আমার হাতের ওপর কেউ হাত রাখল।
“কে? টুটুল? কবে এলি?” আমি বললাম। যাকে বলা সে কোনও উত্তর দিল না।
দিন দিন আমার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসছে। তবু কখনও কখনও সেই অন্ধকার ভেদ করে আমি স্পষ্ট দেখতে পাই। বাইরে নয়, ভিতরে। স্থান-কাল অগ্রাহ্য করে, যা দেখার কথা নয় সেইসব ছেঁড়াখোঁড়া অযৌক্তিক দৃশ্য চোখের ভিতর ভেসে ওঠে। যেমন এখন, হাতের ওপর যখন হাত, যেই রেখে থাকুক… সেই কোন কালে চন্দনপুর ছেড়ে এসেছি, তবু আমি পরিষ্কার দেখতে পেলাম, অনাদিদা জেরক্স মেসিনের ডালা বন্ধ করে সার্টিফিকেটের ফটোকপি করা পাতাগুলো একটা জেমস ক্লিপ লাগিয়ে আমার হাতে দিল। খাঁকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে বলল, “চললি তাহলে?”
একটা জেমস ক্লিপ দিয়ে একসঙ্গে অনেকগুলো জরুরি কাগজ আটকে রাখা যায়। আলপিন দিয়ে আটকালে কাগজের গায়ে ফুটো হয়ে যায়। জেমস ক্লিপ কত মোলায়েম অথচ দৃঢ় ভাবে কাগজগুলিকে ধরে রাখে! যেন সুসম্পর্ক। অবশ্য পুরনো হয়ে গেলে ক্লিপেও জং ধরে, হাজার হোক আকরিক ধাতু। সম্পর্কেও কি জং ধরে না? কত মানুষই তো জং-ধরা সম্পর্ক নিয়ে দিনের পর দিন বেঁচে থাকে। ভাবে আলপিনের মত ফুঁড়ে গেলেই বোধ হয় ভাল হত।
সব সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে যেতে হবে এক অচেনা শহরে। হাতে আর মাত্র কয়েকটা দিন, পুকুরপাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম। হাস্নুহানার গন্ধ আসছে কোত্থেকে। বর্ষার সন্ধে, একটা সাপ পায়ের ওপর দিয়ে সরে গেল। পুকুরপাড় দিয়ে যখনই হাঁটি শুনতে পাই আপাত নিস্তরঙ্গ জল থেকে উঠে আসছে অস্ফুট প্লুতস্বর, যেন তদ্গত মন্ত্রোচ্চারণ। সবাই শুনতে পায় না, আমি পাই। আমি জলের ভাষা পড়তে পারি। পৃথিবীর প্রতিটি জল একে অন্যের সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলে। দূর থেকে চিঠি পাঠায়। এক জল চুল খুলে বসে দুপুরবেলা অন্য জলের চিঠি পড়ে, বিনবিন করে, যেন বাল্যকালের সই। আবার কবে এই শহরে ফিরে আসা হবে কে জানে? আমিও কি চিঠি লিখব? কাকে লিখব? সুমিতাদিকে?
নাহ, আমি জানি, চিঠি আমি লিখব না। অক্ষর এক শাশ্বত অভিশাপ। নিরক্ষরের থেকে সুখী পৃথিবীতে কেউ নেই। অবশ্য সেভাবে দেখলে সব অক্ষর সমান চতুর নয়। তবু আমি কখনও অক্ষর নিয়ে ছেলেখেলা করি না। বরং পালা-পার্বণে লঙ্গর বসাই, রাস্তা থেকে অনাথ অক্ষরদের বাড়িতে তুলে এনে যত্ন করি। মুখে ভাত তুলে দিই। তারা ছাড়া নিজের বলতে আমার আর কে আছে?
আমাদের বাড়ির সামনে খানিকটা ফাঁকা জমি, বাঁখারির বেড়া দিয়ে ঘেরা। আগাছা হয়ে আছে। বেড়ায় অযত্নের বনলতা জড়িয়েছে আষ্টেপৃষ্ঠে। কে আর নিড়ানি দেবে? চোখ ফোটার আগে মা চলে গেছে। বাবা ক্লাস নাইন-এ। এক জ্যাঠামশাই ছিলেন, তিনি দেহ রাখলেন গত শীতে। পারিবারিক সম্পর্কের মোহ-মায়ামুক্ত হলাম। বলতে গেলে তখন থেকেই আমার অলৌকিক অক্ষর-জ্ঞান। নিরাত্মীয় হওয়ার পর থেকেই অক্ষররা আপনজন হয়ে উঠল।
বেড়ার দরজা থেকে বারান্দা পর্যন্ত একটা পায়েচলা পথ। তার পাশেই একটা কাঠচাঁপা গাছ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। বারান্দায় ওঠার সিঁড়ির মুখেই একটা পেয়ারা গাছ, তার মগডাল থেকে একটা বনবিড়াল ঝাঁপ দিল দোতলার ছাদের পাঁচিলে, দেখতে পেলাম। গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে ফালিফালি জ্যোৎস্না এসে পড়েছে সিঁড়ির ওপর। আমি সিঁড়ির কোণে চটি ছেড়ে, খালি পায়ে জ্যোৎস্না মাড়িয়ে ঘরে ঢুকি। পায়ের তলা জ্বালা করে, মনে হয় কাচ ফুটেছে। বসার ঘরের আলো জ্বালাই। তক্তাপোষে বসে পায়ের তলা পরখ করে দেখি, কোনও দাগ নেই।
ঘরের মধ্যে একটা চামচিকে ঢুকে পড়েছে। তার ওড়াউড়ি দেখতে দেখতে মৃত্যুর কথা মনে পড়ে যায়। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। আলো নিভিয়ে জানলা খুলে দিই। খোলা জানলার গরাদে চাঁদের আলোর মাখন লেগে আছে। রাতের পতঙ্গরা উড়ে এসে বসছে, চেটে চেটে খাচ্ছে। একবার এসে বসলে নড়তে চায় না। চামচিকেটা গরাদের ফাঁক গলে পালাল। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
আসলে মৃত্যু আমার ভয়ানক অপছন্দ। দেখলেই মনে হয় আখের মতো চিবোই, চুষে ছিবড়ে করে ফেলি। এই যেমন, ক’দিন আগেই হাসপাতালে তাপসদার ঠান্ডা হাত মুঠোর মধ্যে নিয়ে বসে ছিলাম। মৃত্যু হেরে যাচ্ছিল। তাপসদার পাণ্ডুর ত্বক রং বদলাচ্ছিল। তার গালে রক্ত ছড়াচ্ছিল। চোখের নিচের কালি মুছে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। সুমিতাদি পাশে বসে হাঁ করে দেখছিল। কিছুক্ষণ পরে তাপসদা উঠে বসার চেষ্টা করল। সুমিতাদি তার পিঠের কাছে একটা বালিশ গুঁজে দিল। বলল, “জল খাবে?”
তাপসদা বলল, “খুব খিদে পেয়েছে। ওদের কিছু খেতে দিতে বলো না।”
ডাক্তাররা যে মানুষটাকে জবাব দিয়ে দিয়েছিল, সে কথা বলছে, খাবার চেয়ে খাচ্ছে দেখে সবাই চমকে গিয়েছিল বলাই বাহুল্য। আমিও কম আশ্চর্য হইনি। জানতাম আমার মধ্যে মৃত্যু নিয়ে একটা বিতৃষ্ণা আছে। কিন্তু আমি যে কারও শরীর থেকে মৃত্যু শুষে নিতে পারি সেদিনই প্রথম জেনেছিলাম। দেখলাম মৃত্যুর বিষ আমার কোনও শারীরিক ক্ষতি করতে পারে না। শুধু মাথাটা একটু ভার ভার ঠেকছিল। টয়লেটে গিয়ে ঘাড়ে মাথায় জল দিয়ে এলাম। ভাল লাগল।
সুমিতাদিকে ছোটবেলা থেকে চিনি। ওরা আমাদের পাশের বাড়িতে ভাড়া থাকত। তাপসদার সঙ্গে বছর চারেক ঘোরাঘুরি করে বিয়ে করেছিল। সন্ধেবেলা ওদের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে আমায় তাপসদার কথা বলত সুমিতাদি। ভাল ক্রিকেট খেলত তাপসদা। খেলার জন্যই রেলওয়েজে চাকরি পেয়েছিল। বিয়ের পর সুমিতাদি আর তাপসদা টোনাটুনির সংসার পেতেছিল, কাছাকাছির মধ্যেই। সেও হয়ে গেল বছর তিনেক।
সুমিতাদি সেদিন হাসপাতাল থেকে জোর করে ওদের বাসায় টেনে নিয়ে গিয়েছিল। সাইকেল রিক্সায় বসে বার বার আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছিল সুমিতাদি। ঘরে ঢুকে আর সামলাতে পারল না। আমার হাতদুটো ধরে কেঁদে ফেলল। বার বার বলতে লাগল, “তুই কে? তুই কে রে?”
আমি হেসে বললাম, “চেনো না আমায়? আমি অনি... অনিরুদ্ধ...”
সুমিতাদি বলল, “না, তুই আমার ভগবান।”
সুমিতাদি আমার হাতের পাতাতেই চুমু খাচ্ছিল। তার চোখের জলে আমার হাত ভেসে যাচ্ছিল। কাঁদতে কাঁদতে, হাতের পাতায় ঠোঁট ঘষতে ঘষতে সে হঠাৎ আমার বুড়ো আঙুল মুখের মধ্যে পুরে চুষতে লাগল। আমি সন্ত্রস্ত হয়ে বললাম, “সুমিতাদি, কী করছ?”
সুমিতাদি শুনছিল না। ফোঁপাতে ফোঁপাতে আমার বুড়ো আঙুল চুষে যাচ্ছিল। তার মুখের লালা গড়াচ্ছিল আমার আঙুল বেয়ে। আমার অস্বস্তি হচ্ছিল। নাভির কাছে শিরশির করছিল। আমি হাত টানলাম। সুমিতাদির দাঁত লেগে আমার বুড়ো আঙুলের নুনছাল উঠে গেল। আমি চলে আসছিলাম। সুমিতাদি করুণ গলায় বলেছিল, “আমায় ছেড়ে যাস না, অনি।”
২
তাপসদা সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে এসেছিল। সুমিতাদি একদিন ফোন করে বলল, “মঙ্গলবার তোর তাপসদার জন্মদিন। একটু পায়েস বানাব, আসবি অনি?”
আমি বললাম, “নিশ্চয়ই যাব। কেমন আছে এখন তাপসদা?”
সুমিতাদি বলল, “ভাল, আগের চেয়ে অনেক ভাল। তবে...”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তবে কী?”
সুমিতাদি চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, “মঙ্গলবার আসিস কিন্তু, ভুলে যাস না।”
তাপসদাদের বাসা একটা সরু ইট-বাঁধানো গলির-গলি-তস্য-গলির মধ্যে। একদিকে খোলা নর্দমা, ডিঙিয়ে সদর দরজার কড়া নাড়তে হয়। গলির মুখে কতকগুলো ছেলে দাঁড়িয়ে জটলা করছিল। গলিতে ঢোকার সময় আমাকে দেখে আগাপাশতলা মাপল। আমি খুব একটা পাত্তা দিলাম না। সুমিতাদি দরজা খুলে দিল। একটা ছোট্ট উঠোন, এক ধাপ সিঁড়ি দিয়ে উঠে বারান্দা। ঘরে ঢুকে দেখলাম মুমূর্ষু হলুদ আলোর নিচে তাপসদা একটা তক্তাপোষের ওপর শুয়ে আছে। আমি পাশে একটা চেয়ার টেনে বসে বললাম, “এ কী? সন্ধেবেলা শুয়ে পড়ে আছ কেন?”
তাপসদা ম্লান হাসল। বলল, “পায়ে জোর পাচ্ছি না রে এখনও। আমার কথা ছাড়। তোর খবর বল। কবে যাচ্ছিস?”
আমার মনে পড়ল না তাপসদার সঙ্গে আমার চলে যাওয়া নিয়ে কোনও কথা হয়েছে কি না। হেলসিঙ্কি ইউনিভার্সিটির এক প্রোফেসরের সঙ্গে ইমেল চালাচালি হচ্ছে। ভদ্রলোক টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্টশিপও অফার করছেন। সত্যিই যাব কি না মনস্থির করে উঠতে পারিনি এখনও। সুমিতাদি পিছনে দাঁড়িয়ে শুনছিল। গলায় অভিমান নিয়ে বলল, “বলিসনি তো আগে...”
আমি তাপসদার দিকে সন্দিগ্ধভাবে তাকিয়ে বললাম, “দেখি...”
তাপসদা বলল, “যাওয়ার আগে জানিয়ে যাস অনি, দুম করে পালিয়ে যাস না যেন।”
সুমিতাদি বলল, “বলা কওয়া নেই, পালিয়ে যাবে মানে? গেলেই হল?”
আমি কথা ঘোরাবার জন্য সুমিতাদির দিকে তাকিয়ে বললাম, “কই, পায়েস খাওয়াবে বলেছিলে যে...”
সুমিতাদি থমথমে মুখ করে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। শুধু পায়েস নয় সুমিতাদি লুচি মাংসও রেঁধে রেখেছিল। একটা তেপায়া টেবিল আমার চেয়ারের সামনে পেতে আমায় খেতে দিল। তাপসদাকে দিল তক্তাপোষের ওপর জলচৌকি পেতে, তার ওপর থালা রেখে। তাপসদা বলল, “পেট ভরে খা অনি। সকাল থেকে কিছু খাসনি।”
সুমিতাদি ভুরু কুঁচকোল, “তুমি কী করে জানলে?”
এবার আর আমি খুব একটা আশ্চর্য হলাম না। ভোর রাত্তিরে জ্বর এসেছিল। ভেবেছিলাম আসতে পারব না। আজকাল মাঝে মাঝে এই রকম হয়। আর জ্বর এলেই মাথার মধ্যে মৃত অক্ষরেরা ভিড় করে। হরপ্পা মহেঞ্জোদরোর লোগো-সিলেবিক শিলালিপির দল ছেঁকে ধরে। আমায় ঘিরে নাচানাচি শুরু করে দেয়, যেন উৎসব। চোখ বন্ধ করেও তাদের থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায় না। সারা দিন মুখে রুচি ছিল না। দাঁতে কুটোটি কাটিনি। দুপুর নাগাদ জ্বর ছেড়ে গেল। পা টলমল করছিল। তবু সুমিতাদিকে কথা দিয়েছি বলে উঠে চলে এলাম।
“তুমিও খাবার নিয়ে নিলে না কেন?” আমি বলতে যাচ্ছিলাম, তাপসদা আমার মুখের কথা কেড়ে বলল। সুমিতাদি বলল, “পরিবেশন করবে কে? তোমরা শান্তি করে খাও তো। অনি, তোকে আর দুটো লুচি দিই?” পাতের ওপর রাখা হাত এড়িয়ে জোর করে আরও দুটো লুচি দিল সুমিতাদি। কতদিন এত যত্ন করে কেউ খাওয়ায়নি।
খাওয়া শেষ করে তাপসদা বিছানায় বসেই একটা বাটির মধ্যে হাতমুখ ধুয়ে নিল। মনে হল খাওয়ার পরিশ্রমেই সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। চোখের ওপর হাত রেখে আবার শুয়ে পড়ল। আমি উঠলাম। সুমিতাদি আমায় সদর দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এল। ছিটকিনিতে হাত রেখে সুমিতাদি আমায় চাপা গলায় বলল, “ছোটবেলায় চিলেকোঠার ঘরে তুই আমায় একবার জোর করে চুমু খেয়েছিলি, মনে আছে?”
আমি গালে হাত বুলিয়ে হেসে বললাম, “মনে থাকবে না আবার? এমন চড় কষিয়েছিলে গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসে গিয়েছিল।”
সুমিতাদি কেমন অন্যমনস্ক গলায় বলল, “তুই বলেই বলছি। তোর তাপসদার অসুস্থ শরীর, হেঁটে কলতলায় যেতে পারে না। কাল পাশে বসে আছি। হঠাৎ কাছে টেনে চুমু খেল। বিশ্বাস কর মনে হল, অবিকল তুই।”
আমি লজ্জা-লজ্জা গলায় বললাম, “তোমার মনে আছে?”
সুমিতাদি বলল, “ন্যাকামি করিস না। প্রথম চুমুর স্বাদ কোনও মেয়ে ভোলে না। সত্যি করে বল তো, তোর তাপসদাকে কী জাদু করেছিস?”
এই ব্যাপারটাই আমি এড়িয়ে যেতে চাইছিলাম। আমিই কি জানি ছাই? আমার ওপর ভূত না ভগবান কী ভর করেছে? সম্ভবত সেদিন যখন হাসপাতালে তাপসদার হাত ধরে বসে ছিলাম, আমার কিছুটা অংশ তাপসদার মধ্যে চলে গেছে। না-হলে তাপসদা আমার না-বলা কথাগুলো কী করে জানতে পারছে? সুমিতাদি দরজা আটকে দাঁড়িয়ে আছে। কী করেছি না জেনে বেরোতে দেবে না। আমি বললাম, “পরের বার যখন আসব, তখন ঠিক বলব। আজ যাই?”
সুমিতাদি কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই তাপসদার গলা পেলাম, “মিতু, কোথায় গেলে? বাথরুম যাব।”
ভগবানকেও মাঝে মাঝে কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়। মানুষ তো কোন ছার! তাপসদা যদি আমার মন পড়তে পারে, তবে আমিই বা কেন তার মনের মধ্যে ঢুকে পড়তে পারব না? তার হয়ে কথা বলতে পারব না? সুমিতাদি দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াল। বলল, “আর কোনওদিন আসিস না, অনি। তোর সঙ্গে আর দেখা না হওয়াই ভাল।”
আমি অন্ধকার গলির মধ্যে নেমে এলাম।
গলির মুখে লাইটপোস্টের আলো। সেই ছেলেগুলো দাঁড়িয়ে আছে। নিজেদের মধ্যে কী আলোচনা করছিল। আমায় দেখে চুপ করে গেল। একটা নতুন মুখ চোখে পড়ল। চোয়াড়ে, গালে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। আমি কাছে যেতে আমার কলার চেপে ধরে বলল, “শালা, মাগীবাজি করার জায়গা পাসনি?”
অন্য ছেলেগুলো রাস্তা আটকে গোল করে ঘিরে রেখেছে আমাদের দু’জনকে। পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার উপায় নেই। আমি ছেলেটার দিকে অপলকে চেয়ে রইলাম। ছেলেটা বোধহয় ভেবেছিল আমি ভয় পাব। আমি ওকে চমকে দিয়ে বললাম, “শুভময়, তোমার খুব বিপদ। তুমি যত তাড়াতাড়ি পারো পালাও।”
আমার কথা শুনে রাগে ছেলেটার মুখ দিয়ে থুতু বেরিয়ে এল। হিসহিস করে বলল, “বাঞ্চোত, ঢ্যামনামী করছিস আমার সঙ্গে? পুঁতে রেখে দেব এখানে।”
কোথাও কিছু নেই, আচমকা একটা হাতবোমা ফাটল ছেলেগুলোর ঘাড়ের ওপর। তীব্র আলোর ঝলকানি, কান ফাটানো শব্দ... ওরা আমায় আড়াল করে দাঁড়িয়ে ছিল বলে স্প্লিনটারের হাত থেকে রেহাই পেলাম। চোখের সামনে শুভময় বলে ছেলেটা রাস্তায় লুটিয়ে পড়ল। এ অঞ্চলে বোমাবাজি নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা। শব্দ পেলে গৃহস্থরা জানলা বন্ধ করে শুতে যায়। সকালে এসে পুলিশ লাশ তুলে নিয়ে যায়।
অন্য ছেলেগুলো আমায় ছেড়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে দৌড় লাগাল। প্রতিপক্ষ বোধহয় নজর রেখেছিল। একটা ম্যাটাডোর চালু হবার শব্দ পেলাম। সম্ভবত ছেলেগুলোর পিছু নিল। একটু দূরে আর একটা বোমা ফাটল। আমি শুভময়কে ছেড়ে হাঁটা দিলাম। মৃত্যু আমায় বিরক্ত করে, ব্যথিত করে। কিন্তু ধর্ম সংস্থাপনের জন্য কিছু কিছু মৃত্যু কাম্য, যে কোনও যুগেই। তাতে দোষ নেই।
৩
যাকে টুটুল বলে ডেকেছিলাম, সে হাত সরিয়ে নিল। কিন্তু উঠে গেল না। কথাও বলল না। পাশে বসে রইল। তার নিঃশ্বাসের ভাপ আমার গায়ে লাগছিল। সেই উষ্ণতা ছুঁয়ে ছুঁয়ে আমি আবার বর্তমানে ফিরে আসছিলাম।
ইদানীং প্রতিদিন সকালেই কিছু গুণমুগ্ধ মানুষজন আমার বৈঠকখানা ঘরে বসে থাকে। তার মধ্যে কিছু ছাত্র-ছাত্রী, কিছু সাধারণ আশ্রমিক। যারা আসে আমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে চায়। আমি পা সরিয়ে নিই। পায়ে নখের স্পর্শ লাগলে আমার অস্বস্তি হয়। ভয় হয় যদি নখ বিঁধে সেপটিক-টেপটিক হয়ে যায়! টুকটাক কথা হয় সবার সঙ্গে। ওদের প্রশ্নের উত্তর দিই। কুশল জিজ্ঞাসা করি। বিদেশ থেকে ফিরে এসে এখানে থাকতে শুরু করার পর মোটামুটি এটাই নিয়ম হয়ে গেছে। তারা কী জন্য এসে আমার আশপাশে ভিড় জমায় জানি না। আমি কি খুব দর্শনীয় বস্তু? নাকি তারা আমার বোধবুদ্ধির আগুনে কিছুক্ষণ হাত সেঁকে নিতে চায়! কে জানে? তবু প্রতিটি মানুষেরই একটা নিজস্ব সংকেত থাকে। পিছনে এসে দাঁড়ালেও বোঝা যায় সে এসেছে। সংকেতের পাঠোদ্ধার করাই আমার কাজ। আজীবন তাই করে এসেছি। এই ঘরে বসা প্রত্যেকটি মানুষের সংকেত আমি চিনি। পাশে বসা মানুষটার অস্তিত্ব আমি আলাদা করে টের পাচ্ছিলাম।
ইনগ্রিডও এইরকমই চুপ করে পাশে বসে থাকত। আমি কম্প্যুটারের ওপর ঝুঁকে থাকতাম। আর ও পড়াশুনো শিকেয় তুলে আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকত। প্রোফেসর একটা ফেলোশিপ যোগাড় করে দিয়েছিলেন, ইউনিভার্সিটির পড়া শেষ করে সেখানেই রিসার্চ করতে ঢুকেছিলাম। রিসার্চ মানে অক্ষরের উৎস সন্ধান। উৎসের মধ্যেই রহস্য উন্মোচনের চাবিকাঠি লুকিয়ে রাখা আছে। আস্তে আস্তে সুপ্রাচীন অক্ষরেরা আমার সামনে নিজেদের স্বরূপ মেলে ধরছিল। শীত ঋতু শেষ হয়ে আসছিল। বরফ গলতে শুরু করেছিল। ইনগ্রিড বলল, চলো, আমরা টিউলিপ ফেস্টিভ্যাল দেখে আসি, যাবে?
আমি বললাম, কোথায়?
ইনগ্রিড বলল, অ্যামস্টারডামের আশেপাশে অনেক টিউলিপ গার্ডেন আছে। যাই চলো, অনেকদিন কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়নি।
সেই এপ্রিলে রঙের উৎসব দেখতে আমরা নেদারল্যান্ড গিয়েছিলাম। যেদিকেই তাকাই ধূ-ধূ করছে রংবেরঙের টিউলিপ। তীরের ফলার মত চোখে এসে বিঁধছে। দেখতে দেখতে চোখ পুড়ে যাচ্ছিল। চোখের সমস্যা আমার ছোট থেকেই। ইনগ্রিডের অবশ্য কোনও অসুবিধে হচ্ছিল না। সে খুব খুশি হয়েছিল গিয়ে। ফুলের খেতের মধ্যে দিয়ে আমার হাত জড়িয়ে হাঁটছিল। কথায় কথায় খিলখিল করে হেসে উঠছিল। যেন নিজেই ফুল হয়ে গিয়েছিল। হোটেলে ফিরে এসে ঘুমনোর তাল করছি, ইনগ্রিড দুষ্টু হেসে বলল, কোনওদিন স্ট্রিপ-টিজ দেখেছ, অনি?
আমি হেসে বললাম, না বাবা, ওসব কারবারে আমি নেই। বাই দ্য ওয়ে তুমি যদি দেখাও, ইন প্রাইভেট, আই ডোন্ট মাইন্ড।
ইনগ্রিড আমার কথায় আমল দিল না। বলল, সে কী! অ্যামস্টারডামে এসে তার নাইট-লাইফ না দেখে ফিরে গেলে লোকে তো তোমায় ছি-ছি করবে। গায়ে থুথু দেবে।”
যে যাই বলুক, এই ঠান্ডায় আমি আর বেরোচ্ছি না, আমি বললাম। যথারীতি আমার কোনও আপত্তিই ধোপে টিকল না। ইনগ্রিড আমায় হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে একটা নাইটক্লাবে টেনে নিয়ে গেল। এদেশে যৌন বিনোদন আইনসঙ্গত ব্যবসা। সেসব নিয়ে মানুষের বিশেষ আদিখ্যেতা নেই। আমাদের সামনে এক নৃত্যরতা নারী নিজেকে ধীরে ধীরে উন্মোচন করছিল। ককটেলের পাত্রে চুমুক দিতে দিতে আমরা দেখছিলাম। উন্মোচনটাও যে একটা পরিশীলিত শিল্প, ইনগ্রিড জবরদস্তি না করলে জানতে পারতাম না। ইনগ্রিড আমার উরুতে হাত রেখে বলল, কী হে, কেমন দেখছ?
আমি হেসে বললাম, ইনগ্রিড, রহস্যই একমাত্র অ্যাফ্রোডিসিয়াক যা আমার ওপর কাজ করে। এইসব নিরামিষ নগ্নতা আমায় টানে না।
ইনগ্রিড মদির গলায় ফিসফিস করে বলল, আজ রাতে হোটেলে ফিরে তোমায় আমি পৃথিবীর আদিমতম রহস্য চেনাব।
নাইটক্লাব থেকে বেরিয়ে হোটেলে ফিরতে মাঝরাত পেরিয়ে গেল। আমার মাথা সামান্য টলছিল। ঘরে ঢুকেই আমি ইনগ্রিডকে কাছে টানলাম। ইনগ্রিড আমায় দু’-হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিল। বলল, আমায় ছোঁবে না একদম। ওই সোফায় গিয়ে চুপটি করে বোসো।
আমি বাধ্য ছেলের মত আসনপিঁড়ি করে সোফার ওপর বসলাম। ইনগ্রিড মহেঞ্জোদড়োর রমণীর মত কোমরে হাত দিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়াল। বলল, এবার আমি তোমায় এমন স্ট্রিপ-টিজ দেখাব, যা তুমি সাত জন্মে দেখনি।
ইনগ্রিড নাচতে শুরু করল। চেনা কোনও নৃত্যরীতির সঙ্গে সেই নাচের বিন্দুমাত্র মিল নেই। হয়তো পৃথিবীর প্রথম নারী তার পুরুষকে সম্মোহিত করার জন্য এমন নাচ নেচেছিল। দেখছিলাম, সেই সম্মোহনে রূপের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে অরূপ, প্রেমের সঙ্গে অবলীলায় মিশে যাচ্ছে প্রার্থনা। ইনগ্রিডের লীলায়িত দেহবল্লরী নৈবেদ্য সাজিয়ে দিচ্ছে প্রাণের দেবতাকে। আহা, সে কী নাচ! আমার মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। আমি চাপা গলায় বললাম, ইনগ্রিড এই নাচ তুমি কোত্থেকে শিখেছ?
ইনগ্রিড নাচতে নাচতেই বলল, মায়ের কাছ থেকে। তার দেশ ছিল মিশরে…
আমি বললাম, আর তোমার মা?
তার মায়ের কাছ থেকে… তার দেশ ছিল ইরান, থেমে থেমে বলল ইনগ্রিড।
ওর নাচের প্রতিটি মুদ্রা যেন এক একটি অনন্য সংকেত। আমার নেশা কেটে যাচ্ছিল। মাথার মধ্যে হরপ্পার রহস্যাবৃত লিপিগুলো ভূতের নেত্য শুরু করেছিল। তবু আমি যেন তাদের পরিষ্কার চিনতে পারছিলাম। নাচতে নাচতে অনাবৃত হচ্ছিল ইনগ্রিড। এক এক করে পরনের পোশাক খুলে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছিল এদিক-সেদিক। আমি তার লাস্যময় ভঙ্গিমা পড়ে পড়ে লিপিদের পাঠোদ্ধার করছিলাম। একেকটি লিপি আদিমানবীর একেকটি দেহ-বিভঙ্গ। ইনগ্রিড অনুবাদ করে দিচ্ছিল, আর আমি বিড়বিড় করে আওড়াচ্ছিলাম সম্মিলিত ভাষান্তর। ইনগ্রিড যখন তার শেষ পরিধেয়টুকু আঙুলের ডগায় তুলে আনল, তখন আমি অবাক হয়ে দেখলাম, তার মুখে আর লাস্যের চিহ্ন মাত্র নেই। বরং চোখে ঈশ্বরচেতনার প্লাবন নেমেছে। সেই মুহূর্তে আমি শেষ চিহ্নটিরও পাঠোদ্ধার করলাম। ইনগ্রিড কাছে এসে ঝুঁকে পড়ে আমায় জড়িয়ে ধরল।
“কী রে টুটুল? চুপ করে আছিস কেন? মাসীমা কেমন আছেন রে?” এবারও সে আমার কথার কোনও জবাব দিল না।
নেচার সায়েন্সে হরপ্পা-লিপির পাঠোদ্ধারের পেপারটা ছাপা হতেই হৈ-হৈ শুরু হয়ে গেল। মিডিয়া আমায় ছেঁকে ধরল। পৃথিবীর সমস্ত বিখ্যাত সংবাদপত্রের প্রথম পাতায়, নামী-দামী পাক্ষিকের মলাটে আমার মুখ। বক্তৃতা দেওয়ার জন্য পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছিলাম। সেমিনার, সিম্পোসিয়াম, প্রেস কনফারেন্স করে দম ফেলার সময় পাচ্ছিলাম না। ইনগ্রিডের মুখ কালো হচ্ছিল, ওকে যথেষ্ট সময় দিতে পারছিলাম না। একদিন বলল, “জানি, আমায় আর তোমার দরকার নেই। অল্প-অল্প করে না ছেড়ে, একেবারে মুক্তি দাও না কেন?”
আমি বললাম, “অভিমান কোরো না, ইনগ্রিড। দেখছ তো কত ব্যস্ততা। সারা বিশ্ব ডাকাডাকি করছে। তাদের না বলি কী করে?”
ইনগ্রিড বলল, “আর কত দেখব? আর কতবার তুমি একই অজুহাত দেখিয়ে আমায় ছেড়ে যাবে? এবার না-হয় আমিই তোমায় ছেড়ে যাই!”
ইনগ্রিড চলে গেল। আমায় শূন্য করে দিয়ে ইনগ্রিড চলে গেল। বছর দশ-বারো এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করলাম। সম্মান, মর্যাদা, পুরস্কার… ভাল লাগছিল না। চোখটাও জ্বালাচ্ছিল। কোথাও একটু থিতু হয়ে বসা দরকার। নিজের ভিতর থেকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে সবাইকে কিছু না কিছু দিতে দিতে আমি ফুরিয়ে যাচ্ছিলাম। মনে হল দেশে ফিরে গেলে কেমন হয়। চন্দনপুরের বাড়িটা খণ্ডহর হয়ে পড়ে আছে। বন্ধুবান্ধবদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানলাম তাদের কেউ আর সে শহরে থাকে না। সুমিতাদির খোঁজ দিতে পারল না কেউ। তাপসদা নাকি বেশিদিন বাঁচেনি। তার মারা যাওয়ার পর সুমিতাদি ভাড়ার বাসা ছেড়ে চলে গিয়েছিল। কোথায়, কেউ জানে না। অগত্যা ফিরে এলাম, এই আশ্রম-বিশ্ববিদ্যালয়ে।
সে কি চলে গেল? আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, “কথা বলছিস না কেন, এই টুটুল?”
তার নড়ে বসার খসখস শব্দও শুনতে পেলাম। আমি তার পিঠে হাত রাখলাম। সে সরে গেল না। একটা মৃদু ফোঁপানির শব্দ শুনতে পেলাম, “তুমি কাঁদছ?”
হাত বাড়ালাম। তার গাল ছুঁলাম। চেনা নম্রতা। সে সরে গেল না।
সে কি আমার ছলনা বুঝতে পেরে গেছে? সে কি বুঝতে পেরে গেছে আমি তাকে চিনতে পেরেছি? কিন্তু জানাচ্ছি না। কত কাল কেটে গেল। এখন নিশ্চয়ই তার চোখের কোণে পাখির পায়ের ছাপ পড়েছে। চুলে রূপালি রেখা। সে কি এখনও দাঁত দিয়ে নখ কাটে?
সুমিতাদি আমার হাতটা টেনে নিয়ে ঠোঁট ছোঁয়াল। আমার পাথর ঘাঁটা হাত তার চোখের জলে ভিজে যাচ্ছিল। আমি জানি সে কী ভাবছে। তার ঠোঁট নড়ছিল, কিন্তু কোনও শব্দ আসছিল না। তবু আমি শুনতে পাচ্ছিলাম, সে বলছে - ‘দেখা না হওয়াই ভাল’ বলেছিলাম বলে এমনি করে শাস্তি দিলি? আমি কি চেয়েছিলাম তুই অন্ধ হয়ে যাবি? বোকা ছেলে!
কী করি? মুখ ফুটে চেয়েছিলে যে। আমিও মেনে নিয়েছিলাম।
দেখতে পাচ্ছিলাম না, কিন্তু মনে হচ্ছিল বৈঠকখানা ঘরে উপস্থিত সবাই চোখ বড় বড় করে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে জনসমক্ষে, প্রকাশ্য দিবালোকে সুমিতাদি আমার বুড়ো আঙুল মুখের মধ্যে পুরে চুষতে লাগল, বাচ্চা মেয়েদের মত।
আমি তার কানে কানে বললাম, “শান্ত হও। শান্ত হও। হে প্রিয় বান্ধবী! আর কোনোদিন আমি তোমায় ছেড়ে যাব না। সত্যি...”