস পদ্ধতিকেই বলা হয় তরহ। গজ়লের প্রতিটি শের-এর দ্বিতীয় পঙ্ক্তির শেষে অন্ত্যমিলবিশিষ্ট যে শব্দ বা শব্দসমষ্টির পুনরাবৃত্তি হতে থাকে তা হল রদিফ। আর কাফিয়া হল সেই ছন্দমিল যা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গজ়লের প্রতিটি শেরকে বেঁধে রাখে। আরও গুরুত্বপূর্ণ হল ছন্দের এই মিলের অবস্থান লাইনের শেষের বদলে রদিফের ঠিক আগে। সাধারণত গজ়লের প্রথম একটি বা দুটি শেরের (যাদের মত্লা বলা হয়) প্রতিটি পঙ্ক্তিতে এই মিল পরিলক্ষিত হয়। তারপরে প্রতিটি শের এর দ্বিতীয় পঙ্ক্তিতে এই মিল পাওয়া যাবে (যেমন, কক, খক, গক, ঘক ইত্যাদি)। অর্থাৎ সাধারণত শুধু ‘মত্লা’ অংশে রদিফ আর কাফিয়াকে প্রতিটি পঙ্ক্তিতে পাওয়া যাবে।
দিল-এ-নাদাঁ তুঝে হুয়া কেয়া হ্যায়এই গজ়লে ‘কেয়া হ্যায়’ শব্দবন্ধের পুনরাবৃত্তিই হল রদিফ, আর ‘হুয়া’, ‘দাওয়া’, ‘মাজরা’, ‘মুদ্আ’, ‘খুদা’ হল কাফিয়া।
আখির ইস্ দরদ কি দাওয়া কেয়া হ্যায়
হাম হ্যাঁয় মুশতাক অউর বোহ্ বেজ়ার
ইয়া ইলাহি ইয়ে মাজরা কেয়া হ্যায়
ম্যাঁয় ভি মুঁ মেঁ জ়ুবান রাখতা হুঁ
কাশ পুছো কে মুদ্আ কেয়া হ্যায়
জব কে তুঝ বিন নহিঁ কোই মওজুদ
ফির ইয়েহ হাঙ্গামা, অ্যায় খুদা, কেয়া হ্যায়
ছন্দের এই বিন্যাস বজায় রাখতে হলে গজ়ল-গো অর্থাৎ গজ়ল-লিখিয়ে কবিকে কী পরিমাণ দীর্ঘ অভ্যাস ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হয় তা অনুধাবন করতে অসুবিধে হয় না। তাই বোধহয় আইয়ুব সাহেব বলেছেন যে উর্দু শায়েরদের রূপদক্ষ হতেই হয়। চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী মুশায়রায় একটি বিশেষ ‘তরহ’ মেনে পদ্য লিখতে হয়। শোনা যায় বাহাদুর শাহ জ়ফর ফারসি আর উর্দু কবিতার জন্য দুটি ভিন্ন ‘তরহ’-র সুপারিশ পাঠাতেন। করিমউদ্দিনের মুশায়রায় অবশ্য সম্রাট কবিদের ছন্দের ব্যাপারে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন।
মুশায়রা অবশ্যই সহজ বিনোদনের বন্দোবস্ত নয়। এই ধরনের সান্ধ্য কবি সম্মেলনে কবিরা তাঁদের সাম্প্রতিক মূল রচনা পাঠ করেন। মুঘল আমলেই মুশায়রা ক্রমশ হয়ে উঠেছিল সাহিত্য সমালোচনা, তর্ক-বিতর্ক এবং কখনও বা তাৎক্ষণিক কাব্যরচনার সমাবেশ-ক্ষেত্র, যদিও যে কোনও মুশায়রার মূল উদ্দেশ্য হত নির্বাচিত গজ়ল কানে শুনে উপভোগ করার সুযোগ দেওয়া। বাহাদুর শাহের আমলের প্রথম দিকে সম্রাটের অনুরোধে এবং পৃষ্ঠপোষকতায় মাসের ১৫ আর ২৯ তারিখ দিওয়ান-এ-আম এ কবি সম্মেলনের আয়োজন করা হত। পরবর্তীকালে দিওয়ান-এ-আম এর বদলে বিভিন্ন স্থানে মুশায়রা অনুষ্ঠিত হত। করিমউদ্দিনের মুশায়রার অনুষ্ঠানস্থলটি ছিল হাউজ্ কাজ়িতে মুবারকউন্নিসার হাভেলি। সেই মুশায়রায় বাদশাহ তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন মোমিন, জ়ৌক, গালিব এবং অন্যান্য প্রথম সারির কবিদের বাড়ি গিয়ে আমন্ত্রণ জানিয়ে এই অনুরোধ রাখতে যে তাঁরা যেন মুশায়রায় অংশগ্রহণ করেন আর সেহ্বাই, আজ়ুরদাহ বা শৈফতাহ্র মত প্রতিভাবান শাকরেদেরও সঙ্গে নিয়ে আসেন। সম্রাট দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন যে দরবারের আচরণবিধির কারণে তাঁর পক্ষে কেল্লার বাইরে অনুষ্ঠিত কোনও মুশায়রায় অংশ নেওয়া সম্ভব হবে না। কিন্তু তিনি একটি অসাধারণ গজ়ল লিখে পাঠিয়েছিলেন (যা আমরা পরে শুনব), এবং তাঁর হয়ে সম্মেলন পরিচালনার জন্য কনিষ্ঠ পুত্র মির্জা ফখরুকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। মির্জা ফখরু অতি মনোরম ভঙ্গিতে, সাবলীলভাবে সে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
'নিশাস্ত' অর্থাৎ মুশায়রায় কবিদের বসার বন্দোবস্ত স্পর্শকাতর বিষয় ছিল। চিরাচরিত শিষ্টাচার মেনে কবিরা কে কোথায় বসবেন তা নির্ধারণ করা হত। প্রতিষ্ঠিত ওস্তাদ কবিরা সদলবলে বসতেন, শাকরেদরা তাঁদের ঘিরে থাকতেন। এই বিশেষ ব্যবস্থায় তাঁদের খ্যাতি-প্রতিপত্তি সম্পর্কে আরও কোনও সন্দেহ থাকত না। প্রায় গোলাকার বসার ব্যবস্থায় সভাপতি অবশ্যই কেন্দ্রীয় আসনটিতে বসার অধিকার পেতেন। তাঁর সামনে বাগদেবীর প্রতীক হিসেবে শামাহ্ অর্থাৎ দীপটি রাখা হত। অনুষ্ঠান শুরু হলে একে একে এই দীপটি উপবিষ্ট কবিদের সামনে এলে তাঁরা স্বরচিত কাব্য পাঠ করতেন। করিমউদ্দিন জানিয়েছেন যে মির্জা গালিব তাঁর আবেগময়, মাধুর্যে ভরা কণ্ঠস্বরে গজ়ল পাঠ করেছিলেন। বাহাদুর শাহের সময়ে গজ়ল গান করে অথবা সুর করে পড়ার রীতিই চালু ছিল। উর্দু ভাষায় যাকে 'তারান্নুম্ সে পড়না' বলা হয় তা হল আসলে গান গাওয়া আর কবিতা পাঠের মধ্যবর্তী একটি রীতি। করিমউদ্দিনের মুশায়রায় সেহ্বাইয়ের শাকরেদ শাহজ়াদা ইজ়াদ তাঁর গজ়লটি গেয়ে শুনিয়েছিলেন। শোনা যায় যে শাহজ়াদার সুরেলা কণ্ঠের মাধুর্য তাঁর কাব্যের দুর্বলতা অনেকটাই ঢেকে দিয়েছিল!
নাম-এ-নেক-এ রফ্তগাঁ জ়ায়ে মকুনতাঁর কেতাবের 'তম্হিদ' অর্থাৎ মুখবন্ধে ফরহতউল্লাহ্ বেগ বলছেন:
তা বা মানদ নাম-এ-নেকত বরকরার
(- শেখ সা'দি শিরাজ়ি, ফারসি কবি)
[পূর্বপুরুষের সুনাম বিনষ্ট হতে দিও না; যাতে তোমার নামও অমলিন থাকে।]]
দিল্লির শেষ কবি সম্মেলনে সর্বকালের সব উর্দু কবিদের পরিবর্তে ফরহতউল্লাহ্ কল্পনায় শুধু সেই কবিদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, মুঘল সাম্রাজ্যের পড়ন্ত বেলায় দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের আমলে দিল্লির বিভিন্ন মুশায়রায় যাঁদের উজ্জ্বল উপস্থিতি দেখা যেত। ফরহতউল্লাহ্র কল্পিত মুশায়রার ঐতিহাসিক তাৎপর্য অনস্বীকার্য। তাঁর ভাষায় 'জ়মানা এক রঙ্গ পর নহিঁ রহতা'। কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই হারিয়ে যায়। সিপাহি বিদ্রোহের ঝোড়ো দিনগুলিতে ১৮৫৭-র পরেও যে কবিরা বেঁচে ছিলেন তাঁরা রামপুর, হায়দ্রাবাদ বা অন্যত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলেন। 'অউর এক জ়মানা বোহ্ আনেওয়ালা হ্যায় কে কোই ইয়ে বাতানেওয়ালা ভি না রহেগা কে মোমিন মরহুম কা কাঁহা থা। জিস্ তরহ সিভায়ে মেরে আব শায়েদ কিসি কো ইয়ে ভি মালুম নহিঁ কে উন্ কি কবর কাহাঁ হ্যায়।’ এমন একটি যুগ আসছে যখন কবি মোমিনের বাসস্থান কোথায় ছিল অথবা কোথায় তাঁকে কবর দেওয়া হয়েছিল সে খবর দেওয়ার কেউ থাকবে না।‘মুঝে বচপন সে শোরায়ে উর্দু কে হালাত পড়নে অউর সুন্নে কা শওক্ রহা।’ উর্দু কবিদের জীবন কাহিনি জানার এই মনোবাঞ্ছা শেষ পর্যন্ত এই ইচ্ছের জন্ম দিল যে একটি বইতে তিনি প্রখ্যাত উর্দু কবিদের জীবন্ত প্রতিকৃতি ভাষায় প্রকাশ করবেন। ‘জব কোই বাত হোনেওয়ালি হ্যায়, তো আসবাব খুদ-বখুদ পয়দা হো জাতে হ্যাঁয়।' নিয়তি নির্দিষ্ট করে দিলে সে কাজ সম্পন্ন করার উপায়ের অভাব হয় না। ‘আসলে হল কী আমার পুরোনো কাগজপত্রের মধ্যে হাকিম মোমিন খান দহলভি'র কালি-কলমে লেখা প্রতিকৃতি পেয়ে গেলাম। তৎক্ষণাৎ আমার মনে হল যে মুহম্মদ হুসেন আজ়াদ নইরঙ্গ-এ-খেয়াল (কল্পনার অত্যাশ্চর্য পৃথিবী)-এ যেমন করেছেন, আমি তেমনই কবিদের নিয়ে একটি কল্পিত মুশায়রার ছবি আঁকব। কিন্তু কাব্যের পর্যালোচনামূলক উপস্থাপনার পরিবর্তে কবিদের “চলতি-ফিরতি তসভির”, অর্থাৎ জীবন্ত প্রতিকৃতি উপস্থাপিত করব। এই ধারণা থেকেই ধীরে ধীরে আমার মনে সেই কবি-সম্মেলনের পরিকল্পনাটি স্পষ্ট হতে থাকে। লেকিন ইয়ে মুঝ মে নহিঁ আতা থা কে মুখতলিফ জ়মানে কে শায়েরোঁ কো কিস্ তরহ এক জাগাহ্ জমাহ্ করুঁ।’ বিভিন্ন যুগের কবিদের এক জায়গায় বসানোর উপায়ই বা কী? এই দ্বন্দ্বের সমাধান হল প্রয়াত মুন্শি আমিরুল্লাহ্ তসলিমের একটি শের স্মরণে আসায়:
'জওয়ানি সে জ়েয়াদা ওয়াক্ত-এ-পিরি জোশ হোতা হ্যায়
ভড়কতা হ্যায় চিরাগ-এ-সুবহ্ যব খামোশ হোতা হ্যায়'
[প্রদোষকালে নেভার আগে দীপশিখা যেমন উজ্জ্বলতর হয়, বার্ধক্যের আবেগ-উন্মাদনা তেমন যৌবনকে পিছনে ফেলে।]
ফরহতউল্লাহ্ বলেছেন যে হিজরি ১২৬১-র ঘটনাবলীর ঐতিহাসিক বিবরণ তিনি এমনভাবে দিতে পারতেন যেন তা তাঁর স্বচক্ষে দেখা। তাঁর সামনে ছিল মুহম্মদ হুসেন আজ়াদ রচিত নইরঙ্গ-এ-খেয়াল-এর কল্পিত মুশায়রার উদাহরণ। আবার অন্যদিকে করিমউদ্দিন মগফুরের তবকত-উল-শোরা-এ-হিন্দ থেকে তিনি জানতে পেরেছিলেন ১৮৪৫ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত সেই আসল মুশায়রার কাহিনি। সে সম্মেলনের আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন করিমউদ্দিন স্বয়ং। তাঁর বাড়িতেই সেই মুশায়রার আয়োজন হয়েছিল। তিনিই ছিলেন সেই সম্মেলনের ‘রুহ-এ-রওয়াঁ’ (হৃদয় ও আত্মা)। তফাত শুধু এই যে করিমউদ্দিনের মুশায়রায় অংশ নেওয়া কবিদের সংখ্যা ছিল সীমিত। ফরহতউল্লাহ্ তাকে আরও ব্যাপক রূপ দিয়ে সে যুগের সব খ্যাতনামা কবিদের সেই সম্মেলনে আমন্ত্রণ করে এনে বসালেন।
কেতাবের ‘তদ্বির’ (পরিকল্পনা) শিরোনামবিশিষ্ট অধ্যায়টির সূচনা হচ্ছে মির্জা গালিবের একটি শের দিয়ে:
‘হাভাস্ কো হ্যায় নিশাট-এ-কার কেয়া কিয়াএই ক্ষণস্থায়ী জীবনে দাগ রেখে যাওয়ার বাসনাই প্রাণিত করেছিল সেই মানুষটিকে যিনি ঘোষণা করছেন: ‘মেরা নাম করিমউদ্দিন হ্যায়। ম্যাঁয় পানিপতকে রহনেওয়ালা হুঁ।’ পেশায় হস্তলিপিশিল্পী এই করিমউদ্দিন সারাদিনের কঠোর পরিশ্রমের পর শুধু লেখাপড়াকে ভালোবাসার কারণে সাহিত্যসভা বা মজলিসে ঘুরে বেড়াতেন। উর্দু কাব্যের সে স্বর্ণযুগে বাদশাহ থেকে ফকির সকলেই কবিতায় মজে আছেন। দুর্ভাগ্য এই যে তা সত্ত্বেও শুধু আনন্দের জন্য অধ্যয়নের কোনও সামাজিক মূল্য নেই। তাই কয়েকজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে করিমউদ্দিন মুবারকউন্নিসার হাভেলিতে ছাপাখানা খুলেছেন। আরবি ভাষার সুপরিচিত ধ্রুপদী সাহিত্যকীর্তির অনুবাদ প্রকাশ করে চলেছেন। ‘খেয়াল আয়া কে এক মুশায়রা কায়েম কর কে শোরাকে হালাত অউর উন কা কালাম তবহ করুঁ।’ উর্দু কবিদের জীবন কাহিনি ও কাব্য প্রকাশ করতে পারলে ছাপাখানাও চলবে।
না হো মরনা তো জিনে কা মজ়া কেয়া’
[তীব্র জীবনতৃষ্ণা আর ভোগলালসায় তাড়িত এ জীবন; মৃত্যু না রইলে বাঁচার আনন্দই বা কী!]
'বশের ও সুখন মজলিস্ আরাসতন্দবাদশাহ-নির্দিষ্ট কবি সম্মেলনের দিন রজব (ইসলামি বর্ষপঞ্জির সপ্তম মাস) এর চোদ্দ তারিখ সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় করিমউদ্দিন মুশায়রায় যাওয়ার জন্য তৈরি হলেন। বলছেন: ‘ঘর সে জো নিক্লা তো বাজ়ার মেঁ চহল-পহল দেখি। হর শখস্ কি জ়ুবান পর মুশায়রে কা জ়িকর থা।’ বাজারে সকলেই উত্তেজিত, সবার মুখে মুশায়রার কথা। মুবারকউন্নিসা বেগমের হাভেলি চুনকামের পরে নতুন সাজে সেজে উঠেছে। চারদিকে আলোর ছটা। একে একে কবিদের আগমন ঘটছে। মুশায়রায় চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী কবিদের বসানোও একটি শিল্প। বসার বন্দোবস্ত এমন ভাবে করা হয়েছিল যাতে সভাপতির ডানদিকে সেই কবিরা বসলেন যাঁরা লখনউ দরবারের কবি। আর দিল্লি দরবারের শায়েররা আসন গ্রহণ করলেন বাঁদিকে। সম্রাটের কনিষ্ঠ পুত্র মির্জা ফখরু এলেন পালকিতে। পেছনে পেছনে এল সবুজ পাগড়ি, সবুজ কোট, কোমরে লাল স্কার্ফ আর হাতে সোনালি-রূপালি দণ্ড নিয়ে সোঁটাবরদারেরা। শাহজ়াদা শামিয়ানার সামনে দাঁড়িয়ে সকল অভ্যাগতকে সালাম জানিয়ে বললেন, ‘ইজাজ়ত?’ প্রত্যুত্তরে ‘বিসমিল্লাহ্, বিসমিল্লাহ্’ ধ্বনি উঠলে তিনি শামিয়ানার অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন। সকলকে সালাম জানিয়ে উপবেশন করলেন। বাকি সকলকে বসার অনুমতির জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, ‘তসরিফ রাখিয়ে, তসরিফ রাখিয়ে’।
নশিস্তন্দ-ও-গুফ্তন্দ ও বরখাসতন্দ'
[তাঁদের কাব্য আর শিল্পের প্রসাদগুণে মজলিস মাধুর্যমণ্ডিত হল। তাঁরা আসন গ্রহণ করলেন, আলাপ-আলোচনা সারলেন, পরিশেষে সানন্দে করলেন প্রস্থান।]
ফতিয়া খইর পাঠ শেষ হলে শাহজ়াদা কবিদের উদ্দেশে বললেন: ‘দিল্লির বাগিচার সুরেলা কণ্ঠের গায়কদের সামনে এই বিশিষ্ট ওস্তাদদের মুশায়রায় মির-এ-মজলিস্ হওয়ার কথা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। আমি শুধু হজরত পির ও মুরশিদের (অর্থাৎ বাদশাহের) ফরমান তামিল করার জন্যই এখানে হাজির হয়েছি। এই মুশায়রার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আপনারা সকলেই অবহিত। এর জন্য কোনও ‘তরহ’ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়নি। আর দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যটি হল একটি দীপের বদলে দুটি দীপ রাখা হয়েছে। ‘তরহ’ এর বাঁধন খুলে দেওয়ায় যেমন ঔদ্ধত্য হেতু কবিদের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধের দরজাটি বন্ধ করে দেওয়া গেল, তেমনি দুটি দীপ রেখে আমি ‘ইবতিদা অউর ইন্তেহা’ অর্থাৎ সূচনা আর সমাপ্তির ব্যবধান ঘুচিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। মহামহিম বাদশাহের মহিমামণ্ডিত রচনা দিয়ে আজ সন্ধ্যায় মুশায়রার সূচনা করতে পেরে আমি আনন্দিত। ঠিক তার পরেই স্বরচিত গজ়লটি নিবেদন করব যাতে ‘প্রথম’ আর ‘শেষ’ এর দ্বন্দ্বটি দূর হয়।’
বক্তব্যের শেষে মির্জা ফখরু হাত নাড়াতেই দুজন সোঁটাবরদার দুটি শামাহ্ মহামহিমের সামনে রাখল। ‘বিসমিল্লাহ্’ বলে শাহজ়াদা দীপ প্রজ্বলন করার পরে তারা খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট ও উচ্চস্বরে ঘোষণা করল: ‘হজ়রাত! মুশায়রা শুরুহ হোতা হ্যায়।’ সমাবেশে তখন পিন পড়লেও শব্দ শোনা যায়।
‘হুজ্র-এ-শাহ মেঁ আহিল-এ-সুখন কি আজ়মাইশ হ্যায়উপস্থিত সকলে হাঁটু মুড়ে মাথা নুইয়ে বসলে বাদশাহের উর্দি পরা ছোকরা-চাকর রেশম কাপড়ে মোড়া বাক্স থেকে বাদশাহ সালামতের গজ়লটি বার করে সেটি ঠোঁটে আর চোখে স্পর্শ করে মধুর, সুরেলা কণ্ঠে পড়তে শুরু করল। রচনার স্বতঃস্ফূর্ততা, ভাষার সৌকর্য আর পাঠকের গলার স্বরে সকলে বিমোহিত হয়ে গেলেন। পাঠ শেষ হলে কয়েক মুহূর্ত সকলেই নীরব, যেন তাঁরা হর্ষধ্বনি দিতেও ভুলে গেছেন। মক্তা (গজ়লের অন্তিম শেরটি) পড়ার সময় মনে হচ্ছিল কেউ যেন জাদু করেছে। তারপরেই উঠল ‘সুভান আল্লাহ্, সুভান আল্লাহ্’ রব।
চমন মেঁ নওয়াইন-এ-চমন কি আজ়মাইশ হ্যায়।
(-মির্জা গালিব)[মহামহিমের উপস্থিতিতে কবিশ্রেষ্ঠদের বিচার বসেছে। বাগানের সুকণ্ঠীদের পরীক্ষা চলেছে।]
নহিঁ ইশক্ মেঁ ইস্ কা তো রঞ্জ হমেঁদীর্ঘ সময় ধরে, রাতভর চলেছিল করিমউদ্দিনের সেই মুশায়রা। প্রায় ষাট জন কবি স্বরচিত গজ়ল পাঠ করেছিলেন। দুটি দীপ সভাপতির ডান ও বাঁদিকে ঘুরে বেড়িয়েছিল। উর্দু ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি বলে পরিচিত মির্জা গালিবের যখন গজ়ল পড়ার পালা এল, তখন ভোর হচ্ছে। তাঁর সামনে দীপটি রাখার সঙ্গে সঙ্গে কবি বলে উঠলেন, ‘সাহাবো! আমি ভৈরবী গাওয়ার আগে সুর মিলিয়ে নিই।’ তিনি এমন মাধুর্য নিয়ে গজ়ল পড়লেন যে আসর মাত করে দিলেন:
কে করার ও শাকিব জ়ারা না রহা
গম-এ-ইশক্ মেঁ তো আপনা রফিক রহা কোই অউর
বালা সে রহা না রহা
না থি হাল কি জব হামেঁ আপনে খবর
রহে দেখতে অউরোঁ কে আইব-ও-হুন্র
পড়ি আপনি বুরাইয়োঁ পর জো নজ়র
তো নিগাহ্ মে কোই বুরা না রহা
................................................
জ়ফর আদ্মি উস্ কো না জানিয়েগা
হো বোহ্ ক্যায়সা হি সাহিব-এ-ফাহিমো জ়কা
জিসে আইশ মেঁ ইয়াদ-এ-খুদা না রহে
জিসে তাইশ মেঁ খওফ-এ-খুদা না রহা
[প্রেমের বিরুদ্ধে আমার এই অভিযোগ নয় যে সামান্য শান্তি আর স্থৈর্যও আর রইল না। প্রেমের বেদনা আমার সঙ্গী ছিল — আর কেউ থাকল কী না তাতে কীই বা আসে যায়। নিজের খবর রাখতে পারিনি, কিন্তু অন্যের পাপ-পুণ্যের হিসেব রেখেছি। যখন নিজের দোষত্রুটির ওপর নজর পড়ল, তখন আমার দৃষ্টিতে অন্যের কলঙ্ক আর ধরা পড়ে না।.............যিনি আরাম আর আয়েশের সময় ঈশ্বর-বিস্মৃত হন, আবেগ আর ক্রোধের বশে যাঁর ঈশ্বরভীতি অপসৃত হয়, তিনি যতই জ্ঞান আর বুদ্ধির অধিকারী হোন না কেন, জ়ফর তাঁকে মানুষ বলে গণ্য কোরো না।]
দিল-এ-নাদাঁ তুঝে হুয়া কেয়া হ্যায়সাধারণত নৈশ সঙ্গীতানুষ্ঠানের সমাপ্তি হয় রাগ ভৈরবীর উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে। গালিব বোধহয় ভৈরবী রাগের উল্লেখ করে বলতে চেয়েছিলেন যে মুশায়রার শেষ কবি এবং গালিবের প্রতিদ্বন্দ্বী জ়ৌক মুশায়রার অনুষ্ঠানের পরিসমাপ্তি ঘটানোর সম্মান লাভ করবেন না। বরং গালিবের রচিত গজ়লটিই দিল্লির শেষ মুশায়রার শেষ গজ়ল হিসেবে মানুষের মনের মণিকোঠায় অমলিন হয়ে থাকবে।
আখির ইস্ দরদ কি দাওয়া কেয়া হ্যায়
হম হ্যাঁয় মুশতাক অউর বোহ্ বেজ়ার
ইয়া ইলাহি ইয়ে মাজরা কেয়া হ্যায়*
..........................................
হম্ কো উন সে ভফা কি হ্যায় উম্মিদ
যো নহিঁ জানতে ভফা কেয়া হ্যায়
........................................
ম্যাঁয় নে মানা কে কুছ নহিঁ গালিব
মুফৎ হাথ আয়ে তো বুরা কেয়া হ্যায়*
[অবুঝ মন তোর কী হয়েছে?
এ ব্যথার উপশম কীসে?
আমি ব্যাকুল আর তিনি বিরক্ত –
হায় ঈশ্বর, এ কী ব্যাপার?
....................................
আমি তাঁর কাছে বিশ্বস্ততা চেয়েছি
যে জানে না বিশ্বাস কী!
.........................
মানলাম যে গালিব কিছুই না, তবু
একেবারে বিনা খরচায় পেয়ে যাও তো মন্দই বা কী?
(* চিহ্নিত শেরগুলির অনুবাদ আবু সয়ীদ আইয়ুবের ‘গালিবের গজল থেকে’ নেওয়া)
তথ্যসূত্র:
১) উর্দু:
দহ্লি কা এক ইয়াদগার মুশায়রা ইয়া দহ্লি কি আখরি শামাহ্
লেখক: মির্জা ফরহতউল্লাহ্ বেগ দহলভি
মূল্যায়ন ও পর্যালোচনা: এহসান-উল হক আখতার
আদবি লাইব্রেরি, লাহোর
প্রথম সংস্করণ, মার্চ ১৯৬৮
২) ইংরেজি
The Last Musha’irah of Dehli
Mirza Farhatullah Baig
Translated from the Urdu by Akhtar Qamber
Orient Blackswan
Hyderbad, India
2010
৩) বাংলা
গালিবের গজ়ল থেকে: চয়ন ও পরিচিতি
আবু সয়ীদ আইয়ুব
দে'জ পাবলিশিং
কলকাতা – ৭০০০৭৩
সপ্তম মুদ্রণ; নভেম্বর ২০০১