--আচ্ছা - চিল কি সত্যিই এত বন্ধু হয় মানুষের?
--তরুণবাবু একটু চমকে বললেন - গম্ভীরভাবে
--কেন?
--না মানে 'একুশ শতক' পত্রিকায় আপনার 'হাই চিল' লেখাটা পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। খুব উদাসীনভাবে বললেন আপনি পড়েছেন লেখাটা? আমি বললাম হ্যাঁ। আরও এরকম লেখা পড়তে চাই। আমি আমাদের সম্পাদিত ক্ষীণকায় জেলার জেরক্স অফসেটে ছাপা পত্রিকা দিলাম। দেখে রেখে দিলেন। জিজ্ঞেস করলেন উৎপলদা কেমন আছেন?
'ভালো আছেন' বলে বেরিয়ে এলাম। এক অদ্ভুত বিস্ময়ে স্টুডিওর চারিদিক ঘুরে ফিরে দেখছি। কিছুটা এগিয়ে টেকনিসিয়ান স্টুডিও। কয়েক বছর আগেই মুক্তি পেয়েছে তরুণ বাবুর জনপ্রিয় সিনেমা আলো। এই ছবিটি বড় পর্দায় আমার দেখা তরুণবাবুর প্রথম ছবি। এর বাইরে বড়পর্দায় আর কিছু দেখার সুযোগ হয়নি। কিছু ছবি - দাদার কীর্তি, গণদেবতা দেখেছি দূরদর্শনে। যদিও এই সব ছবির ঘরানা আমার সিনেমা দেখার অভ্যাস থেকে একেবারে আলাদা।
আবার কয়েক বছর পর উৎপলদা বললেন - তিমির তরুণবাবুকে একটা বই পৌঁছে দিতে হবে। দুর্গেশনন্দিনীর চিত্রনাট্যের কাজে বইটি প্রয়োজন। তুমি কলকাতা কবে যাবে? ফোন করে বললাম উৎপলদা বই পাঠিয়েছেন। কীভাবে বইটি দেব? খুব মৃদু আর শান্তস্বরে বললেন চলচ্চিত্র শতবর্ষ ভবনে চলে আসুন। তখন তিনি চলচ্চিত্র শতবর্ষ ভবনে একটি ঘরে বসতেন। আমি আর ঝিলদা গেলাম। দেখলাম দু 'তালার একটি ঘরে বসে একা একা লিখছেন। স্পাইরালে বাঁধানো খাতায় দুর্গেশনন্দিনীর স্ক্রিপ্ট। কালোকালিতে সুদৃশ্য হাতে লেখা। বাঁ দিকে অনেকটা মার্জিন। পরে হয়তো নোট লিখবেন বা পরিবর্তন করার জন্য এই বিস্তীর্ণ পরিসর ছেড়ে রাখা হয়েছে। লিখতে লিখতে হাত দেখিয়ে বসতে বললেন। কিছুক্ষণ বসে বই দিয়ে চলে এলাম।
প্রায় এক দশক পর, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ইউনিট থেকে কাজ চলে যাওয়ার পর কলেজ স্ট্রিটের দে'জ পাবলিশিং-এর প্রকাশনা দপ্তরে কাজ পেলাম। তখন অপুদা বলল তরুণবাবুর একটা বই করছি। বললাম একুশ শতকে পড়া লেখাটির কথা। কী সুন্দর নাটকীয় এবং নিখাদ আবেগমাখা লেখনী। আবার সুযোগ এল তরুণবাবুর সঙ্গে সাক্ষাতের। এর মধ্যে রাজ্য রাজনীতির আকাশ বদলে গেছে। চির বামপন্থী তরুণবাবু কিন্ত তাঁর ছবি এবং আদর্শের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে এক সুতোও সরে যাননি। তাঁর এই দৃঢ়চেতা মনোভাব শহুরে তথাকথিত বুদ্ধিজীবী মানুষের কাছে একটি শিক্ষনীয় বিষয়।
২০১৭ সালে 'বাতিল চিত্রনাট্য' প্রকাশ পেল। তরুণবাবুর ৮৩ বছর বয়সে প্রথম বই প্রকাশ পেল। পরের বছর বেরোলো আবার একটি বই 'নকশিকাঁথা'।
তখন উনি গণশক্তি দৈনিকের লাইব্রেরিতে বসেন। মাঝে মাঝে প্রুফ দিতে বা নতুন লেখা আনতে যাই। একদিন অপুদা বলল - তিমির তরুণবাবুর স্মৃতিকথা লেখা শেষ। আগামীকাল কপি দেবেন। পরের দিন অফিসে গিয়ে দেখলাম 'সিনেমাপাড়া দিয়ে' এক সুবিশাল পাণ্ডুলিপি। A4 ৭০ জি এস এম কাগজে হাতে লেখা ১০০ পাতা করে কয়েকটি ইনস্টলমেন্ট। শুরু হল কম্পোজ। ৮৭ বছর বয়সে 'সিনেমাপাড়া দিয়ে' র পাণ্ডলিপি এল। অপুদা আর আমি যেতাম গণশক্তির অফিসে। প্রচ্ছদ কেমন হবে। ইলাস্ট্রেশন কেমন হবে। এসব উনি কত নিবিড়ভাবে বলতেন প্রকাশক অপুদাকে। দেখেছি, কত বিশদে অলংকরণ ও প্রচ্ছদ শিল্পী রঞ্জনদার সঙ্গে চলত দীর্ঘ আলোচনা। আস্তে আস্তে এক সত্যিকারের 'সিনেমাপাড়া দিয়ে' নির্মাণ হল বইপাড়ায়। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকদের মন জয় করে নিলেন।
অনেকদিন পর আবার দেখতে পেলাম, ১লা বৈশাখের সকালে সিনেমা পাড়া দিয়ে বেরিয়ে দৃঢ়চেতা তরুণবাবু সাদা ধুতি সাদা পাঞ্জাবি পরে ২৪ পার সেকেন্ড ফিল্মস্প্রিডে হেঁটে যাচ্ছেন বইপাড়া দিয়ে ...