সত্তরের দশকের অস্থির সময়। কলেজে যাওয়ার সময় অনি নীলার পিছু নিতো। দীর্ঘ, ঋজু, বাঁ হাতি অনির চোখে সার্চলাইটের মতো আলো জ্বলতে দেখতো নীলা। পড়াশুনোয় ভালো ছিল অনিকেত। ইতিহাস নিয়ে স্কটিশ চার্চে অনার্স পড়ছিলো। বাবুঘাটে পাশে হাঁটতে হাঁটতে ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস বলতো। ভালো লাগতো নীলার। ভরসা হতো। স্বপ্ন দেখতো অনির সঙ্গে একদিন ঘর বাঁধার।
অনিকেতের বাড়িতে নীলামাসির সঙ্গে যেত বাচ্চু। অনিদার বাবা ছিলেন উঁচু সারির সরকারি আমলা। নীলামাসিকে খুব পছন্দ করতেন মাসিমা আর মেসোমশাই। দেখা হলেই মাসিমা বলতেন, ‘নীলা একটু বলো না অনিকে এসব ছেড়ে পড়াশুনো করতে। ভীষণ ভয় করে আমার ! আমাদের কথাতো শুনলো না, তুমি বললে শুনবে।’
তারপর অনিকেত কলেজ ছাড়লো। এই বুর্জোয়া শিক্ষায় ওর আর কোনো আস্থা নেই। একদিন বললো, --আমাদের আর দেখা না হওয়াই ভালো।
--কেন?
--আমার জীবন এখন কোন খাতে বইবে আমি নিজেই জানি না। উত্তর কলকাতার অ্যাকশন স্কোয়াড এখন আমাকে লিড করতে হবে। পুলিশ আমাকে খুঁজবে। তুমি বিপদে পড়ে যাবে। তারপরে আমি গ্রামে চলে যাবো। অনেক কাজ!
--আর কোনোদিন দেখা হবে না?
নীলার গলা ধরে এলো।
--হবে হয়তো একদিন যেদিন ভারতবর্ষ মুক্তাঞ্চল হয়ে যাবে। যদি বেঁচে থাকি আবার দেখা হবে। তুমি কি ততদিন অপেক্ষা করতে পারবে?
নীলা নিশ্চুপ। চোখে জল।
নীলা কলকাতায় বাচ্চুদের বাড়িতে থেকে পড়াশুনো করতো। বাবা মা আসানসোলে। বোনপো বাচ্চুও দিন দিন ওর ভক্ত হয়ে উঠলো কারণ নীলা অনির নাড়ি নক্ষত্রের খবর রাখে। কবে কোথায় কী অ্যাকশন সব কিছু আগাম জানতে পারে বাচ্চু নীলামাসির কাছ থেকে। বাচ্চুকে একদিন ব্যারিটোন গলায় ডাকলো অনিদা ক্ষুদে কমরেড বলে। বললো, ‘এই বস্তাপচা সমাজকে বদলাতে হলে বন্দুক ধরা ছাড়া আরতো কোনো রাস্তা নেই কমরেড। এই পার্লামেন্টতো শুয়োরের খোয়াড়। বন্দুকের নলইতো রাজনৈতিক শক্তির উৎস।’ কথাগুলোর মধ্যে বারুদের গন্ধ পেলো বাচ্চু। রেডবুক পড়তে শুরু করলো লুকিয়ে। গেরিলা আক্রমণের মূল নীতি, শত্রু আক্রমণ করলে পিছু হটো, শত্রু ক্লান্ত হলে আচমকা আক্রমণ করো। আরো কত কী !
এর মধ্যে পাড়ায় গুজব ছড়াতে শুরু করলো নীলা আর অনিকেতকে নিয়ে। একদিন ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী সুহাসবাবু বাচ্চুর বাবাকে সরাসরি বললেন,
--অংশুমানবাবু, আপনি কি খবর রাখেন, নীলা কী করে বেড়াচ্ছে?
--কী ব্যাপার?
--ওই নকশাল ছেলেটির সঙ্গে মেলামেশা কিন্তু আমাদের সকলের বিপদ ডেকে আনছে! আজকাল বাচ্চুকেও ওই অনির সঙ্গে বসে আড্ডা মারতে দেখেছি আমরা!
অংশুমানবাবু থম হয়ে শুনলেন। সেই রাতটির কথা এখনো বাচ্চুর মনে পড়ে। মা ঠান্ডা চোখে হিসহিস করে নীলামাসিকে ভর্ৎসনা করছেন,
‘দুধ কলা দিয়ে বাড়িতে কালসাপ পুষছি! তুই কি চাস তোদের জন্যে আমরা সব জেলে যাই?’
নীলা নিশ্চুপ।
--কালই আসানসোল চলে যা!
--না আমি এখানেই থাকবো!
নীলা কিছুদিনের জন্য ঘরবন্দি হলো। বাচ্চুকে ধমকানো হলো অনিকেতের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না রাখতে! তাও কি হয়? অনিকেতের ব্যারিটোন গলা আর সেই ঝকঝকে চোখ তখন বাচ্চুকে সম্মোহিত করে ফেলেছে! অনিকে তখন পুলিশ খুঁজছে হন্যে হয়ে। অক্রুর দত্ত লেনের একটি পোড়োবাড়িতে অনি থাকতো। নীলামাসী মাঝেমাঝে কলেজের টিফিন অনির কাছে পৌঁছে দিতে বলতো বাচ্চুকে, সঙ্গে একটা চিরকুট। বাচ্চু একদিন সেই চিরকুট খুলে দেখেছিলো। তাতে লেখা, অনি এটা খেও, ভালো থেকো সাবধানে থেকো। -- তোমার নীলা।
অক্রুর দত্ত লেনে সেই ভাঙা বাড়িতে বিভিন্ন ধরণের লোকের যাতায়াত ছিল। সকলেরই অবিন্যস্ত চুল দাড়ি, কাঁধে ঝোলা। তাদের মধ্যে কিছু দাদাদের চোখের ভাব ছিল ক্রূর আর নিষ্ঠুর। অনেক সময়ই অনিকেত গম্ভীর উদ্বিগ্নমুখে আলোচনা করতো সেই দাদাদের সঙ্গে। দেশব্রতী বলে একটি পত্রিকা সকলের হাতে হাতে ঘুরতো। একদিন অনিদা বাচ্চুকে অপেক্ষা করতে বলে পাশের ঘরে মিটিং করতে গেল। কিছুক্ষণ বাদে বাচ্চু শুনলো পাশের ঘরে বাকবিতন্ডা চলছে। অনিদা উত্তেজিত ভাবে বলছে,
‘না কমরেড, আমরা ঠিক পথে চলছি না। এতো ব্যক্তিহত্যার রাজনীতি! হঠকারী পথে বিপ্লব হয় না। আমাদের আরো সংগঠিত হতে হবে। গ্রামে গিয়ে কাজ করতে হবে।’
আরেকজন দাদা মন্তব্য করলেন, ‘কমরেড অনিকেত আপনার কথাগুলিতে কিন্তু শোধনবাদের গন্ধ পাচ্ছি।’
এরপর একদিন অনিদা বাচ্চুকে দেখা করতে নিষেধ করলো।
--আর আসিস না এখানে। আমি গোপীবল্লভপুর চলে যাচ্ছি কাল। সাবধানে থাকিস। পড়াশুনা করবি মন দিয়ে কেমন?
অনিদার চোখের সেই ঝকঝকে ভাবটা কমে এসেছে। গলা নিস্তেজ। বাচ্চু অবাক হলো। এই অনিদাই একদিন বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থা বর্জন করতে বলেছিলো!
মধ্যরাতে পাড়ায় মাঝেমাঝে কালো সাঁজোয়া গাড়ি আসতো। পুলিশ অনেক ছেলেদের তুলে নিয়ে যেতো যাদের অনেককে বাচ্চু আর কোনোদিন দেখে নি। বাচ্চুর বাবা স্থির হয়ে বসে থাকতেন বিছানায়। ওদের বাড়িতে কোনোদিন রেড হয় নি। অংশুমানবাবুর এক বন্ধু লালবাজারে কাজ করতেন।
তারপর অনিকেত হারিয়ে গেল। নানারকম গল্প শুনতো বাচ্চু বন্ধুবান্ধবের কাছে। অনিদাকে না কি তিহার জেলে ডাণ্ডাবেড়ি দিয়ে আটকে রেখেছে। কেউ কেউ বলতো অনি মেদিনীপুরে কমব্যাটে মারা গেছে।
অনিকেত বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেল। আর নীলামাসি, সেও একদিন আকাশের তারা হয়ে গেল।
বাচ্চু প্যারিসে এসেছে কিছুদিন হলো একটি বহুজাতিক সংস্থার কাজে। গত সপ্তাহে আইফেল টাওয়ার দেখতে গিয়েছিলো কেয়া আর রণ্টুকে নিয়ে। হঠাৎ রণ্টু হাত ধরে দাঁড় করালো বাচ্চুকে।
--বাবা বাবা, দেখো দেখো !
থমকে দাঁড়ালো বাচ্চু। একটি লোক খেলনা বিক্রি করছে। ওর পাশে অনেকগুলি বাংলাদেশী ছেলে নানারকমের খেলনা বেচছে। কিন্তু এই লোকটিই সবথেকে বয়স্ক। আর বিক্রি করছে একটি অভিনব টয়গান। আকাশের দিকে তাক করে ট্রিগার টিপলেই দুম করে আওয়াজ করে আলোর রোশনাই বেরিয়ে আসছে নলের মধ্যে দিয়ে। তারপর সেগুলি একটা বড়ো বুদ্বুদ হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে আকাশে।
রুগ্ন ক্ষয়া দীর্ঘকায় বৃদ্ধলোকটি বাঁ-হাতে পিস্তলটি ধরে ট্রিগার টেপার আগে মুখ দিয়ে একটি আওয়াজ করছে, হো, হো… সেই ব্যারিটোন গলার গমগমে আওয়াজ!!
তখন সন্ধে নেমে আসছিল। বাতাসে হিমের ছোঁয়া। আইফেল টাওয়ারের অপরূপ আলোগুলি একটি একটি করে জ্বলতে শুরু করছে।