অফিসের কাজ সেরে ফিরছিলাম ব্যাঙ্গালোর (এখন বেঙ্গালুরু) থেকে ট্রেনে। আমার থেকে সামান্য দূরত্বে বসে থাকা এক মেয়ে, যথেষ্ট আধুনিক এক মেয়ে, কথা বলছিল বাংলায়। কিন্তু সে মেয়ের অবয়বে যেহেতু সামান্য অবাঙালি যামিনী “টান” ছিল আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না যে সে আসলেই বাঙালি কি না। কিছুক্ষণ পরেই আমাদের কামরায় ঠান্ডা পানীয় নিয়ে এক হকারের আবির্ভাব। ঠান্ডা পানীয়র বোতলগুলোর দিকে একটু নজর করলেই বোঝা যাচ্ছিল খুব যত্ন করে আসলেই “নকল মাল” বিক্রি করা হচ্ছে। আমরা কেউই সে ঠান্ডা পানীয় কিনিনি – একজন ছাড়া। সেই একজন ঠান্ডা পানীয় কেনার পরই সে মেয়ে ফিসফিস করে আমাকেই বলল, কিছু লোক আছে দেখবেন – একদম ঘাউড়া। ব্যস, আমি নিশ্চিত হলাম – এ মেয়ে বাঙালি। মানে, বলতে চাইছি যে, প্রত্যেক ভাষারই কিছু আত্মিক উচ্চারণ আছে, যা কিনা ভাষার আত্মার আত্মীয়রাই কেবল উপলব্ধি করতে পারে, প্রকাশ করতে পারে মন খুলে। এখানে “ঘাউড়া” শব্দটা সেই বিশেষ উপলব্ধিরই প্রকাশ মেনে নিয়ে সেদিন মেয়েটিকে “পরীক্ষায়” পাশ করিয়ে দিয়েছিলাম।
তামাবিল বর্ডার। মেঘালয়ে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত। আমার থেকে “এক গেট” দূরে একটা ছেলে, কানে মোবাইল ফোন, অনর্গল বাংলায় কথা বলে যাচ্ছে। আমার এবং তার ভাষা এক। কিন্তু সীমান্তের বেড়া আমাদের দু’জনকে দু’দিকে রেখে মুচকি হাসছিল সেদিন। আমরা যারা “বাঙাল” – তারা জানি “বাংলাদেশ” ভাবলে এখনও গলার সামনে এক দলা আবেগ জমা হয়ে কীভাবে জড়িয়ে ধরতে চায় অতীতকে। এর মধ্যেই চোখে পড়ল সীমান্তের ওপারে এক কিশোর, হাতে কুলের আচারের প্যাকেট, তাকিয়ে আছে “এ পারের” ক্রেতার আশায়। ডাকলাম তাকে। কিনলাম কুলের আচার। সেদিন “নো ম্যানস ল্যান্ড”এ দাঁড়িয়ে সেই বালকের সঙ্গে “বাঙাল” ভাষায় কথা বলে খুব আনন্দ পেয়েছিলাম। এবং কুলের আচার! সেদিন আমার “উনি” প্রথমে খাবেন না বলে, পরে আমার কুলের আচারের প্যাকেটেও ভাগ বসিয়েছিলেন।
কিন্তু কথা হচ্ছে এই যে, মাতৃভাষা মানেই তো আর শুধু বাংলা ভাষা নয়। দেখা যাক ভাষাটা ইংরেজি হলে কেমন হয় বা হতে পারে। আজাহারউদ্দিন দু’রানে ব্যাট করছিলেন। পরের বল কভারে ঠেলে তিনি আরও দু’ রান নিলেন। ধারাভাষ্যকার হেনরি ব্লোফিল্ড বললেন, আজাহার ডাবলড হিজ স্কোর উইথ দিস টু। মাতৃভাষা। বল বাউন্ডারি লাইনের দিকে দৌড়চ্ছে। পিছনে ফিল্ডার। অনেক দৌড়েও চার রান বাঁচানো গেল না। রিচি বেনো বললেন, দ্য ফিল্ডার এসকর্টেড দ্য বল টিল দ্য বাউন্ড্রি লাইন। মাতৃভাষা। দীর্ঘকায় জোয়েল গার্নার বল করা শুরু করলেন। রিচি বেনো বললেন, বিগ বার্ড ব্লোয়িং। মাতৃভাষা। খুব কাছ থেকে একজন সাহেবকে দেখেছিলাম – যে কিনা এক সরকারি অফিসে তার কাজ উদ্ধার করেছিলেন প্রচুর কাঠখড় পুড়িয়ে। সেই সাহেব আমাকে বলেছিলেন, ইউ নো, আই হ্যাড টু স্পেন্ড ফাইভ অফ মাই ভ্যালুয়েবল ডেজ টু মিল্ক অল দোজ স্যাক্রেড কাউজ। মাতৃভাষা।
দেখুন, উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার লক্ষ্যে পাকিস্তান কী কী করেছিল এবং তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ১৯৫২ সালে যে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল, এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ নামে এক নতুন দেশের জন্ম - এসব আমরা সকলেই কম-বেশি জানি। যেমন জানি ২১শে ফেব্রুয়ারিকে কেন রাষ্ট্রভাষা দিবস বা শহিদ দিবস বলা হয়। ফলে আমি সে সব নিয়ে আর কিছু লিখছি না। আমি বরং একটু “অন্য পথে” হেঁটে দেখি ভাষা এবং তার হালকা বিবর্তনের উপর দাঁড়িয়ে কিছু লিখলে বা লিখতে চাইলে ব্যাপারটা কেমন দাঁড়ায়। আসুন দেখি -
একদা আমিই লিখেছিলাম, “জলবেঁধে সারসগুলো মিছিলে পৌছনোর আগেই সিঁড়িতে নেমে এল অন্ধকার, শিষ্টাচার মেনে বন্ধ হয়ে গেল দরজা এবং হাঁফ ছেড়ে বাঁচল আচারের শিশিগুলো। ভাবখানা এমন, যেন এক সারসে রক্ষে নেই...! এ’সময় দেরাজ খুললেই আরশোলাগুলো পাকা খেজুরের মতো টসটসে আর হাওয়াই চটি খুঁজে না পেয়ে ডারউইনকে শাপশাপান্ত। বিবর্তনবাদ...!”
পরে জানতে পেরেছিলাম, অনেক পাঠকের কাছেই খুব গোলমেলে লেগেছিল ভাষা এবং রচনার এই “বিবর্তনবাদ”! ফলে নিজের “মোটা মাথা”কে ভিত্তি করে সরল কিছু লেখার চেষ্টা করলাম এইভাবে -
দিন কয়েক আগে ‘মান্না দে’র গলায় ‘লাগা চুনরি মে দাগ’ শুনে একটা বাচ্চা বলে উঠল, ‘লোকটা’ ‘অনীক’এর গানটা ভালোই গাইছে। বোঝো ঠ্যালা। আরেকটা বাচ্চা তার মার কপালে একটা এক টাকার কয়েন রেখে বলেছিল, ‘ইউ আর টল’। মাতেশ্বরী থতমত খেয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, মানে কী? আসলে ‘বড়লোক’ ইংরেজি জানি না তো তাই টল, বাচ্চাটির সপ্রতিভ উত্তর। কবি মন বলে উঠল, ওরে বাবা, এ তো বিবর্তন, ভাষার বিবর্তন, মনের ভাব প্রকাশের বিবর্তন।
এ’টুকু লেখার পর মনে পড়ল - আমার ছেলে এবং মেয়ের প্রাথমিক পর্যায়ের স্কুলবেলায় জনৈক “ভোলাদা” তাঁর গাড়িতে ওদের স্কুলে দিয়ে আসা এবং নিয়ে আসার কাজটা করত। ওরা দুজনেই এখন বড় হয়েছে। মাঝে একদিন “ভোলাদা”র কথা ওঠায় আমার মেয়ে কিছুতেই মনে করতে পারছিল না সেই “ভোলাদা”কে। তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করল আমার ছেলে। সে তার বোনকে স্নেহভরে বোঝাল, দেখ তুই এখন যেমন ওলা ক্যাব চড়িস – আমাদের স্কুলবেলায় ছিল “ভোলা ক্যাব”। অনুমান করি, এমন উদাহরণ সমেত বোঝানোতে আমার মেয়ের স্মৃতি হাতড়ানো তর্জনী হয়ত অনেকটা স্বস্তি পেয়েছিল। বিবর্তন! ভাবনা-চিন্তার যুগধর্মী বিবর্তন!
আমি নিশ্চিত, এ পর্যন্ত পড়ে সম্পাদক ক্লান্ত, সম্পাদকমণ্ডলী তার আগেই। ঠিক আছে আর কথা না বাড়িয়ে আমরা বরং এবার দেখে নিতে পারি ভাষার বিবর্তনের মধ্যেও কীভাবে আসল “সম্পদ্গুলো” মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে অনন্তকাল। চলুন, শুরু করা যাক –
রেডিওতে শম্ভু মিত্র, কণ্ঠে জীবনানন্দ –
“শোনা গেল লাশকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে – ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে চাঁদ
মরিবার হল তার সাধ”
এই লাইনগুলো বহুবার পড়ার পরেও মনে হয়, ‘কোথায় এক পরিবর্তন’। আধুনিক মনস্ক কেউ কেউ হয়ত এই কবিতার ব্যাকগ্রাউন্ডে ‘লম্বি জুদাই’ গানটা হালকা করে বাজিয়ে দিতে চাইবেন। যুগের বিচারে সেটা ভালো না মন্দ, সে বিতর্কে না গিয়ে এ’টুকু বলা যেতেই পারে যে এই কবিতার ব্যাকগ্রাউন্ডে প্রকৃতপক্ষে একটা মিউজিক আছে। কবিতার দিকে তাকান, অনুভব করুন, পিছনে একটানা বেজে চলেছে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, সেই থেকে আজ অবধি...।