পম্পাদের পাড়ার মোড়ে এসে দেখি উলটোদিক থেকে সে আসছে। কাঁধে লাল চামড়ার বটুয়া ঝোলানো। পরেছে আমার দেওয়া গেরুয়া রঙের সস্তা সালোয়ার কামিজ। চুলে একটা কমলা রঙের ক্লিপ গোঁজার পর তাতেই তাকে দারুণ দেখাচ্ছে।
আমাকে দেখে সে দূর থেকে হাত নাড়ছিল। দুজনে প্রায় একই সময়ে গলির মোড়ে এসে হাজির হয়েছি।
— ছোটু, বল কেমন দেখাচ্ছে আমায় আজ!
— দারুণ! তারপর মুখ ফস্কে বেরিয়ে এল—ঠিক যেন পার্কটাউনের নগরবধূ।
— কী বললি? পম্পা ঠিক শুনতে পায়নি।
— কিছু না। একটা বৌদ্ধযুগের স্ক্যান্ডাল তোমাকে শোনাব আজ, তুমি আম্রপালীর নাম শুনেছো?
পম্পা একটু কাঁচুমাচু হয়ে বলল—পেটে আসছে, মাথায় আসছে না। আমরা তো আধুনিক যুগে থাকি, তোর মতো পৌরাণিক যুগে আর কে থাকে বল?
পম্পাকে আমি বললাম—আম্রপালী হল লিচ্ছবীদের রাজধানী বৈশালীর নগরবধূ। এর কথা ইস্কুলের লাইব্রেরিতে জাতকের গল্পের বইতে আছে। সাত বছরে একবার একজন নগরবধূকে চয়ন করা হতো। নগরবধূ হল রাজনর্তকী। তবে অন্যান্য কাজও থাকত তার।
— কী কাজ? পম্পা তার মাথা থেকে চুল সরিয়ে এমন সরলভাবে জিজ্ঞেস করল যেমনভাবে একমাত্র শকুন্তলারাই কথা বলতে পারে।
তার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি জটিল ইতিহাস কী করে কাটানো যায় তাই ভাবছি। টোটোদার মাস্টারমশাই সুখেনবাবু বলতেন ইতিহাস আর অন্ধবিশ্বাসের মধ্যে কোনো দেয়াল নেই আমাদের দেশে। কোথায় ইতিহাস শেষ হয়ে গল্প শুরু হয়ে গেছে সেটা বুঝতে গেলে দেশের বাইরে লেখা দশটা বই পড়ে নেওয়া ভালো। দশটা বই তো দূর, আমি একটাও পড়িনি।
— দ্যাখো নগরবধূ কথাটার মধ্যে একটা মাধুর্য্য আছে না? পম্পাকে বললাম।—এমন একজন যাকে সকলেই বধূ হিসেবে কল্পনা করতে চায়। কিন্তু বাস্তব কী ছিল? নামটা গালভরা শোনালেও নগরবধূ তো আসলে ক্ষমতাশালী পুরুষদের হাতে বন্দি একটা অসহায় মেয়ে। পুরুষদের মনোরঞ্জন ছাড়া তার কী কাজ হতে পারে?
— যাক। এতদিনে তুই ঠিক চিনেছিস আমাকে।
পম্পা চুলে একটা ঝটকা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। আমি ঢিলে প্যান্টটা টানতে টানতে তার পিছনে ছুটলাম।
— পার্কটাউনের নগরবধূ মানে পার্কটাউনের ড্রীম গার্ল। পম্পাকে ধরে ফেলার পর বললাম।—তুমি যদি আম্রপালীর তথাকথিত ইতিহাস পড়ো তাহলে দেখবে তার রূপে আর গুণে মুগ্ধ হয়নি এমন কোনো পুরুষ ছিল না। এমনকী মগধের রাজা বিম্বিসার আর তার ছেলে অজাতশত্রু দুজনেই লিচ্ছবিদের যুদ্ধে হারাবার পর আম্রপালীর প্রেমে পড়ে তার হাতের লাট্টু হয়েছে। নগরবধূরা কাকে নিজের বেডরুমে ঢুকতে দেবে সেটা নিজেরা ঠিক করতে পারত, এবং তাদের ভালোই টাকাকড়ি হতো।
পম্পা তার হরিণচোখের নৈঋত কোণ দিয়ে আমাকে দেখে বলল—সাত বছর পর যখন সে আর নগরবধূ থাকত না তখন?
পম্পাকে বললাম—এত বিশদে কি কোথাও লেখে? নগরবধূ হতে গেলে ললিত কলায় পারদর্শী হতে হয়। আন্দাজ করা যায় বোকা নয় তারা। রিটায়ারমেন্টের জন্য জমিজমা কিনত নিশ্চয়ই। তুমি তো শরৎচন্দ্র আমার চেয়েও বেশি পড়েছ। রাজলক্ষ্মীর একটা টেক্স্টাইল মিল ছিল না?
পম্পা আমার দিকে তাকিয়ে বুঝবার চেষ্টা করল আমি তাকে উস্কে দেওয়ার জন্য বলছি কিনা। তারপর নিশ্চিত না হতে পেরে বলল—কাপড়ের দোকান।
— দেয়ার ইউ আর। আম্রপালীর সেরকম একটা বিরাট আমবাগান ছিল। সেখানে বুড়ো বয়সে শাক্যমুনি স্বয়ং এসেছিলেন অতিথি হয়ে। বুদ্ধদেব অল্পবয়সী শিষ্যটিষ্যদের সাবধান করে দিতেন। চোখ বুজে থেকো। আম্রপালীকে দেখে মাথা ঘুরে গেলে সমস্ত সাধনা গোল্লায় যাবে।
সকালে এক পশলা বৃষ্টি হওয়ার পর বেলাটা ঠান্ডা হয়ে এসেছে। পার্কটাউনের বাগানওয়ালা বাড়ির এই সুশ্রী পাড়াতে রাজহংসীর মতো গ্রীবা তুলে পম্পা আমার চেয়ে অর্ধ-পদক্ষেপ এগিয়ে হাঁটছিল। আমাদের পিছনে ভিজে রোদ একটা সুখী আর অলস গরুর মত হেলতে দুলতে চলেছে।
— আমার সঙ্গে মিশে তোর সব সাধনা যেমন গোল্লায় যাচ্ছে? পম্পা বটুয়া দোলাতে দোলাতে তার ভুরুটা বাঁকিয়ে বলল।
শিমলিপুরের ছেলেদের কোনো বলার মতো ভবিষ্যত থাকলে পম্পা এই ইয়ারকিটা করতে পারত না। সাতশো বছর ধরে শহরটা সুফীদের কব্জায়। একটা নির্লজ্জ কালচার। অধঃপতনই যেখানে জীবনের গন্তব্য। পম্পা ভালোই জানে আমি হিন্দী গান আর উর্দু গজল পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছি।
তাকে লক্ষ্য করে বললাম—
তুঝকো মস্জিদ হ্যায় মুঝকো ম্যায়খানা
ওয়া—ইজা অপনী অপনী কিস্মৎ হ্যায়।
তোর হয়েছে মসজিদ আর আমার শুঁড়িখানা
মোল্লা, সব নিজের নিজের কপাল আমাদের।
— এটা আবার কার? পম্পা বটুয়া ঘোরানো না থামিয়ে বলল।
— মীর তাকি মীর বলে একজন সুফীর। যাঁকে তুমি পছন্দ করো না। তিনি আমাদের যুগে জন্মালে চৌদ্দ বছর বয়স হওয়ার আগেই তোমার শুধু স্কার্ট নয়, তার নিচে যা পরো...।
— স্টপ! একদম স্টপ! আবার ছোটলোকের মত অসভ্য ভাষায় কথা বলা শুরু করেছিস তুই। তোর সঙ্গে হাঁটতে লজ্জা করে। মীর শুঁড়িখানাতে পৌঁছে থেমেছিলেন। তোর নামার কোনো শেষ নেই।
আমরা পম্পাদের বাড়িতে পৌঁছে গিয়ে সেটাকে পেরিয়ে গিয়েছি। কেন, কেউ জানি না। বা দুজনেই জানি। পম্পা আমাকে মনের সুখে দুষবে। আমি নির্লজ্জের মত চোখ দিয়ে গিলব তার শরীর, আর মুখে মুখে বদমাইশ ছেলের মতো জবাব দিয়ে যাব। এই হল আমাদের হরমোনসিঞ্চিত দেহকোষ থেকে আসা এক্স আর ওয়াই ক্রোমোসোমের আদেশ।
তাই পাড়াটা একবার ঘুরে উলটোদিকের বড়ো রাস্তা ধরে একটা চক্কোর দিয়ে আসতে হচ্ছে আমাদের।
পম্পাকে বললাম—আমি আম্রপালীর মতো আরেক নগরবধূ আর সে যুগের আটজন বোধিসত্ত্বকে নিয়ে একটা ভীষণ অসভ্য ঘটনার কথা তোমাকে শোনাতে পারি। তুমি কি সেটা শুনতে চাও?
— অ্যাঁ! তুই বোধিসত্ত্বদের নিয়ে নোংরা প্রচার করবি এবার?
কিছু শোনার আগেই পম্পা বোধিসত্ত্বদের বাঁচাবার চেষ্টায় নেমে গেছে। যেন আমার একটা মাত্র নগরবধূর খপ্পরে পড়ে তাদের আটজনের সর্বস্ব যাবে।
পম্পাকে বললাম—নগরবধূ কি বাঘ যে তাদের ধরে খাবে? নগরবধূ তোমার মতো একটা মেয়ে। নিশ্চয়ই তাকে প্রথমে জোর করে লাইনে নামানো হয়েছিল। পরে তার অতুলনীয় রূপ আর নাচের খ্যাতি গান্ধার থেকে চম্পা পর্যন্ত ছড়িয়েছে। তোমার মনে আগে এই প্রশ্নটা উঠছে না যে আটজন বোধিসত্ত্ব তার কাছে এসে উপস্থিত হয়েছে কেন?
পম্পা বলল—প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু তোর কাছ থেকে যে অশ্লীল উত্তরটা পাব সেটা আমি শুনব কেন?
পম্পা আর আমি দাঁড়িয়ে দুটো ফেদারওয়েট বক্সারের মতো পরস্পরের চোখে চোখ রেখেছি। পম্পা ‘না’ বলেনি। সুতরাং গল্পটা সে শুনবে। কিন্তু আগে আমাকে আস্তে আস্তে তার মন থেকে লজ্জার আবরণগুলো খুলে দিতে হবে। সেটা আমার আজকের চ্যালেঞ্জ।
বললাম—সুফীরা আশিক লোক। তারা জানত বংশের নাম আর কীর্তির পরোয়া না করে জীবনের মজাগুলো কীভাবে লোটে। এই মজা লুটবার ইচ্ছেটা আটজন বোধিসত্ত্বের মধ্যে ঢুকেছিল। এবার কী হবে?
— তাহলে তারা আমাদের মতো সাধারণ হয়ে যাবে। বোধিসত্ত্ব থাকবে না। নিজের ভোগেই যদি সময় কেটে যায় তাহলে অন্যদের মঙ্গল করবে কী করে?
— তা না হয় হল। কিন্তু তারা নগরবধূর কাছে আসবে কেন?
— ভাই ফোঁটা নিতে। পম্পা দাঁত কিড়মিড় করে বলল।—যেমন আমি তোকে দিই।
পম্পা যেভাবে কথাটা বলল তাতে আমি হেসে ফেললাম। তার হাতে ভাই ফোঁটা নেওয়ার কথা উঠেছিল গত বছর। সত্যি, বাবা মা’রা যে কোন জগতে থাকে! মজা দেখার জন্য আমি আপত্তি করিনি। ভেবেছিলাম পম্পার সামনে বাবু হয়ে বসে আমি তার নরম অনামিকার স্পর্শ নেওয়ার পর প্রণাম করার ছলে পায়ের বুড়ো আঙুলের ডগা কামড়ে দেব। পম্পা ব্যাপারটাকে নানা ফিকির করে কাঁচিয়ে দেয়।
বললাম—নিশ্চয়ই বুঝে গেছো, এই তরুণ ও যুবক বয়সের বোধিসত্ত্বরা নগরবধূর কাছে নিজেদের কৌমার্য হারিয়েছিল। কিন্তু তারা সেজন্য তার কাছে আসেনি। তারা এসেছিল একটা বিশেষ বস্তুর অমোঘ টানে।
পম্পা তাকিয়ে রইল আমার দিকে।
— শুনতে চাও না সেটা কী?
— আমি কি তোর কাছে যত রাজ্যের অসভ্য গল্প শুনব বলে বায়না করেছি?
অর্থাৎ—বলে ফ্যাল অসভ্য ছেলে। নইলে তোর সঙ্গে এতক্ষণ ঘুরছি কেন? পম্পার শরীর থেকে চোখ সরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে আমি বললাম—বৈশালীর এই নগরবধূর নাম কী জানো? তার নাম হলো স্বর্ণবৃন্তা। কেন এই নাম? কারণ তার স্তনের বোঁটাগুলোর রঙ ছিল কাঁচা সোনার আর তা থেকে কচি আমের স্বাদ ও সুগন্ধ পাওয়া যেত। বৈশালীর লোকেরা বলতো যে সুতির কাপড়ের উপর দিয়েও তা চুষলে...।
পম্পার মুখ দিয়ে কোনোদিন গালাগালি বেরোয় না। সেদিন রাস্তার মাঝখানে থেমে গিয়ে সে কোনোক্রমে একবার শুধু বলল—জানোয়ার! তারপর ঘুরে হন হন করে নিজের বাড়ির দিকে রওনা দিল।
অসম্ভব যা-তা ভাবে দিনটা শুরু হওয়ার পর আমি ভাবছিলাম আর কারো কি কোনোদিন এরকম হয়েছে? বা হবে? একটা সামান্য স্ক্যান্ডালের গল্প বলতে গিয়ে বান্ধবী খোয়া গেছে কারো? হলে পৃথিবীতে প্রথম আমার ভাগ্যেই হবে।
আসলে এই সুতির কাপড়ের উপর দিয়ে যে বিশেষ কাজটার কথা বলেছি, সেটা পম্পার জীবনেরও একটা লজ্জাকর অভিজ্ঞতা। যদিও আমার ধারণা পম্পা একবার শুনলেই বুঝতে পারত যে কারো পক্ষে সেটা ধরা সম্ভব নয়। কিন্তু কিছু শোনার আগেই তার ফিউজ উড়ে গেছে।
এখন কী করি? তাদের বাড়িতে যদি যাই সে আমার মুখ দেখতে চাইবে কিনা সন্দেহ। মায়ের সামনে একটা কিছু ছুঁড়েই না মারে। না যদি যাই তাহলে মাসিমা কাঁচকলার কোফ্তা নিয়ে না খেয়ে বসে থাকবেন। এই ধর্মসঙ্কট থেকে কোন পূর্বপুরুষ আজ বাঁচাবে আমায়?
পম্পাদের বাড়ির উলটোদিকে একটা শিবের মন্দির। সেখানে গিয়ে মন্দিরের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছি। পার্ক করা সাদা একটা ফিয়েট গাড়ি পাড়ার লোকের অনুসন্ধানী দৃষ্টি থেকে কিছুটা আড়াল করছে আমায়। দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি। মাথা খুলছে না। দুবার মরীয়া হয়ে দরজায় টোকা দিতে গিয়েও ফিরে এলাম। মিনিট দশেক পর যখন ভাবছি যে মোড়ের মাথায় পানের দোকান থেকে একটা ঠান্ডা কোল্ড ড্রিঙ্ক কিনে আনব, তখন সামনের বাড়ির দরজাটা খুট করে খুলল আর পম্পা সাবধানে বেরিয়ে এসে দরজা ভেজিয়ে দাঁড়াল।
মানে মাসিমাকে লুকিয়ে বেরিয়েছে।
আমার গুস্সেওয়ালী গার্লফ্রেন্ড ডানদিক আর বাঁদিকে তাকিয়ে আমাকে খুঁজছিল। আমি প্রায় তার নাক বরাবর থেকেও অদৃশ্য। ফিয়েটের ছাদের উপর দিয়ে মাথাটা উঁচিয়ে লোফারদের মতো জিভের তলা দিয়ে একটা আওয়াজ করলাম—ছিক্ ছিক্।
আমার জিভের আওয়াজটা শুনে পম্পা এদিকে মুখ ফেরাল এবং প্রচণ্ড গম্ভীর মুখে একটা মৃত্যুশীতল চাউনি ফুটিয়ে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল। আমি নেংটি ইঁদুরের মতো গুট গুট করে এবং দুই বাহু সামনের দিকে এনে প্রায় হাতজোড় করে এগিয়ে গেলাম তার কাছে।
— উপরে আসিসনি কেন?
— তোমার ভয়ে। তুমি আসতে বললেই আসব।
পম্পা দরজাটা ছেড়ে দিয়ে একধারে সরে এল আর আমি খাঁচায় প্রবেশ করার মতো সেটা খুলে সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করলাম।
খাওয়ার পরে যখন পম্পা তার নিজের ঘরে না ঢুকে আমাকে বাইরের ঘরে বসিয়ে গম্ভীরমুখে একটা ম্যাগাজিন পড়তে লাগল, তখন আমি আমার যা কাজ তাই শুরু করলাম, অর্থাৎ মুখোমুখি না বসে একটু পাশ থেকে তাকে দেখতে লাগলাম।
আমাদের দুজনের মাঝখানে কোনো দেয়াল এসে পড়েনি। এসেছে স্বর্ণবৃন্তা নামের একটি বৌদ্ধ যুগের চরিত্র। ঘরের মাঝখানে তাকে ঘিরে জটলা করছে সাতজন সুপুরুষ যুবক, যাদের বয়স ষোলো থেকে ছাব্বিশ। অষ্টমজনকে দেখতে পাচ্ছি না। যাদের দেখা যাচ্ছে তাদের অনেকের পরনে রেশমের বস্ত্র, গলায় মুক্তোর হার। সবচেয়ে তরুণ যে সে তার লম্বা চুল একটু আগোছালোভাবে কেশরের মতো ছড়িয়ে রেখেছে কাঁধের উপর। বালক হলেও সে একজন বোধিসত্ত্ব। তার চোখের দৃষ্টিতে জ্ঞানের সমুদ্রের গভীরতা। তারা নিজেদের মধ্যে আলাপ করতে করতে ঘরের ভিতর ঘুরে বেড়াচ্ছিল। স্বর্ণবৃন্তা মাঝে মাঝে আড়চোখে পম্পাকে দেখছে। যেন এক ঘরে দুজন সুন্দরীর উপস্থিতি অশোভন।
আমি পম্পার সংবিত ফেরাবার জন্য একটু গলা খাঁকরে বললাম—কী ভাবছো জানতে পারি?
পম্পা কোনো উত্তর দিল না। সে হাতের পত্রিকাটা টেবিলের উপর রেখে সোফায় হেলান দিয়ে বসেছে এবং আমাকে এমনভাবে দেখছে যেন আমার চামড়ায়, বা হাড়ের গঠনে কোনো অসংশোধনীয় ত্রুটি আছে যার জন্য তাকে দুঃখের সঙ্গে আমাকে তার রাজত্ব থেকে নির্বাসন দিতে হচ্ছে। যেন সে তার সান্নিধ্যের জাদুঘর থেকে জয় নামটা এক্ষুণি কাটবে, এবং বলে উঠবে—বাই দ্য ওয়ে, বেরোবার পথে আমার নীল স্কার্টটা ফেরৎ দিয়ে যাস (যেটা সবার সামনে সুবোধ বালক সেজে থাকার পুরস্কার হিসেবে সে আমাকে রাখতে দিয়েছিল)।
একটু পরে পম্পা উঠে দাঁড়াল। স্বর্ণবৃন্তা আর তার অপোগণ্ড বোধির সাগরগুলো তখন মানে মানে সরে পড়ছে। দুটো হাত নিজের বুকের কাছে জড়ো করে পম্পা বলল—তোকে আমি যা দেওয়া উচিত তার বেশি দিয়েছি। আমার বন্ধুদের মধ্যে যারা খুব চালু তারা পর্যন্ত এতদূর এগোয়নি। তার পরেও একটা অচেনা, অপরিচিত ছেলেকে তোর এত হিংসে! ওর সঙ্গে আমার যে একটা মাত্র বাজে ঘটনা ঘটে গেছে সেটাকে তুই ভুলতে পারছিস না। সারাজীবন ধরে কি আমাকে সেটার জন্য অপমান সইতে হবে?
— অপমান?!
আকাশ থেকে পড়লাম একেবারে।—কী যে বলো তুমি? অপমান কেন করব? করলামই বা কখন?
— এই নগরবধূকে দিয়ে যা করাচ্ছিস সেটাই তো আমাকে অপমান করছে! এই যে... এই যে নোংরা জিনিসটা বললি ... আমার জীবনের একটা প্রাইভেট দুর্ঘটনাকে থিয়েটার বানিয়ে পৃথিবীময় সবাইকে দেখিয়ে বেড়াবার জন্য... সেটা কোন আক্রোশ থেকে তোর মনের মধ্যে আসছে?
— বিশ্বাস করো, আমি আক্রোশ-টাক্রোশের থেকে হাজার ক্রোশ দূরে আছি। আমায় তুমি বেওকুফ বলতে পারো, ঘটিয়া কিসিম বলতে পারো। বে-অদব, বদ্জবান, গ্যায়র-তহজীব, দেশদ্রোহী এসব বলা যায়। কিন্তু তোমার প্রতি আক্রোশ আমার কোনোদিন হয়নি।
— তাহলে যে ঘটনাটা আমি মা’কে ছাড়া মাত্র আর একজনকে পৃথিবীতে ভরসা করে জানিয়েছিলাম, সেই ঘটনাটা তুই বিশ্বসুদ্ধু রটিয়ে দেওয়ার কথা ভাবলি কী করে? তোর উপরে আমার বিশ্বাস না থাকলে আমাদের সম্পর্কে রইলটা কী?
এবার ভালো ভালো উপদেশ আসতে শুরু করবে ভেবে আমি অধৈর্য হয়ে পড়েছিলাম। বললাম—তুমি যদি জীবনটাকে আরেকটু সহজভাবে নিতে, তোমার ভদ্রতার মস্জিদ ছেড়ে সুফীদের মতো শুঁড়িখানায় বসে আমাকে স্রেফ একটা যৌন খেলনা, মানে সেক্স টয় হিসেবে দেখতে শিখতে...।
আর যাবে কোথায়? চিড়বিড়িয়ে উঠে পম্পা বলল—জয়, তুই একটা থাপ্পড় খাওয়ার জন্য নিশপিশ করছিস, তাই না? দু-বছর ছোট হয়ে আমাকে এই নজরে দেখছিস আজকাল? সেইজন্য আমার বিশ্বাসের কোনো দাম নেই আর।
— ওফ্ফো! বিশ্বাস, সহযোগিতা, লয়ালটি, ধানাই-পানাই, এইসব পলকা জিনিস দিয়ে তুমি আমাকে নিজের সঙ্গে বেঁধে রাখতে চাও কেন বলো তো? আমি যখন তোমাকে লুকিয়ে দেখি, তখন তোমার বিশ্বস্ত হওয়ার প্রমাণ খুঁজি না। ঘন চুলের সমুদ্রের ভিতর একটা ব্লু হোয়েল আর একটা আধডোবা জাহাজের মতো তোমার আর আমার শরীরদুটোকে কল্পনা করি।
— মানে তুই আমাকে নিয়ে যা ইচ্ছে লিখবি?
— বৈশালীর স্বর্ণবৃন্তার মধ্যে কে পার্কটাউনের পম্পা মুখার্জিকে খুঁজে পাবে? তোমার আটটা পণ্ডিত প্রেমিক আছে?
পম্পা আমার অবাধ্যতা বশে না আনতে পেরে সাইকোলজি লাগাল।— এত প্লট থাকতে তুই এই ঘটনাটাকেই নিয়ে পড়লি কেন? সেটা আক্রোশ থেকে নয়?
কী যে বলি? ঘুরে ফিরে একই জায়গায় ফিরে এসেছি আমরা। কোনো সমাধান নেই তর্ক বাড়িয়ে। শকুন্তলাকে বললাম—আচ্ছা, যদি কোনোদিন এ সব কথা লিখেও ফেলি, ছাপাব না। অপ্রকাশিত থাকবে।
— তাহলে লিখে কী লাভ?
— না লিখলেও হয়। লিখে ফেললে ওটা আমাদের সঙ্গে বড়ো হবে। পরে তার ভিতর থেকে ডালপালার মতো অন্য চিন্তা বেরিয়ে বৈশালী কীভাবে আম্রপালীর আম থেকে শুরু করে মজফ্ফরপুরের লিচুতে পৌঁছে গেল সেটা হয়তো একদিন বুঝে ফেলব আমি। এইভাবেই আমার যা শেখার তা শিখি। তুমি তো চাও আমি তাড়াতাড়ি ম্যাচিওর হয়ে উঠি, তাই না?
— হা ঈশ্বর! এই তোর ম্যাচিওরিটি?
— টাকাও বানাব। মামাদের মতো গরীব আমি থাকব না। হাত খুলে খরচ করব দুজনের জন্য। পালিকা বাজারের বাচ্চা সেল্স্ম্যানগুলো তোমাকে আর আমাকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করবে।
— সেটাকেও ম্যাচিওর হওয়া বলে না জয়।
— আমি জানি না কাকে বলে বড়ো হওয়া। কিন্তু গম্ভীর, সিরিয়াস, চক্রান্তকারী, টেকো ঘুঘু আমি হতে চাই না। সেরকম হওয়ার আগে কলেজ গ্রাঊন্ডের মাঠে একটা বুলেট খাওয়া ভালো। চুল টুল পাকার আগে মরব আমি।
তারপর আমাদের আবার ভাব হয়ে গিয়েছিল এবং দুপুরবেলাটা এ নিয়ে আর কথা হয়নি। দিনের শেষে তাদের নাচের গ্রুপের নতুন ছেলেমেয়েদের অডিশানে আশাদিকে সাহায্য করার পর ক্লান্ত শরীরে সে যখন আমার সঙ্গে ফিরছিল, তখন ম্যাড্রাস হোটেল থেকে একটা খালি বাসে উঠে আমি তাকে বলেছিলাম—তুমি এই ডান্সের ট্রুপ ছাড়া বাঁচবে কী করে? আজকে আমি বুঝেছি, নাচই তোমার ফার্স্ট লাভ।
আমার ফার্স্ট লাভ যে নাচনেওয়ালী সেটা আমরা দুজনেই জানতাম।
পম্পা তখন আমার প্রশ্নের কোনো জবাব দেয়নি। সন্ধ্যেবেলার ফাঁকা ফিরোজশাহ রোড দিয়ে বাসটা হু হু করে যাচ্ছিল আর জানালার বাইরে বড়ো বড়ো জাম আর অর্জুন গাছের পাতার উপরে রূপোলি-নীল আকাশ আমাদের হৃদয়হীন শহরের মাথায় একটা হাত রেখে বলছিল—গুডনাইট।
প্রসঙ্গটা আমি ভুললেও, সে ভোলেনি। পরে আমার গায়ের সঙ্গে লেগে সেই নাচনেওয়ালী বলেছিল—তোর সেই রাজনর্তকীর কী হবে?
তাকে নিয়ে তো কিছু লিখব না ঠিক করেছি। পম্পাকে বললাম—কিছুই হবে না। একটা ফাঁকা স্লেটের মতো পড়ে থাকবে সে। আস্তে আস্তে আমি ভুলে যাব তার কথা।
— না, না। ভুলবার আগে একবার অন্তত তার কী হল বলে রাখ আমায়। ভালো হল না খারাপ?
হুম্ম্ম্। ইতিহাস কি হিন্দী সিনেমার লাভ-স্টোরি যে শুধু ভালোই হবে? অজাতশত্রুর হাতে পড়ে বৈশালীর কী হয়েছিল? পম্পার মনটা তৈরী করার জন্য বললাম—রাজনর্তকী হল শহরের একটা প্রত্যঙ্গ। এক ধরণের মানুষের প্রতীক। প্রতীকদের সঙ্গে যা হয় সেটা অনুমিত ইতিহাস। একটা লেজেণ্ড। এই ধরণের ট্র্যাজিক চরিত্র কখনো পার্সোনালি নিতে নেই।
— কী ধরণের মানুষের প্রতীক এই রাজনর্তকী?
পম্পার নরম গায়ে নিজেকে আরেকটু গেঁথে দিয়ে বললাম —ওয়েল, সেই ধরণের মানুষ যাদের হাতে পড়লে ভদ্র পরিবারের ভালো ছেলেরা খারাপ হয়ে যায়। শাক্যমুনি অবধি জানতেন সেটা।
— কাহিনীর গোড়াটা তো তুমি জানো। কোত্থেকে শুরু করব তাহলে? পরে জানালার বাইরে ছুটে পালানো গাছের পাতাগুলোকে শিরিষ কাগজের মতো আমার দৃষ্টির ফ্রেম ঘষতে দিয়ে বললাম।—অনেক দিন আগে বৈশালীর এক নগরবধূ ছিল। তার নাম স্বর্ণবৃন্তা।
— আটজন বোধিসত্ত্বের নাম কী? নাম না দিতে পারলে গল্পে তাদের ঢোকাতে যাস না।
— বেশ। বয়স অনুক্রমে বলছি শোনো। বড়ো থেকে ছোট। প্রিয়ব্রত, গতাসূয়, বোধিদ্রুম, চন্দ্রহাস, শুদ্ধ, শ্বেতকেতু, অরণ্য, আর সলিল।
— এক্ষুণি বসে বসে বানালি তো? শেষ দুটো নাম শুনে বোধিসত্ত্ব বলে মনে হচ্ছে না।
— কী করে মনে হবে? এগুলো তাদের মা-বাবার দেওয়া নাম। প্রিয়ব্রতর বয়স ছাব্বিশ। অরণ্যের ষোলো। অরণ্যের মাথা জুড়ে সিংহের কেশরের মতো বাদামী চুল। তার চোখের মণিও হলুদ। পরবর্তী জীবনে তার একটা বোরিং নাম হবে নিশ্চয়ই। শীলভদ্র কি ধর্মছত্র। কিন্তু আপাতত নগরবধূর কাছে সে নিজেকে অরণ্য বলে পরিচয় দিয়েছে।
— আর সলিল? যে সবচেয়ে ছোট?
— হ্যাঁ সেই ছেলেটাকে নিয়ে একটু সমস্যা আছে। তার বয়স মাত্র চৌদ্দ। স্বর্ণবৃন্তার সত্যিকারের বয়স তার দুগুণ। যদিও সে কমিয়ে বলে বাইশ।
— ওঃ কী যা তা! পম্পা আমার গা থেকে গা সরিয়ে একটু সোজা হয়ে বসে বলল।
— তুমিও তো আমাকে চৌদ্দতে নষ্ট করেছিলে। বোধিসত্ত্বটাকে ছাড়া হবে কেন? নগরবধূর কাজই তো তাই।
— নগরবধূর কাজই তো তাই! পম্পা মুখ ভেঙিয়ে বলল।—সমস্ত দোষ তার ঘাড়ে চাপিয়ে এই আটটা ছেলেকে ভালো বানিয়ে দে।
— ওঃ। এখন নগরবধূর জন্য তোমার প্রাণের পাখি কেঁদে উঠেছেন। একটু আগে তুমি তার হাত থেকে বোধিসত্ত্বদের বাঁচাতে চাইছিলে না? তুমি কী চাও আমি জানি। ছেলেরা সব গুড-বয় হয়ে মায়ের আঁচলের নিচে লুকিয়ে থাকুক। মেয়েরা চার্চে গিয়ে ধর্মযাজিকা হয়ে যাক। দুদলের মধ্যে একটা শুদ্ধতার দেয়াল খাড়া করে আমি গান্ধীজী হয়ে বসে থাকি।
আই-টি-ও-তে বাস থেমেছে। একটা লোক গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে উঠে আমাদের পাশ দিয়ে ড্রাইভারের পাশের সিঙ্গল্ সীটটাতে গিয়ে বসল। সুন্দর একটা হুইস্কি আর পানের গন্ধ ছড়িয়ে গেল সর্বত্র। পম্পা নাক কুঁচকে জানালার দিকে মুখটা বাড়িয়ে দিয়েও তার গরম শরীর দিয়ে আমাকে আরেকটু চেপে দিয়েছে। মুখে সে যা বলছে, শরীরের ভাষায় তার উলটোটা শুনছি আমি।
— প্রেম, ভালোবাসা, এসব ছেড়ে তোর পুরো আকর্ষণটা হল পারভার্শানের দিকে। হোয়াট এ ক্রীপ!
ইংরেজিতে গাল শুনে খচে গিয়ে আমি বললাম—ভালো। এই নগরবধূও হল পারভার্শানের প্রতিমা। তোমাদের ভাষায় বলতে গেলে এ গডেস অফ ক্রীপ। যৌন বিকৃতির অধিষ্ঠাত্রী দেবী। সেই প্রতিযোগিতায় জিতেই সে নগরবধূ হয়েছে। এবার বলো তুমি তার কাহিনী শুনতে চাও কি চাও না?
পম্পা আমার দিকে তাকিয়ে খুক্ খুক্ করে হাসতে হাসতে প্রায় গড়িয়ে পড়ে গেল।
— আচ্ছা তাহলে পরের প্রশ্নটার উত্তর দে। হঠাৎ এই আটজন আমসত্ত্ব রাজনর্তকীর কাছে এসে হাজির হবে কেন? কীসের সন্ধানে? একটু সামলে নেওয়ার পর পম্পা আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করল।
আমি বললাম—বুদ্ধপূর্ণিমার দিন বৈশালী নগরে একটা বিরাট সমাগম হয়। দূর দুরান্ত থেকে গৃহী ও ভিক্ষুরা সাতদিন আগে থাকতে এসেছিল সেবার। পূর্ণিমার আগের দিন এই আটজন বোধিসত্ত্ব ঊষার অপেক্ষায় নারায়ণী নদীর তীরে বসে ধ্যান করছিল। কোত্থেকে তারা এসেছিল কেউ জানে না। কেন সেদিন একসঙ্গে তারা নদীর তীরে জড়ো হয়েছিল সেটাও জানে না কেউ। সূর্যের প্রথম আলো ফোটার সময় স্বর্ণবৃন্তা যখন নদী থেকে স্নান করে উঠছিল তখন তার সোনার কলসের মতো দুই বুক থেকে টপ টপ করে সোনার মতো জলের ফোঁটা পড়তে দেখে ফেলে এই আট বোধিসত্ত্ব। ব্যাস্। ধ্যানের বারোটা বেজে গেল।
— এইরকম ছ্যাবলা মার্কা ছেলেগুলো বোধিসত্ত্ব হল কী করে?
— এ সবের উত্তর পরে পাবে। তার আগের ঘটনাটা আগে শোনো। আটজন বোধিসত্ত্ব নগরবধূর পথ আটকে দাঁড়িয়েছিল। দু-পা গেলেই তার আমবাগান। এইটুকু পথের জন্য কে আর প্রহরী নিয়ে আসে? যাহোক একটুও ভয়ের চিহ্ন না দেখিয়ে নগরবধূ বলল—তোমাদের কি পথ হারিয়েছে বালকগণ? মা-বাবা কোথায়?
তখন সলিল বলে সেই চৌদ্দ বছরের ছেলেটা গম্ভীরভাবে বলল—বালক কাকে বলছো নগরবধূ? আমরা সবাই বোধিসত্ত্ব। তোমার সঙ্গে কথা বলব বলে রাত থেকে এখানে অপেক্ষা করে আছি।
বোধিসত্ত্ব শুনে স্বর্ণবৃন্তার ভ্রু বঙ্কিম হয়ে গিয়েছিল। মনে মনে সে ভাবল—উফ্, কী মিথ্যেবাদী এই ডেপোঁ ছেলেটা। তাও সে আটজনকে সঙ্গে করে বাড়িতে নিয়ে গেল। তারপর নাচ-গানের অনুশীলনের জন্য তৈরী ষোলটা শ্বেতপাথরের খাম্বা লাগানো প্রাসাদের মতো কক্ষে বসিয়ে বলল—বলুন বোধিসত্ত্বগণ, আপনাদের জন্য কী আনাব? আপনারা দুগ্ধ পান করবেন না আমপোড়ার শীতলপানীয়? বুদ্ধপূর্ণিমার জন্য যতদিন এই শহরে আপনাদের থাকার অভিপ্রায়, আমার বাড়িতেই থাকতে পারেন।
অরণ্য আর সলিল কিছু বলতে যাচ্ছিল। প্রিয়ব্রত এক হাত তুলে তাদের নিরস্ত করে বলল—হে নগরবণিতা স্বর্ণবৃন্তা, আমরা গৃহী নই। সংসারের ছলা-কলা আমাদের মানায় না। আমাদের আসার উদ্দেশ্য তোমাকে আগেই অকপটে জানিয়ে দেওয়া কর্তব্য।
স্বর্ণবৃন্তা বলল—বেশ তো। বলুন।
প্রিয়ব্রত বলল—আমরা এসেছি... মানে আমাদের উদ্দেশ্য হল...। এই পর্যন্ত বলে প্রিয়ব্রতর মুখটা পাঁশুটে হয়ে গেছে। তারপর সে বিষম খেয়ে কাশতে শুরু করল।
তখন সিংহের কেশরধারী অরণ্য তার সঙ্গীদের সকলের চোখ মাটির দিকে দেখে এগিয়ে এসে বলল—সুন্দরী আমরা তোমার সঙ্গে একটিবার করে মিলিত হতে চাই। এটাকে আমাদের দুর্বলতা ভেবো না। আমাদের সাধনার একটা অঙ্গ ভাবতে পারো। তুমিও আটজন অসাধারণ পুরুষের সঙ্গলাভ করার সুযোগ পাবে।
এই জায়গাটায় পম্পা আর থাকতে না পেরে খিল খিল করে হেসে উঠল আর বাসে যে কটা লোক ছিল তারা আমাদের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল। আমি লজ্জায় থেমে গেলাম। পম্পা জিভ কেটে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বলল—সরি, সরি। কিন্তু এই বোধিসত্ত্বগুলো ভয়ঙ্কর ফানি। ষোলোতে কেউ পুরুষ হয় নাকি? তুই তো একটা বাচ্চা ছেলে বয়ম্যান!
পম্পাকে চাপা গলায় একটু বকে বললাম—নগরবধূও তাই ভেবেছিল। কিন্তু সে হাসলেও, তুমি অত জোরে হাসতে পারবে না।
— ঠিক, ঠিক। আচ্ছা, আর হাসব না। বল।
— হুম্। তো শোনো। অরণ্যের আবেদন শুনে স্বর্ণবৃন্তাও তোমার মতো খিল খিল করে হেসে উঠেছিল। সে বলল—ও এই কথা। তা বেশ তো। নগরবধূকে শপথ নিতে হয় যে অকারণে কোনো পুরুষ বা অর্ধপুরুষকে সে বর্জন করবে না। কিন্তু আমার সঙ্গে মিলনপ্রার্থীদের দশটি স্বর্ণমুদ্রা জমা করে নাম লিখিয়ে যেতে হয়। তারপর সুবিধেমতো আমরা একটা তিথি জানাই। আপনারা দশ দশ মুদ্রা নিয়ে এসেছেন কি?
সবাই চুপ। চন্দ্রহাস যার নাম সে তখন বলে উঠল—হে নগরবধূ, আমরা কেউই দরিদ্র পরিবারের সন্তান নই। আমার জন্ম বণিক সম্প্রদায়ে, চীনাংশুকের বিরাট ব্যবসা আছে আমাদের। প্রিয়ব্রত আর শ্বেতকেতু রাজার পুত্র। অরণ্যও একজন সেনাধিপতির সন্তান। কিন্তু বোধিসত্ত্ব হতে গেলে অর্থের মোহ ছাড়তে হয়। সর্বত্যাগী হওয়ার পর আমরা দশ স্বর্ণমুদ্রা পাব কোথায়?
স্বর্ণবৃন্তা বলল—তাহলে আমাকে ক্ষমা করুন। মূল্য না নিয়ে আপনাদের পঙ্ক্তিতে ঢুকিয়ে দিলে বিশ্বসুদ্ধু যে সব রাজারাজড়া আর ধনকুবেররা আমার সান্নিধ্যলাভের জন্য ছমাস ধরে বসে আছেন তাঁদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা হবে। আপনারা যতদিন ইচ্ছে আমার প্রাসাদে অতিথি হয়ে বিশ্রাম করুন, কিন্তু আমাদের সম্পর্ক শুদ্ধ থাকবে। আপনারা আমাকে বৃন্তাদি বলে ডাকতে পারেন। নমস্কার।
তখনকার দিনে সুন্দরীরা হীলতোলা স্যান্ডেল পরত না। কিন্তু এইভাবে প্রথম সাক্ষাতেই আটজন তরুণ বোধিসত্ত্বের মুখের উপর নগরবধূর প্রত্যাখ্যানের জুতো আছড়ে পড়েছিল।
অপমানিত হলেও বোধিসত্ত্বরা কোথায় যাবে? হয়তো তাদের উপায় নেই। সেই দিনটা তারা নগরবধূর আমবাগানে ঘুরে ঘুরে কাটিয়ে দিল। স্বর্ণবৃন্তা তার সখিদের সঙ্গে সকালবেলাটা নাচের অনুশীলন করার পর সারা দিন বিশ্রাম করে। সন্ধ্যেবেলা থেকে তার নৃত্যের অনুষ্ঠান দেখতে আসে বৈশালীর গণ্যমান্য ও সম্ভ্রান্তরা। এদের মধ্যে স্ত্রী পুরুষ উভয়ই আছে। রাতের অন্ধকারে গা ঢেকে একজন কি দুজন অত্যন্ত ভাগ্যবান নাগরিক তার শয্যামন্দিরে উপগত হত। স্বর্ণবৃন্তা তাদের সঙ্গে সেখানে কী করে কেউ জানতে পারত না। লোকে বলে গভীর রাত্রে ভৃত্যেরা কয়েকটি অবেচেতন শরীর খাটিয়ায় ফেলে ভবনের বাইরের ঘরগুলোতে রেখে যায়। ভোর হওয়ার আগে তাদের ঘুম থেকে তুলে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার নাকি নিয়ম।
সেদিন রাতে বুদ্ধপূর্ণিমা। নগরবধূর শয্যামন্দিরে কেউ আসেনি। মধ্যরাত্রে একটি দাসী এসে স্বর্ণবৃন্তার কানে কানে জানাল—আটজন অতিথি চুপি চুপি ঘর থেকে বেরিয়ে নদীর দিকে গিয়েছে।
স্বর্ণবৃন্তা তড়াক করে উঠে বলল—চল আমরাও গিয়ে দেখি।
বিরাট একটা রূপোর থালার মতো বুদ্ধপূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে আকাশে। তার নিচে কুল কুল করে বয়ে চলেছে নারায়ণী নদী। আটজন বোধিসত্ত্ব আটটা শিলাখণ্ডের উপর বসে ধ্যান করছিল। স্বর্ণবৃন্তা তার দুজন সহচরীকে নিয়ে আমবাগানের গাছের আড়াল থেকে তাদের দেখতে পেল। আশে পাশের বন-জঙ্গল, প্রমোদ উদ্যান, ও উপবন থেকে সার বেঁধে হরেক রকমের জন্তু জানোয়ারের দল এসে জড়ো হচ্ছে বোধিসত্ত্বদের ঘিরে। হরিণ হরিণী এসেছে তাদের ছানাপোনা নিয়ে, খরগোশরা এসেছে হিমালয়ের বিরাট ঋক্ষরাজ ভালুকের পিঠে চেপে, এসেছে সজারু, চিতাবাঘ, শেয়াল, আর বন্য বরাহ। দলে দলে এখনো উড়ে আসছে পাখি। তারা শিলার উপরেই বোধিসত্ত্বদের গা ঘেঁষে বা কাঁধে অবতরণ করছে। অজগর সাপগুলো কাছাকাছি গাছের ডাল থেকে ঝুলে আছে। সবার পিছনে নীল পর্বতের মতো দেহ নিয়ে অরণ্যের হাতিরা একটু দূরে একজন আরেকজনের পিছনে লুকিয়ে দাঁড়িয়েছে যাতে অন্যরা কেউ ভয় না পায়। এই প্রাণীদের মধ্যে কেউ কেউ খাদক, বাকিরা খাদ্য। কিন্তু আজকে এদের মধ্যে হিংসার লেশমাত্র দেখা যাচ্ছে না।
একসঙ্গে চোখ খুলে বোধিসত্ত্বরা আকাশের দিকে ডান হাতের তর্জনি তুলেছিল। স্বর্ণবৃন্তা আর তার সহচরীরা সে দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখল চাঁদের রূপোর মতো রঙটা আস্তে আস্তে পালটে উজ্জ্বল সোনার মতো হয়ে গেছে। অরণ্যের পশুপাখিরা একটু ভয় পেয়ে বোধিসত্ত্বদের কাছে ঘেঁষে এল। স্বর্ণবৃন্তা দেখল নিঃশব্দে কিন্তু তরতর করে বোধিসত্ত্বদের আসনের নিচে শিলাগুলোর গায়ে সবুজ লতা আর ফুলের গাছ গজিয়ে যাচ্ছে, এবং একটা মৃদু আর সুখকর বাতাস এসে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে সমস্ত প্রাণীজগতকে। এরপর আর দেখতে চায়নি স্বর্ণবৃন্তা। সহচরীদের নিয়ে তাড়াতাড়ি তার ভবনে ফিরে এসেছিল।
পরের দিন প্রত্যুষে নদীতে অবগাহন করে উঠে স্বর্ণবৃন্তা বোধিসত্ত্বদের ডেকে বলল—তোমরা শিলার আড়ালে লুকিয়ে দেখছো কেন? এবার বেরিয়ে আসতে পারো। আমরা একসঙ্গেই ফিরব।
গুটি গুটি বেরোল তার আটজন পোষ্য। নগরবধূর সিক্ত বসন ভেদ করে সোনার কলসগুলো ভোরের রোদ্দুরে ধুয়ে যাচ্ছে। নাভির কাছে নদীর জল জমে একটা নীলার মতো আলো বিচ্ছুরিত করছিল। কোনো কুন্ঠা ছাড়া বৈশালীর লজ্জাহীন স্বপ্নের নায়িকা তার সঙ্গীদের সঙ্গে গল্প করতে করতে বাড়ির দিকে চলেছে। অরণ্য আর সলিল তার দুপাশে এসে বলল—আমরা কি তোমাকে একটু ছুঁয়ে দেখতে পারি বৃন্তা?
নগরবধূ ভ্রুভঙ্গি করে বলল—এখন নয়। হয়তো পরে। আচ্ছা শোনো, একটা সুসংবাদ আছে। তোমাদের জন্য দশটা করে স্বর্ণমুদ্রা যোগাড় করার উপায় হয়েছে।
আটজন বোধিসত্ত্ব উৎসুক হয়ে নগরবধূকে ঘিরে ফেলে বলল—কীভাবে যোগাড় হবে সেগুলো বৃন্তা?
নগরবধূ তাদের সবাইকে একবার ভালো করে দেখে নিয়ে বলল—তোমাদের তো ভালোই স্বাস্থ্য। আমার ভবনে বিনা ভাড়ায় না থেকে কিছু কাজ করো। সেই পারিশ্রমিক জমিয়ে তোমরা আমাকে দশটা করে স্বর্ণমুদ্রা দিতে পারবে।
কী কাজ?
তখন নগরবধূ তাদের সামনে একটা নাচের মুদ্রায় দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল—এই মুদ্রাটা তোমাদের ভালো লাগছে?
মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকে দেখতে দেখতে বোধিসত্ত্বরা বলল—ভীষণ।
স্বর্ণবৃন্তা বলল—আমার নাচের আসরে কিছু পুরুষ সঙ্গী যোগ করতে পারলে ভালো হয়। তোমরা আজ থেকে সকালবেলাটা আমার কাছে নাচ শিখতে শুরু করো। একশোটি নাচের মুদ্রা আয়ত্ত করার পারিশ্রমিক হবে একটি স্বর্ণমুদ্রা। এক সহস্র মুদ্রা শিখে নিতে পারলেই আমাকে পাবে।
বোধিসত্ত্বরা একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে ছিল। সলিল আগেভাগে বলে উঠল—আমি প্রস্তুত। তারপর আর বাকিদের তর সইল না। সবাই হাত তুলে বলল—আমরাও প্রস্তুত বৃন্তা। আজ থেকে আমরা তোমার কাছে নৃত্যের শিক্ষা নিতে চাই।
তো এইভাবে অবতারণা হয়েছিল বৈশালীর বিখ্যাত নট ও নটীদের একত্রে অভিনয়ের পালা। স্বর্ণবৃন্তা তার নাট্যানুষ্ঠানের নাম দিয়েছিল—আট গন্ধর্ব ও এক অভিসারিকা।
পম্পা আমার গায়ে একটা চিমটি কেটে বলল—এটা তুই আমাদের ট্রুপ থেকে ঝেড়েছিস। তার মানে সদ্য সদ্য বানানো।
আসলে তা নয়। আমি কাল থেকেই চোখ বুজলে দেখতে পাচ্ছিলাম নগরবধূর মুদ্রাগুলো অবিকল অনুকরণ করে আটজন বোধিসত্ত্ব তার পিছনে দাঁড়িয়ে নাচছে। তারা ন’টি পাখির বলাকার মতো নাট্যশালার একদিক থেকে অন্যদিকে একত্রে ছুটে যাচ্ছিল। তারপর একসঙ্গে ঝুঁকে নিজেদের পায়ের আঙুল স্পর্শ করে আবার ফিরে আসছিল।
পম্পাকে জিজ্ঞেস করলাম—খুব কি অশ্লীল মনে হচ্ছে?
— না, না। এখন পর্যন্ত সব ঠিক আছে। কোথায় তোর পারভার্শান?
— আসবে আসবে। ভয় নেই। তোমাকে আমি নিরাশ করব না।
পম্পা বলল—আচ্ছা, বোধিসত্ত্বদের এত ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তারা নগরবধূর কাছে এসেছে কেন সেটা কিন্তু এখনো ভালো করে বোঝা যায়নি। তারপর সে গলা আরো নামিয়ে, প্রায় আমারই শ্রুতির অগোচর একটা ধ্বনি বার করে বলল—শুধুই এক রাত্রের ইয়ে? মানে মিলনের জন্য?
আমি পম্পাকে বললাম—সে সব তো অন্য জায়গাতেও হতে পারত। আসলে তারা স্বর্ণবৃন্তার গোপন কথাটা জেনে গিয়েছিল। স্বর্ণবৃন্তার শয্যাগৃহে প্রবেশের অনুমতি যারা পেত, সব হয়ে-টয়ে যাওয়ার পর মিষ্টিমুখ হিসেবে তাদের একটা উপহার দিত নগরবধূ। নিজের বুকের উপর একটা পাতলা মসৃণ কাপড়ের আবরণ ফেলে তার ভিতর দিয়ে—বুঝলে তো—সে অতিথিদের স্বর্ণবৃন্তগুলো চুষতে আমন্ত্রণ করত। সেই রস পান করাই ছিল এই আটজন পুরুষ-বালকের আসল উদ্দেশ্য।
পম্পা এবার রাগ না করে খুব লজ্জিতভাবে আমার দিকে ঝুঁকে ফিস ফিস করে বলল—কিন্তু সেগুলো চুষেই বা কী লাভ বল? সত্যিকারের টফি তো নয়।
— তাহলে তোমাকে এবার গল্পের আসল ব্যাপারটা বলে দিতে হয়। বোধিসত্ত্বরা কী করে অল্পবয়সেই বুঝে যায় যে তারা বোধিসত্ত্ব সেটা জানো?
— না, সেটাও একটা ভালো কোয়েশ্চেন।
— জানতে। বইতে লেখা ছিল। তোমার মনে নেই। বোধিসত্ত্বরা সবাই জাতিস্মর। তাদের বহু বহু পূর্বজন্মের স্মৃতিসহ জন্ম হয়। সেই জন্মগুলোতেও তারা বোধিসত্ত্ব ছিল। তাদের কত জন্মের কত কীর্তি, সব ঘাড়ে নিয়ে তারা বাচ্চা বয়স থেকে ছোট ছোট পায়ে টিলটিল করে হাঁটে। তো সারা দেশ জুড়ে এরকম বেশ কিছু বোধিসত্ত্ব বাচ্চা একসঙ্গে বড়ো হচ্ছিল। কেউ মিথিলায়, কেউ মগধে, কেউ উজ্জয়িনীতে, কেউ বিদর্ভে। সবাই তো একরকম হয় না। বিগত জন্মের কীর্তির ভারে ঝুঁকতে ঝুঁকতে কোনো কোনো বোধিসত্ত্ব এক সময়ে বুঝে যায় যে এই জন্মে বুদ্ধ হওয়ার আর প্রবৃত্তি নেই তার। এই একটা জন্ম সে টপকে যেতে চায়।
— টপকে যেতে চায় মানে?
— মানে যেমন ছাত্ররা একটা বছর নষ্ট করে। ফাইনাল পরীক্ষাটা আর দেয় না। হাল ছেড়ে দিয়ে বলে—এ বছরটা হল না, পরের বছর দেখা যাবে। সেরকম আর কি।
— হোয়াট অন আর্থ্ ...?
— এই বোধিসত্ত্বদের চরিত্রগুলো সমতল নয়। এদের ভিতরে একটু দুঃখ আর দীর্ঘশ্বাস আছে। ফেল করা বোধিসত্ত্ব বলা যায়। মানসিকভাবে একটা অবসন্নতায় আক্রান্ত। সেইজন্য এরা একজোট হয়েছে। প্রত্যেকেই বুঝতে পেরেছে যে পূর্বজন্মের স্মৃতিগুলো ভুলতে না পারাই তাদের কষ্টের প্রধান কারণ। এবং সেই কষ্ট দূর করতে পারে একমাত্র বৈশালীর নগরবধূ।
— মানে তার বুকের টফি...?
— রাইট। দুঃখের বিষয় টফি শব্দটা প্রাক্-ব্রিটিশ আখ্যানে ব্যবহার করা যাবে না, কিন্তু কনসেপ্টটা বুঝতে গেলে এই শব্দটাই সবচেয়ে যুৎসই। বোধিসত্ত্বরা শুনেছিল সেই আমের সুগন্ধযুক্ত টফির রস পান করলে হলাহলের মতো প্রচণ্ড নেশায় মানুষ প্রথমে অচৈতন্য হয়ে পড়ে। স্বপ্নের মধ্যে তার সমস্ত অতীত আকাশের তারার মতো চোখের সামনে এসে আলো বিকীরণ করতে করতে গুঁড়িয়ে যায়। সেই আশ্চর্য ঘুম ভাঙে উল্লাসে, এবং মানুষটার মন থেকে লোভ আর মাৎসর্য্য অন্তত কিছুদিনের জন্য বিলুপ্ত হয়। সেই সঙ্গে আসে স্বর্ণবৃন্তার প্রতি পোষ মানা জন্তুর মতো আনুগত্য। এই শেষ ব্যাপারটার জন্যই নগরবধূ তার দেহের রস অকুন্ঠভাবে বিলিয়ে লিচ্ছবিদের সবাইকে নিজের হাতের মুঠোয় করে নিচ্ছিল।
— উইচ্ক্র্যাফ্ট! পম্পা মাথা নাড়িয়ে বলল।—তোর এই রাজনর্তকী তো আসলে একটা ডাইনি। তার কাজ হল পুরুষদের কনট্রোল করা। খুব ডেঞ্জারাস জিনিস!
— যে কথাটা বলা নিষিদ্ধ সেটা বলে ফেললে তো? গল্পের কিছু কিছু ইঙ্গিত ফাঁস করা যায় না। যে বুঝবে তাকে বুঝে নিতে দিতে হয়। এরকম একটা ক্ষমতাশালী মহিলাকে সমাজ এক সময় ভয় পেতে শুরু করে। শুধু পুরুষরা নয়, মেয়েরাও। তারপর তার কী হয়?
— আগুন। আগুনে দেওয়া হয় তাকে।
— বাকিটা তুমিই বলে দেবে, না আমাকে বলতে দেবে?
— আচ্ছা, আচ্ছা। আমি মুখে কুলুপ দিচ্ছি। তুই বল।
— শোনো, কাহিনীতে ফেরার আগে দুটো জিনিস তোমাকে জানিয়ে দিই। এক, রাজনর্তকী শুধু পুরুষদের নিয়ন্ত্রণ করে ক্ষান্ত হয়নি। নারী-পুরুষ, বুড়ো-বুড়ি, বালক-বালিকা, যে তার টফি চুষতে চাইত তাকেই সে আস্কারা দিত। এখানে তুমি তার পারভার্শানের ইঙ্গিত পাচ্ছো। কিন্তু ওদিকে ধনী ও ক্ষমতাশালী লোকেরা লক্ষ্য করেছিল যে নগরবণিতার কাছে বেশি যাতায়াত করলে রাজ্যশাসন করার জন্য যে ক্রূরতা দরকার বা একটা ব্যবসা চালাবার জন্য যে অর্থলোভ প্রয়োজন সেটা ভোঁতা হয়ে যায়। সুতরাং অনেকে তার কাছ থেকে দূরে থাকারও চেষ্টা করত। আর দুই, বোধিসত্ত্বরা শুনেছিল যে অতীতের তারাগুলো গুঁড়িয়ে গিয়ে মানুষটা যখন একটা নতুন জন্ম পায় তখন তার পূর্বজন্মের স্মৃতিও বিনষ্ট হয়। স্বর্ণবৃন্তাকে তারা খুঁজে বের করেছিল এই লোভে।
লাল-কেল্লার সামনে থেমেছে বাস। ফোর্টের উপর ভারতের পতাকা একটু একটু আন্দোলিত হচ্ছিল হাওয়ায়। কয়েকটা পায়রা উড়ছে তার উপর। এখানে শহরের দুটো সত্তা দেখতে পাওয়া যায়। একদিকে চাঁদনি চকের রাস্তায় ডজন ডজন হ্যাজাক জ্বালিয়ে এখনো কেনা-বেচা চলছে। অন্যদিকে লাল পাথরের নির্জন দূর্গটা শান্তভাবে অপেক্ষা করে বসে আছে। কবে এই ক্ষুদ্র মানুষদের কিচিরমিচির বন্ধ হয়ে আবার আরাবল্লীর মরুভূমি ফিরে আসবে। যতবার এখানে আসি, আমি মানুষগুলোকে না দেখে কেল্লার উপরের আকাশটাকে দেখি।
পম্পাও সেদিকে খানিকক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থেকে বলল—তারপর?
খোলা জানালার ফাঁক দিয়ে আমার বৌদ্ধযুগের রূপকথায় লালকেল্লার নির্জনতা আর ট্র্যাজেডি ঢুকে পড়ছে। আমি বললাম—বৈশাখ আর জ্যৈষ্ঠ মাসের শুকনো দিনগুলোতে আটজন বোধিসত্ত্ব সারাদিন ধরে নেচে চলেছিল। তাদের সাধনায় ত্রুটি নেই। সকালে যতটুকু শিখিয়ে গেছে স্বর্ণবৃন্তা ততটুকু নিখুঁতভাবে আয়ত্ত না করে তারা ছাড়ে না। এক এক করে বোধিত্ব থেকে মুক্তির দিন গুনছে এই কয়েকটা ছেলে। তারপর তাদের ভবিষ্যত কী? সেটা নিয়ে কেউ ভাবছে না।
সন্ধ্যেবেলা যখন নুপূর আর চন্দ্রহারের শব্দ উঠোনের এক দিক থেকে অন্য দিকে ছুটে বেড়ায় তখন তারা দূরের বাগানে বসে কখনো কখনো দেখতে পায় অন্ধকারের অবগুন্ঠনের নিচে কেউ ছুটে আমবনের ধারে চলে যাচ্ছে। সেখানে কে না আসে? হয়তো কোনো বৃদ্ধ সেখানে ওৎ পেতে আছে, যদি নগরবধূ তার পাশ দিয়ে যায় সে হাত বাড়িয়ে ধরে নেবে। স্বল্পভাষী বোধিদ্রুম কী একটা দেখে ফেলে পরের দিন অনুযোগ করেছিল—বৃন্তা তুমি স্ত্রী-পুরুষ, সুস্থ-রুগ্ন, বৃদ্ধ-বালক নির্বিচারে দরিদ্রদের সাথে ব্যভিচার করো, কিন্তু আমাদের দিনের পর দিন বসিয়ে রেখেছ কয়েকটা স্বর্ণমুদ্রার অছিলায়!
নগরবধূ তার দিকে তাকিয়ে তখন বলেছিল—ছিঃ! তুমি নাকি বোধিসত্ত্ব?
তারপর স্বর্ণবৃন্তা তিনদিন নাচ শেখাতে আসেনি। ফিরিয়ে আনার জন্য আটজন বোধিসত্ত্বকে হাঁটু গেড়ে বসে ক্ষমা চাইতে হয়।
এইভাব মহড়া দেওয়ার সুযোগে বোধিসত্ত্বরা নগরবধূর যত কাছে আসতে শুরু করল ততই তাদের হাঁটাচলায়, কাজে কর্মে, একটা দ্রুততা, একটা লয় দেখা যেতে লাগল। যেন নগরবধূর আত্মা তাদের শরীরে ভর করতে চাইছে। হয়তো এইভাবে একদিন তাদের স্বর্ণমুদ্রার আহরণ শেষ হত আর প্রতিশ্রুতিমতো স্বর্ণবৃন্তার সাহায্যে তারা পূর্বজন্মের কীর্তির ভার থেকে মুক্তিলাভ করত। হয়তো নগরবধূর ইচ্ছে ছিল তাদের কোনো ছুতোয় নিজের কাছে রেখে দেওয়া, যাতে বোধিত্ব হারাবার পরেও তারা অকিঞ্চনতা আর দারিদ্র্যের পাথরের নিচে পিষে না যায়।
কিন্তু তারা যেরকম ভেবেছিল, বা নগরবধূর যা পরিকল্পনা ছিল, তা হয়নি। ইতিহাসের চাকা যখনই ঘুরেছে, কোনো দেব-দেবী, যক্ষ-রক্ষ, তন্ত্র-মন্ত্র, নগরবধূ, বা বোধিসত্ত্ব তাকে ঠেকাতে পারেনি। ইতিহাসের অভিপ্রায় ছিল লিচ্ছবিরা মগধের কাছে সহজে মাথা নত করবে না, এবং মগধের রাজা তাদের বার বার আক্রমণ করবে। শেষবার যখন সেই আক্রমণ হয়েছিল তখন বৈশালী নগরের সাথে আম্রপালীর আমবাগানটিও পুড়ে ছাই হয়। তার পর এক যুগ অতিক্রান্ত হয়েছে। পোড়া ধ্বংসস্তূপের জায়গায় আবার একটা সমৃদ্ধ নগর গড়ে উঠেছিল। লোকে বলে আম্রপালীর বাগানের উপরেই স্বর্ণবৃন্তা তার প্রমোদ উদ্যান বানায়। এক যুগ পরে ইতিহাসের চাকা আবার যখন ঘুরতে শুরু করেছিল তখন লিচ্ছবিদের গৃহবিবাদের সুযোগ নিয়ে মগধের সৈন্য বৈশালীকেই প্রথম আক্রমণ করে।
বৈশাখ মাসে, বুদ্ধপূর্ণিমার আগের দিন, বোধিসত্ত্বরা প্রথম পা রেখেছিল নগরবধূর বাড়িতে। তার তিন মাসের মধ্যে লিচ্ছবিদের সঙ্গে মগধের ছোটখাটো সংঘর্ষ আরম্ভ হয়ে যায়। সেনাপতির পুত্র অরণ্য সংসার ত্যাগ করার পরেও এই বিষয়গুলো ভালো বুঝত। একটা বিরাট যুদ্ধ আসন্ন আশঙ্কা করে সে স্বর্ণবৃন্তাকে পরামর্শ দিয়েছিল সমস্ত অস্থাবর সম্পত্তি নিয়ে মগধে চলে যেতে।
— নিজের বিপন্ন নগরবাসীকে ফেলে দিয়ে শত্রুদের মধ্যে গিয়ে থাকতে বলছ অরণ্য? অরণ্যের মাথার চুলে হাত বুলিয়ে স্নেহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিল নগরবণিতা।
অরণ্য বলল—মগধের এক সেনাপতির ঘরে তো আমারও জন্ম। তার মানে কি আমি তোমার শত্রু?
— তুমি আর মগধের কেউ হও না। তোমরা সবাই এখন বৈশালীর রাজনর্তকীর শিষ্য।
আরো তিনমাসের মধ্যে অরণ্যের আশঙ্কা সত্যি বলে প্রমাণিত করে ভয়ঙ্কর একটা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। নগরের প্রতিটি সক্ষম পুরুষের ডাক পড়ল সেনাবাহিনীতে। বাড়িতে একটিও পুরুষ ভৃত্য আর অবিশিষ্ট রইল না। বোধিসত্ত্বরা প্রাণীহত্যা করতে পারে না বলে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। স্বর্ণবৃন্তা তাদের পই পই করে বলে দিল, কিছুতেই গৃহের বাইরে যেন তারা পা না দেয়।
একদিন বিকেলে রাজনর্তকী তার ভবনের অলিন্দে সূর্যাস্তের অপেক্ষায় বসে ছিল। নগরের দক্ষিণ সীমানায় লিচ্ছবিদের প্রতিরোধ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বৈশালীর নগরপাল দণ্ডপাণি নিজের বিশ্বস্ত অনুচরকে বিকেলেই পাঠিয়েছিলেন একটি নিদারুণ সংবাদ জানাতে। বৈশালীর সেনা নগর ত্যাগ করে আজ রাতের মধ্যে উত্তরদিকে মিথিলা আর লুম্বিনির অভিমুখে অপসরণ করবে। নগরবধূকে তারা জানিয়েছিল সত্বর জীবনধারণের জন্য আবশ্যক যা কিছু উপকরণ সঙ্গে নিয়ে সবার সঙ্গে উত্তরদিকে যাত্রা করতে।
স্বর্ণবৃন্তা ভাবছিল এই হবে ভবনের অলিন্দ থেকে দেখা তার শেষ সূর্যাস্ত। এই দৃশ্যের স্মৃতিগুলো ছাড়া সে সঙ্গে আর কী নিয়ে যেতে পারবে? তার অলঙ্কারাদির পরিমাণ বিপুল। গত কয়েকদিনে বেশির ভাগ দাস দাসীদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছে। প্রথমে খুব কষ্ট হলেও এখন তার মনে হচ্ছে যেটুকু অবশিষ্ট আছে তাও নেওয়া নিষ্প্রয়োজন। সে একটি গো-শকট আনতে নির্দেশ দিয়েছিল। এমন সময় একজন সহচরী ছুটতে ছুটতে এসে বলল—সর্বনাশ হয়েছে! বোধিসত্ত্বরা গো-শকটের সন্ধানে বেরিয়েছিলেন। লিচ্ছবিদের এক সামন্ত রাজার অনুচররা তাদের মগধের গুপ্তচর ভেবে বন্দি করে রেখেছে।
স্বর্ণবৃন্তার মস্তক ঘুর্ণিত হল সংবাদটা পেয়ে। উঠতে গিয়ে আবার বসে পড়ে সে বলল—আটজনকেই ধরে নিয়েছে?
— একমাত্র সলিল ভবন ত্যাগ করেননি। কিন্তু সংবাদটি আরো গুরুতর। জানতে পেরেছি যে সামন্ত রাজার অনুচররা নিজেরাই প্রাণভয়ে কাল নগর ত্যাগ করবে ঠিক করেছিল। বোধিসত্ত্বদের বেশিক্ষণ ধরে রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। খুব সম্ভবত প্রভাতের আগেই সাতজনের মুণ্ডচ্ছেদ করা হবে।
স্বর্ণবৃন্তা উঠবার চেষ্টা করে দেখল সে উঠতে পারছে না। ইতিহাসের চাকা কোনদিকে চলেছে সেটা তার মতো একজন সামান্য বণিতার অনুধাবনের অতীত। কোত্থেকে এল এই যুদ্ধ? কে ইন্ধন যোগাল মগধের ঈর্ষায়? কিছুই ভালো করে জানা যায়নি আজও। শুধু এইটুকু জেনেছে নগরবধূ, যে মাত্র কয়েক দিনের যুদ্ধের পর তার নিজের হাতে সাজানো বাড়ি জনশূন্য হতে চলেছে। প্রিয় নগরটিতেও সে আর ফিরতে পারবে কিনা সন্দেহ।
— আমাদের বেরোবার কোনো ব্যবস্থা আছে? স্বর্ণবৃন্তা সহচরীকে জিজ্ঞেস করল।
— একটা ভাঙা ঘোড়ার গাড়ি ছিল। সেটাকে বোধিসত্ত্বরা কিছুটা সারিয়ে গিয়েছিলেন। বুড়ো গাধাটা থাকত আমবাগানে, সেটাকে কেউ নিয়ে যায়নি। সলিল তাকে গাড়ির সঙ্গে যুতে রেখেছেন আপনাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
— তাঁকে বল গাড়ি তৈরী করে রাখতে। আমি আসছি। আর তোরা বাকিরা সবাই এই মুহূর্তেই নগর ত্যাগ করে বেরিয়ে যা।
— আমরা আপনার সঙ্গে থাকব নগরবধূ।
— না, না! আমার জন্য কেউ অপেক্ষা করবে না। এক্ষুণি যেতে হবে তোদের।
অর্ধদণ্ড পরে সলিল যখন স্বর্ণবৃন্তাকে তার গাড়িতে বসাচ্ছিল তখন সে অবাক হয়ে দেখল, সাদা উত্তরীয় দিয়ে সর্বাঙ্গ মুড়ে বসলেও তার নিচে এমন সাজ ও পরিচ্ছদ নগরবধূর যেন সে বৈশালী ছেড়ে পালাচ্ছে না, কোথাও নৃত্যের অনুষ্ঠান করতে চলেছে।
বাস আড্ডায় থামার আগেই পুরোনো লেল্যান্ড কম্পানির ডি-টি-সি বাসটা গোঁ গোঁ শব্দ করছিল। কুদ্সিয়া গার্ডেন পার করার পর সিভিল লাইন্সের চড়াইয়ের মুখে ইঞ্জিনটা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। খানিকক্ষণ আমরা সবাই হাঁদার মতো বসেছিলাম। ড্রাইভার আলো নিভিয়ে দিয়ে বলল—বসে আছিস কেন বোকা? উতর যা। ইয়ে বস্ তো বেকার হো গই।
পম্পা আর আমি নেমে লুডলো ক্যাসেলের বাস স্টপ অবধি হাঁটছি। জায়গাটা অন্ধকার। ডানদিকে কুদ্সিয়া গার্ডেনের উঁচু তাল গাছগুলোর মাথা দেখা যাচ্ছে। বাঁদিকে লুডলো ক্যাসেলের জিমনেসিয়াম, যেখানে আমি আর প্রবুদ্ধ স্কুল চলাকালীন প্রায়ই টেবিল টেনিস খেলতে আসি। আমাদের সঙ্গে বাস থেকে যে কজন নেমেছিল, তাদের কেউ কেউ পিছনে কাশ্মীরী গেটের দিকে ফিরে গেছে। দু-একজন লুডলো ক্যাসেল পেরিয়ে আরো এগিয়ে গেল। বাস স্টপে শুধু রয়ে গেলাম আমি আর পম্পা। শহরের মাঝখানে হলেও, এই এলাকাটা এমন নির্জন যে নাচনেওয়ালীটি সঙ্গে থাকার জন্য আমার বেশ একটু ভয় ভয় করছিল।
পম্পার অবশ্য কোনো ভয়বোধ নেই। রাতের নির্জন দিল্লী যে তার চিড়িয়াখানা থেকে বিপজ্জনক পশুগুলোকে শিকার খোঁজার জন্য রাস্তায় ছেড়ে দেয় সে খেয়াল পার্কটাউনের মেয়েদের অতটা থাকে না। আমার যেটুকু আছে তা থেকে আমি জানতাম এখানে যত কম সময় কাটানো যায় ততই আমাদের পক্ষে মঙ্গল। এতটা দেরি একদম করা উচিত হয়নি।
ফুর ফুর করে হাওয়া দিচ্ছে। পম্পা একটা হাই তুলে বলল—আঃ কী ভালো লাগছে, তাই না? মনে হচ্ছে আমরা দুজন কোনো ঐতিহাসিক গল্পের মধ্যে দিয়ে মিথিলার দিকে চলেছি।
সত্যিই কী ভালো! বাঘ নেই, ভালুক নেই, সাপ নেই, ডাকাত নেই, অপঘাত বলে কোনো বস্তু নেই এই ইতিহাসে। রূপকথার মতো ভাবনাহীন জীবন। আমিই কানে ঢালছি তার।
বছর পাঁচেক আগে বিল্লা-রঙ্গার কেস হওয়ার পর হঠাৎ মধ্যবিত্ত পরিবারদের টনক নড়ে উঠেছিল। আমাদের বয়সী দুজন ছেলেমেয়েকে গুণ্ডারা নৃশংসভাবে খুন করেছিল সেদিন। সিভিল লাইন আর উত্তর দিল্লীর এই অঞ্চলগুলোতে যে সব গরীব পরিবাররা থাকে তারা বহুদিন থেকেই জানে এই শহরের ভিতর একটা জঙ্গল লুকিয়ে আছে। এখানে রাতের অন্ধকারে যে রক্তের ফোঁটাগুলো ঝরে সকালের খবরের কাগজে তার দাগ থাকে না।
— আমরা কি একটা স্কুটার পেলে নিয়ে নেব? পম্পাকে মিন মিন করে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
— না, না। তার দরকার হবে না। বাসই পেয়ে যাব শীগ্গীর।
— তোমার বাড়িতে চিন্তা করে যদি?
পম্পা আমার দিকে চেয়ে দারুণ খুশির একটা হাসি দিয়ে বলল—বয়ম্যান, সেইজন্যই তো তোকে নিয়ে বেরিয়েছি। তুই সঙ্গে থাকলে মা একদম চিন্তা করে না।
ভয়ানক দমে গেলাম কথাটা শুনে। পম্পার মা আমার উপর যতটা ভরসা করেন আমি নিজে তার সিকি ভাগও করি কিনা সন্দেহ। দরকারে বড়জোর একটাকে সামলাতে পারি। কিন্তু দুজন এলে? চারজন? তার উপরে ইনি চণ্ডীগড়ে গিয়ে থাকতে চান।
— চলো না আমরা হেঁটে এক্সচেঞ্জ স্টোর্স্ অবধি চলে যাই। ওদিকটায় বেশ আলো আছে। লোকজনও বেশি।
— ধুৎ। লোকজন দিয়ে কী হবে? এই নিরালায় আমরা একা থাকলেই তো ভালো, জানেমন। তুই চালিয়ে যা না! কী হল সলিল আর স্বর্ণবৃন্তার? বোধিসত্ত্বদের কি বাঁচানো গেল?
মরুক বোধিসত্ত্বরা! বাস আডডার দিকে থেকে একটা বাস ঘুরেছে গড় গড় করে। থামবে তো? রাত্রিবেলা লোক না নামলে ডি-টি-সির বাস কি আর থামে? বাসটা যদি না থামে তাহলে এক এক করে বোধিসত্ত্বদের শিরশ্ছেদ করাব আমি।
মুদ্রিকা। রিং রোড ধরে গোল হয়ে দিল্লীর চারপাশে ঘুরপাক খায়। কদাচিৎ দয়া করে দু একজন ভাগ্যবানকে তুলে নেয়। আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন আজ। একটা লোক নামছে।—চলো, চলো উঠে পড়ি। পম্পাকে ঠেলেঠুলে বাসের দরজা অবধি নিয়ে গেলাম।
— না রে! এটা তো কিংস্ওয়ে ক্যাম্প্ টাচ্ করে সোজা বেরিয়ে যাবে। আবার বাস পালটাতে হবে আমাদের।
— ক্যাম্প্ থেকে ভটভটি নিয়ে নেব। ফাঁকা আছে দেখছো না? বেশ ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে গল্প করব।
পম্পাকে সামনে রেখে নিজেই হ্যান্ডেল ধরে উঠে পড়লাম। ফলে সেও উঠতে বাধ্য হল।
মুদ্রিকাটা এত তাড়াতাড়ি পেয়ে গেলাম বলে বোধিসত্ত্বদের বাঁচার একটা সুযোগ দেওয়া গেল। পম্পাকে জানালার ধারে সেট করে দিয়েছি। হাওয়ায় তার কয়েকটা পাতলা শ্যাম্পুর গন্ধ মাখা গাঢ় বাদামী রঙের চুল এসে আমার মুখের ভিতর ঢুকে যাওয়ার চেষ্টা করছে। খুব ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তার মত না নিয়ে সেগুলোকে মুখে নিতে পারলাম না। পম্পার মতো বৈশালীর নগরবধূর চুলও খুলে দিয়ে আমি গল্পটা বলতে শুরু করলাম।
— বৈশালী খাঁ খাঁ করছে। নদীর ধারে একটা নির্জন স্থানে এই পাথরের নির্মিত কারাগার। তার কয়েকটা মাত্র অলিন্দে লোহার শলাকা বসানো। বন্দিদের মধ্যে যাদের মৃত্যুদণ্ড হয় তাদের দেহ এই নদীতেই যায়।
গাধার গাড়িটাকে দেখে কারাগারের ভিতর থেকে একজন প্রহরী শূল হাতে বেরিয়ে এসে সলিলকে বলল—কী রে! কী চাই তোর এখানে?
সলিল কী বলবে ভেবে না পেয়ে তোতলাচ্ছে। এমন সময় শকট থেকে নেমে এল বৈশালীর নগরবধূ। সাদা উত্তরীয়ের ফাঁক দিয়ে তার অলঙ্কারগুলো একটু একটু দেখা যাচ্ছে। সদ্য অগুরুর ধোঁয়ায় সুরভিত চুলগুলো উড়ছে বাতাসে। শূলধারীকে সে বলল—শোনো প্রহরী, নগরপাল দণ্ডপাণি আমাকে এই লিপিটি আজকেই দিয়ে গেছেন, যাতে বেরোবার পথে আমার কোনো বাধা না আসে। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সঙ্গে একবার দেখা করে যেতে বলা হয়েছে আমাকে। তাদের কাছ থেকে কিছু সংবাদ আদায় করার আছে।
— আর্যা, এরা ভিক্ষু নয়, শত্রুর চর। মৃত্যু আসন্ন জেনে বোকা সাজছে।
— সে যাই হোক। নগরপালের ইচ্ছে অনুসারে তোমরা আমাকে তাদের কাছে নিয়ে চলো। কোনো ভয় নেই। আমি একাই যাব।
সলিল দেখল একবার তার দিকে অভয়ের মুদ্রায় হাত তুলে দেওয়ার পর কৃতান্তের মতো প্রহরীর সঙ্গে সাদা জুঁই ফুলের চেয়ে সুকুমার নগরবধূ একাকী কারাগারের পাথর আর লোহা দিয়ে তৈরী অভ্যন্তরে প্রবেশ করে যাচ্ছে।
একটা অন্ধকার লোহার খাঁচার মেঝেতে বসে সাতজন বোধিসত্ত্ব ধ্যান করছিল। কেউই তারা বিশেষ দুঃখবোধ করছে না। বরং আর কিছুক্ষণের মধ্যে মুক্তি, এই বিশ্বাসের বলে তাদের মুখে প্রশান্তির ছাপ এসে পড়েছিল। হঠাৎ খস খস শব্দ শুনে তাদের চোখ খুলল। খাঁচার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে একটা সাদা কাপড় জড়ানো মূর্তি। আস্তে আস্তে মূর্তিটা তার সাদা কাপড়ের আচ্ছাদন সরিয়ে উপস্থিত দুজন প্রহরীর মধ্যে একজনকে ধরতে বলল। স্তম্ভিত বোধিসত্ত্বরা দেখল তাদের সামনে স্বর্গবণিতা উর্বশীর বেশে নগরবধূ।
স্বর্ণবৃন্তার পরনে শুধু সেইটুকু আবরণ যা পুরুষদের উন্মাদ করে দেওয়ার পক্ষে অচুক। কঞ্চুলিটি এত শীর্ণকায় যে তার সোনার কলসদুটির তিন চতুর্থাংশ চকচকে কন্দুকের মতো শাসন ও যবনিকার বাইরে। তার সিংহিনীর মতো ক্ষীণ কটি সম্পূর্ণ উন্মুক্ত, নাভিতে হর্ষ্যক্ষের চক্ষুর সঙ্গে উপমেয় একটি সোনালী-হলুদ বৈদূর্য। তার বিস্তৃত শ্রোণির উপর তিনটি স্তরে কুয়াশার চেয়ে অর্ধস্বচ্ছ ও লঘুভার বস্ত্রের আবরণ। একটির উপর আরেকটি শুয়ে স্তরগুলি প্রায় স্বচ্ছ হয়েও নগরবধূর লজ্জা নিবারণের আপ্রাণ চেষ্টা করছে। স্বর্ণবৃন্তার মেখলার অন্তে পীত হস্তীর শুণ্ডের মতো দুই উরুর মাঝখানে নীলাভ রহস্যরোমের ক্ষীণতম আভাস। সর্বনাশা যুদ্ধের দিনে গ্রীবায় একটিমাত্র মুক্তোর হার পরে এই দুর্জ্ঞেয় রমণীটি তার বক্ষস্থলে মরু টিলার উপরের জ্যোৎস্নার মতো প্রহেলিকাময় একটা আলো এনে ফেলেছিল। লোহার পিঞ্জরের সামনে এসে শিউরে উঠে সেই হরিণী বলল—এই ছেলেগুলো বিদেশের গুপ্তচর?
প্রহরীরা কথা বলবে কী? নগরবধূর এই সজ্জা দেখে তাদের চিন্তাশক্তি পঙ্গু হয়ে গেছে। তোতলাতে তোতলাতে একজন বলল—হ্যাঁ, সুন্দরী। এদের ধরে আমরা নগরকে বিপদমুক্ত করেছি।
— উফ্। কী ভয়ঙ্কর কাণ্ড! গুপ্তচররা আমার নাচের দলে ঢুকে পড়েছিল। বলতে বলতে দুলে উঠেছে নগরবধূর বুক।—ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। তোমরা আমার কাছে কাছে থেকো প্রহরী।
প্রহরী দুজন নগরবধূর যতটা কাছে আসা সম্ভব এসে সেই কাঁচা আমের গন্ধ পেল যা মানুষের পূর্বজন্মের স্মৃতিও ভুলিয়ে দেয়। স্বর্ণবৃন্তা বলল—কী সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার! এরা চোখ দিয়ে সারাদিন আমায় গিলত। বিশেষ করে ওই সিংহের কেশরের মতো চুল যার, সেই ছেলেটা। আরেকটু হলে বিদেশীদের হাতে পড়ছিল আমার এই দেহ যার উপর শুধু বৈশালীর নাগরিকদের অধিকার।
— সাধু, সাধু। সত্যি বলেছ সুন্দরী।
দু-হাত দিয়ে দুই প্রহরীর পিঠ আকর্ষণ করে নগরবধূ তাদের নিজের বুকের কাছে নিয়ে এসে একবার এদিক আর একবার ওদিকে দৃষ্টিপাত করে বলল—কী দেখছ বলো তো তোমরা?
কোঁত করে ঢোঁক গিলে একটি প্রহরী বলল—কিছু মনে কোরো না, কিন্তু তোমার এই কন্দুকের মতো এগুলো কি...?
কথাটা আর শেষ হল না। স্বর্ণবৃন্তা কপট ক্রোধে তার মুখে একটা হাত রেখে দিয়েছে। দুই প্রহরীর মোটা মোটা আঙুল সে তার কঞ্চুলিকার বন্ধনী পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে বাকিটা তাদের বুদ্ধির উপর ছেড়ে দিল। এর কয়েক পলের মধ্যে কঞ্চুলিটি খসেছিল মেঝেয়। প্রহরীদের সঙ্গে বোধিসত্ত্বরাও আবিষ্কার করল স্বর্ণবৃন্তার সোনার কলসের সুপুষ্ট চূড়া থেকে ফলের রসের মতো আঠা বেরোয়। দু হাতে সেই রসটা বুকের উপর ছড়িয়ে দিয়ে সে যখন বলেছিল—দাঁড়াও, একটা কাপড় পেতে দিই, তখন অরণ্যও তার চোখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়।
— এদের দেখার সাহস নেই, বলে নগরবধূ তার শ্রোণির আচ্ছাদন থেকে একটি স্বচ্ছ স্তর খুলে নিয়ে নিজের উর্ধাঙ্গে জড়িয়ে নিল তারপর।
অতঃ কিম? নগরবধূকে কারাগারের পাথরের প্রাচীরের সঙ্গে চেপে ধরে যতক্ষণ না দুই প্রহরী সেই চীনাংশুকের চেয়ে স্বচ্ছ আবরণের মধ্যে দিয়ে তার বুকের আম্রমধুর রস চুষতে চুষতে গভীর ঘুমে ঢলে পড়েছিল ততক্ষণ পর্যন্ত বোধিসত্ত্বরা বুঝতে পারেনি তাদের সঙ্গে এ কী ধরণের পরিহাস করছে স্বর্ণবৃন্তা। প্রহরীদের ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে নগরবধূ খাঁচা থেকে বোধিসত্ত্বদের মুক্ত করে বলেছিল—তোমাদের কটা করে স্বর্ণমুদ্রা পাওনা হয় সেই হিসেব রাখো কেউ?
চন্দ্রহাস মাথা নিচু করে জানায়—ছটা করে পাওনা, দেবী।
তখন নগরবধূ বলল—কিন্তু আজ সে ছটা দেওয়ারও ক্ষমতা নেই আমার। সমস্ত স্বর্ণ বিলিয়ে দিয়ে আমি এখন রাজনর্তকীর বদলে পথের ভিক্ষুণী। তোমাদের কাছে যা ঋণ করেছি সেটা আমার কাছে যা আছে তাই দিয়েই পরিশোধ হবে আজ।
বোধিসত্ত্বরা একযোগে বলল—আজই?
— এখনই। আর সময় নেই হাতে। সবাইকে মুক্তি দিয়ে তবে আমার ছুটি। অরণ্য আর শ্বেতকেতু, তোমাদের দুজনকে বাড়িতে পৌঁছোনো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। অন্যরা এখানেই আমার কাছে এসো।
তারপর একসঙ্গে পাঁচজন বোধিসত্ত্ব নগরবধূকে কোলে তুলে নিয়ে চুষতে শুরু করল। বহু জন্মের ব্যর্থ পিপাসার আক্ষেপে নগরবধূকে পাঁচটি তরুণ এমন তীব্রতায় শুষতে আরম্ভ করেছিল যে স্বর্ণবৃন্তার বৃন্তদুটি থেকে ফোয়ারার মতো বেরিয়ে আসতে লাগল আমের রস। এইভাবে স্বর্ণবৃন্তার দেহনির্যাস পান করে অচিরেই একে একে পাঁচজন বোধিসত্ত্ব ভূমিতে পড়ে গেল। নগরবধূ তখন আবার নিজেকে সাদা কাপড় দিয়ে আপাদমস্তক ঢেকে অরণ্য আর শ্বেতকেতুকে বলল—এবার এদের শকটে নিয়ে গিয়ে তুলবে তোমরা দুজন।
এর কিছুক্ষণ পরে গাধায় টানা গাড়িটা তার ন-জন যাত্রীকে নিয়ে আবার চলতে শুরু করেছিল বৈশালীর পথে।
বাস মল রোড ছাড়িয়ে এসেছে। এবার আমাদের নামতে হবে। পম্পা বলল—এই জায়গাটা বেশ একটু অশ্লীল হয়ে যাচ্ছে, জয়। সবাই তোকে ভালো ছেলে ভাবে। তোর কি এত ডিটেলে সব বলে দেওয়া উচিত?
বললাম—তুমি চাও তো বাদ দিয়ে দিই। ফেল করা বোধিসত্ত্বদের কাহিনী আর কে শুনছে?
— হুম্ম্। পরে ভাবব। আচ্ছা, তোর কি এই সব বোধিসত্ত্বদের মতো কোনো মানসিক অবসাদ আছে? ডিপ্রেশান?
— আমার বন্ধুদের মধ্যে প্রায় সবার আছে। মুখে বলে না কেউ। যে কয়েকজনের নেই সেই আইটেমগুলো আমাদের চেয়েও বোকা।
— তোর টোটোদার আছে?
— আছে।
— কেন?
— কে জানে। আমাদের জীবনে না আছে কোনো মহৎ উদ্দেশ্য, না আছে কোনো বড়ো সমস্যা। সরকারী কলোনীতে সকলেই জানে তারা চাকরি না পেলেও বাবার পেনশনে চলবে কিছুদিন। আবার এটাও সবাই জানি যে এইভাবে চিরকাল জীবনটা চলে না। শীগ্গীরই শিমলিপুর ছেড়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে যাব আমরা। কিন্তু কোথায় যাব? কাদের সঙ্গে মিশব? তারা কী চোখে আমাদের দেখবে? আমরা বড়লোকও নই, গরীবও নই। না শিক্ষিত, না অশিক্ষিত। ইংরেজি পড়ি, কিন্তু বুঝি না। কে আমাদের দলে নেবে?
— নাই বা নিল? দেশে তো অনেকরকম মানুষ থাকে। সবাইকেই এক দলে হতে হবে?
— সে সব কথা ঠিক। কিন্তু দেখো আমাদের আগের জেনারেশনটা এত কিছু করল, আর আমাদের কিছু করার নেই। দুফির বা আমার বাবা-জ্যাঠারা একবস্ত্রে এক দেশ থেকে অন্য দেশে এসে নিজেদের দাঁড় করিয়ে দিল। তিরিশ-চল্লিশ বছর লেগে গেছে আস্তানার সন্ধানে। তার আগে আমার দাদু, ঠাকুর্দা এরা সব স্বাধীনতার জন্য কিছু না কিছু রিস্ক নিয়েছে জীবনে।
— তবে যে শুনি তোর মা আর মামা চান ব্রিটিশরা ফিরে আসুক?
— সে আমার মেজোমামা কংগ্রেসীদের উপর চটা বলে। এদিকে বড়োমামা ব্রিটিশ জেলে মারও খেয়েছে। এরা যতই ক্ষ্যাপা হোক, এক সময়ে এদের জীবনে একটা নিশানা ছিল। আমাদের সেটা নেই। পাঞ্জাবী সুফী বুল্লে শাহের লেখায় আছে—আমি না হিন্দী, না তুর্কী, না পেশোয়ারী। না আগুন, না পানি। না নদীর, না ডাঙার। আমরা সেরকম। টোটোদার এতদিনের গার্লফ্রেন্ড যখন তাকে ছেড়ে দিয়ে একটা ফালতু ছেলের সঙ্গে কেটে যাচ্ছিল তখন টোটোদা বলেছিল, পরভীন ঠিকই করেছে। আমার কোনো পার্সোনালিটি নেই। আই অ্যাম এ নোবডি।
নাচনেওয়ালী সঙ্গিনীটি সাহস দিয়ে বলল—আমি তো তোর সঙ্গে আছি। আমাকে পেয়ে তোর এই ডিপ্রেশান কাটে না?
তাকে উসকে দেওয়ার জন্য বললাম—রোজ বিকেলে ম্যাঙ্গো জুস মেখে আমার গেঞ্জি পরে যদি আসো তাহলে বোধহয় কেটে যায়।
কিংস্ওয়ে ক্যাম্প থেকে পম্পা ঠিক করেছিল হাঁটবে। এক মাইল রাস্তাটা খুব আলোকিত নয়। তবু এদিক-ওদিক দোকান বাজার আছে কিছু। এখন বন্ধ হলেও পথে একটা মন্দির আর সরকারী হাসপাতাল পড়ে। সারাক্ষণ ভটভটিয়া আর স্কুটার চলেছে। যমুনার শ্বাপদসঙ্কুল এলাকা থেকে দূরে না হলেও মোটামুটি জনবহুল।
সেই রাস্তার ধূলোর উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি পম্পাকে বাকিটা বলেছিলাম।—গাধায় টানা গাড়িটা যখন নগরবধূর প্রমোদ উদ্যানে এসে পৌঁছোল তখন সুর্যাস্ত হচ্ছে। বৈশালীতে শুধু পাখির কূজন। মানুষের সাড়াশব্দ নেই। সেই নীরবতার মধ্যে লুকিয়ে আছে একটা অপার্থিব অনিশ্চয়ের উপস্থিতি। বৈশালীকে এরকম নির্জন ও শান্ত রূপে কোনোদিন দেখেনি স্বর্ণবৃন্তা।
এক এক করে ঘুমন্ত বোধিসত্ত্বদের পৌঁছে দেওয়া হল তাদের শয্যায়। তারপর নিজের শয়নগৃহে প্রবেশ করে নগরবধূ শ্বেতকেতু, অরণ্য, আর সলিলকে ডেকে বলল—আমি এখানে অনেকটা আঙুরের রস রেখে গিয়েছিলাম। এসো তোমরা আমার সঙ্গে সেটা পান করবে।
তারা চারজন মিলে অস্তসূর্য দেখতে দেখতে যখন সেটা পান করছিল তখন সলিল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। নগরবধূ বলল—কাঁদছিস কেন বোকা? তুই না বোধিসত্ত্ব? এরকম যুদ্ধ তো লাগেই।
— আমি নিজের জন্য কাঁদছি না। বলল সলিল।—তোমার কী হবে সেটা ভাবতে গেলে আমার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
— বোধিসত্ত্বরা সমস্ত পৃথিবীর জন্য কাঁদে। সেটা তো স্বাভাবিক। একজন নগরবণিতার জন্য কান্না তাদের শোভা পায় না।
তখন সলিল হেঁচকি তুলতে তুলতে বলল—আমার বোধিত্ব কিছুদিন আগেই কেটে গেছে। কোনো পূর্বজন্মের স্মৃতিও আর আমার মনে নেই।
সলিলের কথা শুনে অরণ্য আর শ্বেতকেতুও অবাক। এটা কীভাবে হয়? পূর্বজন্মের স্মৃতি তো বছরের পর বছর ধরে তাদের তাড়া করে বেড়িয়েছে। সেটা কি মানুষ এমনি এমনি ভোলে?
নগরবধূ বলল—কিন্তু তোকে তো আমি আমার শরীর ছুঁতে দিইনি এখনো! তুই কি লুকিয়ে আমায় ছুঁয়েছিলি?
সলিল বলল—আমি যখন তোমার কাছে থাকতাম তখন লুকিয়ে তোমাকে দেখতাম, আর মনে মনে ভাবতাম আমার আত্মাটা তোমার শরীরের ভিতরে ঢুকে লুকিয়ে পড়েছে। সেটা করতে করতে সমস্ত জ্ঞান আর বোধি আমাকে ছেড়ে যায়। গত এক মাস ধরে খুব ভালো ঘুমোচ্ছিলাম। কোনো পূর্বজন্মের স্মৃতি এখন স্বপ্নের মধ্যে জ্বালাতে আসে না। এমনকী জন্তু জানোয়ারদের জন্য আমার মনে যে সারাক্ষণ একটা দুঃখ হত সেটাও আর হয় না।
— ওয়াট দ্য হেক্? পম্পা মুখ খারাপ করার চৌকাঠ মাড়িয়ে ফিরে এল।—আমাকে কত রকম ভাবে গল্পের ভিতর চটকাবি বলতো? এই সলিল হতচ্ছাড়াটা নগরবধূর শরীরে ঢোকার কথা বলছে এখন। এ সব তো তুই আমাকে আগেও বলেছিস!
আমি বললাম—যে যুগেই যাও না কেন, গল্পের মধ্যে তো আমাদেরকেই পাবে। বৈশালীর মধ্যে দিল্লী, দিল্লীর মধ্যে তুমি, তোমার মধ্যে আমি, আমার মধ্যে শিমলিপুরের বন্ধুরা, তাদের মধ্যে ডিপ্রেশান, আর ডিপ্রেশানের মধ্যে আমাদের উপর দিয়ে গড়িয়ে যাওয়া ইতিহাসের চাকা।
সাবধানে একটা খাড্ডা পেরিয়ে গিয়ে পম্পা বলল—কোনদিন শুনব তোর নায়িকার অ্যাপেন্ডিসাইটিস হয়ে সে মরতে বসেছে। যেমনটা আমার হয়েছিল। তারপর তার কী হল? টাইফয়েড?
তার পর আর কী? নিজের শয্যায় শুয়ে পড়ে বৈশালীর নগরবধূ তার উত্তমাঙ্গ ঢেকে দিয়েছিল সেই স্বচ্ছ পরিচ্ছদের আরেকটা স্তর খুলে নিয়ে। অরণ্য আর শ্বেতকেতু তখন একসঙ্গে নগরবণিতার কাছে উপগত হয়। কিশোর সলিল নগরবধূর পেটের কাছে লেগে থাকা একটুখানি আঠা চাটার মুহূর্তের মধ্যে বাচ্চাদের মতো সেই শয্যার পাশে মাটিতে ঘুমিয়ে পড়ে।
সেদিন গভীর রাতে ভূমিশয্যা থেকে উঠে নগরবধূ দেখেছিল দক্ষিণের আকাশে ধূ ধূ করে জ্বলছে আগুনের শিখা। একশো বছর পরে বৈশালী আবার পুড়ছিল। সবাই নগর ত্যাগ করতে পারেনি। মানুষ ও প্রাণীদের আর্তচিৎকার ভেসে আসছিল কানে। অন্য ঘরগুলো থেকে পাঁচজন বোধিসত্ত্ব উঠে নগরবধূর কাছে চলে এল। তাদের মুখ থেকে বোধির জ্যোতি নিভে গিয়ে তখন ফুটে উঠেছে সাধারণ তরুণদের মতো ভয় আর কৌতুক। গতাসূয় তার গম্ভীর হাবভাব পরিত্যাগ করে সলিলের প্যাংলা আর নির্লোম শরীর নিয়ে ফোড়ন কাটতে শুরু করেছে।
বোধিহীন বোধিসত্ত্বরা নগরবধূকে জিজ্ঞেস করল—এবার কী করব আমরা? আগুন তো একটু পরে এই বাড়িতেও এসে পড়বে।
— আসুক। তোমরা আরেকটু ঘুমিয়ে নাও। সকাল হলে খাটাব খুব।
ভোররাতে যখন স্বর্ণবৃন্তার ভবনে আগুন এসে প্রবেশ করল তার আগেই বাগানের পাখিরা তাদের বাচ্চাদের ঘুম থেকে তুলে পালিয়ে গিয়েছিল নদীর ওপারে। স্বর্ণবৃন্তা আটজন তরুণ সঙ্গীকে নিয়ে নাচের সজ্জায় এসে উপস্থিত হয়েছিল তার নাট্যমন্দিরে। করতালিতে তাল দিয়ে স্বর্ণবৃন্তা শুরু করেছিল নটা যূথবদ্ধ পলাতক হরিণের মতো তাদের নাচ।
মগধের দু চারজন সৈন্য আগুন লাগাবার পর সেদিন নগর থেকে বেরোবার পথ খুঁজছিল। নগরবধূর প্রমোদ উদ্যানের পাশ দিয়ে নদীর দিকে যাবার সময় একটি তরুণীর পিছনে আটটি তরুণকে আগুনের মালার ভিতর নাচতে দেখেছিল তারা। কাণ্ডটা বিশ্বাস হয়নি বলে দূরে দাঁড়িয়ে সৈন্যরা অপেক্ষা করেছিল কখন মানুষগুলো নাচে ক্ষান্তি দিয়ে পালায়।
কিন্তু নগরবধূর বাড়ি আগুনের পেটে চলে যাওয়ার পরেও নাচ বন্ধ হয়নি। প্রিয়ব্রত, গতাসূয়, বোধিদ্রুম, চন্দ্রহাস, শুদ্ধ, শ্বেতকেতু, অরণ্য, আর সলিল, স্বর্ণবৃন্তার এই আটটি প্রেমিক—এখন প্রেমিকই বলা উচিত তাদের—তারাও এতক্ষণে বুঝতে পেরে গিয়েছিল যে নগরবণিতার বস্ত্রে ছাঁকা আমের রস যাদের ঠোঁটে লেগেছে তাদের আগুন আর পোড়াতে পারে না।
আর এই রসে যারা ভিজেছিল, বৈশালীর আবাল-বৃদ্ধ-বণিতাদের মধ্যে যারা অন্ধকারে লুকিয়ে চুষেছিল নগরবধূর শরীরের আঠায় ভেজা চীনাংশুক, মগধের চমৎকৃত সৈন্যদের সামনে সেদিন তারা আগুনের সমুদ্র অক্লেশে অতিক্রম করে ছড়িয়ে গিয়েছিল চতুর্দিকে।
সারাদিন ধরে জ্বলবার পর যখন উদ্যানবাটিকার ধোঁয়া প্রশমিত হয়ে আসছিল তখন নগরবধূ আর তার আটটি প্রেমিক তাদের জ্বলন্ত দেহগুলো নিয়ে নেমে আসে উত্তরের অরণ্যে, যেখানে তখন দাবানলের মতো ফুটছে সেই যুদ্ধের অলৌকিক বহ্নিকমল। নাচতে নাচতে তারা ন’জন চলেছিল অরণ্য থেকে অরণ্যে। নগরবধূর তরুণ সঙ্গীরা হয়ত ভেবেছিল সাগরে গিয়ে থামবে এই দুরন্ত আগুনের নদী, অথবা কোনো প্রচণ্ড বর্ষার ঋতুতে ভিজতে ভিজতে নিভে যাবে একদিন। কিন্তু সেটা হয়নি। আগুনটা বৈশালী থেকে চলে যায় অঙ্গে, বিদেহে, মগধে। তারপর কাশী, আর পাঞ্চালে। উজ্জয়িনী পুড়িয়ে সেটা হানা দেয় গান্ধার আর কম্বোজ। সেখান থেকে আরো অনেক বিদেশ ঘুরে পরে বৈশালীতেও ফিরেছিল কয়েকবার। যেখানেই গিয়েছে সেই আগুন সেখানেই বৈশালীর নগরবধূও এসেছিল তার আটটি তরুণ সঙ্গীকে সঙ্গে নিয়ে। সেই দক্ষ নৃত্যশিল্পীদের পদশব্দ শুনে যারা জড়ো হত, বৃক্ষের আড়ালে তারা স্বর্ণবৃন্তার বৃন্তের স্বাদ কীরকম সেটা জানতে পারে।
আটজন তরুণ পরে বুঝেছিল যে তাদের একটা বিফল জন্ম স্রেফ নাচতে নাচতে কাটতে চলেছে। কেননা আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবার শরীরে দুটি স্বর্ণকলসের আমগন্ধী রস প্রবেশ না করা অবধি এই অন্তহীন যুদ্ধের আগুন মানুষকে পোড়াতে থাকবে।
আর স্বর্ণবৃন্তা নিজে? সে জানত ততদিন পর্যন্ত পৃথিবীর মঞ্চে জেগে থাকতে গেলে একটা মনের মতো নাচের দল তার চাইই। ভাগ্যিস এই করুণ ছেলেগুলো তার কাছে এসেছিল।
অনন্তকাল বাড়িঘর ছেড়ে শুধু আগুনের অরণ্যে নাচতে থাকার জন্য আটজন ব্যর্থ বোধিসত্ত্বের চেয়ে ভালো সঙ্গী আর কোথায় পেত বৈশালীর নগরবধূ?
গল্প শেষ। বাকি পথটাতে আমরা নিঃশব্দে রাস্তা দেখতে দেখতে হাঁটছিলাম। পম্পা বাড়িতে ঢোকার মুখে হাতজোড় করে বলল—দ্যাখ আমার ব্যর্থ বোধিসত্ত্ব, ফিরতে দেরি হয়ে গেছে। মা একটা সীন করবেই। তুই বলবি আমরা তাড়াতাড়ি বেরিয়েছিলাম কিন্তু বাস খারাপ হওয়ার জন্য লেট হয়ে গেছি।
— অফ কোর্স্। আর কিছু?
— মা জোর করবে তুই যেন খেয়ে যাস। জানি তোর মা আর মামিমা চিন্তা করে বসে থাকবে।
— আমার মামার মতে আমি রাত্রিবেলা রাস্তায় থাকলে তাতে বাড়ির লোকেদের নয়, রাস্তার লোকেদের ভয়। অবশ্য আমি প্রচণ্ড তাড়াতাড়ি খেয়েও নিতে পারি।
— জয়, তুই যে কী সুইট! আমি জানতাম তোর গল্পে বিরাট একটা আগুন না লাগিয়ে আজ তুই ছাড়বি না। তাও আমার খুব ভালো লেগেছে, এবং আমি চাই এটা প্রকাশ হোক। কিন্তু যেরকম ইয়ে টিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছিস, কোনো ম্যাগাজিন ছাপাতে সাহস করবে না। কী হবে তাহলে স্বর্ণবৃন্তার?
— ফিকর নট। পরে কমিয়ে বাড়িয়ে অন্য কিছু বানিয়ে দেব।
বাড়িতে ঢুকতেই মাসিমার কাছ থেকে এক ডজন প্রশ্ন ভেসে এল। পম্পা চেঁচিয়ে বলল—জয়কে খেতে দিয়ে দাও, যাতে ওর আর দেরি না হয়। আমি বাথরুম থেকে আসছি। এসে সব জবাব দেব।
আমি মাসিমার পিছু পিছু রান্নাঘরে ঢুকে বললাম—বাস খারাপ হয়ে গিয়েছিল। নইলে তাড়াতাড়িই ফিরতাম। আশা করি চিন্তা করেননি, কারণ আমরা তো একসঙ্গে ছিলাম সারাক্ষণ। তাছাড়া রাস্তায় কত লোক।
মাসিমা কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন—চণ্ডীগড়ে এরকম দেরি করলে কী হবে? সেখানে তো তুই থাকবি না।
— মাসিমা, আপনার মেয়ে কিছু বোকা হাঁদা নয়। ভেবেচিন্তেই কাজ করে।
— ওর কোনো দরকার হলে তোকে পাঠাতে পারব?
— প্রবুদ্ধকে ফোন করে খবর পাঠিয়ে দেবেন। সেদিনই পোঁছে যাব। আমার বন্ধু অক্কিকে বলে চণ্ডীগড়ে একটা ভালো পুলিশের কনট্যাক্ট খুঁজে দেব আপনাকে। দরকার পড়লে তাকে দিয়েও কাজ হবে।
— একটা ডাক্তারও...।
— অফ কোর্স্! প্রবুদ্ধর বাবা আছেন কী করতে? অসংখ্য ছাত্র ভূভারতে ছড়ানো। উকিল কটা লাগবে বলুন।
— উকিল দিয়ে কী হবে?
— না, মানে যদি কোনো পুলিশ কেসে জড়িয়ে পড়ে? পরের বছর যখন সিনিয়ার হয়ে র্যাগিং করবে তখন যদি কোনো ফ্রেশার ছাত্র বা ছাত্রী এফ-আই-আর লজ করে দেয়? এফ-আই-আর বোঝেন তো?
মাসিমা চোখ মুছতে মুছতে বললেন—জয়, যা তুই টেবিলে গিয়ে বোস। আমি খাবার নিয়ে যাচ্ছি।
টেবিলে বসতে না বসতেই নাচনেওয়ালী এসে জুটল। বাথরুম টাথরুম সব ধাপ্পা। মা’কে আমার হাতে ছেড়ে দিয়ে লুকিয়েছিল নিজের ঘরে। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল—সব ঠিক আছে? আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম।
একটু পরে স্নান টান করে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে ঘরে ঢুকলেন পম্পার বাবা। আমাকে দেখে চোখ নাচিয়ে বললেন—কোফ্তা খেয়েছিলে?
— সুভানাল্লা! দু-হাত বুকের সামনে ক্রস করে কানে আঙুল ঠেকিয়ে বললাম আমি।—এরকম কোফ্তা আগে কখনো খাইনি। মূলোর বদলে কাঁচকলা কেন আমাদের ন্যাশানাল সব্জি নয় জানি না।
পম্পা বলল—বাজে বকিস না, জয়। মূলো একটা জঘন্য খাবার। বাঙালিদের মধ্যে তোরা ছাড়া আর কেউ খায় না।
আমাদের বাড়িতে ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি মূলো ভারতের ন্যাশানাল ভেজিটেব্ল্। আর গাজর হল পাকিস্তানের। সেজন্য মূলোর পরোটা আর গাজরের হালুয়া একদিনে খেলে পেট থেকে তোপের গর্জন...। মামার কাছ থেকে পাওয়া শাস্ত্রজ্ঞানটা ভালোমানুষের মতো যেই জানাতে গেলাম, নাচনেওয়ালী আমার মুখ ম্যানহোলের ঢাকনার মতো একটা হাত দিয়ে বন্ধ করে দিল।
পম্পার বাবা বললেন—একটু হিং, একটু লবঙ্গ দিতে হয়। আদা দিলে সব মাটি। কী প্রোগ্রাম করতে যায় বলো তো ও?
পম্পা মোটা গলা করে বলল—বাবা আমি নিজেই বসে আছি এখানে। আমাকে জিজ্ঞেস করলেই তো জানতে পারবে সেটা। নাচের অডিশান ছিল আজ। জয় দেখতে চেয়েছিল বলে যাওয়া। নইলে যেতাম না।
বাড়িতে বানানো মোগলাই পরোটা চলে এল। আমি গোগ্রাসে গিলছি। পম্পার বাবা আমার খাওয়ার স্পীড দেখে একটু বিস্মিত হয়ে গিয়ে বললেন—দুপুরে ছেলেটা খেয়েছিল সত্যি?
পম্পা বলল—রাক্ষসের মতো।
পম্পার বাবা আমাকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বললেন—মনে হচ্ছে তোমার মামাকে আমি একবার দুর্গাপূজোর বিসর্জনে দেখে থাকতে পারি। আট দশ বছর আগের কথা। তুমি কি ঘাটের ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিলে?
ঘটনাটা একশো শতাংশ সত্যি। কে জানত পম্পার বাবা আমার জীবনের একটা পুরোনো নাটকের সাক্ষী। বললাম—দলছুট হয়ে অন্য গ্রুপের সঙ্গে চলে গিয়েছিলাম আর কি।
পম্পার বাবা ভাবতে ভাবতে বললেন—তোমার মামাকে সবাই বলছিল মাইকে একটা অ্যানাউন্সমেন্ট করিয়ে দেওয়ার জন্য। উনি উড়িয়ে দিয়ে বললেন—কোনো ভয় নেই। চাইলেও খোয়া যায় না এরা। শিমলিপুরে ছেলেধরারা ছেলে ফেরত দিয়ে যায়।
পম্পা আর আমি দুজনেই থ।
পম্পা তার বাবার উপর রাগ করে বলল—তুমি জোর করে একটা অ্যানাউন্সমেন্ট করাতে পারলে না? বাচ্চা ছেলে! ঘাটে লরিগুলো প্রতিমা নিয়ে যেখান সেখান দিয়ে যায়। বেচারা গাড়ি চাপা পড়তে পারত। তোমার নিজের মেয়ে হলে চলে আসতে?
পম্পার বাবা আমাদের দিকে একজন গবেষকের মতো দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন। যেন আমরা দুটো চিড়িয়াখানা থেকে পালানো কচ্ছপের ছানা আর উনি সামুদ্রিক প্রাণীবিদ্।—করিয়েছিলাম কয়েকবার। পরে বললেন উনি।—নামটা জানতাম না তো। মাইকে বলা হয়েছিল শিমলিপুরের ছেলে বা মেয়ে কেউ হারিয়ে থাকলে যেন ঘোষণা কেন্দ্রে চলে আসে। তারপর আমরা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছি, কিন্তু কেউ আসেনি।
আমি বললাম—সিরিয়াস কিছু হয়নি। খানিকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে আমি দলকে পেয়ে যাই।
আসলে সেটা হয়নি। এতদিন পরে বুঝছিলাম কেন ন-বছর আগে দশমীর দিন এক ঘন্টা ধরে হন্যে হয়ে নিজেদের দলটাকে খুঁজে না পেয়ে যমুনার ঘাট থেকে বাড়ি অবধি আট কিলোমিটার পথ স্কুল বাসের রুট ধরে হেঁটে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম। এতদিন ভাবতাম আমি যে হারিয়েছি সেটা কেউ ধরতে পারেনি। আজ আবিষ্কার করলাম সেটা জেনেও আমাকে শিমলিপুরের তরফ থেকে খোঁজার কোনো চেষ্টা হয়নি।
এখন যা ঘটছে, সবই আগের ঘটনার জের। কিছু কিছু নাটক শুরু হয়েছিল আমার জন্মেরও আগে। আসলে এই পৃথিবীটা অতীতের কোনো জগতের প্রতিধ্বনি। আজও আমার সামনে আট কিলোমিটার পথ। ডাইরেক্ট বাস নেই। হয়তো হেঁটে যেতে হবে।
পম্পা আমার মুখ দেখে কী বুঝল জানি না, সে আমার মাথায় একটা সান্ত্বনার হাত রেখে বলল—দুঃখ পাস না জয়। সত্যি যদি হারিয়ে যেতিস তাহলেও কেউ না কেউ ঠিক তোকে খুঁজে বার করত। বাবাই হয়তো নিয়ে আসত বাড়িতে। আমাদের তখন বক্সার বলে একটা সুন্দর কুকুর ছিল। তোর মতো সুইট। তোকে দেখলে খুব খুশী হত সে। তাই না বাবা?
মনে করার চেষ্টা করছি। আমি কি সেদিন ঘাট থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিলাম? বা অত কোলাহলের মধ্যে মাইকের আওয়াজ শুনেও বুঝতে পারিনি?
পম্পার বাবা বললেন—বোকা বক্সার? বলা মুশকিল। কারো বাড়ির কুকুরই ছিল এককালে, কিন্তু কীভাবে কে জানে হারিয়ে গিয়ে রাস্তার নেড়ি হয়ে যায়। সেইজন্য পরে কোনোদিন মানুষকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারেনি। অবশ্য আমাদের কাছে আসার পর ছিল তোফা। টেবিলে বসে সবার সঙ্গে চা খেত।
তারপর পার্কটাউনের বাবা আর মেয়ে প্রসন্নবদনে আমার মোগলাই পরোটা খাওয়া দেখবে বলে তাকিয়ে রইল।