“কেন বলুন তো?”
“আমার একটি পাখি হারিয়ে গেছে!”
“আপনার পাখি হারানোর সাথে আমার আসার সম্পর্ক কী?”
“আপনি তো পাখিশিকারী। কোন কোন পাখি মারেন?”
এবার আমি ভীষণ লজ্জা পেলাম! বললাম, “মারব কেন?”
মেয়েটি কথা বলল না। একটা সরু সুতোর ফাঁদ উঁচু করে আমাকে দেখাল, “এটা আপনি পেতেছেন তো?”
আমি মাথা নিচু করে রইলাম।
মেয়েটি সুতোর গিঁট খুলতে চেষ্টা করল। পারল না। ওটাকে আছড়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে এবার বলতে শুরু করল---
***
আপনি যেখানটাতে ফাঁদ পেতে রোজ অপেক্ষা করেন, ওইখানে এককালে আমার ঘর ছিল। একটা নির্জন গানের ঘর। আমার অনিত্যের মন্দির! অনিত্য আমার গানপাগল স্বামী। ওর জন্যে আমি অনেক কষ্টে জায়গাটা আবিষ্কার করেছিলাম! জায়গাটা পেয়ে অনিত্যও খুব খুশি হয়েছিল। ওর সিদ্ধির জন্যে সংসারের সবকিছু ফেলে আমিও সেই কোন শতকে যেন সন্ন্যাস নিয়েছিলাম তা আর মনে নেই। কিন্তু একদিন দেখি ঘরের কপাট এঁটে অনিত্য হাউহাউ করে কাঁদছে! ওকে ওই অবস্থায় দেখে আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম! জিজ্ঞাসা করলাম, “অমন অস্থির দেখাছে কেন অনিত্য?”
দেখলাম অনিত্য এক দৃষ্টে আমার চোখের দিকে চেয়ে আছে। এবার বীণা নিয়ে এলাম। অনিত্যর কান্না আরও বেড়ে গেল। এবার অভিমান মাখিয়ে বললাম, “গাও। কোলের ওপর বীণা নিয়ে কতক্ষণ বসে আছি সে খেয়াল আছে?”
কিন্তু মনে হল অনিত্য অন্তরীপের ওই পারে বসে আছে! যেন কিছুই পৌঁছল না ওর কাছে!
অনিত্যকে এইভাবে বারুণীর পুতুল হয়ে বসে থাকতে দেখে আমার কেমন যেন আশঙ্কা হল, “কী হল? টোড়ি ভুলে গেছ নিশ্চয়ই?””
“আরেকটু নির্জনতা দিতে পারলে না পাপিহারা?”
“বলছ কী! এটা পশ্চিম সমুদ্রের নির্জনতম তট। অনেক কষ্টে তোমার জন্যে এই তটে অন্তরীপখানি নির্মাণ করিয়েছি! এই ঘরে তো তোমার কোনো অসুবিধা থাকবার কথা নয়!”
“কারা যেন কথা বলছে পাপিহারা! আমার আরোহির সিঁড়িটা বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে!”
বাইরে এলাম। খাঁচার মধ্যে তখনো তরঙ্গ ঘুমাচ্ছিল। তরঙ্গ আমার পাখি, আমাদের সকল অসুখবিসুখের একমাত্র উপশম। ভাবলাম ওর টানে কি অন্য পাখিরা আসছে? আর সেকারণেই কি অনিত্যের সুরের আলাপে ছেদ পড়ছে?
খাঁচা খুলে ঘুমন্ত তরঙ্গকে বাইরে আনলাম। ওকে তালুর মধ্যে পদ্মকোরক করে অনেকখানি আদর করলাম। নরম পালকের ওম নিলাম। তারপর বললাম, “কিছুকাল আমাদের এই অন্তরীপ থেকে আনস্থানে যা তরঙ্গ। অনিত্যর সাধনা পূর্ণ হোক, তারপর ফিরে আসিস!”
ডানা ঝাপটে তরঙ্গ কিচকিচ করে ডেকে উঠল। তারপর বারান্দার গ্রিলের ওপর গিয়ে বসল। কাঠঠোকরার মতো দরজার কপাটে কয়েকবার ঠোকা মারল। হয়ত শেষ বারের মতো একবার অনিত্যর স্পর্শ পাবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠছিল! কিন্তু অনিত্য আর দরজা খুলল না! তরঙ্গ উড়ে গেল।
এখন ঘুলঘুলির মুখে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে উত্তুঙ্গ মুলতানী, “সুন্দর সুরজানভা সাঁহি রে/ মনভা”ই রে সুন্দর সুরজানভা...!”
আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি! “তোমার এ অন্তরীপে আমাকে নেবে না অনিত্য?”
অনিত্য সুর সমুদ্রে ডুবে গেছে, “স জ্ঞ হ্ম প ন র্স/ র্স ন দ প হ্ম জ্ঞ ঋ স/ সুন্দর সুরজানভা সাঁই রে...!”
কীকরে ডাকব ওকে? যে ভুলটা তরঙ্গ করে গেছে, আমি আর দ্বিতীয়বার করতে চাইলাম না।
পায়ে পায়ে নেমে এলাম অনেক নিচে। একটি নালার ধারে। সেখানেও জল ভাঙছে তিনতালে। তরঙ্গটা কোথায় উড়ে গেল জানি না! সমুদ্রের ফেনায়িত উচ্ছ্বাসে কেবলমাত্র শোনা যাচ্ছে, “র্স ন দ প হ্ম জ্ঞ ঋ স/ সুন্দর সুরজানভা সাঁই রে...!”
এখন দ্বিপ্রহর। আমার সমস্ত আকাশ পৃথিবীর দিগ্বিদিক ব্যেপে কেবল অনিত্যর স্বর ভেঙে ভেঙে ভাসতে লাগল, “নিশদিন তুমহারো ধ্যায়ান আরাধত হ্যাঁয়/ আন মিলোঁ রব সাঁহি রে/ সুন্দর সুরজানভা সাঁহি রে...!”
অনিত্যকে একা রেখে আমি চলে এসেছি অনেকদূর। আর এই অবসরে আমি আমার ইহজীবনের সমস্ত কান্না নদীর পলিতে পুঁতে ফেলব মনস্থির করলাম! কিন্তু এ কে? আমারই মতো করে, আমারই নাম ধরে কাঁদছে কে?
আরেকটু অগ্রসর হতেই দেখলাম স্যাঁতলাপড়া একটা কাঠের পিঁড়িতে ফেলে কাপড় কাচছে একটি কিশোর। বয়স বারো পেরিয়ে গেছে অনেকদিন। কিন্তু শরীরের সমস্ত সৌষ্ঠব ও সৌকুমার্য অবিকল মেয়েদের মতো। মুঠোর মধ্যে কাঁচা কাপড় নিয়ে মোচড় মারছে, আর কাঁদছে!
“কী নাম তোমার?”
“কনক।”
“থাক কোথায়?”
এবার ছেলেটি একটি শুকনো উত্তরীয় উড়িয়ে দেখাল, “ওই তো পণ্ডিতজীর পোতাশ্রয়ে!”
“পোতাশ্রয় মানে?”
সে আর একটি কথারও আর উত্তর দিল না। আমি তাড়াতাড়ি ওর হাত থেকে কাপড়গুলো কেড়ে নিয়ে কেচে নিংড়ে তুললাম, “চলো তোমাদের পোতাশ্রয়ে যাব!”
মাটির পাঁচিল ডিঙোতেই ভেতর থেকে ক্ষীণ কন্ঠে আহ্বান এল, “পাপিহারা, এদ্দিন কোথায় ছিলে হে?”
আমি ওঁর পায়ে আছাড় খেয়ে পড়লাম, “শৃঙ্গারজী আপনি এইখানে? এটা যে পশ্চিমসাগরের জনাকীর্ণ মোহনা!”
“আমিও কী ভেবেছিলাম এখানে আসব! বিন্ধ্যবতী ছাড়ল কই! নুড়ি পাথর কাদা বালি যেভাবে আসে, অতএব আমিও কালের প্রবাহে এইখানে...!”
“কনক বলছিল, এটা পোতাশ্রয়, তাই?”
“বিশ্বাস হচ্ছে না? কিছুদিন থেকে দেখো। দেখবে জাহাজ আসবে। তাতে সুন্দর সব সারেং। কী অপূর্ব ওঁদের বেশবাস! সানাই আসবে, সেতার আসবে, মন্দিরা আসবে। আর ফেনায়িত তরঙ্গের সাথে ভেসে আসবে অপূর্ব সব বেদনানাশক রাগ! ওঁরা আমাকে খামোখা বন্দরের মালিক বানিয়ে রেখেছে। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি এটা চাইনি। আমি চাই, তোমাদের মধ্যে থেকে কেউ উঠে আসুক! কই তোমার বীণাটা আনলে না? কোথায় ফেলে এসেছ? ইস! আমার দেবীর হাতদুখানি বড্ড খালি খালি লাগছে!”
ঘরে আলো বলতে সূর্য সহায়! গুমোট অন্ধকার। ওর মধ্যেই বসে কথা হচ্ছে আমাদের। কথার মধ্যে গুরুজীর কাশির আওয়াজ আমাকে ভীষণভাবে পীড়া দিয়ে যেতে লাগল! আমি দক্ষিণ দিকের দুটো জানালা খুলে দিলাম। উনি আপত্তি করলেন না। বরং একটুখানি হাসলেন। আলনায় ঝোলানো অনেক কালের উত্তরীয়। সব একত্রে ডাঁই করা। ধুলো পড়ে সব পুরু হয়ে উঠেছে। কোনোটাতে বাহাউদ্দিন জাকারিয়ার নামাঙ্কিত, কোনটাতে শেখ মুলতানীর কারুকাজ। কয়েকটাতে সোনার জরি বসানো। বাকি সব পাতলা কম দামী রেশমের। আমি যখন একটা একটা করে ধুলো ঝাড়ছিলাম, শৃঙ্গারজীর কাশি আরও বেড়ে গেল। কাছে গিয়ে কপালে হাত দিলাম। ধুম জ্বর! উনি চোখদুটো বন্ধ করে আস্তে আস্তে আবদার করলেন, “এইখানে আরেকটু হাত রাখবে?”
ওঁর দিকে নিষ্পলক চেয়ে আছি! পরিত্যক্ত পিয়ানোর মতো ওঁর পাঁজরগুলো উঁচু হয়ে ওপরের দিকে ঠেলে উঠতে চাইছিল। আমার দিঘি ফেটে দুফোঁটা উষ্ণ অশ্রু ওঁর ওই শুকনো পাঁজরের ওপর ঝরে পড়ল, “এক ভয়ঙ্কর ক্ষয়রোগের কবলে পড়ে আছেন আপনি!”
“যাও উঠে হাত ধুয়ে এসো। এ বালাই বড় ছোঁয়াচে!”
“এত এত দরবারকে আপনি সমৃদ্ধ করেছেন! অথচ প্রাপ্তির ঝুলিতে কেবল কয়েকখানা মিহি-সুতোর উত্তরীয়?”
“কী বা বলি বলো! রাজাদেরই এখন রাজ্য চলে না! ওঁদের অভাব আরও বেশিরকম ভয়ঙ্কর গো পাপিহারা! যুগ যত বদলায়, প্রজাদের ক্ষিদের বৈচিত্র্যও তত বদলায়! এই তো সেদিন একজন এসে কনককে আমার কাছে বেচে গেল!”
আমি শিউরে উঠলাম, “বেচে গেল মানে?”
“ওই আর কী! ওরও অনন্ত ক্ষিদে! তবে সেটা সুরের! আমি আর কী দেব? কিছু পাখোয়াজ আর বাঁধানো বাঁয়া ছিল। দিয়ে দিলাম। বললাম, বেচে যা হয় নেবেন!”
“আপনার কাছে আসে সাহায্য চাইতে?”
“সে আর বলতে! কতশত প্রভাবশালীকে চিনি, যাঁরা চাদরের নিচে মুখ লুকিয়ে আমার কাছে আসেন! কীকরে ফেরাই বলো তো! এমন অনেকে আছেন, যাঁরা কেবলমাত্র প্রতিশ্রুতি জমা রেখে আমার থেকে প্রবাল নিয়ে গেছেন!”
“এভাবে সর্বস্ব বিলিয়ে দিলেন?”
“দিতে হয়! দেশের দুর্দিনে যাঁরা মাথা ঠিক রাখতে পারতেন, তাঁদের মধ্যে কাউকে কাউকে মাস্তুলও দিয়েছি! কেউ কেউ অবশ্য প্রশ্ন করতেন, আমি এসব কোত্থেকে পাই! আমি বলতাম, সমুদ্র শান্ত হোক, একদিন সব বলব!”
“কনক কিছু বলল না? ওকে কোথা থেকে আনা হয়েছে!”
“না! আমিই ওকে বারণ করেছি। আদেশ আছে কারও কথা মনে পড়লেই গলা ছেড়ে কাঁদবি!”
কথাটা কানের কাছে যেন আছাড় খেয়ে পড়ল! মনে পড়ল, আজ যখন নালার ধার দিয়ে হাঁটছিলাম, আমারই নাম ধরে কনক কাঁদছিল আর ভিজে কাপড়ে বাড়ি মারছিল! আমি উদ্বেলিত হয়ে হাঁক ছাড়লাম, কনক, শিগগির এদিকে একটু এসো তো!
কাঁটা-কুঞ্জের ওপাশ থেকে কনক হাঁপাতে হাঁপাতে এল, “আমাকে ডাকছেন মা?”
“হ্যাঁ। দেখছ না উনার খুব কাশি! সম্ভবত যক্ষা! শিগগির যাও। বন থেকে যেভাবে পার বনতুলসীর পাতা আর মধু নিয়ে এসো!
একটা দোমড়ানো তামার থালা হাতে কনক মধু খুঁজতে চলে গেল।
শৃঙ্গারজীর শিয়রে একটা ফুটো ভাঁড় ঝুলছিল। ওটা বড্ড অসুন্দর! ওর কানাচ থেকে দড়ি কেটে, কিছু খড়কুটো গুঁজে ফুটোর মুখটা বন্ধ করলাম। নালা থেকে জল আর অল্প আলোমাটি তুলে, ঘর-বারান্দা নিকিয়ে নিলাম। মাঝে মাঝেই দমকা বাতাস ছাড়ছিল। বাগানের শুকনো পাতাগুলো ভীষণরকম ভয় জাগিয়ে জানালার দিকে এগিয়ে আসছিল! জানালা দুটো বন্ধ করে দিয়ে শৃঙ্গারজীকে সাগরের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসিয়ে দিলাম। দরজার মুখে একটা অশোকের ডাল ঝুঁকে পড়েছে। ওর থেকে টুপটাপ করে একটা দুটো ফুল খসে পড়তে লাগল। কনক কেন এখনো আসছে না দেখে, আমি চঞ্চল হয়ে উঠলাম। সময় মোটে অতিবাহিত হয় না। অনেকগুলো ফুল একত্র করে একটা সুতোয় গেঁথে যখন ঘরে এলাম, দেখি গুরুজীর বুকের ওপর চাপ চাপ রক্ত!
আমি হাহাকার করে উঠলাম, “কনক কোথায় তুমি?”
উত্তর এল না!
“এত উদ্বেগের কিছু নেই পাপিহারা! কনক ছেলেমানুষ! আসবে নিশ্চয়ই!”
“আপনার এই কষ্ট দেখতে পারছি না গুরুজী!”
“এই তো বুঝেছ! কনকও জানে কখন কতটা সময় এই আলয় থেকে দূরে থাকতে হয়! কষ্টই যখন পাচ্ছ, এক কাজ করো। বাগানের উত্তর দিকে যাও। বাসকের মূল থেকে কিছু বাকল তুলে নিয়ে এসো। ওটা মুখের মধ্যে রাখলে অনেকটা আরাম পাব!”
শাবল নিয়ে বাগানে এলাম। কিন্তু কোথায় বাসক? চিনি না। আমি সঙ্গীত চিনি, স্বরলিপি চিনি, রাগ জানি রাগিণী বুঝি, কিন্তু বাসক বলে যে আলাদা কোনো ওষধি থাকতে পারে, এটা আজও আমার বোধের বাইরে!
এখন বাসকের মূল পাবার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছি! মাটিতে কোপ পড়ছে এলোমেলো। ঠং করে শব্দ হতেই থমকে দাঁড়ালাম। কী এটা? ছোট্ট একটা পেতলের সরু মুখওয়ালা পাত্র। আবারও কোপ। একে একে অনেকগুলো উঠল। সবে সাগরের ঢেউগুলো রাঙা হতে শুরু করেছে। পাত্রগুলো নিয়ে মলিনমুখে ওঁর মাথার কাছটায় রাখলাম, “এগুলো কী শৃঙ্গারজী?”
“কী সাঙ্ঘাতিক! এগুলো খুঁজে পেলে কী করে?”
“বলুন এগুলো কী?”
“কুপী! বাদশাবাড়ির মেয়েরা বলত চেরাগ। তখন ছোকরা বয়েস, বুঝতে পারতাম পর্দার ওপারে থেকেও তারিফ করতে চাইছেন কেউ কেউ! দরবার করে যখন ঘরে ফিরে আসতাম, এগুলো ওঁদের থেকেই উপহার পেতাম!
“আহা! একেই বলে অনন্ত অনুরাগ!”
“আমি তো আনন্দে উল্লসিত হয়ে দৌড়ে ঘরে আসতাম। বিন্ধ্যবাসিনীকে দিয়ে বলতাম, দেখো কী একখান আজব জিনিস এনেছি! আমার যখন ফিরতে রাত হবে, তুমি দুয়োরে জ্বেলে রেখে অপেক্ষা করো! বিন্ধ্যবাসিনী সেকথা রেখেওছিল! কিন্তু শেষরক্ষা হল না! একদিন পাগল হলাম। সুরের সমুদ্রে তলিয়ে গেলাম। ঘর সংসার সব ভুলে গেলাম। বিন্ধ্যকে ভুলে গেলাম। নাওয়া-খাওয়া ভুলে, কোথায় যে কোন রসাতলে আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল বলতে পারিনে! কোনও কোনও দিন পথ ভুলে হাঁকতাম, “কই গো, কোথায় গেলে বিন্ধ্য?”
বিন্ধ্য গায়ে অন্ধকার জড়িয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াত!
“ঘর অন্ধকার যে? কুপীটা পুঁতে ফেলেছ নিশ্চয়ই?”
অভাবে দুঃখে বিন্ধ্য খেইখেই করে উঠত!
আমি ঝুলি থেকে আরেকটা কুপী বার করে হেসে উঠতাম, “এ হল আলেয়ার আলো! চাপা দিলে এ জ্যোতি কদ্দুর যায় বলো তো?”
একদিন শুনতে পেলাম বিন্ধ্য শেষ কুপীটাও পুঁতে ফেলেছে!
দেখলাম গুরুজীর চোখে জল! আমি একটাতে সলতে পরিয়ে কুলুঙ্গিতে জ্বেলে দিলাম!
সমুদ্র তখন শঙ্খনাদে সবে উত্তাল হতে শুরু করেছে। পশ্চিম আকাশে উঠেছে একটিমাত্র তারা। আমি একটার পর একটা কুপীতে আগুন দিয়ে উঠোনের চারপাশ সাজিয়ে দিলাম। আর এইসময় কনক ফিরে এল।
“কী হে, বনতুলসী পেলে?”
কনক কথা বলল না। শুধুমাত্র থালাটা এগিয়ে দিল।
একটা পাতার মুকুট। ঠিক যেন পাতিলেবুর গন্ধ।
“কে বানাল এটা? তুমি?”
কনক মাথা নাড়ল।
আমি একছুট্টে শৃঙ্গারের কাছে গেলাম।
উনি মাথা এগিয়ে দিলেন, “কথা দাও পাপিহারা! আমাকে একলা ফেলে আর কোত্থাও যাবে না!”
আমার স্বর্গ মর্ত পাতাল জুড়ে থরথর করে কেঁপে উঠল!
“কথা দাও পাপিহারা! জীবনে কিচ্ছুটি পাইনি আমি! এর জন্যে সন্তাপ নেই একটুও! শুধু তুমি থাকো!”
সহসা একটা চেনা স্বর ভেসে এল। আমি ব্যগ্রস্বরে বললাম, কোথায় তুমি তরঙ্গ?
আলাপে আন্দোলিত হয়ে উঠল দূরের আকাশ, “নিশদিন নিশদিন নিশদিন নিশদিন নিশদিন তুমহারো ধ্যায়ান ধরত হুঁ...!”
দেখলাম শুকনো ঠোঁটে অশোকের শাখায় পাখার ঝাপট মারছে আমাদের তরঙ্গ! তরঙ্গকে কাছে পেয়ে অনেকটা কাঁদলাম! আর ঠিক এইসময় বৃদ্ধ শৃঙ্গারের ওপর বড্ড বেশি অভিমান হল! মনে মনে উচ্চারণ করলাম, “কী একখান মাকড়সার জাল বিছিয়ে রেখেছেন! অনিত্য হয়ত এতক্ষণ আমাকে ভুলেই গেছে!
এখন মুহুর্মুহু মীড় ভেসে আসছে, “সুন্দর সুরজানভা সাঁহিরে রে/ মনভা”ই রে সুন্দর সুরজানভা...!”
“আমায় যেতে হবে গুরুজী!”
“কোথায়?”
“ওই যে অনিত্যর কাছে!”
“যাবেই যখন আগে এটা পুঁতে রেখে এসো!”
বাগানে গেলাম। যেখানে বাসকের মূল খুঁজে গর্ত খুঁড়েছিলাম ওইখানে। কিন্তু এ কী! প্রতিটি গর্তের অন্তর থেকে উত্থিত হচ্ছে সহস্র ঝিল্লির স্বর, “তুমহারোঁ ধ্যায়ান আরাধত হ্যাঁয়...!”
মুকুটখানি পুঁততে পারলাম না! এর পরিবর্তে পায়ের মঞ্জির দুখানি মাটি চাপা দিয়ে আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছিলাম।
কে যেন ককিয়ে উঠলেন, “ওটা কোথায় নিয়ে চললে পাপিহারা?”
“শৃঙ্গারজী আপনি! মুকুটখানি নেবার অনুমতি পাব না?”
“তুমি তো আমাকেই পরালে! এক উষ্ণীষে কয়জনকে সম্রাট সাজাতে চাও তুমি? তার চেয়ে এক কাজ করো, ওই যে অশোক ফুলের মালাটা গেঁথেছ, ওটা নিয়ে যাও!”
এখন অন্ধকার। নালার ধার বরাবর হেঁটে চলেছি। এতক্ষণে কনক হয়ত একটা একটা করে কুপী নিভিয়ে দিচ্ছে। কাল থেকে আবার হয়ত মলিন উত্তরীয়গুলো কাচতে কাচতে কনক কাঁদবে! ওর ওই কান্নাটা আমি আরও একবার প্রাণভরে শুনতে চাইছিলাম! কিন্তু নাহ! কাঁদছে না!
অশোকের মালাখানি নিজেই পরে নিয়েছি। পায়ে পায়ে আছড়ে পড়ছে ঝালা! এখন আকাশে একেকদিন একেক রকমভাবে সংকেত পাঠাচ্ছে তরঙ্গ! আমি সেই সঙ্কেতে কান রেখে এগিয়ে চলেছি!”
***
সারাটা সন্ধ্যা জুড়ে গানের গল্প শুনলাম। উঠবার সময় দেখলাম মেয়েটির চোখে জল! বাদশাবাড়ির চেরাগের মতো চিকচিক করছে! তবু বললাম, আপনার তরঙ্গের জন্যে আরও কয়েক শতক হয়ত আপনি কাঁদবেন! কিন্তু আপনার অনিত্য? তিনি কোথায়?”
মেয়েটি মায়াজালটিকে আমার মুঠোর মধ্যে গুঁজে দিয়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল!